25 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পরিশিষ্ট

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত -  পরিশিষ্ট 
******************************
জেল থেকে বার হবার পর আমরা যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। পার্টি তখন খন্ড বিখন্ড। অনেক প্রশ্ন আর সংশয়। একটা সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখতে পারছিনা। বেশ কিছুদিন হাবু ডুবু খেলাম। কিন্ত মূর্তিমান বাস্তব, নিজেদের রুজি রোজগারের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াল। যারা স্কুল,কলেজের পাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম তারা তার  কিছুটা শেষ করলাম। যারা চাকরি ছেড়ে এসেছিল তারা চাকরিতে যোগ দিল।  কেউ কেউ নতুন করে চাকরি খুঁজে নিল। অজস্র মানুষ প্রবল দারিদ্রে দিন গুজরান করতে থাকলো। বেশীর ভাগ লোক শারীরিক ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ বা অকেজ হয়ে পড়ল। তবুও তারা  নিজেদের পেশার সাথে নানা ধরনের সমাজ কল্যাণ কর কাজে যোগ দিল। একদল অবশ্যই এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার সুবাদের নাম ভাঙিয়ে খেল। সেটা একেবারে নগন্য ঘটনা। 
--
তা সত্ত্বেও পথ খোঁজা চলতে থাকল। নকশালবাড়ির  আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শ্রমিক / কৃষক এবং মেহনতী মানুষকে কমিউনিস্ট পার্টীর নেতৃত্বে  শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নয় প্রধানত  সশস্ত্র পথে  ক্ষমতাদখলের লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল। পার্টি সমস্ত যুবশক্তিকে শ্রমিক / কৃষকের সাথে একাত্ব হবার আহবান জানায়। এই সংগ্রামের সবচেয়ে সদর্থক দিক হল সমাজ বিবর্তনের আন্দোলনে এক নতুন ইতিহাস যুক্ত হল। আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক সশস্ত্র লড়াই হলেও সেগুলির মূল দিশা ছিল অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়। এখানেই পূর্বতন লড়াইগুলির সাথে নকশাল বাড়ীর আন্দোলনের মূলগত পার্থক্য। এই কথাটাই অনেকের মনে থাকেনা। 
যাইহোক  অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পূর্বতন শদীদ সিঁধু ,কানু চাঁদ ভৈরব, তিতুমীর, নুরুলদের সাথে ভূমাইয়া, কিসটা, ধ্যানেশ্বরী, সীমাস্বরী, নয়েয়েশ্বরী, সুরুবালা,সোনামতি, ফুলমতি, সামসারি, গৌড়রাও, খাড়শিং ইত্যাদি অসংখ্য শহীদ  কিষাণ ও কিষানীর নাম যুক্ত হল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য বীর যোদ্ধা সূর্য সেন, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা দের সাথে নির্মলা কৃষ্ণমূর্তি,দ্রোণাচার্য, আশু মজুমদার বিপ্লব ব্যানার্জী ইত্যাদি, তেভাগা  তেলেঙ্গানার, খাদ্য আন্দোলন  এর মত আন্দোলন গুলিকে কে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করল। জীবনে সর্ব ক্ষেত্রে উত্থান /পতন থাকে , ঠিক / ভুল হয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আত্ম সমীক্ষার মাধ্যমে ভুল শুধরে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতাই বিজ্ঞান। অনেক আত্মত্যাগ আর লড়াই এর মধ্যে দিয়েই  বিপ্লব সফল হয়।তাই মে দিবস আজও পালিত হয়। 
--            
আমরা বেশীর ভাগ এখন ও মনে করি আমাদের সবচেয়ে নিষ্পাপ, সরল আর সুন্দর সময় টা ব্যক্তিগত ক্যারিয়র তৈরী করার পেছনে না দৌড়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য একটা মহান , সুন্দর কাজে ব্যয় করেছিলাম। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়ে এক নতুন সমাজ গড়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমাদের পরম ভাগ্য। জ্ঞানের মহা সমুদ্রের এক বিন্দু জল সেখানেই পান করেছিলাম। সেটাই আমাদের পরম সম্পদ।
--
আমরা অনেকেই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে  ধীরে ধীরে গতানুগতিক জীবনে ফিরে এসেছি। কেউ কেউ নাটক, গণতান্ত্রিক অধিকার, নারীমুক্তি, পথশিশু, শিশু শ্রমিকদের পড়াশোনা ইত্যাদি নানা কিছু মানবিক আর সামাজিক কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা করছি। কিছুটা হয়তো নিজেরা যাতে জড় পদার্থে পরিণত না হয়ে যাবার তাগিদে।
--
 আর এক দল মানুষ হাজার সংশয় আর প্রশ্ন থাকা নিয়েও  সক্রিয় ভাবে সহস্র বাঁধা সত্বেও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে, কারণ তারা জানে প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন সমস্যার সমাধান করা যাবেনা।  আমি নতজানু হয়ে সেই সৈনিকদের কুর্নিশ জানাই, বিশ্বাস করি এক দিন না একদিন সেই শোষণহীন নতুন সমাজের লাল আলোয় পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
*************************************************************************************
 বিঃ দ্রঃ -
এখানে বলা প্রয়োজন, বিশেষ কারণে মিনু, সীমা , শীলা ও কমলা নাম চার টি পরিবর্তন করতে হয়েছে।
 তাছাড়া প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। কিছু স্মৃতি বিভ্রম ঘটে থাকতে পারে। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনীয়। সেই সময়ের অনেক অভিজ্ঞতা ও জেলের অনেক বন্দিনীর জীবনী আগেই লিখেছি। সাধারণ মানুষের কথা লেখাই আমার ইচ্ছা ছিল। জেলে সাধারন বন্দিনীদের অবস্থা, তাঁদের উপর অত্যাচার এবং জেলকর্ত্রীপক্ষ ও দালাল দের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের কথা ইংরেজিতে 'dishari' গল্পে যতটা মনে ছিল লিখেছিলাম। এর বাংলা করার ইচ্ছা ছিল। চোখের সমস্যার জন্য তা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার কন্যা সম কিছু বন্ধুদের অনুরোধে লিখলাম। আপনারা যাঁরা ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। জেলখানকে শোধনাগার নাম দিলেও, বদলায়নি কিছুই , "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। "







23 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 9

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৯
************************
আমাদের ইন্টারভিউ ও কোর্ট গুলিতে আমাদের বাবা, মা, ভাই, বোন বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন রা আসতেন।  রোজ দেখা হতে হতে তাঁরা সবাই যেন একই পরিবারের লোক হয়ে গিয়েছিলেন, সকলেই পরস্পরের সমব্যাথী। আমাদের কারো কোন বিশেষ জিনিসের প্রয়োজন থাকলে, আমরা তাঁদের যে কোন কাউকে অক্লেশে বলতে পারতাম। যেমন আমার কোন বিশেষ কিছুর প্রয়োজন থাকলে, বৌমা তার ভাইকে বলত। আমাদের মধ্যে যারা বিবাহিত ছিল মীনাক্ষীর মা তাদের জন্য পূজোর সময় লাল চুড়ি কিনে আনতেন। বিজুর কিছুর প্রয়োজন হলে আমার মাকে বলতাম। শিয়ালদা কোর্টের লোকজন আমার মাকে বিজুর মা বলে জানত। তাছাড়া সবাই নানা ধরনের খাবার,জামা কাপড়, বইপত্র ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। কোর্টে তাঁরা যা খাবার নিয়ে আসতেন, আমাদের সাথীরা সারাদিন প্রায় উপবাস থেকে সব কিছু জেলে নিয়ে আসতো, সবাই মিলে খাবার জন্য। সকাল ১০টা নাগাদ জেল থেকে সামান্য কিছু খেয়ে তারা বার হত আর ওয়ার্ডে  ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে  ৭/৮ টা হয়ে যেত।
--
জেল অফিসে সে সময় নানা বন্দী /বন্দিনী, জমাদার/ জমাদারনী, অন্যান্য কর্মচারি ইত্যাদি তে পরিপূর্ন থাকত। স্বাভাবিক ভাবে কিছুটা গোলমাল হত। একজন ডেপুটি জেলায় গন্ডগোল থামাতে বকে উঠত,"আইকি, অটো সেসামিসি, সেসামিসি; অইটা কি সারিয়াখানা ?(একি, এত চ্যাঁচামিচি, চ্যাঁচামিচি; এটা কি চিড়িয়াখানা?)" গোলমাল রূপান্তরিত হতো হাসিতে। তাড়া তাড়ি ভদ্রলোক সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতো।
--
আমাকে মারার পরে জেলার, সুপার রাউন্ডে এলে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে আমার কোন উত্তর দিতাম না। সুপার হিংস্র গলায় বলতো," কি কথার উত্তর দেবেন না, না! বলে কটমটিয়ে মেট্রনের দিকে তাকাতো। সে বেচারা গদগদ গলায় নানা কথা বলে তোয়াজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। জেলার চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতো। বন্দিনীরা ওকে আড়ালে রাবড়ি খচ্চর বলে ডাকত। আমাদের ওয়ার্ডে কোথা থেকে একটা ছোট্ট সাদা বেড়াল বাচ্চা এসে জুটেছিল। সেটাও ওদের দেখলে আমাদের কোলে এসে উঠত।
--
ইদানিং তাঁদের সকলের গলা দিয়েই যেন মধু ঝরতে শুরু করল, কি অসুবিধা,কি প্রয়োজন ইত্যাদি। যথারীতি আমরা কোন উত্তর দিতাম না। চুপচাপ মাথা নীচু করে চলে যেত। এই সময় ইন্টারভিউ তে কোন রকম বই দিতে নিষেদ্ধাজ্ঞা ছিল না, এমনকি মাও সে তুঙ থেকে চারু মজুমদারের বই পর্যন্ত। প্রথম থেকেই আমাদের সব ইন্টারভিউ তে  আই.বি / এস বি রা উপস্থিত থাকত, তারাই স্থির করে দিত কি দেওয়া যাবে আর কি দেওয়া যাবে না। এখন তারা অতি সজ্জ্বন, সর্ব দাতা।
--
দেখতে দেখতে সারা ভারত জুড়ে ইলেকশনের বাদ্যি বেজে উঠল। তখন কেবল  বুলু ,মাসিমা কল্পনা, মলয়া, খুকু, শুভা, মিতা, মীনাক্ষী, সাথী, গৌরী, রাজশ্রী আর আমি জেলে ছিলাম। বাকিরা বাইরে বন্দিমুক্তি আন্দোলনে ব্যাস্ত।    ১৯৭৭এর  মার্চ এসে গেল।কল্পনা ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে একটা ট্রান্সজিস্টর জোগাড় করে নিয়ে এলো ইলেকশন বুলেটিন শোনার জন্য। সম্ভবত বিশে মার্চ রেজাল্ট ডিক্লেয়ার শুরু হয়েছিল। কল্পনা সারা রাত জেগে খবর শুনতে থাকল।আমরা আধা জাগরণ, আধা ঘুমে। একটা করে মহীরুহের পতন হয়, কল্পনার ডাকে আমরা হই হই করে উঠি। সবচেয়ে বেশী আনন্দে আমরা আত্মহারা হয়ে হুল্লোড় করি সির্দ্ধার্থ শংকর রায়ের পরাজয়ে। যার নেতৃত্বে বরাহনগর/ কাশিপুরের শয়ে শয়ে লরি বোঝাই আমাদের সাথীদের আত্মীয় স্বজন শব গঙ্গায় ফেলা হয়। যার হাত আমাদের হাজার হাজার সাথীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। তাছাড়া  যে গান্ধী পরিবার সারা দেশেকে জেল বানিয়ে ছেড়েছিল, বিরুদ্ধ মতামত কে স্তব্ধ করে ভারতবাসী কে ক্রীতদাস বানাতে চেয়েছিল তাদের পরাজয় আমাদের মধ্যে আনন্দের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল।
--
সারা রাত জেগে হৈচৈ চলল, চা খাওয়া চলল। পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হল। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারের অন্যত্তম মূল ঘোষনা ছিল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস বিরোধী সর্বদল মোর্চার  ইস্তেহারেও সেই ঘোষণা ছিল।  কেন্দ্রে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে সেই কংগ্রেস বিরোধী জনতা দল ক্ষমতায় আসে।  
শুরু হয় রাজনৌতিক বন্দীদের মুক্তি।
-
জেনানা ফাটক থেকে প্রথমে শুভা, সাথী, গৌরী একে একে মুক্তি পেল। তারপর মাসিমা আর বুলুর  মুক্তির অর্ডার এল। ছল ছল চোখে বিদায় নিয়ে ভাটি ঘর পর্যন্ত্য গিয়েও মাসিমার পা আটকে গেল, কিছু যেন বাদ থেকে গেল। মীনাক্ষী আমাকে মাসিমার কাছে ঠেলে দিয়ে বলল, " যাও মাসিমার আল্লাদী তোমাকে কিছু না বললে তাঁর পা ওখানেই আটকে থাকবে।" আমি আর একটু কাছে গেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, মাসিমা বুলুর সাথে এগিয়ে গেল।
--
এরপর এল আমার আর মলয়ার মুক্তির পরোয়ানা। তখন আমরা সবাই এক জায়গায় বসে ছিলাম। আমি আর মীনাক্ষী পাশাপাশি বসেছিলাম। এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে। মীনাক্ষীর কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। সবাই ঘিরে ধরে আমাকে শান্ত করার চেস্টা করছে। আর মলয়া বলে যাচ্ছে," ও রীতা কাঁদিস না, কাঁদিস না। আমাকে ও ছেড়ে দেবে শিগগিরই।" সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে, বলল, " তাকাচ্ছিস কেন, দেখছিসনা আমার ছাড়ার অর্ডার না আসার জন্য ও কাঁদছে।" খুকু বলে উঠল, "কি যে বলিস, তোর আর ওর অর্ডার তো একসাথে ই এসেছে।" সব কান্না এক বিশাল হাসিতে ভরে উঠল। কল্পনা বলল," বাইরে গিয়ে এক অন্য জগতে পড়বি , শুধু মনে রাখিস এডজাস্টমেন্ট শব্দটা।" সাবায়ের কাছ থেকে হাসি/ কান্নায় বিদায় নিয়ে অফিসে এলাম। আমি মলয়া কে বললাম, "আমি তো এদিকটা চিনতে পারবোনা।" ওর বাড়ী ছিল চেতলা। অভয় দিয়ে বলল, "আরে আমার বাড়ী তো  কাছেই, ভাইকে দিয়ে তোকে পৌঁছে দেবো।
--
অফিস থেকে বেরিয়ে জেলের কাঁটার তার নিয়ে ঘেরা শেষ চত্বরের গেটে দেখি সজল নয়নে দাঁড়িয়ে আছে মা, 'আমার মা।' শেষ হল আমার জেল জীবনের সারে ৪বছর। 
এরপর প্রথমে মীনাক্ষী, রাজশ্রী ,তারপর কল্পনা, শেষে খুকু মিতা সবাই  ছাড়া পেল ১৯৭৭ সালে ই।
*********************************************************************************   (চলবে )



























