9 Dec 2019

দুই সখীর গল্প

ভূমিকা
*******
 কালীঘাটে যে ভিখারিনী শিশুদুটি ধর্ষিতা হয়েছে, আর প্রতিদিন সমাজের প্রান্তিকশ্রেণীর যে সব শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধারা সকলের চোখের আড়ালে ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন,  বিচারের নামে যে প্রহসন সহ্য করেন, তাঁদের সকলের স্মরণে আমার আজকের লেখা।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

দুই সখীর গল্প
**********
মিতা আর শোভা দুই বান্ধবীকে জেলে সব সময় একসাথে সকলে দেখতে অভ্যস্থ ছিল। দুইজনেই রেপ কেসের ভিক্টিম হিসাবে জেল কাস্টডিতে ছিল। মিতার সাধারণ ঘরোয়া চেহারার মধ্যে দুটি উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত, চোখ আর শান্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা মুখের ভাব ওকে অসাধারণ করে তুলেছিল। স্বল্পবাক ও কিন্তু মিশুকে সহজে সবার আপন হয়ে উঠত। অন্যদিকে শোভা ছিল রীতিমত সুন্দরী, উচ্ছল স্বভাবের মেয়ে। বিপরীত স্বভাব হলেও  দুজনে ছিল হরিহর আত্মা।   
---
মিতারা ছিল পূর্ব বাংলার লোক। জমিজমা কিছু ছিল না, বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। এক ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে মোটামুটি চলে যেত। সব ছেলেমেয়েই স্কুলে যেত। মিতা ছিল মেজ এবং ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী, বাবা আর বড় বোনের মিতাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ও গর্ব। দিদি যখন সবে স্কুলের গণ্ডি পার হয়, তখন বাংলাদেশ যুদ্ধ চলছিল। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যদের ভয়ে মিতারা ভারতে চলে আসে। কিন্তু বাবা দেশ ছেড়ে আসার দুঃখ সহ্য করতে পারেননি। এদেশে কাজকর্মের বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। বড় মেয়ে পড়াশুনা ছেড়ে দুইবেলা বস্তিতে বস্তিতে বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ শুরু করে, বাবাও প্রথমে তাই করতেন। তাঁদের দুজনের প্রবল ইচ্ছা মিতার পড়াশুনা যাতে বন্ধ না হয়, যদিও মিতার মা এ ব্যাপারে ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। মিতা ঘরের কাজকর্ম, ছোট ভাইবোন দুটিকে দেখাশুনার সাথে তার পড়াশুনা বাবা ও দিদির সাহায্যে চালিয়ে যেতে থাকে। ইচ্ছে প্রাইভেটে বোর্ডের পরীক্ষা দেবে। 
--
কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বাবার মৃত্যু সব স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়ে যায়। দিদির একার পক্ষে পুরো সংসারের দায়িত্ব নেওয়া অসম্ভব হওয়াতে মিতা দিদির অমতেই একটা কারখানায় কাজ যোগাড় করে নিতে বাধ্য হয়। তবে বাড়ীতে মায়ের তীব্র বিরোধীতা সত্ত্বেও সব কাজের মধ্যেও রাত জেগে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকে। দিদি অবশ্য সবসময় তাকে উৎসাহ দিয়ে যায়। কিন্তু এই টুকু সুযোগ ও তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। 
---
সংসারের অভাব মেটাতে মিতা দিদির ঘোরতর অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায়ই ওভারটাইম করত। ফিরতে রাত হয়ে যেত, তার বিপদের আশংকায় দিদি অস্থির হয়ে পড়ত। বড় রাস্তা থেকে একটা কালভার্ট পেরিয়ে তাদের বস্তির পথ। সেখানে শাসক দলের কিছু বাজে ছেলে মদ খেয়ে মাতলামি করত, মেয়েদের পিছনে লাগত। দিদির ভয় কে সত্যি করে একদিন মিতার ফিরতে একটু বেশী রাত হয়ে যায়, সারা রাস্তা নির্জন, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসার পথে মিতা তাদের খপ্পরে পড়ে।  অনেক অনুনয়, চেঁচামিচি, ধস্তাধস্তি করেও তাদের হাত থেকে মুক্তি পায়না। জনা ৫/৬ জন তাকে একটা নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে, রক্তার্ত আর মুর্ছিত অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়। 
---
সারা রাত উৎকণ্ঠায় থেকে কাক ভোরে দিদি দুই একজন বস্তিবাসীকে নিয়ে মিতাকে খুঁজে বার করে এবং থানায় খবর দেয়। পুলিশ মিতাকে ভিক্টিম হিসাবে তাদের সেফ কাস্টডিতে নেয়। এরপর সেই একই বস্তাপঁচা ইতিহাস। মিতা ঘটনার যথা সম্ভব বর্ণনা দেয়। বস্তিবাসী রা কালভার্টের ওপর সন্ধ্যারাতের বখাটে ছেলেদের মাতলামি, মেয়েদের পিছনে লাগা এবং অসভ্যতার কথা বিবৃত করে। মিতাকে পুলিশ কাস্টডি থেকে জেল কাস্টডিতে চালান করা হয়। কেস ফাইল হলেও কোন লাভ হয় না। টি আই প্যারেডে মিতা ঠিক মত কাউকে চিনতে পারেনি ,"একে অন্ধকার রাত, চেহারা গুলি ভাল করে বোঝা যায় না। ভুল করে যদি নির্দোষ কোন লোককে সনাক্ত করে ফেলি, মনের মধ্যে সেই ভয়রে দিদি,তাইতো সব গুলিয়ে গেল।"  মিতার দিদি মোটামুটি বোনের জন্য যথাসাধ্য করার চেষ্টা করলেও, মায়ের ঘোরতর আপত্তি এবং বখাটে গুন্ডাদের ভয়ে  মিতাকে ছাড়িয়ে বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারেনা। আলিপুর প্রেসিডেন্সী জেল তার ঘরবাড়ী হয়ে দাঁড়ায়। 
---
শোভার ক্ষেত্রে ঘটনাটা ছিল অন্যরকম। শোভা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, স্কুলে পড়ত। তাদের পাড়ায় একটি বড়লোক বাড়ীর ছেলে শোভার রূপে আকৃষ্ট হয়ে প্রেম নিবেদন করে। কিশোরী শোভাও তার প্রেমে পড়ে। সে প্রেমে কোন খাদ ছিল না, মনপ্রাণ দিয়ে ছেলেটিকে ভালবাসে, বিশ্বাস করে। তাই ছেলেটি বিয়ের প্রস্তাব দিলে নিজের বাবামা এর অমতে শোভা সাড়া দেয়। দুজনে পালিয়ে গিয়ে কালীঘাটে বিয়ে করে এবং ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। মাস ২/৩ বাদে ছেলেটির হাতের পয়সা যথারীতি ফুরিয়ে যায়, ফলে বাধ্য হয় বাড়ী যায় টাকা যোগাড় করতে। ছেলেটির পরিবার সেই সুযোগে দুজকেই যার যার বাড়ী ফিরতে পরার্মশ দেয়, সামাজিক ভাবে তাদের বিয়ে দেবার প্রস্তাবে। দুজনে মহানন্দে বাড়ী ফেরে। 
---
কিন্তু ছেলেটা বাবামায়ের কথায় আত্মসমর্পণ করে, সম্ভবত শোভাকে যথেচ্ছ ভোগ করে তার নেশা কেটে যায়। এদিকে শোভা তখন সন্তানসম্ভবা। ছেলের বাড়ী থেকে তাঁদের এড়িয়ে চললেও, শোভা বিশ্বাস হারায় না। কিন্তু তার বাবামা ছেলের বাড়ীর মতলব বুঝে থানায় নালিশ করে। পুলিশ দুজন কে ধরে নিয়ে যায়, ছেলেটির বাবার প্রভাবে দুজনের জবানবন্দী আলাদা করে নেয়। কোর্টে কেসের শুনানির সময় শোভা সরল বিশ্বাসে সব কথা বলে এবং স্বীকার করে দুজনের স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। ছেলেটি সব অস্বীকার করে। ফলে পয়সার জোরে ছেলেটি জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। আর শোভা ভিক্টিম হিসাবে যথারীতি জেলকাস্টডি পায় এবং প্রেসিডেন্সী জেল তার আশ্রয় হয়।
---
শোভার মনের বিশ্বাস তাতেও ভাঙেনা। তার ধারণা হয় সন্তানের জন্ম হলে  তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ীর লোক সব ভুলে তাকে ঘরে নিয়ে তুলবে। এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে তার দিন কাটে জেল হাসপাতালের তোষোকচাদর শূন্য খালি মরচে ধরা লোহার খাটে। যেদিন শোভা সন্তান প্রসব করল, তার আগের দিন তার স্বামী এক বড়লোকের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলল। হাসপাতালে বাবামা এর মুখে এই খবর পেয়ে জীবনের প্রতি সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে খান খান হয়ে গেল। গভীর রাতে বাচ্চাটা মরচে ধরা খাটে টিটেনাসে মারা গেল। কদিন পরে নির্বাক, হতবাক শোভা হাজতি নম্বরে বদলি হল। এই দুর্দিনে মিতা প্রথম শোভাকে কাছে টেনে নিল। সেই শুরু তাদের বন্ধুত্বের।
--
ধীরে ধীরে শান্তি মাসি, হাসিনা, হাওয়া বিবি, শ্যামলী ইত্যাদি সকলে মিলে পরম যত্নে তাকে ঘিরে ধরল, আর বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনল। কিন্তু বাবামা অনেক করে বাড়ীতে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও শোভা ফিরতে চাইল না, "প্রতিদিন আমার চোখের সামনে নতুন বৌ নিয়ে সে ঘুরে বেড়াবে, আমাকে দেখিয়ে আনন্দ করবে, আমাকে বিদ্রূপ করবে, সে আমার আত্মায় সহ্য হবে না, সম্মানে লাগবে। আমার মত বোকার পক্ষে এই জেল ই ভাল। " কিন্তু জেল যে কেমন নরক, পদে পদে মৃত্যু  এখানে ফাঁদ পেতে বসে, ধীরে ধীরে শোভা সেটা বুঝেছিল।              
