30 Jul 2015

দায়ী কে!

দায়ী কে !
*******

"বিশু আর নেই রে "- সকাল বেলায় মা ঘুম থেকে ডেকেই  খবরটা দিলেন দিয়াকে। ধরমড়িয়ে উঠে বসলো সে," কি বলছো কি ! সাত সকালে যত  আবোল তাবোল কথা কোথা থেকে শুনলে তুমি !" "না গো বৌদি, মাসীমা ঠিক কথাই বলেছে। সত্যি আজ ভোর বেলায় বিশু মারা গেছে। একটু পরে ওরা ওর দেহ নিয়ে আসবে।" কাজের মাসি উত্তর দিল। "কি ! কি হয়েছিল ! কবেই বা এত টা অসুস্হ হলো। এইত তিন / চার দিন আগে আমার সাথে কথা হলো। শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা বলেছিলো বটে। কিন্তু আমি হাসপাতালে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলাতে, বলেছিলো সে রকম মারাত্মক কিছু নয়। এর মধ্যে কি হলো যে তরতাজা প্রাণবন্ত ছেলেটা চলে গেল ! কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো, জানো কিছু ?"
---

"হাসপাতালে তো নিয়ে যায়নি। দিদির বাড়ী নিয়ে গিয়েছিলো ঝাঁড় ফুঁক করতে।""সেকি,ওর দিদির বাড়ী তো অনেকে দূর, একেবারে অজ পাড়া গাঁ। সেখানে তো কিচ্ছু নেই ,ওষুধের দোকান , স্বাস্থ্য কেন্দ্র - একদম কিচ্ছু নেই। তার চেয়ে এখান থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তো অনেক বড় / ছোট, সরকারী / বেসরকারী হাসপাতাল ছিল। সেখানে নিলো না কেন !" " বৌদি তোমরা তো মাত্র বছর খানেক হলো এসেছো, এখানের রীতি নীতি গুলি জানতে পারোনি। এখানে লোকেদের হাসপাতাল/ডাক্তার এসবের থেকে ঝাঁড় ফুঁক আর জলপড়া র উপর বিশ্বাস বেশী।"  " কিন্তু বিশুর মেয়ের কদিন আগেই তো বিশাল করে জন্মদিন পালন করলো, কেক কাটা হলো, মাইক লাগিয়ে গান বাজলো, কত লোক খেলো। ওদের তো পয়সাকড়ির খুব অভাব নেই , তাহলে ?"
 "বৌদি, আসলে তোমাদের মত শহরের লোকেদের দেখে ওরা জন্মদিন, বিয়ের দিন এসব শিখেছে, কিন্তু তোমাদের মতো পড়াশুনা তো শেখেনি, তাই এখনো অসুখ করলে বেশীর ভাগ মানুষ পুরানো দিনের ঝাঁড় ফুঁক এসবে বেশী বিশ্বাস করে।"
 ---
দিয়া চুপ করে যায়। বিশুর হাসিখুশী মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে তখন তারা এই ফ্লাটে নতুন এসেছে। একদিন সে যখন বাড়ীতে একা, বিদ্যুতের লাইনে কোন কারণে নিজেদের ফ্ল্যাটের ইলেকট্রিসিটি অফ হয়ে যায়। প্রচন্ড গরমে টেঁকা দায়। দিয়া নীচে নাম ইলেকট্রিশিয়ানের খোঁজে। ঠিক উল্টো দিকে বিশু নিজের কাপড় ইস্ত্রির দোকানে কাজ করছিলো। দিয়ার উত্কন্ঠিত মুখ দেখে বেরিয়ে আসে, "কি হয়েছে কাকিমা, কোন সমস্যা?"  সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিজের খুড়তুত ইলেকট্রিশিয়ান ভাইকে ডেকে পাঠিয়ে লাইন সারিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। সেই প্রথম আলাপ।
---

বিশুর ছোট বেলায় পোলিও হবার ফলে পায়ে জোর ছিল না। বিশুর বাবার বেশ কিছুটা জমি জায়গা ছিল। তার বেশ  কিছুটা জমি প্রমোটারি ব্যবসায়ে নিযুক্ত এক রাজনৌতিক দলের নেতা ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে লিখিয়ে নিয়েছিলো। সেই ফ্লাট ভাড়া, বিশুর বাবার  মুদিখানা দোকানের আয়, বিশুর নিজের দোকানের ছাড়াও, আরও বেশ কিছুটা জমির আয় ছিল।
---