22 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 8

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৮
************************

১৯৭৫ সালে এমার্জেন্সি জারী হল।বাইরে তদানীন্তন সরকারের অত্যাচারে সর্বত্র জনগণ আর বিভিন্ন রাজনৌতিক দলগুলির মিছিল মিটিঙ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের, বিভিন্ন কাগজের পত্রকারদের জেলে বন্দী করা হল। একদিন প্রায় শ খানেক বিভিন্ন রাজনৌতিক দলের মহিলা কর্মী ও তাঁদের কিছু নেত্রীরা জেনানা ফাটকে এলো। সম্ভবত তাঁরা ২/৩দিন ছিলেন। আমাদের সাথে তাঁদের, বিশেষ করে সাধারণ কর্মীদের, অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক  বিষয়ে আলোচনা হল। তাঁরা জোর গলায় ঘোষনা করে গেল," তোমাদের আমরা ঠিক বার করে নিয়ে যাব। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় দাবী হবে।"
--
তখন লক আপ হয়ে গেছে। আমাদের ঘরের উঁচুতে দুটি ছোট্ট ছোট্ট গরাদ আর লোহার জাল ঘেরা জানালা ছিল। বাথরুমের পাঁচিল ওপর আমাদের কজন দাঁড়াবার জায়গা হল, মুষ্ঠি বদ্ধ হাত তুলে সেখান থেকে স্লোগান দিতে থাকলাম  "জনতাই সকল শক্তির উৎস, একদিন তাঁরাই নতুন শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলবেন ইত্যাদি। " আর বাইরে থেকে প্রায় শ খানেক রাজনৈতিক কর্মীদের কণ্ঠে একটাই স্লোগান জেলের প্রাচীর ফাঁটিয়ে সারা আকাশ মন্দ্রিত হয়ে উঠলো," সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।''
--
এদিকে জেনানা ফাটকে কয়েক জন রাজনৈতিক বন্দিনীদের খালাসের অর্ডার এলো, কয়েক জন কে অন্য জেলে বদলী করা হল। আমরা বাকীরা যথারীতি আমাদের গান, নাটক, লেখা,পড়া, হাতের কাজ সব নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ডিভিশন ওয়ার্ডে একটা শিউলি ফুল আর একটা দুধে আলতা রঙের ফুলের গাছ ছিল। মাটিতে পড়ে যাওয়া শিউলি ফুলগুলি  ঘরে এনে রাখতাম, সারা ঘর গন্ধে  ম ম করত। দুধে আলতা রঙের ছোট ছোট কয়েকটা  ফুল ও পাতা শুদ্ধু ডাল ছোট শিশিতে জল দিয়ে সাজিয়ে রাখতাম।   আমাদের মধ্যে বরাবর বাগানের করার চল ছিল। বুলু, খুকু, বৌমা, মলয়া আর মাসিমা এ ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী ছিল। গাছের পরিচর্যা করত আর লুকিয়ে  দোপাটি ফুলের বড়া, শিউলি পাতার শুক্ত এই রকম নানা রান্না করে খাওয়াত। কুমড়ো গাছের বিচি মাটিতে পুঁতে দারুন একটা গাছ করেছিল। নানা ডাল, বাকল আর দড়ি দিয়ে একটা মাচার মত তৈরী করে তার উপর লতিয়ে দিয়েছিল। কদিন পর কুমড়ো ফুলের বড়া, আর পাতার শাক ও খেলাম।ছোট ছোট কুমড়ো ধরল,আস্তে আস্তে বিশাল বড় হতে থাকে।
--
লোভী ওয়ার্ডার আর মেট্রনের নজরে পড়ে । অবশ্য ভয়ে হাত দেবার সাহস হয়নি। মজা হত জেলার, সুপার রা রাউন্ডে এলে। এত বিশাল বস্তু গুলি কুমড়ো না বোমা, নাকি ওর ভেতরে আমরা কিছু লুকিয়ে রেখেছি, ভেবে শুকনো সন্দিগদ্ধ মুখে তাকাতো। অবশেষে একদিন মহাদেবীয়ার সাথে কথা বলে প্রায় গোটা তিরিশ বিশাল কুমড়ো শুদ্ধ গাছ টাকে তুলে দিলাম, একসাথে রান্না করে সারা জেনানা ওয়ার্ড গুলিতে প্রত্যেক বন্দীর মধ্যে বিলি করার জন্য। লোভী মানুষ গুলি অনেকটা আত্তসাৎ করে নিলেও ছিটেফোঁটা সাধারণ বন্দীদের মিলল, এই টুকুই আমাদের সান্তনা।
 --
আমাদের মধ্যে বুলু খুব মিষ্টি ,ভাবুক অথচ রসিক মেয়ে ছিল। কোনদিন কারো সাথে ওর মনোমালিন্য হয়নি। একদিন জয়ার খুব শরীর খারাপ ছিল বুলু সারা রাত জেগে ওকে হাওয়া করল। সকালে জয়া হেসে হেসে আমাদের গল্প করছে, "জানিস কাল সারা রাত আমি রবিকে স্বপ্ন দেখেছি।" "ও মেয়ে, সারা রাত আমি হাওয়া করলাম আর তুই রবির স্বপ্ন দেখলি।" এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটত। মাসীমার মাথা ব্যাথা হলে তেলজল মিলিয়ে মালিশ করতাম। খুকুর গলার ইনফেকশন বুকে ধরে গেল। ২ মাস লড়াই করে সবাই মিলে তাকে সারিয়ে তুললাম। আর আমার গ্যাস্ট্রিক হওয়ার পর  সকলে জীবন পাত করে সারিয়ে তুলেছিল। একবার কানে ফোঁড়া হয়ে কদিন প্রচন্ড ব্যথা।সাথী অতি সাবধানে ঠান্ডা জল দিয়ে মাথা ধুয়ে দিল কতক্ষন ধরে। শিখা সারাদিন বসে হাওয়া করল। আমার থেকে অন্তত বছর চারেকের ছোট হওয়া সত্ত্বেও প্রথম থেকেই আমাকে মেয়ে বানিয়ে নিল। আর মায়ের মত মমতায় নজর রাখত। খুকু সারা রাত কাপড় লন্ঠনের গায়ে গরম করে সেঁক দিল। ভোরের দিকে ফোঁড়া ফেটে গেলে মলয়া ধীরে ধীরে কাঠির মাথায় তুলো লাগিয়ে কান পরিষ্কার করে দিল। বাকীরা হাসপাতালের সামনে গিয়ে চেঁচামিচি করে ডাক্তার বাবু কে ডেকে নিয়ে এলো ওষুধ দেবার জন্য। আমরা সবাই তখন সবায়ের জন্য প্রাণ দিতে পারতাম। হায় ! কোথায় হারিয়ে গেল সে সব দিন।
--
এর মধ্যে একদিন  হটাৎ খুব জোরে জোরে পাগলী বাজতে শুরু হল। গুলি গোলার আওয়াজ শোনা গেল। আমরা বুঝতে পারলাম ছেলেদের ওয়ার্ডে নিশ্চয় খুব বড় গন্ডগোল হয়েছে।সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।কল্পনার কোর্ট ছিল, অনেক দেরীতে ফিরে বলল, "জানিস, ভেতরের গেট, মেইন গেটের  সব চাবি বন্ধুক ধারী জমাদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের প্রায় ৫০ জন ছেলে জেল ভেঙে পালিয়েছে। স্বদেশ আর কালু দুজন বাকিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার দায়িত্বে ছিল। নিজেরা জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছে। আর এক জমাদার ও মারা গেছে। " বিকাল ৬টা নাগাদ বড় জমাদার বন্দুক কাঁধে নিয়ে, আরও জমাদার, জমাদারনী সাথে এসে আমাদের লক আপ করে গেল।  
--

পরদিন থেকে সারা জেলে তল্লাশী শুরু হয়। দুদিন পরে আমাদের ওয়ার্ডে তল্লাশী হবে জেনে আমরা আমাদের বই পত্র লুকিয়ে ফেললাম। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ছেলে পুলিশরা মেটালডিটেক্টার দিয়ে সর্বত্র খুঁজতে লাগল, সারা ঘর,প্যাসেজ, স্নান ঘর সার্চ করল।  ঘরের বাইরে বিশাল একটা গর্ত কে টানেলের মুখ ভেবে তারা খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল। লোহার মাটি খোঁড়ার যন্ত্র পাতি এনে বিশাল আড়ম্বরে খুঁড়তে শুরু করতে না করতে ই গুটি কতক বড় বড় ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে এলো। বীর পুংগবেরা তাড়াতাড়ি পিছু হটে বাঁচল। গৌরী খিক খিক করে হাসে আর বলে,"খা,খা মাটি খা, ইদুরের কামড় খা।" আমরা হাসা হাসি করতে থাকলাম।
--
এদিকে মহিলা পুলিশরা আমাদের জামা কাপড়, কম্বল, বইপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। স্তালিনের একটা খন্ড  আমরা লুকাতে ভুলে গেছিলাম। শেষে মলয়ার উল সেলাইয়ের ব্যাগে সেটা ভোরে দেওয়া হল। একজন মহিলা পুলিশ খালি তাড়া দেয় আপনি কম্বল টা থেকে উঠুন তো। রাজশ্রী আর আমি বলি,"উঠে পড় , ওই ধার টা ওনার খোঁজা হয়ে গেছে তুই ওখানে বস।" আমরা দুজন ওকে গার্ড করলাম, ও বইটা ব্যাগ থেকে বার করে, তার উপর বসে সেলাই করতে লাগল। আর এক মহিলা পুলিশ এসে ওর ব্যাগ টা সার্চ করে চলে গেল। আমরা হেসে বললাম," দে, এবার ভাল করে তা দে। " রাজশ্রীর বাড়ী থেকে বিরাট একটা ছবির খাতা দিয়েছিল। সেটাতে আমাদের সকলের আঁকা ছবি ছিল। এক মহিলা পুলিশ 'দুনিয়া কাঁপান দশ দিন' বইটার মলাটে লাল রঙ দিয়ে আঁকা যে ছবিটা ছিল, রাজশ্রীর হাতের আঁকা সেই  ছবি দেখেই ষাঁড়ের মত খেপে গেল। ওটা যে নির্দোষ একটা ছবির খাতা মাত্র সেটা কিছুতেই বোঝানো গেল না। দম্ভভরে খাতা টা বগল দাবা করে ইঁদুরের তাড়ায় ভীত বীরের দল বেরিয়ে গেল। আমরা হেসে ফেললাম,' নাকের বদলে নরুন পেল।' মলয়ার স্তালিনের বই বাঁচাবার গল্প শুনে সবার কি হাসি। আর স্তালিনের নাম উঠলেই মলয়ার  মুখ খুশীতে লাল হয়ে যেত।
 --
কোথায় কুমড়োর ভয়ে জেল কর্তৃপক্ষ পাগল হয়ে যাচ্ছিল, আর কোথায় তাদের নাকের তলা দিয়ে ৫০ জন পালিয়ে গেল। জেলে আবার কড়াকড়ি বাড়লো। তবে চূড়ান্ত অত্যাচার আর তল্লাশি চালিয়ে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তো বটেই, প্রায় একবছর আগে শেলাদা কোর্ট থেকে পালন বেশীর ভাগ ছেলেদের ধরে ফেলে, প্রচন্ড অত্যাচার করেও ক্ষ্যান্ত হল না। ধরা পড়া সবাইকে নিয়ে আলিপুর স্পেশাল জেলে জমায়েত করে ডান্ডাবেড়ি পড়ালো, যাতে কেউ নড়তে চড়তে না পারে। ২/৩ দফায় প্রায় ৫০ এর ওপর পাকানো লম্বা বাঁশের লাঠি ধারী জমাদার তাঁদের বেধড়ক মার মারত। সারা পশ্চিম বাংলার জেলগুলি থেকে দাগী বদমাস দালাল এনে লাঠি, লোহার রড দিয়ে  কদর্য ভাবে নানা রকম অত্যাচার করত।
--
 দিনের পর দিন এই অত্যাচার সহ্য করে আমাদের ছেলেরা  ধীরে ধীরে দালাল বাহিনী ও কিছু কিছু জমাদার বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে,তাদের বশীভূত করে। এদিকে বিভিন্ন জেলের প্রবল অত্যাচার নিয়ে বাইরে বন্দীমুক্তি বাহিনী, নানা মানবিক সংগঠন,গানের দল তৈরী হয়। তারাও গণজাগরণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পত্র পত্রিকা তে লেখালেখি শুরু হয়। আমাদের সমর্থক বাহিনী বিদেশের পত্র পত্রিকা তে লেখা বার করার ব্যবস্থা করে। ফলে সরকার বাধ্য হয় অত্যাচার বন্ধ করতে।
--
এদিকে বাইরে তখন ভোটের দামামা বেজে গেছে। এমার্জেন্সি উঠে গেছে। ভোটে এবার যে একটা ওলোট পালট যবে আমরা আঁচ করতে পারছিলাম জেল কর্তৃপক্ষ আর পুলিশবাহিনীর নরম ব্যবহারে। কথায় আছে  না জাহাজ ডুবলে ইঁদুররা পালায় সবার আগে ।
১৯৭৭ সালে  সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী বিভিন্ন রাজনৌতিক দল  শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের  বিরুদ্ধে একজোট হল ভোটে লড়তে। 
************************************************************************************
 (চলবে)






  

