17 Dec 2016

ভাবনা

ভাবনা
******
নীল আকাশে সাদা মেঘের  সারি
অলস কল্পনায় ভাসি
অসীমের পানে ছুটে যেতে
অবিরত দেয় হাতছানি।  
--
এ ধরণীতে সহস্র কোটি প্রাণ
তারই  মাঝে বাজে জীবনের গান
শক্ত মাটিতে পা রাখার
সুতীব্র সুগভীর আহবান।
--
অনন্ত আকাশে মুক্ত মেঘমালা
অন্ধকারে আশার প্রদীপ জ্বালা। 
কঠিন কঠোর জীবন
বয়ে আনে জ্ঞানের ঊর্ম্মিমালা।
--
অবিরাম জীবনকে জানা
তারই গর্ভে জন্ম নেয়
হাজার ভাবনা
ভাবনা - নতুন ভাবনা
***************

26 Nov 2016

কালো ধন

কালো ধন
******
'কালো ধন উচ্ছেদ ' সাবাস ভাই সাবাস  
রাতারাতি নোট বাতিল, সাবাস  
'স্বচ্ছ ভারত' সাবাস।
--
রাঘব বোয়ালেরা নিশ্চিন্তে, কালো ধন দূর বিদেশে  
যেটুকু বাকী, সময় মত সাদা হয়ে গেছে 
কি জানি কার অদৃশ্য ইঙ্গিতে !
--
সাধারণের ঘরে শুধু কঠোর শ্রমের ফসল 
হঠাৎ কি করে যেন হয়ে গেল অচল
বলির পাঠা তারাই কেবল !
--
সৎ রোজগারের ধন এখন কালো
বাঁকা পথই কি তবে ভালো !
সোজা মানুষ কি পেল !
--
বিদেশের কালো টাকা ঘরে কি ফিরেছে?
লাখ পনেরো কজন পেয়েছে ?
উত্তর কি মিলেছে ?
--
অন্যদিকে ভোট বাজারের ভাবনা
শুধু গরম গরম ঘোষণা
বোঝে নাকি জনতা !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

12 Nov 2016

বয়স আঠারো

বয়স আঠেরো
**********
আঠেরো বছর বয়স
টগবগে তরতাজা সময়
নুতন স্বপ্ন দেখা। 
বুকভরা সাহস, সততা 
উদার, নির্ভিক চেতা, 
দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলা।
যাপনে ত্যাগের ব্রত
দেশ ও দশের তরে
তাগিদ কিছু করা।
--
আঠারো বছর বয়স
বড় মধুর, বড় সুন্দর সময়
স্মৃতির  কণাগুলি জুড়ে
আগামী দিনের ক্যানভাস,
প্রতি পল অবিরত 
তাড়া করে ফেরে। 
সারা জীবন ভরে
আঠার বছরের সঞ্চয়
রয় মনের গহন গভীরে।   ++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++         


10 Nov 2016

দাদার কীর্তি


দাদার কীর্তি
*********
রপ্তানি করেছি দাঙ্গা
দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন
বিক্রি করেছি অস্ত্র
পাঠিয়েছি যুদ্ধ জাহাজ
বোমারু বিমান বিধ্বংসী 
আজ আমারই ঘর বিপন্ন।
হিরোশিমা নাগাসাকি
সে আমারই কারসাজি। 
কার্পেট বোমবিং এর বীজ
বুনেছি ভিয়েতনাম, লাওস
ক্যাম্বোডিয়া, সমগ্র আরব দুনিয়ায়,
তারই চারা গাছ জন্ম নিয়েছে
আমার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক অঙ্গনে।
আধিপত্য বিস্তারে তৈরী করেছি
ষড়যন্ত্রী জঙ্গি, জীবন্ত রোবট কত শত
ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে তারা আমারই দুয়ারে 
ছড়িয়েছি মারণ বিষ পৃথিবীর কোনে কোনে
ঘৃণিত দস্যু আমি আজ বিশ্বের দরবারে।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++         
     



 

9 Nov 2016

দিশারী - পর্ব 6

দিশারী - পর্ব ৬
************
প্রায় তিনটে বছর পার হয়ে গেল। দিশারী বাড়ীর  জন্য প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখিয়ে যায়। আশায় থাকে একদিন বাড়ীর লোক ঠিক চিঠি পেয়ে তাকে নিতে আসবে। কিন্তু মনে সন্দেহ রয়ে যায় চিঠি ঠিক জায়গায়  পৌঁছাচ্ছে না, কারন বোঝে ঠিকানা টাই সে ঠিক মত বলতে পারছে না। ইতিমধ্যে হটাৎ করে রশ্মি ছাড়া পেয়ে যায়। হাওয়ায় কথা ভাসে, সে নাকি লাইনে নেমেছে। কারণ ইদানিং সুইপার লছমীরানীর আর কুখ্যাত এক জমাদারনীর সাথে তার খুব ঘনিষ্টতা বাড়তে দেখা গেছিল। আলো মাসী তাকে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে কথা শুনতো না, ওই দুজনের সাথে মেয়ে পাচারকারী চক্রের যোগাযোগ আছে বলে অনেকে সন্দেহ করত।
--
জেনানা ফটকে তিন জন মহিলা সুইপার আসতো - শ্যামবাই, ছোট লছমীবাই আর বড় লছমীবাই। বড় লছমীবাইকে মেট্রন গোষ্ঠী লছমী রানী বলে ডাকত। সে অন্য দুজনের তুলনায় বয়স্ক আর সবচেয়ে পুরান লোক ছিল। কর্তৃপক্ষের খুব কাছের মানুষ, তাদের অনেক কুকর্মের ভাগীদার। তাই সাধারণ বন্দীরা তার থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করত।
--
রশ্মি লাইনে নেমেছে, একথা মানতে দিশারীর মন চাইত না, "রশ্মি দেহ বেচে খায়। এ হতে পাইরে না।" বছর ঘুরতে না ঘুরতে একদিন রশ্মি আরও কয়েকটি মেয়ের সাথে জেলে এল। তার সাজগোজ, ধরণ ধারণ ই পালটে গেছে, এখন তার নাম লীনা। দিশারীর কাছে সে কিছু গোপন করল না, বলল,"আমাদের মাসী তো কালই আমাদের ছাড়িয়ে নেবার ব্যবস্থা করবে। তুই চাইলে তোকে বার করার ব্যবস্থা করতে পারি। নাহলে তোকে এই জেলেই পচে মরতে হবে। আসবি দুজনে একসাথে থাকব।" ঘৃনায় দিশারী মুখ ঘুরিয়ে নিল,"ছিঃ! দেহ বেচার চে জেলে পইচে মরাও ভাল।" রশ্মি মুখ বেজার করে সরে গেল। পরদিন তারা ছাড়া পেয়ে গেল। এরপর সে আরও এক দুবার জেলে আসে, ১/২ দিনে ছাড়াও পেয়ে যেত।
--
একদিন মা র মুখে শুনল তাদের সাত জন ছেলে শেয়ালদা কোর্ট থেকে কেমন করে পালিয়েছে। শুনে দিশারী দারুন খুশি, "বেশ হইছে।পেইলে যাবার ঠিক জায়গা বেইচেছে। ওহানে যা নোকজন এক্কারে থই থই কইরতেছে। একবার  ভীড়ে মিসে জাতি পাইরলে, কে ধইরবে। মারে,আমারে যদি একবার শেলদা কোটে নে যায় তো ওই ভীড়ে আমিও পেইলে যাব, তুই দেইখিস ক্ষণে। "
--
একদিন দিশারী গরাদের ওপার থেকে উত্তেজিত গলায় ডেকে বলে,"হই শুইনেছিস, মোর শ্বহুরবাড়ীর গেরামের এক বুবু এইসেছে, সে মোর স্বামীদের ঘর ভাল চেইনে, মোদের কথা হবি নাকি জাইনে, মোরে বইলেছে ছেইড়ে নে যাবে।"
"বাঃ, এতো ভাল কথা। তা কি কেসে জেলে এসেছে, নাম কি ?" "দাঁইড়ে থাক, ডেইকে আইনতেছি, অ তুলসী বুবু, এপাশে এইসতো, মোর মা ডাইকতেছে।" একজন আধা গ্রাম্য আধা শহুরে মহিলা এসে দাঁড়াল।" মাসী, তুমি দিশারীর শ্বশুর ঘর চেন ?" "হ চিনিত,ওদের গুষ্টিগোত্তর সব জানি।" "তুমি কি কেসে এসেছ ?" "পেটের দায়ে গাঁ থেইকে আনাজ পত্তর এইনে শহরে বেচি। মাস ফুইরে গেইছে খ্যাল ছিলনি, নূতন মাসিক টিকিট কাটা হইনে, তাই ধইরেছে।"
"কিন্তু ওকে কি  ওর স্বামী ঘরে নেবে।" "নারে মা, সোয়ামির ঘর আমি যাবনি, শেলডা ইস্টিশনে মাসি নে যাবে, আমি বাপ্ মায়ের ঘরে চইলে যেইতে পাইরব।"
--
তুলসী মাসি দিন সাতেক সাজা খেটে বেরিয়ে গেল। দিশারী কে বলে গেল সে তার গ্রামে গিয়ে ফকির মিঞার সাথে সব কথা বার্তা বলে ঠিক করে রাখবে। প্রথমে তার নিজের স্বামী কে ইন্টারভিউ করতে পাঠাবে, তারপর কোর্ট ফেলার ব্যবস্থা করে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে, শেয়ালদা থেকে সে তার নিজের বাড়ী যেতে পারবে। প্রায় একমাস বাদে দিশারীর ইন্টারভিউ এল। সবাই খুশী। দিশারী মুখে হাসি, চোখে আনন্দের ঝিলিক। ডগমগ হয়ে ইন্টারভিউ তে গেল। কিছক্ষন বাদে সে যখন ফিরে এল, সমস্ত আলো মুছে গেছে, কপালে চিন্তার ভাঁজ।
--
সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল,"কিরে, কি হইল, কে এইসেছ্যাল, কি বইল?" দুটো ভারিক্কি গোছের নোক এইছ্যাল। তার মধ্যি একজন কইল বুবুর সোয়ামি, অন্যজনে তার পাড়ার নোক।" "ত তুই মুখটা অমন কালোপানা  কইরেছিস ক্যানে ? তোর বাপেরে খপর দ্যাছে ? তোরে ছাড়ায়ে নে যাবেনি ?" " কি জানি মোর কপালে কি আছে," বলে দিশারী থম মেরে বসে রইল।
--
ডিভিশন বাড়ীর দিদিরাও দিশারীর অপেক্ষায় ছিল," আর কি হল বলবি তো, চুপ করে আছিস কেন ?"
"জানিসনে ত, বুবুর সোয়ামীরে শুইধেছি, বাপেরে বুবু কি খপর দেছে, শুধু ঘাড় নেইরে হ্যা বইলে, মোর বাপমা মোর কথা কি বইলেছে স্যা সব বইলেনি। সোয়ামীর কথা যেই শুইধেছি, অন্য নোক টা বইল, তুমি তো বে হইছে স্যাই কথা চেইপে গেইছ।" "আরে, অ তো নামে মাত্তর বে।" "বুবুর সোয়ামি আমারে বইল, তর কোর্ট পৈরবে, কেউ জানতি চাইলে বৈলবি আমি তর পিশা।"
--
শুনে  শুনে সবাই গম্ভীর হয়ে গেল, ব্যাপারটা সন্দেহজনক, তুলসীরা সম্ভবত কোন দালাল চক্রের সাথে যুক্ত। দিশারীর মুখে তার জীবনের কথা শুনে চাল চেলেছে আর বানানো গল্প করেছে। " তুই ঠিক সন্দেহ করেছিস। জজের কাছে তোকে তুললে তুই সোজা বলে দিবি চিনিনা।" আশ্চর্য্য বিষয় দিন তিনেক পরেই দিশারীর কোর্টের দিন পড়ল এতদিন জেলে পচার পর। দিশারী কোর্টে গেল, কিন্তু আর ফিরল না। ওর সাথে আর যারা সেদিন কোর্টে গেছিল, তারা খুব পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারল না। দু /একজন শুধু বলল দিশারীকে জজের কাছে তোলেনি, লক আপ থেকে খালাস বলে বার করে দিয়েছে। শঙ্করীকে ছাড়াতে তার আসল বাবা মা মাসের পর মাস উপযুক্ত প্রমান সমেত থানা, কোর্ট আর জেল এ চক্কর কাটতে কাটতে জেরবার হয়ে গেছিল। অথচ দিশারীকে অনায়াসে খালাস করে দিল ! কোন প্রভাবশালী চক্র এর পেছনে কি কাজ করল ! তার ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা অজানাই থেকে গেল ! রয়ে গেল বিরাট একটা প্রশ্নচিন্হ।       ++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

 দিশারী - পরিশিষ্ট
 *************
 হাসিনা আমার জেলের মেয়ে। কিন্তু দিশারী আমার মানসকন্যা। তাই তার সেই কথাটাই আমার কানে বাজে," মারে,  আমারে যদি একবার শেলদা কোটে নে যায় তো, ওই ভীড়ে আমিও ঠিক পেইলে যাব, তুই দেইখিস ক্ষণে।"    
 --
১৯৭৭ সালে সরকার পরিবর্তিত হল। ভোটের সময়ে ঘোষিত তাদের রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির কর্মসূচি কার্য্যকর হল। আমরা বার হলাম। তার বেশ কিছু সময় বাদে একটা খবরের কাগজে একটন খবর বার হয়, নারীপাচার চক্রের একটা দল ধরা পড়েছে। বড় লছমীবাই মা সেজে একজন কে ছাড়াতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে । সে নাকি তার স্বীকারক্তিতে জেল কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মচারী / কর্মচারিনী আর মেয়ে জমাদারনীর নাম বলে দেয় এবং রাজস্বাক্ষী হতে রাজী হয়। তাকে প্রেসিডেন্সি জেলেই রাজসাক্ষী হিসাবে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষী দেবার আগেই ভাটি ঘরে কাজ করতে গিয়ে তার গায়ে আগুন লেগে যায়, এমন বীভৎস ভাবে পুড়ে মারা যায় যে সে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দেবার সুযোগ টুকুও পায়নি। কিভাবে তার  আগুন লাগে, সেও এক বিরাট প্রশ্নচিন্হ !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++                                                                 


  
















      


























4 Nov 2016

দিশারী - পর্ব 5

দিশারী - পর্ব ৫
**********

ধীরে ধীরে দিশারীর বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মায়ের মত স্নেহ প্রবন আলো মাসি, রশ্মি,শ্যামবাই, সমেদা। তবে আলোমাসি আর শোভা তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। হাজতী নম্বর ছাড়াও আরও ওয়ার্ড ছিল - মেয়াদী নম্বর, জাল ঘর, পাগল বাড়ী, ডিভিশন ওয়ার্ড, সেল। শোভার কাছে শুনল ডিভিশন ওয়ার্ডে আর উপরের একটা সেলে রাজনৈতিক বন্দীরা থাকে। তাদের সাথে কাউকে কথা বলতে দেখলে মেট্রন, কিছু ওয়ার্ডার আর দালাল রা মারধর করে।
--
আগে নাকি শিখা বলে একটি ভয়ংকর হিংস্র একটা দালাল ছিল, তার নেতৃত্বে আর মেট্রনের নির্দ্দেশে দালাল বাহিনী কত মানুষ কে যে অমানুষিক মার মেরেছে, এমনকি মেরেও ফেলেছে তার হিসাব নেই। তাছাড়া বন্দিনীদের খাবার মারত আর বাড়ীর লোক দেখা করতে এসে কিছু দিয়ে গেলে কেড়ে নিত। জেল কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আর মেট্রনের প্রিয়পাত্রী ছিল, তাদের সব ঘৃণ্য কুকর্মের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল। সে থাকতে সাধারণ বন্দিনীরা তো বটেই কিছু ভালমানুষ ওয়ার্ডার ও তটস্থ থাকত।
--
 মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল কলকাতায় রুজি রোজগারের জন্য। ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা দালাল কাউকে ভয় করত না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রন কে ডিঙিয়ে সে জানতে চাইল কবে তার কোর্টের দিন পড়বে।পরে সেই অপরাধে  মেট্রনের অঙ্গুলি লেহনে শিখারা চুড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় তাকে পাগল বাড়ীতে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়। তাকে কেউ আর দেখতে পায়নি।
--
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগরি বাই এর স্বামীর নতুন করে বিয়ে হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়। শিখা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত। একদিন কোনমতে সেল থেকে বেরিয়ে সে রোদ পোহাতে গেছিল। সেই অপরাধে তাকে মেরে লোপাট করে দিল। "সে এক ভয় পাইত  ডিভিশন বাড়ী আর দোতলার স্যালের দিদিগরে", শোভা বলে। ওই দিদিদের সাথ আমারে একবার দেখা কইরে দিবি," "হ্ একই দিন ফাঁক বুইঝ্যা তরে লইয়া যামু।"
--
একদিন শোভার সাথে দিশারীকে পাগল বাড়ীতে খাবার পৌঁছে দিতে বলা হল। ভেতরে ঢুকে সে হতভম্ব আর নিঃশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। উলঙ্গ, মাথা কামান কিছু কঙ্কাল শেকলে বাঁধা। কেউ কাঁদছে। কেউ নোংরা মেঝে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছে। কেউ কেউ পাশেই তার সহবন্দিনীর সাথে খামচা খামচি করছে। যে যেখানে আছে সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ করছে।
--
 শোভা কাজ সেরে দিশেহারা দিশারীকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এল। "দ্যাখ, গড়িব ঘরের মানষে তাদের পাগল স্বজনরে এই হানে চিকিৎসা কইরা সুস্থ করনের লাইগ্যা দিয়া যায়। তারা জানেই না ক্যামনে এয়াদের চিকিৎছে হইত্যাছে,"শোভা বলে। "কিন্তু, এথানে সুস্থ নোকে, অসুস্থ হয়ে পইরবেনি !" কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিশারীর প্রশ্ন।
--
ইতিমধ্যে দিশারীর ডিভিশন বাড়ীর দিদিদের সাথে আলাপ বন্ধুত্বে দাঁড়িয়ে গেল। জীবনের সব কথা তাদের কাছে গল্প করত। দিদিদের কাছে নানা গল্প, তাদের জেলে আসার কারণ সব শুনত। তাদের সব কথা না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছিল এরা গরীব মানুষের বন্ধু। সমস্ত গরীব মানুষ কে এক হতে হবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়তে হবে, নিজেদের প্রাপ্য নিজেদেরই আদায় করে নিতে হবে। জেলে এসে তার অভিজ্ঞতা আরও বাড়ল। একদিকে চরম স্বার্থপরতা, লোভ, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা আর অন্য দিকে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, আত্মসম্মান বোধ। একদিকে অত্যাচার অন্যদিকে জোটবদ্ধ প্রতিরোধ।
--
একদিন প্রায় ১৫/২০ জন বন্দিনী একজোটে দালালদের অত্যাচার, কম খাবার আর বিনা অসুধ আর চিকিৎসায় মরার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। স্বাভাবিক ভাবেই দিশারী, শোভা, আলো মাসী আর তাদের বাকী বন্ধুরাও সেই জোটে ছিল। রাজনৈতিক বন্দীরা তখন ইন্টারভিউ থেকে ফিরছিল। তারাও ওদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেল। মেট্রন বেগতিক বুঝে দালালদের লোকদেখান বকাঝকা করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঠিকঠাক খাবার বাটালেন। মিষ্টি গলায় প্রতিশ্রুতি দিলেন এরপর সবাই অসুখ হলেই যেন হাসপাতালে তার কাছে চলে আসে, সবাই ঠিকঠাক চিকিৎসা পাবে।
--
আর একদিন রাতে হাজতী নম্বরে অনেক বন্দিনী এল। ভীড়ে সবার চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবার অবস্থা। এরই মাঝে একটি দুর্বল অসুস্থ বাচ্চা খিদের তাড়নায় কাঁদতে শুরু করে। রুগ্ন মায়ের শুকনো বুকে দুধ ছিল না। বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর মত কিছুই ছিল না, ফলে একনাগাড়ে বাচ্চাটা কেঁদেই চলে। আনোয়ারা, জোত্স্না আর বাকি দালালরা হুংকার ছাড়ে, "এই  মাগী তোর ওই বেজন্মাটা কে থামা শিগগিরি, নইলে গলা টিপে জন্মের মত চুপ করিয়ে দেব।" দিশারীদের দল এক জোটে রুখে দাঁড়ায়," একবার চেষ্টা কইরে দেখ ক্যানে, বাচ্চার কোন ক্ষেতি কইরতে চায়লে, আসো দেহি। কেমন ধারা মানুষ তমরা, পশুর অধম।" জোরাল প্রতিবাদে দালালরা বোবা হয়ে গেল।
--
রাজনৈতিক বন্দীদের জেল কর্তৃপক্ষ বা দালালরা সচরাচর ঘাঁটাতো না, প্রাপ্য জিনিসপত্র কিছুটা হলেও দিতো। কিন্তু সাধারণ বন্দিনীদের দুর্দ্দশার সীমা ছিলো না, এদিক-ওদিক হলেই মারধর। শুধু খাবার কেন, খাবার জলটাও ঠিকমতো জুটতো না। অসুখবিসুখে ওষুধপত্রও মিলতো না। আমরা চেষ্টা করতাম যাতে ওরা একজোট হয়ে নিজেদের দাবীগুলো আদায় করতে পারে। একজোট হয়ে দালালদের মারধোর ঠেকাতে পারে। দালালরা সব সময় চোখে-চোখে রাখতো, যাতে আমাদের সাথে ওরা কথা বলতে না পারে। কিন্তু তাই বলে জেলে লড়াই কখন থেমে থাকেনি। অন্যান্য বন্দিনীদের লড়াইয়ের পাশে আমরা সব সময় থাকতে চেষ্টা করেছি ,তাঁরাও আমাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। কখন লড়াই শুরু করেছে মীরা,শান্তিবাই,বেলা,রেখারা, কখন বা মিতা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, মদিনা ,শোভা, শান্তি মাসীর। কখন বার্মিজ মাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে, কখন মেয়াদী নম্বরের পাকিস্তানের পাসপোর্ট কেসের মাসীরা, আবার কখন মাস্তান একাই জেলকতৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবারে জীবন বাজী রেখে লড়ে গেছে।     
----
কিছুদিন পর দিশারীদের কয়েক জনকে মেয়াদী নম্বরে বদলী করে দেওয়া হল। ডিভিশন বাড়ীর দিদিদের সাথে পরিচয় হবার কিছুদিন পর থেকে প্রতি সপ্তাহে যে পোস্টকার্ড দেওয়া হত, তাতে তার হারান এবং বর্তমান বাসস্থানের কথা দিয়ে   তার মাকে চিঠি লিখে দিতে হত। "নেখ, পথমে ফকির মোল্লা, গেরাম রাইদিহি, সোন্দর বন।"
--
"পোস্ট অফিস কি? থানা কি? জেলা কি?" "ওসব বইলতে পাইরবনি।ডাকঘর চন্ননদিহি হোতি পাইরে।" প্রতিবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিকানা লেখা হত। সুন্দরবন হলে জেলা দক্ষিণ ২৪পরগনা হওয়া স্বাভাবিক। আর রায়দীঘি, চন্দনদীঘি উল্টে পাল্টে লেখা হত। কখন গ্রাম, কখন পোস্ট অফিস, বা কখন থানা, যদি কোনটা খেটে যায়। কিন্তু খাটে না দিশারীর বাড়ীর কোন খবর নেই।
--
ইতিমধ্যে শঙ্করী নামে হারান একটি বাচ্চা মেয়ের বাড়ীর লোক খবর পেয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, ভূতপূর্ব ওয়েলফেয়ার অফিসারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে। তবুও শঙ্করীর বাবা মাকে মাস কয়েক জেল, থানা, কোর্টে তদবীর করতে করতে পায়ের শুকতলা ক্ষয়ে যায়। যেদিন শঙ্করী ছাড়া পেল ততদিনে সেই অফিসার বদলী হয়ে গেছে। যাই হোক শঙ্করী ছাড়া পাওয়াতে সকলের মধ্যে একটা খুশী সেই সাথে একটা আসার সঞ্চার হয়।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
(চলবে )








