10 Dec 2015

ভার

ভার
***

বৃষ্টির বাবা মারা যান ১৯৭১ সালে। সেই রাতের ছবিটা এখনও তার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। সেদিন শরীর টা সকাল থেকেই খারাপ ছিল। ডাক্তারবাবু মোটামুটি ওকে বলেই গেছিলেন, "আর টানাহ্যাচড়া করে লাভ নেই, শেষ সময়টা শান্তিতে পরিবারের সাথে থাকাই কাম্য।" একমাস আগেই হাসপাতাল থেকে এই কথা বলেই ছুটি দিয়েছিল। তবু একটা মাস বাবার যত্ন করেতে তো পেরেছে বৃষ্টি।
--
মা তো তার কবেই চলে গেছেন। বাবা দুজনের স্নেহ দিয়ে তাকে বড় করেছেন। দাদা দিদিদের থেকে বয়সে সে অনেকটা ছোট। তাদের স্নেহও যথেষ্ট পেয়েছে। বাবা সবাই কেই খুবই স্নেহ/ভালবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন। প্রচুর পরিশ্রম করতেন। নামী এডভোকেট ছিলেন। আয় যথেষ্ট ছিল। কার কোন অভাব হতে দেননি সাধ্যমত। দাদা দিদিরা সবাই কৃতি ছাত্র/ছাত্রী ছিলেন। এখন সবাই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত, ভাল আয়।
--
একমাত্র বৃষ্টি এখন ইউনিভার্সিটির ছাত্রী,পড়াশুনায় ভাল। বাবা তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে না যেতে পারার দুশ্চিন্তায় ভুগতেন, তাঁর হাতে যে বেশী সময় নেই বুঝতে পেরেছিলেন। বৃষ্টির ঠাকুরদাদাও নামী এডভোকেট ছিলেন, বাবা তাঁর একমাত্র সন্তান। লেকের কাছে এক বিশাল বাড়ী করেছিলেন, নাতি/নাতিনীদের কথা ভেবে। বলা যায় বৃষ্টিরা যথেষ্ট স্বচ্ছল পারিবার।
--
বাবা বাড়ী আসার পর থেকে বৃষ্টি একাই আয়া মাসীদের সাহায্যে তাঁকে দেখাশুনা করত। নিজেই বাবাকে খাবার বা ওষুধ খাওয়াত, স্নান থেকে শুরু করে সব কিছু তার তত্বাবধানে হত। ইউনিভার্সিটি যাওয়া হত না। বাবা রাগ করতেন,"তুই আজও বাড়ী বসে আমার সেবা করবি,পড়াশুনা কি ছেড়ে দিলি? তোকেও কিন্তু ভাল রেজাল্ট করতে হবে।" " কদিন বাবার সেবা করলেই যদি রেজাল্ট ভাল না হয়, তবে সে পড়াশুনার দরকার কি?"
--
কিন্তু এই সময় টা ছেলেমেয়েদের একটু সান্নিধ্য মনে মনে আশা করতেন, যদিও মুখে কখনও প্রকাশ করেননি। তাঁর চার ছেলে /বৌ, বাকি দুই মেয়ে/জামাই, নাতি/নাতনি একই বাড়ীতে উপর তলায় থাকে। ইচ্ছে করলে পালা করে একটু সময় তাঁর সাথে অনায়াসে কাটাতে পারত। বৃষ্টি ই তাঁর অগতির গতি, দেখভাল ছাড়াও বাবাকে কাগজ/বই পড়ে শোনাত, গল্প করত। তিনি ঘুমালে তাঁর ঘরে বসেই নিজের পড়াশুনা করত।
--
সেদিন বিকাল গড়িয়ে গেলে বাবা মারা গেলেন। ডাক্তারবাবু ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে দিলেন। দিদি দাদারা একেবারে তাদের পরিবার সমেত এক তলায় বাবার ঘরে হাজির। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এদিকে সারা অঞ্চল পুলিশ/মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে। সমস্ত পাড়ায় চিরুনী তল্লাশী শুরু হল, ধরপাকড় চলল প্রায় রাত ১২/১ পর্য্যন্ত। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল।
--     
বৃষ্টি দের বাড়ীতে তখন অদ্ভূত এক পরিবেশ। বাবার মৃত দেহের সামনে ঘন্টাখানেক একটু কাঁদার পরই দাদা, দিদি, বৌদি, জামাইবাবুরা সবামিলে তন্ন তন্ন করে বাবার আলমারির চাবি খুঁজতে শুরু করল। উইল, কাগজ পত্র, মায়ের গয়না আর টাকাকড়ি  সব সেখানেই থাকত কিনা। এদিকে মৃতদেহের সামনে বৃষ্টি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। একটু ইতস্তত করে বড়দা তাকে বলল,"কাঁদিস না বোন, বাবার সময় হয়েছে চলে গেছেন। আমরাই তোর দেখভাল করব। বাবার চাবিটা কোথায় বলত।"
--
বৃষ্টি অবাক চোখে তাকায়,"বাবার চাবি ! এখন কি করবে চাবি দিয়ে!" "না মানে বাবার উইল, মায়ের গয়না, কাগজপত্র সব বার করতে হবেত", দাদার উত্তর। "কিন্তু এখন সেগুলি বার করতে হবে কেন!"- বৃষ্টির বিস্ময় কাটে না। মেজদি বলে,"বাঃ! বাবা কি রেখে গেছেন, কাকে কি দিয়ে গেছেন, দেখতে হবেনা " বৃষ্টি বলে,"এখনি দেখতে হবেই বা কেন!" বড়দি আমতা আমতা করে বলে,"আসলে সে সব ঠিক মত সবার মধ্যে ভাগ করতে হবেত।" " কিন্তু বড়দি,সেটা ত পালিয়ে যাবেনা। বাবার মৃতদেহ এখনও বাড়ীতে। দাহ হয়নি, আর এখনই  ভাগ বাটোয়ারা করতে হবে। দু /এক দিন পরে করা যাবেনা! আশ্চর্য্য! লোকে শুনলে কি বলবে!"
--
এবার হাল ধরলেন মেজদা,"বেশী পাকামী করো না! কোন লোক আছে এখানে, আমাদেরের একান্ত নিজেদের জন ছাড়া। আর এই গণ্ডগোলের মধ্যে মৃতদেহ নিয়ে তো বেরনো যাবে না, তাহলে আসল কাজ সেরে ফেলতে বাধা কোথায়।" এরপর কথা বাড়াতে বৃষ্টির প্রবৃত্তি হল না,"দ্যাখো, বাবার বিছানার গদির নীচে আছে!" "না না, বাকী বিছানা তো আমরা দেখেছি। বাকি শুধু....,বৌদির অসমাপ্ত কথা টা বৃষ্টি বুঝল, নীরবে বাবার বালিশের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে গোটা দশেক হাত ঝাঁপিয়ে পড়ল।
--
ভোর রাতে, বাবাকে দাহ করে ফিরে এসে বৃষ্টি অবসন্নের মত তাঁর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বেলা আটটায় ঘুম ভাঙলে, চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন দক্ষ যজ্ঞ হয়ে গেছে সে ঘরে। উঠে চোখ মুখে জল দিয়ে ভাল করে ঘরটা গুছাল, পরিষ্কার করল।বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, টেবিলের ঢাকনা সব বদলালো। বাবার আরাম কেদারার কাছে তাঁর হাতে পোতা একটা ফুলের টব রাখল। অনেক ফুল দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে, দেয়ালে টাঙানো বাবা আর মার বড় ছবি দুটিতে  মালা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে দিল।
--
স্নান সেরে, জামা কাপড় বদলে, বাবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। 'এঘরে এখন আর কারো দরকার পড়বে না। সবার প্রয়োজন তো কাল রাতেই মিটে গেছে' - একথা ভাবতে ভাবতে প্রিয় বান্ধবীর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেটা তাদের বাড়ী থেকে বেশ কিছু টা দূরে। যেতে যেতে মনে হল সারা পাড়ায় যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। দোকান পাট বন্ধ, লোকজন খুব কম। যারা বাইরে বেরিয়েছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন অদৃশ্য দুঃখের ঝড়ে ভেঙে পড়ছে, মুখ গভীর শোকে বিহ্বল। বাচ্চারাও যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। বৃষ্টির মনে হল কোন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে আছন্ন সমস্ত এলাকা। 
--
বান্ধবীর বাড়ীর গিয়ে দেখে তারাও শোকে মুহ্যমান। "বৃষ্টি, শুনেছি তোর বাবা কাল মারা গেছেন, কালই যাব ভাবেছিলাম। কিন্তু পাড়ায় যে অবস্থা যেতে পারিনি, কিছু মনে করিস নিত। আজ যেতাম, তা তুই এত সকালে বাড়ী  থেকে বেরিয়েছিস?" "সে অনেক কথা পরে বলব, এখন মন ভাল লাগছেনা।" "আমাদেরও আজ খুব মন খারাপ। শুধু আমাদের কেন সারা পাড়ায়, না সারা বেলেঘাটাতেই আজ শোকের দিন।" "হ্যা, এতটা রাস্তা আসলাম, মনে হচ্ছিল কি একটা মারত্মক কিছু ঘটেছে। তোদের বাড়ীরও সবাই শোকগ্রস্ত বোঝাই যাচ্ছে। কি হয়েছে রে?"বৃষ্টি জানতে চায়।    
--
"জানিস  কাল পাড়ার চারটে অল্প বয়সী ছেলেকে গুলি করে মেরে লেকের ধারে ফেলে দিয়ে গেছে।" বৃষ্টি জিজ্ঞাসা করে, "সেকি, কেন !" "ওরা যে এই সমাজ ব্যবস্থা কে পাল্টাতে চেয়েছিল।" "মানে?" "মানে,ওরা নতুন মানুষ হতে চেয়েছিল। নতুন একটা সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।" তারপর দুই বন্ধু চুপচাপ। মুখে কারও কোন কথা নেই, কিন্তু মনের মধ্যে যেন উথল পাতাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
--
বৃষ্টি বিরাট এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে," আচ্ছা আমাদের বাবা যে ছেলেমেয়েদের কে প্রাণপাত করে মানুষ করেছেন , তাঁর মৃত্যু তাদের মধ্যে কোন দাগ ই রেখ গেল না। অথচ এই ছেলেগুলির জন্যে সমস্ত এলাকা শোকস্তব্ধ। তাদের মৃত্যু অনাত্মীয় মানুষের বুকে কি বিশাল ভার চাপিয়ে দিয়েছে, কেন !" উত্তর এল," ওরা যে সূর্য্য ধরতে চেয়েছিল।"
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



















      






















































  