বাড়ীটা নিজেদের। তাই আর্থিক ভাবে অসচ্ছলতা ছিল না। বাবা মা নির্বিবাদী ভালমানুষ। তার বৌটির ব্যবহারও  খুব মিষ্টি। আর বিশুর ব্যবহারের তো তুলনা ছিল না। আসে পাশের মানুষ জনদের ছোটখাটো সমস্যাগুলি সে নিজে থেকেই সমাধান করতে চেষ্টা করতো। কোন বাড়ীতে জলের লাইনে সমস্যা, তা মেটানো। কোন ফ্ল্যাটের লোকেরা কদিনের জন্য বাইরে গেছে, যাতে চুরি নাহয় রাস্তার ধারে দোকানে বসে সব খেয়াল রাখতো। আর  নিজের ফোনে লোক ডেকে সবাই এর সমস্যার সমাধান করতো। 
---

দিয়ার মনে পড়ে আর একদিন সে ভুল করে চাবি না নিয়েই গডরেজ লকের দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়েছিল, এমনকি মোবাইলটাও ঘরে রয়ে গেছিল। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। বিশু তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে,সব শুনে নিজের দোকানে বসায়, বলে, " কাকিমা, কাকুর অফিস তো কাছেই। তাঁর কাছে বাড়তি চাবি নেই ? তাহলে আমার ফোন থেকে একটা ফোন করে দিন।" বিশুর সাহায্যে ই সেদিন ও দিয়া বিরাট ঝামেলার হাত থেকে মুক্তি পায়।
---

বিশুদের বাড়ী সল্টলেক সিটি থেকে পাঁচ মিনিট আর নিউটাউন থেকে দুই মিনিট দূরত্বে। পাড়ায় মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য বেশ কয়েকটি মল্টিস্টরিড বিল্ডিং ও হয়েছে। জায়গাটা যদিও এখনো পঞ্চাযেতের অধীন। সরকারী প্রাথমিক স্কুল আছে। ছেলেদের  জন্য সেলুন, মেয়েদের জন্য বিয়ুটিপর্লার আছে।আধুনিক নাচ শেখার কেন্দ্র ও হয়েছে। অঞ্চলের   অধিবাসীরাও এসবে উত্সাহ ভরে যোগ দেয়। 
--- 

ওষুধের দোকান আছে। কিন্তু এলোপ্যাথিক কোন ডাক্তার নেই। একজন হোমিয়প্যাথিক ডাক্তার দাঁত থেকে শুরু করে সব কিছুর  চিকিত্সা করেন, আর একজন অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার আছেন  যিনি মূলত এলপ্যাথিক চিকিত্সা করেন, একটু কিছু হলেই স্যালায়িন গুঁজে দেন।
---

অনেক বাচ্চারা প্রাথমিক স্কুলে যায়। কিন্তু প্রথম থেকে প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়েও বিশেষ কিছু শেখেনা। শহরের হাওয়ার সান্নিধ্যে এসে আঞ্চলিক অধিবাসীদের মধ্যে কেক কেটে, বেলুন লাগিয়ে,ব্যান্ড বাজিয়ে জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ চালু হয়েছে।
ফেসিয়াল করা, উত্সবে ব্যান্ড বাজিয়ে চূড়ান্ত আধুনিক নাচ করা, চুলের বাহার, পোশাকের বাহার সবই আয়ত্ব করেছেন। কিন্তু অসুখ / বিশুখে মূলত ঝাঁড়ফুঁক/তুকতাক এর আশ্রয় নেন, খুব জোর অঞ্চলের হাতুড়ে ডাক্তার দের কাছে যান। কিন্তু সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে খুব কম লোক যান, তাও লোকাল হাতুড়ে ডাক্তাদের  পরামর্শ, একেবারে শেষ পর্যাযে।
----

শহর ভিত্তিক সংস্কৃতির জীবনের অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বা অন্যান্য কুপ্রভাব গ্রামের সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবন যাত্রার উপর অনেকটাই  প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু তার বিজ্ঞান সম্মত বিষয়গুলি সম্পর্কে অজ্ঞতা আর শিক্ষাগত নীচু মানদন্ডের সমস্যা আগের মতই থেকে গেছে। উপরের শহুরে চাকচিক্য এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অনীহা থেকে গেছে। তারই ফলে বিশুর মত টগবগে মানুষদের অকালে বিনা চিকিত্সাতে মরতে হয়। কে এর দায় নেবে ! কে জ্বালবে প্রকৃত জ্ঞানের আলো !