  


















   













           

30 Oct 2016

দিশারী - পর্ব 4

দিশারী - পর্ব ৪
************
কখন ভোর হল দিশারী খেয়াল ই করল না। হটাৎ এক বিদঘুটে চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেল। তাকিয়ে দেখল গেটের সামনে একটি গোলাকার জমাদারনী বীভৎস মুখ বিকৃত করে গালি দিচ্ছে, " এই কুত্তীর বাচ্চা, চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি ? দেখছিস না সকাল হয়ে গেছে,গেট খুলতে এসেছি। ফাইলে না বসে গেট জুড়ে বসে আছিস কেন।" দিশারী তাকিয়ে দেখে ঘরের মাঝখানে সবাই একটা লাইনে বসতে শুরু করেছে। দুটি সর্দারনী গোছের মেয়ে চেঁচাচ্ছে," ফাইল, ফাইল। এই শালী ওখানে কি করছিস। ফাইলে বস তাড়াতাড়ি। "বইসতেছি, তা শুধু মুধু সক্কাল বেলা সকলে মেইলে গাল পারতেছো কেনে ?"
 --
"তব্বেরে, হারামীর বাচ্চা, খুব সাহস দেখি ", বলে তেড়ে গিয়ে তার চুলের ঝুঁটি ধরে। খাপরদার আমার বাপেরে গাল পারবেনি বলতেছি।" এদিকে গেট খুলে জমাদারনী দুই চেলা (দালাল বন্দিনী ) নিয়ে ভেতরে ঢোকে, "কি হয়েছে রে আনোয়ারা, এত গোলমাল কিসের ?" একসাথে কয়েক জন বন্দিনী দিশারীর পক্ষ নিয়ে বলে," ও বেচারা  মাত্র কাল এসেছে, কিছু জানে না। আনোয়ারা খামোখা ওর পেছনে পড়েছে।"
--
জোটবদ্ধ প্রতিবাদের মুখে জমাদারনী বিজয়া আর শিখা সহ সব দালালরা ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। "ও, নতুন বটে। ছাড়ান দে আনোয়ারা। গুনতি কর।" একজন সমবয়সী মেয়ে দিশারীর হাত ধরে টেনে লাইনে বসিয়ে দেয়। গুনতি করে খাতায় লিখে নেয় আর একটি দালাল। নতুন রা সব গেটের কাছে লাইন দে, 'কেস টেবিলে' যাবার জন্য," বলে গোলগাল ওয়ার্ডারটি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে যায়।
--
দিশারী গেটের কাছে 'কেস টেবিলে' যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যে গেট দিয়ে একজন মোটাসোটা ধোপদুরস্থ মহিলা ঢোকেন। সব ওয়ার্ডার আর দালালরা হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে,"নমস্কার মেট্রন মা।" মহিলা তাদের দিকে কৃপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু হেসে তার অফিসে ঢুকে যায়। হাসপাতাল টাই ছিল মেট্রনের অফিস ঘর।
--
তারপর ছেলে জমাদার বাইরে থেকে ঘন্টি বাজালে গেট খোলা হয়। এক জমাদারনী নতুন বন্দিনীদের নিয়ে তার সাথে ছেলেদের ওয়ার্ডের যায়। সেখানে বড় একটা টেবিলে ডেপুটি জেলার, বড় জমাদার আর এক / দুজন অফিস কর্মী ছিল। উল্টো দিকে নতুন বন্দীরাও লাইন দিয়ে বসে। সবায়ের নাম ধরে ডেকে জাবদা একটা খাতা থেকে তথ্য মিলিয়ে, কি সব লিখছিল আর একটা জাবদা খাতায়। প্রত্যেকের একটা বড় কাগজে (যাকে জেলে টিকিট বলা হত ) প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করে নিচ্ছিল।
--
দিশারী একটু যেন আসার আলো দেখল। এইবারে সে সব কথা বলতে পারবে, তাহলে নিশ্চয় বাড়ী ফেরার একটা উপায় হবে। তাকে ডেকে নাম ধাম, বাবার নাম সব লেখা হল, কিন্তু সে তার গ্রামের নাম ছাড়া থানা, পোষ্ট অফিস, জেলা কিছুই বলতে পারেনা। ডেপুটি জেলার তাচ্ছিল্য ভরে জিজ্ঞাসা, "কি দুষ্কর্ম করে এসেছিস ?" " চাচা আমি সুন্দরবনের মেয়া। কলকাতায় খেটে খেইতে এইসেছিনু। নোকের বাড়ী কাজ কইরতেছিনু। গেরাম থেইকে এইসে পথ হেইরে গেইছে। মোরে শেলদা ইস্টিশনে যদি পৌঁছায়ে দেন, আমি আমার কাজের বাড়ী আর গেরামে দুয়োই খানে যেইতে পাইরব। দয়া করেন, অনেক তাহইলে আল্লা আপনের অনেক দোওয়া কইরবেন। "
--
খ্যাক খ্যাক করে বিদ্রূপের হাসি হাসে টেবিলের সকলে মিলে। একজন বলে," লেখ হারান কেস। আর একজন বলে, "যত দিন না তোর বাবা মা কোর্টে জজের কাছে উপযুক্ত প্রমান দিতে পারবে ততদিন তোকে এখানেই থাকতে হবে। "সরকার এখন তোর অভিভাবক। তোকে খেতে পরতেও দেবে চিন্তা নেই। তোদের মত কত অসহায় মেয়েদের এভাবেই সরকার সব বিপদের থেকে রক্ষা করে।" "কিন্তুক মোর আব্বা আম্মা জানবেক কি কইরে, যে আমি ইখনে রইছি।"
উত্তর আসে, "যা যা কাজের সময় গোল করিস না। এটাই হল আইন " জেনানা ওয়ার্ডে ফেরার পথে দিশারী ভাবে, 'এ কেমন আইন! কেমন ই বা সরকার! তারা নির্দোষ মানুষ কে রক্ষা করার নামে অন্ধ কূপে বন্দী করে রাখে!
--
ধীরে ধীরে দিশারী তার নতুন পরিস্থিতিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে লাগল। তাকে একটা এলুমুনিয়ামের থালা, একটা কম্বল আর একটা বস্তার মত মোটা লাল পাড় সাদা শাড়ী দেওয়া হল। সকালে একমুঠ পোকা ধরা ছোলাসেদ্ধ, কাঁচা চিড়ে বা এক টুকরো পাউরুটি, বা এক ডাব্বু বিভিন্ন ফসলের মেশানো খিচুড়ি দেওয়া হত। দুপুরে এক ডাব্বু ভাত, ৫০গ্রাম মত, জলের মত ডাল আর, মুখে দেওয়া অযোগ্য সবজির ঘ্যাট, আর রাতে বাজরা/ জোয়ারের আধা কাঁচা তিনটে রুটি ছিল বরাদ্দ। গরীবের মেয়ে সে, বাড়ীতে অতি সাধারণ মানুষরা যা খায় তাই খেত, কিন্তু তাতে যত্ন আর স্নেহের ছোঁয়া থাকত। এখানে খাবার পশুর ও খাওয়ার অযোগ্য ছিল, তার পরিমাণ এতই অকিঞ্চিৎকর, যে সহ বন্দিনীদের মত পেটের আগুন কখন নিভতো না।
--
সকালে ঘন্টা ২/৩ মত তারা ছাড়া থাকত। সেই সময়ের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ করে স্নান থেকে শুরু করে সকাল ও দুপুরের খাবার খেয়ে এক থালা খাওয়ার জল নিতে নিতেই লক আপ এর সময় হয়ে যেত। আবার বিকালে ঘন্টা খানেকের জন্য ছাড়া পেত রাতের খাবার খেয়ে আর খাওয়ার জল নিতে নিতেই লক আপের সময় হয়ে যেত। সন্ধ্যে বেলায় সহ বন্দিনীদের সাথে পরস্পরের সাথে নীচু গলায় সুখ দুঃখ বাটা, আর রাতে এক চিলতে জায়গায় আধ শোওয়া হয়ে ঘুমান। এর ওপর ছিল জেলের দালাল বাহিনী আর মেট্রনের নির্দেশ মত ওয়ার্ডারদের অত্যাচার। আর এখানে খিদের জ্বালায় একটা  বাড়তি রুটি বা এক মুঠো ভাতের জন্য, একটু বাড়তি সুবিধার বিনিময়ে দালাল তৈরী করা খুবই সহজ ব্যাপার ছিল।
--
গরাদের ধারের ভাল জায়গা গুলি থাকত দালালদের জন্য। যদি ৭৫ জন লোকের থাকার ঘরে ২০০ লোক কে থাকতে হয় আর তার আধা জায়গা গোটা ৭/৮ লোক দখল করে নেয়, তবে বাকীদের বস্তাবন্দীর মত রাত কাটান ছাড়ান পথ থাকেনা। মাটির মেয়ে দিশারী নির্বাক চিত্তে সব সহ্য করত। কিন্তু প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্নতা টা অসহ্য লাগত, কিছুতেই  মেনে নিতে পারত না। গেটের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ত, তাতে রাতের শোবার এক টুকরো জায়গা দখল হয়ে গেলেও আপত্তি ছিল না। দালালদের জন্য সেটাও অনেক সময় সম্ভব হত না।আর ঘরের এক কোনে পাঁচিল ঘেরা একটা জায়গা ছিল যেটা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার হত তার দুর্গন্ধে দিশারীর পেটের নাড়ি উল্টে আসতো। মনে পড়ত গ্রামে তাদের নিকান, পরিচ্ছন্ন ছোট্ট কুটিরের কথা।
--
দ্বিতীয় রাতে না জেনে দালাদের নির্দিষ্ট ফাঁকা জায়গায় সে তার জিনিস পত্র নিয়ে রওনা দিয়েছিল। পাশ থেকে শোভা  নামে একটি মেয়ে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়, "আরে,আরে ওদিক খবরদার যেও না। ওগুলি আনোয়ারা, কাঁদা  মন্ডল, পুঁটিরানী, আসগরি, আরতি, সমেদা দের জায়গা। ওখানে কারও যাওয়া নিষেধ, গেলে মেরে রেখে দেবে। ওরা মেট্রন আর ওয়ার্ডারদের খুব প্রিয়, তাদের সব হুকুম তালিম করে, একে মারা,তাকে সেল বা পাগল বাড়ীতে ঢোকান, কাকে কম খাবার দেবে, কাকে বেশী সব কিছু। আমাদের খাবার মেরে  মেট্রন /ওয়ার্ডারদের দেয়, তাদের গরু/মোষ খাবার জন্য আর অসুস্থদের ডাক্তারবাবু ডায়েট লিখে দিলে, সেখান থেকে ডিম, বিস্কুট, দুধ, মাছ তাদের না দিয়ে মেট্রন,ওয়ার্ডারদের দেয়। কারো বাড়ী থেকে খাবার বা জিনিস পত্র এলেও নিয়ে ওদের দেয়। ওরা হল জেলের দালাল। ওদের ধারে পাশে যাবি না, বিপদে পড়বি। হয় দালালের দলে নাম লেখাতে হবে নয় মারধর খেতে হবে। তাই ওদের সব সময় এড়িয়ে চলবি।"
--
দিশারী শোভার, সাথেই থাকত। আস্তে আস্তে তাদের সাথে আরও শ্যামলী, মীরা,শান্তিবাই, শ্যামবাই, বেলা, হাওয়া বিবি,শান্তি মাসি  আরও অনেকে জুটল। দুই মীরার একজন বাংলা দেশের মেয়ে, তার মতোই হারান কেস। আর এক  মীরা ছিল রেপ কেসের ভিক্টিম। যে তাকে রেপ করেছিল সে মুক্ত হয়ে আরও কতজনের সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছে কে জানে । আর মীরা তার দেওয়া হাড় জিরজিরে একটা বাচ্চাকে বুকের  মধ্যে অপরিসীম মমতায় আঁকড়ে ধরে অন্ধ কূপে তিল তিল করে মরণের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজ একজন ধর্ষক কে মেনে নিচ্ছে কিন্তু ধর্ষিতাকে, বিশেষ করে একজন কুমারী মা কে মেনে নেবে না বলে মীরার গরীব বাড়ীর লোক তাকে বাড়ীতে নিয়ে যেতে ভয় পেয়েছে। সরকারি তত্ত্বাবধানে জেলে ফেলে রেখে দিয়েছে।বেলা চুরি কেস এ আটক। শান্তিবাই / শ্যামবাই খুনের কেসে ইত্যাদি। লক্ষ্মী ডাকাতি কেসে।        
--
বেলা চুরি না করেও মিথ্যা আরোপে আটক। সবাই বলে ও যদি জজের সামনে চুরির অভিযোগ স্বীকার করে নিত, তাহলে ১০/১৫ দিনের সাজা খেটে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ও তা করেনি, তাই এখন জেলে পচছে। "তা, যে চুরি কইরেনি, সে কেনেই বা বইলবে কইরেছে। সম্মানে লাগবেনি। আর এ কেমন বিচার ধারা, অন্যায় না কইরে মানতি হবে,"  দিশারী বলে। "তা হইলে তুই /আমি কি অন্যায় করসি, ক দেহি। আর শ্যামলী অর বাপের অমতে বিয়া করসে। অর বাপ নাবালিকা কইয়া অরে, জ্যালে দিসে। শোভারে অদের গাঁয়ের জোতদারের ব্যাটা অরে বিয়া কইরবার কথা কইয়া নষ্ট করসে। পোয়াতি হইয়া পরলে বড়লোকের ব্যাটা উলটাপালটা কইয়া গাঁয়ের লোকজনরে কু বুঝাইয়া অরে জ্যালে পুরসে। এইজে হাওয়া বিবি, উয়ারে আর উয়ার বরেরে মিছামিছি খুনের ক্যাস দিসে। শোনিচারিরে বাপের বসতবাটি আর জমিটুক হরপের লাইগ্যা জমিন্দারে খুনের কেসে জড়াইসে। আসলে এ দুনিয়ায় বিসার নাই,"মীরা বলে। দিশারী যত দেখে, শোনে ততই অবাক হয়। ভাবে এ কেমন দুনিয়া!
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
(চলবে)








  

  






   