8 Dec 2015

সেবা


সেবা
****

শিল্পী হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। ঘরে ঢুকলেন এক ভদ্রমহিলা, "দিদি, আমি তোমার দিনের আয়া মাসী, আমার নাম বীণা ঠাকুর।" অবাক চোখে দেখে শিল্পী, কি অদ্ভুত মায়া জড়ানো একটা মুখ, পরিষ্কার পাটভাঙা সাদা  লালপাড়ে ছাপা শাড়ি। চেহারায় একটা নির্ভরতার আশ্বাস। আমতা আমতা করে বলে, "তা আপনি বসুন।" "এইতো, প্রথমেই পর করে দিলে, তুমি বল, নাহলে ক্যামন যেন বাইরের লোক মনে হয়," বলেন বীণামাসী।
--
সেটা ছিল আশির দশক। শিল্পী সন্তান সম্ভবা, জন্ডিজ হবার ফলে একমাস আগেই ডাক্তারবাবুরা ভর্তি করে নিয়েছেন, যদিও সেই হাসপাতালের প্যাথলজী ডিপার্টমেন্ট এর রিপোর্ট এ জন্ডিস ধরা পড়েনি। কিন্তু গাইনোকলজির ডাক্তাররা সিমটমগুলি শুনে  তাকে ভর্তি করে নিয়েছিল। তখন তাঁদের সিনিয়র অনুপস্থিত ছিলেন। জুনিয়ার ডাক্তারা নিজেরাই রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসে। তাতে জন্ডিস পাওয়া যায়, অবস্থা খুব সিরিয়াস ছিল, মরণ / বাচন সমস্যা এবং এমার্জেন্সি কেস।  
--
শিল্পী, স্বামী সরকারি অফিসার হবার সূত্রে কেবিন এ ছিল। বই পড়া, মাঝে মধ্যে বারান্দায় হাঁটা আর জানালা দিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। তাই বীনা মাসী তাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দিতেন, শুধু বাড়ীর লোকের আসার সময় টুকু বাদ দিয়ে। বীনামাসী সংসারে মূল উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন। তিনটি সন্তান আর রুগ্ন স্বামীকে নিয়ে তাঁর সংসার, বনগাঁয়ে বাড়ী।
--
রাত ভরে উঠে ঘর সংসারের কাজ আর রান্না করে সকাল আটার মধ্যে কেবিনে হাজির হয়ে যেতেন। কোনদিন ডিউটি তে কোন রকম অবহেলা, বিরক্তি বা ঘেন্না তাঁর ছিল না। মায়ের স্নেহ দিয়ে রুগীকে যেন আগলে রাখতেন। অন্য কোন আয়ামাসী রুগীদের প্রতি কোন বিরক্তি দেখলে ই সজোরে প্রতিবাদ করতেন,"রাগ করলেতো চলবে না, এ হল সেবার কাজ, রুগীকে সন্তানের মত দেখতে হবে, যত্ন নিতে হবে। তা না পারলে এ লাইনে আসা কেন বাপু।"
--
শিল্পী এবং সাধারন ওয়ার্ড এ ছিলেন এমন আর  একজন রুগীকে নিয়েও  হাউসস্টাফরা খুব চিন্তিত ছিলেন। তাঁর ও একই অবস্থা। অসীম যত্ন নিয়ে এই জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা সব রুগীদের দেখতেন, বিশেষত জন্ডিসে আক্রান্ত হবু মায়েদের প্রতি ছিল সতর্ক নজর, রোজ তাঁদের পথ্য থেকে শুরু করে সব খবর নিতেন।
 --
একদিন সিস্টাররা ওয়ার্ডের রুগীর ব্যাপারে নালিশ করেন। আগের দিন নাকি তাঁর স্বামী তাঁরই আবদার রাখতে লুকিয়ে কাটলেট এনে খাওয়াছিলেন, আধখাওয়া কাটলেট টি দেখালেন। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারবাবুরা বকলেন,"আপনি আপনার নিজের ভাল বোঝেন না। কোথায় আমরা আপনাদের সুস্থ করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, আপনি নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছেন। এমনি করলে আপনার বাড়ীর লোক আসা বন্ধ করে দেব।"
--
কদিন পর রাতের মাসীর কাছে শিল্পী জানতে পারল, ওই রোগিনী মারা গেছেন। পরদিন সকালে বীনামাসীকে খবরটা দিল। শুনেই মাসী রেগে টং, "কে বলল তোমাকে ? রাতের মাসী বুঝি ! সত্যি এদের কোন আক্কেল নেই ! গল্প করার বিষয় পায় না। দিদি, তুমি এসব আবোল তাবোল কথা একদম শুনবে না কিন্তু।" শিল্পী আর কথা বাড়ায় না।
--
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল, তার প্রসবের দিন এসে গেল। সকাল থেকে ব্যথা শুরু হল অল্প অল্প। যে সিনিয়ার ডাক্তারের অধীনে শিল্পী ভর্তি ছিল রাউন্ডে এসে, জুনিয়র ডাক্তারদের বলে গেলেন, বেরোবার মুখটা পরিষ্কার করে দিও।"
ক্রমে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যে একজন স্যারের  নির্দেশ মত কাজ করে, তাকে সাহস জুগিয়ে গেল,"একদম চিন্তা করবেন না, আমাদের আজ নাইট শিফট না থাকলেও অসুবিধা কিছু হবেনা। যাদের ডিউটি আছে, তারাই দেখাশুনা করবে।"  
--
রোজ বীনা মাসীকে শিল্পী আগেই ছেড়ে দিত, অনেক দুর তাঁকে যেতে হয় বলে। কিন্তু বার বার বলা সত্বেও সেদিন তিনি রাজী হলেন না। রাতের মাসী যথারীতি দেরী করে এলেন। বীণা মাসীর যেতে রাত হয়ে গেল। যাবার সময় রাতের মাসীকে বললেন,"আমি ট্রলি আনতে বলে যাচ্ছি। দিদিকে একদম ছাড়বেনা, সব সময় সঙ্গে থাকবে। অন্য কোথাও গল্পে জমে যেওনা।"
 --
বীণামাসী যাবার পরই খুব জোর প্রসব বেদনা শুরু হল। নীচে বীণা মাসী, আর অপেক্ষা রত শিল্পীর স্বামী আর বাবা দৌড়া দৌড়ি করে ট্রলির ব্যবস্থা করলেন। লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। সেখানে সারি সারি বেডে প্রায় জনা দশেক প্রসূতি অপেক্ষায় রয়েছে। শিল্পীর সারা রাত যন্ত্রণা হতে থাকল, ব্যথা ওঠে আবার পড়ে যায়। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে মনে হতে থাকে,পাশে দাঁড়ান মাসীর কাছে কয়েক বার জল চায়। মাসী মাঝে মধ্যেই ঘন্টা ভর ডুব দ্যায়। তখন একটু জল দেবার ও লোক মেলে না। এই চলে সারা রাত।
--
 ভোর হয়ে আসে, দ্বিতীয় লেবার রুমে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। দরজার কাছেই সে বেড পেল। জল ভাঙতে শুরু হয়ে যায়। শুরু হল নবাগত নার্স দের হাত পাকানোর পরীক্ষা। একটি ট্রেইনি নার্স সাহস করে এগোয় পরীক্ষার নামে হাত পাকাতে। শিল্পী চোখ পাকিয়ে এক ধমক লাগায়,"একদম হাত দেবে না।"মেয়েটি পালিয়ে বাঁচে। ইতিমধ্যে বীণা মাসী এসে গেছেন, সব দেখছিলেন। এবার কাছে এসে বললেন, "ঠিক করেছ দিদি, ওদের ওপর তো আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই।"        
--
সকাল বেলায় সেই সিনিয়র ডাক্তার, হাউস স্টাফদের নিয়ে উপস্থিত হলেন। সারা ঘর ঘুরপাক দিয়ে তিনি যেই দরজা দিয়ে বার হতে যাবেন, শিল্পী খপ তাঁর হাত টা চেপে ধরে,"আপনি আমাকে না দেখে যেতে পারবেন না।" "না, না, দেখছি, দেখছি।" জুনিয়ররা বার বারই তার দিকে দেখছিলেন, কিন্তু স্যার কে কিছু বলতে পারছিলনা। এবার তাঁরা নীরবে উত্সাহিত করার ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালেন। বড় ডাক্তার দেখেই বললেন,"তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটার নিয়ে যাও, অজ্ঞান করে ডিপ ফর্সেভ দিয়ে বাচ্চা বার কর। সাবধান গলায় কর্ড জড়িয়ে আছে।"
--
তাঁর ইমিডিয়েট সিনিয়র ডাক্তারের নেতৃত্বে জুনিয়র ডাক্তারদের টিম শিল্পীকে এটেন্ড করতে শুরু করলেন। জ্ঞান ফিরতে তার কানে এল, একজন জুনিয়র ডাক্তার বলছেন,"শুনুন, আপনার বাচ্চা হয়ে গেছে।" সারাদিন লেবার রুমের একটা বেডে অঘোরে ঘুমাল সে। বিকালে ঘুম ভাঙতে, যিনি অপারেশন করেছিলেন এসে পরীক্ষা করে, কেবিনে ফিরিয়ে দিতে নির্দ্দেশ দিলেন।
--
ট্রলি করে কেবিনে ফিরে শিল্পী, দেখল মা, বাবা আর স্বামী বসে আছে। মা উদ্বিঘ্ন গলায় প্রথমেই বীণামাসী কে জিজ্ঞাসা করলেন,"বীণা বাচ্চা কেমন আছে?" "এখন ভাল আছে মাসীমা, মস্ত ফাঁড়া কাটিয়ে মা - ব্যাটা বেঁচে ফিরেছে। দিদি ভাগ্যিস বড় ডাক্তার বাবুর হাত চেপে ধরেছিল। বাচ্চার গলায় নাড়ী জড়িয়ে বার হতে পারছিল না। তবে হ্যা মাসীমা,  হাউসস্টাফ রা আপ্রাণ করেছে। বাচ্চা অনেক্ষণ কাঁদেনি, ওদের চেষ্টার ফলে শেষ পর্যন্ত কেঁদে উঠেছে, প্রাণে বেঁচেছে।" আরও চার দিন বীণামাসীর যত্নে থেকে বাচ্চা নিয়ে বাড়ী ফেরে শিল্পী। 
--
এরপর কত বছর অতিক্রান্ত, আজও তার মনে বীণা মাসীর ছবি অম্লান। সেই জুনিয়র ডাক্তারদের নাম আজও তার মনে আছে, গঙ্গা, অমিতাভ, অভয়। তাঁরা সকলে ডাক্তার নরম্যান বেথুনের উত্তরসূরী।
 _________________________________________________________________________________________








    

7 Dec 2015

বাঁশী কেন কাঁদে

বাঁশী কেন কাঁদে
**********

নতুন পাড়ায় আসার পর দ্যূতি রোজ রাতে লিখতে বসলে, অদূরে কোথা থেকে বাঁশীর অপূর্ব একটা মন উদাস করা মেঠো মিষ্টি সুর শুনতে পায়। শুনতে শুনতে লেখে। খুব সুন্দর লাগে। যেন একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। লেখা কেন শুধু,  রাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই কান খাঁড়া হয়ে থাকে বাঁশীর সুরের জন্য। কে বাজায় জানতে খুব মন চায়। শিল্পীকে একবারের জন্য দেখতে ইচ্ছা হয়।
--
আসেপাশের লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে। শেষে পাড়ায় বিশুকে জিজ্ঞাস করে,"বিশু, বলতে পারো রোজ রাতে এত সুন্দর বাঁশী কে বাজায় ?"  "কাকিমা ওত আপনাদের কলমিস্ত্রি নিশীথ।" দ্যুতির মনে পড়ে , প্রথম দিন তাদের বাড়ী এসেই, নিশীথ বলেছিল, "বৌদি, আপনাগো ঘরেতো বই ই বই। আমি এক আধটু পড়থে পারি। সময় কইরা লইয়া যামু কিন্তু, পড়নের লাইগ্যা।" "বাঃ এতো খুব ভাল কথা, নিও। তুমিতো খুব সুন্দর বাঁশী বাজাও!" "তা হুন্দর হয় কিনা কইতে পারিনা, বাজাইতে ভালবাসি। সবই তো দ্যাশে ছাইরা আসছি। হুধু বউ, বাঁশী আর বাজান ডা সাথে নিয়া আসছি। এখানে আইসা একডা মাইয়া হইসে। এই আমার রাজার ধন, এডুকু লইয়া য্যান থাইকতে পারি"-- বলে দিল খোলা এক হাসি হেসেছিল।
--
ওপার বাংলার নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান নিশীথ। বাংলা দেশ থেকে রোজগারের চেষ্টায় প্রায় এক কাপড়ে বউ কে নিয়ে  চলে এসেছিল কলকাতায়। অনেকের মতই কিছু কাল রেলস্টেশনে কাটিয়ে, খালপাড়ে একটা আস্তানা জুটেছে। যখন যে কাজ জুটেছে তাই করেছে। ক্রমে কলের কাজ শিখে নিয়ে কলমিস্ত্রির কাজ করছে।  
--
তাও বোধহয় কপালে সইল না। একদিন বাঁশী থেমে গেল। দিন যায়, বাঁশীর সুর আর রাতের হওয়াতে ভেসে আসেনা। দ্যূতি শেষে থাকতে না পেরে আবার বিশুকে জিজ্ঞাসা করে, "নিশিথের খবর জান ? কেমন আছে? ও আর বাজায় নাতো। "
--
"বৌদি, আপনি শোনেননি, নিশীথের মেয়েটা কোথায় চলে গেছে, মানে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।" "সেকি, দ্যূতি আর কিছু বলতে পারে না, ভাবতে ভাবতে বাড়ী ফিরে আসে। রোজই বিশুর কাছে খবর নেয়। নিশীথরা পাগলের মত মেয়েকে খুঁজছে, সাত সকালে বার হয় আর রাতে ফেরে। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার কোন খবর নেই।
--

শেষে একদিন নিশীথের মেয়ে ফিরে এল, কিন্তু লাশ হয়ে, খালের জলে কচুরিপানার সাথে ভেসে। বিশুর কাছে ই প্রথম শুনল, তারপর অবশ্য খবরের কাগজেও দেখল,"ছয় /সাত বছরের শিশুকে গ্যাং রেপ, তারপর শ্বাস রোধ করে হত্যা করে খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 --
দেখতে দেখতে দু / তিন মাস কেটে গেল, নিশীথ কাজে মন দিতে পারে না, খায় না, ঘুমায় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বউ স্বামীর অবস্থা দেখে নিজের দুঃখ চেপে, কান্না গিলে, তাকে সান্তনা দেয়,খাওয়ানোর চেষ্টা করে। দ্যূতি বিশুর কাছ থেকে সব খবরই পায়, কিন্তু  যেতে চাইলে বিশু মানা করে। রাতে বেশী করে নিশীথের  কথা মনে পড়ে। 
--
অবশেষে একদিন গভীর রাতে হটাত বাঁশীর করুন সুরে বেজে উঠলো। দ্যুতির মনে হল এ যেন সুর নয়, মনের তীব্র যন্ত্রণার প্রকাশ। বাঁশী যেন কাঁদছে।  মন ভারী হয়ে আসে। তারপর থেকে প্রতিদিন বাঁশীর কান্নার মূর্ছনা গভীর রাতের আকাশ ভরিয়ে তুলত। 
--
আস্তে আস্তে নিশীথ আবার কাজ করতে শুরু করলো। একদিন দ্যুতির বাড়ী কল সারাতে এল। কাজ শেষ করে কান্না চাপা গলায় বলল,"বৌদি, আমার সাত রাজার ধন চুরি হইয়া গেসে শুনছেন।" নির্বাক দ্যূতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
"আস্সা বৌদি, ওরা কি মনিষ্যি! কি কইরা একফোডা মাইয়ার সাথে হেই নোংরামি ডা করতে পারল! আর পুলিশ্গুলান, আমারে জিগায়,'মাইয়া আমার কাউর লগে পিরিত করত নাকি!' আমি কই, 'বাবুমসইরা মাইয়া আমার মায়ের গড়ন পাইসে, মায়ের কাপড় ডা জড়াইয়া মা সাইজ্যা খেলা কৈরতাসিল। দ্যাখতে নয় / দশ লাইগতে পারে, কিন্তু মাত্র সাত বত্সরের আছিল, পিরিত বোঝনের বয়স ই হয় নাই। তাও ছাড়ান দ্যান, মাইরা ফ্যালোনের বিহিত ডা তো করেন।'কত দিন হইয়া গ্যাল, কোনডারে ধইরতে পাইরে না! কারেই বা কোই। আমি বাপ হইয়া কিইবা কর্তে পারসি।" 
--
দ্যুতি কিছুক্ষণ বোঝাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে তো অন্তঃসার শুন্য কিছু কথা। আসলে নিশীথের কথার কোন উত্তর তার জানা ছিলনা। তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে বাঁশী বাজানোর কথা তুললো। "বৌদি, আমি ত বাঁশী আর বাজাই না, কান্দি, কাইন্দা কাইন্দা মাইয়াডারে ডাকি। ডাইক্যা কই, কি দোষে আমারে ছাইরা গেল! অর কি এখন যাওনের সময়!"
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------     









  













5 Dec 2015

স্বপ্ন -- (2)

স্বপ্ন - (২)
***

বিশাল সে জলরাশি পৃথিবীর বুকে,
জন্ম নিয়েছিল জীবন যেখানে,
আমি চেয়েছিলাম তার অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দু জল হতে।
দিগন্ত বিস্তৃত বালুকাবেলা যার উপর দিয়ে পা পা করে
এগিয়েছে সভ্যতা, সহস্র কোটি যুগ ধরে,
চেয়েছিলাম শুধু তারই এক অতি নগণ্য বালুকণা হতে।
যে মেঘেরা অঝোর ধারায় সিক্ত করে চলেছে এই ধরনীকে, 
চেয়েছিলাম তারই ছোট্ট এক টুকরো মেঘ হতে।
উঁচু ঋজু পাহাড়গুলি, যাদের গর্বিত মাথা আকাশে ঠেকেছে,
চেয়েছিলাম তাদের এক অকিঞ্চিতকর নুড়িপাথর হতে।
যে আদিম বনানী এই গ্রহকে সবুজের রঙে রাঙিয়েছে,
চেয়েছিলাম তারই রঙে একটু সবুজ হতে।
 --

সাগরের মাঝে যে অগনিত ঝিনুক ভাসে,
আমি চেয়েছিলাম সেই একটা ঝিনুক হতে।
যে বাতাস খেলে যায় এ ধরার এক প্রান্তর অপর প্রান্তরে,
আমি চেয়েছিলাম তার সাথে একটু খেলতে।
সকালের সোনাঝরা নরম রোদ গায়ে মেখে,
চেয়েছিলাম বুকভরে মিষ্টি ফুলের নির্য্যাস নিতে।  
যে মানুষেরা জীবনে সত্যের জন্যে যুগ যুগান্ত ধরে লড়ছে,
চেয়েছিলাম তাদের পথে হাঁটতে।
বিশ্বব্রম্ভান্ডের ঘূর্ণনের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম।
অনন্ত আকাশের অসীমতায় মিশে গিয়ে,
স্বপ্ন দেখেছিলাম তার নীলিমায় নীল হতে।   
স্বপ্ন দেখেছিলাম মানুষের মত মানুষ হতে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------





28 Nov 2015

অপরাজিতা



অপরাজিতা 
*********

আমিই  দুর্গা,
আমিই চন্ডী,
আমি মানবী।
--

আমাকে উলঙ্গ করে
বিকৃত আনন্দে মত্ত,
তবু তোরা পরাভূত।
 --

তোদের পৈশাচিক উল্লাস।
আমি যদিও ধর্ষিতা,
আমিই অপরাজিতা।
--

যুগে যুগে আমিই তোদের করেছি ধারণ,
বারে বারে আমিই তোদের করেছি সংহার,
আমি যে সবলা, এটাই আমার অহংকার।
--

ভীরু, কাপুরুষের দল ,
আমাকে হত্যা করিস যখন,
নির্ভয়ার সম্মান পাই তখন। 
--

লাশঘরে আমার দেহ হয় কাঁটাছেড়া, 
এ দেহ যতবার হবে ক্ষতবিক্ষত, ধর্ষিত,
আমি নই, সমগ্র মানবতা হবে লুন্ঠিত ।  
--