19 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 7

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৭
**************************
সারাটা দিন আমরা রোজকার প্রয়োজনীয় ঘরের কাজ ছাড়া বই, খবরের কাগজ পড়া, সেলাই করা, ছবি আঁকা, লেখা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। যেখানে যখন সুযোগ পাওয়া যেত সাধারণ বন্দিনীদের সাথে গল্প করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যে গল্প করতাম। সবাই প্রায় সকলের জীবনের কথা, পরিবারের কথা জানতাম। সপ্তাহে সকলে একটা করে পোস্টকার্ড পেতাম। সবাই সবায়ের বাড়ীতে চিঠি লেখার পর, গোল হয়ে বসে সব চিঠিগুলি পড়া হত। সকলের বাড়ী থেকে উত্তর এলেও সবাই শুনতাম। যাদের যেদিন ইন্টারভিউ বা কোর্টের ডেট থাকত থাকত তারা ফিরে এসে, যাবার পথে ছেলে সাথীদের সাথে কি কথা হল, বাড়ীর লোকেদের কি কথা হল , কি কি ঘটনা ঘটল সব গল্প করত। বাকিরা বুভুক্ষুর মত সেগুলি গিলত। সেই সবদিন গুলি যেন উৎসবের মত মনে হত। -- নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হলেও সবাই মিলে তার মীমাংসা করা হত, কেউ কোন ভুল করলে আত্মসমালোচনা না করা পর্যন্ত্য কোন ছাড় দেওয়া হত না। কিন্তু মীমাংসার পর কেউ তা মনে পুষে সাধারণত রাখতোনা।   কেউ অসুস্থ হলে সবাই পালা করে সারা দিন সারা রাত তার দেখভাল করত। এমনকি কোন কারনে কারোর যদি মন খারাপ হত, বা কেউ চুপচাপ থাকত সবাই তাকে ঘিরে বসে মনের কথা টেনে বার করে, নানাভাবে তাকে হাসানোর চেষ্টা চলত, যতক্ষণ না সে হাসতো কেউ হাল ছাড়তো না, প্রয়োজনে সারা রাতও জাগা হতো। কারোর বাড়ীতে বোন, ভাই বা কারোর বিয়ে ঠিক হলে সবাই মিলে হাতের কাজের  নানা রকম উপহার তৈরী করে দেওয়া হতো। সকলের বাড়ী থেকে যা আসতো তা ছিল এজমালি।
--
 আমরা পরস্পর কে নানা আদরের নাম দিয়েছিলাম। নিজেদের নিয়ে নানা মজা করতাম। একদিন খুকু বলল, " জানিস আমি না এক জায়গায় গোটা গোটা সেদ্ধ ডিমের পায়েস খেয়েছিলাম।"ব্যাস তারপর কিছু হলেই খুকুকে সেদ্ধ ডিমের পায়েস বলে খেপানো হত। একদিন শীতকালের বিকালে বিজু, শিখা, মিতা জয়া আর আমি ঠান্ডা কনকনে জল দিয়ে বেশ করে গায়ে মাথায় সাবান মেখে স্নান করলাম। কে যেন তাই দেখে ফেলে  ঘরে গিয়ে সবাইকে নালিশ করল। সবাই রেগেমেগে ঠিক করল আমাদের বয়কট করা হবে। আমরা তো ব্যাপার টা আগে থেকেই আঁচ করেছিলাম।  প্রথমে আমারা পাঁচ জন মিলে বাকীদের নামের একটা করে বিশেষত্ত্ব দিয়ে গান বাঁধলাম। জেলে বছরে দুটো করে বন্দীদের পাড় আলা সাদা শাড়ি দেওয়া হত। একটা করে শাড়ি পরে আর একটা করে গলায় জড়িয়ে চুল খুলে কীর্তনীয়া সেজে ঘরে ঢুকে গোল হয়ে বসলাম।
--
 কারোর সাথে কোন কথা না বলে লক আপ হয়ে গেলে থালা বাজিয়ে গান শুরু করলাম। বিচারকেরা এ হেন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলে ও মুখগুলি হাসিতে ফাটো ফাটো। প্রথমেই বুলু হাত কামড়ে ফ্যাক করে হেসে ফেললো, "এই দ্যাখনা পাঁচটা কেমন রোবট এসেছে, আর গান গাইছে।" বাকীদের পক্ষে কষ্ট করে হাসি চেপে রাখা বড়ো মুশকিল।  মীনাক্ষীর কটমট চাউনি দেখে তারা হাসতে গিয়ে হাসিটা পারছে না। কিন্তু পেট ফুলে যাওয়া হাসি চাপা বড় দায়। এক মীনাক্ষী ছাড়া সবাই গানের তোড়ে হেসে  লুটোপুটি খাচ্ছে। মীনাক্ষী আমাদের ছেড়ে বিচারক দের বকতে শুরু করল, রেগে মেগে এক জায়গায় গুম মেরে বসে, মোটে কথা বলবেনা, খাবেনা। শেষে আমরা পাঁচ দোষী অনেক সাধ্য সাধনার পর মেয়ে ঠাণ্ডা হল।
--
আর এক দিন রাতে নিহারকণা বলে অতি পাজী এক ওয়ার্ডারের রাতের ডিউটি পড়ল আমাদের ওয়ার্ডে। তাকে আমরা মাসি মাসি করে চেঁচিয়ে ডাকলাম। সে আমাদের ওয়ার্ডে ডিউটি পড়লেই  ভয়ে কাঁপত। ভাটি ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,"কি হয়েছে "? " আরে, আরে এত দূরে কেন কাছে এস, ভয় পাচ্ছ, কেন আজ আবার কি অপকীর্তি করেছো ? বলো শুনি।" "আরে রাম, রাম আমি কি করব, গোবেচারী মানুষ।" "তাই বুঝি, আজ কারো হাজতী বা মেয়াদী নম্বরের ইন্টারভিউ এর খাবার বা জিনিসে ভাগ বসাও নি, মেট্রনের কাছে চুকলি করে কাউকে মার্ খায়াওনি ?" "না না, এই নাকে ক্ষত, কানে ক্ষত। " ঠিক আছে যাও, মাসীমার মাথা ব্যাথা করছে, হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে এস।" হটাৎ সাথী (লতিকা) বলে উঠলো, "যাচ্ছত, ওষুধের নামটা শুনলে না!" "কি নাম?" "বলো গিয়ে ড্রিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস," সাথীর বলার সাথে সাথে আমরা কয়েকজন চিৎকার করে উঠলাম," ইয়াক ইয়াক।" নীহারকণা দৌড়, একটু পরে একটা ওষুধ নিয়ে এল। সাথী বলল," এতো ভুল ওষুধ এনেছো, গিয়ে বল ওষুধের নাম 'ড্রিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।" "ইয়াক ইয়াক," আমরা সমস্বরে চীত্কার করলাম। এইভাবে পাঁচবার ওকে ঘোরানোর পর ক্ষ্যামা দিলাম। হাসিনার মত অজস্র সরল মেয়েগুলির কথা যে আমরা ভুলতে পারতাম না।
--
বৌমা (জয়শ্রী) ছোট্ট বয়স থেকে আই.পি.টি.আই তে নাটক করত। পরিণত বয়সে  নাটক লেখা, পরিচালনা, অভিনয় সব কিছুতে সে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। ওঁর নেতৃত্বে আমাদের নাটক চর্চা প্রবল বেগে এগিয়ে চলল। কখন লক আপ হবার পর আমরা কজন নাটক করতাম। বাকীরা দেখত। বৃত্তাকারে চলত। পরবর্তী কালে কল্পনাও  অনেক নাটক লিখেছে। বাকীরা অল্প বিস্তর হাত পাকিয়েছে। আমরা নিজেরা স্টেজ বানাতাম ,কম্বল দিয়ে ট্রেনের বগি, চাসনালা খনি, স্পার্টাকাসের যুদ্ধের জন্য অডিটোরিয়াম ইত্যাদি বানাতাম। নানা রকম ড্রেসও  বানাতাম। আর চির সাথী থালা আমাদের নাটকে কত কাজ দিয়েছে কিছুটা যাত্রার দলের মত। গুলির  শব্দ দরকার হলে একটা থালা দিয়ে আর একটা থালায় ধাম করে মারতাম। কখন কখন অবশ্য লোকটা আগে পড়ে  যেত, গুলির শব্দটা পরে হত। আনন্দের সিনে থালা বাজিয়ে গান হত। ঘরের মধ্যে লক আপের পর ২/৩ জন মিলে হটাৎ করে ছোট ছোট পথ নাটিকা আরম্ভ করে একে অপর সকল কে চমকে দিতাম, পাল্টা চমকে উচ্ছসিত হয়ে উঠতাম।
--
জিয়রদান ব্রুনো থেকে মার্ক্স্ , স্পার্টাকাস থেকে লেনিন , স্তালিন, মাও, চে  সবাই যাঁরা পৃথিবীতে সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্টা করতে জীবন দান করে গেছেন, তিতুমীর, টিপু সুলতান, ভকত সিং সবাই যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, শ্রমিক কৃষক আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ই যে জীবনের চালিকা শক্তি , আমাদের নাটক,গল্প গান সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আমরা সেটাই বলার চেষ্টা করতে করতাম সহজ সরল ভাষায়। মাঝে মাঝে আমরা মেয়াদী নম্বরের সামনের প্যাসেজে নাটক করতাম। হাজতী নম্বর থেকেও অনেকে দেখতে আসতো। মহাদেবীয়া এসব নিয়ে ঝামেলা করত না, এমনকি  হাসপাতাল থেকেও সবাই উঁকি ঝুঁকি মারত। মোটের উপর জেনানা ফাটকে আমাদের নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল।      
--
জেলের খাবার খেয়ে কেউ সুস্থ ছিল না। সকলের অল্পবিস্তর পেটের সমস্যা ছিল। আমার হজম শক্তি খুব দুর্বল হয়ে গেছিল। একদিন বাইরে থেকে এক নাম করা ডাক্তার বাবু দেখতে এলেন। আমার পাশে মীনাক্ষী বসে ছিল। ওর কাল কোঁকড়ান ঝাঁকড়া চুল গুলি পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিল। তখন ও খুব রোগা ছিল।বিশাল লম্বা কাঠির মত লম্বা হাতপা। ডাক্তার বাবু কিছু না জিজ্ঞাসা করেই প্যাক প্যাক করে ওর পেট টিপতে শুরু করল। ভুল ভাঙানোর পর ডাক্তার বাবু আমাকে দেখে চলে যেতেই আমাদের কি হাসি। আর একবার রাজশ্রীর পায়ে কাঁটা ফুঁটে পেঁকে গেল। একজন ছেলে বন্দী কম্পাউন্ডারের কাজ করত। সেবার ও রাজশ্রী র বদলে মীনাক্ষীর পা পরিস্কার করতে শুরু করল। এবার মীনাক্ষী সবার কাছে খুব বকা খেলো, অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য।
--
প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার জন্য অর্চনা দি কে সরকার ছেড়ে দেয়। তারপর মলয়ার ব্রেস্ট এ টিউমার হওয়ার ফলে পি.জি তে ভর্তি করা হয়েছিল ম্যালিগন্যান্ট ছিল না এই রক্ষে। রাজশ্রী, গৌরী ও আমাকেও পি.জি তে মাঝে মাঝে দেখাতে নিয়ে যাওয়া হত। তখন রোগ নিয়ে আমরা একেবারেই ভাবতাম না, বরং কিছুটা বন্ধন মুক্তির স্বাদ প্রানভরে উপভোগ করতাম। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু, ম্যাডাম,সিস্টার রা সকলে আমাদের এতো স্নেহ করতেন আমরা খুব কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।
--
তবে  অচিরে ই সবচেয়ে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এল,আমাদের প্রিয় মাসিমার ইউট্রাসে ক্যান্সার ধরা পড়ল। কিছুদিন পর পর পি.জি তে তাঁকে রেখে চিকিৎসা হতো। কিন্তু তাঁর মুক্তির জন্য কেউ কোন প্রচার বা প্রচেষ্টা করেনি। জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তিনি থাকতে বাধ্য হলেন। হয়ত তাঁর জন্য চেষ্টা করার মত বিশেষ বিশেষ লোকজন দের অভাব ছিল, তাই তিনি কোনোদিনই প্রচারের আলোতে আসতে পারলেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যু ও সকলের অজান্তে ,অগোচরে হয়েছে। সম্ভবত একটা শহীদ স্মরণে তাঁর উদ্দেশ্যে হয়নি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরাও খবরটা বহুদিন বাদে কানাঘুষো শুনেছিলাম। এটা যে আমাদের জীবনের কত বড়ো লজ্জার, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
--
১৯৭২ সালে  সি. পি. আই (এম.এল ) জন্মদাতা শ্রদ্ধেয় চারু মজুমদার লালবাজারে শহীদ হবার পর, অনেক আলোচনা সমালোচনার পর পার্টি দুভাগে ভাগ হয়ে গেছিল।  একভাগের নেতৃত্ব ছিল শহীদ জহর। অন্যভাগের নেতৃত্ব ছিল মহাদেব মুখার্জ্জী। ১৯৭৫ সালে মহাদেব মুখার্জ্জী ধরা পরে পুলিশের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। সেই প্রশ্নে পার্টি আবার খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়ল।
--
প্রথমে আমরা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ি। খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের হতাশা কাটিয়ে আমরা নিজেদের দেশ, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংগ্রামএর ইতিহাস নিয়ে জোরদার পড়াশুনা শুরু করলাম। তাছাড়া নাটক, লেখা, গান, হাতের কাজ  মাসিদের সাথে গল্প করা আরও দুরন্ত  গতিতে চলতে থাকে। এই পর্যায়ে কল্পনা, রাজশ্রী আমাদের কাছে ডিভিশন ওয়ার্ডে চলে আসে। যদিও আগেই ওদের নিয়েই বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা আগেই করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি শুভা আর দুচারজন মেয়ে আমাদের মধ্যে এসেছিল। আস্তে আস্তে অনেকে ছাড়াও পেয়ে যায়। যাই হোক প্রথমে কিছুটা মুষড়ে পড়লেও আমরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। বরং কিছুটা যেন বদ্ধ জলা থেকে বেরিয়ে আমাদের জীবন যেন আরও  পরিণত আর ক্রিয়েটিভ হয়ে ওঠে। 
************************************************************************************
(চলবে )   
















  


















 







15 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 6

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৬
************************
এতেও জেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কল্পনা কে হাজারীবাগ জেলে বদলী করল। রাজশ্রীকে লালবাজারে এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু কাউকেই ভাঙতে পারেনি। মীনাক্ষীকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে একদিন মিতা এলো মেদিনীপুর থেকে, অনেক অত্যাচারের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তারপর দেবযানী আর কমলা এল। দেবযানী পার্টি ছেড়ে দিয়েছিল আর কমলা ছিল খুবই সাধারণ, ঘরেলু মেয়ে।  আমাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ছিল। তাদের ও সরকার বাহাদুর ভয় পেল।
--
কদিন বাদে রাজশ্রী ফিরে এলো। ওকে একা সেলে রাখাতে আমরা আপত্তি জানাতে দেবযানী আর কমলাকে সেলে পাঠিয়ে দিল। কিছুদিনে বাদে কল্পনা সেলে ফিরে আসে আর দেবযানী, কমলা ছাড়া পেয়ে যায়। ১৯৭৪ এর মাঝে মলয়া ধরা পরে। ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার চলে, দীর্ঘ একমাস পুলিশ হাসপাতালে রাখার পর ওকে জেলে পাঠায়। টেবিলের ওপর ফেলে পেছনে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। আমাদের কাছে আসার পর ওর হিপে লাঠির বাড়ির দাগ আর অজস্র খোঁদল। মলয়া স্কুল টিচার ছিল। এরপর  কৃষ্ণা ওরফে জয়া, শিখা,পার্বতী, জয়শ্রী একে একে ধরা পড়ে। যথারীতি পুলিশের অত্যাচারের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। কৃষ্ণার টেক নাম ছিল জয়া। কিন্তু ওকে আমরা সারা জীবন জয়া বলেই ডাকতাম। আর জয়শ্রী কে বৌমা বলতাম। বৌমা ও স্কুল টিচার ছিল।
--
এরপর লতিকা ওরফে সাথী, অর্চনা দি আর গৌরী ধরা পড়ল। ওদের তিনজনের ওপর, বিশেষ করে অর্চনা দির ওপরে প্রচন্ড অত্যাচার হয়েছিল। সাথী গোখেল কলেজের অধ্যাপিকা, অর্চনা দি একজন স্কুল টিচার আর গৌরী সেলাইয়ের কাজ করত। অর্চনাদি আর গৌরী সাথীর ননদ ছিল। একমাত্র অর্চনাদি আর মাসিমা ছাড়া আমরা সবাইকে নাম ধরে ডাকতাম। রাজশ্রী, মীনাক্ষী আমি সবে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে পা রেখেছিলাম।গৌরী আর খুকু আমাদের বয়সী ছিল। জয়া সভবত বি.এ পাশ ছিল। খুব সম্ভব কল্পনা, বৌমা, মলয়া, সাথী সম বয়সী ছিল। বিজু, মিতা,শিখা আর পার্বতী স্কুলের গন্ডি তখন ও পার হয়নি।
--
বিভিন্ন বয়সের হওয়া স্বত্তেও আমাদের সকলের সবার সাথে খোলাখুলি মিশতে কোন বাঁধা কখন হয়নি। সকলে কত যে গুণের অধিকারী ছিল। বিজুর  এম্ব্রডায়েরী দেখার মত ছিল,উল বোনা, কুরুশের কাজেও পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী অসাধারণ ছবি আকঁতো, সেলাইও নিপুন ছিল। মীনাক্ষীও ছবি আঁকা, সেলায়ে, আব্বৃত্তি তে পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী আসার পর কল্পনার আঁকা ভীষণ সুন্দর হয়ে গেল। রাজশ্রী ছবি আঁকতে বসলেই ও খুব খেয়াল করে দেখত,আর নিজের ভেতরের অসীম প্রতিভায় খুব তাড়াতাড়ি পারদর্শী হয়ে গেল। মিতা কোন ছবি দেখলে এমন  নিপুন ভাবে সেটা আঁকতো,যে কোনটা আসল বোঝা যেতোনা। মাসিমা আর মলয়া ২/৩ দিনে একটা সোয়েটার শেষ করে ফেলত। গৌরী,শিখা,বুলু ও সূচীকর্মে পারদর্শী ছিল।খুকুর হাতের রান্না ছিল অসাধারন।  জয়া, বৌমা, মিনু, মলয়া আর সাথীরা  অসাধারণ গান করত। সাথীর তো ক্লাসিকাল চর্চা করা গলা ছিল। বৌমা পুরানো দিনের আই .পি.টি.আই এর কত যে  গান জানত, তা সবাইকে শেখাতো। তাছাড়া লেখালিখি তে অল্পবিস্তর সবাই পারদর্শী ছিল।বৌমা সর্বপ্রথম জেলের ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করে।
--
জয়া টা (কৃষ্ণা) খুব রসিক ছিল। যে কোন গুরু গম্ভীর পরিবেশে গম্ভীরভাবে এমন একটা রসিকতা করত যে সবাই হেসেই আকুল। তারপর সহজ পরিবেশে সমস্যাটা সমাধান করা খুব সুন্দর ভাবে হয়ে যেত। বৌমা, আমাদের জয়া আর শিখা ধরা পরার কিছুদিন পর একসাথে পুলিশ কাস্টডি তে ছিল। কি করে কাগজ পেন্সিল যোগাড় করে একজন পুলিশ অফিসার কে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছিল," ...নবীশের ভুড়ি / করি হাড়িকিড়ি। ...."ইত্যাদি। সেটা আবার সেই পুলিশ অফিসারের হাতে পড়েছিল। ফলে তার জন্য আর একদফা ঝামেলা পোহাতে হয়।
--
সকলের এত গুণাবলীর কথা বললাম এই কারনে যে, এরা এত সব গুনের অধিকারী ছিল ইচ্ছা করলেই প্রচলিত জীবনে থেকে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারতো। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে একটা নতুন সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়। ইতিমধ্যে একদিন শিখা আর পার্বতী কোর্ট থেকে পালতে গিয়ে, ধরা পরে মারধর খেয়ে চোখ মুখ ফুলিয়ে ওয়ার্ডে ফিরল।
--
এইসময় ডিভিশন ওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩০ এ গিয়ে দাঁড়াল,এদের মধ্যে আন্নার নাম টা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। ওরা খুব গরীব ছিল, লোকের বাড়ী কাজ করে সংসার চালাত। আমরা থালা কম থাকায় দুজনে মিলে এক থালায় খেতাম। সবাই একই জমা কাপড় পড়তাম। কারোর নিজস্ব বলে কিছু থাকতনা। ইন্টারভিউয়ে যার বাড়ী থেকে যা আসতো সাধারণ কমিউনে জমা পড়ত। দুজন করে এক সপ্তাহের কমিউন ইনচার্জ হত। তাদের হাতে খাবার দেবার দায়িত্ব থাকত। সেই সপ্তাহে ঘরের টয়লেট পরিস্কার করা, ঘর মোছা, ভাটির দিন  কাপড় কাচা সেসব কাজ থেকে তাদের ছুটি দেওয়া হতো। একবার আমি আর আন্না একসাথে কমিউন ইনচার্জ ছিলাম। এক থালায় খেতে খেতে ও আমাকে বলল দেখ আমরা এই রাজনীতি করি বলেই না এক সাথে খাই , সব কাজ একসাথে করি। কেউ কাউকে ঘেন্না করি না। আমাদের নতুন সমাজ টা তো এ রকম ই হবে।"আমি থ হয়ে ভাবলাম কত বড় সত্যি টা ও সহজ আর সুন্দর ভাবে বলল। এর কিছুদিন পর আন্না, মিনু, দেবযানী কমলা আরো অনেকে চলে গেল। তবে কল্পনা সেলে ফিরে এল। মোটের উপর আমরা ১৫/১৬ জনে এসে দাঁড়ালম।
---
এ কদিন মিতা, হাওয়া বিবি ,শান্তি মাসী, হাসিনা,শোভা, মর্জিনা ইত্যাদি প্রায় জনা তিরিশ বন্দিনী খাবার কম, ওষুধের অভাব, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা খাবার ধরল না, লক আপ ঢুকল না। তাঁদের সমর্থনে আমরাও খাবার বয়কট আর লক আপ রেজিস্ট করলাম। যৌথ প্রতিবাদের সামনে মেট্রন, আর এক কুখ্যাত বিজয়া ওয়ার্ডার আর দালাল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে কোর্ট থেকে আমাদের কজন কমরেড ফিরল। বন্দিনীদের কাছে আমাদের যৌথ প্রতিবাদের কথা শুনে তাঁদের সাথে বাইরেই  দাঁড়িয়ে থাকল কারন ডিভিশন ওয়ার্ডের গেট খুললে আমরাও বার হয়ে গেলে আর সামাল দেওয়া যাবেনা। অনেক তর্কবিতকের পর দালালরা হাত জোড় করে মাপ চায়, মেট্রন ওয়ার্ডার রা কথা দেয় তারা অন্যায়ের প্রতিকার করবে , খাবার মাপ মত দেবে ইত্যাদি। তারপর সবাই খাবার ধরে আর লক আপ হয়।     
---
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরের বন্দিনীরা খালাশ পেয়ে গেল, সরকারী পর্যায়ে বন্দী বিনিময় সূত্রে। মুন্নি,হামেদা, আসমা। জড়িনা মাসী, নানী ইত্যাদি যাবার সময়ে আমাদের জন্য অনেক দোয়া করলেন, শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। এবারে মেয়াদী ঘরে নানা কেসের বন্দিনীরা এলো। আরো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হল। এক আশ্চর্য্য ঘটনা দেখলাম। রেড লাইট এলাকার দেহ ব্যবসায়ীনী দের সাথে সেখানকার  মালকিন বা মাসিদের তুলে আনা হত মাঝে মাঝে, আবার ১/২ দিন বাদে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হত জানতাম। এবার দেখলাম সেই মাসিরা অনেক বন্দিনী মেয়েদের নানা রকম প্রলোভন দেখাচ্ছে। কাউকে বোঝাত তার বাড়ী পৌঁছে দেবে, কাউকে চাকরি পাইয়ে দেবে  ইত্যাদি। বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারা সহজেই সে প্রলোভনে পা দিত। কিছু পাজী ওয়ার্ডার আর জেলের অসৎ কর্মচারীদের সাথে তাদের ভাল যোগাযোগ থাকত। মেয়েগুলিকে বলে যেত,"আমি তোদের একে একে কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করব,  তোদের  মা / বাবা / পিসি /কাকা ইত্যাদি বলে যাকেই পাঠাবো, জজসাহেব জিজ্ঞাসা করলে মেনে নিবি। সেই লোক তোদের ছাড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি তখন তোদের ঠিক ঠাক ব্যবস্থা করে দেব। এখানে কাউকে কিছু বলবি না।" এইভাবে একটার পর একটা মেয়ে উধাও হয়ে যেত।
--
হাসিনা বলে আমাদের খুব প্রিয় একটি মেয়ে ছিল। আমাকে মা বলে ডাকত। সুন্দরবনের এক চাষী পরিবারের আদরের মেয়ে ছিল, অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বর বাড়ী এলে কোলে উঠে পুতুল কিনে দেবার বায়না ধরত। অবশেষে বর আর একটি বিয়ে করে। হাসিনাকে গ্রামের মোড়লের লালসার গ্রাস থেকে বাঁচাবার জন্য, ওর বাবা কলকাতায় কাজে পাঠায়। একবার বাড়ী তে দেখা করতে যাবার সময় পথ হারায়। ট্রাফিক পুলিশের কাছে শেয়ালদা স্টেশনের খোঁজ নিতে গিয়ে থানায় জমা হয়, সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে। একদিন এসে খুশীতে ঝলমল করা মুখে বলল," জানিস মা, আমার শ্বশুর ঘরের গ্রামের এক মাসি এখান এসেছিল। প্রথমে ইন্টারভিউ করবে, তারপর মেসো কে পাঠিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।" দুদিন পর ইন্টারভিউ এলে হাসিনা খুশী মুখে গেল। কিন্তু ফিরে চিন্তিত মুখে বলল," জানিস মা, মাসি,মেসোর সাথে আর একটা লোক এসেছিল। আমি মাসিকে আমার বরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই, রেগে গিয়ে মাসিকে বলল,'এ যে বিবাহিত তাতো বলনি।' মাসি তাকে বলল,' বেরিয়ে সব কথা শুনলে বুঝবে।" আমরা ব্যাপারটা বুঝলাম, হাসিনাও বুঝল। আমরা বলে দিলাম, "জজের কাছে তুললে, তুই চিনিস না বলে দিবি।" পরদিন হাসিনার কোর্ট পড়ল, কিন্তু আর জেলে ফিরল না। ওর সাথে যারা গেছিল, তাদের মুখে শুনলাম যে ওকে জজের কাছে তোলেইনি, লক আপ থেকে ছেড়ে দিয়েছে। কি সাংঘাতিক চক্র যে এর পেছনে কাজ করছে ভেবে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অথচ সত্যিকার বাবা মা রা যখন অতি কষ্টে খোঁজ পেয়ে বাচ্চাদের ছাড়াতে আসেন তাঁদের নাস্তানাবুধ হয়ে যেতে হয়। মাসের পর মাস চক্কর কাটার পর হারানো বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফেরে।      
************************************************************************************
(চলবে)