__________________________________________________________________________________________















































25 Jul 2015

আজকের খনা


আজকের খনা 
**********

আমি জানি ,
পুরাকালে খনার জিভ কেটে ফেলতে হয়েছিল ,
কারণ মানুষ তাঁর বচন কে সত্য বলে মানত।
আজ দুর্বৃত্তরা আমার জিভ কেটে দিয়েছে
আমার সত্য বচনের ভয়ে।
আমি নীরবে ওদের কুপ্রস্তাবে রাজী হইনি
এই দোষে।  এটা আমার ঔদ্ধত্য,
সারা শরীরে ওদের অত্যাচারের ক্ষত নিয়ে,
আমি রুখে দাঁড়িয়েছি
সহস্র বছরের অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
আমি সদম্ভে ঘোষণা করেছি
জনতার সামনে ওদের
নোংরা মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার।
এত স্পর্ধা ওরা অতীতে সহ্য  
করেনি, আজও করবেনা।
কিন্তু ওরা ভুলে গেছে
একটা খনা লাখো খনার জন্ম দিয়ে গেছে ,
আজ তারা উঠে দাঁড়িয়েছে ,
জোট বেঁধেছে, তারা আর
একা পড়ে মার খাবেনা।
-----------------------------


17 Jul 2015

আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র

আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র 
*********************
সত্তর দশকের একটি ব্ল্যাক আউট এর রাত। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। কলকাতা শহরের চিত্পুর আর হ্যারিসন রোডের ক্রসিং এ বাসস্টপে একটি কিশোরী তার এক সাথীর জন্য অপেক্ষারত। এদিকে ওদিকে আরও কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। মন হচ্ছে সবাই বাসের অপেক্ষায়ে। কিশোরীর ঠিক পেছনে একজন অতি সাধারণ জামা কাপড় পরা মানুষ দাঁড়িয়ে। তাঁর দোহারা চেহারা, পেশীবহুল দুটি হাত। দেখে মনে হয় সম্ভবত কোন কঠিন শ্রমজীবি কাজের সাথে যুক্ত। মানুষটি সতর্ক দৃষ্টিতে মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন।
---

একের পর এক বাস আসে, চলে যায়, কিন্তু কিশোরীটির বাসে ওঠার জন্য কোন তত্পরতা দেখা যায় না। অন্ধকার রাত, কারফিউ জারি হয়েছে। বেশীর ভাগ লোকজন বাস ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরার জন্য উদগ্রীব। কিশোরিটি একটা লাইট পোস্টে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। শ্রমজীবি মানুষটি অনেকক্ষন ধরে উদগ্রীব চিত্তে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে, কিশোরীকে প্রশ্ন করেন, " দিদি কোন বাসে উঠছো না কেন ?" "আমার বাস এখনো আসেনি", সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে। "কেন অনেকক্ষণ ধরে তুমি দাঁড়িয়ে। কত বাস তো এলো, গেলো। কত নম্বর বাসে যাবে তুমি ?"
"আমি... দেখি..দেখা যাক। " ছাড়া ছাড়া জবাব দিয়ে চুপ করে যায় মেয়েটি।
---

"কত নম্বর বাসে যাবে জানোনা ! সবাই একে একে বাসে উঠছে এই অশান্ত সময়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী যেতে ব্যস্ত। তুমি দাঁড়িয়ে আছ তো আছই !রাত বাড়ছে, কত নম্বর বাসে যাবে ঠিক করে বল ?"
"দেখি , কত নম্বর বাস পাই,"আবারসেই কাঠ কাঠ উত্তর। কিছুক্ষন নীরবতা। "ঠিক করে বলতো তুমি কোথায় যাবে? কত নম্বর বাসে যাবে ? একগাদা বাস চলে গেল !" অধৈর্য ভাবে বলেন তিনি। "আপনার কি দরকার ?আমি কোথায় যাব আর কত নম্বর বাসে যাব ?" - রুক্ষভাবে বলে মেয়েটি।
---

লোকটি হাঁটা দেয়। কিন্তু একটু গিয়েই আমার ফিরে আসে। কিশোরীটি পাশে দাঁড়ায়। আবার ও কিছু বাস চলে যায়। তখন তিনি প্রশ্ন করেন," কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন ? কত বাস তো গেল। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে তুমি দাঁড়িয়ে আছ।" এবার কিশোরী টি আর কোন উত্তর দেয় না। দু /একটা  বাসের দিকে এগিয়ে যায়। বাস ধরার ছল করে, কিন্তু কোন বাসে ওঠেনা। "কি হলো বাসে তো উঠলে না , কেন ?" "ভীষণ ভীড়, তাই উঠলাম না। " "মোটেও বেশি ভীড় ছিল না, তুমি ইচ্ছে করলেই উঠতে পারতে !" "ভীড় কি ভীড় না, আমাকে ঠিক করতে দিন।" রাগত স্বরে উত্তর করে মেয়েটি।
---

