25 Aug 2018

মঙ্গল

মঙ্গল
*****

সেদিন ভোরে খবর পেলাম কল্যাণ মঙ্গল কে খুঁজে বেড়াচ্ছে, "হ্যাঁ গো মঙ্গল কে চেনো? ও ভাই, মঙ্গলের ঠিকানা টা বলতে পারো? মঙ্গল কে দেখেছ নাকি? " হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না ! কল্যাণ মঙ্গল কে খুঁজবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গেল কোথায় মঙ্গল!
--
আগে হর হামেশাই মঙ্গলের দেখা পাওয়া যেত, গলির মোড়ে, ট্রেনের কামরায়। চলতি বাসে লাফিয়ে উঠছে, পাড়ার রোয়াকে বসে আড্ডা মারছে। তবে এখন কেন তার দেখা মিলছে না ! আমাদের ছোট বেলায় কত যে মঙ্গল ছিল, প্রতি বাড়ীতে,পাড়াতে পাড়াতে, রাস্তায় ঘাটে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে সর্বত্র।
--
গভীর রাতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মঙ্গল তার দল নিয়ে উপস্থিত,  ট্যাক্সি না পেলে রুগীকে পাঁজকোলা করে নিয়ে হাজির সরকারী হাসপাতালে। ডাক্তার নার্স সবাইকে খুঁজে নিয়ে, মিনতি করে ভর্তি করে দিয়ে, রাত ভর বসে থাকত, অপেক্ষা করত ঘন্টার পর ঘন্টা বিপদ কাটা পর্যন্ত্য। অবশেষে রুগীর বাড়ীতে গিয়ে সুখবর দিয়ে ছুটি।
কিন্তু সে বাড়ীতে লোকবল বা অর্থবল কম হলে ছুটি হত না। লোকবলের অভাব নিজেরাই পূরণ করত। অর্থের অভাব থাকলে পাড়ায় বাড়ী বাড়ী ঘুরে চাঁদা তুলতো। 
--
আগে অবশ্য সরকারী হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসার সুযোগ আজকের মত এতটা অপ্রতুল  ছিল না। কারণ তখন বেড পাওয়া থেকে শুরু করে  ওষুধপথ্যি, বা স্যালাইন, অক্সিজেন ইত্যাদির জন্য ঘাটে ঘাটে পয়সা দিতে হত না।  নেতা নেত্রী বা হোমরা চোমরাদের তদবিরের আবশ্যিকতা কম ছিল, মানবিক মুখের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী ।
--
প্রবল ঝড় জলে কোন বাড়ীতে মৃত্যু হানা দিলে মঙ্গল উপস্থিত, সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে ঠিক শব সৎকারের ব্যবস্থা করে ফেলত। মহামারী, বন্যায় চেয়েচিন্তে জামাকাপড়,ওষুধপত্র জোগাড় করে, লঙ্গর খোলার মত খাদ্য দ্রব্য, এমনকি ডাক্তার বদ্যি সমেত আলাদীনের জীনের মত হাজির হয়ে যেত ঘটনা স্থলে।
--
দাঙ্গা ইত্যাদির র সময় মঙ্গল দল বল নিয়ে পাহারা দিত যাতে সংখ্যালঘু দের গায়ে কেউ হাত দিতে সাহস না পায়। প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের যোগান নিশ্চিত থাকত। পুরো অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যাতে শান্তি আর সম্প্রীতি নিয়ে থাকতে পারে, সেটা খেয়াল রাখা যেন তাঁদের বরাদ্দ কাজ। কত মঙ্গল যে নিজেদের জীবনের মূল্যে কত শত জীবন বাঁচিয়ে গেছে তার লেখা কোনো নথি ইতিহাসে নেই অবশ্য।
--  
স্বাভাবিক সময়ে বাচ্চাদের নিয়ে 'সব পেয়েছির আসর' খুলে বসত। কিশোর কিশোরীদের খেলাধুলার জন্য গড়ত ক্লাব। ফিবছরে একবার  অন্তত চড়ুইভাতি, চিড়িয়াখানা বেড়ান হত। এ ছাড়াও হরেক কিসিমের দৌড়, কাবাডি, খোখো, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদির সুস্থ প্রতিযোগীতার  আয়োজন করত।
--