আমি অপরাজিতা,
আমি সবলা,
আমি নির্ভয়া।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------






27 Nov 2015

আমার বাবা

আমার বাবা
********


অনেক দিন আজকে আমার বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। দীর্ঘ্য, সোজা, সুঠাম দেহ, মাথাভরা ঝকঝকে শ্বেতশুভ্র চুল। বাবা আমার পচাত্তর বছর বয়সেও ভারী বিশাল ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে অনায়াসে চারতলায় উঠে আসতেন। হাঁটা চলা ছিল সাবলীল। বিছানা বা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বই বা কাগজ মুখে বসাটা ছিল তাঁর অভ্যাস।খাওয়া দাওয়ার কোন ঝামেলা ছিল না, তবে মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসতেন। আর ঘন ঘন চা পেলেই খুশি। সেই সাথে মুখে সারাক্ষণ জর্দা পান। দিনভর একই খবর শোনা আর খেলা দেখা তে কোন বিরুক্তি ছিল না।
--

বুকভরা স্নেহ, সৎ, সহজ সরল মানুষ, সকরুণ মুখাবয়ব। জীবনে একবারই মাত্র আমাকে একটা চড় মেরেছিলেন,তাও খুব জোরে নয়। মায়ের কাছে বরং আমরা অনেক বেশী মার্ খেয়েছি। কিন্তু বাবা রেগে গেলে এমন একটা হুঙ্কার দিতেন যে, পেটের পিলে চমকে যেত। তাই মার কাছে আমি আর আমার দাদা অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ ছিলাম। কিন্তু আমাদের জন্যে নীরবে অনেক আত্মত্যাগ করতেন। আসলে অন্তরে খুবই স্নেহশীল মানুষ ছিলেন।  
--

আর একদিকে আমার বাবা কিন্তু সৃষ্টিশীল মনের মানুষ ছিলেন, নানা রকম হবি ছিল। সারা জীবন বাগান করা, মাটির মূর্তি গড়া , কাঠের জিনিসপত্র বানানো ইত্যাদি। সাংসারিক বিপর্যয়ে সাধারনত বিহ্বল হয়ে পড়তেন। কোন  প্রিয়জন অসুস্থ্য হলেই খুব ঘাবড়ে যেতেন। সবাই তাঁকে দুর্বল চিত্ত মনে করতো। তবে দারুন সাহসিকতায় যুঝেছিলে জীবনের শেষ কটা দিন। আজও স্মৃতি হিসাবে রয়ে গেছে তাঁর  হাতে লাগান কিছু গাছ, তাঁর মাটির তৈরী মূর্তি, আরও নানা কিছু শিল্পকর্ম। সেই সঙ্গে আছে তাঁর স্নেহশীল মনের পরশ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------






  











 

12 Nov 2015

ককটেল জীবন, মাগো

ককটেল জীবন
***********

সুখ, দুঃখ, ভালবাসা
সব দিয়ে মন ঠাসা,
ককটেল জীবন আমার,
তবু দিন যেন কাটে
নাকো আর।
-----------


মাগো
****

মা আমার গেছে চলে
দূরে, বহু, বহু দূরে,
আমাকে একেলা ফেলে
এই গহন আঁধারে।
 ---------
  

9 Nov 2015

দীপাবলী

দীপাবলী
******
আকাশ সেজেছে গোধুলি রঙে,
গিরিশিখর তাতে সলজ্জ হাসে,
দিগন্তে বনরাজী হওয়ায় নাচে,
উন্মত্ত সমুদ্র গর্জ্জায় উচ্ছাসে।

 
দুরন্ত আঁধার করে চারিধার, সূর্য যখন নামল পাটে,
শুভ দীপাবলী মহা-আয়জন, জ্বেলেছে প্রদীপ অদূরে ঘরে ঘরে,
দিক বিদিকে ছড়ায় বারতা, জেগছে মানুষ, পৃথিবী জেগেছে,
অসুর নিধনের দিন এসে গেছে, আজ শুভদিনে এই ধরনীতে।
__________________________________________________________________________________________



30 Sept 2015

পড়শী

পড়শী
*****

দেশ বিভাগের সমসাময়িক সময়ের কথা। তখন পর্যন্ত্য ভারত ও পাকিস্থান দুই  মানুষের মনেই একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। কিছু সুবিধাভোগী আর সমাজবিরোধীরা তাতে হাওয়া দিয়ে চলছে কিছু বাড়তি সুযোগ আদায়ের ইচ্ছায়। সেই সময়ে কলকাতার এন্টালি এলাকার একটি পাড়ায় খিস্টান, হিন্দু, মুসলমান বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সহবস্থান ছিল।
--

সেখানে একই  বাড়ির দুটি অংশে থাকতো একটি হিন্দু আর একটি মুসলমান পরিবার। তাঁদের মধ্যে সদ্ভাবের অভাব ছিল না। বরং বলা যায় অতি ঘনিষ্ট আত্মীয়ের মত। দুটি পরিবারেরই জড় ছিল তদানিন্তন পূর্ব বাংলার টাঙ্গাইলের পাশাপাশি দুটি বাড়িতে ।  দুটি পরিবারের আধখানা সেখানেই রয়ে গেছিলো, আর আধখানা বৃত্তির তাগিদে কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিল। একের  উত্সবে অপরের উপস্তিতি আর উপহার দেওয়া শুধু স্বাভাবিক নয় আবশ্যিক ছিল। বিপদ আপদেও  তাই। রায়টের সময় ও দুই পরিবার পরস্পরকে আগলে ধরে পরম মিত্রতার মধ্যে দিয়ে কঠিন সময় পার করে চলেছে।
--

দুটি পরিবারেই বছর দেড় / দুই য়ের দুটি শিশু ছিল, যারা দুই পরিবারের চোখের মনি। শিশুদুটিকে কেন্দ্র করে ঘনিষ্টতা আরও যেন গভীর হয়ে ওঠে। তারা কখন এবাড়ি কখন বা ওবাড়ি থাকতো, খেলা করা, স্নান করা, এমনকি খাওয়া, ঘুমানো চলতো। একটি বাড়িতে ব্যস্ততার সময়ে অন্য বাড়ির রক্ষণাবেক্ষনে থাকতো তারা। মোটের উপর আপদে বিপদে পরস্পরের সহযোগিতায় দিন কাটছিলো। তাঁদের পাশের বাড়িতে এক বৃদ্ধ খ্রিষ্টান দম্পতি ছিলেন। তাঁদের ও এই পরিবার দুটির সাথে যথেষ্ট যাতায়াত ছিল। পাড়ায় এদের পাস্পরিক ভালবাসার কথা পাড়ার সবাই জানতেন। অতি দুর্যোগের মধ্যেও মোটামুটি শান্তিতে ছিলেন এখানকার মানুষ জন।
--

আচমকাই বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো একদিন। শিশুদুটি কোন একটি বাড়িতে সকালের  খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ তাদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলনা। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে অথচ কোন চেঁচামিচি নেই।
দুই পরিবারই ধরে নিয়েছে অন্যদের কাছে আছে। তবু একটা সময়ের পর দুই মায়ের মনে হয় এবার অপর কে বিশ্রাম দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল তাদের গতিবিধি সম্পর্কে কেউই অবহিত নন। দুই পরিবারের  বাকি লোকজন ও এসে জড়ো হলো যে ঘরে বাচ্চা দুটি ঘরে ঘুমাচ্ছিল সেখানে। দেখা গেল মাটিতে বিছানাযে তারা শুয়ে ছিল সেগুলি ভেজা অবস্থায়ে পরে আছে। কিন্তু বাচ্চা দুটি নেই। দুই বাড়ির আনাচে কানাচে খোঁজ শুরু হল। কোথাও পাওয়া যায়না তখন বাড়ির কর্তাদের অফিসে খবর গেল। হন্তদন্ত হয়ে তাঁরাও হাজির।
--

অবশেষে  কার দায়িত্বে তারা ঘুমিয়েছিল তার হিসেব নিকেশ শুরু হল। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাকে প্রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করনোর অবস্থায় এসে পড়ে। ফলে তিনি ও বেগতিক দেখে নিজের দোষ কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে একে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্ঠা শুরু হল। তার থেকে এক পরিবার অন্য পরিবারের ঘাড়ে দোষ দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে পাড়ার লোকজন জড়ো হয়েছে। ধান্দাবাজ অত্যুতশাহিরা ধর্মের জিগীর তুলে দুই পক্ষকে উত্তেজিত করার চেষ্টায় রত। এত দিনের ভালবাসা, বিশ্বাস সব যেন গুঁড়িয়ে যাবার যোগাড়। শেষে অহিংস তর্কাতর্কি প্রায় সহিংস সংঘর্ষের রূপ নিতে চলে। দুই পরিবারের কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি।
--

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে দেখে এক পরিবারের ঠাকুমা নিজের ঘরে সন্ধ্যা আরতি দিতে ঢোকেন। খাটের তোলা থেকে পিলসুজ বার করতে গিয়ে তিনি চমকে ওঠেন। এক দৌড়ে ঘর থেকে বার উঠোনে যেখানে সব মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে গিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকেন, "এই তোরা সব তাড়াতাড়ি আমার ঘরে আয়, দেখে যা কি কান্ড হয়েছে।"  সবাই দৌড়ে যায়।
--

বৃদ্ধা বলেন,"দ্যাখ  সবাই খাটের তলায়!" সকলে পস্পরকে ঠ্যালাঠ্যেলি করে ঝুঁকে পড়েন খাটের তলে। অবাক হয়ে দেখেন শিশু দুটি পাশাপাশি বসে আছে। সামনে তাদের দুটি  বড় গামলা  একটাতে চাল ভর্তি, আর অন্যটায় ডাল। দুজন মিলে তাদের ছোট্ট মুঠি ভরে চাল তুলে ডালের  আর ডাল তুলে চালের গামলায় মেশাচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিজেদের মুখে দেবার চেষ্টাও চলছে। ঘুম ভেঙে গেলে সম্ভবত হামগুড়ি দিয়ে পাশের ঘরের খাটের তলায় মজার খেলায় মেতেছে। বড়দের মধ্যেকার অশান্তির আবহাওয়া তাদের দুজনের খেলায় কোন বিঘ্ন ঘটায়নি।
--

সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মায়েরা চট জলদি বসে পড়ে শিশু দুটিকে টেনে বার করেন। বুকের মানিকদের নিজেদের কলে তুলে জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কাঁদতে  কাঁদতে আদর করতে থাকেন। দুই পরিবারের বাকিরা কিছক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। লজ্জায় একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। হটাত দুই বাড়ির লোকজনের সম্বিত ফেরে। চোখের জলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। ধান্দাবাজের দল গুটি গুটি সরে পরে। শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা দুই পরিবারের মিলনে নিজেদের মিলিয়ে দেন।
--

শেষ চমক দিলেন পাশের বাড়ির খ্রিষ্টান পরিবারের বৃদ্ধ কর্তা, "এই যে মায়েরা নিজেদের বাচ্ছাদের ফিরে পেয়েছ তো। একবার তাকিয়ে দ্যাখতো নিজের বাচ্চাকেই কোলে নিয়েছ তো!" সবাই অবাক হয়ে যায় তাঁর কথায়। দুই মা ভাল করে তাকিয়ে দেখেন, একে অন্যের বাচ্চাকে বুকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। গুমঠ গরম কেটে স্নিগ্ধ হাওয়া খেলতে থাকে সারা উঠোন জুড়ে।  
_________________________________________________________________________________________





























































26 Sept 2015

মাত্র দুটো বছর

মাত্র দুটো বছর
**********

তুমি বাঁচতে চেয়েছিলে আর দুটো বছর,
হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে,
মুখে অসহায় আকুতি,
আকাঙ্খা ভরা সজল দুটি চোখ,
বাঁচতে চেয়েছিলে মাত্র আর দুটো বছর।
--

আকুল কন্ঠে ডেকেছিলে তোমার ভগবানকে,
সকরুণ মিনতি জানিয়েছিলে
ডাক্তার, নার্স, এমনকি আর্দালিদের কাছে,
ভরসা করেছিলে প্রিয়জনদের, বিশ্বাস -
যদি কেউ বাঁচিয়ে দেয় মাত্র দুটো বছর।
--

আশা নিরাশার দোলা,
প্রতিদিনের উত্কন্ঠিত প্রতীক্ষা,
অবশেষে নিদান ঘোষণা।
অসহায় প্রিয়জনরা চোখের জল লুকিয়ে,
আশ্বাস দিয়েছিল তুমি বাঁচবে আরও দুটো বছর।
--

যে কাল ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল শরীরে,
ছড়িয়ে পড়ছিল অতি দ্রুত গতিতে,
সেকি বুঝেছিলে! নাকি লুকোচুরি খেলতে
সবার সাথে, তোমার প্রিয়জনদের মত!
তুমিতো বাঁচতে চেয়েছিলে মাত্র আর দুটো বছর।
--

প্রতিদিনকার দূরারোগ্য ব্যাধির সাথে
লড়তে গিয়ে হয়ত বা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল,
তোমারই আপনজনেরা, হয়তো বা চেয়েছিল
অসহ্য রোগ যন্ত্রণা যেন ভোগ না করো,
কিন্তু তুমি তো বাঁচতে চেয়েছিলে মাত্র দুটো বছর।
--

প্রতি রাতের মৃত্যু ভয়ের আকুল আকূতি,
হয়তো অভাব ঘটেছিল সহমর্মিতার ,
তোমার অভিমান সেদিন পায়নি সাড়া,
আজ যখন তোমার পরম আপনজনদের 
মনটা গুমরাচ্ছে, তুমি তখন কোথায় !