এতক্ষণ চাপা গলায় কথাবার্তা চলছিল। আস্তে আস্তে মেয়েটির গলা একটু চড়ে যায়। লোকটি এবার কঠিন গলায় প্রায় আদেশের সুরে বলে," এবার যে বাস আসবে তাতেই উঠে যাবে।আর কোন কথা নয়। আর দাঁড়াবেনা।"
"মেয়েটি ক্ষেপে যায়,"আপনার কি, আমি কি করবো, আমি ঠিক করবো, আপনি বলার কে!" আসে পাশে একটা অদৃশ্য অস্থিরতা অনুভূত হলো - দুজনেই বুঝলো। মেয়েটির এতক্ষনে ভাবলো, লোকটি সাদা পোশাকে পুলিশ নাকি! মানুষটিও একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও তার পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেলো। ইতিমধ্যে মেয়েটির সাথী এসে গেলো, "অনেক দেরী হয়ে গেলোরে। অনেকক্ষণ তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। "
---

তার আগমনে শ্রমজীবি মানুষটি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তিনি নবাগত ছেলেটির হাত ধরে নীচু গলায় বললেন "দাদা আপনি ভাগ্যিস এসে পড়েছেন। পেছন দিয়ে খেয়াল করে দেখুন একটা মাস্তান গ্যাং রয়েছে। দিদি তো কিছু খেয়াল করছেনা। একলা হলেই দিদিকে তুলে নিয়ে যাবার প্ল্যান করছে। অনেকক্ষণ তো ভীড় ছিল। কিন্তু ক্রমাগত হালকা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিদিকে ছেড়ে যেতে পারছিনা। তাই এতক্ষণ ধরে দিদিকে তাড়াতাড়ি  বাসে উঠে চলে যেতে বলছিলাম। এত কথা তো বলতে পারছিলাম না। দিদি জানে না বলে রেগে যাচ্ছিলো।"
---

মেয়েটির বন্ধু উপকারী, সাহসী মানুষটিকে হাত ধরে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন। ইতিমধ্যে তিনজনে শিয়ালদহ স্টেশন এর দিকে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন। স্টেশনের কাছে পৌঁছে মানুষটি বিদায় নিলেন। বন্ধুটির কাছে সব কথা শুনে মেয়েটি স্তম্ভিত হয়ে গেলো। নিজের ব্যবহারে ভীষণ লজ্জা পেল।
কত বড় মাপের একজন মানুষের সান্নিধ্যে এতক্ষণ সে ছিল - অতি সাধারণ এক মানুষের  অসাধারণ মানবিকতা, সাহসিকতা আর পরার্থপতার কথা ভেবে অভিভূত হয়ে গেল। সারা জীবনেরর অভিজ্ঞতার  ঝুলি তে এক অমূল্য রত্ন যোগ হলো।
----

আজ চল্লিশ বছর পরেও সেদিন হটাত আকাশের  উজ্জ্বল যে নক্ষত্র টা ছিটকে এসে পৃথিবীর মাটিতে পড়েছিল তার আলো আজও এতটুকুও ম্লান হয়নি। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় এই অজস্র ঝিকমিক করা বাকি নক্ষত্রগুলি আজ কোথায় গেলো, - তারা কি হারিয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে মনে হয় - তারা হারিয়ে যায়নি, মহাবিশ্ব প্রসারিত হবার সাথে সাথে তাদের সংখ্যা চোখে দেখা না গেলেও বেড়ে চলেছে। সেই উজ্জল নক্ষত্ররা বেঁচে আছে আর বেঁচে থাকবে শহীদ বরুন বিশ্বাস, অরূপ ভান্ডারী, তপন দত্ত, রাজীব দাস, সৌরভ চৌধুরীদের মধ্যে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------























14 Jul 2015

মানুষের স্বর্গ

মানুষের স্বর্গ
*********


খড়দা স্টেশন। কারফিউ এর রাত। সত্তর দশক। ট্রেন থেকে নামল এক কিশোরী। বয়স তার ১৬ কি ১৭। নাম মৃত্তিকা। কাঁধে একটা বড় সড় ব্যাগ। তাতে ভর্ত্তি তার রাজনৈতিক পার্টির কাগজপত্র। যদিও সেই পার্টি আইনগত ভাবে বেআইনি সংগঠন বলে ঘোষিত হয়নি। কিন্তু কোন ব্যক্তি তার সাথে যুক্ত থাকলে, এমন কি জড়িত বলে সন্দেহ করলে, অথবা তার পত্র পত্রিকা কারো কাছে পাওয়া গেলে, তাকে পুলিশ আটক করতে, শারীরিক / মানষিক নির্যাতন করতে,  জেলে বন্দী করতে এমন কি হত্যা করতেও পারতো। সেই পার্টির মতাদর্শ কে সমর্থন করাও বেআইনি বলে মনে করা হতো।
---