পূজা পার্বন  ছাড়াও স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, সুকান্ত, নজরুল, বা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করত। সুন্দর সব সুরুচিসম্মত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হত।একটা পাড়ায় একটাই সম্মিলিত উৎসব, যেখানে চোখ ধাঁধানো আলোর রোশনাই বা কান ফাটান মাইকের দোর্দণ্ড প্রতাপ হয়তো থাকত না, কিন্তু মাধুর্য্য আর সম্প্রীতির নরম আলোয় হয়ে উঠত উজ্জ্বল।
--
মঙ্গলে কিন্তু কোথাও কখন কোন বেয়াদপি চলতে দিত না। বেয়াদপদের অভিভাবকের মত শাসন করত, আবার পরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিত।বামাল সমেত পকেটমার ধরা পড়লে দুচারটে ধমকধামক দিয়ে, মালিক কে জিনিষ ফেরত দিয়ে, ছেড়ে দিত। অমানুষিক গণধোলাই ঘটতে দিত না।
--
বাসে ট্রামে বাচ্চা, মহিলা আর বয়স্কদের জন্য সদাই বসার জায়গা টি ছেড়ে দিত।  ট্রেনে প্রয়োজনে স্টেশন থেকে দৌড়ে গিয়ে  জল ভরে আনা, অপরের জন্য খাবার কিনে আনা যেন মঙ্গলদেরই দায়। লোকাল ট্রেনেও মঙ্গলদের দেখা যেত কারও বোঝা তুলে বা নামিয়ে দিত। তাঁরা সদাই যেন অসহায়ের সহায়, সব বিপদহরণ মধুসূধন।
--
আজ সত্যি এই মঙ্গলদের সংখ্যা কমে গেছে বটে তবে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি বোধহয়। তাইত দাঙ্গায় নিজের সন্তানের মৃত্যু সত্ত্বেও ইমাম দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, প্রতিহিংসার বলি রোধ করেন। ছোট্ট শিশুকে বাঁচাতে আজও কোনো তরুণ আগুনের লেলিহান শিখা উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। কিশোরী জলে ঝাঁপ দেয় তার সাথীকে বাঁচাতে।
--
কেপি জয়সল তাঁর সাথীদের নিয়ে  প্রাণের ঝুঁকি সত্ত্বেও বন্যার্তদের উদ্ধ্বারে কুন্ঠিত হন না। গুন্ডাদের বিরুদ্ধে গোটা গ্রাম  একসাথে রুখে দাঁড়ায়, জোর করে বিক্রি হয়ে যাওয়া মেয়ে, পালিয়ে গ্রামে ফিরে আশ্রয় নিলে, তাঁকে রক্ষা করতে। অবৈধ মদ, গাঁজার ঠেক ভাঙতে মহিলা গোলাপ দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। আসিফার মৃত্যুর তদন্ত করতে প্রাণনাসের ভয় সত্ত্বেও এগিয়ে আসে তরুণী এডভোকেট।
--
মঙ্গল আজও বিরাজমান। তাইত আজও  মানুষ আশায় থাকে। তাইত সাম্য, আস্থা, শান্তি আর সম্প্রীতি ইত্যাদি শব্দগুলি এখনও মুছে যায়নি । তাই আজও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------                          
 











           

3 Aug 2018

মাস্তান

মাস্তান
******

সত্তর দশকের প্রেসিডেন্সি জেলের মহিলা ওয়ার্ডের সকাল আট কি নয় টা। সকালের খাবার এসেছে মটর সেদ্ধ। লাইন দিয়ে বন্দিনীরা খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত। তদারকিতে সবচেয়ে দাপুটে এক জবরদস্ত মহিলা ওয়ার্ডার বিজয়া,  আর সবচেয়ে  নৃশংস জেল কর্তৃপক্ষের এক বিশ্বস্ত দালাল শিখা তার বাকী চামচা বাহিনী সহ দাঁড়িয়ে মাতব্বরীতে ব্যস্ত। হটাৎ করেই একটা শোরগোল উঠল, আধ ভাঙা হিন্দী বাংলায় সতেজ গলায় শোনা যায়, " ইয়ে এক কীড়াওয়ালা ঘোড়ে কে খানে কি লিয়ে মুঠঠি ভর চানে মে ক্যায়া ভুক মিট জায়গি, কেইসে আদমী জিয়েগা !"