--
আজও  তোমার হাতে লাগান কিছু গাছ আছে ,
আছে তোমার তৈরী মূর্তি, আরও কিছু শিল্পকর্ম।
কিন্তু তুমি নেই। নাকি আছ ! গঙ্গার জলস্রোতে!
এদেশের মাটিতে মিশে! পৃথিবীর পরিমন্ডলে!
অন্তত পক্ষে আমাদের হৃদয়ে।

_________________________________________________________________________________________





















  













19 Sept 2015

প্রথম দেখা

প্রথম দেখা
********
তখন প্রথম দেখেছিলাম তোমাকে ,
ছিপছিপে টান টান চেহারা ,
দৃঢ় উঁচু ঘাড়, কাঁচাপাকা মাথা,
থুতনিতে সামান্য ঝুলে পড়া দাড়ি,
কিন্তু গোঁফ জোড়াটা বিশাল।
তার ফাঁক গলে আকর্ণ বিস্তৃত
মন মাতানো সহজ সরল হাসি,
আপনভোলা এক মানুষ।
--

বুদ্ধি দীপ্ত ডাগর চোখে
অনুভূতিপ্রবন মনের ছায়া।
আপন করে নিতো অচিরে,
খুলে যেতো ভারাক্রান্ত মনের  
সকল বন্ধ দরজা জানালা,
ঝরঝরে সবুজ হয়ে ওঠা।
নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত হৃদয় জিতে নিত
শ্রদ্ধামাখা ভালোবাসা অচিরেই।
--

তারপর কত যুগ কেটে গেছে,
এখনো উতলা মন তোমাকেই খোঁজে,
সমস্ত রাগ-যন্ত্রণা, হাসি-কান্না তে
তোমাকে, শুধুমাত্র তোমাকেই চায়,
প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহুর্তে তোমারি
উষ্ণ সান্বিধ্য টুকুর জন্যে মন উদগ্রীব, 
তোমার শক্ত মুঠোতে যেন বাঁধা থাকে
জীবন যুদ্ধের শেষ পারানির ক্ষন টুকুও।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



 












9 Sept 2015

আমার মা




















আমার মা
*******
পুতুল পুতুল গড়ন ,
চাঁপা নাক, টুকটুকে রঙ ,
গলায় কোকিলের মিষ্টি সুর, 
লম্বা বাদামী চুল, ডাগর দুটি চোখ,
পাতলা লাল ঠোঁট, পানপাতা মুখ,
সবার আপনজন, নাম ছিল তার পুতুল।
---

স্নেহরসে পরিপূর্ন এক মানুষ
কথা খোলামেলা, সোজা সাপ্টা, 
পাখির মতো শরীরে তাঁর হাতির বল,
দিন ভর ব্যস্ততা, আর ঘোড়ার মত ছোটা,
পাহাড়ের ঋজুতা মনে, হৃদয় তাঁর সমুদ্রের মত,
সারা জীবন ভরে শুধু কলুর বলদের বোঝা বওয়া।
_________________________________________________________________________________________


















28 Aug 2015

হারানো কাকলী

হারানো কাকলী
**********
বাবুই, বউকথা কও, বক, ইস্টিকুটুম
চিরকালই গ্রামের বাসিন্দা।
শহরের বুকে আধিপত্য ছিল
কাক, কোকিল, চড়াই, পায়রাদের।
--

গৃহস্থের পরিছন্ন গৃহস্থালিতে   
চড়াই পাখিদের অযাচিত অনুপ্রবেশ।
ঘরে কোনা-কাঞ্চিতে
বাসা বাঁধা, ডিম পাড়া।
--

নৈমিত্তিক তাদের খুনসুটি, 
ঠোঁটে করে বাচ্চাদের খাবার আনা ,
অনবরত খড়কুটো ফেলা,
ছিল তাদের জন্মগত অধিকার।
--

পায়রাদের বসত ছিল   
পুরাতন বাড়ির ঘুলঘুলির মধ্যে।
উঠোনের আনাচে কানাচে 
খাবারের সন্ধানে তাদের ব্যস্ততা ।
--

বারমহলে তাদের অনয়াস গতি,
বেড়ালের প্রতি সতর্ক নজর,
দিনভর গলা ফুলিয়ে বকবকম
নির্জনতার প্রাচীর ভাঙত।
--

আজ যখন চড়াইয়ের খুনসুটি দেখে
পায়রার বকুমবকুম শুনে
একাকিত্ব থেকে মুক্তির পথ খুঁজি,
তারা হারিয়ে গেছে শহুরে মানুষের জীবন থেকে।
--

কেমন হবে সেদিন যেদিন থেকে
বাড়ীর কার্নিশে, ছাদের পাঁচিলে
কাকদের সভা আর বসবে না, কোকিল আর 
ডিম পাড়ার জন্য কাকের বাসা খুঁজে পাবেনা।
__

এমনি করেই মানুষকে আরো একা করে
কোন এক দিন হয়তো বা হারিয়ে যাবে
কাকের কর্কশ কা কা রব ,
সাথে কোকিলের মিঠে কুহু তান।  

__________________________________________________________________________________________

























27 Aug 2015

শ্রাবন শেষের আঙিনাতে

শ্রাবণ শেষের আঙিনাতে
****************

ঘন ধূসর মেঘের আস্তরণের
মধ্য দিয়ে বিদ্যূত চমকের মত
যৌবনের সহজাত প্রেরণাগুলি
মনের গভীর থেকে উঁকি মারছে।
--

অলস কালক্ষেপন না করে ,
উদ্দাম চলমান জগতের সাথে
দৃঢ় পদক্ষেপে, শান্ত সমাহিত মনে, 
অভিসারে সাড়া দিতে ডাকছে।
--

বৃষ্টি শেষে সদ্যস্নাত কচি চারাগুলি
দিনের উচ্ছল আলো মেখে
রাতের হিমেল বাতাসের পরশ পেয়ে
নরম আনন্দে ভরিয়ে দেবে মনের দৃষ্টিকে।
---

হাসি কান্নার জোয়ার ভাঁটায় 
অনন্ত অসীম বিশ্বের নৈসর্গিক
রূপ রস অনুভবে মগ্ন করবে
আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতা আর সৃষ্টিকে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------







19 Aug 2015

আপনজন


আপনজন
********

কসর আলীর সাথে সৃষ্টির পরিচয় হয়েছিলো ১৯৭১ সালের এক বৃষ্টি ভেজা শীতের রাতে, তাদের এক সাথীর মাধ্যমে।
"এই দ্যাখ সৃষ্টি ইনি হলেন আমাদের কসর দা, ওনার বাড়ীই আপাতত তোর আস্তানা। ওঁদের ঘর তিলজলা বস্তিতে, ওখানে তোকে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। বিশাল এলাকা মানে বিশাল কাজের জায়গা।
ওখানে বেশীর ভাগ উর্দুভাষী মুসলিম। তবে হিন্দী জানেন, ভাঙা বাংলাও জানেন। তুই তো আবার হিন্দীটাও ভাল জানিস না। ভাঙা হিন্দী আর বাংলা মিলিয়ে মিশিয়ে চালাবি।"
--

কসর দা প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, খাড়া নাক, মমতা মাখা সরল দুটি চোখ। বোঝা যায় গায়ের রঙ এক সময় গৌরবর্ণ ছিল, বর্তমানে পুড়ে তামাটে। চেহারায় কঠোর পরিশ্রমের আর পোশাকে দারিদ্রের ছাপ। তিনি জুতার কারখানায় ওস্তাদ কারিগর। বাড়ীতে আম্মা, স্ত্রী আর চারটি সন্তান। একটি ছয় ফুট / ছয় ফুট টিন আর ছাপড়া বেড়ার ঘর। তাতে উঁচু করে পাতা একটা বড় চৌকি যার উপরে নীচে শোবার ব্যবস্থা, মানে কোনমতে কাত হওয়া। আর এক কোনে উনান পাতা, রান্না, খাওয়ার সরঞ্জাম। সারা অঞ্চল জুড়েই এই ব্যবস্থা।
--

এরই মধ্যে কসর আলী সৃষ্টি কে নিয়ে হাজির হলেন। বাড়ীর লোকেদের বোধহয় আগাম নোটিস দেওয়া ছিল, তাই স্বাভাবিক ভাবে সবাই মেনে নিল। ভাবী মানে কসর দার স্ত্রী, সন্তানদের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন, "ইয়ে তুমহারা বুয়া হায়।" বাচ্ছারা খুব খুশির সাথে বুয়ার কাছ ঘেসে এলো। ছোট্ট টা দুহাত বাড়িয়ে দিল কোলে ওঠার জন্যে। "বাদমে, পহলে বুয়াকো বৈঠনে দো, মুহাত ধোনে দো।" সৃষ্টি ভাবী আর আম্মাকে নমস্তে করে বাচ্ছা টাকে কোলে তুলে নিল। যথারীতি ভাঙা হিন্দি আর বাংলা মিশিয়ে সবায়ের সাথে আলাপ করতে লাগলো। তবে তার উপস্থিতি যে আম্মা কে সন্তুষ্ট করেনি, সেটা বুঝতে পারলো। ভাবী চোখের ইঙ্গিতে ঘাবড়াতে বারণ করলো।
--

রাতে রুটি আর হালিম খাওয়া হলো। কসর দা রাজনীতি, চার পাশের মামুষের অবস্থা, দেশের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা আলোচনা করলেন। ভাবী ও হাতের কাজ সারতে সারতে কিছুক্ষন আলোচনা শুনলেন। সৃষ্টি সাহায্য করতে গেলে বাধা দিয়ে বললেন, " আব তুমলোগ বাতে করো, সুভে মেরে হাত বাটানা।" কিন্তু আম্মা সবাইকে চুপ করে শুতে বলে দিলেন। কসর দা আস্তে আস্তে বললেন," দো দিন যানে দো, তব সব কুছ ঠিক হো যায়গা।" কসর দা আর  ভাবী ছোট দুটো বাচ্ছাদের নিয়ে চৌকির নীচে মাদুর পেতে শুলেন, আর উপরে আম্মা, বড় বাচ্ছা দুটি আর সৃষ্টি। সারা দিন খাটাখাটনির পর শোবার সাথে সাথে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। শুধু ঘুম নেই সৃষ্টির চোখে। প্রবল মশার উপদ্রব। মশা মারতে মারতে রাত কাবার।
--

পরদিন সকালে কসর দা কাজে বেরিয়ে গেলেন। সৃষ্টি ভাবীর সাথে হাতে হাতে কাজ করতে করতে গল্প করতে লাগলো। বস্তির একটা গোসল ঘর, তাতে কল দেওয়া বিশাল একটা চৌবাচ্চা, জল ভর্তি করা হয় স্নানের জন্য। বাইরে আর একটা টাইম কল। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জল ধরা, আর সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে নিতে হয়। স্নান থেকে শুরু করে সব কিছু লাইন দিয়ে করতে হয়। দুপুরে ভাত পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে খাওয়া। বিকালে আবার টাইম কলে লাইন দিয়ে কাজ সারা।
--

কসর দার ওভার টাইম সেরে ফিরতে একটু রাত হত। খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ কথা বার্তা। রাতে শোওয়া। দ্বিতীয় দিন রাতে সৃষ্টি মশার কামড়ের মধ্যে ই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হটাত কোঁকানির আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেল। দেখে আম্মা উঠে বসে নিজের পা টিপছেন  আর কোঁকাচ্ছেন। সৃষ্টি কাছে গিয়ে জোর করে তাকে শুয়িয়ে দিয়ে সরষের তেল পায়ে মালিশ করে দিল। আস্তে আস্তে আম্মা ঘুমিয়ে পড়লে, সে শুয়ে পড়লো।
--

প্রায় দিন সাতেক পার হতে চলল। আম্মার ব্যবহারের  আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। ইতিমধ্যে বস্তির অনেক মহিলা ও মেয়েদের সাথে সৃষ্টির পরিচয় হয়ে গেছে। সে প্রায় ঘরের লোক হয়ে গেছে। প্রচারের কাজ ধীরে ধীরে ভালই এগোচ্ছে। একদিন কসর দা দের সাথে তাদের  এক আত্মীয়ের বাড়ীতে এক পরব উপলক্ষে গেল। সে বিশাল বড়লোক বনেদী মুসলিম পরিবার, গিজগিজ করছে মানুষ। এলাহি ব্যাবস্থা। সৃষ্টি তো অবাক। আম্মা তাই দেখে বললো,"বেটি অব হামলোগনে এয়েস্যা জী রহী হু, মগর কসরকা  বাপ অওর মেরে খানদান নবাব ঘর সে তালুক রাখতে থে।" সৃষ্টি বুঝতে পারলো এই জন্য আম্মা প্রথম দিন তাকে ভাল মনে কেন গ্রহন করতে পারেননি , আসলে তাঁর প্রাচীন আভিজাত্যে ঘা লেগেছিল। বর্তমান দারিদ্রে বাইরের লোকের সামনে প্রকাশ করতে চান না। তাছাড়া পর্দানশীন বনেদী পরিবারের একজন বৃদ্ধার কাছে বাইরের একটা উটকো মানুষ কে মেনে নেওয়া স্বভাবিকভাবেই সহজ নয়। কসর দা ও ভাবী যে কতটা প্রগতিশীল মানুষ, সেটা ভেবে অবাক হতে হয়। 
--

একদিন সৃষ্টিকে সকালে কসর দার সাথে পার্টির বিশেষ কাজে বার হতে হলো। কাজ সেরে রাতে বস্তিতে ফিরতে গিয়ে একটা বিশাল উত্তেজনার পরিবেশ নজরে এলো।
কসর দার বাড়ী যাবার পথে তাঁদের একজন প্রতিবেশী তাকে হাত ধরেটেনে ঘরে নিয়ে গেল। মহিলা বললেন,"তু আভ্ভি উনকো ঘর মত যানা, বহুত ঝামেলা চল রহা হ্যায়। মসজিদ সে  মৌলভি সাব আয়া। উনকো পাস্ খবর হ্যায় কী কসর জীকে ঘরমে এক হিন্দু লেড়কি আয়া। বস্তিকা সব লোগনে মিলকে উনকো সমঝাযা, কসর জী কে এক বাঙালী মুসলীম দোস্ত কা বেটি কুছ দিনকে লিয়ে আয়া। ম্যায়নে মেরি মরদ কো বুলাতা হু। তু মেরে এক বোর্খা পহেনকে আভ্ভি বাস পকড় কে ভাগ যা। "
--

ইতিমধ্যে একজন  মহিলা আম্মাকে ডেকে এনেছে। স্বাভাবিক ভাবেই কসর দা আর ভাবী আসতে পারেননি। কারণ তারা মৌলভী সাহেবের সাথে কথা বলছেন।
আম্মা এসেই কেঁদে সৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরেন। "বেটি ম্যায় পহলে তুঝে আচ্ছা দিলসে নেহী লেনে সেকা। মুঝে মাপ কর দে।"সৃষ্টি বারবার করে আম্মাকে বুঝাতে থাকে যে তাঁর কোন দোষ নেই। তার নিজের মা ও  হটাত একজন অপরিচিত মুসলীম মেয়েকে নিয়ে গেলে, সহজে মেনে নিতে পারবেন না। উপস্তিত সবাইয়ের চোখ দিয়ে জল বেরিযে আসে। মাত্র সাতদিনের পরিচয়ে বস্তির বেশীর ভাগ মানুষ একজন ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে মনের ভিতর থেকে গ্রহন করেছে।সে যেন তাদের একান্ত আপনজন।
--

ইতিমধ্যে কসর দার সেই ঘরের প্রতিবেশী দাদা চলে আসেন। সেই ভাবীর বোর্খা পরে সৃষ্টি তাঁর সতর্ক প্রহরায় বাস স্ট্যান্ডে আসে। বোর্খাটা খুলে সেই দাদাকে দিয়ে ফিরে যেতে বলে,পাছে কেউ তাঁকে দেখে ফেললে, তিনি আবার বিপদে না পড়েন।
কিন্তু তিনি শুধু একটু দুরে দাঁড়িয়ে চারদিকে কড়া নজরদারি করতে থাকলেন, যতক্ষণ না সৃষ্টি নিরাপদে বাসে উঠে চলে যায়। মাত্র সাতদিনের আশ্রয় সৃষ্টিকে একটা জিনিস শিখিয়েছে যে সাধারণ মানুষের কাছে মানবিকধর্ম বোধ ঐশ্বরিক ধর্মের থেকে অনেক উপরে। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




































































































 

9 Aug 2015

স্বপ্ন -- (১)

স্বপ্ন - (১)
***
যুগ যুগ ধরে, পলে পলে
মানবতা খুন হচ্ছে,
স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে 
সেই সুদিনটার যেদিনে 
মনুষত্বের  বিজয় পতাকা প্রতিরোধে
পৃথিবীর আকাশে উড়বে সদর্পে।
তার বার্তা বাতাস ছড়িয়ে দেবে
সাগরের ফেনায় ফেনায়, বন থেকে বনান্তরে,
পাহাড়ে পাহাড়ে, দিক থেকে দিগন্তরে। 
----
হ্যামিলিনের সেই পাইড পাইপারের বাঁশীতে  
উৎসারিত সুরের মোহে আকর্ষিত হয়ে,
শয়তানের দল, যারা মুখ ঢেকে আজ মানুষের মুখোশে,
ইঁদুরের মত একে একে গিয়ে পড়বে
আগ্নেয়গিরির জলন্ত লাভা স্রোতে।
যুগ থেকে যুগান্তরে নিহত,
সকল শহীদের কন্ঠে উচ্চারিত সুরে,
নতুন জীবনের আগমন প্রতিধ্বনিত হবে। 
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------








4 Aug 2015

দূর্ভোগ

দূর্ভোগ
******

শ্যাওলা ধরা আকাশে
ঝলমলে রোদ মারছে উঁকি,
পিচ্ছিল রাস্তাগুলি এখন শুকনো,
নেই সেই বিরক্তিকর বদ্ধ থৈ থৈ জল ,
বাতাসে কেটেছে মেঘের কঠিন কঠোর ভ্রুকুটি,
নরম আলো হাসছে গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় ,
শহুরে মানুষের মনে স্যাতস্যাতে ভাব মুছে তৃপ্তির হাসি।
---

এখনও বহু জায়গা বানভাসি ,
মানুষগুলি ঘর ছাড়া, নেই মাথার উপর ছাদ,
কিছু ভাগ্যবানের কপালে জুটেছে ছিঁটেফোঁটা ত্রান, 
পেটে ক্ষুধার জ্বালা, পরনে কাদামখা ভিজা কাপড়, খাবার জলের আকাল,
পুকুর, নদীর কূল ছাপিয়ে, নালার জল মিলেমিশে একাকার, এবার হবে মহামারী,
ত্রান নিয়ে চলছে রাজনীতি, নেতারা উদগ্রীব নজর কাড়তে, ভোটের বাজার গোছাতে।  
প্রকৃতির মারের চেয়ে বড় বিপদ মনুষ্যত্বের কেনা বেচা, মানুষ কবে শিখবে মানুষকে ভালোবাসতে !
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

30 Jul 2015

দায়ী কে!