---
মিতা হাসিনাদের মত আমাদের সাথে মেয়াদী নম্বর দিয়ে কথা বলত, আমাদের রাজনীতির কথা শুনত। আমাদের সঙ্গে, বিশেষ করে মীনাক্ষীর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়। শোভা কিন্তু আমাদের একটু এড়িয়েই চলত,কল্পনার সাথে একটু সহজ ছিল। প্রতিবাদ দেখলে সরে যেত। অবশেষে এল সেই দিন যেদিন হাসিনা, মিতা, হাওয়াবিবি, মদিনা, শান্তিমাসি, শ্যামলী ইত্যাদি প্রায় জনা ২০/২৫ মেয়ে কম খাবার দেওয়া,  হয় কথায় নয় কথায় মারধর করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল, লক আপ হল না।  আমরা ওদের সমর্থনে লক আপ হলাম না। মিতা সহ সব বান্ধবী প্রতিবাদে নেমেছে সেখানে শোভা দূরে সরে থাকে কি করে, সে ও যোগ দিল। সেদিন ওই লড়াইয়ের মুখে কতৃপক্ষ নত হয়, দালালরা ক্ষমা চায়, মেট্রন ঠিক মত খাবার দেবার আশ্বাস দেয়। অবশ্য সাধারণ বন্দিনীদের মধ্যে প্রতিবাদী মুখগুলি কে চিনে রেখে দিল।
---
জেলে অনেক অসৎ কর্মচারী ও ওয়ার্ডার রা বাইরে রেড লাইট এরিয়ার মাসি ও দালালদের সাথে যোগাযোগ রাখত। সুযোগ বুঝে অনেক মেয়েকে নানা প্রোলভন দেখাত, যেমন বাড়ী পৌঁছে দেওয়া, বাইরে কাজ পাইয়ে দেওয়া, কখন সুলভে বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে, তাঁদের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মেয়ে চালান দিত। এই রকম একটি খারাপ ওয়ার্ডারের নজর পড়ল শোভার ওপর।  ওর সৌন্দর্য্য দেখে তার জিভ লালায় ভরে গেল। সে সুযোগ পেলেই ওকে ডেকে কথা বার্তা বলত। শান্তিমাসী প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আমাদের ওদের দলের সবাইকে জানিয়ে দিল।
--
সেই প্রথম শোভা হাসিনা মিতাদের সাথে ছুটে এল আমাদের কাছে। শোভাকে ভাল করে সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা হল। ও প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গেল। ওকে সকলে মিলে সাহস দিয়ে বলল," ভয় পেলে আরও পেয়ে বসবে, সাহস রাখ। সব সময় আমাদের সকলের মাঝে থাকবি। তোকে একা ডাকলেই কাউকে সাথে নিয়ে যাবি, পারত পক্ষে ওর ধারে কাছে যাবি না। " একদিন যখন সেই ওয়ার্ডার শোভাকে ডেকেছে দেখেই, শান্তিমাসি সঙ্গে গিয়ে হাজির, "কি গো মা,আমাদের ডাহেন ক্যান, কি কইবেন কন, আমাগো আবার ম্যাট্রন মা অনেক কাম কর্থে কৈছেন। শ্যাষ না হইলে জিগাইলে আপনার কথা কইতে লাগব। " জোঁকের মুখে নুন পড়ল। শোভাকে উনি দালালির ক্ষেত্রে মেট্রনের সাথে ভাগ করতে রাজী নন, তাতে লাভের গুন পিঁপড়ে খেয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি বললেন," না না, মেট্রনমার  তোমাদের কাজের কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম।" কিন্তু এভাবে কদিন ঠেকান যাবে, আমরা মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম।
---
এবার বিপদ এল অন্য দিক দিয়ে। জেলে ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে  সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা মেয়েদের ওয়ার্ডে নানা কাজে আসত, সেই সময় মেট্রনের দালাল হয়ে যাওয়া মেয়েরা দালাল ওয়ার্ডারদের তদারকিতে তাদের সাথে প্রেম ও মাখামাখি করত। চিঠিপত্র চলাচালি চলত। অনেক সময় ত্রিকোণ, চতুস্কোন ইত্যাদি নানা প্রেমের ফলে মেয়েদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি হত। শোভা ফেঁসে গেল এই গোলমালের মধ্যে। তার হাতের লেখা সুন্দর, সে পড়াশুনা জানা মেয়ে। প্রেমে পড়া দালাল মেয়েরা সবাই তার কাছে চিঠি লেখাতে আসত। সুন্দর হস্তাক্ষরে মন মাতাল করা ভাষায় প্রেমপত্র লিখে দিত সবাইকে। ওর বন্ধুরা আর  আমরা সকলে বারণ করা সত্ত্বেও শোভা  প্রেমপত্র লেখা ছাড়তে পারল না," আমার মনে হয় যখন আমি প্রথম ওই ছেলেটাকে ভালবেসেছিলাম, তখন যেন ওকে চিঠি লিখছি, বিয়ের প্রথম দিনগুলিতে যেন বরকে চিঠি লিখছি ,এইটুকু ভাল লাগা ছাড়া আর কি আছে আমার,বল তোরা। " "কিন্তু ধরা পড়লে তোরই বিপদ হবে, কেউ কিন্তু স্বীকার করবে না। "
ভবি ভোলবার নয়।
---
অবশেষে মীরাকে লিখে দেওয়া চিঠি পড়ল হামিদার হাতে। হাতের লেখা যে শোভার বুঝতে দেরী হল না, হামিদাও যে অনেক চিঠি লিখিয়েছে। সে শোভাকে শাসাতে লাগল," আজ লক আপ হোক না, কি করি দেখবি।" ভয়ে শোভা আর তার বদ্ধুরা ছুটে এলো আমাদের কাছে। " আমাদের দরজা তো সারাক্ষণ বন্ধ থাকে। আমরা তো তোদের কাছে যেতেই পারব না। আর লক আপের পর ওরা কিছু করলে তো তোদের সবাইকে দল বেঁধে প্রতিবাদ করা ছাড়া কোন পথ নেই। ভয় পেলে চলবে না। সবাই মিলে ওকে ঘিরে থাকিস। "  
---
সেদিন রাতে হাজতি নম্বর থেকে প্রচন্ড চিৎকার চ্যাঁচামিচি শোনা গেল। পরদিন সকাল হতে মেয়াদী নম্বরের জালনায় আমরা পালা করে হাজির থাকলাম, শোভারা কেউ এল না। মেয়াদী ঘরের মাসিদের সাথেও কথা বলা যাচ্ছে না। কারণ একজন না একজন দালাল সব সময় নজর রাখছে। সারাদিন ওই ভাবে গেল, সারা ফিমেল ওয়ার্ড যেন থম থম করছে। রাতে একজন ভাল ওয়ার্ডারের ডিউটি পড়ল আমাদের ডিভিশন ওয়ার্ডে। তাঁর মুখে শুনলাম রাতে হামিদা দলবল নিয়ে শোভাকে মারতে চেষ্টা করেছিল ,তবে তার বন্ধুরা পাল্টা রুখে দাঁড়িয়েছে। হাজতী নম্বরের অন্য অনেক  মাসীরাও শোভাদের পক্ষে ছিল। মেট্রনের কাছে হামিদা নালিশ করার পর মেট্রন হেড জমাদার আর মেয়ে ওয়ার্ডারদের নিয়ে শোভাকে পাগল বাড়ীতে দিয়েছে, মিতা আর মদিনাকে পাগলবাড়ীর মেটের ঘরে রেখে দিয়েছে।
---
পরদিন আমরা কয়েকজন ডাক্তারদের আর ওয়েলফেয়ার অফিসার কে ব্যাপার টা জানালাম। তাঁদের মধ্যস্থতায় দিন ২/১ বাদ দিয়ে মিতা হাজতী নম্বরে ফিরে আসে। মদিনা আর শোভা পাগলবাড়ীর মেটের ঘরে আছে। মদিনার নন ক্রিমিন্যাল লুনাটিক কেস ছিল বলে মেট্রন সেই সুযোগ টা নিয়েছে। আর শোভা মিতাকে বলেছে হাজতী নম্বরে ফিরলে হামিদারা ওকে মেরে ফেলবে। তাছাড়া ওখানে থাকলে খারাপ ওয়ার্ডারটার কুদৃষ্টির হাত থেকেও বাঁচবে। " কিন্তু জেলের কুচক্র যে কোন কাউকেই ইচ্ছে করলে  তার অমতে হাসিনার মত চালাকি করে বার করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিতে পারে না জানি কোন অন্ধকারে।
---
আমরা ভেবে দেখলাম আপাতত শোভার পক্ষে এটাই ভাল। অবশ্য জেলখানায় সব ভালই সাময়িক। এখানে চূড়ান্ত ভাল আর চূড়ান্ত মন্দের খেলা চলে অনবরত। এখানে একদিকে একটুরো রুটির জন্য মানুষ দালালি করে, অন্যদিকে এক মা তার বুকের দুধ অন্যের সন্তানকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে, নিজের ভাগ অন্যেকে নির্বিচারে দান করে। এখানে কত মানুষকে পিটিয়ে মেরে রাতারাতি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে ,অনাহারে মরেছে কত পাগল। জেলের প্রতিটি কোনে শোনা যায়, জানোয়ারের চেয়েও অধম অবস্থায় রাখা পাগলদের গোঙানি, দুঃখী মানুষের হাহাকার, মীরা,শোভাদের মত মেয়েদের  আর্তনাদ, আর অন্যদিকে শোনা যায় হয়তো বা একটা কুমড়ো চুরির অপরাধে ধৃত গ্রামের মানুষের মেঠোগলায় অথবা  শংকরের মত শিশুগলায় শোষণের আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গান, রাজনৈতিক দলের স্লোগান আর প্রতিবাদের ও লড়াইয়ের  গান।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পরিশিষ্ট
******
কাগজে দেখেছিলাম কালীঘাটের ধর্ষিতা ভিখারিনী শিশুদুটিকেও ভিক্টিম হিসাবে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভবত মিতা, শোভা, হাসিনাদের মত সেফ কাস্টডি হিসাবে কারেকশন হোমে (যা নাকি জেলের বর্তমান নাম, আদতে একই জিনিষ, কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ ) নেওয়া হবে আর তাদের ভাগ্যেও একই পরিণতি লেখা আছে,একটু একটু করে তিলে তিলে নরকের আগুনে পুড়বে, শেষে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাবে। তাই মনে হয় পুরো ব্যবস্থাটিকে নতুন করে ঢেলে না গড়লে সমাজের বুকের এই ক্ষত থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------