              








14 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 5

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৫
************************

জেল কর্তৃপক্ষ ব্যাপার টাকে  যে ছেড়ে দেবেনা আমরা জানতাম।প্রথমে ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলী করে দিল। ওয়েলফেয়ার অফিসারকেও ট্রান্সফার করে দিল। ১৯৭৪ এর একেবারে প্রথম ভাগে ঘটনাটা ঘটে। সেই সময় আমাদের ৬৭/৬৮ বছর বয়সী মাসিমা আর বুলু বর্ধমান বা মেদিনীপুর  জেল থেকে বদলি হয়ে এসেছিলেন। আমাদের মহাভাগ্য জেলে আমরা মাসিমাকে মা হিসাবে পেয়েছিলাম। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় আমাদের ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বয়সে আমাদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতেন। তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তিনি খুবই ছোট ছিলেন, কিন্তু লুকিয়ে বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন । বস্তুত স্বাধীনতা আর ন্যাযের প্রতি তাঁর চিরকালই অশেষ শ্রদ্ধা ছিল।তাঁর নাম ছিল শান্তিরানী দেব।
--
দেশ ভাগাভাগির সময় সব ফেলে খালি হাতে চলে আসেন। অশেষ কষ্টের মধ্যে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান। মেসোমশাই অসুস্থ থাকার ফলে তাঁকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। ছেলেরা একটু বড় হতেই বিভিন্ন কারখায় কাজ জুটিয়ে নেয়। তাঁর চার ছেলের মধ্যে ২/৩ জন আমাদের পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। মাসিমার বিবাহিত মেয়ে যেন মাসিমার ই প্রতিমূর্তি। জামাই ও খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু মমতা আর সহৃদয়তার প্রতিচ্ছবি।
--
বুলু শান্তশিষ্ট, হাসিখুশী, দৃঢ়চেতা মেয়ে ছিল। একদিন আমি আর বুলু হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলাম। দালাল রা মেট্রনের নির্দ্দেশে তৈরী ছিল। মেয়াদীও হাজতী নম্বর, জাল ঘরের বন্দিনীদের লক আপ করে দিল। ভাটি ঘর আর সেলের নীচের  কাঠের দরজা টা তো বন্ধ করাই থাকতো। এর মধ্যেই মেয়াদী নম্বরের মাসিরা বিজুদের খবর দিয়ে দিয়েছে শিখার নেতৃত্বে বিশাল এক দালাল বাহিনী বাঁশের লাঠি, লোহার রড নিয়ে আমাদের মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিজুরা হাসপাতালের জানালা দিয়ে আমাদের সাবধান করে দিল। তবে ওরাও জানতো আর আমরাও বুঝলাম খালি হাতে দুজন এতগুলি লাঠি ,রড ধারী দালালদের সাথে যুঝে উঠতে পারবো না। তাছাড়া চশমা খোলা অবস্থায় আমি তো অসহায়।  চশমাটা  বিজুর হাতে দিয়ে  বুলুর হাত শক্ত করে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ওয়ার্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম।আমার দুজন ঠিক করে নিয়েছিলাম মার তো খাবোই। কিন্তু ওরা যেন ভয় পেয়েছি মনে না করে।
--
কয়েক জন দালাল আমাদের প্রায় ঘিরে নিয়ে চলল, আর পুরো বাহিনী ভাটিঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে যেতেই আনোয়ারা আমার মাথায় লোহার রড দিয়ে বাড়ি লাগলো। এই আনোয়ারা আন্ডার এইজ সংশোধনাগারে তিনটি বাচ্চার মাথায় পাথর জাতীয় কিছু মেরে খুন করার কেসে ছিল। তাই শিখা ওকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিল। আমার মাথার ব্রম্ভতালুর  একটু ধারে দুটো, আর কপালের কাছে একটা বাড়ি লাগে। প্রায় অর্ধ অচেতন অবস্থায় চুল ধরে হিড়হিড় করে মাঠের মাঝে নিয়ে গেল, যাতে একমাত্র ডিভিশন ওয়ার্ড ছাড়া সেল, জাল ঘর, মেয়াদী আর হাজতী নম্বর থেকে সবাই দেখতে পায়, আর অসহায় রাগে ছটফট করে। যতক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল, বুঝতে পারছিলাম হাতে,পায়ে সর্ব শরীরে লাঠি আর রডের বাড়ি পড়ছে, মাথা দিয়ে রক্ত বার হয়ে চলেছে। আমি ক্ষীন স্বরে ওয়ার্ডার কে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি,"মাসি বুলু কোথায় দেখ।"
--
তার পর আর জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান আসে দেখি হাসপাতালের একটা বেডে শুয়ে। আর চার জন ডাক্তার ঘিরে আছেন, একজন মাথায় সেলাই করছেন। একজন প্রেসার দেখছেন, আর বলছেন ভীষণ হাই আর ফ্লাকচুয়েট করছে।
চিফ মেডিকেল অফিসার আর তাঁর পরের পদে যিনি তাঁরা কথা বলছেন।পাশের বেডে বুলু কে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে, ওর ও শুশ্রুষা চলছে।" ইতিমধ্যে মেট্রন মুখ বাড়িয়ে যত বার মিস্ষ্টি  কথা বলতে আসছে, আমি আর বুলু ওঠার চেষ্টা করছি, আর বকে যাচ্ছি, "চালাকি হচ্ছে,সব জেনে প্ল্যান করে এ সব কান্ড ঘটিয়ে, এখন ভালোমানুষি হচ্ছে ,ইত্যাদি।" আর হাত বাড়াচ্ছি ওকে ধরার জন্য, বুলু তো প্রায় ধরেই ফেলেছিল। একজন ডাক্তারবাবু কড়া গলায় মেট্রনকে  বললেন, " আপনি এখন থেকে সরুন তো, শুধু শুধু এদের উত্তেজিত করবেন না।"  
--
অকেনক্ষণ বাদে অবস্থার উন্নতি হলে আমাকে স্ট্রেচারে আর বুলু কে ধরে ডিভিশন ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে গেল। বুলু একবারে নতূন এসেছিল বলে, ওকে অল্পের ওপর দিয়ে ছাড় দিয়েছিল।বুলুর হাতে সেলাই পড়েছিল।আমাদের সাথীরা না খেয়ে অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা ঘরে ঢোকার পর থেকে আমাদের দুজনের সব দায়িত্ব তারা নিজেদের হাতে তুলে নিল। রেগুলার ওষুধ খাওয়ান আর  সেলাইয়ের জায়গা পরিস্কার করে নতুন ব্যান্ডেজ করতে হত সেলাই না কাটা পর্যন্ত্য। আমার সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল। এই সময় টা আমি হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারতাম না। মাসিমা,খুকু,বিজু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে সুস্থ করে তুলল। ওদের ছাড়া আমার পক্ষে টয়লেট করাও সম্ভব ছিল না।কোন বিরক্তি বা ঘেন্না না দেখিয়ে হাসিমুখে ওরা সব করত।
--
আর জেলের সহবন্দিনীরা যে আমাদের কত ভালবাসত তার প্রমান আমরা নতুন করে পেলাম। ওই স্বল্প খাবার থেকে তাঁরা ডায়েটের দুধ, বিস্কুট, ডিম,ফল যে যা পারত লুকিয়ে পাঠাত। কোন বারণ শুনতো না।আমাদের মারার পর শিখাকে অন্য জেলে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। মহাদেবিয়া হাসপাতালের মেট হল। একদিন শান্তিবাই ভাটির দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, শিখা ভয়ের চোটে পালিয়েছে। মহাদেবিয়া ভাল মানুষ। এখন আর আগের মত অবস্থা থাকবে না। চিন্তার কিছু থাকবেনা। হাত নেড়ে ওকে শুভেচ্ছা জানালাম। 
--
অবশেষে দিন ৭/৮ বাদে একটু সুস্থ হলে মেয়াদী নম্বর ঘরের সামনে বিজু আর খুকু আমাকে ধরে নিয়ে যাবার পর মাসিরা নিশ্চিন্ত হল। খাবার পাঠান বন্ধ করা গেল। মাসিদের মুখে শুনলাম আমাকে মারার পর মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত দিয়ে শিখারা পায়ে আলতা পরেছিল। আর সেইদিন যে ওয়ার্ডারের কাঁধে জেনানা ফাটকের শিকলে ঝোলানো চাবির ঝোপা ছিল, তাই দিয়ে তিনি দালাদের তাড়াবার আপ্রাণ চেস্টা করেছিলেন। তাছাড়া চারজন ডাক্তারবাবু সে সময় গেট দিয়ে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা আমাকে ঘিরে হাত ধরে দাঁড়িয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলেন। "নাহলে তোদের হয়ত সেদিন মেরেই ফেলত।" হাজতী নম্বর থেকেও অনেকে এসে দেখা করে গেল। এতোদিন পরে সবাইকে দেখে আর তাঁদের ভালোবাসা, শুভেচ্ছায় মন ভরে গেল। সাধারণ মানুষের এই ভালবাসা/শ্রদ্ধা  কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি ছিল না, ছিল আমাদের মতাদর্শের প্রতি।
--
 শান্তিবাই আর মীরা এসে হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে বলল, "দিদি মাপ করিস, আমরা দুজনকে  সেদিন ওদের পেছনে থাকতে বাধ্য  হয়েছিলাম, নাহলে মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখিয়েছিল।  তোদের মারতে দেখেও আমরা কিছু করতে পারিনি , মনে মনে কেঁদেছি।" " আরে না,না, তোদের যখন মেরেছিল, আমরা তো অসহায় ভাবে দেখেছি। কিছু করতে পারিনি। নিজেরা সবার সাথে মিলে মিশে থাকবি। কিন্তু ওদের দলে ভীড়ে সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার করিসনা।" " নারে, দিদি ওদের মত কখন হবোনা।"  
 --
এরপর কল্পনা, বিজু, খুকু, ডালিয়া, রাজশ্রী,মিনাক্ষী, আমার ও পূর্ববর্তী ওয়েলফেয়ার অফিসারের নামে ব্যাংকশাল কোর্টে মেট্রন কে মেরে ফেলার যড়যন্ত্রের অপরাধে জেল কর্তৃপক্ষ কেস করল। আমাদের মজাই হল, জেলের এই অন্ধকূপ থেকে বাইরে যাবার একটা সুযোগ মিলল। ব্যাংকশাল কোর্টে গিয়ে ডালিয়ার সাথে অনেক দিন বাদে দেখা হল। অনেক গল্প হল। বিকালে কোর্ট বন্ধ হলে আবার ছাড়াছাড়ি। আবার সেই কালো রাতের মত কাল উঁচু পাঁচিলের মধ্যে আবার হারিয়ে যাওয়া।
 --
কোর্টে যাবার সুযোগে ভ্যান থেকে হোলেও তার খুপরি জলনার ভিতর দিয়ে বাইরের পর পৃথিবী টাকে একটু দেখতে পেতাম। এরকম এক কোর্টের দিনে জেলে অফিসে আমাদের যখন তল্লাশির জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে, দেখলাম এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা আর দুই মেয়ে মিলে তাদের মাকে জেলে ভর্ত্তি করতে এসেছে, যাতে তাঁর গভীর ডিপ্রেশন থেকে সেরে ওঠে। আমরা সকলে মিলে তিন ভাগে ভাগ য়ে বাবা আর দুই মেয়েকে জেলের প্রকৃত অবস্থা কি, পাগলদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়, তার পরিণতি কি সব বুঝিয়ে বললাম। "১ /২  মাস মাকে নয় তাঁর কঙ্কাল টা দেখতে পাবে, আর কদিন বাদে তাঁকে আর খুঁজেই পাবে না। তাঁকে জীবিচাইলে শীগগিরই বাড়ী নিয়ে যাও।" মেয়েরা কাঁদতে শুরু করল আর বাবার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ২/১ সপ্তাহ বাদেই সব ব্যবস্থা করে মাকে তাঁরা বাড়ী নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের জালনা থেকে আমরা আনন্দের সাথে দেখলাম। যাবার সময় গরাদের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাদের অনেক ভালবাসা জানালেন। আমরাও তাঁদের এই কাজের অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম। 
--


