10 Dec 2015

ভার

ভার
***

বৃষ্টির বাবা মারা যান ১৯৭১ সালে। সেই রাতের ছবিটা এখনও তার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। সেদিন শরীর টা সকাল থেকেই খারাপ ছিল। ডাক্তারবাবু মোটামুটি ওকে বলেই গেছিলেন, "আর টানাহ্যাচড়া করে লাভ নেই, শেষ সময়টা শান্তিতে পরিবারের সাথে থাকাই কাম্য।" একমাস আগেই হাসপাতাল থেকে এই কথা বলেই ছুটি দিয়েছিল। তবু একটা মাস বাবার যত্ন করেতে তো পেরেছে বৃষ্টি।
--
মা তো তার কবেই চলে গেছেন। বাবা দুজনের স্নেহ দিয়ে তাকে বড় করেছেন। দাদা দিদিদের থেকে বয়সে সে অনেকটা ছোট। তাদের স্নেহও যথেষ্ট পেয়েছে। বাবা সবাই কেই খুবই স্নেহ/ভালবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন। প্রচুর পরিশ্রম করতেন। নামী এডভোকেট ছিলেন। আয় যথেষ্ট ছিল। কার কোন অভাব হতে দেননি সাধ্যমত। দাদা দিদিরা সবাই কৃতি ছাত্র/ছাত্রী ছিলেন। এখন সবাই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত, ভাল আয়।
--
একমাত্র বৃষ্টি এখন ইউনিভার্সিটির ছাত্রী,পড়াশুনায় ভাল। বাবা তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে না যেতে পারার দুশ্চিন্তায় ভুগতেন, তাঁর হাতে যে বেশী সময় নেই বুঝতে পেরেছিলেন। বৃষ্টির ঠাকুরদাদাও নামী এডভোকেট ছিলেন, বাবা তাঁর একমাত্র সন্তান। লেকের কাছে এক বিশাল বাড়ী করেছিলেন, নাতি/নাতিনীদের কথা ভেবে। বলা যায় বৃষ্টিরা যথেষ্ট স্বচ্ছল পারিবার।
--
বাবা বাড়ী আসার পর থেকে বৃষ্টি একাই আয়া মাসীদের সাহায্যে তাঁকে দেখাশুনা করত। নিজেই বাবাকে খাবার বা ওষুধ খাওয়াত, স্নান থেকে শুরু করে সব কিছু তার তত্বাবধানে হত। ইউনিভার্সিটি যাওয়া হত না। বাবা রাগ করতেন,"তুই আজও বাড়ী বসে আমার সেবা করবি,পড়াশুনা কি ছেড়ে দিলি? তোকেও কিন্তু ভাল রেজাল্ট করতে হবে।" " কদিন বাবার সেবা করলেই যদি রেজাল্ট ভাল না হয়, তবে সে পড়াশুনার দরকার কি?"
--
কিন্তু এই সময় টা ছেলেমেয়েদের একটু সান্নিধ্য মনে মনে আশা করতেন, যদিও মুখে কখনও প্রকাশ করেননি। তাঁর চার ছেলে /বৌ, বাকি দুই মেয়ে/জামাই, নাতি/নাতনি একই বাড়ীতে উপর তলায় থাকে। ইচ্ছে করলে পালা করে একটু সময় তাঁর সাথে অনায়াসে কাটাতে পারত। বৃষ্টি ই তাঁর অগতির গতি, দেখভাল ছাড়াও বাবাকে কাগজ/বই পড়ে শোনাত, গল্প করত। তিনি ঘুমালে তাঁর ঘরে বসেই নিজের পড়াশুনা করত।
--
সেদিন বিকাল গড়িয়ে গেলে বাবা মারা গেলেন। ডাক্তারবাবু ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে দিলেন। দিদি দাদারা একেবারে তাদের পরিবার সমেত এক তলায় বাবার ঘরে হাজির। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এদিকে সারা অঞ্চল পুলিশ/মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে। সমস্ত পাড়ায় চিরুনী তল্লাশী শুরু হল, ধরপাকড় চলল প্রায় রাত ১২/১ পর্য্যন্ত। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল।
--     
বৃষ্টি দের বাড়ীতে তখন অদ্ভূত এক পরিবেশ। বাবার মৃত দেহের সামনে ঘন্টাখানেক একটু কাঁদার পরই দাদা, দিদি, বৌদি, জামাইবাবুরা সবামিলে তন্ন তন্ন করে বাবার আলমারির চাবি খুঁজতে শুরু করল। উইল, কাগজ পত্র, মায়ের গয়না আর টাকাকড়ি  সব সেখানেই থাকত কিনা। এদিকে মৃতদেহের সামনে বৃষ্টি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। একটু ইতস্তত করে বড়দা তাকে বলল,"কাঁদিস না বোন, বাবার সময় হয়েছে চলে গেছেন। আমরাই তোর দেখভাল করব। বাবার চাবিটা কোথায় বলত।"
--
বৃষ্টি অবাক চোখে তাকায়,"বাবার চাবি ! এখন কি করবে চাবি দিয়ে!" "না মানে বাবার উইল, মায়ের গয়না, কাগজপত্র সব বার করতে হবেত", দাদার উত্তর। "কিন্তু এখন সেগুলি বার করতে হবে কেন!"- বৃষ্টির বিস্ময় কাটে না। মেজদি বলে,"বাঃ! বাবা কি রেখে গেছেন, কাকে কি দিয়ে গেছেন, দেখতে হবেনা " বৃষ্টি বলে,"এখনি দেখতে হবেই বা কেন!" বড়দি আমতা আমতা করে বলে,"আসলে সে সব ঠিক মত সবার মধ্যে ভাগ করতে হবেত।" " কিন্তু বড়দি,সেটা ত পালিয়ে যাবেনা। বাবার মৃতদেহ এখনও বাড়ীতে। দাহ হয়নি, আর এখনই  ভাগ বাটোয়ারা করতে হবে। দু /এক দিন পরে করা যাবেনা! আশ্চর্য্য! লোকে শুনলে কি বলবে!"
