31 Aug 2016

মচকায় না

মচকায় না
*******
উপছে  পড়া ভীড় ঠেলে অভিমন্যু  লোকাল ট্রেনের বগি থেকে কোনোমতে বিরাটী স্টেশনে পা রাখাল। কামরায় ওঠা আর নামা যাত্রীদের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বেঁধে গেছে। তার ভিতর থেকে সশরীরে বেরিয়ে  আসা ও কম ঝক্কি নয়। একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েই প্রবল ধাক্কায় তা যেন আবার বুকের ভিতর ঢুকে গেল। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল প্লেনড্রেস পুলিশ থিক থিক করছে  স্টেশনে।
--
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক হওয়া মানেই অপরাধ। আর একটু বিশিষ্ট কর্মী হলেই তাঁদের মাথার দাম ধরা থাকত অথবা দেখা মাত্রই গুলি করার নির্দেশ। অভিমন্যু অল্প বিস্তর তাদের দলে। খুব নিরীহ মুখে শান্ত ভঙ্গীতে একটি কামরা আবার উঠতে গেল। ট্রেন তখন চলতে শুরু করে দিয়েছে। তার সাথে সাথে ডজন ডজন মানুষ প্রতিটি কামরার সাথে দৌড়চ্ছে।
--
ট্রেনে ওঠা অসম্ভব বুঝতে পেরে একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনে স্বাভাবিক ভঙ্গীতে ধরাল। আড় চোখে তাকিয়ে দু / তিন পা বাড়াতেই একজন পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে বলল ," আরে আরে অভিমন্যু বাবু কোথায় যাচ্ছেন! আমরা যে এতজন লোক ৫/৬ ঘন্টা ধরে অধীর আগ্রহে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি, আপনাকে সাদরে আমাদের সদর দপ্তরে নিয়ে যাবার জন্য।একটুর জন্য ফসকে যাননি সেইটাই মহাভাগ্য," এক জাদরেল পুলিশ অফিসার তরুণ সেন পেছন থেকে তার পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে, কানের কাছে মুখ নিয়ে কথাগুলি বললো।
--
অভিমন্যু এক হাতে সিগারেটটা টানতে থাকে, আর অন্য হাতে তাঁর রাতের সেল্টারের একটা চাবি ছিল, সকলের অগোচরে কায়দা করে একফাঁকে বার করে ফেলে দেয়। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০/৬০ জন সাধারণ পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী তাকে ঘিরে  ফেলেছে। "অনেকবার চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়েছেন। এবার আর উপায় নেই। যার সাথে দেখা করতে এসেছেন সে যে অলরেডি আমাদের জালে, তাতো জানেন না। তার কাছে খবর পেয়ে আমরা ভোর রাত থেকে চক্রব্যূহ সাজিয়ে আপনার অপেক্ষায় আছি। সেটা টের পেলেও ভীড় ঠেলে ট্রেনে উঠে পালাতে পারেননি। এবার চলুন আমরা একটু খাতির দারি করি।"  অভিমন্যু শার্টের হাতার ভাঁজে রাখা একটা ছোট্ট চিরকূট অনেক ক্ষন ধরে ফেলে দেবার চেষ্টায় ছিল। আর এক দুঁদে অফিসার দেখতে পেয়ে খপ করে সেটা ছিনিয়ে নিল।  
--