--
সঙ্গে বিজয়া আর শিখা চামচাবাহিনী সহ এগিয়ে আসে, "ক্যাড়া চিল্লায়, এত বুকের পাটা ? "হ্যামি মাস্তান আছি, হ্যাঁ, বুকের পাটা হ্যায় মেরে অন্দর, তুমলোগ কৌন হো !', শিখা আর চামচে বাহিনীর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জবরদস্ত লম্বা চাওড়া খাটিয়ে পেটানো চেহারার এক পাঞ্জাবী মহিলা রুখে ওঠে। চারিদিকে বন্দিনীরা ভীড় করে এগিয়ে আসে। বেগতিক বুঝে বিজয়া তাড়াতাড়ি সামাল দেয়, " এই পুঁটি ঠিক করে খাবার বাট, ওকে আর দুটো মটর সেদ্ধ দে।" মাস্তান কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে খাবার নিয়ে মেয়াদী নম্বরে ঢুকে যায়।
--
মেয়াদী নম্বরের গরাদের কাছে ছিল মাস্তানের জায়গা। সবুজ ছাপ ছাপ কাপড়ের ঢোলা পাজামা আর ঢোলা একটা জামা থাকত পরনে। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া ছোট ছোট চুল। গরাদের ফাঁক দিয়ে ওধারে বাকী ওয়ার্ড থেকে বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক বন্দিনীদের সাথে তাঁর ধীরে ধীরে আলাপ জমে ওঠে। অন্যান্যদের মত সে তাদের দিদি বলে ডাকতো না, দোস্ত বলে সম্বোধন করত। তাঁর আসল নাম ছিল সফিয়া। দেশ ভাগের সময় তাঁদের পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আত্মীয় স্বজনদের অনেকে ভারতে চলে আসেন, অনেকেই আবার ওধারে থেকে যান। স্বাভাবিক সময়ে এপারের লোকজন ওপারে, ওপারের মানুষ এপারের আত্মীয়দের বাড়ী যাওয়া আসা চলত।
--
দু দেশের মধ্যে উত্তেজনার সময় সেটা কঠিন হয়ে পড়ত। অনেক সময় সাধারণ নিরীহ মানুষ সীমান্ত পারাপার করতে গিয়ে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ত। চতুর আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্নরা  কখন কখন ঘুষ দিয়ে  ছাড়া পেয়ে যেত। কিন্তু  সাধাসিধা গরীব মানুষরা অনেক সময়ই  নিরাপত্তা রক্ষীদের হাত থেকে কোন দেশের সরকারি থানা বা জেলে ধরা পড়ত, যথারীতি ছল চাতুরী না করে সত্যি কথা কবুল করে ফেঁসে যেতে। অনেকের  বাড়ীর লোকজন আর তাঁদের কোন হদিশই পেত না।
--
এই বিপদ এড়াতে ঘুর পথে সীমানা পার হতে গিয়ে পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত গ্রামের সহায় সম্বল হীন  সফিয়া বাড়ী  ফেরার রাস্তা  হারিয়ে ক্রমাগত ভবঘুরের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন শহর জায়গায় ঘুরতে থাকে, বাড়ীর পথ খুঁজে বেড়ায়। তাঁর আত্মসম্মান বোধ বড় প্রখর। কখন কারও কাছে হাত পাতেনি, আবার নিজের যখন যা কাজ জুটেছে করেছে পেট ভরাতে আর পথখরচ জোগাড় করার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে কিভাবে যে পশ্চিমবাংলায় এসে পড়ে, নিজেও বলতে পারত না। ক্রমে কলকাতার ফুটপাত তাঁর বাসস্থান হয়ে দাঁড়ায়।
--