--
এবার হাল ধরলেন মেজদা,"বেশী পাকামী করো না! কোন লোক আছে এখানে, আমাদেরের একান্ত নিজেদের জন ছাড়া। আর এই গণ্ডগোলের মধ্যে মৃতদেহ নিয়ে তো বেরনো যাবে না, তাহলে আসল কাজ সেরে ফেলতে বাধা কোথায়।" এরপর কথা বাড়াতে বৃষ্টির প্রবৃত্তি হল না,"দ্যাখো, বাবার বিছানার গদির নীচে আছে!" "না না, বাকী বিছানা তো আমরা দেখেছি। বাকি শুধু....,বৌদির অসমাপ্ত কথা টা বৃষ্টি বুঝল, নীরবে বাবার বালিশের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে গোটা দশেক হাত ঝাঁপিয়ে পড়ল।
--
ভোর রাতে, বাবাকে দাহ করে ফিরে এসে বৃষ্টি অবসন্নের মত তাঁর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বেলা আটটায় ঘুম ভাঙলে, চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন দক্ষ যজ্ঞ হয়ে গেছে সে ঘরে। উঠে চোখ মুখে জল দিয়ে ভাল করে ঘরটা গুছাল, পরিষ্কার করল।বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, টেবিলের ঢাকনা সব বদলালো। বাবার আরাম কেদারার কাছে তাঁর হাতে পোতা একটা ফুলের টব রাখল। অনেক ফুল দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে, দেয়ালে টাঙানো বাবা আর মার বড় ছবি দুটিতে  মালা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে দিল।
--
স্নান সেরে, জামা কাপড় বদলে, বাবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। 'এঘরে এখন আর কারো দরকার পড়বে না। সবার প্রয়োজন তো কাল রাতেই মিটে গেছে' - একথা ভাবতে ভাবতে প্রিয় বান্ধবীর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেটা তাদের বাড়ী থেকে বেশ কিছু টা দূরে। যেতে যেতে মনে হল সারা পাড়ায় যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। দোকান পাট বন্ধ, লোকজন খুব কম। যারা বাইরে বেরিয়েছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন অদৃশ্য দুঃখের ঝড়ে ভেঙে পড়ছে, মুখ গভীর শোকে বিহ্বল। বাচ্চারাও যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। বৃষ্টির মনে হল কোন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে আছন্ন সমস্ত এলাকা। 
--
বান্ধবীর বাড়ীর গিয়ে দেখে তারাও শোকে মুহ্যমান। "বৃষ্টি, শুনেছি তোর বাবা কাল মারা গেছেন, কালই যাব ভাবেছিলাম। কিন্তু পাড়ায় যে অবস্থা যেতে পারিনি, কিছু মনে করিস নিত। আজ যেতাম, তা তুই এত সকালে বাড়ী  থেকে বেরিয়েছিস?" "সে অনেক কথা পরে বলব, এখন মন ভাল লাগছেনা।" "আমাদেরও আজ খুব মন খারাপ। শুধু আমাদের কেন সারা পাড়ায়, না সারা বেলেঘাটাতেই আজ শোকের দিন।" "হ্যা, এতটা রাস্তা আসলাম, মনে হচ্ছিল কি একটা মারত্মক কিছু ঘটেছে। তোদের বাড়ীরও সবাই শোকগ্রস্ত বোঝাই যাচ্ছে। কি হয়েছে রে?"বৃষ্টি জানতে চায়।    
--
"জানিস  কাল পাড়ার চারটে অল্প বয়সী ছেলেকে গুলি করে মেরে লেকের ধারে ফেলে দিয়ে গেছে।" বৃষ্টি জিজ্ঞাসা করে, "সেকি, কেন !" "ওরা যে এই সমাজ ব্যবস্থা কে পাল্টাতে চেয়েছিল।" "মানে?" "মানে,ওরা নতুন মানুষ হতে চেয়েছিল। নতুন একটা সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।" তারপর দুই বন্ধু চুপচাপ। মুখে কারও কোন কথা নেই, কিন্তু মনের মধ্যে যেন উথল পাতাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
--
বৃষ্টি বিরাট এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে," আচ্ছা আমাদের বাবা যে ছেলেমেয়েদের কে প্রাণপাত করে মানুষ করেছেন , তাঁর মৃত্যু তাদের মধ্যে কোন দাগ ই রেখ গেল না। অথচ এই ছেলেগুলির জন্যে সমস্ত এলাকা শোকস্তব্ধ। তাদের মৃত্যু অনাত্মীয় মানুষের বুকে কি বিশাল ভার চাপিয়ে দিয়েছে, কেন !" উত্তর এল," ওরা যে সূর্য্য ধরতে চেয়েছিল।"
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



