26 Oct 2016

দিশারী - পর্ব 3

দিশারী - পর্ব ৩
************
রুবিনা দিশারীকে বেলেঘাটায় এক মধ্যবিত্ত বৃদ্ধ দম্পতির কাছে কাজে দিল। তাঁদের মেয়ের বাড়ীতে সে আয়ার কাজ করে। দিশারীকে ঘরের সব কাজ করতে হত, রান্না থেকে শুরু করে কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা, ঘর পরিস্কার সবকিছু।
হাড় ভাঙা খাটুনিতে অভ্যস্ত গ্রামের মেয়ে সে। তাদের তিনটি লোকের জন্য সে এই কাজ তার কাছে কোন সমস্যা ছিল না। বৃদ্ধ দম্পতি ভাল মানুষ ছিল।
--
মেয়ের বাড়ী যাবার সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। সেই বাড়ীর বারান্দা থেকে গঙ্গার ঘাট দেখতে পাওয়া যেত। রুবিনা বুয়ার সাথে দেখা হওয়া ছাড়া ঘাটের দিকে চেয়ে সূর্যাস্ত দেখতে তার খুব ভাল লাগত। তাছাড়া শেয়ালদায় বাজার করতে যাওয়া হত। চিড়িয়াখানা ইত্যাদি  নানা জায়গায় মেয়ের সাথে বেড়াতে যাবার সময় ও তাকে সাথে নিত। দম্পতির গাছের শখ ছিল। বাড়ীতে ছাদের উপর টবে গাছ ছিল। মাটির সাথে নাড়ির টান, তাই ধীরে ধীরে গাছের পরিচর্যার কাজ দিশারী আস্তে আস্তে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তিনজনে মিলে সেখানে অনেক সময় কাটাত, তাদের তার জীবনের সব গল্প করে  দিশারী মন হাল্কা করত। 
--
ঈদের সময় নিজের জমানো মাইনের টাকা নিয়ে রুবিনার সাথে গ্রামে গেল। বাড়ীর সবাই খুশীতে আত্মহারা। বিশেষত  ফকিরের আনন্দ যেন আর ধরে না, মেয়েকে এক মিনিট ও কাছ ছাড়া করতে চাইত না। কিন্তু কোথা দিয়ে উৎসবের দশটা দিন কেটে গেল। তারপর সেই কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের সাথে আবার ছাড়াছাড়ি। উন্মুক্ত খোলা আকাশ আর নদীর পাড় ছেড়ে বদ্ধ শহর জীবন।
--
ছয় মাস বাদে আবার গ্রামে ফেরার সময় রুবিনা তার সাথে যেতে পারল না। তার কাজের বাড়ীর লোকেদের সাথে সে কোথায়  যেন বেড়াতে গেল। রুবিনা তাকে শেয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দিল। ঠিক হল দিন সাতেক বাদে সে নিজেই ফিরে আসবে। সবাই বার বার করে জিজ্ঞাসা করল "কিরে রাস্তা চিনে ঠিক মত ফিরতে পারবি তো।" "হ্যাগো, তোমাদের সাথ শেলডা বাজারে কত্তবার গেইছিনি, ঠিক চিনে নিব," - দিশারী আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
--
সে ঠিক মতই গ্রামে পৌঁছাল, কদিন মহা স্ফূর্তিতে কাটাল। মাইনের জমা টাকা আব্বার হাতে তুলে দিতে সে খুব তৃপ্ত বোধ করে। এবারে দিশারী ফেরার সময় ফকির জীবনে এই প্রথম বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল, "মা রে, কেমন যেন মনে হইছে তরে আর দেইখতে পাইরবনি। " "ইমন কথা বলনি আব্বা, তোমারে আমি কলকাতায় ভাল হাসপাতালে দ্যাখায়ে ভাল কইরে তুইলব," চোখের জলে বাপকে জড়িয়ে ধরে দিশারী বলে। ফকির চুপ করে যায়, মনে মনে কি এক অজানা আশঙ্কায় মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
--
ভাইরা ক্যানিং স্টেশন থেকে বোনকে আবার কলকাতা গামি ট্রেনে চাপিয়ে দেয়। সারাটা সময় দিশারীর অসুস্থ বাবার অসহায় মুখটা মনে পড়তে থাকে। কোনদিকে আর হুশ থাকেনা। কখন যে কোলকাতা পৌঁছে গেল খেয়াল ই রইল না। অন্যমনস্ক ভাবে ট্রেন থেকে নামল। ভীড়ের ঠ্যালায় যেদিকে নিয়ে যায় সেই দিকে চলতে শুরু করল। বেলেঘাটা যাবার বাসের রাস্তা কখন পার হয়ে কেমন যেন সম্মোহিত মানুষের মত হেঁটেই চলেছে। হটাৎ কানের কাছে একটা তীব্র আওয়াজ আর সেই সাথে এক প্রবল ধাক্কায় তার হুঁশ ফিরল।
--
তাকিয়ে দেখে তার চার পাশে ভীড় জমে গেছে।তাকে ধাক্কা দিয়েছিল যে মানুষ টি তাকে বকে ওঠে,"গিয়েছিলে তো এখনই বাসের তলায়, অন্ধের মত রাস্তা চলচ্ছ, লাগেনিত।" লজ্জিত মুখে দিশারী মাথা নেড়ে না করে, কৃতজ্ঞ চোখে তার দিকে তাকায়। "ভাল করে দেখে রাস্তা চল,"বলে লোকটি তার পথে চলে যায়, ভীড় ও কেটে যায়, পথিকরা যে যার পথে চলতে থাকে। এইবারে দিশারী ভাল করে চার পাশ তাকিয়ে দেখে, সব ই কেমন অচেনা, অজানা লাগে। বুঝতে পারে সে পথ হারিয়েছে। এক দিক ধরে সে চলতে শুরু করে, শেয়ালদা স্টেশনের দিকে যাবার জন্য।
--
অনেক্ষন হাঁটার পর ও রাস্তা খুঁজে পায়না। চিন্তা, খিদে আর তেষ্টায় অসুস্থ বোধ করে। রাস্তার ধারে একটা দোকান থেকে একটা গোল পাউরুটি আর এক ভাঁড় চা নিল। একগ্লাস জল চেয়ে খায়। এবার কি করবে চিন্তা করতে করতে মাথা ঝিম ঝিম  করতে থাকে। কোনমতে খাবার টা গলাদ্ধকরণ করে, হতবুদ্ধির মত কিছুক্ষণ বসে থাকল।
--
দোকানের প্রবীণ মালিক তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারল সে কোন বিপদে পড়েছে। দিশারী তার সমব্যাথী দৃষ্টি দেখে শেয়ালদা স্টেশন কিভাবে যাবে জিজ্ঞাসা করল। "মা তুমি একদম উল্টো রাস্তায় অনেক দূর চলে এসেছ। তুমি একা যেতে পারবে না। রাস্তার মোড়ে যে পুলিশটা কে দেখছ, ওকে বল ও তোমায় শেয়ালদার বাসে তুলে দেবে। শেয়ালদা এলে কন্ডাক্টার যখন চেঁচাবে, তুমি নেবে যাবে। তোমার কাছে পয়সা আছেতো। দিশারী মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
--
সেই মত দিশারী পুলিশটা কে তার বিপদের কথা জানায় এবং শেয়ালদার বাসে তুলে দিতে অনুরোধ করে। ট্রাফিক পুলিশটি সেখানে কর্তব্যরত সার্জেন্ট কে রিপোর্ট করে। সার্জেন্ট দিশারীকে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বড় একটা পুলিশ ভ্যানে উঠতে বলে। দিশারী ভাবে পুলিশ নিশ্চয়ই এই গাড়ীতে তাকে শেয়ালদায় নামিয়ে দেবে। ভ্যানে আরও কিছু মহিলা ও পুরুষ মানুষ বসে ছিল।
--
প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ ভ্যানটি সবাইকে নিয়ে একটি পুলিশ থানায় উপস্থিত হয়, লাইন করে ভেতরে ঢোকায়। দিশারী ভাবে কিছু ভুল হয়েছে বোধহয়। সে একজন পুলিশ কে বলে,"কাকা আমরে  শেয়ালদা স্টেশনে ছেইড়ে দেন, ট্রেনে আমি আমার গ্রামে চইলে যাতি পাইরব।" পুলিশ টি সজোরে ধকম লাগে। পাশ থেকে একটি মেয়ে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়। "চুপ করে আমাদের সাথে বসে থাক, না হলে পুলিশ ডান্ডার বাড়ী লাগাবে। তারপর মেয়েদের এক করে নাম জিজ্ঞাস করে তার সথে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, "এটা চুরি কেস, এটা রেপ কেস, এটা দেহবেচা কেস, দিশারীর বেলা বলে এটা হারান কেস ইত্যাদি। "
--
তারপর সবাইকে একটা বড় ঘরে ঢুকিয়ে লোহার গেট বন্ধ করে দেয়। কেউ কেউ হাসাহাসি করতে থাকে, কেউ  কাঁদে কেউ নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগায়।পুর্বতন মেয়েটি তাকে বলে,"ও তুমি হারিয়ে গেছো, তাই শেয়ালদা স্টেশন যেতে চাইছিলে। কিন্তু পুলিশের সাহায্য নিয়েই ভুল করেছ। ওরা তোমাকে সোজা জেলে নিয়ে যাবে, কারণ ওটাই ওদের কাছে সহজ পথ।" দিশারী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে।
--
পরের দিন সকালে এক টুকরো পাউরুটি আর চা খাইয়ে তাদের ভ্যানে করে শেয়ালদা কোর্টে নিয়ে গেল। সেই রাস্তায় যাবার পথ দিশারীর একান্ত পরিচিত। সে বার বার চেঁচিয়ে বলতে," ওগ আমারে ছেইড়ে দাও, ইখান থেইক্যে আমি আমার কাজের বাড়ী আর আমার গ্রামে দুইখানেই যেইতে পেইরব।" কাকস্য পরিবেদনা। কেউ তার কথায় কর্নপাত ই করল না। কোর্টে জজের কাছে কাউকে তোলা হল না। সন্ধ্যার সময় সবাইকে বাক্সবন্দি করে সোজা প্রেসিডেন্সি জেলে যাওয়া হল।
--
জেল অফিসে সবায়ের নাম, ধাম ইত্যাদি লিখে আপাদমস্তক সার্চ করে মেয়েদের নিয়ে দুই মেয়ে জমাদারনী (ওয়ার্ডার) এক লাঠিধারী জমাদার জেলের মধ্যে দিয়ে আর একটি দেয়াল ঘেরা ছোট জেলের মত জায়গায় গেল। জমাদার বিশাল জোরে হাঁক পারল, "জেনানা ওয়ার্ড " আর একটা ঝোলান দড়ি ধরে টান মারল। সাথে সাথে ঢংঢং করে ঘন্টা বাজতে  লাগল। ভেতর থেকে লোহার গেট খুলে আর এক জমাদারনী গুনে গুনে তাদের ঢুকিয়ে নিল। ভেতরে ঢুকে আর এক পর্ব সার্চ। তারপর বিভিন্ন ওয়ার্ডার বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দিনীদের ঢুকিয়ে দিল। দিশারীদের হাজতী নম্বরে ঢুকিয়ে বিশাল তালা ঝুলিয়ে দিল। বন্ধ লোহার গেটের সামনে বসে সারা রাত ধরে দিশারী অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, 'এ কেমন জগৎ যে শুধু মাত্র রাস্তা হারিয়ে যাবার অপরাধে সে আজ জেলে বন্দি। আর যে পুলিশদের কাছে সাহায্য চাইতে গেল তারা সাহায্য তো করলেই না, উল্টে বিনা দোষে তাকে এক অন্ধকূপে বন্ধ করার ব্যবস্থা করল। আর কেউ তার একটা কথাও শুনল না।'
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
( চলবে )











 



















   

















    





 

17 Oct 2016

কলঙ্ক

কলঙ্ক
******
কোজাগরীর চাঁদ দেখতে গেলাম
চারিদিকের নিয়ন আলোর ঝলকানি, 
চাঁদখানি বড়োসড়ো ছিল বটে, কিন্তু হারিয়েছে
তার সেই মিষ্টি মধুর আকাশ ভাসানো আলোখানি, 
কোথায় গেল সেই একঢাল ঝিকিমিকি তারার দল 
এ যেন শুধুমাত্র এক যান্ত্রিক জীবনের ফসল। 
 --
ধোঁয়াশায় মোড়া, পূর্ণিমার আকাশ
অনুপস্থিত গ্রাম গঞ্জের খোলা মাঠে,  
গুমোট ক্যানভাসে লোভের বাতাস
প্রকৃতির স্নিগ্দ্ধতা মুছে বারুদ ফাটে,
কোজাগরীর চাঁদে বিদ্রুপের আভাস 
বিষন্নতা ছুঁয়ে গেছে গঙ্গার ঘাটে। 
--
পূর্ণিমার চাঁদ বলে এতদিন 
দেখেছ আমার কলংক যত,
পৃথিবী ছিল ভাগ্যবতী বহুদিন 
মানুষ নাকি সবচেয়ে উন্নত !
আশীর্বাদের বিনিময়ে উপেক্ষিত প্রকৃতি
মানুষের লোভেই আজ পৃথিবী বিপন্ন, কলঙ্কিত । ____________________________________________________________________________________


















16 Oct 2016

দিশারী - পর্ব 2

দিশারী  - পর্ব ২
************
ধীরে ধীরে দিশারী বড় হয়, ঋতুমতী হয়। ক্রমে সে তার চনমনে ১৬ বছরে পৌঁছায়, তার বিবাহিত বন্ধুদের মুখে নানা রোম্যান্টিক গল্প শোনে। এখন সে তার স্বামীর কথা ভাবতে শুরু করে। নাসির কে নিয়ে নিজের জীবনের নানা রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বড় মধুর লাগে নাসিরের টুকরো টাকরা স্মৃতি। সে নানা ভাবে তার খবর পেতে চেষ্টা করে। ঠিক কোথায় নাসিরের বাড়ী, কি পরিস্থিতি সব খবর সংগ্রহ করে। বাবা মাকে কিছু বলতে লজ্জা পায়। অবশেষে যৌবনের ডাক অগ্রাহ্য করতে না পেরে বাড়ীতে কাউকে না জানিয়ে একাই নাসিরের গ্রামে গিয়ে, তার বাড়ী খুঁজে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। শুধু এক বান্ধবী কে বাড়ীতে খবর দেবার কথা বলে যায়, যাতে বাবা মা চিন্তা না করে।
--
এদিকে নাসিরের বাড়ীতে তার উপস্থিতি এক বিরাট গন্ডগোল বাঁধায়। সারা গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। নাসিরের দ্বিতীয়া স্ত্রী উঁচু গলায় চিৎকার করতে থাকে। তার কোলের বাচ্চাটা ভয়ে কাঁদতে থাকে, আর একটি বাচ্চা মায়ের আঁচল চেপে ধরে খাবারের দাবী জানাতে থাকে।প্রতিবেশীরা বাড়ী ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা মতামত দিতে থাকে। সদর দরজার ভেতরের একপাশে দিশারী মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে, কিন্তু ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় বিনা যুদ্ধে সে মাটি ছাড়বে না। এদিকে নাসিরের মা চিৎকার করে একবার দিশারীর আর একবার প্রতিবেশীদের চোদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করছে। কারণ প্রতিবেশীদের বেশ বড় একটা অংশ দিশারীর স্বপক্ষে সওয়াল করতে থাকে। হতবুদ্ধি নাসির দাওয়ায় মাথায় দু হাত দিয়ে বসে থাকে।
--
নাসিরের বড় বোন কামিনী ও তার স্বামী জাকির আসে। তাদের দিশারীকে দেখে খুব মায়া হয়। তারাও তাকে ঘরে তোলার যুক্তি দেয়। অবশেষে গাঁয়ের মাতব্বরের দল সালিশির জন্য আলোচনায় বসে। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হয়। মাতব্বরের দল বিধান দেয় দিশারীকে বাড়ীতে থাকতে আর খেতে পরতে দিতে হবে। কিন্তু নাসির দ্বিতীয়া স্ত্রীর সাথেই সহবাস করবে। দিশারীর বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে সব জানিয়ে দেওয়া হবে।
--
পরিবারের প্রধান হিসাবে নাসিরের মা সংসারের সব ভারী কাজের দায়িত্ব চাপিযে দেয় দিশারীর কাঁধে। আর ভারী পণ নিয়ে আসা দ্বিতীয়া স্ত্রীর ভাগে হাল্কা কাজের ভার দেয়। কামিনী ও জাকির দিশারীর জন্য একটা সন্মানজনক ব্যবস্থার পক্ষে বৃথাই সওয়াল করে। দিশারীর ভাগ্যে শুধু শ্বশুরঘরে স্থান টুকু জোটে কোনমতে।
--
এই ভাবে দুবছর কাটল। সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে শ্বাশুড়ি ও সতীনের অকথ্য গালিগালাজ আর প্রায় আধপেটা খেয়েও সে মুখ বুজে আর দাঁত কামড়ে পড়ে ছিল। সমস্ত দুঃখের মধ্যে তার একমাত্র সান্তনা ছিল স্বামী। কারণ ইতিমধ্যে নাসির লুকিয়ে চুরিয়ে দিশারীর সঙ্গে সহবাস করতে শুরু করেছিল। যৌবনের ধর্মে স্বামীর আদর সে উপভোগ করত, আনন্দে সাড়া দিত, আর প্রাণ ভরে তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল।
--
তবে ক্রমে নাসিরের ব্যবহার তার কাছে পরস্পর বিরোধী হয়ে উঠতে লাগল। অনেক সময় শ্বাশুড়ি ও সতীনের কথায় তাকে প্রচন্ড গালিগালাজ, এমন কি প্রচন্ড মারধর করতে শুরু করল। অন্যদিকে তার শারীরিক আকর্ষণ শুধু যে উপেক্ষা করতে পারত না তা নয়, লুকিয়ে চুরিয়ে মেঠাইও খাওয়াত। আর ছোট বেলায় তার ঘাড়ে চেপে মেঠাই এর জন্য বায়না করা নিয়ে ঠাট্টা করত। মাঝে মাঝে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বাপের বাড়ী ফিরে যাবার পরামর্শ দিত," তুই মোর থেইকে অনেক ছোট।এখন ডাগর ডুগর হহইয়েছিস, বাপের বাড়ী চইলে যা, আবার জোয়ান মরদ বিয়া কর।" উত্তরে দিশারী স্বামীকে আঁকড়ে ধরে, বুকে গুঁজে দিত, "দূর, আমি আর বিয়া কইরতে পাইরবনা।"
--
কামিনী দিদির কাছে সে সব গল্প করত। নিঃসন্তান কামিনী ও জাকির তাকে মেয়ের মত ভালোবাসত। কামিনী তার শুকনো মুখ দেখলেই কাছে বসিয়ে পেট ভরে খাওয়াত। কিন্তু অকস্মাৎ মাথায় বাজ পড়ল। দিশারী সন্তানসম্ভবা হল। আর তাদের গোপন রোমান্স ধরা পরে গেল। স্বাভাবিক কারণে ঈর্ষায় সতীনের তার প্রতি দুর্ব্যবহার মাত্রা চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, তাই তাকে তুষ্ট করতে নাসির আর তাঁর মা দিশারীর উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করল। কামিনী আর জাকির দিশারীর মা হওয়ার সম্ভাবনায় খুব খুশি ছিল আর যথা সম্ভব তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করত।
--
একদিন দুপুরে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত দিশারীকে বিশ্রাম নিতে দেখে নাসির বিদ্রুপ করে," অরে রাইজকন্যা ভর দোপোরে ঘুমের ব্যবস্থা দেখতেছে। যা ওঠ বড়মানষের মেয়া, জমিনে বেগুন চারা লেইগেছি। ওই পোকামারনের ওষুধ (পেস্টিসাইড) ওগুলার পাতার উপর ছড়ায়ে দিবি। আর সারের বোঝা নিয়া যা, গাছের গড়ায় দিবি। উল্টাপাল্টা কইরলে আস্ত রাখবনি, মনে থাকে যেন।"
--
সার আর কীটনাশকের ভারী বোঝা নিয়ে দিশারী কোনো মতে টলতে টলতে বেগুন ক্ষেতে যায়।  চোখে মুখে সে যেন সর্ষেফুল দেখছে। নাসিরের কথা ভুলে গিয়ে সার আর কীটনাশক দুই কোন মতে গাছের উপর ছুড়ে ছুড়ে দিতে থাকে। নাসির তার পেছনে এসে এই কান্ড দেখে সব বোধ হারিয়ে হাতের কাস্তে টা ছুঁড়ে মারে। সেটা গিয়ে দিশারীর ডান হাতর ওপরে পড়ে অনেকখানি কেটে যায়। যন্ত্রয়ায় চিৎকার করে কেঁদে সে মাটিতে বসে পড়ে। বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে তাকে সজোরে এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে নাসির বাড়ী ফিরে যায়। অবসন্ন দিশারীর ডান হাত থেকে প্রবল বেগে রক্ত ঝরতে থাকে, তারপর জ্ঞান হারিয়ে বেগুন ক্ষেতে শুয়ে পড়ে।
--
একটু পরে জ্ঞান ফেরে, কিন্তু তলপেটে বীভৎস যন্ত্রনায় সারা শরীর মোচড় খেতে থাকে, দু পায়ের মধ্যে দিয়ে রক্তস্রাবে কাপড় ভিজে যায়। বমি হতে শুরু করে। অনেক্ষন পর কোন মতে উঠে প্রায় হামাগুড়ি দেওয়ার মত করে কামিনীর বাড়ীর দরজায় কাছে পৌঁছে আবার জ্ঞান হারায়। প্রায় সপ্তাহ ভর বাদে তার পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে। দেখে কামিনীর খাটে সে শুয়ে, স্বামী স্ত্রী দুজন তার শুশ্রূষায় ব্যস্ত। কামিনীর মুখে নিজের গর্ভপাতের খবর জানতে পারে, নাসির বা তার মা এক বারের জন্যও তার কোন খবর নেয়নি।
--
আরও  কিছু দিন  বাদে তার শরীরে বল আসে, কিন্তু বিবাহিত জীবনের রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলি একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে। কামিনীর পরামর্শে সে জাকিরের সাথে বাপের বাড়ীর পথে পা বাড়ায়। গ্রামে পৌঁছে দিয়ে জাকির ফিরে যায়, দিশারী প্রচন্ড সংকোচে বাড়ী না গিয়ে পুকুর পাড়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। লোকমুখে খবর পেয়ে বাড়ীর সবাই ছুটে আসে। ফকির হারান মানিক ফিরে পেয়ে আত্মহারা হয়ে যায়,"মারে, তুই তোর নিজি স্থানে ফিরে এইসেছিস। তর কুন
দোষ নাই। লাজ কইরবি ক্যানে।"
--
মেয়ের অবস্থা দেখে ফাতেমা আর হামেদা নাসিরদের সকলকে অভসম্পাত করতে থাকে। ফকির বলে,"চুপ যা, ওদের নাম এ ঘরে কেউ বলবিনি। ওর মনে স্থিতি আসুক আর কিছু চাইবিক না কেউ।" শুধু দিশারীর ভায়েরা বলে, "তর চারটা ভাই রয় নাই। ইয়ার জবাব না দিয়া ছাড়বোনি।" "আল্লার কাছে সবার বিচার হবে, কনদিন কি কন ভাল মনিষ্যি  মোর সোনার পিতিমের দাম দিবে না, তাও কি হয় নাকি," বলে ফকির মেয়ের মাথায় হাত বুলায়।
--
দিশারী চুপ করে থাকে। বিয়ের কথা সে আর ভাববে না। তার রাস্তা সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে। কদিন সময় লাগবে এই দুঃস্বপ্ম থেকে থেকে পুরোপুরি মুক্তি। তারপর শরীর আর মনের জোর ফিরে পেলে, সে জাকির ভাই কথা মত হাতের কাজ শিখবে। এবার থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে।
 ---