  

22 Nov 2019

কর্ষিত জমিন

কর্ষিত জমিন
************
সত্তর সালের ডিসেম্বর মাস, অফিস টাইম, স্টেশনের লোক্যাল ট্রেনগুলিতে উপচে পড়া ভীড়। দুটি কিশোর আর একটি কিশোরী ধস্তাধস্তি করছে হাওড়াগামী ট্রেনে ওঠার জন্য, কিন্তু কিছুতেই একসাথে ট্রেনে উঠতে পারছে না। একজন ওঠে তো বাকী দুজন নীচে থেকে যায়, ফলত প্রথম জনকেও নেমে আসতে হয়। এমনিতেই এখান থেকে হাওড়ার ট্রেনের সংখ্যা কম। শেষে তারা ঠিক করে স্টেশনের বেঞ্চে বসে নিজেদের কাজের কথা বার্তা সেরে নিয়ে অফিস টাইমের ভীড় কমলে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করবে। একটু পরে ভীড় কেটে গেল বটে পরের ট্রেন প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে। ট্রেনের অপেক্ষায় থেকে, নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলতে থাকে।
--
কপাল মন্দ ! জাঁদরেল এক টিকিট চেকার এসে তাদের ধরে বলে তারা নিশ্চই বিনা টিকিটে ট্রেনে এসেছে। স্বভাবতই তারা প্রতিবাদ জানায় ,"আমরা হাওড়া স্টেশনের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, এইতো আমাদের কাছে হাওড়া যাওয়ার টিকিট আছে।" "তাহলে তোমরা কর্ড লাইনের ট্রেনে বিনা টিকিটে এখানে এসেছ, হাওড়ার টিকিট কেটে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছ। অনেকক্ষন ধরে তোমাদের আমি লক্ষ করছি, এখানে বসে গল্প করছ।" " হ্যাঁ ,তা করছি কারণ অফিস টাইমের ট্রেনে এত ভীড় যে আমরা উঠতে পারছিলাম না।" "তোমরা সব বিশ্ব বখাটে ছেলেমেয়ে, টিকিট ফাঁকি দিয়ে এখন গল্প বানাচ্ছো। চলো অফিসে, স্টেশন মাস্টারের ঘরে।" "ঠিক আছে চলুন ", বলে তিনজন চেকারের পেছন পেছন স্টেশন মাস্টারের অফিসে যায়।
--
সেখানে বেশ জনা কতক ট্রেনের কর্মচারী বসেছিলেন। দু /চার জন উৎসাহী লোকজনও জুটে গেল। নানা রকম টিকা টিপ্পুনি শুরু হয়ে যায়। "কিহে বিনা টিকিটে ট্রেনে সফর করছ "  "ওহে, এই বয়সেই প্রেম করছো ", " কি বেহায়া মেয়ে দেখেছেন, একজন দুটোকে নাচাচ্ছে ", ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা তিন জন প্রতিবাদ করে উঠলো, " আমরা মোটেও বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়িনি, আমাদের সাথে টিকিট আছে ", "কেন আজেবাজে কথা বলছেন, আমরা বন্ধু, এক পাড়ায় থাকি।"
এই ভাবে তর্ক বিতর্ক চলে, ঝামেলা বেশ পাকিয়ে উঠল। কেউ বলে আচ্ছা 'ধড়িবাজ', কেউ বলে 'বেয়ারা, বখাটে ', কেউ বলে 'কান ধরে ওঠ বস করান।'  শেষ পর্যন্ত স্টেশন মাস্টার বলেন, "কই দেখিতো হাওড়ার টিকিট কই?"
--
ওদের মধ্যে লিডার গোছের ছেলেটি তিনটি টিকিট বার করে দেয়। স্টেশন মাস্টার টিকিট তিনটি হাতে নিতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একজন  চেকার স্টেশনমাস্টাররে  হাত থেকে টিকিট তিনটে নিয়ে বলে ওঠেন," আরে একি, তোমাদের মধ্যে কে নাবালক ?" লিডার গোছের ছেলেটি বলে,"আজ্ঞে আমি, মানে হাফ টিকিটটা আমার। আর ফুল টিকিট দুটি ওদের দুজনের।" সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কিশোরটিও সবার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম একটা হাসি ছাড়ে। এদিকে কিশোরীটি আর অপর কিশোরটি তো অবাক তাদের সাথীর দিকে তাকায় আর ভাবে, "এটা কি উদ্ভট কাজ করেছে আকাশ, আর কেন করেছে ! ওর কি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে, তিনজন সাবালক তারা, তাহলে কেনই বা দুজনের ফুল টিকিট আর একজনের হাফ টিকিট!" মাথা মুন্ডু খুঁজে পায় না।
--
চেকারটি আকাশ কে ধমকে ওঠে," চুপ করহে বাচাল ছোকরা, এখনই পুলিশে তুলে দেব তিনজনকে। " আকাশ গম্ভীর ভাবে বলে, "না ,তা আপনি করতে পারেন না, আমাকে পুলিশে দিতে পারেন হাফ টিকিটের জন্য, কিন্তু ওদের দুজনকে পুলিশে দিতে পারেন না, ওদের তো ফুল টিকিট আছে। "  সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সেই জাঁদরেল চেকারটি লাফিয়ে পড়ে, "দাঁড়াও, তোমার হাফ টিকিট আর ফুল টিকিট বার করছি। প্রথমেই আমি বলেছিলাম বিনা টিকিটে ট্রেন ধরে কর্ড লাইন থেকে এখানে এসেছো, হাওড়ার ট্রেন ধরার জন্য। মেন্ লাইন বলে ভয়ে দুটো ফুল আর একটা হাফ টিকিট কেটেছ , আর মিথ্যা কথা বলেছ। " আকাশ বলে." আমরা মিথ্যা কথা মোটেও বলিনি। "
--
এবার কিশোরী আর অন্য কিশোরটি ময়দানে নামে," দেখুন,ও খেয়াল করেনি। নাহলে দুটো ফুল টিকিট কাটল যখন এক তখন একটা হাফ কাটবে কেন! আমরা হাফ টিকিটের বদলে আর একটা ফুল টিকিট কেটেঁ নিচ্ছি। আমাদের বিরাট ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দিন। " "কভি নেহি ,পুলিশে তোমাদের দেবই দেব। কদিন জেলে ঘানি টেনে এস তবে তোমাদের শিক্ষা হবে বাছাধন। " কিশোরী টি আস্তে আস্তে স্টেশন মাস্টারের কাছে ঘেসে বলতে শুরু করল," দেখুন মাস্টার  মশাই , আপনিই ভাবুন এই রকম ফাঁকি কেউ দেয়, হয় টিকিট কাটে না, নয়তো তিনটেই হাফ টিকিট কাটে। একসাথে তিনজন সাবালক যাচ্ছি, সেখানে এ রকম বোকামি ইচ্ছে করে কেউ করে !" " আমিও তো বুঝে উঠতে পারছি না, এ কি রকম বুদ্ধি ! আর তুমি মা একটা মেয়ে সঙ্গে আছো, কি যে করি !" জাঁদরেল চেকার টি চেঁচিয়ে ওঠে, "মাস্টারমশাই আপনি নরম হবেন না। ওদের পুলিশেই দিতে হবে। "
--
এবার উপস্থিত মানুষদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেল। কেউ বলে 'পুলিশে দেওয়া ঠিক,'  বিরোধী পক্ষ বলে 'ছেড়ে দিন, অল্প বয়েসের ছেলে মেয়ে, কিছু একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে, সঙ্গে একটা মেয়ে আছে'  ইত্যাদি, ইত্যাদি। দু /চার জন আবার বললে, 'কিন্তু সত্যি কি ঘটনা হয়েছে সেটা জানা দরকার।' হটাৎ আকাশ সবাই কে চমকে দিয়ে বলে উঠল, "আমার কাছে দুটো ফুল আর একটা হাফ টিকিটের বেশী পয়সা ছিল না, আমরা তিনজন গরীব মানুষের পার্টি করি, আজ আমাদের কলকাতায় ফিরতেই হবে তাই এ ছাড়া উপায় ছিল না ," আকাশ মুখ খোলার সাথে সাথে অপর কিশোর টি ও তাদের রাজনীতি প্রচার করতে শুরু করে দিল। কিশোরীটি ব্যাগ থেকে পার্টির কাগজ পত্র বার করে বিলোতে থাকল। তিনজন তিনটে গ্রূপ করে তাদের পার্টির মতাদর্শ প্রচার করতে শুরু করে দিল। নির্বাক হয়ে জনতা তাদের কথা শুনলো। কাগজ পত্র পকেটে পুরে ফেললো। অনেকেই বলে ফেলল," সত্যি এই সমাজ টাকে বদলানো দরকার, তোমরা হয়তো পারবে। আমাদের শুভেচ্ছা তোমাদের সাথে থাকল। "
--
ইতিমধ্যে হাওড়াগামী ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। স্টেশনমাস্টার তিনটে ফুল টিকিট ওদের হাতে দিয়ে বলল ,"এ রকম ভুল আর কোরনা, সাবধানে থেক। " জাঁদরেল চেকার টি ওদের সঙ্গে করে খালি কামরা দেখে  ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বলল ,"সাবধানে যেও ভাই। " আর ট্রেনে উঠেই অন্য কিশোর আর কিশোরী দুজনে মিলে দুদিক থেকে আকাশের দুই কান ধরে টেনে ধরল, "হতভাগা  আমাদের বাঁচিয়ে নিজে শহীদ হতে গিয়েছিলি। তবে জনতা যে সত্যিকারের কর্ষিত উর্ব্বর জমিন, প্রয়োজন শুধু উৎকৃষ্ট বীজের, এটা আবার প্রমান হল।  "
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
              