************************************************************************************
(চলবে )




  


























  







 









    









13 Sept 2016

জাননা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 4

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৪
***********************

আমরা ফিমেল ওয়ার্ড বা জেনানা ফাটক কে বলতাম জেলের ভেতর জেল। তার ভিতর ছিল সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ড। দুনিয়া থেকে কেন প্রেসিডেন্সি জেলের ভেতরে যে ছোট্ট জেল তার থেকেও আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রচেষ্টা বহাল ছিল। সাধারণ বন্দিনীদের উপর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়ে চলল, বিশেষ করে আমাদের সাথে যারা কথা বলার চেষ্টা করত। এমন কি ছোট হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের ও কোন মাফ ছিল না, বেধড়ক অত্যাচার চলত।
--
আমরা সকলেই সাধারণ বন্দিনীদের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে নানা ভাবে যোগাযোগ রাখতাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর তার জন্য নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধার কথা বলতাম। আমাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য, নানা দেশের গরীব মানুষের লড়াইয়ের কথা বলতাম। কোন বন্দিনীর সাথে কোন কমরেডের হয়ত বেশী সখ্যতা গড়ে উঠত। সবাই সন্ধ্যে বেলায় লক আপ হলে সবার সাথে কথাগুলি বা কোন সমস্যা থাকলে তাই নিয়ে আলোচনা হত। তাই সকল বন্দিনীদের কথাই সবার গোচরে থাকত।
--
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরে বাংলাদেশ যুদ্ধে ধৃত কিছু মহিলাদের সাথে তাঁদের কিশোরী মেয়েদের আর বাচ্চা কাচ্চাদের রাখা হল। শুনলাম তাঁদের স্বামীদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে সম্ভবত আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়েছিল।যাইহোক জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একমাত্র শিখার মত গুটি কয়েক নৃশঃস বন্দিনী ছাড়া বাকী সবাই মোটামুটি একজোট ছিল। মেয়াদী নম্বরের মাসিদের সাথে আমাদের ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের কিশোরী মেয়েরা তো আমাদের সমর্থক হয়ে যায়। অনেক ব্যাপারে আমাদের গোপনে সাহায্য ও করত।
--
তার কিছুদিন পরে বেশ কিছু বার্মিজ মাসিদের একইরকম ভাবে কিশোরী মেয়ে আর ছোট ছোট বাচ্চাদের জেলে নিয়ে আসা হল।ধর্মের গোড়ামি মানুষ কে কতটা যে অমানুষ করে দেয় তাই নতুন করে দেখলাম। বর্মা মূলত বৌদ্ধধর্ম প্রধান দেশ। সেখানকার সংখ্যা-লঘু মুসলমান আদি অধিবাসীদের ওপর নানা অত্যাচার চলত। সেই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই সুদূর বর্মা থেকে এইটুকু আশ্রয়ের জন্য তাঁরা তাড়া খেতে খেতে ভাৰতে আসে। এসব দেখে তখন খুব অবাক হতাম। আজ আর হই না আজ এই গ্রহের মানুষ হয়েও কত কোটি মানুষের নিজের দেশ, আস্তানা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতি দিন। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে, ছোট্ট ফুলের মত শিশুদেরও ছাড় নেই। বাঁচার তাগিদে, একটুকু আশ্রয়ের জন্য এই পৃথিবীর মানুষ এক প্রান্ত থেকে অন্য্ ছুটে বেড়াচ্ছে। যেন পৃথিবীর কোন একটা কোণেও তাঁদের থাকার অধিকার নেই। ভারতে এসে বর্মী মাসীদের আশ্রয় হল জেলে। সীমান্ত থেকে বন্ধ ভ্যানে বদ্ধ দম আটকানো ঘুঁটে বোঝাইএর মত করে নিয়ে আসা হল প্রেসিডেন্সী জেলে।  
--
তাঁদের স্থান হল জাল ঘরে, যার  চার পাশটা  মোটা রড আর  জাল দিয়ে ঘেরা, মাথায় একটা চাল দেওয়া। গরমের  দুপুরে ঝলসানো গরম বাতাসে ছোট বাচ্চা গুলি পেটের অসুখে ভুগতে ভুগতে ডিহাইড্রেশন এ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলো। ওষুধ পথ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। শীত কালে হুহু করা হিম শীতল বাতাসে  ঠান্ডা লেগে নিমোনিয়া ইত্যাদি তে কত যে মারা গেল কেউ জানেনা। বার্মিজ মাসীরা বাকী ওয়ার্ড থেকেএকটু বিচ্ছিন্ন থাকতেন।
--
বাকী বন্দিনীদের সাথে আমাদের লুকিয়ে চুরিয়ে মোটামুটি একটা যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বার্মিজ মাসীরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন বলে আমাদের সাথেও সে রকম ঘনিষ্ঠ কোন যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারেনি। ইন্টারভিউ বা কোর্টে যাতায়াতের পথে তাঁদের দূর থেকে চোখের দেখাটুকুই একমাত্র যোগাযোগ ছিল , কথা আদানপ্রদানের সুযোগ হত না। অন্যান্য বন্দিনীদের মাধ্যমে কিছু কিছু খবরাখবর পেতাম মাত্র, তাঁদের বিপদে পাশে দাঁড়াবার ও সুযোগ হত না। এদিকে ওয়েলফেয়ার অফিসারকে ঠুঁটো জগন্নাথের মত করে রাখা হল। তাই চূড়ান্ত কষ্টে তাঁরা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন।
--
এখানে একটা কথা বলা দরকার। জেলের ডাক্তারবাবুরা একেবারে অমানবিক ছিলেননা। ডাক্তার দাস মূলতঃ মেয়েদের ওয়ার্ডের ডাক্তার ছিলেন। প্রতিদিন তিনি আসতেন। তাছাড়া ডাক্তার গুপ্ত, ডাক্তার চ্যাটার্জী আর সি.এম. ও (চীফ মেডিক্যাল অফিসার ) সপ্তাহে ২/৩ বার আসতেন ।  চাকরির স্বার্থে অনেক সময় তাঁরা আপোষের মনোভাব নিয়ে চলতেন একথা ঠিক। কিন্তু মেট্রন আর দালাদের এড়িয়ে  তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তাঁরা সাধ্য মত করার চেষ্টা করতেন।
--
আমারদের ওয়ার্ডে তাঁরা ভিসিটে এলে আমার তাঁদের ওয়ার্ডের বিভিন্ন বন্দিনীদের অবস্থার কথা তুলে ধরতাম। কখন কখন হাসপাতালের জালানা দিয়ে তাঁদের কাছে অভিযোগ গুলি জানতাম। মেট্রন কিছু বিরোধীতা করতে সাহস করত না। সেই সুযোগের সাধারণ বন্দিনীদের জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব হত। যদিও সব টুকু সুবিধা তাঁদের হাতে ঠিক মত পৌঁছাতে না। খবর পেলে আমরা আবার ডাক্তার বাবুদের কাছে নালিশ জানতাম। তখন আবার কিছুদিন ঠিকমত চলত। এইভাবে সাধারণ মরণাপন্ন কিছু বন্দিনীদের, বিশেষ করে বার্মিজ মাসিদের সামান্য কিছু সহায়তা হত।
--
রোজকার বন্দিনীদের খাবার চুরি করা ছাড়াও, কচিৎ কারোর বাড়ী থেকে ইন্টারভিউ তে বাড়ীর লোক যা নিয়ে আসতো সব কিছু হাসপাতালে বসে মেট্রন, ওয়ার্ডারদের সামনে আত্মোৎস্যাত আর ভাগাভাগি হয়ে যেত। খিদের জ্বালায় বন্দীরা একদিন প্রতিবাদ করতে শুরু করল। আমাদের কিছু সাথীরা কোর্ট থেকে তখন ফিরছিল, তারাও ওদের সাথে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। মেট্রন বেগতিক দেখে যারা খাবার বাটে তাদের ছদ্ম শাসন করল। ফলে সেদিনে খাবারের পরিমান কিছুটা বেশী হল।
--
আর একদিন  আমরা কজন বাড়ীর লোকেদের সাথে ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে দেখি একজনকে  মারার প্রতিবাদে  বাংলাদেশের মীরা, শান্তিবাই,  বাসন্তী মাসি, সমেদা এরকম প্রায় ২০ জন প্রচন্ড চেঁচামিচি আর কান্না কাটি করছে। শুনলাম রেখা আর বেলাকে শিখার বাহিনী বিনা কারণে মেরেছে। আমরাও তাদের  লড়াইয়ে সাথে সামিল হলাম। মেট্রন যথারীতি সেই দালালদের দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করাল। কিন্তু এইভাবে ক্রমাগত প্রতিবাদের দানা বেঁধে ওঠাটা কে মেট্রনরা আর তাদের দালাল রা স্বাভাবিক ভাবেই ভাল চোখে দেখল  না। আমরা শান্তিবাইদের  বোঝাতে লাগলাম সব সময় দল বেঁধে থাকতে আর চলাফেরা করতে। কারণ আমাদের কাঠের দরজা তো বেশীর ভাগ বন্ধ করে রাখা হয়।  
--
দালাল শিখা ছিল এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌ, দুটি সন্তানের মা। রোজ বরের অফিসে টিফিন নিয়ে যাবার ছুতায় মালিকের ছেলের সাথে প্রেম করে সব ফেলে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাড়ী ভাড়া নিত, পড়শীদের সাথে ভাব জমাত। তারপর তাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানা দামী জিনিসপত্র, টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি নিয়ে চম্পট দিত। এ হেন মানুষের চরিত্র শঠতা, নিষ্ঠুরতা আর লোভে ভরা থাকাটাই স্বাভাবিক।
--
ফিমেল ওযার্ডে পাগলরাও  ওর অত্যাচারের হাত থেকে বাদ যেত না। শুধু জেল কতৃপক্ষকে তুষ্ট করতেই নয়, অত্যাচার করাতে ও আনন্দ পেতো। কত অভাগা মেয়ের গোপনাঙ্গে হিংস্র ওয়ার্ডারদের সাথে মিলে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। অবশ্য এধরনের অসংখ্য শিখাদের জেল কর্তৃপক্ষ খুঁজে নিত নিজেদের অত্যাচার কায়েম রাখতে। রাতের অন্ধকারে কত মানুষ কে পিটিয়ে বা, পুড়িয়ে মেরেছে তার হিসাব নেই। দিনের আলোতে মানুষগুলি কে খুঁজে পাওয়া যেতনা।
--
মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল কলকাতায় রুজি রোজগারের জন্য। ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা দালাল কাউকে ভয় করত না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রন কে ডিঙিয়ে জানতে চায় কবে তার কোর্টের দিন পড়বে।পরে সেই অপরাধে  মেট্রনের অঙ্গুলি লেহনে শিখারা চুড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় পাগল বাড়ীতে শেকল বেঁধে রেখে দেয়। তাকে আমরা আর দেখতে পাইনি।
--
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগড়ি বাই এর স্বামীর নতুন করে বিয়ে হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়। শিখা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত। একদিন কোনমতে সেল থেকে বেড়িয়ে রোদ পোহাতে গেছিল শেষ তাকে মেরে লোপাট করে দিল। কাজ ফুরালে ছেঁড়া চটির মত তাকে ফেলে দিতে তাদের বাঁধত না।
--
ওপরে সেলের একটা ঘরে ওয়েলফেয়ার অফিসার বসতেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ ভাল ছিলেন। যতটা পারতেন বন্দীদের ভাল করার চেষ্টা করতেন, আমাদের প্রতি একটা স্নেহ ছিল। কোন বিশেষ সুবিধা নিতেন না। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। ফলে মেট্রন আর তার দল বল ওনাকে সহ্য করতে পারত না, নানা ভাবে তাঁর কাজে বাঁধা দিত। তিনি ওদের কোন পরোয়া না করে, একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তাঁর কাজে সাহায্য করার জন্য যে বন্দিনীদের দেওয়া হয়েছিল তাদের ওপর মেট্রন বাহিনীর রাগ ছিল।
--
একদিন দালালরা শান্তিবাই আর বাংলা দেশের মীরাকে অমানুষিক ভাবে মারল, যেহেতু এরা আমাদের ভালবাসত, আর ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে কাজ করত। প্যাসেজের থেকে হাসপাতালের ভিতর কিছুটা দেখা যেত, আমরা অসহায় ভাবে ওদের ক্রন্দনরত বীভৎস ভাবে ফুলে ওঠা বিকৃত মুখগুলি আর ক্ষত বিক্ষত হাত পা গুলি দেখে নিষ্ফল রাগে ফুঁসতে লাগলাম। 
--
ইতিমধ্যে সম্ভবত ১৯৭৩ সালের শেষ ভাগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভেঙে পালানোর একটা প্রচেষ্টা হয়।  অনেক ছেলেদের সাথে রাজশ্রী আর মীনাক্ষী ধরা পড়ে। তার পরই খুকুও ধরা পড়ে। রাজশ্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটি কমরেড সঞ্জয় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। রাজশ্রীকে সেন্ট্রাল  জেল গেটেই  প্রচন্ড মারধর করা হয়। লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যায়, পায়ে গুলির স্প্লিন্টার লাগে। মীনাক্ষ আর খুকু কে লালবাজারে অত্যাচারের স্বীকার হয়। বেশ কিছুদিন জেরার পর ওদের  জেলে পাঠান হয়। খুকুকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয় আর মীনাক্ষী, রাজশ্রী কে সেলে কল্পনার সাথে রাখা হয়। সাথীদের সেবা শুশ্রুষায়  ওরা ভাল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ৩/৪ দিনের জন্য জয়াকে পুরুলিয়া থেকে আনা হয়, সেখান থেকে ওকে মুক্তি দেওয়া হয়।
--
তখন ফিমেল ওয়ার্ডে মেট্রন, খারাপ ওয়ার্ডার আর শিখা তার দালাল বাহিনীর অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, একটা প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল খুব।  আমরা ঠিক করলাম এর একটা শিক্ষা না দিতে পারলে ওরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকবে। কিছু ন্যাকড়া আমাদের উকুন মারা কেরোসিন কাম মাথার তেলে ভিজিয়ে হাতপাখার হাতল গুলি ভেঙে মশালের মত বানালাম, আগুন দেখলে ভয় তো পাবে। আর আমাদের খাবার জন্য জেল থেকে যে এলুমুনিয়ামের থালা দিয়েছে তাই হল অস্ত্র। ঠিক হল চায়ের জন্য যখন সেলের আর ভাটিঘরের দরজা খুলবে আমরা সবাই ঠেলে দুপাশ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে যাবো। সবাই চুল গুলি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে খোঁপা করে নিলাম।
---
পরিকল্পনা মতো তাই হল ওয়ার্ডার  চীৎকার করে উঠোল,"আরে কোথায় যাচ্ছ সবাই মিলে।" ভাটির আগুন থেকে মশাল জ্বালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হল না। আনাড়ী হাতের মশাল কি জ্বলে। তাই মশালের আশা ত্যাগ করে থালা হাতেই দৌড়ালাম। হাসপাতালের গেটে মেট্রন, "কি হল কি হল" করে বেরিয়ে আসতেই ডালিয়া একথালার বাড়ী বসিয়ে দিল। মেট্রনের কপালের কাছে কেটে যেতেই ভয়ের চোটে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে গেল। সবচেয়ে দজ্জাল হেড জমাদারনী একটা মোঠা বাঁশের লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতেই ডালিয়া হাত থেকে লাঠি টা কেড়ে নিলো। ওদিকে শিখা বীর দর্পে এগিয়ে এলো আর একটা পাকান বাঁশের লাঠি নিয়ে। খুকু খপ করে সেটা ছিনিয়ে নিল।
--
তখন দেখার মতো অবস্থা। ওয়ার্ডার আর বাকী দালাল অর্ধেক হাওয়া ,আর অর্ধেক হা করে দেখছে শিখা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। খুকু আর ডালিয়া দুপাশ থেকে ছন্দ বজায় রেখে কাপড় কাঁচার মত পেটাচ্ছে। আমি আর বিজু চশমা খুলে গেছিলাম। আমার হাই পাওয়া বলে কিছু ভাল বুঝতে পারছিনা। কে আমাদের মেয়ে, কে সাধারণ বন্দিনী আর কে দালাল কিছুই বুঝতে পারছিনা। সেই সুযোগে শিখার মত নৃশংস একটা দালাল আমার পিছন থেকে বিশাল ধাক্কা মারল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। তখন মিনু এসে থালা দিয়ে তাকে একবাড়ি মেরে আমাকে ধরে তুলল।
--
এদিকে পাগলী বেজে গেছে, অর্থাৎ জেলের গন্ডগোলের সতর্ক বার্তা পৌঁছে গেছে।  ওয়ার্ডারের বাঁশির আওয়াজ,   ফোর্সের বুটের শব্ধ শোনা যাচ্ছে। আমরা সবাই পরিকল্পনা মাফিক সেলের দিকে দৌড়ে উঠে গেলাম। সেলের বারান্দার জাফরী দিয়ে আমরা ওদের কান্ড কলাপ দেখতে থাকি। জেলারের নেতৃত্বে বিশাল ফোর্স আস্তে আস্তে যেই সেলের দিকে এগোতে যায় ,আমরা চেঁচাতে, "থাকি মার মার বোম মার। গুলি চালা। " অমনি ফোর্স পিছিয়ে যায়। আবার এগোতে গেলে আবার আমরা সবাই মিলে চেঁচাই। ওরা আবার পিছিয়ে যায়। শুধু থালা হাতে আমরা এইভাবে লড়াই করতে গেছি, সেটা মেট্রন রা ভাবতে পারেনি। আসলে ওরা আমাদের ভাল করে দেখতে পারছে না, আর আন্দাজ ও করতে পারছে না আমাদের কাছে সত্যি কি অস্ত্র আছে।
--
এইভাবে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর নিজেরা পরার্মশ করতে থাকে। শেষে একজন গোবেচারি ডেপুটি জেলার সাদা রুমাল নাড়িয়ে ওপরে এসে বলে ,"তোমাদের যে কোন একজন চল। জেলার বাবু জানতে চায়, কি সমস্যা তোমাদের। জেলারবাবু ব্যবস্থা করবেন।" " আমরা একজন ও যাব না। জেলার বাবুকে গিয়ে বলুন, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। ফিমেল ওয়ার্ডে দিনের পর দিন সাধারণ বন্দিনী দের ওপর যে অত্যাচার চলছে, সেটা বন্ধ করতে বলুন। ঠিকমত চিকিৎসা আর ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করতে বলুন। রোজকার মাপমত খাবার সবাইকে দিতে বলুন। এতগুলি ই সমস্যা। এগুলির সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। "
--
ডেপুটি জেলার ফিরে গেল। হাসপাতালে আলাপ আলোচনা করে ফোর্স নিয়ে জেলার ফিরে গেল। তখন জল টল  খেয়ে, যাদের লেগেছে তাদের দেখভাল করা হল। কল্পনা আর বিজুর হাতে বেশ লেগেছিল, জলপট্টি করা হল। বিকালে সেই ডেপুটি জেলার হেডজমাদারকে সঙ্গে এনে গার্ড দিয়ে আমরা যারা ডিভিশন ওয়ার্ডে থাকি সেখানে পৌঁছে দিয়ে লক আপ করে দিল। সেলেও লক আপ করে ফিরে গেল।
***********************************************************************************
(চলবে)