সূর্য্যকে আর একবার প্রদক্ষিন করল পৃথিবী। কিন্তু দিশারীদের অবস্থা আরও খারাপ হল। ফকির জঙ্গলে গাছ থেকে পড়ে  শিরদাঁড়ায় এমন চোট পেল যে তার ভারী কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল। একটি ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেল।বাড়ীর বাকীদের ওপর চাপ বাড়ল। দিশারীকে ও ঘরের কাজের সাথে বাইরে কাজে বার হতে হল, শাকপাতা সংগ্রহ, জ্বালানী জোগাড়, নদীর পাড়ে মাছ ধরার জন্য।  
 --
কিন্তু বিধি বাম। তার পিছনে লাগল গ্রামের জোতদার আরশাদ মোল্লা। ফলে মা বা পিসির সঙ্গ ছাড়া একা বেরোন বন্ধ করতে হল। ইতিমধ্যে দিশারীর কিছু বিয়ের প্রস্তাব আসে। পরিবারের ইচ্ছা থাকলেও দিশারী অনড়। বাড়ীর লোক তাকে বিয়ের জন্য কোন চাপ দেয়নি। আরশাদ মোল্লা তার সুযোগ নিল। নিজের অপরিণত মস্তিস্কসম্পন্ন ছেলের সাথে দিশারীর বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। তার বদ মতলব আর কারসাজি গ্রামের লোকের বুঝতে বাকী রইল না।
 --
বাপ মেয়ের আসন্ন বিপদের গন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়ল। অসহায় ফকির  গ্রামের লোকেদের পরামর্শে তার খালাত বোন
রুবিনা খাতুনের তত্ত্বাবধানে তাকে ঘরের কাজের লোক হিসাবে কাজ করার জন্য কলকাতায় পাঠাতে রাজী হল।"মারে, তুই রুবীনারে তর মা আর খালার মত মান্য কইরবি। আল্লা তরে বিপদে রক্ষা কইরবে। তর ভাল মন্দের বোধের উপর মোদের পুরাপুরি বিশ্বাস রইছে।"
--
 ফাতেমা আর হামেদা চোখে আঁচল দিল। ভারী বুকে দাঁত চেপে ফকির মেয়ের জন্য সকলের কাছে দোয়া চাইলেন। ভাইরা রুবিনা আর দিশারীর সাথে ক্যানিং স্টেশন পর্যন্ত গেল, সেখান থেকে তারা কলকাতার ট্রেনে চড়ল। অবশেষে দিশারী তার ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল - তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নাকি আরও বড় দুর্গতি ভোগ করার জন্য !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
 (চলবে )






  


































































13 Oct 2016

দিশারী -- মুখবন্ধ, দিশারী - পর্ব ১

দিশারী   --  মুখবন্ধ
**************
দিশারী গল্পের মূল চরিত্রের আসল নাম ছিল হাসিনা। আমার সাথে আলাপ হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে।  ১৯৭৪/৭৫ সালে।সেখানেই মীরা, জাহানারা, ছোট্ট শংকর, শ্যামলী ইত্যাদি অজস্র মানুষের, বিশেষত মেয়েদের সাথে আলাপ হয়েছিল। হাসিনা আমার মেয়ে ছিল। মেয়াদী নম্বরের গরাদের ওপারে ছিল হাসিনা, অন্যপারে আমি।  দুজনেই প্রায় সমবয়সী। সুন্দরবনের কোন এক গাঁয়ের মেয়ে হাসিনা, প্রথম সাক্ষাতে দাবী করল আমি ওর মা। আমিও মেনেনিলাম। মেয়ের মতই আবদার ছিল তার। তার থেকে বেশী অন্য কারোর সাথে কথা বললে মুখ ভারী। কারনে অকারণে তার তলব আসতো। আমাদের অন্য কোন বন্ধুকে দেখলে,বলতো," এই দিদি মাকে ডেইকে দে।" বন্ধুটি এসে জানাত,"এই যা তোর মেয়ে ডাকছে। "  
 --
এখানে হাসিনার নাম দিয়েছি দিশারী। তারই মত জেলের অন্ধ কুঠুরি তে বন্দী অসংখ্য মেয়েদের প্রতিচ্ছবি সে। প্রথম কয়েকটি পর্ব তারই মুখে শোনা তারই জীবন কথা। পরবর্তী পর্বে সে হয়ে ওঠে সেই সব মানুষের মুখ, যারা জেলে নিদারুন কষ্ট আর অত্যাচারের এবং অন্যায়ের বিরুধ্বে প্রতিবাদের শরিক।  
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++ ++++

দিশারী - পর্ব ১
***********
"আম্মা দোর টা ঠিক কইরে চেইপে দে। দেখতেছিস না সূর্য্যির আলো ঘরে ঢুকতেছে। রাইতের আঁধার থাইতে, ভোর হওয়ার আগেই খাবারডা খায়ে ফালি, রোজা রাইখবো যে, " ৩/৪ বছরের দিশারী ঘুম ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে বলল। "ভোর কোন কালে হৈছে, সকলে যখন পান্তা খেইতেছিলো অনেক ডাকাডাকি তে ও উঠিস নাই। এখন কিছু খালে আর রোজা রাখতে পারবি না মা " আমিনা উত্তর দিলো। "তুই দোর টা চেইপে দেলেই আলো এইসতে পাইরবে  না। আঁধারে পান্তাডা খালে ই রোজা রেইখতে পারবো," জেদি গলায় দিশারী ঘোষোনা করে। "অমন বলে না, ফির বচ্ছরে রাইত থাইতে মোদের সাথে পান্তা খেইয়ে নিবি, আর রোজা রাইখতে বাঁধা থাইকবে না।" "না, ফির বছর লয়, ই বছরে রোজা রাইখবো," রীতিমত রেগে গেল মেয়ে। মা জিজ্ঞাসা করে,"পিপাস লাইগলে কি করবি ?" "পুকুরে চান করতে যেয়ে ডুইবে ডুইবে জল খায়ে নিব, কেউ বুইজতে পারবে না। " রেগে মা বলে, "সেয়ান মেয়া।"
--
বাবা ফকির আলী হাসি চেপে এতক্ষন মা মেয়ের বাকবিতন্ডা শুনছিলেন। এবারে হস্তক্ষেপ করলেন," আহা ছেইড়ে দে ক্যানে, ছোট দের কসুর আল্লা মাফ করি দিবেন, উয়াকে রোজা রাইখতে দে।" "দেখছোনি আব্বা কি বলতেছে, তাইতো আব্বারে এত ভাইলোবাসি" আল্লাদী গলায় দিশারী বিজয়ীর হাসি হাসে। " "যা মনে ধরে কইরোগে যাও, বাপের আর পিসির আদরে মেয়ার বারোটা বাজতেছে, মেয়ামানসের এত আল্লাদ উচিত লয়। " মেয়ামানুষ আর বেটাছিলের মইধ্যে কন ফারাক লাই। দুই আল্লার দান, আদরের জিনিস, " ফকির দৃঢ় গলায় উত্তর দেয়। ফকিরের বোন হামেদা উত্তর দেয়, ঠিক কথা বটে, কিন্তুক মেয়ামানুষদের যত দায়। আমারেই দেখ, বনকে মধু আনবার গিয়া বাঘের প্যাটে গেইল মরদ। শ্বশুরঘর আমারে দায়ী কইরে ভিটা ছাড়া কইরলে। দুই ছেলা নিয়া তমাদের এটুক স্থানে এইশতে হইলো।" "ইখানে এইসবে নাত কোথা যাবে, ই তমার বাপের ঘর," আমিনা বলে। ফকির বোন ধমকে বলে, "ই ঘরে তর সমান হক, খপরদার বাজে বকবিনি। তর দুই ছেইলা, মোদের দুই ছেইলা আর,এক বিটি, সব্বে মোদের আসল ধন, আদরের ধন।"
---------

সাত বছর কেটে গেছে। দিশারী এখন সকলের মত সমস্ত নিয়ম মেনে যথাযথ ভাবে রোজা পালন করে। সে এখন বাবার মুখে ছোটবেলায় রোজা রাখা নিয়ে তার ছেলেমানুষীর কথা শুনে লজ্জিত ভাবে হাসে। পাঁচ বছর আগেই কাছাকাছি গ্রামের নাসিরের সাথে তার নিকা হয়ে গেছে। তখন নাসির এলে সে তার ঘাড়ে চেপে মিষ্টি খাওয়ানোর বায়না ধরত। শ্বশুর বাড়ীর লোকেদের সাথে ঠিক হয় সে ঋতুমতী হলে পনের বাকী অংশ নিয়ে শ্বশুরঘরে যাবে।
--
ফকির আলীর ভিটে টুকু ছাড়া আর কোন জমি ছিল না। চাষের সময় হামেদার ছেলেদের নিয়ে জোতদারের জমিতে চাষ করত। বাকী সময় মাছ ধরত, জঙ্গলে কাঠ আর মধু সংগ্রহে যেত। ফতেমা আর হামিদা ধান ভানা, জমিতে বীজ বপন ইত্যাদি কাজ ছাড়াও নদীর পাড়ে মাছ ধরা, শাক তোলা ইত্যাদি কাজে ব্যাস্ত থাকতো।দিশারী  ঘরের সব কাজ ছোট থেকেই করত। শুধু রান্না করার পুরো দায়িত্ব পিসি দিত না, কেবল জোগান দিত। বাকি সময় বান্ধবীদের সাথে গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, ছাড়া গল্প করে হেসে খেলে দিন কাটাত।
--
গ্রামের মেয়ে, প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছে সে। নীল আকাশে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠে বা নদীর জলে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত , গাছের পাতায় বৃষ্টির জল, ঝোড়ো হাওয়া শব্দ, রাতের আকাশে তারাদের ঝিকিমিকি সব কিছু তার একান্ত আপনার, সবই তাকে ভীষণ ভাবে টানতো। সুখ না থাকলেও শান্তি ছিল পরিবারে। সবার আদরে সহজ সরল জীবনে খুশি ছিল দিশারী।
--
এর মধ্যে একদিন খবর এল নাসির ভাল পণ নিয়ে ১৯/২০ বছরের এক যুবতীকে বিয়ে করেছে। গ্রামের লোকজন ফকির কে পরামর্শ দিল পনের বাকি টাকার কিছু অন্তত দিয়ে দিশারীকে শ্বশুর বাড়ী পাঠিয়ে দিতে। ফকির সোজা সাপটা বলে," আমার মেয়া কে সতীনের ঘর করতে দিব না। " "সময় মত মেয়া কে মোরা ফির বিয়া দিব," হামেদার মত। ফতেমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে," কোথা পাব  টাকা! আর কি হবে মোদের মেয়ার !" গ্রামের লোকেরা সবাই বোঝে, তাদের সকলেই একই পরিস্থিতি। দিশারীর মন কিন্তু খুশিতে উচ্ছল, তাকে নিজের ঘর ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে হবেনা। নাসিরের দ্বিতীয় বার বিয়েতে তার কোন হেল দোল নেই। 
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++









































7 Oct 2016

ইচ্ছা

ইচ্ছা
****

প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে
জীবনের সবচেয়ে অসম্ভব
সুন্দর এক মিষ্টি ইচ্ছা মনকে
আকুল করে প্রতিপলে।
নতুন করে মা হবার স্বপ্ন
দেখি বার বার, প্রতিবার।
 --
নতুন করে নিজের জঠরে
নিয়ত আস্বাদ পেতে চাই  
নতুন প্রাণের স্পন্দন ,
ক্ষুদে হাত পায়ের সঞ্চালন
অনুভব করি সেই সুতীব্র গর্ভ যন্ত্রনা ,
তার সাথে নতুন অতিথির আগমন।
--
নতুন সে অতিথির
বাসযোগ্য ভূমির জন্ম দিতে পারেনি
তাদের অভাগা মা বাপ। 
তারাই যেন তা গড়ে নিতে পারে, 
আনতে পারে শান্তি, স্বাধীনতা, সাম্য
সাধারণ মানুষের সেই চিরন্তন  কাম্য।
-------------------------------------------








  

1 Oct 2016

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা


 যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
************

আয় আমারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলি
তলায় তলায় হাত মেলামেলি
টেবিলের ওপর যত ঘুষোঘুষি
চল আজ আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলি।
--
গ্রামের হাটে চলেছে বিকিকিনি   
গাছে গেছে লাফিয়ে বেড়ায় শিশু দস্যুবাহিনী
পুকুরে তোলপাড় ঝাঁকবাঁধা তরুণী
মাঠে মাঠে ফসল বুনে চলে কিষাণ কিষাণী।
--
কিছু বোমা ফেল তুই, আমি ফেলি কিছু
আরো কত আসবে মোদের পিছু পিছু 
রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে কত সহস্র শিশু 
তাতে তোর বা আমার আসে যায় না কিছু। 
--
 বোকা তোরা, একে অপরে মারামারি কর
 পেছনে আমি আছি নিয়ে অস্ত্রের সম্ভার,   
 কত যুদ্ধ বিমান আর জাহাজ লাগবে তোদের!
 হবেনা অভাব, আমার ঘর কুবেরের ভান্ডার।
--
ওরে মূর্খ, অর্বাচীনের দল,
আমার চাই তো শুধু বাজার দখল
নিজেদের মাঝে লড়াই করে মর
আগমনী আনে আনুক তোদের অমঙ্গল।
--
অতি সাধারণ মানুষ মোরা এখনও ভুলিনি 
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মাশুল আজও দিয়ে চলেছি -
আউসচয়ুইজ, হিরোশিমা আর নাগাসাকি,
মানবপ্রেমিকরা যুদ্ধ বন্ধের আওয়াজ তুলেছি।
--
ভোল্গা, তাতু, মেকং শিখিয়েছে, তোরা শুধুই কাগুজে বাঘ
একদিন দুনিয়া জুড়ে সফল হবেই শেকল ভাঙার ডাক।  
 
************************************************************************************














25 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পরিশিষ্ট

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত -  পরিশিষ্ট 
******************************
জেল থেকে বার হবার পর আমরা যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। পার্টি তখন খন্ড বিখন্ড। অনেক প্রশ্ন আর সংশয়। একটা সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখতে পারছিনা। বেশ কিছুদিন হাবু ডুবু খেলাম। কিন্ত মূর্তিমান বাস্তব, নিজেদের রুজি রোজগারের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াল। যারা স্কুল,কলেজের পাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম তারা তার  কিছুটা শেষ করলাম। যারা চাকরি ছেড়ে এসেছিল তারা চাকরিতে যোগ দিল।  কেউ কেউ নতুন করে চাকরি খুঁজে নিল। অজস্র মানুষ প্রবল দারিদ্রে দিন গুজরান করতে থাকলো। বেশীর ভাগ লোক শারীরিক ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ বা অকেজ হয়ে পড়ল। তবুও তারা  নিজেদের পেশার সাথে নানা ধরনের সমাজ কল্যাণ কর কাজে যোগ দিল। একদল অবশ্যই এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার সুবাদের নাম ভাঙিয়ে খেল। সেটা একেবারে নগন্য ঘটনা। 
--
তা সত্ত্বেও পথ খোঁজা চলতে থাকল। নকশালবাড়ির  আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শ্রমিক / কৃষক এবং মেহনতী মানুষকে কমিউনিস্ট পার্টীর নেতৃত্বে  শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নয় প্রধানত  সশস্ত্র পথে  ক্ষমতাদখলের লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল। পার্টি সমস্ত যুবশক্তিকে শ্রমিক / কৃষকের সাথে একাত্ব হবার আহবান জানায়। এই সংগ্রামের সবচেয়ে সদর্থক দিক হল সমাজ বিবর্তনের আন্দোলনে এক নতুন ইতিহাস যুক্ত হল। আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক সশস্ত্র লড়াই হলেও সেগুলির মূল দিশা ছিল অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়। এখানেই পূর্বতন লড়াইগুলির সাথে নকশাল বাড়ীর আন্দোলনের মূলগত পার্থক্য। এই কথাটাই অনেকের মনে থাকেনা। 
যাইহোক  অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পূর্বতন শদীদ সিঁধু ,কানু চাঁদ ভৈরব, তিতুমীর, নুরুলদের সাথে ভূমাইয়া, কিসটা, ধ্যানেশ্বরী, সীমাস্বরী, নয়েয়েশ্বরী, সুরুবালা,সোনামতি, ফুলমতি, সামসারি, গৌড়রাও, খাড়শিং ইত্যাদি অসংখ্য শহীদ  কিষাণ ও কিষানীর নাম যুক্ত হল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য বীর যোদ্ধা সূর্য সেন, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা দের সাথে নির্মলা কৃষ্ণমূর্তি,দ্রোণাচার্য, আশু মজুমদার বিপ্লব ব্যানার্জী ইত্যাদি, তেভাগা  তেলেঙ্গানার, খাদ্য আন্দোলন  এর মত আন্দোলন গুলিকে কে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করল। জীবনে সর্ব ক্ষেত্রে উত্থান /পতন থাকে , ঠিক / ভুল হয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আত্ম সমীক্ষার মাধ্যমে ভুল শুধরে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতাই বিজ্ঞান। অনেক আত্মত্যাগ আর লড়াই এর মধ্যে দিয়েই  বিপ্লব সফল হয়।তাই মে দিবস আজও পালিত হয়। 
--            
আমরা বেশীর ভাগ এখন ও মনে করি আমাদের সবচেয়ে নিষ্পাপ, সরল আর সুন্দর সময় টা ব্যক্তিগত ক্যারিয়র তৈরী করার পেছনে না দৌড়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য একটা মহান , সুন্দর কাজে ব্যয় করেছিলাম। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়ে এক নতুন সমাজ গড়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমাদের পরম ভাগ্য। জ্ঞানের মহা সমুদ্রের এক বিন্দু জল সেখানেই পান করেছিলাম। সেটাই আমাদের পরম সম্পদ।
--
আমরা অনেকেই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে  ধীরে ধীরে গতানুগতিক জীবনে ফিরে এসেছি। কেউ কেউ নাটক, গণতান্ত্রিক অধিকার, নারীমুক্তি, পথশিশু, শিশু শ্রমিকদের পড়াশোনা ইত্যাদি নানা কিছু মানবিক আর সামাজিক কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা করছি। কিছুটা হয়তো নিজেরা যাতে জড় পদার্থে পরিণত না হয়ে যাবার তাগিদে।
--
 আর এক দল মানুষ হাজার সংশয় আর প্রশ্ন থাকা নিয়েও  সক্রিয় ভাবে সহস্র বাঁধা সত্বেও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে, কারণ তারা জানে প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন সমস্যার সমাধান করা যাবেনা।  আমি নতজানু হয়ে সেই সৈনিকদের কুর্নিশ জানাই, বিশ্বাস করি এক দিন না একদিন সেই শোষণহীন নতুন সমাজের লাল আলোয় পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
*************************************************************************************
 বিঃ দ্রঃ -
এখানে বলা প্রয়োজন, বিশেষ কারণে মিনু, সীমা , শীলা ও কমলা নাম চার টি পরিবর্তন করতে হয়েছে।
 তাছাড়া প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। কিছু স্মৃতি বিভ্রম ঘটে থাকতে পারে। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনীয়। সেই সময়ের অনেক অভিজ্ঞতা ও জেলের অনেক বন্দিনীর জীবনী আগেই লিখেছি। সাধারণ মানুষের কথা লেখাই আমার ইচ্ছা ছিল। জেলে সাধারন বন্দিনীদের অবস্থা, তাঁদের উপর অত্যাচার এবং জেলকর্ত্রীপক্ষ ও দালাল দের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের কথা ইংরেজিতে 'dishari' গল্পে যতটা মনে ছিল লিখেছিলাম। এর বাংলা করার ইচ্ছা ছিল। চোখের সমস্যার জন্য তা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার কন্যা সম কিছু বন্ধুদের অনুরোধে লিখলাম। আপনারা যাঁরা ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। জেলখানকে শোধনাগার নাম দিলেও, বদলায়নি কিছুই , "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। "