1 Oct 2019

কাশ্মীর

কাশ্মীর
******************

শৈশব বন্দী ভয়ের শেকলে
কৈশোর কে বেঁধেছি কাঁটাতারে
যৌবনের তরে বুলেট বৃষ্টি অকাতরে
প্রবীণ আর বৃদ্ধদের ভরেছি কারাগারে।
-----
তবুও জব্দ হয়নি জনতা
মনোবল ওদের আজও অক্ষুন্ন
মোদের হাতে যে অসীম ক্ষমতা 
প্রতিবাদের ঝড়ে তা অতি নগন্য।
-----
দুস্তরলোভ,পৃথিবীটাকে আস্ত
গিলে খাবার বাসনা মোদের,
কিন্তু দমরুহাতে প্রলয়ঙ্করী
তান্ডবনৃত্য  জনতানটরাজের।
-----
মুক্তির স্বপ্ন ওদের পাখির ডানায়
ডাকাতিয়া বাঁশীর নেশায় মাতাল
রোখে সাধ্য আছে আর কার,সূর্য্য
উঠবে চারিধার করে লালে লাল।
শেষ জয়ের হাসি হাসবে পাহাড়
অত্যাচারীর মুখে গ্রহণের আঁধার।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

20 Sept 2019

বহতা সময়ের অঙ্গীকার

বহতা সময়ের অঙ্গীকার
*****************

নিতান্ত আটপৌরে যাপনেও কোথায় যেন
একটা বিষম রকম চিড় খেয়ে গেছে ,
সকালের চা আর খবরের কাগজ মধ্যবিত্ত জীবনে
এক চলমান চিরাচরিত ধারাতেও ঘুন ধরেছে,
কাগজের প্রতিটি পাতা যেন নিঃশব্দ চোখের জল
চায়ের কাপে মিশে মিশে স্বাদহীন করে তোলে।
--
অনাহার, অর্ধাহার, আত্মহত্যা, খুনোখুনি, ধর্ষণ
বেশ কিছু হল প্রতিদিনের ডাল ভাতের মত জোলো,
নোটবন্দী, দেশের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অনায়াসে
বিদেশে পালানো যেন নেহাৎ ই ছোট্ট একটু মশার কামড়।
বিদেশীদের কাছে প্রাকৃতিক সম্পদ, জনতার জন্মসূত্রে অর্জ্জিত
অধিকার গুলি কোন অদৃশ্য হাতের খেলায়  বিক্রী হয়ে যাচ্ছে।
স্কুল কলেজে গুন্ডাবাজী দেখে দেখে আমাদের চোখ ক্লান্ত
নোঙ্গর ফেলা জীবনে সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবে ঘটে চলছে।
--
কিন্তু আসামে দেশের মানুষ যখন বিদেশী তকমা পেয়ে ক্যাম্পে
বাস করতে বাধ্য হয়, কাশ্মীর যখন সংবিধান স্বীকৃত অধিকার খুইয়ে
কাঁটাতারের ঘেরাটোপে থাকে, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়
সেনাপরিবেষ্টিত বসতি, যখন নিত্যদিন বুলেটবৃষ্টি ঘটে চলে সেখানে,
তখন দাঁড়িপাল্লার মত দোদুল্যমান জীবনেও ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়।
--
যাঁরা চিরকাল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছে,তাঁদের ফেলে যাওয়া
পদচিহ্নের ওপর যে পলিমাটির স্তর সৃষ্টি হয় তাতে সোনাগলা ফসল
ফলে, দিগন্তের কোনে ঝুলে থাকে লাল সূর্য, রাতের সাগরে
ডুব দিয়ে ওঠে অজন্তার পূর্ণিমার চাঁদ, ফুলের মত অসংখ্য তারা,
হৃদয় মোচড়ানো কান্না পরিবর্তিত হয় বহতা সময়ের নুপুর ঝংকারে।
নির্মল শিশির সিক্ত পরিযায়ী বাতাসে মন্দ্রিত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়,
"এই পৃথিবীর মানুষ আর নতুন করে কোন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
বা ইহুদি ঘেটো তৈরী করতে দেবেনা, দেবেনা, দেবেনা। "
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------














3 Sept 2019

শান্তিমাসীর ঘরকন্না

শান্তিমাসীর ঘরকন্না
***************
শান্তিমাসী জেলে এসেছিলেন পাসপোর্ট কেসে। তখন তাঁর বয়স ৩০এর মধ্যে, বাংলা দেশের মানুষ। ছোটখাটো কিন্তু কর্মঠ চেহারা। সম্ভবত বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত, গলায় তুলসীর কন্ঠী, নাকে রসকলি আঁকা। মনটি ছিল দয়ামায়ায় ভরপুর।
মাসীর কাছে শুনেছিলাম খুব কৈশোরেই  দোজবরে বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর আগের পক্ষের দুটি ছেলেই শান্তিমাসীর থেকে বয়সে বড়, এবং বিবাহযোগ্য ছিল। তথাপি ছেলেদের বিয়ে না দিয়ে শ্যামলা চেহারায় মিষ্টি মুখশ্রী ও ফুটন্ত যৌবনের টানে স্বামী নিজেই বিয়ে করেন। সংসারে স্বাচ্ছন্দের অভাব ছিলনা। কিন্তু বিয়ের সাথে সাথেই স্বামী গোয়াল সামলান, ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ, ধানভানা, চিঁড়েকোটা, সবজি বাগান দেখভাল সমস্ত কাজ সদ্যকিশোরী মেয়েটির উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, যাতে তাঁকে সারাদিন ব্যস্ত রাখা যায়।
--
মানুষটি ছিল প্রচন্ড সন্দেহপ্রবন ও কামুক প্রকৃতির। ঘরে দুটি জোয়ান ছেলে, তাই কঠোর নজরদারী। কাজের তোড়ে বউ এর যখন নিশ্বাস ফেলার সময় নেই তখন এসে নিজের শারীরিক খিদে মেটাত, দিনের মধ্যে কত বার যে এ ঘটনা ঘটাত তার ঠিক ঠিকানা থাকত না। শরীরে না পোশালেও কোন রেহাই ছিল না, আপত্তি করলে পৈশাচিক ভাবে তাকে ধর্ষণ করত। একটা  সময়ের পর মাসীর মনে মাতৃত্বের সাধ জাগে, কিন্তু সে গুড়েও বালি। এদিকে নিজের প্রৌঢ়ত্বের অক্ষমতা তার স্বামীকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলত। নাতনীসম কিশোরী মেয়েটির মন বা শরীরের খবর রাখা স্বামীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ত না, শারীরিক খিদে মেটান আর সংসারের সাশ্রয় করার কল ছিল সে। সব সময় সন্দেহ যে জোয়ান ছেলে দুটির প্রতি আকর্ষণ বশতঃ শান্তিমাসীর তার প্রতি অনীহা।  এত বিকৃত অত্যাচার দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে মাসীর জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে, পরিত্রানের পথ খুঁজতে থাকেন।
--
সুযোগ এসে যায় বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের কিছুকাল পরে কিছু পরিচিতজন ও স্বজন পালিয়ে চলে  আসছিল। মাসী তাঁদের সাথে চুপি চুপি ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসেন। পথে সীমান্তরক্ষীদের হাতে পড়েন, এ থানা ও থানা ঘুরে প্রেসিডেন্সি জেলের হাজতী নম্বরে ঠাঁই পান। ধীরে ধীরে এখনকার ব্যাপার স্যাপার বুঝে নেন। আস্তে আস্তে  আমাদের সাথে আলাপ হয়, আমাদের মধ্যে বুলুর সাথে মাসীর বেশী ভাব জমে ওঠে। তাছাড়া হাজতি নম্বরে মদিনা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, শোভা, মিতাদের স্নেহ দিয়ে কাছে টেনে নেন, ক্রমে তাঁদের গার্জিয়ান হয়ে ওঠেন। কোন সময়ে কোন কারণে তাঁরা অবাধ্যতা করলে দু কথা শোনাতে ছাড়তেন না, আবার কারোর শরীর বা মন খারাপ হলেও সেবাযত্ন আর হাসি মস্করা করে তাঁদের ভুলিয়ে রাখতেন। কিন্তু কোন কারণে যদি ওঁর কথা না শুনতো বা মাসীর মুখে মুখে কথা বলত, তিনি চোখের জল ফেলতে ফেলতে মেয়াদী নম্বরের গরাদের কাছে, আমাদের সাাথে ফাঁক দিয়ে কথা বলার জন্য ছুটে আসতেন, তাঁর কষ্টের কথা জানাতেন, "দ্যাখতো, আমার তো সত্যকার ঘরকন্না তো কোনদিন হইল না, মা হইতে পারি নাই।  অদের দিয়া ঘরকন্নার স্বাদ মিটাই, মা না হওনের দুখ ভুলি। হেয়ারা হেই কথাডা বঝতে চায় না। অদের যা কোই, অদের ভালার  জন্যি তো কোই।" আমরা তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করতাম, দোষী ব্যক্তি কে একটু বকতাম, মিটমাট হতে সময় লাগত না। অবশ্য শান্তি মাসীর চোখের জল ওরা সহ্য করতে পারত না,  তাই বেশীর ভাগ সময়েই ওরা নিজেরাই মিটমাট করে নিত।
--
শান্তি মাসীর পুষ্যিদের মধ্যে বেশ কজন হারানো বাচ্চা ছিল, যাদের কেউ দেখার ছিল না। জেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে ওরা নাম কে ওয়াস্তে ছিল, ওদের প্রকৃত আশ্রয় ছিল শান্তি মাসী। কে খাবাার ধরেনি, মাসী দালাল আর মেটদের সাথে নরমে গরমে কথা বলে তার খাবার ধরে নিয়ে আসতো, না পেলে নিজের খাবারের থেকে ভাগ দিত। কোন বন্দিনী অবাক হলে মাসী বলতেন,  " অরে আমাগো না খাইয়া থাকার অভ্যাস আসে, হেয়ারা পোলাপান মানুষ, ক্ষিদা সঝ্য করবো ক্যামনে !" জেলের ভিতর ক্ষিদে সহ্য করা যে কি কঠিন, সকালে এক মুঠো মুড়ি, দুপুরে এক ডাব্বু ভাত আর ডালের নামে একটু হলুদ জল, চিমটি খানেক তরকারি নামক এক বিশেষ ধরনের ঘ্যাট, বিকালে তিনটে আধা কাঁচা রুটি আর সেই ডালের জল আর ঘ্যাট। এতে একজন জোয়ান মানুষ কেন বাচ্চাদেরও পেট ভরে না, সেই মুষ্টিভর  অন্ন অনায়াসে বিলিয়ে দিতে যে পারে তাঁর আত্মত্যাগের কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন হয় না।
--
কোন বাচ্চা চান করেনি, গায়ে বাহ্যি পেচ্ছাপ লাগিয়ে ফেলেছে, জলের কলের কাছে প্রচন্ড ভীড়, কাছে যাবার উপায় নাই। মাসী ঠ্যালাঠেলি করে নিজের খাবার থালায় জল ভরে ভরে এনে উঠোনের ধারে দাঁড় করিয়ে সেই অভাগাটিকে চান করিয়ে, নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে দিতেন। মেট্রন, ওয়ার্ডাররা জায়গা নোংরা করার জন্য বকলে হেসে বলতেন, "চিন্তা কইরেন না, পরিষ্কার কইরা দিমু , জল না পাইলে নিজের কাপড়খানা দিয়া মুইছা দিমু হনে। হেয়ারা গুমুত মাইখ্যা রইলে কি জ্যালার, হুপারের (জেলার,সুপার ) কাসে আপনাগো বদনাম হইব না," জোঁকের মুখে নুন পড়ত। কোন বাচ্চার জ্বর হয়েছে, মাসি মেট্রন, ওয়ার্ডার মেটদের প্রায়  হাতে পায়ে ধরে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপথ্যি আদায় করে ছাড়তো। তা সম্ভব না হলে, ভাল ওয়ার্ডার বা ভাল মেট থাকলে অথবা ডায়েট আছে এমন বন্দিনীদের কাছ চেয়ে চিন্তে  দুধপাউরুটি জোগাড় করে খাওয়াত, ওষুধের বদলে নিজের রাতে খাবার থালার জলের মধ্যে কাপড়ের কোনা ভিজিয়ে জল পট্টি দিত। ওই এক থালা জলই মাসীর রাতের খাবার জন্য ধরা থাকত। মাতৃহীন ছেলে মেয়েরা শান্তিমাসীর কাছে মাতৃস্নেহ পেয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে, মায়ের মতই ভালোবাসত।
--
এসব  দেখে মেট্রন, খারাপ ওয়ার্ডার আর দালাল বন্দিনীরা খুশী হত না। হিংসায় মেট্রন একদিন হারানো বাচ্চাদের দেখার দায়িত্ব আনোয়ারা নামে এক দালালের হাতে তুলে দেয়। আনোয়ারা অল্প বয়সে ইঁট দিয়ে তিনজন বাচ্চার মাথায় মেরে খুন করে জুভেনাইল মার্ডার কেসে বন্দিনী হিসাবে জেলে এসেছিল। বাচ্চাদের দিয়ে সে তার স্নানের জল জোগাড় করা, চুলে, গায়, হাতে, পায়ে সাবান মাখানো, তেল মাখানো এসব কাজ করাত, কেউ কোন কাজ না পারলে প্রচন্ড মারধোর করত। অদ্ভুুুত একটা হিংস্রতা ছিল তার চরিত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই শান্তি মাসির মাতৃত্ব বোধে প্রচন্ড ঘা লাগে। তখন হাসিনারা সকলে মিলে ঘিরে রাখে। নানা আবদারে তাঁকে ব্যস্ত করে রাখত, গ্রামের প্রচলিত নানান ছড়া, গান, গল্প শুনতে চাইত।ওঁদের সেসব শোনাতে গিয়ে নিজের বেদনা ভুলে যেতেন। পরবর্তীকালে যতদিন জেলে ছিলেন সবুরজানের মত ছোট ছোট শিশুগুলির দেখভাল তিনিই করতেন। মেট্রন মনেপ্রাণে সেটা মেনে নিতে না পারলেও কিছু বাধা দেয়নি কারণ এতটুকু বাচ্চাদের দেখভাল যে তার দালালবাহিনীর দ্বারা সম্ভব নয় তা সে ভালই বুঝতো।
--
মাসী নিজের জন্য এক কণা জিনিষ কোনদিন কারও কাছে চাননি, বা নিজের জন্য কখন কোন দয়া ভিক্ষা করেননি। প্রখর আত্মসন্মানবোধ তাঁকে জেলের কুৎসিত প্রভাবগুলি কে ঘৃণা করতে শক্তি যোগাত। আবার যেদিন হাওয়াবিবি, মিতা, শোভা, হাসিনা, মদিনার মত জনা ১৫/২০ মেয়ে কম খাবার দেবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল শান্তি মাসি কিন্তু তাঁদের পাশে ছিলেন। একটাই কথা তাঁর, "আমার মাইয়াগুলান লড়াই করথে গিয়া শয়তানগুলানের হাতে মাইর খাইব আর আমি দূরে দাঁড়াইয়া দেখুম, তা আমার ধরমে সইব না। " তাঁর মাতৃত্ববোধ এমনই মহান ছিল।        
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


