11 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 3

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব  ৩
************************

কল্পনা ধরা পড়েছিল যদুগোড়া জঙ্গল থেকে, শ্রদ্ধেয় অনন্ত সিংহের গ্রূপের বেশ কিছু জনের একটা দলের সাথে। ও আমাদের সকলের মধ্যে  সবচেয়ে বেশী দিন জেলে কাটিয়েছিল । অসম্ভব সাহসী আর দৃঢ় চেতা ছিল। মুক্তি শান্ত শিষ্ট  অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ স্বভাবের মেয়ে, ধরা পড়ে  '৭১সালে। ডালিয়া ছিল ডাকাবুকো। আর বিজু ছিল প্রাণ শক্তিতে ভরপূর উচ্ছল একটা বাচ্চা মেয়ে, কিন্তু দারুন মনের জোর, দেখলে বিস্মিত হয়ে যেতে হয়।ও ধরা পড়ে  '৭২সালের প্রায় শেষের দিকে।জয়া ধরা পড়ে সম্ভবত পুরুলিয়া থেকে। শীলাদি দের পাঁচজনের মধ্যেও সাহসের অভাব ছিল না, তারাও '৭২/ ৭৩ সালে ধরা পড়ে।
--
কল্পনা/ ডালিয়াদের মুখে গল্প শুনেছি, '৭০/৭১ সালের প্রথম দিকে কল্পনা কে প্রথমে একতলায় ঠান্ডা স্যাৎসেতে একটা সেলে রেখেছিল। তখন অনেক মেয়ে ছিল। তাদের রাখা হয়েছিল মেয়াদী নম্বরে। সবাই মিলে ঠিক করে ওকে যখন স্নান করাতে বার করবে তখন জমাদারনিদের হাত থেকে কেড়ে ওয়ার্ডে নিয়ে আসবে। সাধারণ কিছু বন্দিনী তাতে সামিল হয়। যথারীতি পরিকল্পনা মাফিক কাজ হয়। মেয়ে জমাদারনীরা সাহস পায়না। ফলে জেলারের নেতৃত্বে জমাদারদের বিশাল ফোর্স আসে। অসম শক্তির মধ্যে লড়াই শুরু হয়। সবাই কে অবাক করে শিখা বলে সবচেয়ে সক্রিয় বন্দিনী প্রথমেই দল বদলে জমাদারদের হাত থেকে লাঠি নিয়ে মেয়েদের মারতে শুরু করল।
--
অতি সহজেই জেল কতৃপক্ষের সুনজরে এসে সে দালালদের রানী হয়ে বসল। পরবর্তী কালে গোবেচারী জমাদারনীরাও তাকে তোয়াজ করে চলত। যাইহোক আমাদের মেয়েরা লড়াই করল, সকলেই প্রচন্ড আহত হল। কল্পনা, জয়া, ডালিয়া আর সীমাকে সেলে বন্দী করে দিল। বাকীদের মেয়াদী নম্বরে। আমি '৭৩এর প্রথমে ধরা পরি। তখন সেই গ্রূপটার কল্পনা, সীমা, ডালিয়া, জয়া ছাড়া সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে। বাকী সকল কে শীলাদিদের সাথে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সীমাকেও সেল থেকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছিল।
 --
সাধারণ বন্দিনী দের মেয়াদী নম্বরে দেওয়া  হল। আমাদের ওয়ার্ডের বাইরে একটা প্যাসেজ ছিল। সেখান থেকে মেয়াদী নম্বরের জানালা দিয়ে সাধারণ বন্দিনীদের সাথে কথা বলা যেত। তার পাশেই ছিল হাসপাতাল। সেখানে মেট্রন আর  ডাক্তারবাবু দের বসার কথা, তাছাড়া রুগীদের থাকার কথা। কিন্তু সেখানে শিখা তার পেয়ারের দালালদের নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল। আমাদের প্যাসেজ থেকে ওদের কারসাজি আমরা লক্ষ রাখতাম। একজন পাহারায় থাকতাম অন্যরা সাধারণ বন্দিনী দের সাথে গল্প করতাম।
--
মহিলা ওয়ার্ডের ভেতর দিকটা এক কোনে সেল এর সামনে একটা ছোট্ট ভাটিঘরে  বড় দুটো চুলা ছিল। সেখানে গরম জল, বন্দিনীদের সপ্তাহে একদিন কাপড় সেদ্ধ ছাড়াও, মেট্রন আর দালাল দের জন্য রুগীদের ডায়েটের থেকে চুরি করা খাবার দিয়ে মুখরোচক খাবার বানানো হতো। ভাটি ঘরের দুপাশে দুটি আগেকার দিনের ভারী দরজা। আমাদের দিকের দরজা টা সাধারণত বন্ধ থাকত।সেলের দরজাও প্রয়োজন ছাড়া খোলা হত না। 
--
কত মানুষের সাথে পরিচয় হত। পয়সার অভাবে যারা তদবির করতে পারতোনা,বছরের পর বছর তারা জেলে পচে মরতো। মীরা ছিল এক সিধা সরল ধর্ষিতা মা। তার ধর্ষক বাইরের দুনিয়ায় বহাল তবিয়তে ঘুরছে। আর সে একটা হাড় জিরজিরে বাচ্ছা নিয়ে অন্ধকূপে পড়ে আছে। আর এক মীরা বাংলা দেশের মেয়ে, দাঙ্গার সময় পালিয়ে এসে পথ হারিয়ে জেলে আসে। হাসিনা সুন্দরবন থেকে কাজের জন্য কলকাতায় এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলে।শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিলেই সে বাড়ী চলে যেতে পারত। জাহানারা ৯/১০ বছরের বাচ্চা মেয়ে ও ধর্ষিতা। ধর্ষক পয়সার জোরে খোলা আকাশের তলে।শুধু অসহায় মেয়ে গুলি ভিক্টিম হিসাবে সরকারী সেফ কাস্টডির অন্ধকূপে বন্দী। কেউ বন্দী চুরি না করেও চুরির অপরাধে। সবচেয়ে হাস্যকর, চুরি না করে কেউ যদি করেছে বলে স্বীকার করে নেয়,তবে ৫/৭ দিনের সাজা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর কেউ যদি আত্মমর্যাদাবোধে  মিথ্যা অপবাদ অস্বীকার করে ,তাকে জেলে পচে মরতে হয়। ভালবাসার অপরাধেও জেলে থাকতে হয়। জেলে না এলে জীবনে এত অভিজ্ঞতা হতোই না।
--
 এর মধ্যে মুক্তি মিসা থেকে মুক্তি পেয়ে চোখের জলে বিদায় নিল। মিনু আমাদের ওয়ার্ডে এল। একদিন বৃস্টির দিন খুব চা খাবার ইচ্ছা হল। আমরা পুরান কাপড়ে আমাদের সেই বিখ্যাত উকুন তাড়ান তেল ঢেলে যে সামান্য চা পাতা ছিল তাই জলে দিয়ে অনেক ফুটিয়ে চা তৈরী করলাম, অমনি কোন কোনা থেকে একটা নেংটি ইঁদুর লাফ মেরে ফুটন্ত চায়ে পড়ে  নিজের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটালো আর আমাদের চায়ের দফারফা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এক দশাসই জমাদারনি লক আপের কাছে এসে জিজ্ঞাসা শুরু করল "কে আগুন জ্বালিয়েছে ?" কেউ পাত্তা না দেওয়াতে, চাবি আনতে গেল, ঘরে ঢুকে দেখার জন্য। এই অবসরে বিজু গরম চায়ের বাটি ধরে গরাদের ফাঁক দিয়ে নর্দমায় ফেলে দিল, আমি পোড়া ন্যাকড়া গুলি আধা পাঁচিল দেওয়া যে বাথরুম ছিল তার লোহার প্যানে ফেলে জল ঢেলে চাপা দিয়ে দিলাম। জমাদারনী দরজা খুলে কিছুই দেখতে পেলনা। সন্দিগ্দ্ধ দৃষ্টিতে বাথরুমের প্যানের দিকে তাকিয়ে বক বক করতে করতে ফিরে গেল। এদিকে আমাদের দুজনের হাতের অবস্থা খারাপ।অনেকক্ষন জলে হাত ডুবিয়ে বসে থাকলাম।
--
এরমধ্যে আমাকে কোর্ট থেকে আবার ১৪দিনের জন্য লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হল আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আর  জেলের গোপন খবরের জন্য।" আপনাদের লৌহবেষ্টনীর মধ্যে আটকে রেখে আমাকে গোপন খবরের জন্য জেরা করছেন! আপনাদের ফোর্স ছাড়াও তো দালাল বাহিনী রয়েছে খবর দেবার জন্য।" ব্যাস এক প্রস্থ মার। সেন্ট্রাল লক আপে গিয়ে দেখি বরানগরের বহুদিনের ওয়ান্টেড একটি মেয়ের পেছনে এমন মেরেছে ,এক/দু  মাস পুলিশ হাসপাতালে রেখেও ঘা পুরো সারেনি। অথচ মেয়েটি বহুদিন আগেই পার্টি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে রীতিমত ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমাকে মিসা দিয়ে জেলে ফেরত পাঠাল। ওই মেয়েটিকে পরে কদিনের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল। তারপর ছেড়ে দেয়। 
--
রাজনৈতিক বন্দীদের জেল কতৃপক্ষ বা দালাল রা সচরাচর ঘাটাতো না, প্রাপ্য জিনিসপত্র কিছুটা হলেও দিত। কিন্তু সাধারণ বন্দিনীদের দুর্দ্দশার সীমা ছিল না, এদিক ওদিক হলেই মারধর। শুধু খাবার কেন, খাবার জল টাও ঠিকমত জুটতনা। অসুখ বিসুখে ওষুধ পত্র ও মিলত না। আমরা চেষ্টা করতাম যাতে ওরা একজোট হয়ে নিজেদের দাবী গুলি আদায় করতে পারে। একজোট হয়ে দালালদের মারধোর ঠেকাতে পারে। দালাল রা সব সময় চোখে চোখে রাখত যাতে আমাদের সাথে ওরা কথা বলতে না পারে।কিন্তু তাই বলে জেলে লড়াই কখন থেমে থাকেনি। অন্যান্য বন্দিনীদের লড়াইয়ের পাশে আমরা সব সময় থাকতে চেষ্টা করেছি ,তাঁরাও আমাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। কখন লড়াই শুরু করেছে মীরা,শান্তিবাই,বেলা,রেখারা , কখন মিতা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, শোভা, শান্তি মাসীর। কখন বার্মিজ মাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে, কখন মেয়াদী নম্বরের পাকিস্তানের পাসপোর্ট কেসের মাসীরা, আবার কখন মাস্তান একাই জেলকতৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবারে জীবন বাজী রেখে লড়ে গেছে।       
--
একদিন কথা বলতে বলতে একটু বেখেয়ালী হয়ে পড়াতে কয়েকটা দালাল আমার চুল আর কাপড় টা টেনে ধরে। আমি নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে চীৎকার করে বিজু কে ডাকতে থাকি।  বিজু দৌড়ে আসে, দুজনে মিলে টানাটানি করে নিজেকে ছাড়াই। এদিকে মেট্রনের নির্দ্দেশে হেডজমাদারনি আমাদের দরজা টা খুলে শিখা আর তার দালাল বাহিনী কে ঢুকিয়ে দেয়। প্রথমেই আমাদের চশমা দুটো ভেঙে দেয়। আমার চোখের পাওয়ার মাইনাস ১৪। চশমা খুললে আমি কিছুই দেখতে পেতাম না। আমাকে কজন চেপে ধরল।
--
তারা মূল টার্গেট করল বিজুকে। সবাই মিলে ওর চুল ধরে ঘুষি,থাপ্পড় মারতে লাগল। ইতিমধ্যে শীলাদিরা সবাই বার হয়ে ওদের ওপর চড়াও হল। এমনকি দরজা খোলা পেয়ে মীরা, শান্তিবাই রা প্রায় জনা ১৫ সাধারণ বন্দিনীরা ঢুকে দালাল বাহিনী কে আক্রমণ করল। ওরা এতটা ভাবতে পারেনি। কাজেই তাড়া তাড়ি পগারপার। জমাদারনী দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। প্রায় দিন ১০/১৫ সাধারণ বন্দিনীরা আমাদের সাথে থাকল। তারপর ওদের হাজতি নম্বরে ফিরিয়ে দিল।
--
এর কদিন বাদে ডালিয়াকে ১০ বছরের সাজা দিয়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে নামিয়ে দিল আর জয়া কে পুরুলিয়া পাঠিয়ে দিল। শীলাদিরা  সবাই এক এক করে ছাড়া পেয়ে গেল। বিজু, মিনু ,ডালিয়া আর আমি রইলাম ডিভিশন ওয়ার্ডে। কল্পনা একা সেলে। এর কদিন পরে বিজুর মিসা উঠে গেল , ওকে অনেকের সাথে এন্টালি কনস্পিরেসি কেসে ঢুকিয়ে দিল, আর লালবাজারে নিয়ে গিয়ে একপ্রস্থ অত্যাচার ও হল।  আমাদের মাঝে  ফিরে এলো সেই অত্যাচারের চিন্হ নিয়ে।
*********************************************************************************
(চলবে)
 
