      






















































  

8 Dec 2015

সেবা


সেবা
****

শিল্পী হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। ঘরে ঢুকলেন এক ভদ্রমহিলা, "দিদি, আমি তোমার দিনের আয়া মাসী, আমার নাম বীণা ঠাকুর।" অবাক চোখে দেখে শিল্পী, কি অদ্ভুত মায়া জড়ানো একটা মুখ, পরিষ্কার পাটভাঙা সাদা  লালপাড়ে ছাপা শাড়ি। চেহারায় একটা নির্ভরতার আশ্বাস। আমতা আমতা করে বলে, "তা আপনি বসুন।" "এইতো, প্রথমেই পর করে দিলে, তুমি বল, নাহলে ক্যামন যেন বাইরের লোক মনে হয়," বলেন বীণামাসী।
--
সেটা ছিল আশির দশক। শিল্পী সন্তান সম্ভবা, জন্ডিজ হবার ফলে একমাস আগেই ডাক্তারবাবুরা ভর্তি করে নিয়েছেন, যদিও সেই হাসপাতালের প্যাথলজী ডিপার্টমেন্ট এর রিপোর্ট এ জন্ডিস ধরা পড়েনি। কিন্তু গাইনোকলজির ডাক্তাররা সিমটমগুলি শুনে  তাকে ভর্তি করে নিয়েছিল। তখন তাঁদের সিনিয়র অনুপস্থিত ছিলেন। জুনিয়ার ডাক্তারা নিজেরাই রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসে। তাতে জন্ডিস পাওয়া যায়, অবস্থা খুব সিরিয়াস ছিল, মরণ / বাচন সমস্যা এবং এমার্জেন্সি কেস।  
--
শিল্পী, স্বামী সরকারি অফিসার হবার সূত্রে কেবিন এ ছিল। বই পড়া, মাঝে মধ্যে বারান্দায় হাঁটা আর জানালা দিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। তাই বীনা মাসী তাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দিতেন, শুধু বাড়ীর লোকের আসার সময় টুকু বাদ দিয়ে। বীনামাসী সংসারে মূল উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন। তিনটি সন্তান আর রুগ্ন স্বামীকে নিয়ে তাঁর সংসার, বনগাঁয়ে বাড়ী।
--
রাত ভরে উঠে ঘর সংসারের কাজ আর রান্না করে সকাল আটার মধ্যে কেবিনে হাজির হয়ে যেতেন। কোনদিন ডিউটি তে কোন রকম অবহেলা, বিরক্তি বা ঘেন্না তাঁর ছিল না। মায়ের স্নেহ দিয়ে রুগীকে যেন আগলে রাখতেন। অন্য কোন আয়ামাসী রুগীদের প্রতি কোন বিরক্তি দেখলে ই সজোরে প্রতিবাদ করতেন,"রাগ করলেতো চলবে না, এ হল সেবার কাজ, রুগীকে সন্তানের মত দেখতে হবে, যত্ন নিতে হবে। তা না পারলে এ লাইনে আসা কেন বাপু।"
--
শিল্পী এবং সাধারন ওয়ার্ড এ ছিলেন এমন আর  একজন রুগীকে নিয়েও  হাউসস্টাফরা খুব চিন্তিত ছিলেন। তাঁর ও একই অবস্থা। অসীম যত্ন নিয়ে এই জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা সব রুগীদের দেখতেন, বিশেষত জন্ডিসে আক্রান্ত হবু মায়েদের প্রতি ছিল সতর্ক নজর, রোজ তাঁদের পথ্য থেকে শুরু করে সব খবর নিতেন।
 --