দায়ী কে !
*******

"বিশু আর নেই রে "- সকাল বেলায় মা ঘুম থেকে ডেকেই  খবরটা দিলেন দিয়াকে। ধরমড়িয়ে উঠে বসলো সে," কি বলছো কি ! সাত সকালে যত  আবোল তাবোল কথা কোথা থেকে শুনলে তুমি !" "না গো বৌদি, মাসীমা ঠিক কথাই বলেছে। সত্যি আজ ভোর বেলায় বিশু মারা গেছে। একটু পরে ওরা ওর দেহ নিয়ে আসবে।" কাজের মাসি উত্তর দিল। "কি ! কি হয়েছিল ! কবেই বা এত টা অসুস্হ হলো। এইত তিন / চার দিন আগে আমার সাথে কথা হলো। শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা বলেছিলো বটে। কিন্তু আমি হাসপাতালে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলাতে, বলেছিলো সে রকম মারাত্মক কিছু নয়। এর মধ্যে কি হলো যে তরতাজা প্রাণবন্ত ছেলেটা চলে গেল ! কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো, জানো কিছু ?"
---

"হাসপাতালে তো নিয়ে যায়নি। দিদির বাড়ী নিয়ে গিয়েছিলো ঝাঁড় ফুঁক করতে।""সেকি,ওর দিদির বাড়ী তো অনেকে দূর, একেবারে অজ পাড়া গাঁ। সেখানে তো কিচ্ছু নেই ,ওষুধের দোকান , স্বাস্থ্য কেন্দ্র - একদম কিচ্ছু নেই। তার চেয়ে এখান থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তো অনেক বড় / ছোট, সরকারী / বেসরকারী হাসপাতাল ছিল। সেখানে নিলো না কেন !" " বৌদি তোমরা তো মাত্র বছর খানেক হলো এসেছো, এখানের রীতি নীতি গুলি জানতে পারোনি। এখানে লোকেদের হাসপাতাল/ডাক্তার এসবের থেকে ঝাঁড় ফুঁক আর জলপড়া র উপর বিশ্বাস বেশী।"  " কিন্তু বিশুর মেয়ের কদিন আগেই তো বিশাল করে জন্মদিন পালন করলো, কেক কাটা হলো, মাইক লাগিয়ে গান বাজলো, কত লোক খেলো। ওদের তো পয়সাকড়ির খুব অভাব নেই , তাহলে ?"
 "বৌদি, আসলে তোমাদের মত শহরের লোকেদের দেখে ওরা জন্মদিন, বিয়ের দিন এসব শিখেছে, কিন্তু তোমাদের মতো পড়াশুনা তো শেখেনি, তাই এখনো অসুখ করলে বেশীর ভাগ মানুষ পুরানো দিনের ঝাঁড় ফুঁক এসবে বেশী বিশ্বাস করে।"
 ---
দিয়া চুপ করে যায়। বিশুর হাসিখুশী মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে তখন তারা এই ফ্লাটে নতুন এসেছে। একদিন সে যখন বাড়ীতে একা, বিদ্যুতের লাইনে কোন কারণে নিজেদের ফ্ল্যাটের ইলেকট্রিসিটি অফ হয়ে যায়। প্রচন্ড গরমে টেঁকা দায়। দিয়া নীচে নাম ইলেকট্রিশিয়ানের খোঁজে। ঠিক উল্টো দিকে বিশু নিজের কাপড় ইস্ত্রির দোকানে কাজ করছিলো। দিয়ার উত্কন্ঠিত মুখ দেখে বেরিয়ে আসে, "কি হয়েছে কাকিমা, কোন সমস্যা?"  সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিজের খুড়তুত ইলেকট্রিশিয়ান ভাইকে ডেকে পাঠিয়ে লাইন সারিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। সেই প্রথম আলাপ।
---

বিশুর ছোট বেলায় পোলিও হবার ফলে পায়ে জোর ছিল না। বিশুর বাবার বেশ কিছুটা জমি জায়গা ছিল। তার বেশ  কিছুটা জমি প্রমোটারি ব্যবসায়ে নিযুক্ত এক রাজনৌতিক দলের নেতা ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে লিখিয়ে নিয়েছিলো। সেই ফ্লাট ভাড়া, বিশুর বাবার  মুদিখানা দোকানের আয়, বিশুর নিজের দোকানের ছাড়াও, আরও বেশ কিছুটা জমির আয় ছিল।
---

বাড়ীটা নিজেদের। তাই আর্থিক ভাবে অসচ্ছলতা ছিল না। বাবা মা নির্বিবাদী ভালমানুষ। তার বৌটির ব্যবহারও  খুব মিষ্টি। আর বিশুর ব্যবহারের তো তুলনা ছিল না। আসে পাশের মানুষ জনদের ছোটখাটো সমস্যাগুলি সে নিজে থেকেই সমাধান করতে চেষ্টা করতো। কোন বাড়ীতে জলের লাইনে সমস্যা, তা মেটানো। কোন ফ্ল্যাটের লোকেরা কদিনের জন্য বাইরে গেছে, যাতে চুরি নাহয় রাস্তার ধারে দোকানে বসে সব খেয়াল রাখতো। আর  নিজের ফোনে লোক ডেকে সবাই এর সমস্যার সমাধান করতো। 
---

দিয়ার মনে পড়ে আর একদিন সে ভুল করে চাবি না নিয়েই গডরেজ লকের দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়েছিল, এমনকি মোবাইলটাও ঘরে রয়ে গেছিল। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। বিশু তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে,সব শুনে নিজের দোকানে বসায়, বলে, " কাকিমা, কাকুর অফিস তো কাছেই। তাঁর কাছে বাড়তি চাবি নেই ? তাহলে আমার ফোন থেকে একটা ফোন করে দিন।" বিশুর সাহায্যে ই সেদিন ও দিয়া বিরাট ঝামেলার হাত থেকে মুক্তি পায়।
---

বিশুদের বাড়ী সল্টলেক সিটি থেকে পাঁচ মিনিট আর নিউটাউন থেকে দুই মিনিট দূরত্বে। পাড়ায় মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য বেশ কয়েকটি মল্টিস্টরিড বিল্ডিং ও হয়েছে। জায়গাটা যদিও এখনো পঞ্চাযেতের অধীন। সরকারী প্রাথমিক স্কুল আছে। ছেলেদের  জন্য সেলুন, মেয়েদের জন্য বিয়ুটিপর্লার আছে।আধুনিক নাচ শেখার কেন্দ্র ও হয়েছে। অঞ্চলের   অধিবাসীরাও এসবে উত্সাহ ভরে যোগ দেয়। 
--- 

ওষুধের দোকান আছে। কিন্তু এলোপ্যাথিক কোন ডাক্তার নেই। একজন হোমিয়প্যাথিক ডাক্তার দাঁত থেকে শুরু করে সব কিছুর  চিকিত্সা করেন, আর একজন অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার আছেন  যিনি মূলত এলপ্যাথিক চিকিত্সা করেন, একটু কিছু হলেই স্যালায়িন গুঁজে দেন।
---

অনেক বাচ্চারা প্রাথমিক স্কুলে যায়। কিন্তু প্রথম থেকে প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়েও বিশেষ কিছু শেখেনা। শহরের হাওয়ার সান্নিধ্যে এসে আঞ্চলিক অধিবাসীদের মধ্যে কেক কেটে, বেলুন লাগিয়ে,ব্যান্ড বাজিয়ে জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ চালু হয়েছে।
ফেসিয়াল করা, উত্সবে ব্যান্ড বাজিয়ে চূড়ান্ত আধুনিক নাচ করা, চুলের বাহার, পোশাকের বাহার সবই আয়ত্ব করেছেন। কিন্তু অসুখ / বিশুখে মূলত ঝাঁড়ফুঁক/তুকতাক এর আশ্রয় নেন, খুব জোর অঞ্চলের হাতুড়ে ডাক্তার দের কাছে যান। কিন্তু সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে খুব কম লোক যান, তাও লোকাল হাতুড়ে ডাক্তাদের  পরামর্শ, একেবারে শেষ পর্যাযে।
----

শহর ভিত্তিক সংস্কৃতির জীবনের অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বা অন্যান্য কুপ্রভাব গ্রামের সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবন যাত্রার উপর অনেকটাই  প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু তার বিজ্ঞান সম্মত বিষয়গুলি সম্পর্কে অজ্ঞতা আর শিক্ষাগত নীচু মানদন্ডের সমস্যা আগের মতই থেকে গেছে। উপরের শহুরে চাকচিক্য এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অনীহা থেকে গেছে। তারই ফলে বিশুর মত টগবগে মানুষদের অকালে বিনা চিকিত্সাতে মরতে হয়। কে এর দায় নেবে ! কে জ্বালবে প্রকৃত জ্ঞানের আলো !

__________________________________________________________________________________________















































25 Jul 2015

আজকের খনা


আজকের খনা 
**********

আমি জানি ,
পুরাকালে খনার জিভ কেটে ফেলতে হয়েছিল ,
কারণ মানুষ তাঁর বচন কে সত্য বলে মানত।
আজ দুর্বৃত্তরা আমার জিভ কেটে দিয়েছে
আমার সত্য বচনের ভয়ে।
আমি নীরবে ওদের কুপ্রস্তাবে রাজী হইনি
এই দোষে।  এটা আমার ঔদ্ধত্য,
সারা শরীরে ওদের অত্যাচারের ক্ষত নিয়ে,
আমি রুখে দাঁড়িয়েছি
সহস্র বছরের অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
আমি সদম্ভে ঘোষণা করেছি
জনতার সামনে ওদের
নোংরা মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার।
এত স্পর্ধা ওরা অতীতে সহ্য  
করেনি, আজও করবেনা।
কিন্তু ওরা ভুলে গেছে
একটা খনা লাখো খনার জন্ম দিয়ে গেছে ,
আজ তারা উঠে দাঁড়িয়েছে ,
জোট বেঁধেছে, তারা আর
একা পড়ে মার খাবেনা।
-----------------------------


17 Jul 2015

আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র

আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র 
*********************
সত্তর দশকের একটি ব্ল্যাক আউট এর রাত। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। কলকাতা শহরের চিত্পুর আর হ্যারিসন রোডের ক্রসিং এ বাসস্টপে একটি কিশোরী তার এক সাথীর জন্য অপেক্ষারত। এদিকে ওদিকে আরও কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। মন হচ্ছে সবাই বাসের অপেক্ষায়ে। কিশোরীর ঠিক পেছনে একজন অতি সাধারণ জামা কাপড় পরা মানুষ দাঁড়িয়ে। তাঁর দোহারা চেহারা, পেশীবহুল দুটি হাত। দেখে মনে হয় সম্ভবত কোন কঠিন শ্রমজীবি কাজের সাথে যুক্ত। মানুষটি সতর্ক দৃষ্টিতে মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন।
---

একের পর এক বাস আসে, চলে যায়, কিন্তু কিশোরীটির বাসে ওঠার জন্য কোন তত্পরতা দেখা যায় না। অন্ধকার রাত, কারফিউ জারি হয়েছে। বেশীর ভাগ লোকজন বাস ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরার জন্য উদগ্রীব। কিশোরিটি একটা লাইট পোস্টে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। শ্রমজীবি মানুষটি অনেকক্ষন ধরে উদগ্রীব চিত্তে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে, কিশোরীকে প্রশ্ন করেন, " দিদি কোন বাসে উঠছো না কেন ?" "আমার বাস এখনো আসেনি", সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে। "কেন অনেকক্ষণ ধরে তুমি দাঁড়িয়ে। কত বাস তো এলো, গেলো। কত নম্বর বাসে যাবে তুমি ?"
"আমি... দেখি..দেখা যাক। " ছাড়া ছাড়া জবাব দিয়ে চুপ করে যায় মেয়েটি।
---

"কত নম্বর বাসে যাবে জানোনা ! সবাই একে একে বাসে উঠছে এই অশান্ত সময়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী যেতে ব্যস্ত। তুমি দাঁড়িয়ে আছ তো আছই !রাত বাড়ছে, কত নম্বর বাসে যাবে ঠিক করে বল ?"
"দেখি , কত নম্বর বাস পাই,"আবারসেই কাঠ কাঠ উত্তর। কিছুক্ষন নীরবতা। "ঠিক করে বলতো তুমি কোথায় যাবে? কত নম্বর বাসে যাবে ? একগাদা বাস চলে গেল !" অধৈর্য ভাবে বলেন তিনি। "আপনার কি দরকার ?আমি কোথায় যাব আর কত নম্বর বাসে যাব ?" - রুক্ষভাবে বলে মেয়েটি।
---

লোকটি হাঁটা দেয়। কিন্তু একটু গিয়েই আমার ফিরে আসে। কিশোরীটি পাশে দাঁড়ায়। আবার ও কিছু বাস চলে যায়। তখন তিনি প্রশ্ন করেন," কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন ? কত বাস তো গেল। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে তুমি দাঁড়িয়ে আছ।" এবার কিশোরী টি আর কোন উত্তর দেয় না। দু /একটা  বাসের দিকে এগিয়ে যায়। বাস ধরার ছল করে, কিন্তু কোন বাসে ওঠেনা। "কি হলো বাসে তো উঠলে না , কেন ?" "ভীষণ ভীড়, তাই উঠলাম না। " "মোটেও বেশি ভীড় ছিল না, তুমি ইচ্ছে করলেই উঠতে পারতে !" "ভীড় কি ভীড় না, আমাকে ঠিক করতে দিন।" রাগত স্বরে উত্তর করে মেয়েটি।
---