23 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 9

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৯
************************
আমাদের ইন্টারভিউ ও কোর্ট গুলিতে আমাদের বাবা, মা, ভাই, বোন বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন রা আসতেন।  রোজ দেখা হতে হতে তাঁরা সবাই যেন একই পরিবারের লোক হয়ে গিয়েছিলেন, সকলেই পরস্পরের সমব্যাথী। আমাদের কারো কোন বিশেষ জিনিসের প্রয়োজন থাকলে, আমরা তাঁদের যে কোন কাউকে অক্লেশে বলতে পারতাম। যেমন আমার কোন বিশেষ কিছুর প্রয়োজন থাকলে, বৌমা তার ভাইকে বলত। আমাদের মধ্যে যারা বিবাহিত ছিল মীনাক্ষীর মা তাদের জন্য পূজোর সময় লাল চুড়ি কিনে আনতেন। বিজুর কিছুর প্রয়োজন হলে আমার মাকে বলতাম। শিয়ালদা কোর্টের লোকজন আমার মাকে বিজুর মা বলে জানত। তাছাড়া সবাই নানা ধরনের খাবার,জামা কাপড়, বইপত্র ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। কোর্টে তাঁরা যা খাবার নিয়ে আসতেন, আমাদের সাথীরা সারাদিন প্রায় উপবাস থেকে সব কিছু জেলে নিয়ে আসতো, সবাই মিলে খাবার জন্য। সকাল ১০টা নাগাদ জেল থেকে সামান্য কিছু খেয়ে তারা বার হত আর ওয়ার্ডে  ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে  ৭/৮ টা হয়ে যেত।
--
জেল অফিসে সে সময় নানা বন্দী /বন্দিনী, জমাদার/ জমাদারনী, অন্যান্য কর্মচারি ইত্যাদি তে পরিপূর্ন থাকত। স্বাভাবিক ভাবে কিছুটা গোলমাল হত। একজন ডেপুটি জেলায় গন্ডগোল থামাতে বকে উঠত,"আইকি, অটো সেসামিসি, সেসামিসি; অইটা কি সারিয়াখানা ?(একি, এত চ্যাঁচামিচি, চ্যাঁচামিচি; এটা কি চিড়িয়াখানা?)" গোলমাল রূপান্তরিত হতো হাসিতে। তাড়া তাড়ি ভদ্রলোক সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতো।
--
আমাকে মারার পরে জেলার, সুপার রাউন্ডে এলে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে আমার কোন উত্তর দিতাম না। সুপার হিংস্র গলায় বলতো," কি কথার উত্তর দেবেন না, না! বলে কটমটিয়ে মেট্রনের দিকে তাকাতো। সে বেচারা গদগদ গলায় নানা কথা বলে তোয়াজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। জেলার চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতো। বন্দিনীরা ওকে আড়ালে রাবড়ি খচ্চর বলে ডাকত। আমাদের ওয়ার্ডে কোথা থেকে একটা ছোট্ট সাদা বেড়াল বাচ্চা এসে জুটেছিল। সেটাও ওদের দেখলে আমাদের কোলে এসে উঠত।
--
ইদানিং তাঁদের সকলের গলা দিয়েই যেন মধু ঝরতে শুরু করল, কি অসুবিধা,কি প্রয়োজন ইত্যাদি। যথারীতি আমরা কোন উত্তর দিতাম না। চুপচাপ মাথা নীচু করে চলে যেত। এই সময় ইন্টারভিউ তে কোন রকম বই দিতে নিষেদ্ধাজ্ঞা ছিল না, এমনকি মাও সে তুঙ থেকে চারু মজুমদারের বই পর্যন্ত। প্রথম থেকেই আমাদের সব ইন্টারভিউ তে  আই.বি / এস বি রা উপস্থিত থাকত, তারাই স্থির করে দিত কি দেওয়া যাবে আর কি দেওয়া যাবে না। এখন তারা অতি সজ্জ্বন, সর্ব দাতা।
--
দেখতে দেখতে সারা ভারত জুড়ে ইলেকশনের বাদ্যি বেজে উঠল। তখন কেবল  বুলু ,মাসিমা কল্পনা, মলয়া, খুকু, শুভা, মিতা, মীনাক্ষী, সাথী, গৌরী, রাজশ্রী আর আমি জেলে ছিলাম। বাকিরা বাইরে বন্দিমুক্তি আন্দোলনে ব্যাস্ত।    ১৯৭৭এর  মার্চ এসে গেল।কল্পনা ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে একটা ট্রান্সজিস্টর জোগাড় করে নিয়ে এলো ইলেকশন বুলেটিন শোনার জন্য। সম্ভবত বিশে মার্চ রেজাল্ট ডিক্লেয়ার শুরু হয়েছিল। কল্পনা সারা রাত জেগে খবর শুনতে থাকল।আমরা আধা জাগরণ, আধা ঘুমে। একটা করে মহীরুহের পতন হয়, কল্পনার ডাকে আমরা হই হই করে উঠি। সবচেয়ে বেশী আনন্দে আমরা আত্মহারা হয়ে হুল্লোড় করি সির্দ্ধার্থ শংকর রায়ের পরাজয়ে। যার নেতৃত্বে বরাহনগর/ কাশিপুরের শয়ে শয়ে লরি বোঝাই আমাদের সাথীদের আত্মীয় স্বজন শব গঙ্গায় ফেলা হয়। যার হাত আমাদের হাজার হাজার সাথীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। তাছাড়া  যে গান্ধী পরিবার সারা দেশেকে জেল বানিয়ে ছেড়েছিল, বিরুদ্ধ মতামত কে স্তব্ধ করে ভারতবাসী কে ক্রীতদাস বানাতে চেয়েছিল তাদের পরাজয় আমাদের মধ্যে আনন্দের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল।
--
সারা রাত জেগে হৈচৈ চলল, চা খাওয়া চলল। পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হল। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারের অন্যত্তম মূল ঘোষনা ছিল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস বিরোধী সর্বদল মোর্চার  ইস্তেহারেও সেই ঘোষণা ছিল।  কেন্দ্রে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে সেই কংগ্রেস বিরোধী জনতা দল ক্ষমতায় আসে।  
শুরু হয় রাজনৌতিক বন্দীদের মুক্তি।
-
জেনানা ফাটক থেকে প্রথমে শুভা, সাথী, গৌরী একে একে মুক্তি পেল। তারপর মাসিমা আর বুলুর  মুক্তির অর্ডার এল। ছল ছল চোখে বিদায় নিয়ে ভাটি ঘর পর্যন্ত্য গিয়েও মাসিমার পা আটকে গেল, কিছু যেন বাদ থেকে গেল। মীনাক্ষী আমাকে মাসিমার কাছে ঠেলে দিয়ে বলল, " যাও মাসিমার আল্লাদী তোমাকে কিছু না বললে তাঁর পা ওখানেই আটকে থাকবে।" আমি আর একটু কাছে গেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, মাসিমা বুলুর সাথে এগিয়ে গেল।
--
এরপর এল আমার আর মলয়ার মুক্তির পরোয়ানা। তখন আমরা সবাই এক জায়গায় বসে ছিলাম। আমি আর মীনাক্ষী পাশাপাশি বসেছিলাম। এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে। মীনাক্ষীর কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। সবাই ঘিরে ধরে আমাকে শান্ত করার চেস্টা করছে। আর মলয়া বলে যাচ্ছে," ও রীতা কাঁদিস না, কাঁদিস না। আমাকে ও ছেড়ে দেবে শিগগিরই।" সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে, বলল, " তাকাচ্ছিস কেন, দেখছিসনা আমার ছাড়ার অর্ডার না আসার জন্য ও কাঁদছে।" খুকু বলে উঠল, "কি যে বলিস, তোর আর ওর অর্ডার তো একসাথে ই এসেছে।" সব কান্না এক বিশাল হাসিতে ভরে উঠল। কল্পনা বলল," বাইরে গিয়ে এক অন্য জগতে পড়বি , শুধু মনে রাখিস এডজাস্টমেন্ট শব্দটা।" সাবায়ের কাছ থেকে হাসি/ কান্নায় বিদায় নিয়ে অফিসে এলাম। আমি মলয়া কে বললাম, "আমি তো এদিকটা চিনতে পারবোনা।" ওর বাড়ী ছিল চেতলা। অভয় দিয়ে বলল, "আরে আমার বাড়ী তো  কাছেই, ভাইকে দিয়ে তোকে পৌঁছে দেবো।
--
অফিস থেকে বেরিয়ে জেলের কাঁটার তার নিয়ে ঘেরা শেষ চত্বরের গেটে দেখি সজল নয়নে দাঁড়িয়ে আছে মা, 'আমার মা।' শেষ হল আমার জেল জীবনের সারে ৪বছর। 
এরপর প্রথমে মীনাক্ষী, রাজশ্রী ,তারপর কল্পনা, শেষে খুকু মিতা সবাই  ছাড়া পেল ১৯৭৭ সালে ই।
*********************************************************************************   (চলবে )



























22 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 8

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৮
************************

১৯৭৫ সালে এমার্জেন্সি জারী হল।বাইরে তদানীন্তন সরকারের অত্যাচারে সর্বত্র জনগণ আর বিভিন্ন রাজনৌতিক দলগুলির মিছিল মিটিঙ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের, বিভিন্ন কাগজের পত্রকারদের জেলে বন্দী করা হল। একদিন প্রায় শ খানেক বিভিন্ন রাজনৌতিক দলের মহিলা কর্মী ও তাঁদের কিছু নেত্রীরা জেনানা ফাটকে এলো। সম্ভবত তাঁরা ২/৩দিন ছিলেন। আমাদের সাথে তাঁদের, বিশেষ করে সাধারণ কর্মীদের, অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক  বিষয়ে আলোচনা হল। তাঁরা জোর গলায় ঘোষনা করে গেল," তোমাদের আমরা ঠিক বার করে নিয়ে যাব। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় দাবী হবে।"
--
তখন লক আপ হয়ে গেছে। আমাদের ঘরের উঁচুতে দুটি ছোট্ট ছোট্ট গরাদ আর লোহার জাল ঘেরা জানালা ছিল। বাথরুমের পাঁচিল ওপর আমাদের কজন দাঁড়াবার জায়গা হল, মুষ্ঠি বদ্ধ হাত তুলে সেখান থেকে স্লোগান দিতে থাকলাম  "জনতাই সকল শক্তির উৎস, একদিন তাঁরাই নতুন শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলবেন ইত্যাদি। " আর বাইরে থেকে প্রায় শ খানেক রাজনৈতিক কর্মীদের কণ্ঠে একটাই স্লোগান জেলের প্রাচীর ফাঁটিয়ে সারা আকাশ মন্দ্রিত হয়ে উঠলো," সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।''
--
এদিকে জেনানা ফাটকে কয়েক জন রাজনৈতিক বন্দিনীদের খালাসের অর্ডার এলো, কয়েক জন কে অন্য জেলে বদলী করা হল। আমরা বাকীরা যথারীতি আমাদের গান, নাটক, লেখা,পড়া, হাতের কাজ সব নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ডিভিশন ওয়ার্ডে একটা শিউলি ফুল আর একটা দুধে আলতা রঙের ফুলের গাছ ছিল। মাটিতে পড়ে যাওয়া শিউলি ফুলগুলি  ঘরে এনে রাখতাম, সারা ঘর গন্ধে  ম ম করত। দুধে আলতা রঙের ছোট ছোট কয়েকটা  ফুল ও পাতা শুদ্ধু ডাল ছোট শিশিতে জল দিয়ে সাজিয়ে রাখতাম।   আমাদের মধ্যে বরাবর বাগানের করার চল ছিল। বুলু, খুকু, বৌমা, মলয়া আর মাসিমা এ ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী ছিল। গাছের পরিচর্যা করত আর লুকিয়ে  দোপাটি ফুলের বড়া, শিউলি পাতার শুক্ত এই রকম নানা রান্না করে খাওয়াত। কুমড়ো গাছের বিচি মাটিতে পুঁতে দারুন একটা গাছ করেছিল। নানা ডাল, বাকল আর দড়ি দিয়ে একটা মাচার মত তৈরী করে তার উপর লতিয়ে দিয়েছিল। কদিন পর কুমড়ো ফুলের বড়া, আর পাতার শাক ও খেলাম।ছোট ছোট কুমড়ো ধরল,আস্তে আস্তে বিশাল বড় হতে থাকে।
--
লোভী ওয়ার্ডার আর মেট্রনের নজরে পড়ে । অবশ্য ভয়ে হাত দেবার সাহস হয়নি। মজা হত জেলার, সুপার রা রাউন্ডে এলে। এত বিশাল বস্তু গুলি কুমড়ো না বোমা, নাকি ওর ভেতরে আমরা কিছু লুকিয়ে রেখেছি, ভেবে শুকনো সন্দিগদ্ধ মুখে তাকাতো। অবশেষে একদিন মহাদেবীয়ার সাথে কথা বলে প্রায় গোটা তিরিশ বিশাল কুমড়ো শুদ্ধ গাছ টাকে তুলে দিলাম, একসাথে রান্না করে সারা জেনানা ওয়ার্ড গুলিতে প্রত্যেক বন্দীর মধ্যে বিলি করার জন্য। লোভী মানুষ গুলি অনেকটা আত্তসাৎ করে নিলেও ছিটেফোঁটা সাধারণ বন্দীদের মিলল, এই টুকুই আমাদের সান্তনা।
 --
আমাদের মধ্যে বুলু খুব মিষ্টি ,ভাবুক অথচ রসিক মেয়ে ছিল। কোনদিন কারো সাথে ওর মনোমালিন্য হয়নি। একদিন জয়ার খুব শরীর খারাপ ছিল বুলু সারা রাত জেগে ওকে হাওয়া করল। সকালে জয়া হেসে হেসে আমাদের গল্প করছে, "জানিস কাল সারা রাত আমি রবিকে স্বপ্ন দেখেছি।" "ও মেয়ে, সারা রাত আমি হাওয়া করলাম আর তুই রবির স্বপ্ন দেখলি।" এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটত। মাসীমার মাথা ব্যাথা হলে তেলজল মিলিয়ে মালিশ করতাম। খুকুর গলার ইনফেকশন বুকে ধরে গেল। ২ মাস লড়াই করে সবাই মিলে তাকে সারিয়ে তুললাম। আর আমার গ্যাস্ট্রিক হওয়ার পর  সকলে জীবন পাত করে সারিয়ে তুলেছিল। একবার কানে ফোঁড়া হয়ে কদিন প্রচন্ড ব্যথা।সাথী অতি সাবধানে ঠান্ডা জল দিয়ে মাথা ধুয়ে দিল কতক্ষন ধরে। শিখা সারাদিন বসে হাওয়া করল। আমার থেকে অন্তত বছর চারেকের ছোট হওয়া সত্ত্বেও প্রথম থেকেই আমাকে মেয়ে বানিয়ে নিল। আর মায়ের মত মমতায় নজর রাখত। খুকু সারা রাত কাপড় লন্ঠনের গায়ে গরম করে সেঁক দিল। ভোরের দিকে ফোঁড়া ফেটে গেলে মলয়া ধীরে ধীরে কাঠির মাথায় তুলো লাগিয়ে কান পরিষ্কার করে দিল। বাকীরা হাসপাতালের সামনে গিয়ে চেঁচামিচি করে ডাক্তার বাবু কে ডেকে নিয়ে এলো ওষুধ দেবার জন্য। আমরা সবাই তখন সবায়ের জন্য প্রাণ দিতে পারতাম। হায় ! কোথায় হারিয়ে গেল সে সব দিন।
--
এর মধ্যে একদিন  হটাৎ খুব জোরে জোরে পাগলী বাজতে শুরু হল। গুলি গোলার আওয়াজ শোনা গেল। আমরা বুঝতে পারলাম ছেলেদের ওয়ার্ডে নিশ্চয় খুব বড় গন্ডগোল হয়েছে।সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।কল্পনার কোর্ট ছিল, অনেক দেরীতে ফিরে বলল, "জানিস, ভেতরের গেট, মেইন গেটের  সব চাবি বন্ধুক ধারী জমাদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের প্রায় ৫০ জন ছেলে জেল ভেঙে পালিয়েছে। স্বদেশ আর কালু দুজন বাকিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার দায়িত্বে ছিল। নিজেরা জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছে। আর এক জমাদার ও মারা গেছে। " বিকাল ৬টা নাগাদ বড় জমাদার বন্দুক কাঁধে নিয়ে, আরও জমাদার, জমাদারনী সাথে এসে আমাদের লক আপ করে গেল।  
--

পরদিন থেকে সারা জেলে তল্লাশী শুরু হয়। দুদিন পরে আমাদের ওয়ার্ডে তল্লাশী হবে জেনে আমরা আমাদের বই পত্র লুকিয়ে ফেললাম। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ছেলে পুলিশরা মেটালডিটেক্টার দিয়ে সর্বত্র খুঁজতে লাগল, সারা ঘর,প্যাসেজ, স্নান ঘর সার্চ করল।  ঘরের বাইরে বিশাল একটা গর্ত কে টানেলের মুখ ভেবে তারা খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল। লোহার মাটি খোঁড়ার যন্ত্র পাতি এনে বিশাল আড়ম্বরে খুঁড়তে শুরু করতে না করতে ই গুটি কতক বড় বড় ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে এলো। বীর পুংগবেরা তাড়াতাড়ি পিছু হটে বাঁচল। গৌরী খিক খিক করে হাসে আর বলে,"খা,খা মাটি খা, ইদুরের কামড় খা।" আমরা হাসা হাসি করতে থাকলাম।
--
এদিকে মহিলা পুলিশরা আমাদের জামা কাপড়, কম্বল, বইপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। স্তালিনের একটা খন্ড  আমরা লুকাতে ভুলে গেছিলাম। শেষে মলয়ার উল সেলাইয়ের ব্যাগে সেটা ভোরে দেওয়া হল। একজন মহিলা পুলিশ খালি তাড়া দেয় আপনি কম্বল টা থেকে উঠুন তো। রাজশ্রী আর আমি বলি,"উঠে পড় , ওই ধার টা ওনার খোঁজা হয়ে গেছে তুই ওখানে বস।" আমরা দুজন ওকে গার্ড করলাম, ও বইটা ব্যাগ থেকে বার করে, তার উপর বসে সেলাই করতে লাগল। আর এক মহিলা পুলিশ এসে ওর ব্যাগ টা সার্চ করে চলে গেল। আমরা হেসে বললাম," দে, এবার ভাল করে তা দে। " রাজশ্রীর বাড়ী থেকে বিরাট একটা ছবির খাতা দিয়েছিল। সেটাতে আমাদের সকলের আঁকা ছবি ছিল। এক মহিলা পুলিশ 'দুনিয়া কাঁপান দশ দিন' বইটার মলাটে লাল রঙ দিয়ে আঁকা যে ছবিটা ছিল, রাজশ্রীর হাতের আঁকা সেই  ছবি দেখেই ষাঁড়ের মত খেপে গেল। ওটা যে নির্দোষ একটা ছবির খাতা মাত্র সেটা কিছুতেই বোঝানো গেল না। দম্ভভরে খাতা টা বগল দাবা করে ইঁদুরের তাড়ায় ভীত বীরের দল বেরিয়ে গেল। আমরা হেসে ফেললাম,' নাকের বদলে নরুন পেল।' মলয়ার স্তালিনের বই বাঁচাবার গল্প শুনে সবার কি হাসি। আর স্তালিনের নাম উঠলেই মলয়ার  মুখ খুশীতে লাল হয়ে যেত।
 --
কোথায় কুমড়োর ভয়ে জেল কর্তৃপক্ষ পাগল হয়ে যাচ্ছিল, আর কোথায় তাদের নাকের তলা দিয়ে ৫০ জন পালিয়ে গেল। জেলে আবার কড়াকড়ি বাড়লো। তবে চূড়ান্ত অত্যাচার আর তল্লাশি চালিয়ে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তো বটেই, প্রায় একবছর আগে শেলাদা কোর্ট থেকে পালন বেশীর ভাগ ছেলেদের ধরে ফেলে, প্রচন্ড অত্যাচার করেও ক্ষ্যান্ত হল না। ধরা পড়া সবাইকে নিয়ে আলিপুর স্পেশাল জেলে জমায়েত করে ডান্ডাবেড়ি পড়ালো, যাতে কেউ নড়তে চড়তে না পারে। ২/৩ দফায় প্রায় ৫০ এর ওপর পাকানো লম্বা বাঁশের লাঠি ধারী জমাদার তাঁদের বেধড়ক মার মারত। সারা পশ্চিম বাংলার জেলগুলি থেকে দাগী বদমাস দালাল এনে লাঠি, লোহার রড দিয়ে  কদর্য ভাবে নানা রকম অত্যাচার করত।
--
 দিনের পর দিন এই অত্যাচার সহ্য করে আমাদের ছেলেরা  ধীরে ধীরে দালাল বাহিনী ও কিছু কিছু জমাদার বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে,তাদের বশীভূত করে। এদিকে বিভিন্ন জেলের প্রবল অত্যাচার নিয়ে বাইরে বন্দীমুক্তি বাহিনী, নানা মানবিক সংগঠন,গানের দল তৈরী হয়। তারাও গণজাগরণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পত্র পত্রিকা তে লেখালেখি শুরু হয়। আমাদের সমর্থক বাহিনী বিদেশের পত্র পত্রিকা তে লেখা বার করার ব্যবস্থা করে। ফলে সরকার বাধ্য হয় অত্যাচার বন্ধ করতে।
--
এদিকে বাইরে তখন ভোটের দামামা বেজে গেছে। এমার্জেন্সি উঠে গেছে। ভোটে এবার যে একটা ওলোট পালট যবে আমরা আঁচ করতে পারছিলাম জেল কর্তৃপক্ষ আর পুলিশবাহিনীর নরম ব্যবহারে। কথায় আছে  না জাহাজ ডুবলে ইঁদুররা পালায় সবার আগে ।
১৯৭৭ সালে  সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী বিভিন্ন রাজনৌতিক দল  শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের  বিরুদ্ধে একজোট হল ভোটে লড়তে। 
************************************************************************************
 (চলবে)