একদিন সিস্টাররা ওয়ার্ডের রুগীর ব্যাপারে নালিশ করেন। আগের দিন নাকি তাঁর স্বামী তাঁরই আবদার রাখতে লুকিয়ে কাটলেট এনে খাওয়াছিলেন, আধখাওয়া কাটলেট টি দেখালেন। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারবাবুরা বকলেন,"আপনি আপনার নিজের ভাল বোঝেন না। কোথায় আমরা আপনাদের সুস্থ করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, আপনি নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছেন। এমনি করলে আপনার বাড়ীর লোক আসা বন্ধ করে দেব।"
--
কদিন পর রাতের মাসীর কাছে শিল্পী জানতে পারল, ওই রোগিনী মারা গেছেন। পরদিন সকালে বীনামাসীকে খবরটা দিল। শুনেই মাসী রেগে টং, "কে বলল তোমাকে ? রাতের মাসী বুঝি ! সত্যি এদের কোন আক্কেল নেই ! গল্প করার বিষয় পায় না। দিদি, তুমি এসব আবোল তাবোল কথা একদম শুনবে না কিন্তু।" শিল্পী আর কথা বাড়ায় না।
--
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল, তার প্রসবের দিন এসে গেল। সকাল থেকে ব্যথা শুরু হল অল্প অল্প। যে সিনিয়ার ডাক্তারের অধীনে শিল্পী ভর্তি ছিল রাউন্ডে এসে, জুনিয়র ডাক্তারদের বলে গেলেন, বেরোবার মুখটা পরিষ্কার করে দিও।"
ক্রমে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যে একজন স্যারের  নির্দেশ মত কাজ করে, তাকে সাহস জুগিয়ে গেল,"একদম চিন্তা করবেন না, আমাদের আজ নাইট শিফট না থাকলেও অসুবিধা কিছু হবেনা। যাদের ডিউটি আছে, তারাই দেখাশুনা করবে।"  
--
রোজ বীনা মাসীকে শিল্পী আগেই ছেড়ে দিত, অনেক দুর তাঁকে যেতে হয় বলে। কিন্তু বার বার বলা সত্বেও সেদিন তিনি রাজী হলেন না। রাতের মাসী যথারীতি দেরী করে এলেন। বীণা মাসীর যেতে রাত হয়ে গেল। যাবার সময় রাতের মাসীকে বললেন,"আমি ট্রলি আনতে বলে যাচ্ছি। দিদিকে একদম ছাড়বেনা, সব সময় সঙ্গে থাকবে। অন্য কোথাও গল্পে জমে যেওনা।"
 --
বীণামাসী যাবার পরই খুব জোর প্রসব বেদনা শুরু হল। নীচে বীণা মাসী, আর অপেক্ষা রত শিল্পীর স্বামী আর বাবা দৌড়া দৌড়ি করে ট্রলির ব্যবস্থা করলেন। লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। সেখানে সারি সারি বেডে প্রায় জনা দশেক প্রসূতি অপেক্ষায় রয়েছে। শিল্পীর সারা রাত যন্ত্রণা হতে থাকল, ব্যথা ওঠে আবার পড়ে যায়। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে মনে হতে থাকে,পাশে দাঁড়ান মাসীর কাছে কয়েক বার জল চায়। মাসী মাঝে মধ্যেই ঘন্টা ভর ডুব দ্যায়। তখন একটু জল দেবার ও লোক মেলে না। এই চলে সারা রাত।
--