এতক্ষণ চাপা গলায় কথাবার্তা চলছিল। আস্তে আস্তে মেয়েটির গলা একটু চড়ে যায়। লোকটি এবার কঠিন গলায় প্রায় আদেশের সুরে বলে," এবার যে বাস আসবে তাতেই উঠে যাবে।আর কোন কথা নয়। আর দাঁড়াবেনা।"
"মেয়েটি ক্ষেপে যায়,"আপনার কি, আমি কি করবো, আমি ঠিক করবো, আপনি বলার কে!" আসে পাশে একটা অদৃশ্য অস্থিরতা অনুভূত হলো - দুজনেই বুঝলো। মেয়েটির এতক্ষনে ভাবলো, লোকটি সাদা পোশাকে পুলিশ নাকি! মানুষটিও একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও তার পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেলো। ইতিমধ্যে মেয়েটির সাথী এসে গেলো, "অনেক দেরী হয়ে গেলোরে। অনেকক্ষণ তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। "
---

তার আগমনে শ্রমজীবি মানুষটি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তিনি নবাগত ছেলেটির হাত ধরে নীচু গলায় বললেন "দাদা আপনি ভাগ্যিস এসে পড়েছেন। পেছন দিয়ে খেয়াল করে দেখুন একটা মাস্তান গ্যাং রয়েছে। দিদি তো কিছু খেয়াল করছেনা। একলা হলেই দিদিকে তুলে নিয়ে যাবার প্ল্যান করছে। অনেকক্ষণ তো ভীড় ছিল। কিন্তু ক্রমাগত হালকা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিদিকে ছেড়ে যেতে পারছিনা। তাই এতক্ষণ ধরে দিদিকে তাড়াতাড়ি  বাসে উঠে চলে যেতে বলছিলাম। এত কথা তো বলতে পারছিলাম না। দিদি জানে না বলে রেগে যাচ্ছিলো।"
---

মেয়েটির বন্ধু উপকারী, সাহসী মানুষটিকে হাত ধরে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন। ইতিমধ্যে তিনজনে শিয়ালদহ স্টেশন এর দিকে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন। স্টেশনের কাছে পৌঁছে মানুষটি বিদায় নিলেন। বন্ধুটির কাছে সব কথা শুনে মেয়েটি স্তম্ভিত হয়ে গেলো। নিজের ব্যবহারে ভীষণ লজ্জা পেল।
কত বড় মাপের একজন মানুষের সান্নিধ্যে এতক্ষণ সে ছিল - অতি সাধারণ এক মানুষের  অসাধারণ মানবিকতা, সাহসিকতা আর পরার্থপতার কথা ভেবে অভিভূত হয়ে গেল। সারা জীবনেরর অভিজ্ঞতার  ঝুলি তে এক অমূল্য রত্ন যোগ হলো।
----

আজ চল্লিশ বছর পরেও সেদিন হটাত আকাশের  উজ্জ্বল যে নক্ষত্র টা ছিটকে এসে পৃথিবীর মাটিতে পড়েছিল তার আলো আজও এতটুকুও ম্লান হয়নি। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় এই অজস্র ঝিকমিক করা বাকি নক্ষত্রগুলি আজ কোথায় গেলো, - তারা কি হারিয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে মনে হয় - তারা হারিয়ে যায়নি, মহাবিশ্ব প্রসারিত হবার সাথে সাথে তাদের সংখ্যা চোখে দেখা না গেলেও বেড়ে চলেছে। সেই উজ্জল নক্ষত্ররা বেঁচে আছে আর বেঁচে থাকবে শহীদ বরুন বিশ্বাস, অরূপ ভান্ডারী, তপন দত্ত, রাজীব দাস, সৌরভ চৌধুরীদের মধ্যে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------























14 Jul 2015

মানুষের স্বর্গ

মানুষের স্বর্গ
*********


খড়দা স্টেশন। কারফিউ এর রাত। সত্তর দশক। ট্রেন থেকে নামল এক কিশোরী। বয়স তার ১৬ কি ১৭। নাম মৃত্তিকা। কাঁধে একটা বড় সড় ব্যাগ। তাতে ভর্ত্তি তার রাজনৈতিক পার্টির কাগজপত্র। যদিও সেই পার্টি আইনগত ভাবে বেআইনি সংগঠন বলে ঘোষিত হয়নি। কিন্তু কোন ব্যক্তি তার সাথে যুক্ত থাকলে, এমন কি জড়িত বলে সন্দেহ করলে, অথবা তার পত্র পত্রিকা কারো কাছে পাওয়া গেলে, তাকে পুলিশ আটক করতে, শারীরিক / মানষিক নির্যাতন করতে,  জেলে বন্দী করতে এমন কি হত্যা করতেও পারতো। সেই পার্টির মতাদর্শ কে সমর্থন করাও বেআইনি বলে মনে করা হতো।
---

বড় রাস্তায় মিলিটারী টহল চলছে, পাড়ায় পাড়ায় চিরুনি তল্লাশি চলছে। তাই যাত্রীদল বড় রাস্তা এড়িয়ে গলিঘুচি দিয়ে বাড়ীর পথ ধরলো। মৃত্তিকা চললো তাদের পিছু পিছু। একে একে পথচারীর সংখ্যা কমতে থাকে - টুপটাপ যে যার বাড়ী ঢুকে পড়ে। অবশিষ্ট দুটি মাত্র যাত্রী।  মৃত্তিকা আর ধুতি, খদ্দরের জামা পরা এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। মাথায় তার গান্ধীটুপী। তিনি কোমল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করেন ,"তুমি কোথায় যাবে মা ? কোথায় বাড়ী তোমার ?" মৃত্তিকা ঢোক গেলে,  -- "আমার বাড়ী !"
---

বস্তুত পক্ষে এটা তার দ্বিতীয় দিন খড়দা অঞ্চলে। ঠিক আগের রাতে অন্ধকারে সাময়িক কদিন শেল্টারের জন্য সে তার এক পার্টি কমরেডের সাথে তার দিদির বাড়ী এসেছে। এ অঞ্চলটা তার একেবারে অচেনা অজনা। পথঘাট কিছুই চেনা হয়নি। এমনকি বেশী রাতে আসার ফলে বাড়ীর কারোর সাথে আলাপ হয়নি, কারো নাম, পদবী  পর্যন্ত জানা হয়নি। সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। একমাত্র তার পার্টি কর্মীর একটা ডাক নামটা শুধু জানে, যে এ বাড়ীর বাসিন্দা নয়। অধিক রাত হবার ফলে তারা দুজনও তাড়া তাড়ি শুয়ে পড়ে।
---

পার্টির বিশেষ জরুরী কাজে সাত সকালে মৃত্তিকা কে বার হতে হয়। বড় রাস্তা থেকে একটা গলির  চার নম্বর বাড়ী আর গলির দুই পাশে দুটো বড় ওষুধের আর স্টেশনারী দোকান - এইটুকু নিশানা মনে গেঁথে নিয়ে কাকভোরে বড় রাস্তা ধরে সোজা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা চলে যায়। একমাত্র বন্ধুর দিদি জামাইবাবু দুজনেই কলকাতায় টেলিফোন ভবনে কাজ করেন এটুকু কথাই তার জানা ছিল। বাড়ীর নম্বর, গলির  নাম  কিছুই জানা নেই। ঠিক করে রেখেছিলো ফিরে বাড়ীর লোকজনদের সাথে আলাপ পরিচয় করে নেবে, এলাকা সম্পর্কে খোঁজখবর করে নেবে। কিন্তু বিধি বাম - হটাত কারফিউ জারী হয়ে গেছে। 
---

বৃদ্ধের প্রশ্নের কি জবাব দেবে সহসা ভেবে পায়না মৃত্তিকা। কিছুতো একটা বলতেই হবে। আমতা আমতা করে বলে , "দিদির বাড়ী যাব।" " গলির নাম কি ? কত নম্বর বাড়ী মা ?" " নম্বর টা তো জানিনা। দিদিরা নুতন এসেছে এখানে। আমিও কাল রাত্রে জামাইবাবুর সাথে এসেছি। এখানকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনিনা। বড় রাস্তা দিয়ে, একটা গলির মধ্যে বাড়িটা, গলির দু পাশে দুটো বড় দোকান আছে। আমি সকল বেলায় কলকাতায় কলেজে চলে গেছিলাম।" " পাগলী মেয়ে, বড় রাস্তা থেকে অনেক গলি আছে আর ওরকম অনেক দোকানও আছে। তাছাড়া বড় রাস্তায় তো এখন যেতেই পারবেনা। মিলিটারী টহল দিচ্ছে যে। পাড়ায় পাড়ায় চিরুনি তল্লাশি চলছে। বাড়ী বাড়ী ধর পাকড় হচ্ছে। এভাবে ঘুরে বেড়ানো তো একেবারে ঠিক হচ্ছে না। তা তোমার দিদি জামাইবাবুর নাম কি?" কোনমতে মাথা নীচু করে দুটি নাম বানিয়ে বলে মৃত্তিকা।
---

বাড়ীর নম্বর, রাস্তার নাম জানেনা বলে পার পাওয়া গেছে। কিন্তু নিজের দিদি / জামাইবাবুর নাম জানে না তাতো বলা যায় না। বৃদ্ধ মানুষটি চিন্তিত মুখে বলেন, " নতুন এসেছেন তাঁরা। নাম দিয়ে তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা ! কোথায় কাজ করেন বলতে পারবে?" এবার খোলা মনে বলে মৃত্তিকা, "ওঁরা  দুজনেই কলকাতায় টেলিফোন ভবনে কাজ করেন।" "বাঃ, এখন খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে অনেকে আছে যাঁরা সেখানে কাজ করেন। আমি চিনি তাঁদের, চল তোমাকে নিয়ে যাই। তাঁরা নিশ্চয় চিনবেন তোমার দিদিদের।" একের পর এক , প্রায় সাত / আট টা বাড়ী নিয়ে গেলেন তিনি।
---

কারফিউ চলছে, নির্জন, নিঃস্তব্ধ রাত।  বড় রাস্তা থেকে মিলিটারী দের মার্চের খটখট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা দুই তিন তারা এ গলি, সে গলি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দুটো অলীক নামের ঠিকানা কে দেবে ! পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ীতে বাড়ীতে তল্লাশি চলছে।এভাবে ঘুরে বেড়ানো ভীষন ভাবে বিপদজনক। ব্যাগ ভর্তি পার্টির পত্র পত্রিকা। ধরা পড়লে শুধু তার নয়, এই দয়ালু, নিরাপরাধ, বৃদ্ধ মানুষটি ও রেহাই পাবেননা। শীতের রাত। মৃত্তিকা মনে মনে নিজেকে অপরাধী মনে করে লজ্জিত বোধ করে। কিন্তু এই অজানা অচেনা জায়গায় তার কি করা উচিত ভেবে পায় না। সারা শরীর ঝিম ঝিম করতে থাকে। মাথা টা ভারী হয়ে আসে। তার জন্য নিরীহ, নিস্পাপ মানুষটি  কে অমানুষিক অত্যাচারের মুখে পড়তে হবে, এটা ভাবতেই সে মনের একটা জোর ফিরে পায়। বলে," মেশোমশাই অনেক রাত হয়ে গেছে, আপনি এবার বাড়ী যান, সেখানে সবাই চিন্তা করছে। আমি ঠিক খুঁজে পেয়ে যাব।" "কি বলছো তুমি , এই বিপদে এত রাতে তোমাকে ফেলে আমি বাড়ী চলে যাব , সেটা হয় ! বরং আমি বলি কি মা, আজ রাত তুমি এই বুড়ো ছেলের বাড়ীতে থাক। কাল সকালে আলো ফুটলে আমার মেয়ের সাথে তোমার দিদির বাড়ী খুঁজে নিও। আমার নাম রনজিত সরকার " স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা। তবুও কুন্ঠিত স্বরে বলল," মেশোমশাই আমাকে বাড়ী নিয়ে গেলে কোন অসুবিধা হবে না তো।" " বিপদের সময়ে মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তবে তো  মানুষ জন্ম ই বৃথা মা "- সাবলীল ভাবে উত্তর এলো। 
---

রাত প্রায় বারোটায় দুইজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের বাড়ী পৌঁছালো। পুরো পরিবার চরম উত্কন্ঠায় সময় গুণছে। পরিবারের মাথা, বৃদ্ধ মানুষটি সকাল দশটার ট্রেনে কলকাতায় অফিসের জন্য বেরিয়েছেন রোজের মতন। সন্ধ্যা নয়টার ট্রেনে বাড়ী ফেরেন প্রতিদিন। স্টেশন থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ।  কিন্তু প্রায় মাঝ রাত পর্য্যন্ত না ফেরায়, স্বাভাবিক ভাবে সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এদিকে হটাত করে একযোগে কারফিউ, চিরুনী তল্লাশী, ছুতায় নাতায় মিথ্যা সন্দেহে অত্যাচার, ধর পাকড়, গুলি গোলার আওয়াজ - সবাই দূর্ভাবনায় তঠস্থ, চূড়ান্ত বিপর্যয়ের আশঙ্কায় প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম।
---

"ওঃ তুমি তবে অবশেষে ফিরতে পেরেছো", তাঁর স্ত্রী ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেন। সারা পরিবার তাদের ঘিরে ধরলো।পরিবারে মোট সাতজন সদস্য - বৃদ্ধ, তাঁর স্ত্রী, বিধবা বোন, ছেলে, ছেলের বউ, একটি মেয়ে আর একটি ছোট্ট নাতনী। নিম্নমধ্য পরিবার। পূর্ববাংলার মানুষ। তাঁর আর ছেলের - দুজনের রোজগারে সংসার চলে। ঘরের পরিবেশ সাদামাটা - কিন্তু পরিস্কার পরিছন্ন। বেড়া আর টালির ছাদ দেওয়া দুটি শোবার ঘর, একটি লম্বা দালান, তার এক পাশে ছোট্ট রান্না ঘর , আর বাথরুম। শুধু সযত্নে শহীদ ভকত সিং এর বিরাট একটা ছবি সারা বাড়ী আর পরিবারের অন্তর আত্মা আর স্বত্তা কে মেলে ধরেছে।
---

"আরে দাঁড়াও, আমাদের  একটু নিঃস্বাস নিতে দাও। এই মেয়েটি এখানে ওর দিদির বাড়ী নতুন এসেছে, কিন্তু অন্ধকারে গলি ঘুচি দিয়ে আসতে গিয়ে রাস্তা হাড়িয়ে ফেলেছে। আমরা দুজন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম এতক্ষণ। খুঁজে না পেয়ে বাড়ী নিয়ে এলাম। রাতে কষ্ট করে বুড়ো ছেলের বাড়ী থাকুক। কাল সকালে কেউ সঙ্গে গিয়ে ওর দিদির বাড়ী পৌঁছে দেবে।"
---