  

19 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 7

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৭
**************************
সারাটা দিন আমরা রোজকার প্রয়োজনীয় ঘরের কাজ ছাড়া বই, খবরের কাগজ পড়া, সেলাই করা, ছবি আঁকা, লেখা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। যেখানে যখন সুযোগ পাওয়া যেত সাধারণ বন্দিনীদের সাথে গল্প করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যে গল্প করতাম। সবাই প্রায় সকলের জীবনের কথা, পরিবারের কথা জানতাম। সপ্তাহে সকলে একটা করে পোস্টকার্ড পেতাম। সবাই সবায়ের বাড়ীতে চিঠি লেখার পর, গোল হয়ে বসে সব চিঠিগুলি পড়া হত। সকলের বাড়ী থেকে উত্তর এলেও সবাই শুনতাম। যাদের যেদিন ইন্টারভিউ বা কোর্টের ডেট থাকত থাকত তারা ফিরে এসে, যাবার পথে ছেলে সাথীদের সাথে কি কথা হল, বাড়ীর লোকেদের কি কথা হল , কি কি ঘটনা ঘটল সব গল্প করত। বাকিরা বুভুক্ষুর মত সেগুলি গিলত। সেই সবদিন গুলি যেন উৎসবের মত মনে হত। -- নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হলেও সবাই মিলে তার মীমাংসা করা হত, কেউ কোন ভুল করলে আত্মসমালোচনা না করা পর্যন্ত্য কোন ছাড় দেওয়া হত না। কিন্তু মীমাংসার পর কেউ তা মনে পুষে সাধারণত রাখতোনা।   কেউ অসুস্থ হলে সবাই পালা করে সারা দিন সারা রাত তার দেখভাল করত। এমনকি কোন কারনে কারোর যদি মন খারাপ হত, বা কেউ চুপচাপ থাকত সবাই তাকে ঘিরে বসে মনের কথা টেনে বার করে, নানাভাবে তাকে হাসানোর চেষ্টা চলত, যতক্ষণ না সে হাসতো কেউ হাল ছাড়তো না, প্রয়োজনে সারা রাতও জাগা হতো। কারোর বাড়ীতে বোন, ভাই বা কারোর বিয়ে ঠিক হলে সবাই মিলে হাতের কাজের  নানা রকম উপহার তৈরী করে দেওয়া হতো। সকলের বাড়ী থেকে যা আসতো তা ছিল এজমালি।
--
 আমরা পরস্পর কে নানা আদরের নাম দিয়েছিলাম। নিজেদের নিয়ে নানা মজা করতাম। একদিন খুকু বলল, " জানিস আমি না এক জায়গায় গোটা গোটা সেদ্ধ ডিমের পায়েস খেয়েছিলাম।"ব্যাস তারপর কিছু হলেই খুকুকে সেদ্ধ ডিমের পায়েস বলে খেপানো হত। একদিন শীতকালের বিকালে বিজু, শিখা, মিতা জয়া আর আমি ঠান্ডা কনকনে জল দিয়ে বেশ করে গায়ে মাথায় সাবান মেখে স্নান করলাম। কে যেন তাই দেখে ফেলে  ঘরে গিয়ে সবাইকে নালিশ করল। সবাই রেগেমেগে ঠিক করল আমাদের বয়কট করা হবে। আমরা তো ব্যাপার টা আগে থেকেই আঁচ করেছিলাম।  প্রথমে আমারা পাঁচ জন মিলে বাকীদের নামের একটা করে বিশেষত্ত্ব দিয়ে গান বাঁধলাম। জেলে বছরে দুটো করে বন্দীদের পাড় আলা সাদা শাড়ি দেওয়া হত। একটা করে শাড়ি পরে আর একটা করে গলায় জড়িয়ে চুল খুলে কীর্তনীয়া সেজে ঘরে ঢুকে গোল হয়ে বসলাম।
--
 কারোর সাথে কোন কথা না বলে লক আপ হয়ে গেলে থালা বাজিয়ে গান শুরু করলাম। বিচারকেরা এ হেন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলে ও মুখগুলি হাসিতে ফাটো ফাটো। প্রথমেই বুলু হাত কামড়ে ফ্যাক করে হেসে ফেললো, "এই দ্যাখনা পাঁচটা কেমন রোবট এসেছে, আর গান গাইছে।" বাকীদের পক্ষে কষ্ট করে হাসি চেপে রাখা বড়ো মুশকিল।  মীনাক্ষীর কটমট চাউনি দেখে তারা হাসতে গিয়ে হাসিটা পারছে না। কিন্তু পেট ফুলে যাওয়া হাসি চাপা বড় দায়। এক মীনাক্ষী ছাড়া সবাই গানের তোড়ে হেসে  লুটোপুটি খাচ্ছে। মীনাক্ষী আমাদের ছেড়ে বিচারক দের বকতে শুরু করল, রেগে মেগে এক জায়গায় গুম মেরে বসে, মোটে কথা বলবেনা, খাবেনা। শেষে আমরা পাঁচ দোষী অনেক সাধ্য সাধনার পর মেয়ে ঠাণ্ডা হল।
--
আর এক দিন রাতে নিহারকণা বলে অতি পাজী এক ওয়ার্ডারের রাতের ডিউটি পড়ল আমাদের ওয়ার্ডে। তাকে আমরা মাসি মাসি করে চেঁচিয়ে ডাকলাম। সে আমাদের ওয়ার্ডে ডিউটি পড়লেই  ভয়ে কাঁপত। ভাটি ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,"কি হয়েছে "? " আরে, আরে এত দূরে কেন কাছে এস, ভয় পাচ্ছ, কেন আজ আবার কি অপকীর্তি করেছো ? বলো শুনি।" "আরে রাম, রাম আমি কি করব, গোবেচারী মানুষ।" "তাই বুঝি, আজ কারো হাজতী বা মেয়াদী নম্বরের ইন্টারভিউ এর খাবার বা জিনিসে ভাগ বসাও নি, মেট্রনের কাছে চুকলি করে কাউকে মার্ খায়াওনি ?" "না না, এই নাকে ক্ষত, কানে ক্ষত। " ঠিক আছে যাও, মাসীমার মাথা ব্যাথা করছে, হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে এস।" হটাৎ সাথী (লতিকা) বলে উঠলো, "যাচ্ছত, ওষুধের নামটা শুনলে না!" "কি নাম?" "বলো গিয়ে ড্রিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস," সাথীর বলার সাথে সাথে আমরা কয়েকজন চিৎকার করে উঠলাম," ইয়াক ইয়াক।" নীহারকণা দৌড়, একটু পরে একটা ওষুধ নিয়ে এল। সাথী বলল," এতো ভুল ওষুধ এনেছো, গিয়ে বল ওষুধের নাম 'ড্রিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।" "ইয়াক ইয়াক," আমরা সমস্বরে চীত্কার করলাম। এইভাবে পাঁচবার ওকে ঘোরানোর পর ক্ষ্যামা দিলাম। হাসিনার মত অজস্র সরল মেয়েগুলির কথা যে আমরা ভুলতে পারতাম না।
--
বৌমা (জয়শ্রী) ছোট্ট বয়স থেকে আই.পি.টি.আই তে নাটক করত। পরিণত বয়সে  নাটক লেখা, পরিচালনা, অভিনয় সব কিছুতে সে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। ওঁর নেতৃত্বে আমাদের নাটক চর্চা প্রবল বেগে এগিয়ে চলল। কখন লক আপ হবার পর আমরা কজন নাটক করতাম। বাকীরা দেখত। বৃত্তাকারে চলত। পরবর্তী কালে কল্পনাও  অনেক নাটক লিখেছে। বাকীরা অল্প বিস্তর হাত পাকিয়েছে। আমরা নিজেরা স্টেজ বানাতাম ,কম্বল দিয়ে ট্রেনের বগি, চাসনালা খনি, স্পার্টাকাসের যুদ্ধের জন্য অডিটোরিয়াম ইত্যাদি বানাতাম। নানা রকম ড্রেসও  বানাতাম। আর চির সাথী থালা আমাদের নাটকে কত কাজ দিয়েছে কিছুটা যাত্রার দলের মত। গুলির  শব্দ দরকার হলে একটা থালা দিয়ে আর একটা থালায় ধাম করে মারতাম। কখন কখন অবশ্য লোকটা আগে পড়ে  যেত, গুলির শব্দটা পরে হত। আনন্দের সিনে থালা বাজিয়ে গান হত। ঘরের মধ্যে লক আপের পর ২/৩ জন মিলে হটাৎ করে ছোট ছোট পথ নাটিকা আরম্ভ করে একে অপর সকল কে চমকে দিতাম, পাল্টা চমকে উচ্ছসিত হয়ে উঠতাম।
--
জিয়রদান ব্রুনো থেকে মার্ক্স্ , স্পার্টাকাস থেকে লেনিন , স্তালিন, মাও, চে  সবাই যাঁরা পৃথিবীতে সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্টা করতে জীবন দান করে গেছেন, তিতুমীর, টিপু সুলতান, ভকত সিং সবাই যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, শ্রমিক কৃষক আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ই যে জীবনের চালিকা শক্তি , আমাদের নাটক,গল্প গান সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আমরা সেটাই বলার চেষ্টা করতে করতাম সহজ সরল ভাষায়। মাঝে মাঝে আমরা মেয়াদী নম্বরের সামনের প্যাসেজে নাটক করতাম। হাজতী নম্বর থেকেও অনেকে দেখতে আসতো। মহাদেবীয়া এসব নিয়ে ঝামেলা করত না, এমনকি  হাসপাতাল থেকেও সবাই উঁকি ঝুঁকি মারত। মোটের উপর জেনানা ফাটকে আমাদের নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল।      
--
জেলের খাবার খেয়ে কেউ সুস্থ ছিল না। সকলের অল্পবিস্তর পেটের সমস্যা ছিল। আমার হজম শক্তি খুব দুর্বল হয়ে গেছিল। একদিন বাইরে থেকে এক নাম করা ডাক্তার বাবু দেখতে এলেন। আমার পাশে মীনাক্ষী বসে ছিল। ওর কাল কোঁকড়ান ঝাঁকড়া চুল গুলি পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিল। তখন ও খুব রোগা ছিল।বিশাল লম্বা কাঠির মত লম্বা হাতপা। ডাক্তার বাবু কিছু না জিজ্ঞাসা করেই প্যাক প্যাক করে ওর পেট টিপতে শুরু করল। ভুল ভাঙানোর পর ডাক্তার বাবু আমাকে দেখে চলে যেতেই আমাদের কি হাসি। আর একবার রাজশ্রীর পায়ে কাঁটা ফুঁটে পেঁকে গেল। একজন ছেলে বন্দী কম্পাউন্ডারের কাজ করত। সেবার ও রাজশ্রী র বদলে মীনাক্ষীর পা পরিস্কার করতে শুরু করল। এবার মীনাক্ষী সবার কাছে খুব বকা খেলো, অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য।
--
প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার জন্য অর্চনা দি কে সরকার ছেড়ে দেয়। তারপর মলয়ার ব্রেস্ট এ টিউমার হওয়ার ফলে পি.জি তে ভর্তি করা হয়েছিল ম্যালিগন্যান্ট ছিল না এই রক্ষে। রাজশ্রী, গৌরী ও আমাকেও পি.জি তে মাঝে মাঝে দেখাতে নিয়ে যাওয়া হত। তখন রোগ নিয়ে আমরা একেবারেই ভাবতাম না, বরং কিছুটা বন্ধন মুক্তির স্বাদ প্রানভরে উপভোগ করতাম। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু, ম্যাডাম,সিস্টার রা সকলে আমাদের এতো স্নেহ করতেন আমরা খুব কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।
--
তবে  অচিরে ই সবচেয়ে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এল,আমাদের প্রিয় মাসিমার ইউট্রাসে ক্যান্সার ধরা পড়ল। কিছুদিন পর পর পি.জি তে তাঁকে রেখে চিকিৎসা হতো। কিন্তু তাঁর মুক্তির জন্য কেউ কোন প্রচার বা প্রচেষ্টা করেনি। জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তিনি থাকতে বাধ্য হলেন। হয়ত তাঁর জন্য চেষ্টা করার মত বিশেষ বিশেষ লোকজন দের অভাব ছিল, তাই তিনি কোনোদিনই প্রচারের আলোতে আসতে পারলেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যু ও সকলের অজান্তে ,অগোচরে হয়েছে। সম্ভবত একটা শহীদ স্মরণে তাঁর উদ্দেশ্যে হয়নি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরাও খবরটা বহুদিন বাদে কানাঘুষো শুনেছিলাম। এটা যে আমাদের জীবনের কত বড়ো লজ্জার, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
--
১৯৭২ সালে  সি. পি. আই (এম.এল ) জন্মদাতা শ্রদ্ধেয় চারু মজুমদার লালবাজারে শহীদ হবার পর, অনেক আলোচনা সমালোচনার পর পার্টি দুভাগে ভাগ হয়ে গেছিল।  একভাগের নেতৃত্ব ছিল শহীদ জহর। অন্যভাগের নেতৃত্ব ছিল মহাদেব মুখার্জ্জী। ১৯৭৫ সালে মহাদেব মুখার্জ্জী ধরা পরে পুলিশের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। সেই প্রশ্নে পার্টি আবার খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়ল।
--
প্রথমে আমরা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ি। খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের হতাশা কাটিয়ে আমরা নিজেদের দেশ, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংগ্রামএর ইতিহাস নিয়ে জোরদার পড়াশুনা শুরু করলাম। তাছাড়া নাটক, লেখা, গান, হাতের কাজ  মাসিদের সাথে গল্প করা আরও দুরন্ত  গতিতে চলতে থাকে। এই পর্যায়ে কল্পনা, রাজশ্রী আমাদের কাছে ডিভিশন ওয়ার্ডে চলে আসে। যদিও আগেই ওদের নিয়েই বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা আগেই করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি শুভা আর দুচারজন মেয়ে আমাদের মধ্যে এসেছিল। আস্তে আস্তে অনেকে ছাড়াও পেয়ে যায়। যাই হোক প্রথমে কিছুটা মুষড়ে পড়লেও আমরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। বরং কিছুটা যেন বদ্ধ জলা থেকে বেরিয়ে আমাদের জীবন যেন আরও  পরিণত আর ক্রিয়েটিভ হয়ে ওঠে। 
************************************************************************************
(চলবে )   
















  


















 