বড় রাস্তায় মিলিটারী টহল চলছে, পাড়ায় পাড়ায় চিরুনি তল্লাশি চলছে। তাই যাত্রীদল বড় রাস্তা এড়িয়ে গলিঘুচি দিয়ে বাড়ীর পথ ধরলো। মৃত্তিকা চললো তাদের পিছু পিছু। একে একে পথচারীর সংখ্যা কমতে থাকে - টুপটাপ যে যার বাড়ী ঢুকে পড়ে। অবশিষ্ট দুটি মাত্র যাত্রী।  মৃত্তিকা আর ধুতি, খদ্দরের জামা পরা এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। মাথায় তার গান্ধীটুপী। তিনি কোমল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করেন ,"তুমি কোথায় যাবে মা ? কোথায় বাড়ী তোমার ?" মৃত্তিকা ঢোক গেলে,  -- "আমার বাড়ী !"
---

বস্তুত পক্ষে এটা তার দ্বিতীয় দিন খড়দা অঞ্চলে। ঠিক আগের রাতে অন্ধকারে সাময়িক কদিন শেল্টারের জন্য সে তার এক পার্টি কমরেডের সাথে তার দিদির বাড়ী এসেছে। এ অঞ্চলটা তার একেবারে অচেনা অজনা। পথঘাট কিছুই চেনা হয়নি। এমনকি বেশী রাতে আসার ফলে বাড়ীর কারোর সাথে আলাপ হয়নি, কারো নাম, পদবী  পর্যন্ত জানা হয়নি। সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। একমাত্র তার পার্টি কর্মীর একটা ডাক নামটা শুধু জানে, যে এ বাড়ীর বাসিন্দা নয়। অধিক রাত হবার ফলে তারা দুজনও তাড়া তাড়ি শুয়ে পড়ে।
---

পার্টির বিশেষ জরুরী কাজে সাত সকালে মৃত্তিকা কে বার হতে হয়। বড় রাস্তা থেকে একটা গলির  চার নম্বর বাড়ী আর গলির দুই পাশে দুটো বড় ওষুধের আর স্টেশনারী দোকান - এইটুকু নিশানা মনে গেঁথে নিয়ে কাকভোরে বড় রাস্তা ধরে সোজা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা চলে যায়। একমাত্র বন্ধুর দিদি জামাইবাবু দুজনেই কলকাতায় টেলিফোন ভবনে কাজ করেন এটুকু কথাই তার জানা ছিল। বাড়ীর নম্বর, গলির  নাম  কিছুই জানা নেই। ঠিক করে রেখেছিলো ফিরে বাড়ীর লোকজনদের সাথে আলাপ পরিচয় করে নেবে, এলাকা সম্পর্কে খোঁজখবর করে নেবে। কিন্তু বিধি বাম - হটাত কারফিউ জারী হয়ে গেছে। 
---

বৃদ্ধের প্রশ্নের কি জবাব দেবে সহসা ভেবে পায়না মৃত্তিকা। কিছুতো একটা বলতেই হবে। আমতা আমতা করে বলে , "দিদির বাড়ী যাব।" " গলির নাম কি ? কত নম্বর বাড়ী মা ?" " নম্বর টা তো জানিনা। দিদিরা নুতন এসেছে এখানে। আমিও কাল রাত্রে জামাইবাবুর সাথে এসেছি। এখানকার রাস্তা ঘাট কিছুই চিনিনা। বড় রাস্তা দিয়ে, একটা গলির মধ্যে বাড়িটা, গলির দু পাশে দুটো বড় দোকান আছে। আমি সকল বেলায় কলকাতায় কলেজে চলে গেছিলাম।" " পাগলী মেয়ে, বড় রাস্তা থেকে অনেক গলি আছে আর ওরকম অনেক দোকানও আছে। তাছাড়া বড় রাস্তায় তো এখন যেতেই পারবেনা। মিলিটারী টহল দিচ্ছে যে। পাড়ায় পাড়ায় চিরুনি তল্লাশি চলছে। বাড়ী বাড়ী ধর পাকড় হচ্ছে। এভাবে ঘুরে বেড়ানো তো একেবারে ঠিক হচ্ছে না। তা তোমার দিদি জামাইবাবুর নাম কি?" কোনমতে মাথা নীচু করে দুটি নাম বানিয়ে বলে মৃত্তিকা।
---