"আহারে মেয়ের আমার এই ধকলে মুখ শুকিয়ে গেছে , তা যা অমানুষিক অত্যাচার চলছে - এই জঙ্গলের রাজত্বে  মানুষের মাথা ঠিক রাখাই মুশকিল। তা এত রাত পর্য্যন্ত তোমাদের এই বিপদের মধ্যে বাড়ী খোঁজা একবারেই ঠিক হয়নি। প্রথমেই এখানে চলে আসা উচিত ছিল। কিছু অঘটন যে ঘটেনি এই আমাদের ভাগ্য। তা তোমার নাম কি মা?"
মৃত্তিকা এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিলো। একবারের জন্যও কেউ তাকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করেনি। তার জন্য তাঁদের বাড়ীর কর্তার যে কত বড় বিপদ হতে পারত সে কারনে উটকো আপদ বলেও ভাবেনি। "আমার নাম মৃত্তিকা।"
---

বাড়ীর গৃহিণী সঙ্গে সঙ্গে রাশ ধরলেন। মেয়েকে বললেন," মিনি মা, ওকে কলঘরে নিয়ে যাও হাতমুখ ধুয়ে নিক। তোমার জামা কাপড় ওকে পরতে দাও। আর বড় ঘরে সবার বিছানা কর। তোমার সাথে ওর শোবার ব্যবস্থা কর। ছোট ঘরে দাদারা যেমন শোয় তেমন বিছানা করে দাও।" পুত্রবধূকে বললেন," চল শিখা মা আমরা খাবার ব্যবস্থা দেখিগে।অনেক রাত হয়েছে, আর দেরী করা ঠিক হবেনা।"
---

হাতমুখ ধুয়ে সবাইয়ের সাথে খেতে বসল মৃত্তিকা। মেঝেতে আসন পেতে গোল হয়ে সবাই খেতে বসেছে। সবচেয়ে ভাল জায়গাটি তার জন্য বরাদ্দ হলো। খুব সাধারণ খাবারের ব্যবস্থা - ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ নুন, তেল, আর লঙ্কা দিয়ে মাখা আর একটা নিরামিষ তরকারি। কিন্তু আন্তরিকতার অনবদ্য ছোঁয়াতে সাধারণ খাবার অসধারণ হয়ে উঠেছে।পাছে সে লজ্জা করে, কম না খায় - সবাই খেয়াল রেখেছে। কি অপরিসীম আন্তরিকতা আর আদর !সামান্য সময়ের আলাপ, মৃত্তিকার বানানো পরিচয়। কিন্তু কোন অবিশ্বাসের বা সন্দেহের  বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই কারও মনে। সকলেই সহৃদয়তায় আর মানবিকতায় ভরপুর। বাড়ীর সবাই যেন একছাঁচে গড়া। সরলতা, বিশ্বস্ততা, সততায় পরিপূর্ণ সকলেই। এ যেন অন্য এক জগৎ। মাটির এই পৃথিবীতে এঁরাই গড়ে তুলেছে মনুষ্যত্বের মহান স্বর্গ।
---

রাত্রে  সে আর মিনি পাশপাশি শুয়ে অনকেক্ষণ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে মৃত্তিকা স্বপ্ন দেখল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁদের পাহাড়' এ সে আর মিনি বেড়াচ্ছে। হটাত 'বুনিপ' এসে তাদের দুজন কে আক্রমন করেছে। ঠিক সেই সময়ে কেউ তাকে ধাক্কা দিচ্ছে," উঠে পড়, মিটি, অনেক বেলা হয়ে গেছে। চা আর জলখাবার নিয়ে বৌদি আর মা বসে আছে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে খাবি চল।" চমকে উঠে বসে সে, হটাত ঘুম ভেঙে থতমত খেয়ে যায়। চেয়ে দেখে চারিদিক আলো ঝলমল করছে। স্বপ্নের জগৎ থেকে নেমে আসে বাস্তবের মাটিতে। রাতের বিভীষিকা কেটে গেছে।
----

মিনিকে বলে," তুই আমাকে বড় রাস্তায় পৌঁছে দিলে আমি আমার দিদির বাড়ী খুঁজে নিতে পারবো, যাবি একটু আমার সাথে।" "অবশ্যই পৌঁছে দেবো, কিন্তু আগে খেয়ে নে।" খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোবার সময় পুরো পরিবার এসে ঘিরে দাঁড়ায় তাকে। মিনির দাদা বলেন," মিনি ওকে একেবারে ওর দিদির বাড়ী পৌঁছে দিবি , ও কিন্তু এখানকার কিছুই চেনেনা।" রনজিত বাবু তার মাথায় হাত রেখে কাঁপা গলায় বলেন, "মাটা আমার বড় কষ্ট পেয়েছে কাল রাতে। আবার আসিস মা এই বুড়ো ছেলেটাকে দেখতে। আর সাবধানে থাকবি। আজকাল দিনকাল ভাল না।" মাসীমা কে প্রনাম করে
মৃত্তিকা বলে ,"যাই মাসীমা।" "যাই , বলতে নেই, বল আসি।" বলে চিবুক ধরে আদর করে দিলেন। বৌদি বললেন, "আমাদের ভুলে যাবে নাতো !আবার এস কিন্তু। "
---

মৃত্তিকা কোনমতে চোখের জল চাপলো। কাল রাতে সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল একরাশ বিপদের ঝুঁকি। যদি রাতে এ বাড়ী টাতে তল্লাশি হতো, তার ব্যাগ ভর্ত্তি কাগজ পত্রের জন্য বাড়ীর সবাই বিপদে পড়তো। বিশেষ করে রনজিত বাবু ও তাঁর ছেলে। এক অজানা, অচেনা মানুষকে কত অনায়াসে তাঁরা  সবাই আপন করে নিয়েছেন , একবারের জন্যও অবিশ্বাস করেননি। মানবিকতা আর সহৃদয়তার মূর্ত প্রতিক। এরাই তো পৃথিবীতে তাদের স্বপ্নের স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এঁদের মত মানুষ দের খুঁজে বার করাই তো তাদের ব্রত। শ্রধ্বা আর কৃতজ্ঞতায় তার মন পরিপূর্ণ হযে উঠলো। "সত্যই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কত মহৎ"- এই কথা ভাবতে ভাবতে মিনির সাথে রওনা দিল।

+++++++++++++++

প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর কেটে গেছে। সেদিনের কিশোরী মৃত্তিকা আজ ষাটোর্ধ ,স্বামী পুত্র নিয়ে পুরোপুরি সংসারী। এক রাতের আশ্রয়ে থাকা সেই পরিবার, সেই পরিবারের  মহান বৃদ্ধ গৃহকর্তার কথা আজও মনে পড়ে। তাঁরা অগাধ বিশ্বাস আর আদরে এক অজ্ঞাত কুলশীল কে সমাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন - চরম বিপদ মাথায় নিয়ে তাকে রক্ষা করেছিলেন বিপর্যয়ের হাত থেকে। মাঝে মাঝে সে ভাবে আজ সে নিজে কি পারবে,ওই  চূড়ান্ত কঠিন সময়ে, ওই রকম পরিস্থিতিতে ওই ভাবে অজানা অচেনা উটকো কোন মানুষ কে নির্দ্বিধায় নিজের বাড়ীতে আশ্রয় দিতে, আপনজনের মত বুকে টেনে নিতে !

___________________________________________________________________________________________

সত্যঘটনা অবলম্বনে। প্রথম প্রকাশিত 'কালপ্রতিমা সাহিত্যপত্রে,  জানুয়ারি ২০০১, সপ্তম বর্ষ,  চতুর্থ সংখ্যা।'
____________________________________________________________________________________________-























  






























30 Jun 2015

জাহানারা

জাহানারা
*******

জেল হাসপাতালের এক কোনে পড়ে থাকতো জাহানারা। বয়েস দশ / এগারো।  ছোটখাটো শীর্ণ শরীরের সাথে বেডপ পেটটা একেবারে বেমানান। নির্বাক, ভাবলেশ হীন ভাবে বসে থাকে। কেউ কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে শুধু বিহ্বল, ভাবলেশহীন চোখদুটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কখনো কখনো সেখানে একটা তীব্র আতঙ্ক আর বিতৃষ্ণা ঝিলিক দিয়ে যায়  - কিন্তু মুখে কোন কথা নেই।

---

কী ভয়ঙ্কর অপরাধ করে ও জেলে এসেছে! কোন মারাত্মক অন্যায়ের ভারে এই ছোট্ট মেয়েটা এমন মূকবধির! ক্ষিদে, তৃষ্ণা, ঘুম কোন প্রয়োজন ই কি ওর আর  নেই ! বেশীর ভাগ সময় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। ঘুমায় কিনা বোঝা ভার। দয়া করে কোন সহবন্দিনী ওর প্রাপ্য খাবার টুকু এনে দিলে, হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। কান্না নেই, হাসি নেই, কথা নেই  - ও যেন নিজেই নেই জগতের মানুষ। মাঝেমধ্যে শুধু অভিব্যক্তি হীন চোখ মেলে গরাদের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। পেটটা ওর বড় হতে থাকে দিনের পর দিন। মাস কয়েক পর বোঝা গেল জাহানারা গর্ভবতী।

---

একদিন মাঝ রাতে সে একটি শিশুর জন্ম দিল। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তিতে কোন সাড়া জাগলোনা। নবজাতক ক্ষিদেতে চিত্কার করে। সারা হাসপাতাল বিব্রত বোধ করে, শুধু জাহানারার কোন হেলদোল নেই। মেট্রন / ওয়ার্ডার রা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। মাঝেমধ্যে দু / চার ঘা বসিয়েও দেয় - "দে। তাড়াতাড়ি বাচ্চাকে দুধ দে, নইলে মেরেই ফেলবো তোকে। সারা জেলহাসপাতাল মাথায় করে রেখেছে, যত সব বেজন্মার দল।" দু / চার ঘা লাঠির বাড়ি বা অকথ্য গালাগালি , কিছুতেই বিকার নেই। জীবনের প্রতি কোন মায়া নেই, নেই আকর্ষণ - না বাচ্চার প্রতি কোন টান, না নিজের প্রতি কোন খেয়াল - কিছুই নেই, যেন প্রাণহীন একটা জড় পদার্থ।

---

কদিন পরে জাহানারার বাবা - মা এলেন অসুস্হ মেয়ের সাথে দেখা করতে। বাবা এক ছোটখাটো বিস্কুট কারখানার শ্রমিক, মা লোকের বাড়ীতে বাড়ীতে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা ইত্যাদি কাজ করে বেড়ান। তাদের স্বল্প আয়ের মধ্যেই সাধ্যমত জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। জাহানারা সেসবের দিকে চোখ তুলেও দেখলো না। মা স্নেহভরে গায়ে  হাত বুলাতে লাগলেন। বাবা মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে স্নেহভরে কত কথা বলার চেষ্টা করলেন। মেয়ে নিশ্চুপ, উপুড় হয়ে মুখ গোঁজ করে শুয়ে থাকলো।

---

শেষমেষ মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিব্রত বাবা শোনালেন মেয়ের অপরাধের কাহিনী। অভাবের সংসারে মেয়েকে কোন এক উচবিত্ত পরিবারে কাজে লাগিয়ে ছিলেন, অন্তত পক্ষে পেট ভরে দুটো খেয়ে বেঁচে থাকবে এই আশায়।প্রথম কটা মাস ঠিকঠাক চলছিল। একদিন বাবুর বাড়ীর  নববিবাহিত ছেলে-বউ  সন্ধ্যাবেলায় সিনেমা দেখতে গেল। বাড়ীতে রইলেন তাদের বাবা, বাড়ীর মালিক। বয়স ষাট / বাষট্টি হবে, শক্তপোক্ত চেহারা , রাশভারী মানুষ। ফাই ফরমাস খাটার জন্য রইল জাহানারা। ঠিকে রাঁধুনি রান্নাবান্না সেরে বাড়ী চলে গেল। বড়বাবু রাতের খাবার খেয়ে শুতে  যাবার সময়ে জাহানারা কে এক জগ খাবার জল শোবার ঘরে পৌঁছে দিতে আদেশ করে গেলেন।

---

জাহানারা জল নিয়ে ঘরে গেল। "শোন, জলটা টেবিলে রেখে আমার মাথাটা ভাল করে ম্যাসাজ করে দে। মাথাটা খুব ব্যাথা করছে।  তাছাড়া তোর তো এখন কোন কাজ নেই। আয় এইখানে আমার বিছানার পাশে বস " - আদেশ দিয়ে বিছানায় শুলেন তিনি।  ছোট্ট মেয়েটা ছোট ছোট হাত দিয়ে বড় বাবুর মাথা টিপতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই  প্রবীন মানুষটির মধ্যে পশুবৃত্তি জেগে ওঠে, জাহানারা কে দুহাতে বিছানায় টেনে নেয়। মেয়েটি তখন সবে মাত্র শৈশব থেকে কৈশরে পা রাখতে চলেছে। একেবারে সরল সহজ মেয়ে, জীবনের অনেক কিছু তার অজানা। তবু তার মনের মধ্যে একটা দারুন ভীতির সঞ্চার হল। বার বার তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। বাবু তখন ভয়ংকর আর বেপরোয়া - ভাল করে কোন কিছু বোঝার আগেই সর্বনাশ হয়ে গেল জাহানারার।

----

প্রচন্ড হিংস্রতার সাথে ধর্ষিত মেয়েটি  জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে। এদিকে সিনেমা থেকে ফিরে ছেলে - বউ সব বুঝতে  পেরে তড়িঘড়ি গাড়ী করে জাহানারাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে যায়, বলে হটাত অসুস্হ হয়ে পড়েছে। পাড়ার ডাক্তার আসার পর সব খোলসা হয়ে যায়। বস্তিবাসীরা দল বেঁধে থানায় নালিশ জানায় পুলিশ এসে জাহানারাকে ভিক্টিম হিসাবে থানায় নিয়ে যায়। বাড়ীর লোকজন কে কদিন পরে শেয়ালদা কোর্টে হাজিরা দিতে বলে যায়। থানায় অসুস্থ মেয়েটির উপর চলে নানা পরীক্ষা - নিরীক্ষা, জিজ্ঞাসাবাদ, সেই  সঙ্গে নানা কদর্য্ রসিকতা।

---

সুবিচারের আশায় জাহানারার বাবা - মা কয়েক জন বস্তিবাসীকে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে  সকল দশটা থেকে শেয়ালদা  কোর্টে অপেক্ষা করতে থাকে। সারা দিন তারা পুলিশ, কোর্টবাবু, উকিল ইত্যাদি সবার কাছে চরকির মত পাক খান , কিন্তু কি হচ্ছে, কি হবে কিছুই তাঁদের বোধগম্য হয়না। শুধু বুঝলেন সরকার বাহাদুর জাহানার জন্য সরকারি উকিলের ব্যবস্থা করবেন, যেহেতু পয়সা খরচ করে উকিল রাখার ক্ষমতা তাদের নিজেদের নেই।

---

সারা দিন খাওয়া দাওয়া নেই,  শেয়ালদা কোর্টে  বসে রইলেন তাঁরা। বিকালের দিকে তাঁরা দেখলেন তাঁদের নাবালক ধর্ষিতা কন্যা কে পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে। আর ধর্ষক বড়বাবু বুক ফুলিয়ে ছেলের সাথে কোর্টের গেট দিয়ে বেরিয়ে নিজেদের গাড়ীতে উঠছে। জাহানারার বাবারা দৌড়ে গিয়ে থানার ওসিকে জিজ্ঞাস করলেন, "একি রকম বিচার হলো পুলিসবাবু। আমাদের নির্দোষ নিস্পাপ মেয়েকে তোমরা ধরে নিয়ে কোথায় চলেছো ! আর ওই দিকে অপরাধী যে দিব্ব্যি ছাড়া পেয়ে গাড়ী চড়ে নিজের বাড়ী চলে গেল ?"
---