অনেক সময়ই  কোন স্টেশন বা ফুটপাতের দোকানীদের কাছে ছুটকো ছাটকা কাজ করে পেট চালাত আর তাঁদের থেকে এক প্লাস্টিক জোগাড় করে তাঁবু খাঁটিয়ে রাত কাটাত। আর কি ভাবেই যে সফিয়া শুধুই মাস্তান নামে পরিচিত হল, বলা কঠিন, সম্ভবতঃ কেউ তাঁর নির্ভিক স্বভাবের জন্য এই নামকরণ করেছিল আর মাস্তান সানন্দে মেনেও নিয়েছিল।
--
আবার একদিন পুলিশবাহিনী স্টেশন আর ফুটপাতের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার প্রয়াসে অনেকের সাথে মাস্তানকেও থানায় ধরে নিয়ে যায়। তাঁর সুদূর পাঞ্জাব থেকে কলকাতা পাড়ি দেওয়া বা স্টেশনে স্টেশনে ঘুরে ঘুরে থাকার কথাবার্তা  শুনে তাঁকে  সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখে ও কড়া সওয়াল চালিয়ে যায়। মাস্তান ভয় পাওয়ার পাত্রী নয়, চ্যাটাং চ্যাটাং উত্তর দেয়। পুলিশ সহজ পন্থা  অবলম্বন করে। তাঁকে বিদেশী চর বলে চিহ্নিত করে, আর পাসপোর্ট কেস দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। জেলে এসেও মাস্তান কিন্তু এতটুকু  সাহস হারায়নি।
--
দালাল, ওয়ার্ডার, মেট্রন কাউকে তোয়াক্কা করত না, ন্যায্য কথা মুখের ওপর বলে দিত। খাবার কম দিলে প্রতিবাদ করত, অসুখ করলে সোজা হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের কাছে ওষুধ চাইত। দিনের পর দিন পার হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর কোর্টের ডেট কেন আসে না, তাই নিয়ে মেট্রনদের কাছে কৈফিয়ত চাইত। দরকার হলেই তখনকার সৎ, বিবেকসম্পন্ন ও সহৃদয় ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে তাঁর সমস্যা জানাত। তাঁর নির্ভিক চালচলনে দালাল বাহিনী সচরাচর ঘাটাতে সাহস করত না বটে, তলে তলে তাঁর বিপদ ঘনিয়ে আসছিল।
--
ওয়েলফেয়ার অফিসার সব বন্দিনীদের দাবী ও অভিযোগের সাথে মাস্তানের সমস্যা নিয়েও মেট্রন, জেলার সুপারের সাথে রীতিমত আইসঙ্গত ভাবে কি প্রয়োজন সে প্রসঙ্গে  সরল বিশ্বাসে প্রায়শঃই আলাপ  আলোচনা করতেন, যার ফলে  জেলের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত  মেট্রন, জেলার সুপার কে বিপাকে পড়তে হত।
--
জেলে সপ্তাহে একটা দিন জেলার, সুপার, বড় জমাদার (মেল হেডওয়ার্ডার ), বড় মেট্রন ইত্যাদির একটা দল সব ওয়ার্ড ঘুরে, বন্দি / বন্দিনীদের সুবিধা -অসুবিধা খোঁজ নেওয়ার জন্য বরাদ্দ থাকত, যেটা বস্তুত নিছক একটা লোক দেখান ব্যাপার ছিল। এই পরিদর্শনের সময় সব বন্দিনীদের লাইন করে, যাকে জেলের ভাষায় ফাইল বলা হত, চুপচাপ বসে থাকাটাই রেওয়াজ ছিল।
--
এইরকম  এক পরিদর্শনের সময় মাস্তান ফাইল ছেড়ে উঠে সোজা জেলার সুপারের দিকে এগিয়ে গেল। ওয়ার্ডার, মেট্রনরা আটকাবার চেষ্টা করে পারল না।মাস্তান সবাইকে ঠেলেঠুলে সোজা জেলার সুপারের একেবারে কাছে গিয়ে জোর গলায় প্রশ্ন করল, " কিতনা  দিন সে তুমলোগোনে ইয়ে জাহান্নমে জানোয়ার কি তরা বন্ধ করকে রাক্ষা, মেরেকো কোর্ট মে কিউ পেশ নেহি কর্তে হো ! ম্যায় তো জানু, মেরে কসুর ক্যায়া ?"