বাড়ীর নম্বর, রাস্তার নাম জানেনা বলে পার পাওয়া গেছে। কিন্তু নিজের দিদি / জামাইবাবুর নাম জানে না তাতো বলা যায় না। বৃদ্ধ মানুষটি চিন্তিত মুখে বলেন, " নতুন এসেছেন তাঁরা। নাম দিয়ে তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা ! কোথায় কাজ করেন বলতে পারবে?" এবার খোলা মনে বলে মৃত্তিকা, "ওঁরা  দুজনেই কলকাতায় টেলিফোন ভবনে কাজ করেন।" "বাঃ, এখন খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে অনেকে আছে যাঁরা সেখানে কাজ করেন। আমি চিনি তাঁদের, চল তোমাকে নিয়ে যাই। তাঁরা নিশ্চয় চিনবেন তোমার দিদিদের।" একের পর এক , প্রায় সাত / আট টা বাড়ী নিয়ে গেলেন তিনি।
---

কারফিউ চলছে, নির্জন, নিঃস্তব্ধ রাত।  বড় রাস্তা থেকে মিলিটারী দের মার্চের খটখট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা দুই তিন তারা এ গলি, সে গলি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দুটো অলীক নামের ঠিকানা কে দেবে ! পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ীতে বাড়ীতে তল্লাশি চলছে।এভাবে ঘুরে বেড়ানো ভীষন ভাবে বিপদজনক। ব্যাগ ভর্তি পার্টির পত্র পত্রিকা। ধরা পড়লে শুধু তার নয়, এই দয়ালু, নিরাপরাধ, বৃদ্ধ মানুষটি ও রেহাই পাবেননা। শীতের রাত। মৃত্তিকা মনে মনে নিজেকে অপরাধী মনে করে লজ্জিত বোধ করে। কিন্তু এই অজানা অচেনা জায়গায় তার কি করা উচিত ভেবে পায় না। সারা শরীর ঝিম ঝিম করতে থাকে। মাথা টা ভারী হয়ে আসে। তার জন্য নিরীহ, নিস্পাপ মানুষটি  কে অমানুষিক অত্যাচারের মুখে পড়তে হবে, এটা ভাবতেই সে মনের একটা জোর ফিরে পায়। বলে," মেশোমশাই অনেক রাত হয়ে গেছে, আপনি এবার বাড়ী যান, সেখানে সবাই চিন্তা করছে। আমি ঠিক খুঁজে পেয়ে যাব।" "কি বলছো তুমি , এই বিপদে এত রাতে তোমাকে ফেলে আমি বাড়ী চলে যাব , সেটা হয় ! বরং আমি বলি কি মা, আজ রাত তুমি এই বুড়ো ছেলের বাড়ীতে থাক। কাল সকালে আলো ফুটলে আমার মেয়ের সাথে তোমার দিদির বাড়ী খুঁজে নিও। আমার নাম রনজিত সরকার " স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা। তবুও কুন্ঠিত স্বরে বলল," মেশোমশাই আমাকে বাড়ী নিয়ে গেলে কোন অসুবিধা হবে না তো।" " বিপদের সময়ে মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তবে তো  মানুষ জন্ম ই বৃথা মা "- সাবলীল ভাবে উত্তর এলো। 
---

রাত প্রায় বারোটায় দুইজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের বাড়ী পৌঁছালো। পুরো পরিবার চরম উত্কন্ঠায় সময় গুণছে। পরিবারের মাথা, বৃদ্ধ মানুষটি সকাল দশটার ট্রেনে কলকাতায় অফিসের জন্য বেরিয়েছেন রোজের মতন। সন্ধ্যা নয়টার ট্রেনে বাড়ী ফেরেন প্রতিদিন। স্টেশন থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ।  কিন্তু প্রায় মাঝ রাত পর্য্যন্ত না ফেরায়, স্বাভাবিক ভাবে সবাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এদিকে হটাত করে একযোগে কারফিউ, চিরুনী তল্লাশী, ছুতায় নাতায় মিথ্যা সন্দেহে অত্যাচার, ধর পাকড়, গুলি গোলার আওয়াজ - সবাই দূর্ভাবনায় তঠস্থ, চূড়ান্ত বিপর্যয়ের আশঙ্কায় প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম।
---