9 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 1 & 2

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ১
***********************
প্রায় একমাস লালবাজারের লক আপে ভিন্ন ভিন্ন নামে রেখে অবশেষে আমাদের ১৫/২০ জনের দলটাকে রাইফেল ধারী গার্ড দিয়ে শেয়ালদা কোর্টে নিয়ে যাওয়া হল। প্রতি দিনের শারীরিক ও মানষিক অত্যাচারে সকলেই অল্প বিস্তর বিদ্ধস্ত। দলের মধ্যে আমি ছিলাম একমাত্র মেযে। সকলেই আমার দিকে স্নেহপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এরপরে আমার সাথে দেখা হবার সুযোগ হয়ত হবেনা। সময় ১৯৭৩ সাল, বেলা ১০ টা।
--
কোর্টে আমাকে মহিলা লক আপে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, বাকিদের ছেলেদের লক আপে। বহুদিনের সুখদুঃখের সাথীদের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ছোট্ট নোংরা ঘরটায় একটা মাত্র জালের বিশাল একটা তালাবন্ধ দরজা। প্রায় আত্মবিস্মৃত অবস্থায় একটা কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হটাত কে যেন ডাকল,"এই রীতা, এদিকে আয়, এইযে এই দিকে।" সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখি অন্য কোণে মিনু বসে আছে। ওর কাছে গিয়ে বসলাম। ভাল করে খেয়াল করে দেখি ওর পাদুটো গোদের মত ফোলা।
 --
লালবাজারে পাকানো বাঁশের লাঠির বারি মেড়ে হাত পা ফুলিয়ে দিয়ে একরকম তেল লাগিয়ে দিত যাতে ওপর থেকে ফোলা কমে যেত, ভেতেরে জখম খুব কিছু কমতো না। সেটা নাকি বন্দুক পরিস্কারের তেল। বুঝলাম মিনুর ভাগ্যে তাও জোটেনি। ও কিন্তু একান্ত ভাবেই ঘরোয়া মেয়ে ছিল। কোন কালে কোন রাজনীতির সাথে কোনভাবেই যুক্ত ছিল না, ওর ভাই বোনরা হয়ত ছিল। তাদের না পেয়ে ওকে আর ওর বাবাকে ধরে এনেছে।
--
দেখলাম ওকে উল্টো করে ঝুলিয়ে শুধু বেধরক মারই মারেনি বুক পিঠে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে। দিন সাতেক মানিক তলা থানায় রেখেছিল। মাস কয়েক আগেও একবার ওর বাড়ীতে ভাইবোন দের তল্লাশ করে না পেয়ে ওকে ধরেছিল। সেবার শুধু জিজ্ঞাসা বাদের উপর দিয়ে গেছিল। এবার তাই বোদহয় তিন গুন শোধ নিয়েছে। ওকে দেখে একদিকে যেমন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, অন্যদিকে নিজে নূতন করে শক্তি সঞ্চয় করছিলাম।
--
একটুপরেই একদল বন্দীকে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তারমধ্যে একজন চশমা পরা মহিলা ছিলেন। সে আমাদের মতই রাজনৈতিক বন্দী, মাস কয়েক আগে থেকেই জেলে বন্দী আছে। মিনু আগে একবার ধরা পড়ার সূত্রে তাকে চিনত। নাম শীলা, কোন এক কলেজের অধ্যাপিকা। আলাপ পরিচয় হলো। শীলাদির বাবা বাড়ী থেকে খাবার এনেছিলেন। তার থেকে আমাদের কিছুটা দিল, মিনু আর আমি বুভুক্ষুর মত গিললাম, যেন কতকাল পরে আপনজনের মাঝে এসে পুলিশ থানায় হারানো ক্ষিদে তৃষ্ণা আমাদের ফিরে এসেছে।
--
বিকাল পাঁচটার পর কোর্ট বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের কাউকেই বিচারকের সামনে তোলা হলনা। পরে শুনেছিলাম আমাদের নামে রায়ট, খুনজখম ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ধারায় কেস রুজু করা হয়েছে।  আমাদের পুলিশ ভ্যান এ তোলা হলো। মিনু হাঁটতে পারছিলো না।  আমি সাহায্য করতে গেলে শীলা দি বললো," তুই পারবি না, আমি দেখছি," বলে তাকে কোলে তুলে ভ্যান পর্যন্ত নিয়ে গেল, সাধারণ বন্দিনীদের সাহায্যে উপরে তুললো। আমাদের সবাইকেই গার্ড দিয়ে ভ্যানে তোলা হলো।
--
ভ্যান চলতে শুরু করল। খুপরির ভিতর থেকে বাইরে টা দেখছিলাম। রাস্তায় আলো জ্বলছে। লোকজন ব্যস্ত সমস্ত হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। মনে হচ্ছিল ওদের সবাই স্বাধীন, খোলা আকাশের নীচে মুক্ত হওয়াতে নিশ্বাস নিচ্ছে। কি মজা, নিজেদের খুশী মত যেখনে ইচ্ছা সেখানে যাবে। আর আমদের জন্য নির্দ্ধারিত এক বন্দী জীবন।
--
চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। সেদিনটা পূর্ণিমা কিনা জানা নেই, কিন্তু চাঁদ টাকে অনেক বড় আর উজ্জল দেখাচ্ছিল। তখন ই এক সাথীর গলায় শোনা গানের একটা কলি কানের কাছে বাজতে থাকল,"যে স্বপনে কমরেডস নয়ন ভরেছো, সে স্বপন মুক্তি স্বপন।" মনে মনে সেটাই আওড়াতে লাগলাম। ভ্যান আলিপুর প্রেসিডেন্সী জেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
--
নাম ধরে ধরে সবাই কে গুনে গুনে জেল গেট দিয়ে ঢোকান হলো। মিনু কে আগের মত করে সকলে সাহায্যে নামিয়ে শীলা দি কোলে করে নিয়ে এলো। জেল অফিসে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো। খাতা কলমে সবাই য়ের নাম, ধাম, কেস ইত্যাদি লেখা জোখা হলো। তারপর প্রত্যেক কে তন্ন তন্ন করে সার্চ করে, দুজন মহিলা ওয়াডার আর বড় বাঁশের পাকান লাঠিধারী একজন জমাদার, মানে ছেলে ওয়াডার গরুর পালের মত সব বন্দী কে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। মিনু কে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো।
--
বিশাল পাঁচিল তোলা জেলের মধ্যে চলতে চলতে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট পাঁচিল ঘেরা জায়গায় পোঁছে জমাদার সকলের পিলে চমকে বাঁজখাই গলায় হাঁক দিল,"জেনানা ফাটক আ গয়া।" বলেই দেয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা দড়ি ধরে টান মারলো আর ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠলো। ভিতর থেকে গেট খুলে এক জবরদস্ত জমাদারনি বেরিয়ে, গুনতি মিলিয়ে সবাইকে ওয়ার্ডের ভিতর ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে বিশাল তালা লাগিয়ে দিল।
--
মিনু কে হাসপাতালে রাখা হলো। বাকীদের আবার তল্লাশী করা হলো। শীলাদি কে অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে গেল। আমাকে আর সাধারণ বন্দীদের সাথে হাজতী নম্বরে ওয়ার্ডে দেওয়া হলো। দেখলাম বড়জোর জনা পঞ্চাশেক মানুষ  থাকার একটা ঘরে কম করে শ দেড়েক বন্দিনীকে কেস নির্বিশেষে পুরে দেওয়া হয়েছে। একধারে আধা পাঁচিল তোলা, চট ঘেরা জায়গা প্রাকৃতিক কাজের জন্য নির্ধারিত। তার কটু গন্ধে গা গুলিয়ে বমি আসে।
 --
সেই রাতে জেনানা ফটকের সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা হয়ে গেল নিভা নাম এক ন.সি.এল ( নন ক্রিমিনাল লুনাটিক ) বন্দিনী আর একজন রাজনৌতিক বন্দিনীর সাহচর্যে। নিভা বলল," জানতো এখানে মোট পাঁচ টা ওয়ার্ড। হাসপাতাল, মেয়াদী নম্বর, হাজতী নম্বর, পাগল বাড়ী, ডিভিশন বাড়ী। তাছাড়া গোটা ছয়েক সেল।আর সারা দিনের খাবারের ফিরিস্তি টাও শুনে রাখো। সকাল একপিস পাউরুটি, বা একমুঠ চিড়ে, বা মুড়ি, বা ছোলা সেদ্ধ দেওয়া হয়, দুপুরে এক ডাব্বু ভাত, হলুদ জলের মত ডাল, বুড়িয়ে যাওয়া বা শুটকো তরকারির ঝোল।  রাতে তিনটি রুটির সাথে দুপুরের মত ই  ডাল, তরকারি। খাবারের পরিমান এতই কম জোয়ান মানুষ কেন বাচ্চাদেরও খিদে মেটে না।" রাত জেগে জেল আর জেলের বিভাগের জ্ঞান সঞ্চয়ের চেষ্টা করলাম।
--
ঘরের অধ্বেক জায়গা জুড়ে এক শ্রেনীর বিশেষ সুবিধা ভোগী বন্দিনী, যারা কতৃপক্ষের দালাল, তাদের দখলে। বাকীরা কোনমতে ঘাড় গুঁজে এক কাতে বসে ঘুমাতে চেষ্টা করছে। হাজতী নম্বরের পারিপার্শিক অবস্থা জেল ব্যবস্থার নগ্ন চেহারা টা চোখের সামনে মেলে ধরল। বুঝিয়ে দিল জেনানা ফটকে রীতি মত শোষন অত্যাচারের বিরুধ্বে লড়াই করেই সাধারণ মানুষরা কোনমতে টিকে আছে ।
*********************
(চলবে)

28 Feb 2022


জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ২

***********************
বোধহয় ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো। হটাৎ বিকট এক বাজখাই গলায় চীৎকার," ফাইল, ফাইল।গুনতি, গুনতি।  ওঠ, ওঠ এই শালীরা।" তাকিয়ে দেখি মোঠা সোঠা লাঠি ধারী হেড জমাদারনি তার সাঙ্গপাঙ্গ,মানে  কিছু দালাল বন্দিনীদের সঙ্গে নিয়ে লক আপ খুলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের বন্দিনীরা সবাই তাড়াহুড়া করে লাইন করে মাটিতে উবু হয়ে বসে গেল, নিভা আমার হাত ধরে টেনে একটা জাগায় বসে পড়ল। দালালরা কজন বন্দিনী আছে ,তাদের হিসাব নিল। নতুদের আলাদা করে নাম লিখে বলল," এই তোরা সকালের খাবার পাবিনা। ৯টার সময় কেস টেবিল হবে, তারপর দুপুর থেকে থেকে খাবার পাবি", বলে সদলবলে বেড়িয়ে গেল।
--
বন্দিনীরা প্রাতঃকর্ম সারা, স্নান করা আর খাবার জল ধরার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। কারণ দেরি হয়ে গেলে হয়ত সকালের খাবারটাই মিলবে না। নিভা তার খাবার নিয়ে এসে বলল," আমার থেকেই আজকে খা।" আমি অবাক হয়ে দেখলাম এক/ দেড় মুঠি ছোলা স্বেদ্ধ। ওতে নিভার ই পেঠ ভরবে না, আমি কি করে ভাগ বসাই। নির্বিকার চিত্তে নিভা বলল, "চিন্তা করিস না, তুই না নিলেও আমার পেটের এক কোনা ও ভরবে না। বলেছিনা এখানে পেটের আগুন কখন নেভেনা। জ্বলতে, জ্বলতে শেষে আর বোধ থাকে না।" জোর করে দেওয়া ছোলা মুখে তুলতে গিয়ে দেখি পোকা শুদ্ধ ছোলা। সেটা ফেলতে গেলে নিভা আমার হাত চেপে ধরল, "আরে করিস কি, পোকা ছোলা ফেলতে গেলে সব ফেলে দিতে হবে। চোখ বুঝে খেয়ে নে। দুদিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে।"
--
খাওয়া শেষ না হতেই নিভা আমাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। "চল পাগল বাড়ীর দরজা খোলা, আমি ওখানে আগে থাকতাম। এইফাঁকে দেখেনে, হয়তো আর কোনোদিন দেখার সুযোগ পাবিনা।" জেলখানায় পাগলরা থাকে আগে জানা ছিল না। পরে শুনেছিলাম অনেকেই, বিশেষত যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, তারা জেলখানায় মাথার গন্ডগোল হলে নিজেদের আত্মীয় স্বজন দের জেলে সেরে ওঠার জন্য দিয়ে যায়। যেমন নিভাকে দিয়ে গেছিল। তাছাড়া রাস্তা থেকেও পাগল দের ধরে এনে এখানে রাখা হয়। এরা সবাই নন ক্রিমিনাল লুনাটিক কেসে বন্দী।
 --
পাগল বাড়ী ঢুকে আমি পাথরের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোটা তিনেক খাঁচার মত ঘর। সেখানে অনেক অনেক, একেবারে উলঙ্গ কঙ্কাল, মাথায় চুল জট পাকিয়ে গেছে। গা হাত পা নোংরায় কালো। এখানে সেখানে দগদগে ঘা।  অনেককেই হ্যান্ড কাফ দিয়ে, বা শেকল দিয়ে গরাদের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। যে যেখানে পেরেছে প্রকৃতির ডাকে কাজ সেরেছে। তারই পাশ থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। অনেকে আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি, চুল টানাটানি, এমন কামড়া কামড়ি করে পরস্পরকে ক্ষত বিক্ষত করছে, রক্ত ঝরছে। কেউ গলা ফাটিয়ে কাঁদছে কেউ গালি গালাজ করছে।কাউকে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছেনা। সাধারণ মানুষ ওখানে কদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবে।
--
নিভা আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসার পর সম্বিত ফিরে পেলাম। একটা জায়গায় আমাকে বসিয়ে জল খাওয়াল। একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা এ রকম কঙ্কালের মত কেন !" "কেন আবার ঠিক মত খাবার দেয় না। জানিস ডাক্তার বাবুরা ওদের জন্য কত বেশী বেশী ডায়েট লিখে দেয়, দুধ ,ফল বিস্কুট,পাউরুটি, মাছ সব। কিন্তু কিছুই ওরা পায় না। দালাল গুলি সব মারে। আমাদের সকলের খাবার থেকেও ওরা মারে। তাইতো এতো কম খাবার পাই আমরা।" "কিন্তু মেট্রন,ওয়ার্ডার রা কিছু বলে না !" "পাগল ওদের নির্দেশেই তো এসব চলে। ওরাই তো মোটা ভাগ পায়। দালাল রাও পেটমোটা হচ্ছে খেয়ে খেয়ে। আবার নিজেদের পছন্দের জিনিস আনাছে ওয়ার্ডারদের দিয়ে। সপ্তাহে একদিন মাছ আর একদিন মাংস দেবার দিন। সেদিন দেখবি মগ ডুবিয়ে মাংস খেয়ে ঢকঢক করে হজমের ওষুধ খাচ্ছে।"
--
ইতিমিধ্যে 'কেস টেবিল, কেস টেবিল' করে বিকট চিৎকার শোনা গেল। নিভা আমাকে নিয়ে গিয়ে কেস টেবিলের যাবার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমাদের নতুন বন্দিনীদের দুইজন মেয়ে ওয়ার্ডডার আর একজন লাঠিধারী ছেলে ওয়ার্ডারের সাথে জেনানা ফাটক থেকে বেরিয়ে ছেলেদের ওয়ার্ডের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো।সেখানে একটা টেবিলে একজন ডেপুটি জেলার, হেডজমাদার বসে একটা বিরাট জাবদা খাতায় নাম,ধাম ঠিকানা,  কেস ইত্যাদি লিখে নিচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ওয়ার্ডে ফিরলাম। আমাকে ডিভিশন ওয়ার্ডে রাখা হল। প্ররথমেই এই এই ওয়ার্ডডের  নামকরণের বিষয়ে একটা কথা পরিিিষ্কার করা দরকার। ইংরাজ রাজত্বে এখানে রাজবন্দিনীদের রাখা হত। তাঁরা ছিলেন মধ্য উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ এবং বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত। কালক্রমে এখানে শুধু রাজনৈতিক বন্দিনীদের রাখা হত। আমাদের সময় শুধু নকশাল বন্দিনীদের রাখা হত, বিশেষ সুযোগসুবিধা বর্জন করলেও। প্রথম ছিল ক্লাস ডিভিশন , পরবর্তি কালে রাজনৈতিক মতাদর্শের ডিভিশন, যাতে আমজনতার মধ্যে সেই মতাদর্শ ছড়িয়ে না পরে।     
---
আমি  যেদিন ডিভিশন ওয়ার্ডে যাই তখন সেখানে  আর দোতলার সেলে শুধু নকশাল বন্দিনীদের বন্দীদের আলাদা করে রাখা হয় যাতে তারা সাধারণ বন্দীদের সাথে মিশতে না পারে। শীলাদি ছাড়াও মুক্তি, বিজু আরও পাঁচজনের সাথে পরিচয় হল। ওপরে সেলে কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া থাকতো। বিজু ছিল সবার ছোট, মুক্তি, ডালিয়া আমার সমবয়সী, কল্পনা আর জয়া (মিত্র) ছিল শীলাদির বয়সী। ১টা র সময় হেড ওয়ার্ডার তথা জমাদারনী এসে লক আপ করে দিল। 
--
ভাত খাবার পর বিজু পড়ল আমাকে নিয়ে। শুনলাম প্রতি সপ্তাহে এক মুটকি কেরোসিন তেলের গন্ধ ভরা মাথার তেল, এক মুটকি সরষের তেল আর একটুকরা কাপড় কাচার সাবান বন্দিনীদের প্রাপ্য। সেই কেরোসিন তেল ওরফে মাথার তেল বিজু আমার মাথায় জবজবে করে মাখিয়ে, কোষে বেঁধে বেশ কিছুক্ষণ ৱেখে দিল। তারপর একটা সরু চিরুনি দিয়ে জোরে জোরে আঁচড়াতে লাগলো। আর কেরোসিনের গন্ধে ঝরঝর করে উকুন পড়তে লাগল, মুক্তি সেগুলিকে মারতে থাকল। বিকালে ৪টের লকআপ খুললে বিজু কাপড় কাচার সাবান মাথায় গায়ে ঘষে স্নান করিয়ে দিল।প্রায় দিন ২/৩ দিন এই পর্ব চলল, পুলিশ থানার কম্বলে সঞ্চিত উকুন তাড়াবার জন্য। বিকাল ৫/৬ টার সময় আবার লক আপ হলে মুক্তি আর বিজু মিলে পুলিশ লক আপে মার খেয়ে আঘাতের জায়গায় সরষের তেল মালিশ করতে থাকে।যারাই নতুন আসে এইভাবে শুশ্রুষা করে সারিয়ে তোলাটা এখানকার রেওয়াজ। সাথীদের সাহচর্য্যে আর সেবায় শরীর মন দু ই শান্তি আর স্থিরতা লাভ করে। সন্ধ্যে বেলায় খাবার খেয়ে গল্প করা বা বই পড়া হত, প্রায়ই গানও  হত। মুক্তির গলায় অসাধারণ কাজ ছিল। বিজুর মিস্টি গলা ছিল। সবার শেষে  ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া হত। এইভাবে শুরু হল আমার জেল জীবন।
**********************
(চলবে )
