 ভোর হয়ে আসে, দ্বিতীয় লেবার রুমে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। দরজার কাছেই সে বেড পেল। জল ভাঙতে শুরু হয়ে যায়। শুরু হল নবাগত নার্স দের হাত পাকানোর পরীক্ষা। একটি ট্রেইনি নার্স সাহস করে এগোয় পরীক্ষার নামে হাত পাকাতে। শিল্পী চোখ পাকিয়ে এক ধমক লাগায়,"একদম হাত দেবে না।"মেয়েটি পালিয়ে বাঁচে। ইতিমধ্যে বীণা মাসী এসে গেছেন, সব দেখছিলেন। এবার কাছে এসে বললেন, "ঠিক করেছ দিদি, ওদের ওপর তো আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই।"        
--
সকাল বেলায় সেই সিনিয়র ডাক্তার, হাউস স্টাফদের নিয়ে উপস্থিত হলেন। সারা ঘর ঘুরপাক দিয়ে তিনি যেই দরজা দিয়ে বার হতে যাবেন, শিল্পী খপ তাঁর হাত টা চেপে ধরে,"আপনি আমাকে না দেখে যেতে পারবেন না।" "না, না, দেখছি, দেখছি।" জুনিয়ররা বার বারই তার দিকে দেখছিলেন, কিন্তু স্যার কে কিছু বলতে পারছিলনা। এবার তাঁরা নীরবে উত্সাহিত করার ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালেন। বড় ডাক্তার দেখেই বললেন,"তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটার নিয়ে যাও, অজ্ঞান করে ডিপ ফর্সেভ দিয়ে বাচ্চা বার কর। সাবধান গলায় কর্ড জড়িয়ে আছে।"
--
তাঁর ইমিডিয়েট সিনিয়র ডাক্তারের নেতৃত্বে জুনিয়র ডাক্তারদের টিম শিল্পীকে এটেন্ড করতে শুরু করলেন। জ্ঞান ফিরতে তার কানে এল, একজন জুনিয়র ডাক্তার বলছেন,"শুনুন, আপনার বাচ্চা হয়ে গেছে।" সারাদিন লেবার রুমের একটা বেডে অঘোরে ঘুমাল সে। বিকালে ঘুম ভাঙতে, যিনি অপারেশন করেছিলেন এসে পরীক্ষা করে, কেবিনে ফিরিয়ে দিতে নির্দ্দেশ দিলেন।
--
ট্রলি করে কেবিনে ফিরে শিল্পী, দেখল মা, বাবা আর স্বামী বসে আছে। মা উদ্বিঘ্ন গলায় প্রথমেই বীণামাসী কে জিজ্ঞাসা করলেন,"বীণা বাচ্চা কেমন আছে?" "এখন ভাল আছে মাসীমা, মস্ত ফাঁড়া কাটিয়ে মা - ব্যাটা বেঁচে ফিরেছে। দিদি ভাগ্যিস বড় ডাক্তার বাবুর হাত চেপে ধরেছিল। বাচ্চার গলায় নাড়ী জড়িয়ে বার হতে পারছিল না। তবে হ্যা মাসীমা,  হাউসস্টাফ রা আপ্রাণ করেছে। বাচ্চা অনেক্ষণ কাঁদেনি, ওদের চেষ্টার ফলে শেষ পর্যন্ত কেঁদে উঠেছে, প্রাণে বেঁচেছে।" আরও চার দিন বীণামাসীর যত্নে থেকে বাচ্চা নিয়ে বাড়ী ফেরে শিল্পী। 
--
এরপর কত বছর অতিক্রান্ত, আজও তার মনে বীণা মাসীর ছবি অম্লান। সেই জুনিয়র ডাক্তারদের নাম আজও তার মনে আছে, গঙ্গা, অমিতাভ, অভয়। তাঁরা সকলে ডাক্তার নরম্যান বেথুনের উত্তরসূরী।
 _________________________________________________________________________________________