পুরো বাহিনী ঘিরে ধরে স্টেশানের বাইরে রাখা গাড়ীতে তুলল। আগে পিছে পুলিশ ভ্যান দিয়ে ভি আই পি সম্মানে কলকাতার এক বিশেষ থানায় তুললো। শুরু হল থার্ড ডিগ্রি অত্যাচার। হাত পা বেঁধে মাথা পাখার সাথে ঝুলিয়ে দিল। মাথাটা নীচের দিকে ঝুলতে থাকে।হাতে,গায়ে, পায়ের তলায় বেধড়ক লাঠির বাড়ি পড়তে লাগল। কত বার জ্ঞান হারালো। জলের ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে এনে নতুন বাহিনী আসে, মারতে থাকে, নতুন করে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত। সঙ্গে অশ্রাব্য গালি গালাজ আর অজস্র জিজ্ঞাসা, মুখ খোলানোর চেস্টা। উত্তর না পেয়ে আবার মার। এইভাবে কতক্ষন যে পার হয়ে গেল সে জানতেই পারলনা।
--
নরম গরমে চলার নীতি। তাই হটাৎ নামিয়ে জল টল খাইয়ে একটু সুস্থ করে মিস্টি কথায় মুখ খোলানোর চেষ্টা, অভিমন্যু মুখে শুধু আলগা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। "ঠিক আছে, শুধু এই চিরকুটে যে এপয়েনমেন্ট গুলি সংকেতে লিখেছিস, সেগুলি বল। তোকে ধরার পর থেকে এই সাঙ্কেতিক চিহ্ন গুলি আমরা পাঠোদ্ধার করে যা বুঝছি গোটা কয়েক এপয়েনমেন্টের ডেট, টাইম আর স্পট, যেগুলির সময় একটা ছাড়া বাকি গুলি অলরেডি পার হয়ে গেছে। যেমন বি / স / স ১০ মানে বিরাটি /সোমবার / সকাল ১০ টা, ইত্যাদি, ইত্যাদি । অনেক ঘোল খাইয়েছিস বাপ্ এই তিন বছর ধরে। হাতে পেয়েও কয় ব্যাটা ফসকে গেল তোর জন্য। এইটা শুধু বল বু / চ / ৱ ৫, মানে আজ বিকাল ৫টা। শুধু চ মানে কি,স্পট টা বলে দে।" মনে মনে কিছু হিসাব নিকাশ করে নিল অভিমন্যু, একটু সময় কেনা যাক। এর মধ্যে তার ধরা পড়ার খবর সব খানে রটে গেছে। বাড়িতে ও খবর চলে গেছে নিশ্চয়। হয়ত মা তার সাথী আর বন্ধুদের সাহায্যে থানাগুলি চষে  ফেলছে। আর কিছুটা বিশ্রাম পেলে আবার অত্যাচার সহ্য করার শক্তিও সঞ্চয় হয়ে যাবে। চালাকি ধরা পড়ার পর অত্যাচারের মাত্রা বাড়বে। তবে ভাঙতে তাকে পারবেনা, কিছুতেই না।" " কিরে বল চ মানে কি ?" মিঃ সেন প্রশ্ন করে। " চ মানে চার নম্বর ব্রীজ বাসস্টপ।" "সত্যি বলছিস তো !" - সেন একটু সন্দিগ্ধ্। যেন আহত সুরে উত্তর আসে "যা মনে হয়।" "ঠিক আছে চল তবে।" সহকর্মীদের প্রতি অর্ডার, "গেট রেডি & হ্যারি  আপ।
--
সশস্ত্র প্লেন ক্লোদস ফোর্স আর অভিমন্যু কে নিয়ে মিঃ সেন রওনা দেন। কানে কানে এক সহকর্মী বলেন," তুমি যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছনা।" "হুম।" বেলা একটা থেকে ছটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কারোর টিকির দেখা পেল না পুলিশ । ইতিমধ্যে সবাই স্পেশাল এগ / চিকেন রোল আর চা খেয়েছে। অভিমন্যু হাতে রোল আর চা দেবার সময়ে সেন বলেছে, "বুঝতে পারছি গিয়ে আবার ঝোলাতে হবে, তা খেয়ে গায়ে একটু বল সঞ্চয় করে নিতেই তো আমাদের তুই এখানে নিয়ে এসেছিস, তাইতো। ভড়কি দেবার ফল টা জেনেই ঠান্ডা মাথায় খেলা টা খেলেছিস।" হটাৎ একটা ফোন আসার পর, সেন সকল কে বলে," সবাই থানায় ফেরা যাক। এ ব্যাটার দেখা করার স্পট টা ছিল চেতলা বাসস্টপ। চ মানে চার নম্বর নয়, চেতলা। আমার আগেই সন্দেহ ছিল। সাংঘাতিক ছেলে বটে।"