    

29 Aug 2019

খুঁড়িয়ে চলা মানুষ

খুঁড়িয়ে চলা মানুষ
***************
দারুচিনি রোদেও যেখানে কবরের অন্ধকার
বাউল বাতাসে শুধুই শ্মশানের নিস্তব্ধতা
কবিতার আকাশে কান্নাভেজা বিষণ্ণ জোৎস্না,
প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষা
নরকের মাঝে দিন কাটানোর চেয়েও ভয়ংকর,
যাযাবর মেঘ সেখানে রক্তের আলপনা দেয়
পিঠ কুঁজো করা সময় মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ
কাশ্মীরের ফুলের কলিতে বেয়নেটের খোঁচা,
আমরা জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া ছাপোষা
মানুষের দল তখনও খুঁড়িয়ে চলেছি।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

26 Aug 2019

গোপাল, তুই স্মৃতিতে আছিস আর থাকবি

গোপাল, তুই স্মৃতিতে আছিস আর থাকবি
********************************

কিছুদিন আগে পুরাতন এক বন্ধুর কাছে শুনলাম মাস কয়েক আগে গোপাল স্ট্রোকে মারা গেছে। প্রায় বছর ১৫/২০ আগে বোধহয় ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। কিন্তু ও যে আর নেই এখনও ভাবতে পারিনা, ৭২/৭৩ সালে আলাপের দিন থেকে  প্রতিটি স্মৃতি আজও ছবির মত মনের স্মৃতিকোঠায়  ভাস্বর হয়ে আছে। এখনও ওর সদা হাসিমাখা মুখটা চোখে ভাসে। একটা চূড়ান্ত দুঃখের সময় ও যেন দুহাত বাড়িয়ে আমাকে সব আঘাত থেকে আগলে রেখেছিল।
--
আমাদের সাথে অনেকগুলি গোপাল নামে সাথী ছিল। এই গোপাল কাঠের দোকানে খুব ভাল পালিশ মিস্ত্রির কাজ করত, তাই ওর নাম হয়ে গিয়েছিল কাঠগোপাল, অনেক সময় ওকে শুধু কাঠ বলেও ডাকা হত। আমার সাথে ওর দেখা ৭২এর শেষ ভাগে, যখন আমার চারপাশের ঘনিষ্টরা আর কাজের সূত্রে যুক্ত বেশীর ভাগ সাথীরা ধরা পড়ে গেছে। মনটা ভীষণ খারাপ, কাজের ক্ষেত্রে নতুনদের সাথে যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। মতাদর্শের ক্ষেত্রেও পার্টির ভিতর বিরোধ দেখা দিয়েছে।
--
মনের অবস্থা ঠিক এতটাই খারাপ ছিল যে মাঝে মাঝেই চোখে জল চলে আসত। গোপালের দোকানে যেদিন প্রথম গেলাম, শুনলাম আর একজন সাথীর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেই আমার চোখে জল এসে গেল দেখে ও খুব অপরাধীর মত মুখ করে বলল, " লক্ষীসোনা বোনটি কাঁদিস না, তাহলে আমিও কেঁদে ফেলব কিন্তু। " ওর কথা বলার ধরণে এমন একটা আন্তরিকতা আর সৌহার্দ্য ছিল, আমি অনেক কষ্টে নিজের কান্না গিলে ফেললাম।
--
তারপর থেকেই ওর সাথে যোগাযোগটা পাকাপাকি হয়ে গেল। মন খারাপ লাগলে ওর দোকানে গিয়ে অক্সিজেন সঞ্চয় করে আসতাম। গেলেই জিজ্ঞাসা করত খিদে পেয়েছে কিনা বা কখন খেয়েছি, কি খেয়েছি। নানা রকম গল্পে গল্পে  মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত। সব সময় জিজ্ঞেস করত রাতের থাকার জায়গা ঠিক আছে কিনা, নাহলে দোকানে চলে যেতে বলত। ওর  বাড়ীতে শুধু মা ছিলেন। ওর  গ্রামে বা পরিচিত অন্য কোন গ্রামে রাতের ট্রেনে ওর সাথে চলে যেতাম, কাকভোরে বেরিয়ে আসতাম। একবার কি যেন একটা উৎসবে ওর সাথে আমরা তিন জন সাথী মিলে গিয়েছিলাম। ওর বাড়ীতে একটা হাঁস ছিল, সেটাকে কাটল আর মাকে ভাল করে রান্না করতে বলল আমাদের খাওয়াবার জন্য। তারপর আমাদের নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বেরোলো।
--
কি যেন উৎসব ছিল, বাড়ীতে বাড়ীতে ঘুরে নতুন কোটা চিরে আর গুড় খেয়ে আমার পেট ঢাক হয়ে গেল। বাড়ী ফিরে আমি আর হাঁসের মাংস ভাত খেতে পারছিনা দেখে খুব রেগে গেল, মন খারাপ করতে লাগল। আমিতো কোন মতে এক টুকরো মাংস খেলাম,ওকে উল্টে বকতে শুরু করলাম, "তুই কেন সারা গ্রাম ঘুরে চিরে গুড় খাইয়ে আনলি, তাইতো আর খেতে পারছি না। ছেলেরা অবশ্য ওর আশা পূরণ করে দিল। তখন একটু ঠান্ডা হল।
--
গোপালের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা জায়গায় ঘুরে, শ্রমিক দের কারখানায় গেটে অপেক্ষা করে নতুন করে শ্রমিকদের মধ্যে যোগাযোগ করা, পুরান বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ গুলিকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতাম। সে সময়
শহরে আমাদের থাকার জায়গা গুলি পুলিশের নজরে এসে যাওয়ায়, প্রায়ই গোপালের সাথে বিভিন্ন গ্রামে ওর পরিচিতদের বাড়ী আশ্রয় নিতাম। একবার ওর গ্রামের থেকে একটু দূরে আমরা পোস্টার লিখতে গেছিলাম। কাছেই একটি ক্লাবে যাত্রার রিহার্সাল হচ্ছিল, আমাদের হটাৎ দেখতে পেয়ে তারা বেরিয়ে আসে," কি ব্যাপার আপনার কে, এখানে কি করছেন ?" স্বভাবিকভাবেই আমাদের প্রশ্ন করতে শুরু করল, সঙ্গে  এত রাতে একটা মেয়ে থাকায় সন্দেহটা ঘনীভূত হয়।
--
আমরা তখন আমাদের পার্টির শিক্ষা মত অসুবিধায় পড়লে জগণের কাছে, বিশেষ করে শ্রমিক/ কৃষক কে আমরা সোজাসুজি আমাদের পার্টির নাম ও রাজনীতির কথা বলতাম। দেখেছি এসব ক্ষেত্রে খুব ভালভাবে মানুষ আমাদের গ্রহণ করেছে, অনেক সময়ে সেখানে পার্টি ইউনিট গড়েও তোলা গেছে। তাই আমরা সরাসরি আমাদের রাজনীতি ও উদ্দেশ্য খোলাখুলি বললাম। তাঁরা সব মন দিয়ে শুনলেন, সাবধান করে দিলেন।" খুব ই ভাল আপনাদের উদ্দেশ্য, ভাল কাজ করছেন, কিন্তু প্রতিরোধ বাহিনী গ্রামে গ্রামে টহল দেয়,আর রাত না করে বাড়ী চলে যান। " আমরা তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে আসি।
--