    

7 Dec 2015

বাঁশী কেন কাঁদে

বাঁশী কেন কাঁদে
**********

নতুন পাড়ায় আসার পর দ্যূতি রোজ রাতে লিখতে বসলে, অদূরে কোথা থেকে বাঁশীর অপূর্ব একটা মন উদাস করা মেঠো মিষ্টি সুর শুনতে পায়। শুনতে শুনতে লেখে। খুব সুন্দর লাগে। যেন একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। লেখা কেন শুধু,  রাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই কান খাঁড়া হয়ে থাকে বাঁশীর সুরের জন্য। কে বাজায় জানতে খুব মন চায়। শিল্পীকে একবারের জন্য দেখতে ইচ্ছা হয়।
--
আসেপাশের লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে। শেষে পাড়ায় বিশুকে জিজ্ঞাস করে,"বিশু, বলতে পারো রোজ রাতে এত সুন্দর বাঁশী কে বাজায় ?"  "কাকিমা ওত আপনাদের কলমিস্ত্রি নিশীথ।" দ্যুতির মনে পড়ে , প্রথম দিন তাদের বাড়ী এসেই, নিশীথ বলেছিল, "বৌদি, আপনাগো ঘরেতো বই ই বই। আমি এক আধটু পড়থে পারি। সময় কইরা লইয়া যামু কিন্তু, পড়নের লাইগ্যা।" "বাঃ এতো খুব ভাল কথা, নিও। তুমিতো খুব সুন্দর বাঁশী বাজাও!" "তা হুন্দর হয় কিনা কইতে পারিনা, বাজাইতে ভালবাসি। সবই তো দ্যাশে ছাইরা আসছি। হুধু বউ, বাঁশী আর বাজান ডা সাথে নিয়া আসছি। এখানে আইসা একডা মাইয়া হইসে। এই আমার রাজার ধন, এডুকু লইয়া য্যান থাইকতে পারি"-- বলে দিল খোলা এক হাসি হেসেছিল।
--
ওপার বাংলার নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান নিশীথ। বাংলা দেশ থেকে রোজগারের চেষ্টায় প্রায় এক কাপড়ে বউ কে নিয়ে  চলে এসেছিল কলকাতায়। অনেকের মতই কিছু কাল রেলস্টেশনে কাটিয়ে, খালপাড়ে একটা আস্তানা জুটেছে। যখন যে কাজ জুটেছে তাই করেছে। ক্রমে কলের কাজ শিখে নিয়ে কলমিস্ত্রির কাজ করছে।  
--
তাও বোধহয় কপালে সইল না। একদিন বাঁশী থেমে গেল। দিন যায়, বাঁশীর সুর আর রাতের হওয়াতে ভেসে আসেনা। দ্যূতি শেষে থাকতে না পেরে আবার বিশুকে জিজ্ঞাসা করে, "নিশিথের খবর জান ? কেমন আছে? ও আর বাজায় নাতো। "
--
"বৌদি, আপনি শোনেননি, নিশীথের মেয়েটা কোথায় চলে গেছে, মানে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।" "সেকি, দ্যূতি আর কিছু বলতে পারে না, ভাবতে ভাবতে বাড়ী ফিরে আসে। রোজই বিশুর কাছে খবর নেয়। নিশীথরা পাগলের মত মেয়েকে খুঁজছে, সাত সকালে বার হয় আর রাতে ফেরে। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার কোন খবর নেই।
--