8 Sept 2016

ছোট্টবেলা

ছোটবেলা
*******

হারিয়ে গেছে আমার সেই ছোট্টবেলা
সাথিরা মিলে তেঁতুল খাওয়া
খোলা মাঠে খোখো আর কাবাডি খেলা
ঝড়ের মাঝে আম কুড়ান, বৃস্টি ভেজা
কোমর জলে ডুবকি দেওয়া
হারিয়ে যাওয়া আমার ছোট্টবেলা।
--
হারিয়ে গেছে আমার সেই ছোট্টবেলা
লোড শেডিং এর দিনে পাঠে ফাঁকি
ভাড়াটে বাড়ীর ছাদে আসর জমাটি
সবাই মিলে তারা চেনা আর গোনার খেলা
ঠাকুমার মুখে গল্প, কাকীমার হাতে মুড়ি মাখা
হারিয়ে যাওয়া আমার ছোট্টবেলা।
--
হারিয়ে গেছে আমার সেই ছোট্ট বেলা
ক্লাসে বই মুখে চুপি চুপি গল্প
দিদিমনিদের স্বস্নেহে বকুনি
স্কুলের সবুজ মাঠে কত খেলা
চড়ুই ভাতির কত মজা,খাওয়া দাওয়া
হারিয়ে যাওয়া আমার ছোট্টবেলা।
--
হারিয়ে গেছে আমার সেই ছোট্ট বেলা
গঙ্গার জলে পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে সূর্য ডোবা
রাতের বেলা গায়ে জোৎস্নার গন্ধ মাখা
মাঠের পরে কাশবনে বাতাসের লুটোপুটি খেলা
ভাদ্রের মেঘে শরতের আগমনীর আনন্দ বার্তা
হারিয়ে যাওয়া আমার ছোট্ট বেলা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সততা





সততা 
 *****
দুই সন্তানের মা, নমিতা থাকত দত্তাবাদ বস্তির এক চিলতে ঘরে। স্বামী একটা ছোটখাটো কারখানায় কাজ করত। নমিতা বাড়ী বাড়ী বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাঁচা ইত্যাদি কাজ করত। এক চিলতে দরমার ঘর, চার ধারে বাঁশের খুঁটি, মাথায় বাঁশের উপর চাটাই, প্লাস্টিক। তার ভাড়া ২০০ টাকা। রাস্তার আলো থেকে হুক করে বিজলীর দুটি পয়েন্টের জন্য ৫০টাকা। ঘর ও সরকারি জমির উপর জবর দখল করে বানানো বিশাল বস্তির মধ্যে। বস্তির মালিকানা গুটি কতক লোকের হাতে। তারা যে পার্টি সরকারে থাকে তাদের দলের লোক। সরকার বদল মানে দল বদল।
--
তাই ইচ্ছা মত ভাড়াটে দের ওপর অত্যাচার চালাতে বাধা নেই। বৃষ্টির সময় ছাদ থেকে ঘরে জল পরে, তলা দিয়ে জল ঢোকে। ঝড়ে চাল উড়ে গেলে নিজেদের সারাতে হয়। দুটি বড় বড় পুকুর সরকারি জমির ওপর। তাতেই বস্তিবাসীদের  সব কাজ চালাতে নির্দ্দেশ দেওয়া আছে। বাকি কাজের জন্য খালি মাঠে যেতে হয়। ফলে সর্দিকাশি, পেটখারাপ তাঁদের নিত্য সঙ্গী। বাড়ীর মালিকদের ঠিক সময় মত ভাড়া আদায় করা ছাড়া কোন দায় নেই।
--
মালিক দের ক্রমাগত বাড়ীর পরিসীমা বাড়তে থাকে, পাকাপোক্ত ইট সিমেন্ট টাইলস লাগান ঝাঁ চক চক বাড়ী তৈরী হয়। সরকারি খরচে বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা আদ্ধেকের বেশী মালিক দের সেবায় যায়। বাকী টুকু তে ২০০ঘর ভাড়াটের জন্য দুটি মাত্র জলের কল আর দুটি টয়লেট তৈরী হয়। বস্তিবাসীদের সকল কেই সকালে কাজে বার হতে হয়, অতএব জল, কল আর টয়লেট নিয়ে নিত্য ই ঝগড়া বিবাদ লাগা থাকে।
--
অথচ প্রতি দুবছর অন্তর ঘর সারানোর নামে মালিক রা ভাড়াটেদের কাছ থেকে টাকা তোলে। ঘর সারানো পর দেখা যায় প্রত্যেকের ঘর আগের থেকে ছোট হয়ে গেছে, তা হয় মালিকের এলাকায় ঢুকে গেছে নয় নতুন দু / চারটি ঘর তৈরী হয়েছে নতুন ভাড়াটে বসানোর জন্য।  আর একটা সময় বস্তি মালিকরা খুব সক্রিয়। ভোটের সময় নিজেদের ভাড়াটেদের জোগাড় করে তাদের পছন্দসই প্রার্থীদের জন্য মিছিল করানো, ভোট দেওয়ান ইত্যাদি।
--
বাড়ী ওয়ালাদের আর একটি রোজগারের ব্যবস্থা হল মদের ঠেক চালান। পয়সার আমদানি দেদার , তার থেকে নিত্য নতুন ব্যবসা খোলা। শুধু রাজনৈতিক পার্টিদের চাঁদার জোগান ঠিক রাখা আর গদি নিয়ে কামড়া কামড়ির সময় মদত দেওয়া। মাঝে মধ্যে পার্টির মস্তানদের মধ্যে লড়াই চলে, বোমাবাজী হয়। তখন নমিতরা ছেলে পুলে নিয়ে দুরু দুরু বুকে সারা রাত উৎকণ্ঠায় কাঁটায়। তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে।
--
এক শীতের সকালে নমিতা যখন প্রথম মঞ্জরীর বাড়ী কাজে আসে, পাতলা ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল গায়ে দিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে। মঞ্জরী কি কি করতে হবে বলে দিয়ে সরোদ বাজাতে বসে যায়। রান্না আগেই হয়ে গেছিল। দুই ঘন্টা বাদে যখন হুঁশ আসে, "আরে মেয়েটা এতক্ষন কি করছে, অন্যেরা তো এক ঘন্টার আগেই কাজ সেরে চলে যেত। উঠে গিয়ে দেখে সারা বাড়ী ঘর ঝক ঝক করছে, ওয়াশিং মেশিনে কাঁচা কাপড় মেলা হয়ে গেছে। রান্নাঘরের সব তাক টাক পরিষ্কার করে বাসন মাঝতে বসেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ থেকে, বলে " কাজ হয়ে গেলে টেবিলের ওপর তোমার খাবার ঢাকা আছে খেয়ে নিয়ো।"
 --
দুদিন পর মঞ্জরী ওকে দুটো কাপড় দেয়, নমিতার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে। " তোমার গায়ের চাদর নেই।" "একটা চাদর আছে, সেটা আমার বর গায়ে দিয়ে কারখানায় গেছে, ফিরতে রাত হয়ত, ঠান্ডা লাগবে তাই।" মঞ্জরী একটা গায়ের চাদর ও বার করে দেয় ," মনে মনে ভাবে, যা ঠান্ডা পড়েছে, শেষে অসুখে পরে গেলে আমার ই মরণ।"
 --
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে যায়। নমিতার কাজে কোন ফাঁকি নেই। সময় সময় মঞ্জরী বকে, "হ্যারে তোর বাড়ীঘর নেই, বাচ্চাদুটো স্কুল থেকে আসবে ! কখন বাড়ীর রান্না করবি আর ওদের খেতে দিবি?" "আরে মামী তুমি এত ভেবোনা। আমি ঠিক সময়ে বাড়ীর কাজ সেরে ফেলব। তুমি যে বড় ড্রাম টা দিয়েছ, তাতে সকাল বেলায় জল ভরে রেখে আসি, ফিরে গিয়ে কাজ করতে কোন অসুবিধা হয় না, আর রান্না মানে তো ডাল ভাত বা ভাতে ভাত দুটো ফুটিয়ে নেওয়া।"" "যাই হোক তাড়াতাড়ি বাড়ী যা। আর ঘরের চাবিটা নিয়ে যা, বিকালে আমি থাকব না।" মঞ্জরীর ফ্ল্যাটের একটা চাবির সেট নমিতার কাছেই থাকে, মাঝে মধ্যে ভুলে রেখে যায়।
--
ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক আস্থার জায়গা তৈরী হয়ে গেছে। নমির কখন কোন কাজে ফাঁকী নেই, মনে হয় যেন নিজের ঘরের কাজ করছে। হাজার অভাব স্বত্তেও মুখ ফুটে কখন কিছু চায়না। মঞ্জরীর বাড়ীতে সব কিছু খোলা মেলা পরে থাকে, আলমারিতে চাবি ঝুলতে থাকে। সর্বত্র নমির অবাধ গতি। টেবিলে টাকা পয়সা, মানিব্যাগ পড়ে  থাকে। নমি সুন্দর করে টেবিল পরিস্কার করে রাখে। পাঁচ বছরে একটা সুতোও এদিক ওদিক হয়নি।
--
মঞ্জরী একটু বেখেয়ালি। কোনদিন ব্যাগে ভরতে গিয়ে হাজার টাকার নোট মেঝেতে পড়ে গেছে খেয়াল করেনি, কোনোদিন আবার আলমারি হা করে খোলা রেখে বেড়িয়ে যায়। ফিরে এসে নমির কাছে বকা খায়,"মামী তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। এক একদিন এক একটা কীর্তি করে রেখে যাও।""যাক তুই আছিস তো, সব ঠিক করে রাখবি জানি তো, আর বকিস না।"
--
১৯/২০ বছরের মেয়ে। অবিরাম দারিদ্রের সাথে লড়াই করে চলেছে। কিন্তু প্রখর আত্মসম্মান বোধ। মাঝে মাঝে টাকা ধার করে, ঠিক শোধ ও করে দেয়। মুখ ফুটে কখন কিছু চায় না। বাড়তি কিছু দিলে শুধু একবার চোখ দুটি তুলে তাকায়। একবার ধূম জ্বর নিয়ে নমি কাজে এল। ওর চেহারা দেখে মঞ্জরী কপালে হাত দিয়ে দেখে বলে, "যা বাড়ী যা, গায়ে তো খুব জ্বর, এত ঠান্ডা লাগালি কি করে ?" "শুধু আমার নয় বাড়ী শুদ্ধ লোকের ঠান্ডায় জ্বর হয়েছে। আসলে মাটিতে মাদুর পেতে শুই তো, গায়ে দেবার দেবার মতো মোটা কিছু নেই।"
--
" ঠিক আছে বাড়ী গিয়ে তোর ভাইকে রিকশা টা নিয়ে আসতে বল।" একটু পরে নমির ভাই রিকশা নিয়ে এল, ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে," দিদি বলেছে, যে কদিন আসতে পারবে না, বোন কদিন তোমার কাজ করে দেবে। তোমাকে তো কাজে যেতে হবে।" নমির বিবেচনা বোধে বিস্মিত মঞ্জরীর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। কথা না বাড়িয়ে বাড়তি তোশক, কম্বল, জ্বরের ওষুধ আর টাকা পাঠিয়ে দিল। তার সাথে নিজেদের আধ পুরান কিছু গরম জামা কাপড় ও দিয়ে দিল।
 --
কদিন বাদে নমি কাজে এসে প্রথমেই বলল, "মামী, তোমার পাঠান জিনিষ গুলো খুব কাজে লেগেছে। তবে আমাকে যে টাকা পাঠিয়ে ছিলে আর বোনকে যা দিয়েছো, আমার মাইনে থেকে কিছু কিছু করে কেটে নিও।" লজ্জ্বায় মঞ্জরীর মাথা হেঁট হয়ে যায়। তার বাড়ীতে  বাড়তি তোষক কম্বল থাকা স্বত্তেও নমির পরিবার এই প্রবল শীতে ঠান্ডা মাটিতে রাত কাটছিল, সে খোঁজ ই রাখেনি। অথচ ওই টুকু মেয়ের কি অপরিসীম বিবেচনা বোধ। "যা তোকে আর পাকামো করতে হবে না", বলে কোন মতে ইতি টেনে পালিয়ে বাঁচে।
 --
 একবার মঞ্জরীরা দার্জিলিং যাচ্ছে শুনে, লজ্জিত মুখে এসে বলল,"মামী আমার ছেলে, মেয়ে, আর বরের জন্য ওখান থেকে সোয়েটার এনে দেবে ? মাইনে থেকে আস্তে আস্তে টাকা শোধ করে দেব।" "তোর লাগবে না?" "হ্যা মানে, আমার ও একটা কালো সোয়েটারের খুব শখ, কিন্তু তোমার ওপর অনেক চাপ পড়ে যাবে যে।" " সে সব তোকে ভাবতে হবেনা। আমার সাধ্য মত আমি এনে দেব। পয়সার চিন্তা তোকে করতে হবেনা। তুই আমার জন্য যা করিস, নিজের লোকের থেকেও বেশী।"
--
ফিরে আসার পর সোয়েটার গুলি পেয়ে খুশিতে নমির শ্যামলা রঙ টা কচি কলাপাতার মত ঝল মল করতে থাকে। মঞ্জরী মনে মনে ভাবতে থাকে, " সত্যি মেহনতি মানুষ রা কত অল্পেতে খুশি হয়। আর আমাদের চাওয়ার পাওয়ার যেন কোন শেষ নেই।
--
কিন্তু এরপর মঞ্জরী আর নমির ছাড়া ছাড়ির দিন এগিয়ে এলো। মঞ্জরীর স্বামীর সরকারি চাকরি। অবসরের তিন মাসের মধ্যে সরকারি আবাসন ছেড়ে দিতে হয়। যাবার দিন এগিয়ে আসতে থাকে।  নমি মামীর  গলা জড়িয়ে শুধু কাঁদতে থাকে, মঞ্জরীও কান্না গিলতে থাকে, এমন পরিজন দুর্লভ। এদিকে গোছগাছ শুরু হয়ে যায়। মঞ্জরী কিছু কিছু ফার্নিচার, বাসনপত্র, ট্রাংক,ব্যাগ ইত্যাদি নমিকে দিয়ে দেয়। নমির ভাই আর বর এসে নিয়ে যেতে থাকে।
--
ওপরের লফ্ট এ টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদির প্রচুর পিসবোর্ডের কাটিম জমেছিল। সেগুলি নমিকে নিতে দেখে মঞ্জরী জিজ্ঞাস করে এগুলি দিয়ে জঞ্জাল বাড়িয়ে ঘর গুদাম করে ফেলিস না, উনানে আঁচ দিয়ে দিস।"
"নমি হেসে বলে," না মামী গুদাম হবেনা। তোমার দেওয়া জিনিস ছাড়া আমার ঘরে তো আর কিছু ছিল না। শুধু দুটো মাদুর আর দুচারটে জামা কাপড়। " মঞ্জরী স্তম্ভিত হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করে ভাবে, "একেবারে নিঃস্ব এই মেয়েটা কত কষ্ট সহ্য করেছে। কিন্তু মুখ ফুটে কখন দয়া ভিক্ষা করেনি। হাতে তুলে না দিলে, সুযোগ থাকা স্বত্বেও একটা কুটি ও সরায় নি।    এ আত্মমর্যাদা বোধ আর সততা - এই বোধহয় মেহনতী মানুষের একমাত্র সম্বল আর অনন্য সম্পদ।"
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------