বাড়ী থেকে যখনই মুড়ি / চিড়ের মোওয়া, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি আসত ও আমাদের জন্য সরিয়ে রেখে সহকর্মীদের সাথে ভাগ করে খেত। খুব বড় মন ছিল, শেষ কপর্দক ব্যয় করে সবাইকে খাওয়াতে ভালবাসত। একবার গোপাল আর আমি এক শীতের রাতে শেষ ট্রেনে ওর গ্রামে যাচ্ছি। ট্রেন প্রায় ফাঁকা। আমরা বলাবলি করছিলাম প্রায় রোজ রাতে ওর গ্রামে যাওয়া টা ঠিক হচ্ছে না , শহরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না, গ্রামে নতুন করে কৃষকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। কামরায় আমরা দুজন ছাড়া আর একজন মাত্র ছিলেন। সঙ্গে একটা বিরাট ফাঁকা সবজি বওয়ার ঝুড়ি, আমাদের মনে হল উনি সম্ভবত গ্রামের কৃষক, ক্ষেতের সবজি শহরে বিক্রি করে গ্রামে ফিরছেন। নতুন যোগাযোগ গড়ে তোলার একটা বিরাট সুযোগ।
--
আমরা  কাজে লেগে পড়লাম, ওনার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলাম, কি কাজ করেন, বাড়ী কোথায়, কে কে আছেন ইত্যাদি। দেখলাম আমাদের আন্দাজ ঠিক আছে। ইতিমধ্যে ওনার ষ্টেশন চলে আসতে, নেমে গেলেন। আমরাও তাড়াহুড়ো করে তাঁর সঙ্গে নেমে তাঁর পিছু পিছু চললাম অন্ধকার গ্রামের পথ ধরে। একটু এগিয়ে তাঁকে ডেকে বললাম, "আমরা ভাইবোনে গল্প করতে করতে ভুল করে আমাদের ষ্টেশন ছেড়ে এসেছি, এখন তো আর ট্রেন পাওয়া যাবে না, এই ঠান্ডায় রাতে কোথায় যাব আপনি যদি রাতে আশ্রয় দেন, তো খুব উপকার হয়। " সত্যি আমাদের এক কথায় রাতে তাঁর বাড়ীতে আশ্রয় দিতে কোন দ্বিধা করলেন না। বাড়ী নিয়ে গেলেন। সাধারণ মানুষ এই রকম মহান আর উদার ই হন, আমরা নতুন করে আবার তার প্রমান পেলাম।
--
বাড়ী পৌঁছে তিনি আমাদের পরিচয় আর দুর্গতির কথা বলে সবাইকে বলে দিলেন আমরা রাতে থাকব। একান্নবর্তী পরিবার, অল্প জমি আছে সবাই মিলে নিজেরাই জমিতে খাটেন, শহরে গিয়ে চাল নিজেরাই মহাজনকে গস্ত করেন, মরশুমি সবজি আনাজপাতি নিজেরা শহরে বাজারের ফুটপাতে বা গ্রামের হাটে বিক্রি করেন, দুঃখকষ্টে দিন কেটে যায়। মাটির বাড়ীর দাওয়ায়ে বসে কথা হচ্ছিল একধারে মেয়েদের সাথে আমি বসে কথা বলছি। আর এক ধারে ছেলেদের সাথে গোপাল বসে কথা বলছিল। আমরা ষ্টেশনে হটাৎ করে নামাতে নিজেদের মধ্যে আর কিছু কথা ঠিক করে না নেওয়াতে নিজেরা নিজেদের মত কথা বলছিলাম। হটাৎ একজন যুবক গোপালের কাছে চুপি চুপি বলে, " দাদা আপনার আর আপনার বোনের কথা কিন্তু মিলছেনা। " গোপাল বিড়ি খাবার নাম করে তাঁকে নিয়ে বাইরে গিয়ে সব সত্যিকথা বলে। ছেলেটি শুনে আমাদের পার্টি ও রাজনীতির কথা আরও জানতে খুব উৎসাহ প্রকাশ করে। গোপাল যতটুকু সম্ভব বলে আর কথা দেয় বই কাগজ পত্র নিয়ে পরে আবার আসবে।
--
পরদিন সকালে চা খেয়ে আমরা রওনা দিই। রাস্তায় এসে আমরা ঠিক করি এরপর গোপাল একাই এসে এখানে যোগাযোগ রাখবে আর সংগঠন গড়ে তুলবে। কারণ আমি সাথে থাকলে বাইরের লোকের চোখে পড়বে, তাছাড়া আমি একা গ্রামের পথ ঘাট ঠিক মত চিনে উঠতে নাই পারতে পারি। গোপাল সেখানে সত্যি একটা মজবুত সংগঠন গড়ে তুলেছিল। পরবর্তী কালে জেল থেকে পালিয়ে সেখানে গিয়েই ওঠে। তাঁরা ওকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল। কিছুদিন থাকার পর তাঁদের সাহায্যে অন্য জায়গায় চলে যায়।
--
আর এক রাতে আমরা তিন / চার জন গোপালের গ্রামে যাওয়ার সময় মাঝপথে আমাদের প্রতিরোধ বাহিনীর লোক জন ঘিরে ধরেছিল। "আমরা কে কোথায় থাকি, এতো রাতে কোথা থেকে ফিরছি, কোথায় যাব" ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে। গোপাল বলে যে আমরা তিন জন ওর মামাত ভাইবোন শহরে থাকি, পিসির বাড়ী বেড়াতে এসেছি ,পাশের গাঁয়ে যাত্রা ফিরতে রাত হয়ে গেছে। সঙ্গে মহিলা থাকায় ওরা আর বিশেষ কিছু বললনা। আমরা গোপালদের বাড়ী চলে গেলাম। পরদিন পায়ে না হেঁটে আমরা বাসে করে সোজা ষ্টেশনে নামি। কথা ছিল গোপাল ছাড়া বাকীরা কলকাতায় চলে আসব আর গোপাল বাড়ী ফিরে যাবে। গোপাল ট্রেনের টিকিট কেটে আমাদের দিল। আমাদেেেরর সাথে ও নিজেও ট্রেনে উঠে পড়ল। আমরা অবাক, কি ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। ও শুধু বলল পরের স্টেশনে নেমে একজনের সাথে দেখা করে বাড়ী ফিরবে। আমাদের কেমন যেন সন্দেহ হল, কিন্তু পরের ষ্টেশনে তাড়াহুড়া করে নেমে যাওয়াতে কিছু জানা হল না।
--
দুদিন পর ওর সাথে ওর দোকানে দেখা হতে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, আগের দিনের প্রতিরোধ বাহিনীর একজনের সাথে ওর পরিচিত একটি খোচর কে ষ্টেশনে দেখে ও ট্রেনে উঠে পড়ে। পরের ষ্টেশন থেকে ঘুর পথে বাড়ী গিয়ে পার্টির যে কাগজ পত্র ছিল সরিয়ে দিয়ে, মাকে সব বুঝিয়ে বলে।  ভোর বেলা ট্রেন ধরতে ষ্টেশনে আসার সময় নিজের গ্রাম পার হয়ে বেশ কিছুটা আসার পথে পেছন থেকে কেউ গুলি চালায়। প্রানপন দৌড়ে ঘুরে ঘুরে অন্য ষ্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কোলকাতায় এসেছে। আমরা সবাই খুব বকলাম আমাদের সাথে আগের দিন চলে না আসার জন্য। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে দাঁত বার করে হেসে জবাব দিল, "আরে ফিরব বলে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি, রাতে না ফিরলে বুড়ী মা আমার চিন্তায় মরে যেত যে, আর কাগজ পত্র বাড়ীতে সার্চ করে পেলে, পিটিয়েই মাটাকে আমার মেরে ফেলত। "
--
মানুষের প্রতি, সাথীদের প্রতি ওর প্রগাঢ় দরদবোধ ওকে সব সময় মনের জোর যুগিয়েছে। ধরা পড়ার পর প্রচন্ড পুলিশি নির্যাতনেও ওর মুখ থেকে একটা কথাও বার করতে পারেনি। মৃত্যু ওকে ছিনিয়ে নিলেও মনের গভীরে আমাদের কাঠ গোপালের স্মৃতি জ্বলজ্বল করবে।  