15 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 6

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৬
************************
এতেও জেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কল্পনা কে হাজারীবাগ জেলে বদলী করল। রাজশ্রীকে লালবাজারে এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু কাউকেই ভাঙতে পারেনি। মীনাক্ষীকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে একদিন মিতা এলো মেদিনীপুর থেকে, অনেক অত্যাচারের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তারপর দেবযানী আর কমলা এল। দেবযানী পার্টি ছেড়ে দিয়েছিল আর কমলা ছিল খুবই সাধারণ, ঘরেলু মেয়ে।  আমাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ছিল। তাদের ও সরকার বাহাদুর ভয় পেল।
--
কদিন বাদে রাজশ্রী ফিরে এলো। ওকে একা সেলে রাখাতে আমরা আপত্তি জানাতে দেবযানী আর কমলাকে সেলে পাঠিয়ে দিল। কিছুদিনে বাদে কল্পনা সেলে ফিরে আসে আর দেবযানী, কমলা ছাড়া পেয়ে যায়। ১৯৭৪ এর মাঝে মলয়া ধরা পরে। ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার চলে, দীর্ঘ একমাস পুলিশ হাসপাতালে রাখার পর ওকে জেলে পাঠায়। টেবিলের ওপর ফেলে পেছনে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। আমাদের কাছে আসার পর ওর হিপে লাঠির বাড়ির দাগ আর অজস্র খোঁদল। মলয়া স্কুল টিচার ছিল। এরপর  কৃষ্ণা ওরফে জয়া, শিখা,পার্বতী, জয়শ্রী একে একে ধরা পড়ে। যথারীতি পুলিশের অত্যাচারের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। কৃষ্ণার টেক নাম ছিল জয়া। কিন্তু ওকে আমরা সারা জীবন জয়া বলেই ডাকতাম। আর জয়শ্রী কে বৌমা বলতাম। বৌমা ও স্কুল টিচার ছিল।
--
এরপর লতিকা ওরফে সাথী, অর্চনা দি আর গৌরী ধরা পড়ল। ওদের তিনজনের ওপর, বিশেষ করে অর্চনা দির ওপরে প্রচন্ড অত্যাচার হয়েছিল। সাথী গোখেল কলেজের অধ্যাপিকা, অর্চনা দি একজন স্কুল টিচার আর গৌরী সেলাইয়ের কাজ করত। অর্চনাদি আর গৌরী সাথীর ননদ ছিল। একমাত্র অর্চনাদি আর মাসিমা ছাড়া আমরা সবাইকে নাম ধরে ডাকতাম। রাজশ্রী, মীনাক্ষী আমি সবে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে পা রেখেছিলাম।গৌরী আর খুকু আমাদের বয়সী ছিল। জয়া সভবত বি.এ পাশ ছিল। খুব সম্ভব কল্পনা, বৌমা, মলয়া, সাথী সম বয়সী ছিল। বিজু, মিতা,শিখা আর পার্বতী স্কুলের গন্ডি তখন ও পার হয়নি।
--
বিভিন্ন বয়সের হওয়া স্বত্তেও আমাদের সকলের সবার সাথে খোলাখুলি মিশতে কোন বাঁধা কখন হয়নি। সকলে কত যে গুণের অধিকারী ছিল। বিজুর  এম্ব্রডায়েরী দেখার মত ছিল,উল বোনা, কুরুশের কাজেও পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী অসাধারণ ছবি আকঁতো, সেলাইও নিপুন ছিল। মীনাক্ষীও ছবি আঁকা, সেলায়ে, আব্বৃত্তি তে পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী আসার পর কল্পনার আঁকা ভীষণ সুন্দর হয়ে গেল। রাজশ্রী ছবি আঁকতে বসলেই ও খুব খেয়াল করে দেখত,আর নিজের ভেতরের অসীম প্রতিভায় খুব তাড়াতাড়ি পারদর্শী হয়ে গেল। মিতা কোন ছবি দেখলে এমন  নিপুন ভাবে সেটা আঁকতো,যে কোনটা আসল বোঝা যেতোনা। মাসিমা আর মলয়া ২/৩ দিনে একটা সোয়েটার শেষ করে ফেলত। গৌরী,শিখা,বুলু ও সূচীকর্মে পারদর্শী ছিল।খুকুর হাতের রান্না ছিল অসাধারন।  জয়া, বৌমা, মিনু, মলয়া আর সাথীরা  অসাধারণ গান করত। সাথীর তো ক্লাসিকাল চর্চা করা গলা ছিল। বৌমা পুরানো দিনের আই .পি.টি.আই এর কত যে  গান জানত, তা সবাইকে শেখাতো। তাছাড়া লেখালিখি তে অল্পবিস্তর সবাই পারদর্শী ছিল।বৌমা সর্বপ্রথম জেলের ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করে।
--
জয়া টা (কৃষ্ণা) খুব রসিক ছিল। যে কোন গুরু গম্ভীর পরিবেশে গম্ভীরভাবে এমন একটা রসিকতা করত যে সবাই হেসেই আকুল। তারপর সহজ পরিবেশে সমস্যাটা সমাধান করা খুব সুন্দর ভাবে হয়ে যেত। বৌমা, আমাদের জয়া আর শিখা ধরা পরার কিছুদিন পর একসাথে পুলিশ কাস্টডি তে ছিল। কি করে কাগজ পেন্সিল যোগাড় করে একজন পুলিশ অফিসার কে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছিল," ...নবীশের ভুড়ি / করি হাড়িকিড়ি। ...."ইত্যাদি। সেটা আবার সেই পুলিশ অফিসারের হাতে পড়েছিল। ফলে তার জন্য আর একদফা ঝামেলা পোহাতে হয়।
--
সকলের এত গুণাবলীর কথা বললাম এই কারনে যে, এরা এত সব গুনের অধিকারী ছিল ইচ্ছা করলেই প্রচলিত জীবনে থেকে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারতো। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে একটা নতুন সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়। ইতিমধ্যে একদিন শিখা আর পার্বতী কোর্ট থেকে পালতে গিয়ে, ধরা পরে মারধর খেয়ে চোখ মুখ ফুলিয়ে ওয়ার্ডে ফিরল।
--
এইসময় ডিভিশন ওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩০ এ গিয়ে দাঁড়াল,এদের মধ্যে আন্নার নাম টা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। ওরা খুব গরীব ছিল, লোকের বাড়ী কাজ করে সংসার চালাত। আমরা থালা কম থাকায় দুজনে মিলে এক থালায় খেতাম। সবাই একই জমা কাপড় পড়তাম। কারোর নিজস্ব বলে কিছু থাকতনা। ইন্টারভিউয়ে যার বাড়ী থেকে যা আসতো সাধারণ কমিউনে জমা পড়ত। দুজন করে এক সপ্তাহের কমিউন ইনচার্জ হত। তাদের হাতে খাবার দেবার দায়িত্ব থাকত। সেই সপ্তাহে ঘরের টয়লেট পরিস্কার করা, ঘর মোছা, ভাটির দিন  কাপড় কাচা সেসব কাজ থেকে তাদের ছুটি দেওয়া হতো। একবার আমি আর আন্না একসাথে কমিউন ইনচার্জ ছিলাম। এক থালায় খেতে খেতে ও আমাকে বলল দেখ আমরা এই রাজনীতি করি বলেই না এক সাথে খাই , সব কাজ একসাথে করি। কেউ কাউকে ঘেন্না করি না। আমাদের নতুন সমাজ টা তো এ রকম ই হবে।"আমি থ হয়ে ভাবলাম কত বড় সত্যি টা ও সহজ আর সুন্দর ভাবে বলল। এর কিছুদিন পর আন্না, মিনু, দেবযানী কমলা আরো অনেকে চলে গেল। তবে কল্পনা সেলে ফিরে এল। মোটের উপর আমরা ১৫/১৬ জনে এসে দাঁড়ালম।
---
এ কদিন মিতা, হাওয়া বিবি ,শান্তি মাসী, হাসিনা,শোভা, মর্জিনা ইত্যাদি প্রায় জনা তিরিশ বন্দিনী খাবার কম, ওষুধের অভাব, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা খাবার ধরল না, লক আপ ঢুকল না। তাঁদের সমর্থনে আমরাও খাবার বয়কট আর লক আপ রেজিস্ট করলাম। যৌথ প্রতিবাদের সামনে মেট্রন, আর এক কুখ্যাত বিজয়া ওয়ার্ডার আর দালাল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে কোর্ট থেকে আমাদের কজন কমরেড ফিরল। বন্দিনীদের কাছে আমাদের যৌথ প্রতিবাদের কথা শুনে তাঁদের সাথে বাইরেই  দাঁড়িয়ে থাকল কারন ডিভিশন ওয়ার্ডের গেট খুললে আমরাও বার হয়ে গেলে আর সামাল দেওয়া যাবেনা। অনেক তর্কবিতকের পর দালালরা হাত জোড় করে মাপ চায়, মেট্রন ওয়ার্ডার রা কথা দেয় তারা অন্যায়ের প্রতিকার করবে , খাবার মাপ মত দেবে ইত্যাদি। তারপর সবাই খাবার ধরে আর লক আপ হয়।     
---
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরের বন্দিনীরা খালাশ পেয়ে গেল, সরকারী পর্যায়ে বন্দী বিনিময় সূত্রে। মুন্নি,হামেদা, আসমা। জড়িনা মাসী, নানী ইত্যাদি যাবার সময়ে আমাদের জন্য অনেক দোয়া করলেন, শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। এবারে মেয়াদী ঘরে নানা কেসের বন্দিনীরা এলো। আরো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হল। এক আশ্চর্য্য ঘটনা দেখলাম। রেড লাইট এলাকার দেহ ব্যবসায়ীনী দের সাথে সেখানকার  মালকিন বা মাসিদের তুলে আনা হত মাঝে মাঝে, আবার ১/২ দিন বাদে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হত জানতাম। এবার দেখলাম সেই মাসিরা অনেক বন্দিনী মেয়েদের নানা রকম প্রলোভন দেখাচ্ছে। কাউকে বোঝাত তার বাড়ী পৌঁছে দেবে, কাউকে চাকরি পাইয়ে দেবে  ইত্যাদি। বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারা সহজেই সে প্রলোভনে পা দিত। কিছু পাজী ওয়ার্ডার আর জেলের অসৎ কর্মচারীদের সাথে তাদের ভাল যোগাযোগ থাকত। মেয়েগুলিকে বলে যেত,"আমি তোদের একে একে কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করব,  তোদের  মা / বাবা / পিসি /কাকা ইত্যাদি বলে যাকেই পাঠাবো, জজসাহেব জিজ্ঞাসা করলে মেনে নিবি। সেই লোক তোদের ছাড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি তখন তোদের ঠিক ঠাক ব্যবস্থা করে দেব। এখানে কাউকে কিছু বলবি না।" এইভাবে একটার পর একটা মেয়ে উধাও হয়ে যেত।
--
হাসিনা বলে আমাদের খুব প্রিয় একটি মেয়ে ছিল। আমাকে মা বলে ডাকত। সুন্দরবনের এক চাষী পরিবারের আদরের মেয়ে ছিল, অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বর বাড়ী এলে কোলে উঠে পুতুল কিনে দেবার বায়না ধরত। অবশেষে বর আর একটি বিয়ে করে। হাসিনাকে গ্রামের মোড়লের লালসার গ্রাস থেকে বাঁচাবার জন্য, ওর বাবা কলকাতায় কাজে পাঠায়। একবার বাড়ী তে দেখা করতে যাবার সময় পথ হারায়। ট্রাফিক পুলিশের কাছে শেয়ালদা স্টেশনের খোঁজ নিতে গিয়ে থানায় জমা হয়, সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে। একদিন এসে খুশীতে ঝলমল করা মুখে বলল," জানিস মা, আমার শ্বশুর ঘরের গ্রামের এক মাসি এখান এসেছিল। প্রথমে ইন্টারভিউ করবে, তারপর মেসো কে পাঠিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।" দুদিন পর ইন্টারভিউ এলে হাসিনা খুশী মুখে গেল। কিন্তু ফিরে চিন্তিত মুখে বলল," জানিস মা, মাসি,মেসোর সাথে আর একটা লোক এসেছিল। আমি মাসিকে আমার বরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই, রেগে গিয়ে মাসিকে বলল,'এ যে বিবাহিত তাতো বলনি।' মাসি তাকে বলল,' বেরিয়ে সব কথা শুনলে বুঝবে।" আমরা ব্যাপারটা বুঝলাম, হাসিনাও বুঝল। আমরা বলে দিলাম, "জজের কাছে তুললে, তুই চিনিস না বলে দিবি।" পরদিন হাসিনার কোর্ট পড়ল, কিন্তু আর জেলে ফিরল না। ওর সাথে যারা গেছিল, তাদের মুখে শুনলাম যে ওকে জজের কাছে তোলেইনি, লক আপ থেকে ছেড়ে দিয়েছে। কি সাংঘাতিক চক্র যে এর পেছনে কাজ করছে ভেবে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অথচ সত্যিকার বাবা মা রা যখন অতি কষ্টে খোঁজ পেয়ে বাচ্চাদের ছাড়াতে আসেন তাঁদের নাস্তানাবুধ হয়ে যেতে হয়। মাসের পর মাস চক্কর কাটার পর হারানো বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফেরে।      
************************************************************************************
(চলবে)










              








14 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 5

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৫
************************

জেল কর্তৃপক্ষ ব্যাপার টাকে  যে ছেড়ে দেবেনা আমরা জানতাম।প্রথমে ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলী করে দিল। ওয়েলফেয়ার অফিসারকেও ট্রান্সফার করে দিল। ১৯৭৪ এর একেবারে প্রথম ভাগে ঘটনাটা ঘটে। সেই সময় আমাদের ৬৭/৬৮ বছর বয়সী মাসিমা আর বুলু বর্ধমান বা মেদিনীপুর  জেল থেকে বদলি হয়ে এসেছিলেন। আমাদের মহাভাগ্য জেলে আমরা মাসিমাকে মা হিসাবে পেয়েছিলাম। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় আমাদের ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বয়সে আমাদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতেন। তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তিনি খুবই ছোট ছিলেন, কিন্তু লুকিয়ে বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন । বস্তুত স্বাধীনতা আর ন্যাযের প্রতি তাঁর চিরকালই অশেষ শ্রদ্ধা ছিল।তাঁর নাম ছিল শান্তিরানী দেব।
--
দেশ ভাগাভাগির সময় সব ফেলে খালি হাতে চলে আসেন। অশেষ কষ্টের মধ্যে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান। মেসোমশাই অসুস্থ থাকার ফলে তাঁকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। ছেলেরা একটু বড় হতেই বিভিন্ন কারখায় কাজ জুটিয়ে নেয়। তাঁর চার ছেলের মধ্যে ২/৩ জন আমাদের পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। মাসিমার বিবাহিত মেয়ে যেন মাসিমার ই প্রতিমূর্তি। জামাই ও খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু মমতা আর সহৃদয়তার প্রতিচ্ছবি।
--
বুলু শান্তশিষ্ট, হাসিখুশী, দৃঢ়চেতা মেয়ে ছিল। একদিন আমি আর বুলু হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলাম। দালাল রা মেট্রনের নির্দ্দেশে তৈরী ছিল। মেয়াদীও হাজতী নম্বর, জাল ঘরের বন্দিনীদের লক আপ করে দিল। ভাটি ঘর আর সেলের নীচের  কাঠের দরজা টা তো বন্ধ করাই থাকতো। এর মধ্যেই মেয়াদী নম্বরের মাসিরা বিজুদের খবর দিয়ে দিয়েছে শিখার নেতৃত্বে বিশাল এক দালাল বাহিনী বাঁশের লাঠি, লোহার রড নিয়ে আমাদের মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিজুরা হাসপাতালের জানালা দিয়ে আমাদের সাবধান করে দিল। তবে ওরাও জানতো আর আমরাও বুঝলাম খালি হাতে দুজন এতগুলি লাঠি ,রড ধারী দালালদের সাথে যুঝে উঠতে পারবো না। তাছাড়া চশমা খোলা অবস্থায় আমি তো অসহায়।  চশমাটা  বিজুর হাতে দিয়ে  বুলুর হাত শক্ত করে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ওয়ার্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম।আমার দুজন ঠিক করে নিয়েছিলাম মার তো খাবোই। কিন্তু ওরা যেন ভয় পেয়েছি মনে না করে।
--
কয়েক জন দালাল আমাদের প্রায় ঘিরে নিয়ে চলল, আর পুরো বাহিনী ভাটিঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে যেতেই আনোয়ারা আমার মাথায় লোহার রড দিয়ে বাড়ি লাগলো। এই আনোয়ারা আন্ডার এইজ সংশোধনাগারে তিনটি বাচ্চার মাথায় পাথর জাতীয় কিছু মেরে খুন করার কেসে ছিল। তাই শিখা ওকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিল। আমার মাথার ব্রম্ভতালুর  একটু ধারে দুটো, আর কপালের কাছে একটা বাড়ি লাগে। প্রায় অর্ধ অচেতন অবস্থায় চুল ধরে হিড়হিড় করে মাঠের মাঝে নিয়ে গেল, যাতে একমাত্র ডিভিশন ওয়ার্ড ছাড়া সেল, জাল ঘর, মেয়াদী আর হাজতী নম্বর থেকে সবাই দেখতে পায়, আর অসহায় রাগে ছটফট করে। যতক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল, বুঝতে পারছিলাম হাতে,পায়ে সর্ব শরীরে লাঠি আর রডের বাড়ি পড়ছে, মাথা দিয়ে রক্ত বার হয়ে চলেছে। আমি ক্ষীন স্বরে ওয়ার্ডার কে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি,"মাসি বুলু কোথায় দেখ।"
--
তার পর আর জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান আসে দেখি হাসপাতালের একটা বেডে শুয়ে। আর চার জন ডাক্তার ঘিরে আছেন, একজন মাথায় সেলাই করছেন। একজন প্রেসার দেখছেন, আর বলছেন ভীষণ হাই আর ফ্লাকচুয়েট করছে।
চিফ মেডিকেল অফিসার আর তাঁর পরের পদে যিনি তাঁরা কথা বলছেন।পাশের বেডে বুলু কে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে, ওর ও শুশ্রুষা চলছে।" ইতিমধ্যে মেট্রন মুখ বাড়িয়ে যত বার মিস্ষ্টি  কথা বলতে আসছে, আমি আর বুলু ওঠার চেষ্টা করছি, আর বকে যাচ্ছি, "চালাকি হচ্ছে,সব জেনে প্ল্যান করে এ সব কান্ড ঘটিয়ে, এখন ভালোমানুষি হচ্ছে ,ইত্যাদি।" আর হাত বাড়াচ্ছি ওকে ধরার জন্য, বুলু তো প্রায় ধরেই ফেলেছিল। একজন ডাক্তারবাবু কড়া গলায় মেট্রনকে  বললেন, " আপনি এখন থেকে সরুন তো, শুধু শুধু এদের উত্তেজিত করবেন না।"  
--
অকেনক্ষণ বাদে অবস্থার উন্নতি হলে আমাকে স্ট্রেচারে আর বুলু কে ধরে ডিভিশন ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে গেল। বুলু একবারে নতূন এসেছিল বলে, ওকে অল্পের ওপর দিয়ে ছাড় দিয়েছিল।বুলুর হাতে সেলাই পড়েছিল।আমাদের সাথীরা না খেয়ে অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা ঘরে ঢোকার পর থেকে আমাদের দুজনের সব দায়িত্ব তারা নিজেদের হাতে তুলে নিল। রেগুলার ওষুধ খাওয়ান আর  সেলাইয়ের জায়গা পরিস্কার করে নতুন ব্যান্ডেজ করতে হত সেলাই না কাটা পর্যন্ত্য। আমার সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল। এই সময় টা আমি হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারতাম না। মাসিমা,খুকু,বিজু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে সুস্থ করে তুলল। ওদের ছাড়া আমার পক্ষে টয়লেট করাও সম্ভব ছিল না।কোন বিরক্তি বা ঘেন্না না দেখিয়ে হাসিমুখে ওরা সব করত।
--
আর জেলের সহবন্দিনীরা যে আমাদের কত ভালবাসত তার প্রমান আমরা নতুন করে পেলাম। ওই স্বল্প খাবার থেকে তাঁরা ডায়েটের দুধ, বিস্কুট, ডিম,ফল যে যা পারত লুকিয়ে পাঠাত। কোন বারণ শুনতো না।আমাদের মারার পর শিখাকে অন্য জেলে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। মহাদেবিয়া হাসপাতালের মেট হল। একদিন শান্তিবাই ভাটির দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, শিখা ভয়ের চোটে পালিয়েছে। মহাদেবিয়া ভাল মানুষ। এখন আর আগের মত অবস্থা থাকবে না। চিন্তার কিছু থাকবেনা। হাত নেড়ে ওকে শুভেচ্ছা জানালাম। 
--
অবশেষে দিন ৭/৮ বাদে একটু সুস্থ হলে মেয়াদী নম্বর ঘরের সামনে বিজু আর খুকু আমাকে ধরে নিয়ে যাবার পর মাসিরা নিশ্চিন্ত হল। খাবার পাঠান বন্ধ করা গেল। মাসিদের মুখে শুনলাম আমাকে মারার পর মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত দিয়ে শিখারা পায়ে আলতা পরেছিল। আর সেইদিন যে ওয়ার্ডারের কাঁধে জেনানা ফাটকের শিকলে ঝোলানো চাবির ঝোপা ছিল, তাই দিয়ে তিনি দালাদের তাড়াবার আপ্রাণ চেস্টা করেছিলেন। তাছাড়া চারজন ডাক্তারবাবু সে সময় গেট দিয়ে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা আমাকে ঘিরে হাত ধরে দাঁড়িয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলেন। "নাহলে তোদের হয়ত সেদিন মেরেই ফেলত।" হাজতী নম্বর থেকেও অনেকে এসে দেখা করে গেল। এতোদিন পরে সবাইকে দেখে আর তাঁদের ভালোবাসা, শুভেচ্ছায় মন ভরে গেল। সাধারণ মানুষের এই ভালবাসা/শ্রদ্ধা  কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি ছিল না, ছিল আমাদের মতাদর্শের প্রতি।
--
 শান্তিবাই আর মীরা এসে হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে বলল, "দিদি মাপ করিস, আমরা দুজনকে  সেদিন ওদের পেছনে থাকতে বাধ্য  হয়েছিলাম, নাহলে মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখিয়েছিল।  তোদের মারতে দেখেও আমরা কিছু করতে পারিনি , মনে মনে কেঁদেছি।" " আরে না,না, তোদের যখন মেরেছিল, আমরা তো অসহায় ভাবে দেখেছি। কিছু করতে পারিনি। নিজেরা সবার সাথে মিলে মিশে থাকবি। কিন্তু ওদের দলে ভীড়ে সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার করিসনা।" " নারে, দিদি ওদের মত কখন হবোনা।"  
 --
এরপর কল্পনা, বিজু, খুকু, ডালিয়া, রাজশ্রী,মিনাক্ষী, আমার ও পূর্ববর্তী ওয়েলফেয়ার অফিসারের নামে ব্যাংকশাল কোর্টে মেট্রন কে মেরে ফেলার যড়যন্ত্রের অপরাধে জেল কর্তৃপক্ষ কেস করল। আমাদের মজাই হল, জেলের এই অন্ধকূপ থেকে বাইরে যাবার একটা সুযোগ মিলল। ব্যাংকশাল কোর্টে গিয়ে ডালিয়ার সাথে অনেক দিন বাদে দেখা হল। অনেক গল্প হল। বিকালে কোর্ট বন্ধ হলে আবার ছাড়াছাড়ি। আবার সেই কালো রাতের মত কাল উঁচু পাঁচিলের মধ্যে আবার হারিয়ে যাওয়া।
 --
কোর্টে যাবার সুযোগে ভ্যান থেকে হোলেও তার খুপরি জলনার ভিতর দিয়ে বাইরের পর পৃথিবী টাকে একটু দেখতে পেতাম। এরকম এক কোর্টের দিনে জেলে অফিসে আমাদের যখন তল্লাশির জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে, দেখলাম এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা আর দুই মেয়ে মিলে তাদের মাকে জেলে ভর্ত্তি করতে এসেছে, যাতে তাঁর গভীর ডিপ্রেশন থেকে সেরে ওঠে। আমরা সকলে মিলে তিন ভাগে ভাগ য়ে বাবা আর দুই মেয়েকে জেলের প্রকৃত অবস্থা কি, পাগলদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়, তার পরিণতি কি সব বুঝিয়ে বললাম। "১ /২  মাস মাকে নয় তাঁর কঙ্কাল টা দেখতে পাবে, আর কদিন বাদে তাঁকে আর খুঁজেই পাবে না। তাঁকে জীবিচাইলে শীগগিরই বাড়ী নিয়ে যাও।" মেয়েরা কাঁদতে শুরু করল আর বাবার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ২/১ সপ্তাহ বাদেই সব ব্যবস্থা করে মাকে তাঁরা বাড়ী নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের জালনা থেকে আমরা আনন্দের সাথে দেখলাম। যাবার সময় গরাদের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাদের অনেক ভালবাসা জানালেন। আমরাও তাঁদের এই কাজের অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম। 
--