ওসি উত্তরে বললেন, - "আরে ব্যাটা মুর্খের দল, যতোক্ষণ না প্রমান হচ্ছে উনি দোষী, ততক্ষণ জামিনে ছাড়া থাকবেন । আর তোদের মেয়ের যাতে কেউ কোন ক্ষতি না করতে পারে, তাই ওকে জেলে সরকারি হেপাজতে, মানে হলো গিয়ে রেপ কেসের ভিক্টিম হিসাবে প্রেসিডেন্সি জেলে সেফ কাস্টডিতে  রাখা হবে " জাহানারার বাবা-মা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন, "বাবু আর  কি ক্ষতি ওর হবে, বরং বাড়ী নিয়ে গেলে আমাদের কাছে আদরে থাকবে। তোমরা তো সব জানো। ওই লোকটাকে ধরে রাখো না কেন !" "যা যা, আমাদের উপদেশ দিস না, আইনের বুঝিস কিছু ? বিরক্ত করিসনা। " "একজন বস্তি বাসী উত্তর দেয় ," না বাবু, যে আইন দোষী কে ছেড়ে দিয়ে, নির্দোষী কে জেলে রাখে, সে আইন বুঝা মোদের কম্ম নয়। "

---

এতক্ষন সবাই জাহানারা বৃত্তান্ত শুনছিলো। হটাত করে ডুকরে কেঁদে ওঠে মীরা, কোলে তার হার জিরজিরে একটা বাচ্চা লেপ্টে আছে। জাহানার বাবা অবাক হয়ে তাকান। শান্তিবাই বলে ," ওর একই কেস , গত দুবছর ধরে এখানেই আছে। আর ও কত যে এরকম কেস আছে, তোমরা ধারণা করতে পারবে না। এই দেখোনা, আমাকে গাঁয়ের মোড়লের ছেলে ভালবাসার ভান করে সর্বনাশ করেছে। দিন গুনছি চাচা, যেদিন ছাড়া পাবো, শয়তান টার মজা দেখাবো।"

---

জাহানারার বাবা বুঝতে পারেন সুবিচারের প্রত্যাশায় অনেক  ভিক্টিম জেলের সেফ কাস্টডি পচছে। তবু আশা মরেও মরে না। যাবার সময় মেয়ের হাতদুটি ধরে অনেক বোঝালেন, "বাচ্চা টাকে দুধ খাওয়া মা। উকিল বলেছে এই বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে, ওর রক্তের সাথে শয়তান টার রক্ত মিললে , দোষী প্রমান করা যাবে ,আর শাস্তি হবে। " মেয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলো, আর তার জন্য আনা জিনিস পত্র পড়ে রইলো অবহেলায়।

---

জাহানারার বাবা মা যাবার সাথে সাথে লোভী ওয়ার্ডার আর তাদের দালাল কয়েদীদের মধ্যে তার বাড়ী থেকে আনা জিনিসপত্র ভাগাভাগি হয়ে গেল। কিন্তু সে একই ভঙ্গীতে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। তারপর আরো দুদিন কাটলো। সে বাচ্চাটাকে ছুঁয়েও দেখলো না। ভাল সহ বন্দিনীদের কেউ কেউ নিজের বুকের দুধ দিয়ে, বা হাসপাতালের থেকে একটু  আধটু দুধ জোগাড় করে খাওয়ালো , কিন্তু বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না।
---

আবার এলেন জাহানারার মা - বাবা। তাঁরা আসতেই মেট্রন ঝাঁঝিয়ে উঠলো, " তোমাদের  মেয়ে দুধ না খাইয়ে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে।" বাবা কপাল চাপড়ালেন." হায়, হায়, তুই কি করলি মা!ওটা বেঁচে থাকলে যে শয়তানটার শাস্তি হত।"    এত দিন বাদে চোখ তুলে তাকাল জাহানারা , কোন বিহ্ভলতা নেই সেই চোখে। আছে শুধু একটা পরিণত মানুষের আত্মবিশ্বাস, যা সঞ্চিত হয়েছে দীর্ঘ দশ মাসের  জেল জীবনের অস্বাভিক নরক যন্ত্রনা , কদিনের পুলিশ চৌকিতে পশুখামারের অপরিসীম ক্রুরতা আর দাদুর বয়সী একটা মানুষের আমানবিক পাশবিক হিংস্রতার অভিজ্ঞতার  আলোকে।
---
এক টুকরো বিদ্রূপ মাখা হাসিতে তার ঠোঁটের কোন দুটো একটু বেঁকে গেল। যেন বলতে চাইল, " আইন কি গরীব মানুষদের জন্যে ! আর দোষীকে শাস্তি দেওয়া কি এতই  সোজা সরল ব্যাপার ! তাহলে আমার মত এতগুলি মেয়ে এখানে পড়ে আছে কেন ! অনেক হয়েছে , এবারে আমাকে বাড়ী নিয়ে চলো। এই নরক থেকে আমি মুক্তি চাই। "
_________________________________________________________________________________________
সত্যঘটনা অবলম্বনে। ' সিনি - আশা' র ' ভাবনা ' সংকলনে, ১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশিত।    


____________________________________________________________________________________________




































































27 Jun 2015

নারী

নারী
****

শৈশবে তুমি ফুলের র্কুঁড়ি,
কৈশোরে কচি কলাপাতা,
যৌবনে সাগরের নীল ঢেউ,
প্রৌঢ়ত্বে মাঘের শেষে বৃষ্টি ,
বার্ধ্বক্যে শ্বেতশুভ্র মেঘ।
---------

তুমি উর্ব্বরা চষা জমি,
পৃথিবীর আর্ধ্বেক আকাশ,
দোষগুনে মেশা একটা
আস্ত সজীব মানুষ,
এটাই তোমার পরিচয়। 
 ________________

26 Jun 2015

সময় - 2

সময় 
****

এ বড় অন্ধকার, অনিশ্চিত ,অস্থির একটা দিন  ,
অদ্ভূত নিঝুম  নিঃস্তেজ, নির্মম সময়।   
তখন  ঘড়িতে রাত মাত্র দশ কি সাড়ে দশ ,
বৃষ্টি  ভেজা রাত, পথ ঘাট সুনসান।
রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর গুলোও বেপাত্তা ,
পথে নেই  শুয়ে থাকা ঘরহীন রাস্তার বাসিন্দারা ।
---

অসংখ্য শূন্য  রাস্তা  ঠিক যেন কতগুলি অজগর সাপ ,
নয় ঠিক রাস্তা, নয় কোন সাপ, যেন অসংখ্য লাশ।
অগনিত অচেনা লাশ, সার সার পড়ে আছে,
স্তব্ধ বাতাস, নিরুত্তাপ পৃথিবী, নির্দয় আকাশ।
অনুভূতিগুলো বিপর্যস্ত,অভিব্যক্তি এলোমেলো ,
এক সুকঠিন লড়াইয়ের মোকাবিলার দিন আজ।

 ---

এই মহাকাশে এই মহা  বিশ্বব্রম্ভান্ডে অবিরাম যে ঘূর্ণন
পৃথিবী নামক গোলোক টি তো তারই একটি অঙ্গ মাত্র।
অন্য কোথাও, অন্য কোন খানেও কি
এই একই  অন্ধকার , বোবা হাহাকার !
নাকি অগণিত গোলকের ন একখানে 
আছে অন্য নূতন কোন জীবনের রসায়ন  ! 
--

যেখানে রাস্তাগুলিকে লাশ মনে হয় না
ছোট্ট  কুকুর ছানা গুলি খুনসুটি করে ,
মিষ্টি নরম গোধূলির আলোয় হাসে দিগন্ত ,
বাতাস ঢেউ খেলে যায় ঘাসের উপর দিয়ে
মানুষের জীবন বৃত্তান্ত যেখানে মুখরিত হয়
বনানীতে, আকাশে , বাতাসে,  ধরাতলে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------





25 Jun 2015

সাধনা

সাধনা
*****

অবয়বের ব্যবচ্ছেদে ব্যস্ত সময়
নেই প্রানের শীতল পরশ ,
অজ্ঞান অদক্ষ মন  ,
হৃদস্পন্দন অনুভবের অন্তরায়।
---

এখন ও যে শিশুর টলমল পদক্ষেপ,
কবে আসবে কৈশোরের উন্মুক্ত কলোরব,
যৌবনের দামাল উন্মত্ত দাপাদাপি ,
পরিণত  অনুভূতির মগ্নতা !
---

হাসিকান্নার জোয়ার ভাঁটা ,
নৈসর্গিক  বিচরণ,
সমাহিত আত্মস্থতা,
বিশ্বব্রম্ভান্ডের সাথে একাত্মতা।  
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

বাতুলতা

বাতুলতা
******

অসার মনের তির্যক কথা
জ্বালা ধরায় মনে ,
আঘাত হানে অন্তরে -
ব্যাঙেও আজ লাথি মারতে চাওয়ার
সাহস পায় কোথা !
শুনে ছেলেটা বললে -
ব্যাঙেরাই তো
লাথি মারতে চায় ,
হাতিরা জানে
তাদের পায়ের ওজন  কত ,
সত্যি !
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

22 Jun 2015

মেঘ

মেঘ
***

উন্মুক্ত বিশাল আকাশ তান ধরেছে মেঘ রাগে ,
মেঘ বালিকারা কালো, ধূসর, ঘন নীল্ নানা রঙে,
দৌড়ে বেড়াচ্ছে সারা আকাশটা তোলপাড় করে।
---

সূর্য্য, চাঁদ,আর  তারার  দল  
চাপা পড়ে  গেছে  দূর্ভেদ্য মেঘের পাহাড়ে ,
মেঘরাজ রাজত্ব করছে দাঁপিয়ে।
---

পেখম তুলে ময়ূর নাচে মেঘের ডাকের তালে তালে।
বাতাসে মেঘের গুঞ্জন ,
গাছগাছালি তে লেগেছে মেঘের রঙ ,  
---

দিঘীর জলে বাচ্চা মেঘেদের মিষ্টি মধুর খেলা ,
মাটিতে মেঘের গন্ধ ,
সমুদ্রে উন্মত্ত মেঘের উত্তাল তরঙ্গ।
---

মেঘের প্রেমে মজে প্রকৃতি আলাপ ধরে দেশ রাগে।
মেঘ গর্জনে দুলছে পৃথিবটা ,
মানুষের হৃদয় তন্ত্রীতে মেঘের ঘনঘটা।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



20 Jun 2015

মানুষ সাধারণ

মানুষ সাধারন
**********

আমরা তো নই কেউ নরকের কীট ,
অথবা স্বর্গের দেবদেবী ,
অতি সামান্য মর্ত্যের জীব,
মানুষ সাধারন।
ভাল মন্দে মিশে থাকা
মানুষ সাধারন।
---

তবু তারই মাঝে আছে
কিছু হের ফের ,
কেউ দুর্বল, কেউ দৃঢ় মন
কিছু সরল অথবা জটিল,
কেউ নির্লোভ, কারো লোভী মন ,
অতি সামান্য মানুষ সাধারন।
---

দাতা আর গ্রহীতা ,
দাম্ভিক বা বিনয়ী ,
এই সবই আছে আমাদের মাঝে
কম বা বেশী সব মেশামেশি
সব কিছু মিলে মানুষের মন ,
অতি সামান্য মানুষ সাধারন।
___________________________________________________________________________________












15 Jun 2015

বৃষ্টি ভেজা বিকাল

বৃষ্টি ভেজা বিকাল
*************
বৃষ্টি ভেজা টলটলে বিকাল
ছিমছাম পথ ঘাট।
চারা গাছে জলসিক্ত  ফুলপাতা
ছেড়া ছেড়া মেঘের মধ্যে
স্বচ্ছ নীল আকাশে নরম আলো ,
হওয়ায়  মধুর আমেজ ,
বুড়ো গাছেদের কোটরে পাখীর কূজন ,
ঝরঝরে মনমেজাজ ,
চারদিকে শিশুদের মিঠে কাকলী
নেই দমবন্ধ গুমঠ।
-----------------------------------

11 Jun 2015

বৃষ্টির ছড়া

বৃষ্টির ছড়া
*******

অবশেষে বৃষ্টি এলো ঝাঁপিয়ে
দুরন্ত বাতাসে হেসে খেলে ,
আঁধার ছেয়ে চারি ধারে,
শুষ্ক মাটি সিক্ত করে,
দগ্ধ জীবন শীতল করে
বৃষ্টি এলো ঝাঁপিয়়ে। 

---

মেঘ ডাকে গুড়গুড়িয়ে,
সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে ,
মনের মাটি  ভিজিযে,
বিশ্বভুবন  দাঁপিয়ে,
আকাশটাকে কাঁপিয়ে
বৃষ্টি এলো  ঝাঁপিয়়ে। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



10 Jun 2015

জগজীবন পুর - প্রত্নতত্বের একটি কোলাজ

জগজীবন পুর - প্রত্নতত্বের একটি কোলাজ
**************************************************

১) জগজীবন পুর

***************


জগজীবন , মালদার প্রত্যন্ত এক খানি গ্রাম ,

আজ একটি নাম , প্রত্নতত্ত্বের অবাক বিস্ময়।

জেগেছে সহস্র বত্সরের পুরাতন ইতিহাস

তার প্রাচীন ইমারথ, মাটির ভাঙ্গা পাত্র, মূর্তি,

সিলমোহর আর কত শত প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে ,

আদিম সভ্যতার রূপ, রঙ, রস আর গন্ধ বহে ।

অতীত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বর্তমানের আঙিনায়।

প্রশস্ত করেছে ভবিষ্যতের পথ এক মিলিত কলতানে।
_______________________________




২) জগদীশের হাতপাখা

******************


জগদীশের দেওয়া হাতপাখা টা

বিচিত্র রঙের সুতোয় বোনা।

মনের সবটুকু রঙ নিংড়ে

আন্তরিকতায় ভরপুর।

---


অতি সাধারণ মানুষ জগদীশ

তার অসাধারণ ভালবাসার ডালি নিয়ে,

মানবিক মহিমায়

জ্বলজ্বল করছে।

---


তার নাড়ির টান

জগজীবন পুরের মাটিতে ,

প্রাচীন ইতিহাস প্রস্ফূটিত

তারই লাঙ্গলের ফলায়।

----


অতীত ইতিহাসের পুনঃ জাগরুক

বর্ত্তমান কর্মজযজ্ঞের হোতা

এদেশের উত্খাত কৃষক জনতা

নিজজমিতে আজ অস্থায়ী মজদুর ।
______________________




৩) দুলাল
*********


জগজীবন পুরের দুলাল

সহজ, সরল, স্নেহের প্রতিমূর্তি,

উত্পাটিত পিতৃপুরুষের ভিটে থেকে

একজন সাধারণ অস্থায়ী মজদুর।

প্রাচীন ইতিহাসকে খুঁড়ে

তোলার কর্মকান্ডে আছে

তাঁর বিশিষ্ট এক ভূমিকা।

---


বিগত দিনের ঘুমভাঙানোর প্রচেষ্টায় নিমগ্ন

তৃষ্ণার্ত ক্ষুধাতুর কর্মীদল ক্যাম্পে ফেরে,

নিবৃত্তির উপকরণ নিয়ে হাজির দুলাল,

ভালবাসা তাঁর মূর্ত হয়ে ওঠে

গরম ভাতের থালায় ,

দরদী মনের নীরব আন্তরিকতা

ঠান্ডা জলের গ্লাসে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------