"ওঃ তুমি তবে অবশেষে ফিরতে পেরেছো", তাঁর স্ত্রী ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেন। সারা পরিবার তাদের ঘিরে ধরলো।পরিবারে মোট সাতজন সদস্য - বৃদ্ধ, তাঁর স্ত্রী, বিধবা বোন, ছেলে, ছেলের বউ, একটি মেয়ে আর একটি ছোট্ট নাতনী। নিম্নমধ্য পরিবার। পূর্ববাংলার মানুষ। তাঁর আর ছেলের - দুজনের রোজগারে সংসার চলে। ঘরের পরিবেশ সাদামাটা - কিন্তু পরিস্কার পরিছন্ন। বেড়া আর টালির ছাদ দেওয়া দুটি শোবার ঘর, একটি লম্বা দালান, তার এক পাশে ছোট্ট রান্না ঘর , আর বাথরুম। শুধু সযত্নে শহীদ ভকত সিং এর বিরাট একটা ছবি সারা বাড়ী আর পরিবারের অন্তর আত্মা আর স্বত্তা কে মেলে ধরেছে।
---

"আরে দাঁড়াও, আমাদের  একটু নিঃস্বাস নিতে দাও। এই মেয়েটি এখানে ওর দিদির বাড়ী নতুন এসেছে, কিন্তু অন্ধকারে গলি ঘুচি দিয়ে আসতে গিয়ে রাস্তা হাড়িয়ে ফেলেছে। আমরা দুজন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম এতক্ষণ। খুঁজে না পেয়ে বাড়ী নিয়ে এলাম। রাতে কষ্ট করে বুড়ো ছেলের বাড়ী থাকুক। কাল সকালে কেউ সঙ্গে গিয়ে ওর দিদির বাড়ী পৌঁছে দেবে।"
---

"আহারে মেয়ের আমার এই ধকলে মুখ শুকিয়ে গেছে , তা যা অমানুষিক অত্যাচার চলছে - এই জঙ্গলের রাজত্বে  মানুষের মাথা ঠিক রাখাই মুশকিল। তা এত রাত পর্য্যন্ত তোমাদের এই বিপদের মধ্যে বাড়ী খোঁজা একবারেই ঠিক হয়নি। প্রথমেই এখানে চলে আসা উচিত ছিল। কিছু অঘটন যে ঘটেনি এই আমাদের ভাগ্য। তা তোমার নাম কি মা?"
মৃত্তিকা এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিলো। একবারের জন্যও কেউ তাকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করেনি। তার জন্য তাঁদের বাড়ীর কর্তার যে কত বড় বিপদ হতে পারত সে কারনে উটকো আপদ বলেও ভাবেনি। "আমার নাম মৃত্তিকা।"
---

বাড়ীর গৃহিণী সঙ্গে সঙ্গে রাশ ধরলেন। মেয়েকে বললেন," মিনি মা, ওকে কলঘরে নিয়ে যাও হাতমুখ ধুয়ে নিক। তোমার জামা কাপড় ওকে পরতে দাও। আর বড় ঘরে সবার বিছানা কর। তোমার সাথে ওর শোবার ব্যবস্থা কর। ছোট ঘরে দাদারা যেমন শোয় তেমন বিছানা করে দাও।" পুত্রবধূকে বললেন," চল শিখা মা আমরা খাবার ব্যবস্থা দেখিগে।অনেক রাত হয়েছে, আর দেরী করা ঠিক হবেনা।"
---

হাতমুখ ধুয়ে সবাইয়ের সাথে খেতে বসল মৃত্তিকা। মেঝেতে আসন পেতে গোল হয়ে সবাই খেতে বসেছে। সবচেয়ে ভাল জায়গাটি তার জন্য বরাদ্দ হলো। খুব সাধারণ খাবারের ব্যবস্থা - ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ নুন, তেল, আর লঙ্কা দিয়ে মাখা আর একটা নিরামিষ তরকারি। কিন্তু আন্তরিকতার অনবদ্য ছোঁয়াতে সাধারণ খাবার অসধারণ হয়ে উঠেছে।পাছে সে লজ্জা করে, কম না খায় - সবাই খেয়াল রেখেছে। কি অপরিসীম আন্তরিকতা আর আদর !সামান্য সময়ের আলাপ, মৃত্তিকার বানানো পরিচয়। কিন্তু কোন অবিশ্বাসের বা সন্দেহের  বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই কারও মনে। সকলেই সহৃদয়তায় আর মানবিকতায় ভরপুর। বাড়ীর সবাই যেন একছাঁচে গড়া। সরলতা, বিশ্বস্ততা, সততায় পরিপূর্ণ সকলেই। এ যেন অন্য এক জগৎ। মাটির এই পৃথিবীতে এঁরাই গড়ে তুলেছে মনুষ্যত্বের মহান স্বর্গ।
---