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

















  






    

8 Aug 2019

8 Aug, 2019 ভোর রাতের স্বপ্ন

ভোর রাতের স্বপ্ন 
*************
ভোররাতে স্বপ্ন দেখলাম 
আকাশ থেকে তুষার নয় বারুদ ঝরছে ,
শিকারাগুলির গায়ে ঝকঝকে অক্ষরে
বড় বড় শিল্পপতিদের নাম,
সস্তা শ্রমে কাশ্মীরি হাতের কাজের সম্ভার
বিকোচ্ছে মলে আকাশ ছোঁয়া দামে 
ডাল লেকের জল লালে লাল, 
পথের পাশে ফুলের কেয়ারি নয় শুধুই লাশ !
ফুটফুটে চঞ্চল কিশোরের দল 
ব্যস্ত ছিল ক্রিকেট খেলায়,
কাছেই ভারী বুটের আওয়াজ
কিশোরেরা ঝাঁপ দেয় ঝিলমে 
বাকীরা কিছু দূরে পাড়ে উঠল,
কিন্তু আলতাফ উঠল না 
সে যে সাঁতার জানতনা,
আর ছড়ড়ায় আজাহার হল অন্ধ ;
আমি আজাহার আর আলতাফের 
মুখের উপরে আমার কিশোর ছেলের 
ছায়া দেখলাম, ভোরের স্বপ্ন,
সত্যি না হয়, রামনাম জপ করি !
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




  










7 Aug 2019

একটি স্মরণীও রাত

একটি স্মরণীও রাত
***************


১৯৭২ এর অক্টোবর মাস। পার্টির বেশীর ভাগ নেতৃ স্থানীয় ব্যক্তিত্বরা হয় শহীদ হয়ে গেছেন, নয় জেলে। বাকিদের থাকার জায়গাগুলির অবস্থা  শোচনীয়, কিছুটা সেই কারণে, কিছুটা মধ্যবিত্ত মানষিকতার জন্য অবশিষ্ট শেল্টার গুলিতে জটলা করে থাকা হচ্ছিল।  কালীঘাটের রেড লাইট অঞ্চল আর কালীঘাট মন্দিরের মাঝামাঝি  একটি পুরান বিদ্ধস্ত চারতলা বাড়ীতে অনেকগুলি ঘর ছিল। খেটে খাওয়া মজদুর আর নিম্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকেদের বাস। সেখান পার্টির এক সমর্থক কমরেড একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। আর একজন কমরেড সেটাকে বলত জব চার্ণকের আমলের বাড়ী। একদম ওপরে দুটি ঘরের একটিতে তারা থাকত, আর অন্যটাতে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার - স্বামী, স্ত্রী আর একটি বাচ্চা ছিল। ভদ্রলোকের একান্ত আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর  ছোট ভাইয়ের ঘর টা সমর্থক কমরেডটিকে ভাড়া দিয়েছিল। জল, কল নীচে ছিল। ছেলেরা বাইরে উঠোনে বিশাল চৌবাচ্চা থেকে স্নান করত। সিঁড়ির নীচে খুপচি একটা বাথরুম ছিল, সেখান মেয়েরা স্নান করত। 
--
সাধারণত মিলন আর কৃষ্টি থাকত। মাঝে মধ্যে অন্য দুই একজন কমরেড রা আসতেন। কালীপূজার রাত ,দুজন মেয়ে আর জনা পাঁচেক ছেলে কমরেড ছিল। আর ছিল প্রচুর বই কাগজ পত্র। সবাই তখন আত্মগোপনে। কিন্তু প্রায়শঃ সেটা তাঁদের মাথায় থাকত না, আলোচনা হোক, হাসি বা গল্পই হোক একটু গলা চড়ে যেত। ঘরের মাথায় ন্যাড়া ছাদে যাবার একটা লোহার সিঁড়ি ছিল। সন্ধ্যে বেলায় ন্যাড়া ছাদের মাথায় বসে মাঝে মাঝে কথা বার্ত্তা বলত।
--
সেদিন কৃষ্টি  ঘরে ছিল কিছু কাজের জন্য, বাকীরা ছাদে গেছিল। হটাৎ বিশাল হৈ চৈ, ভেজান দরজায় টকটক করে আওয়াজ, রাগত গলায় কারা বলছে, দরজা খুলুন, খুলুন দরজা। কৃষ্টি তাড়াতাড়ি কাপড় জামাগুলি কাগজ পত্রের ওপরে ফেলে দিয়ে, দরজা খুলতেই শোনে ওপর থেকে শওকতের ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে, " কৃষ্টি ,কৃষ্টি আমরা সব জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন না।" তার সাথে কয়েক টা গলার জড়ান আওয়াজ,"একদম  চুপ, কোন চালাকি  চলবে না। " কৃষ্টিকে  চার / পাঁচ ঘিরে ধরে প্রশ্ন করছে , "নাম কি?, কে, কে থাকেন এখানে ?" " কৃষ্টি  আমি আর আমার নিজের দাদা থাকি। কালীপূজা উপলক্ষে আমাদের জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন রা এখানে এসেছে, দুদিন বাদে চলে যাবে। " "নিজের দাদার নাম কি?" "মিলন ।"  ছাদের ওপরের মেয়েটির কি নাম ,কে হয়। "  " মিঠু, আমার খুড়তুতো বোন।"  শওকতদের  সবাই কে নিয়ে আরও পাঁচটি ছেলে নেমে এলো, "এদের নাম কি?"  যার যা টেক নাম ছিল গড়গড় করে বলে গেল। প্রথমে মিলন নিয়ে পড়ল," আপনি তো ঘর ভাড়া নিয়েছেন ? কি কাজ করেন ?"  "হ্যাঁ, প্রেসে কম্পোজারের কাজ।"  অন্যদের নামধাম , ঠিকুজিকুষ্টি, পেশা বয়স সব তথ্য নিতে লাগল। সবাই বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে গড়গড় করে বলে গেল।

 --
তখন জনা চারেক থাকল আর বাকীরা বাড়ীওয়ালা ছেলেটিকে খুঁজতে গেল। চার জন কে ওরা  বলল, "আসুন ঘরে বসুন, চা করি, ওরা আসা পর্যন্ত্য চা খান। আপনারা তো সব এ পাড়ার ছেলে, একটু চেনা পরিচয়, আড্ডা হয়ে যাবে।" লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল, না না চা করতে হবে না। দ্বীপ ছিল সবার ছোট, জয়ন্তের কথায় সে জোর করে চা বসিয়ে দিল।  একজনের বোধহয় হটাৎ দ্বীপ কে দেখে মনে পড়ল ওর পেশা টা জানা হয়নি," ও কি করে ?" জয়ন্ত নিজের মাথায় আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে ইশারায় বোঝাল মাথাটা একটু গন্ডগোল আছে। তাই দেখে বাকিদের অবস্থা খারাপ,গম্ভীর মুখে হাসি চেপে অন্য দিকে থাকিয়ে থাকল। যাই হোক ওরা আর গন্ডগোল পাকাল না। গল্প চলতে থাকে।
--
বাকীদের পাত্তা নেই। "ওরা বোধহয় সন্তুকে খুঁজে পাচ্ছেনা। " একটু পরে চারজন মিলে ঘরের বাইরে গিয়ে পরামর্শ করে একটা রফায় এলো, কৃষ্টিকে দেখিয়ে বলল দেখুন, " আপনি আমাদের সঙ্গে গিয়ে মাকালীর পা ছুঁয়ে শপথ করতে পারবেন যা যা বলেছেন সব সত্যি ?"  "হ্যাঁ ,নিশ্চয়ই , চলুন কোথায় যেতে হবে।" বাকিরা চঞ্চল হয়ে উঠল, এ মার্কামরা পাড়ায় রাতের অন্ধকারে কোথায় নিয়ে ফেলবে, কে জানে ! শওকত যেই বলল, " আমরা কেউ গেলে হয় না ?" ও বেচারার ওপর ওরা প্রথমেই খেঁপেছিল, কটমট করে তাকিয়ে বলল, " আপনি একদম কোন কথা বলবেন না। " মিলন তাড়াতাড়ি বলে উঠল ," "এই তুই চুপ করত, রাগ করবেন না ভাই বুঝতেই পারছেন বোনেরা সবার বড় আদরের তো, তাই যদি আপনাদের আপত্তি না হলে আমি যেতে। ...." " না একদম নয়, ওনাকেই যেতে হবে।"  "ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, কি আছে ওনাদের সাথেই তো যাচ্ছি, ওনাদের ও বোন আমি, চিন্তার কিছু নেই। "
--
অতএব কৃষ্টি ওদের চার জনের সাথে রওনা হল। অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলতে থাকে গলি ঘুঁচি পেরিয়ে মন্দিরের একটু আগে ওদের একজন সবাইকে দাঁড় করাল। কৃষ্টির দিকে ভাল করে লক্ষ্য করতে থাকে, বাকিরাও তার দেখাদেখি ওর দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে উদ্বেগ থাকলেও কৃষ্টি বাইরে এতটুকু বিচলিত ভাব দেখাল না, সহজ গলায় প্রশ্ন করে." মন্দির কি এসে গেছে ?" " আপনি মা কালীর নামে শপথ করে এখনও বলতে পারেন, যে আপনারা সবাই ভাই বোন। " সে চোখ বুঁজে, হাত জোড় করে বলে, "আমি শুধু মা কালী, মা দূর্গা কেন সব ভগবানের নামে শপথ করে বলছি আমরা সবাই জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোন। আপনারা আমাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে পারেন। আর আমরা তো এখানে আছি, মাঝে মধ্যে গিয়ে গল্প করে আসবেন।,বাড়ীওয়ালার সাথেও কথা বলে নিন। "
--
তখন চার জন নিজেদের নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিয়ে বলল, না না , আপনার কথা আমরা বিশ্বাস করছি। মন্দির পর্যন্ত্ আর যাবার দরকার নেই , চলুন আপনাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। " কৃষ্টি বলল, "একাই চলে যাচ্ছি আপনারা আর কষ্ট করে যাবেন কেন !" "না, না এত রাতে আপনাকে একা যেতে হবে না। জানেন তো পাড়াটা বিশেষ ভাল না। আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি, ওরা ফিরে যাক।" এই বলে  তিন জন চলে গেল আর একজন  কৃষ্টিকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেল।        
--
কৃষ্টি ফিরলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তার কাছে সব শুনে সবাই তো হেসেই খুন। পরদিন বাড়িওয়ালা ছেলেটি এসে মিলনের  কাছে আসল ব্যাপার খুলে বলে, "আমাৰ  দাদাই  ঘরটা দখল করার জন্য পাড়ার ছেলেদের উস্কেছে, তাই একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, আপনারা কিছু মনে করবেন না। পূজোর সময় লোকজন তো ঠাকুর দেখতে আসতেই পারে, আমি এতদিন ধরে আপনাদের দেখছি না," এবং হাত জোড় করে ক্ষমা চায়। এরপর বাড়ী টা থেকে আস্তে আস্তে  সন্দেহ উদ্রেক না হয় এমনভাবে  সব কাগজ পত্র সরিয়ে ফেলা হয়, ভীড় ও কমিয়ে ফেলা হয়। একমাস বাদে ঘর টা ছেড়ে দেওয়া হল।
--
সেদিনটা আজও মনে পড়ে কৃষ্টির, নিজেদের অবিমিশ্রকারিতার জন্য, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যেতে পারত, সমস্ত কাগজ পত্র শুদ্ধ ৭ /৮ জন ধরা পড়ে যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা ওই রকম একটা পাড়ায় থেকেও ছেলেগুলি কত ভাল ছিল, অন্য কোন বিপদ ঘটেনি। আজকের দিন হলে হয়তো বা সে আর মিঠু কোন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারত, আরও ৫টি তাজা প্রাণ চলে যেতে পারত।  
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