************************************************************************************
(চলবে )




  


























  







 









    









13 Sept 2016

জাননা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 4

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৪
***********************

আমরা ফিমেল ওয়ার্ড বা জেনানা ফাটক কে বলতাম জেলের ভেতর জেল। তার ভিতর ছিল সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ড। দুনিয়া থেকে কেন প্রেসিডেন্সি জেলের ভেতরে যে ছোট্ট জেল তার থেকেও আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রচেষ্টা বহাল ছিল। সাধারণ বন্দিনীদের উপর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়ে চলল, বিশেষ করে আমাদের সাথে যারা কথা বলার চেষ্টা করত। এমন কি ছোট হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের ও কোন মাফ ছিল না, বেধড়ক অত্যাচার চলত।
--
আমরা সকলেই সাধারণ বন্দিনীদের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে নানা ভাবে যোগাযোগ রাখতাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর তার জন্য নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধার কথা বলতাম। আমাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য, নানা দেশের গরীব মানুষের লড়াইয়ের কথা বলতাম। কোন বন্দিনীর সাথে কোন কমরেডের হয়ত বেশী সখ্যতা গড়ে উঠত। সবাই সন্ধ্যে বেলায় লক আপ হলে সবার সাথে কথাগুলি বা কোন সমস্যা থাকলে তাই নিয়ে আলোচনা হত। তাই সকল বন্দিনীদের কথাই সবার গোচরে থাকত।
--
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরে বাংলাদেশ যুদ্ধে ধৃত কিছু মহিলাদের সাথে তাঁদের কিশোরী মেয়েদের আর বাচ্চা কাচ্চাদের রাখা হল। শুনলাম তাঁদের স্বামীদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে সম্ভবত আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়েছিল।যাইহোক জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একমাত্র শিখার মত গুটি কয়েক নৃশঃস বন্দিনী ছাড়া বাকী সবাই মোটামুটি একজোট ছিল। মেয়াদী নম্বরের মাসিদের সাথে আমাদের ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের কিশোরী মেয়েরা তো আমাদের সমর্থক হয়ে যায়। অনেক ব্যাপারে আমাদের গোপনে সাহায্য ও করত।
--
তার কিছুদিন পরে বেশ কিছু বার্মিজ মাসিদের একইরকম ভাবে কিশোরী মেয়ে আর ছোট ছোট বাচ্চাদের জেলে নিয়ে আসা হল।ধর্মের গোড়ামি মানুষ কে কতটা যে অমানুষ করে দেয় তাই নতুন করে দেখলাম। বর্মা মূলত বৌদ্ধধর্ম প্রধান দেশ। সেখানকার সংখ্যা-লঘু মুসলমান আদি অধিবাসীদের ওপর নানা অত্যাচার চলত। সেই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই সুদূর বর্মা থেকে এইটুকু আশ্রয়ের জন্য তাঁরা তাড়া খেতে খেতে ভাৰতে আসে। এসব দেখে তখন খুব অবাক হতাম। আজ আর হই না আজ এই গ্রহের মানুষ হয়েও কত কোটি মানুষের নিজের দেশ, আস্তানা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতি দিন। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে, ছোট্ট ফুলের মত শিশুদেরও ছাড় নেই। বাঁচার তাগিদে, একটুকু আশ্রয়ের জন্য এই পৃথিবীর মানুষ এক প্রান্ত থেকে অন্য্ ছুটে বেড়াচ্ছে। যেন পৃথিবীর কোন একটা কোণেও তাঁদের থাকার অধিকার নেই। ভারতে এসে বর্মী মাসীদের আশ্রয় হল জেলে। সীমান্ত থেকে বন্ধ ভ্যানে বদ্ধ দম আটকানো ঘুঁটে বোঝাইএর মত করে নিয়ে আসা হল প্রেসিডেন্সী জেলে।  
--
তাঁদের স্থান হল জাল ঘরে, যার  চার পাশটা  মোটা রড আর  জাল দিয়ে ঘেরা, মাথায় একটা চাল দেওয়া। গরমের  দুপুরে ঝলসানো গরম বাতাসে ছোট বাচ্চা গুলি পেটের অসুখে ভুগতে ভুগতে ডিহাইড্রেশন এ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলো। ওষুধ পথ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। শীত কালে হুহু করা হিম শীতল বাতাসে  ঠান্ডা লেগে নিমোনিয়া ইত্যাদি তে কত যে মারা গেল কেউ জানেনা। বার্মিজ মাসীরা বাকী ওয়ার্ড থেকেএকটু বিচ্ছিন্ন থাকতেন।
--
বাকী বন্দিনীদের সাথে আমাদের লুকিয়ে চুরিয়ে মোটামুটি একটা যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বার্মিজ মাসীরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন বলে আমাদের সাথেও সে রকম ঘনিষ্ঠ কোন যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারেনি। ইন্টারভিউ বা কোর্টে যাতায়াতের পথে তাঁদের দূর থেকে চোখের দেখাটুকুই একমাত্র যোগাযোগ ছিল , কথা আদানপ্রদানের সুযোগ হত না। অন্যান্য বন্দিনীদের মাধ্যমে কিছু কিছু খবরাখবর পেতাম মাত্র, তাঁদের বিপদে পাশে দাঁড়াবার ও সুযোগ হত না। এদিকে ওয়েলফেয়ার অফিসারকে ঠুঁটো জগন্নাথের মত করে রাখা হল। তাই চূড়ান্ত কষ্টে তাঁরা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন।
--
এখানে একটা কথা বলা দরকার। জেলের ডাক্তারবাবুরা একেবারে অমানবিক ছিলেননা। ডাক্তার দাস মূলতঃ মেয়েদের ওয়ার্ডের ডাক্তার ছিলেন। প্রতিদিন তিনি আসতেন। তাছাড়া ডাক্তার গুপ্ত, ডাক্তার চ্যাটার্জী আর সি.এম. ও (চীফ মেডিক্যাল অফিসার ) সপ্তাহে ২/৩ বার আসতেন ।  চাকরির স্বার্থে অনেক সময় তাঁরা আপোষের মনোভাব নিয়ে চলতেন একথা ঠিক। কিন্তু মেট্রন আর দালাদের এড়িয়ে  তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তাঁরা সাধ্য মত করার চেষ্টা করতেন।
--
আমারদের ওয়ার্ডে তাঁরা ভিসিটে এলে আমার তাঁদের ওয়ার্ডের বিভিন্ন বন্দিনীদের অবস্থার কথা তুলে ধরতাম। কখন কখন হাসপাতালের জালানা দিয়ে তাঁদের কাছে অভিযোগ গুলি জানতাম। মেট্রন কিছু বিরোধীতা করতে সাহস করত না। সেই সুযোগের সাধারণ বন্দিনীদের জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব হত। যদিও সব টুকু সুবিধা তাঁদের হাতে ঠিক মত পৌঁছাতে না। খবর পেলে আমরা আবার ডাক্তার বাবুদের কাছে নালিশ জানতাম। তখন আবার কিছুদিন ঠিকমত চলত। এইভাবে সাধারণ মরণাপন্ন কিছু বন্দিনীদের, বিশেষ করে বার্মিজ মাসিদের সামান্য কিছু সহায়তা হত।
--
রোজকার বন্দিনীদের খাবার চুরি করা ছাড়াও, কচিৎ কারোর বাড়ী থেকে ইন্টারভিউ তে বাড়ীর লোক যা নিয়ে আসতো সব কিছু হাসপাতালে বসে মেট্রন, ওয়ার্ডারদের সামনে আত্মোৎস্যাত আর ভাগাভাগি হয়ে যেত। খিদের জ্বালায় বন্দীরা একদিন প্রতিবাদ করতে শুরু করল। আমাদের কিছু সাথীরা কোর্ট থেকে তখন ফিরছিল, তারাও ওদের সাথে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। মেট্রন বেগতিক দেখে যারা খাবার বাটে তাদের ছদ্ম শাসন করল। ফলে সেদিনে খাবারের পরিমান কিছুটা বেশী হল।
--
আর একদিন  আমরা কজন বাড়ীর লোকেদের সাথে ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে দেখি একজনকে  মারার প্রতিবাদে  বাংলাদেশের মীরা, শান্তিবাই,  বাসন্তী মাসি, সমেদা এরকম প্রায় ২০ জন প্রচন্ড চেঁচামিচি আর কান্না কাটি করছে। শুনলাম রেখা আর বেলাকে শিখার বাহিনী বিনা কারণে মেরেছে। আমরাও তাদের  লড়াইয়ে সাথে সামিল হলাম। মেট্রন যথারীতি সেই দালালদের দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করাল। কিন্তু এইভাবে ক্রমাগত প্রতিবাদের দানা বেঁধে ওঠাটা কে মেট্রনরা আর তাদের দালাল রা স্বাভাবিক ভাবেই ভাল চোখে দেখল  না। আমরা শান্তিবাইদের  বোঝাতে লাগলাম সব সময় দল বেঁধে থাকতে আর চলাফেরা করতে। কারণ আমাদের কাঠের দরজা তো বেশীর ভাগ বন্ধ করে রাখা হয়।  
--
দালাল শিখা ছিল এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌ, দুটি সন্তানের মা। রোজ বরের অফিসে টিফিন নিয়ে যাবার ছুতায় মালিকের ছেলের সাথে প্রেম করে সব ফেলে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাড়ী ভাড়া নিত, পড়শীদের সাথে ভাব জমাত। তারপর তাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানা দামী জিনিসপত্র, টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি নিয়ে চম্পট দিত। এ হেন মানুষের চরিত্র শঠতা, নিষ্ঠুরতা আর লোভে ভরা থাকাটাই স্বাভাবিক।
--
ফিমেল ওযার্ডে পাগলরাও  ওর অত্যাচারের হাত থেকে বাদ যেত না। শুধু জেল কতৃপক্ষকে তুষ্ট করতেই নয়, অত্যাচার করাতে ও আনন্দ পেতো। কত অভাগা মেয়ের গোপনাঙ্গে হিংস্র ওয়ার্ডারদের সাথে মিলে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। অবশ্য এধরনের অসংখ্য শিখাদের জেল কর্তৃপক্ষ খুঁজে নিত নিজেদের অত্যাচার কায়েম রাখতে। রাতের অন্ধকারে কত মানুষ কে পিটিয়ে বা, পুড়িয়ে মেরেছে তার হিসাব নেই। দিনের আলোতে মানুষগুলি কে খুঁজে পাওয়া যেতনা।
--
মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল কলকাতায় রুজি রোজগারের জন্য। ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা দালাল কাউকে ভয় করত না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রন কে ডিঙিয়ে জানতে চায় কবে তার কোর্টের দিন পড়বে।পরে সেই অপরাধে  মেট্রনের অঙ্গুলি লেহনে শিখারা চুড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় পাগল বাড়ীতে শেকল বেঁধে রেখে দেয়। তাকে আমরা আর দেখতে পাইনি।
--
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগড়ি বাই এর স্বামীর নতুন করে বিয়ে হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়। শিখা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত। একদিন কোনমতে সেল থেকে বেড়িয়ে রোদ পোহাতে গেছিল শেষ তাকে মেরে লোপাট করে দিল। কাজ ফুরালে ছেঁড়া চটির মত তাকে ফেলে দিতে তাদের বাঁধত না।
--
ওপরে সেলের একটা ঘরে ওয়েলফেয়ার অফিসার বসতেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ ভাল ছিলেন। যতটা পারতেন বন্দীদের ভাল করার চেষ্টা করতেন, আমাদের প্রতি একটা স্নেহ ছিল। কোন বিশেষ সুবিধা নিতেন না। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। ফলে মেট্রন আর তার দল বল ওনাকে সহ্য করতে পারত না, নানা ভাবে তাঁর কাজে বাঁধা দিত। তিনি ওদের কোন পরোয়া না করে, একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তাঁর কাজে সাহায্য করার জন্য যে বন্দিনীদের দেওয়া হয়েছিল তাদের ওপর মেট্রন বাহিনীর রাগ ছিল।
--
একদিন দালালরা শান্তিবাই আর বাংলা দেশের মীরাকে অমানুষিক ভাবে মারল, যেহেতু এরা আমাদের ভালবাসত, আর ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে কাজ করত। প্যাসেজের থেকে হাসপাতালের ভিতর কিছুটা দেখা যেত, আমরা অসহায় ভাবে ওদের ক্রন্দনরত বীভৎস ভাবে ফুলে ওঠা বিকৃত মুখগুলি আর ক্ষত বিক্ষত হাত পা গুলি দেখে নিষ্ফল রাগে ফুঁসতে লাগলাম। 
--
ইতিমধ্যে সম্ভবত ১৯৭৩ সালের শেষ ভাগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভেঙে পালানোর একটা প্রচেষ্টা হয়।  অনেক ছেলেদের সাথে রাজশ্রী আর মীনাক্ষী ধরা পড়ে। তার পরই খুকুও ধরা পড়ে। রাজশ্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটি কমরেড সঞ্জয় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। রাজশ্রীকে সেন্ট্রাল  জেল গেটেই  প্রচন্ড মারধর করা হয়। লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যায়, পায়ে গুলির স্প্লিন্টার লাগে। মীনাক্ষ আর খুকু কে লালবাজারে অত্যাচারের স্বীকার হয়। বেশ কিছুদিন জেরার পর ওদের  জেলে পাঠান হয়। খুকুকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয় আর মীনাক্ষী, রাজশ্রী কে সেলে কল্পনার সাথে রাখা হয়। সাথীদের সেবা শুশ্রুষায়  ওরা ভাল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ৩/৪ দিনের জন্য জয়াকে পুরুলিয়া থেকে আনা হয়, সেখান থেকে ওকে মুক্তি দেওয়া হয়।
--
তখন ফিমেল ওয়ার্ডে মেট্রন, খারাপ ওয়ার্ডার আর শিখা তার দালাল বাহিনীর অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, একটা প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল খুব।  আমরা ঠিক করলাম এর একটা শিক্ষা না দিতে পারলে ওরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকবে। কিছু ন্যাকড়া আমাদের উকুন মারা কেরোসিন কাম মাথার তেলে ভিজিয়ে হাতপাখার হাতল গুলি ভেঙে মশালের মত বানালাম, আগুন দেখলে ভয় তো পাবে। আর আমাদের খাবার জন্য জেল থেকে যে এলুমুনিয়ামের থালা দিয়েছে তাই হল অস্ত্র। ঠিক হল চায়ের জন্য যখন সেলের আর ভাটিঘরের দরজা খুলবে আমরা সবাই ঠেলে দুপাশ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে যাবো। সবাই চুল গুলি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে খোঁপা করে নিলাম।
---
পরিকল্পনা মতো তাই হল ওয়ার্ডার  চীৎকার করে উঠোল,"আরে কোথায় যাচ্ছ সবাই মিলে।" ভাটির আগুন থেকে মশাল জ্বালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হল না। আনাড়ী হাতের মশাল কি জ্বলে। তাই মশালের আশা ত্যাগ করে থালা হাতেই দৌড়ালাম। হাসপাতালের গেটে মেট্রন, "কি হল কি হল" করে বেরিয়ে আসতেই ডালিয়া একথালার বাড়ী বসিয়ে দিল। মেট্রনের কপালের কাছে কেটে যেতেই ভয়ের চোটে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে গেল। সবচেয়ে দজ্জাল হেড জমাদারনী একটা মোঠা বাঁশের লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতেই ডালিয়া হাত থেকে লাঠি টা কেড়ে নিলো। ওদিকে শিখা বীর দর্পে এগিয়ে এলো আর একটা পাকান বাঁশের লাঠি নিয়ে। খুকু খপ করে সেটা ছিনিয়ে নিল।
--
তখন দেখার মতো অবস্থা। ওয়ার্ডার আর বাকী দালাল অর্ধেক হাওয়া ,আর অর্ধেক হা করে দেখছে শিখা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। খুকু আর ডালিয়া দুপাশ থেকে ছন্দ বজায় রেখে কাপড় কাঁচার মত পেটাচ্ছে। আমি আর বিজু চশমা খুলে গেছিলাম। আমার হাই পাওয়া বলে কিছু ভাল বুঝতে পারছিনা। কে আমাদের মেয়ে, কে সাধারণ বন্দিনী আর কে দালাল কিছুই বুঝতে পারছিনা। সেই সুযোগে শিখার মত নৃশংস একটা দালাল আমার পিছন থেকে বিশাল ধাক্কা মারল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। তখন মিনু এসে থালা দিয়ে তাকে একবাড়ি মেরে আমাকে ধরে তুলল।
--
এদিকে পাগলী বেজে গেছে, অর্থাৎ জেলের গন্ডগোলের সতর্ক বার্তা পৌঁছে গেছে।  ওয়ার্ডারের বাঁশির আওয়াজ,   ফোর্সের বুটের শব্ধ শোনা যাচ্ছে। আমরা সবাই পরিকল্পনা মাফিক সেলের দিকে দৌড়ে উঠে গেলাম। সেলের বারান্দার জাফরী দিয়ে আমরা ওদের কান্ড কলাপ দেখতে থাকি। জেলারের নেতৃত্বে বিশাল ফোর্স আস্তে আস্তে যেই সেলের দিকে এগোতে যায় ,আমরা চেঁচাতে, "থাকি মার মার বোম মার। গুলি চালা। " অমনি ফোর্স পিছিয়ে যায়। আবার এগোতে গেলে আবার আমরা সবাই মিলে চেঁচাই। ওরা আবার পিছিয়ে যায়। শুধু থালা হাতে আমরা এইভাবে লড়াই করতে গেছি, সেটা মেট্রন রা ভাবতে পারেনি। আসলে ওরা আমাদের ভাল করে দেখতে পারছে না, আর আন্দাজ ও করতে পারছে না আমাদের কাছে সত্যি কি অস্ত্র আছে।
--
এইভাবে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর নিজেরা পরার্মশ করতে থাকে। শেষে একজন গোবেচারি ডেপুটি জেলার সাদা রুমাল নাড়িয়ে ওপরে এসে বলে ,"তোমাদের যে কোন একজন চল। জেলার বাবু জানতে চায়, কি সমস্যা তোমাদের। জেলারবাবু ব্যবস্থা করবেন।" " আমরা একজন ও যাব না। জেলার বাবুকে গিয়ে বলুন, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। ফিমেল ওয়ার্ডে দিনের পর দিন সাধারণ বন্দিনী দের ওপর যে অত্যাচার চলছে, সেটা বন্ধ করতে বলুন। ঠিকমত চিকিৎসা আর ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করতে বলুন। রোজকার মাপমত খাবার সবাইকে দিতে বলুন। এতগুলি ই সমস্যা। এগুলির সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। "
--
ডেপুটি জেলার ফিরে গেল। হাসপাতালে আলাপ আলোচনা করে ফোর্স নিয়ে জেলার ফিরে গেল। তখন জল টল  খেয়ে, যাদের লেগেছে তাদের দেখভাল করা হল। কল্পনা আর বিজুর হাতে বেশ লেগেছিল, জলপট্টি করা হল। বিকালে সেই ডেপুটি জেলার হেডজমাদারকে সঙ্গে এনে গার্ড দিয়ে আমরা যারা ডিভিশন ওয়ার্ডে থাকি সেখানে পৌঁছে দিয়ে লক আপ করে দিল। সেলেও লক আপ করে ফিরে গেল।
***********************************************************************************
(চলবে)