শেষে একদিন নিশীথের মেয়ে ফিরে এল, কিন্তু লাশ হয়ে, খালের জলে কচুরিপানার সাথে ভেসে। বিশুর কাছে ই প্রথম শুনল, তারপর অবশ্য খবরের কাগজেও দেখল,"ছয় /সাত বছরের শিশুকে গ্যাং রেপ, তারপর শ্বাস রোধ করে হত্যা করে খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 --
দেখতে দেখতে দু / তিন মাস কেটে গেল, নিশীথ কাজে মন দিতে পারে না, খায় না, ঘুমায় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বউ স্বামীর অবস্থা দেখে নিজের দুঃখ চেপে, কান্না গিলে, তাকে সান্তনা দেয়,খাওয়ানোর চেষ্টা করে। দ্যূতি বিশুর কাছ থেকে সব খবরই পায়, কিন্তু  যেতে চাইলে বিশু মানা করে। রাতে বেশী করে নিশীথের  কথা মনে পড়ে। 
--
অবশেষে একদিন গভীর রাতে হটাত বাঁশীর করুন সুরে বেজে উঠলো। দ্যুতির মনে হল এ যেন সুর নয়, মনের তীব্র যন্ত্রণার প্রকাশ। বাঁশী যেন কাঁদছে।  মন ভারী হয়ে আসে। তারপর থেকে প্রতিদিন বাঁশীর কান্নার মূর্ছনা গভীর রাতের আকাশ ভরিয়ে তুলত। 
--
আস্তে আস্তে নিশীথ আবার কাজ করতে শুরু করলো। একদিন দ্যুতির বাড়ী কল সারাতে এল। কাজ শেষ করে কান্না চাপা গলায় বলল,"বৌদি, আমার সাত রাজার ধন চুরি হইয়া গেসে শুনছেন।" নির্বাক দ্যূতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
"আস্সা বৌদি, ওরা কি মনিষ্যি! কি কইরা একফোডা মাইয়ার সাথে হেই নোংরামি ডা করতে পারল! আর পুলিশ্গুলান, আমারে জিগায়,'মাইয়া আমার কাউর লগে পিরিত করত নাকি!' আমি কই, 'বাবুমসইরা মাইয়া আমার মায়ের গড়ন পাইসে, মায়ের কাপড় ডা জড়াইয়া মা সাইজ্যা খেলা কৈরতাসিল। দ্যাখতে নয় / দশ লাইগতে পারে, কিন্তু মাত্র সাত বত্সরের আছিল, পিরিত বোঝনের বয়স ই হয় নাই। তাও ছাড়ান দ্যান, মাইরা ফ্যালোনের বিহিত ডা তো করেন।'কত দিন হইয়া গ্যাল, কোনডারে ধইরতে পাইরে না! কারেই বা কোই। আমি বাপ হইয়া কিইবা কর্তে পারসি।" 
--
দ্যুতি কিছুক্ষণ বোঝাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে তো অন্তঃসার শুন্য কিছু কথা। আসলে নিশীথের কথার কোন উত্তর তার জানা ছিলনা। তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে বাঁশী বাজানোর কথা তুললো। "বৌদি, আমি ত বাঁশী আর বাজাই না, কান্দি, কাইন্দা কাইন্দা মাইয়াডারে ডাকি। ডাইক্যা কই, কি দোষে আমারে ছাইরা গেল! অর কি এখন যাওনের সময়!"
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------     









  













5 Dec 2015

স্বপ্ন -- (2)

স্বপ্ন - (২)
***

বিশাল সে জলরাশি পৃথিবীর বুকে,
জন্ম নিয়েছিল জীবন যেখানে,
আমি চেয়েছিলাম তার অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দু জল হতে।
দিগন্ত বিস্তৃত বালুকাবেলা যার উপর দিয়ে পা পা করে
এগিয়েছে সভ্যতা, সহস্র কোটি যুগ ধরে,
চেয়েছিলাম শুধু তারই এক অতি নগণ্য বালুকণা হতে।
যে মেঘেরা অঝোর ধারায় সিক্ত করে চলেছে এই ধরনীকে, 
চেয়েছিলাম তারই ছোট্ট এক টুকরো মেঘ হতে।
উঁচু ঋজু পাহাড়গুলি, যাদের গর্বিত মাথা আকাশে ঠেকেছে,
চেয়েছিলাম তাদের এক অকিঞ্চিতকর নুড়িপাথর হতে।
যে আদিম বনানী এই গ্রহকে সবুজের রঙে রাঙিয়েছে,
চেয়েছিলাম তারই রঙে একটু সবুজ হতে।
 --

সাগরের মাঝে যে অগনিত ঝিনুক ভাসে,
আমি চেয়েছিলাম সেই একটা ঝিনুক হতে।
যে বাতাস খেলে যায় এ ধরার এক প্রান্তর অপর প্রান্তরে,
আমি চেয়েছিলাম তার সাথে একটু খেলতে।
সকালের সোনাঝরা নরম রোদ গায়ে মেখে,
চেয়েছিলাম বুকভরে মিষ্টি ফুলের নির্য্যাস নিতে।  
যে মানুষেরা জীবনে সত্যের জন্যে যুগ যুগান্ত ধরে লড়ছে,
চেয়েছিলাম তাদের পথে হাঁটতে।
বিশ্বব্রম্ভান্ডের ঘূর্ণনের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম।
অনন্ত আকাশের অসীমতায় মিশে গিয়ে,
স্বপ্ন দেখেছিলাম তার নীলিমায় নীল হতে।   
স্বপ্ন দেখেছিলাম মানুষের মত মানুষ হতে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------