--
কর্তাব্যক্তিরা বিরক্ত মুখে, ভুরু কুঁচকে বড় মেট্রনের দিকে তাকাল। মেট্রন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, " হে, হে, স্যার, কিছু মনে করবেন না। ওর কথায় কান দেবেন না, মাথাটা একটু খারাপ আছে কিনা।" ঘৃণাভরে মেট্রোনদের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠে, "চোপ ঝুটা, ঝুট বোলনেসে তুম থাক নেহি যাতে! হরবখত ঝুট কে সাহারে জিতে হো !" মাস্তানের প্রবল হুঙ্কারে সবাই থতমত খেয়ে যায়।   
--
তড়িঘড়ি সন্মান বাঁচাতে মেট্রন সহ সব কর্তা ব্যক্তিরা, অন্য ওয়ার্ডের দিকে পা বাড়ায়। সেদিন বিকালে সব ওয়ার্ড বন্ধ করে দিয়ে, মেট্রন তার প্রতিশোধ নিল। বিশাল দালাল বাহিনী ও দুই শিফটের উপস্থিত সব ওয়ার্ডারদের সঙ্গে নিয়ে, মাস্তানের ওপর চড়াও হল।
--
অকথ্য গালাগাল বর্ষণ করতে করতে বড় মেট্রনের তত্ত্বাবধানে হিংস্র দালাল আর বিবেকহীন ওয়ার্ডার রা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাস্তানের ওপর।  সকলে মিলে  লোহার রড, পাকানো বাঁশের ডাণ্ডা, কয়লা ভাঙা হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে করতে, টেনে হিঁচড়ে ওয়ার্ড থেকে বার করে নিয়ে গেল। একা খালি হাতে এতগুলো সশস্ত্র  মানুষের সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব জেনেও নির্ভিক মাস্তান আপ্রাণ কঠোর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যায়।
--
শয়তানদের দল রক্তে ভেসে যাওয়ার পরও তাঁকে পাগল বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে অকথ্য অত্যাচার চালায়। দালাল শিখা একটা রড ঢুকিয়ে দেয় তাঁর গোপনাঙ্গে। শেষ পর্যন্ত রক্তার্ত মাস্তানের অচৈতন্য উলঙ্গ শরীরটাকে হাতে পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে মারাত্মক ভাবে উন্মাদ বন্দিনীদের সাথে রেখে দেয়। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য সে ভেঙে পড়েনি, বা কারোর কাছে করুনা ভিক্ষা করেনি। দালাল, এমনকি মেট্রোনদের থেকে  ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
--
দিনের পর দিন অনাহারে, অত্যাচারে কঙ্কালসার মাস্তান আস্তে আস্তে সকলের অগোচরে কবে যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল, কেউ জানতেও পারলো না। তবে তাঁর নির্ভিক, আপোষহীন, প্রতিবাদী মুর্তি বন্দিনীদের মনে গভীর ছাপ ফেলে গেল। প্রায়  চল্লিশ বছর পরেও অতি সাধারণ এক ভবঘুরে মহিলার সেই বীরাঙ্গনা মুর্তি আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।   
 ---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------