--
থানায় ফিরে অভিমন্যু কে যথারীতি চার হাত /পা বেঁধে ঝুলিয়ে পালা করে বীর পুঙ্গবেরা মারতে শুরু করল। অন্য দিকে যাদের জন্য সে চেতলার জায়গায় চার নম্বর বাসস্টপে পুলিশ বাহিনী কে নিয়ে গেছিল, তাদের একজন নাকি আগেই ধরা পড়ে সব বলে দিয়েছিল। অন্য জন এখন সমাদরে পুলিশের অতিথি হয়ে এ থেকে জেড পর্যন্ত্য বলতে শুরু করেছে।
তবে এরা নেতা হলেও, এদের ধরিয়ে দেওয়া ব্যাপক সাধারন ক্যাডার আর সমর্থক রা কিন্তু অভিমন্যুর পথ নিল। তাই দেখে ওর সমস্ত যন্ত্রনা তুচ্ছ মনে হল, শ্রদ্ধ্বায় / গর্বে বুক ভরে গেল তার।
--
একদিন মিঃ সেন অনেকক্ষন  অভিমন্যুর সাথে তাদের কাজ কর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্ন করল। দেশ বিদেশ নিয়ে অনেক আলোচনা হল । শেষে প্রশ্ন করল,"তোদের  উদ্দেশ্য কি সফল হবে কোনোদিন!" অভিমন্যু দ্বিধাহীন গলায় বলে," জীবনের সব কিছুকেই তো  উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কাজ করলে ই ভুল হয়, বেনো জল ঢুকে পড়ে । সে সব বাধা কাটিয়ে আবার নতুন উদ্যমে এগোতে হয়, একদিন না একদিন তা সফল হবেই। "
--
তিন সপ্তাহ বাদে বর্বর অত্যাচারে শারীরিক ভাবে ভেঙে চুরে দ হয়ে যাওয়া অভিমন্যু আর অন্যান্য সাথীদের কোর্টে নেবার অর্ডার হল। ভ্যানে ওঠানোর আগে বুট জুতো পরা  অবস্থায় তার পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সেন  বলল,"এবার আমার গলাটা ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা কর।" কিছুক্ষন চেষ্টার পর অভিমন্যু কোনমতে দাঁড়াল, কিন্ত হাত গুলি মুচড়ে গোল হয়ে গেছে। তাই সকলে ধরে তাকে ভ্যানে তুলে দিল। শুধু বেইমান দুটি পুলিশ কে দ্বিধা দ্বন্দ্ব হীন ভাবে সাহায্য করার পুরস্কার স্বরূপ ছাড়া পেয়ে গেল।
--
মিঃ সেন কে অভিমন্যুর দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে  থাকতে দেখে  তার এক  অধস্তন জিজ্ঞাসা করে,"স্যার, আপনার ওনার প্রতি কেমন যেন একটা বিশেষ শ্রদ্ধা আছে, তাই না?" "ব্যাটা, দেখতে রোগা পটকা, কিন্তু একেবারে আদত বাঘের বাচ্চা। জানো, এ ছেলেটার খোঁজে আমরা যখন সারা ফুলবাগান চত্বর/ বেলেঘাটা গরু খোঁজা খুঁজছি, ও নাকি তখন বিভিন্ন থানার সামনে ফুটপাতে ঠ্যালাওয়ালা দের সাথে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাত। নাকানি চোবানি খাইয়ে ছেড়েছে। শুনবে কোনদিন জেল থেকে পালিয়েছে। দেখলে তো, এত অত্যাচারেও একটু ও মচকালো না।"
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------





























--