রাত্রে  সে আর মিনি পাশপাশি শুয়ে অনকেক্ষণ গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে মৃত্তিকা স্বপ্ন দেখল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁদের পাহাড়' এ সে আর মিনি বেড়াচ্ছে। হটাত 'বুনিপ' এসে তাদের দুজন কে আক্রমন করেছে। ঠিক সেই সময়ে কেউ তাকে ধাক্কা দিচ্ছে," উঠে পড়, মিটি, অনেক বেলা হয়ে গেছে। চা আর জলখাবার নিয়ে বৌদি আর মা বসে আছে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে খাবি চল।" চমকে উঠে বসে সে, হটাত ঘুম ভেঙে থতমত খেয়ে যায়। চেয়ে দেখে চারিদিক আলো ঝলমল করছে। স্বপ্নের জগৎ থেকে নেমে আসে বাস্তবের মাটিতে। রাতের বিভীষিকা কেটে গেছে।
----

মিনিকে বলে," তুই আমাকে বড় রাস্তায় পৌঁছে দিলে আমি আমার দিদির বাড়ী খুঁজে নিতে পারবো, যাবি একটু আমার সাথে।" "অবশ্যই পৌঁছে দেবো, কিন্তু আগে খেয়ে নে।" খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোবার সময় পুরো পরিবার এসে ঘিরে দাঁড়ায় তাকে। মিনির দাদা বলেন," মিনি ওকে একেবারে ওর দিদির বাড়ী পৌঁছে দিবি , ও কিন্তু এখানকার কিছুই চেনেনা।" রনজিত বাবু তার মাথায় হাত রেখে কাঁপা গলায় বলেন, "মাটা আমার বড় কষ্ট পেয়েছে কাল রাতে। আবার আসিস মা এই বুড়ো ছেলেটাকে দেখতে। আর সাবধানে থাকবি। আজকাল দিনকাল ভাল না।" মাসীমা কে প্রনাম করে
মৃত্তিকা বলে ,"যাই মাসীমা।" "যাই , বলতে নেই, বল আসি।" বলে চিবুক ধরে আদর করে দিলেন। বৌদি বললেন, "আমাদের ভুলে যাবে নাতো !আবার এস কিন্তু। "
---

মৃত্তিকা কোনমতে চোখের জল চাপলো। কাল রাতে সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল একরাশ বিপদের ঝুঁকি। যদি রাতে এ বাড়ী টাতে তল্লাশি হতো, তার ব্যাগ ভর্ত্তি কাগজ পত্রের জন্য বাড়ীর সবাই বিপদে পড়তো। বিশেষ করে রনজিত বাবু ও তাঁর ছেলে। এক অজানা, অচেনা মানুষকে কত অনায়াসে তাঁরা  সবাই আপন করে নিয়েছেন , একবারের জন্যও অবিশ্বাস করেননি। মানবিকতা আর সহৃদয়তার মূর্ত প্রতিক। এরাই তো পৃথিবীতে তাদের স্বপ্নের স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এঁদের মত মানুষ দের খুঁজে বার করাই তো তাদের ব্রত। শ্রধ্বা আর কৃতজ্ঞতায় তার মন পরিপূর্ণ হযে উঠলো। "সত্যই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কত মহৎ"- এই কথা ভাবতে ভাবতে মিনির সাথে রওনা দিল।

+++++++++++++++

প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর কেটে গেছে। সেদিনের কিশোরী মৃত্তিকা আজ ষাটোর্ধ ,স্বামী পুত্র নিয়ে পুরোপুরি সংসারী। এক রাতের আশ্রয়ে থাকা সেই পরিবার, সেই পরিবারের  মহান বৃদ্ধ গৃহকর্তার কথা আজও মনে পড়ে। তাঁরা অগাধ বিশ্বাস আর আদরে এক অজ্ঞাত কুলশীল কে সমাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন - চরম বিপদ মাথায় নিয়ে তাকে রক্ষা করেছিলেন বিপর্যয়ের হাত থেকে। মাঝে মাঝে সে ভাবে আজ সে নিজে কি পারবে,ওই  চূড়ান্ত কঠিন সময়ে, ওই রকম পরিস্থিতিতে ওই ভাবে অজানা অচেনা উটকো কোন মানুষ কে নির্দ্বিধায় নিজের বাড়ীতে আশ্রয় দিতে, আপনজনের মত বুকে টেনে নিতে !

___________________________________________________________________________________________

সত্যঘটনা অবলম্বনে। প্রথম প্রকাশিত 'কালপ্রতিমা সাহিত্যপত্রে,  জানুয়ারি ২০০১, সপ্তম বর্ষ,  চতুর্থ সংখ্যা।'
____________________________________________________________________________________________-