  

     















13 Jul 2019

শান্তিবাই

শান্তিবাই
*******
শান্তিবাই ছিল খুনের কেসের বন্দিনী। শ্যামবাই তার ঘনিষ্ট বান্ধবীও একই কেসে জেলে ছিল। দুজনেই যৌনকর্মী, একই পল্লীতে পাশাপাশি ঘরে থাকত। শ্যামবাই ছিল অপূর্ব সুন্দরী, অনেকটা লম্বা,ফর্সা টুকটুকে গায়ের রঙ। ডাকের সাজের প্রতিমার মত ডাগর ডাগর চোখ, টিকাল নাক, লম্বা কোমর ছাড়িয়ে লম্বা  কালো কুচকুুুচে চুল। শ্যামবাই ছিল লখনৌয়ের আদি নাম করা বাঈজী ঘর থেকে আসা মেয়ে। তাঁর কাছে শুনেছিলাম, তাঁদের ঘরানার নিয়ম অনুসারে ঘরের ছেলের বউদের লাইনে নামতে দেওয়া হত না, যাতে সন্তান হলে সে যে নিজেদের পরিবারের কিনা বোঝা যায়। লাইনে নামানো হত বাড়ীর মেয়েদের। সেই রীতি অনুসারে শ্যামবাই লাইনে আসে। সে  তখন সন্তানসম্ভবা, অনাগত সন্তানের প্রতীক্ষা করছে। সাধারণভাবে কুমারী যৌন কর্মীদের দর বেশী হয়। এমনিতে সৌন্দর্যের জন্য শ্যামবাই এর প্রচুর কদর ও খরিদ্দার ছিল। বাঁধা বাবুদের সংখ্যা ও নেহাৎ কম ছিল না। সন্তান হলে তার বাজার খারাপ হতে পারে, সে সম্ভাবনা  থাকলেও গর্ভবতী হওয়াতে তার কোনরকম দুঃখ বা দুঃশিন্তা ছিল না। মা হবার আনন্দে সে ডগমগ, এমন কি রীতিমত গরবিনী ছিল বলা যায়। শান্তিবাই তার সব কাজ করে দিত. পান থেকে চুন খসলে পাছে তার সন্তানের কোন ক্ষতি হয় এই আশঙ্কায় বান্ধবী কে বকে ভূত ভাগিয়ে দিত। শান্তিবাইকে কখন কোন রাগ করতে দেখা যেত না। শ্যামবাইয়ের অনাগত সন্তানের জন্য তারও দুঃশ্চিন্তা আর আনন্দ দুই ছিল, সে ও মাসি হতে চলেছে।
---
শান্তিবাই বিহারের আদিবাসি মেয়ে, শ্যামলা রঙ, সাপের মত লম্বা একটা বিনুনি,শ্যামবাইয়ের মত না হলেও অনেক টাই লম্বা ছিল। বয়স ১৭/ ১৮, চাবুকের মত ছিপছিপে শরীর, একফোঁটাও মেদ ছিলনা আর বিদ্যুৎ গতিতে চলা ফেরা করত। গ্রামে ভূমিহীন ক্ষেত মজুরের ঘরে তার জন্ম। সারাদিন ক্ষেতে, ঘরে দুঃসহ পরিশ্রম করত, দিনে এক বেলা খাওয়া। খাটতে তার কোনরকম আপত্তি ছিল না, শুধু পেটের ভুখটাই সহ্য হত না। তাইতো গ্রামের বড়লোকের বাড়ীর বাজার ঘাট করার ছেলেটার খপ্পরে পড়ল।  সে জোতদারের কাজে বিভিন্ন শহরে যেত , অনেক খবর রাখে। কোলকাতায় গেলে অনেক ভাল কাজ পাওয়া যাবে, দুজনে খাটবে, বিয়ে করে ঘর পাতবে, পেট ভোরে খেতে পাবে, এই স্বপ্ন দেখে একদিন তার সাথে পালিয়ে চলে এল কলকাতায়।
---
ছেলেটা তাকে নিয়ে তুলল পতিতা পল্লীতে। অনেক রাতে প্রায় অন্ধকার বড় একটা বাড়ীতে ঢুকল তারা। বয়স্কা একজন মহিলার সাথে আলাপ করিয়ে দিল বাড়ীওয়ালি বলে। তাকে একটা ঘরে বসিয়ে বললো, "তু থোড়া ঠ্যার য়া,খানা ভেজতা হুঁ ,পহলে খালে, ফির শো যা। ম্যায় ঘর কি কিরায়া কা বাত করলু, শুভা মে তেরে আউর মেরে কাপড়া, ঔর কুছ সমান খরিদ কর দুপহর আউঙ্গা। নাহা ভি লেনা, ঔর সাজধাজকে মেরে ইন্তেজার করনা। একসাথ খানা খাকে, কলকাত্তা ঘুমনে যাউজ্ঞা ।"
---
সরল বিশ্বাসে শান্তিবাই বাড়ীওয়ালি মাসীর দেওয়া খাবার খেয়ে খুব খুশি, জীবনে প্রথম পেট ভরা খাবার খেতে পেয়েছে। সেই ঘরেই পাতা মাদুরে শুয়ে ভবিষ্যতের সুখের সংসার পাতার স্বপ্ন দেখতে দেখতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন অনেক বেলায় মাসী ডেকে দিল। স্নান করে, খেয়েদেয়ে সেজেগুঁজে তৈরী  হয়ে নিতে বলল। পাশের ঘরেই শ্যামবাই থাকত। সেই কিছু ভাল জামাকাপড়, প্রসাধনী জিনিসপত্র আর কাঁচের চুড়িপুঁথির মালা, নাকে, কানে পেতলের গয়না ইত্যাদি দিল। এসব জিনিস পরা তো দুরস্থান, জীবনে কোনদিন চোখেই দেখেনি। শান্তিবাই মহাখুশী, চটপট তৈরী হয়ে তার গ্রামের লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, তার বিয়ে হবে, সুন্দর একটা সংসার হবে, পেট ভরে দুবেলা খেতে পাবে, আর কি চাই।
--
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর, হটাৎ করে বাড়ীওয়ালি মাসি তার ঘরে একজন দেহাতি লোক কে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো  " নে তোর মরদ এয়ে গেছে,", কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় একটা ওড়না চাপিয়ে দিয়ে মুখ পর্যন্ত্য ঢেকে দিল। লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, " নাও, বাপু এবার মাথায় সিঁদুর দে, বে সেরে লাও, তারপর ঘর কর, তবে হ্যাঁ মাসের ভাড়া আর আমার দিনের হক মেরোনি, আর পেইল্যে যাবার চেষ্টাটি কর নি, তাইল্যে গুন্ডা দিয়ে এমন হাপিস করে দেব, কেউ টেরটি পাবেনি, " বলেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে, বাইরে থেকে শিকল টেনে দিল। বাড়ীওয়ালীর কথা শুনে শান্তিভাই ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কিছু বোঝার বা ভাল করে দেখার আগেই এক খাবলা সিঁদুর তার মাথা, মুখ ভরিয়ে দিয়ে  শান্তিকে সবলে আকর্ষণ করে কামুক লোকটি প্রাণ ভরে নিজের খিদে মেটাল। তারপরে তার হাতে ৩০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলল," আমি রোজ রাতে আসবো, রাতটা আমার জন্য খালি রাখবি, দিনে যত ইচ্ছে খদ্দের নিতে পারিস। " বলে দরজা ঠক ঠক করলে দরজা খুলে গেল।  লোকটা বেরিয়ে গেল আর শান্তি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
--
শ্যামবাই দৌড়ে এসে সান্তনা দিতে লাগল। শান্তির মুখে একটাই কথা, " থোড়া পেটভর খানেকে লিয়ে ম্যাঁয় এ কিস জাহান্নামে আ গেই। " ধীরে ধীরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শ্যামবাই নিজের জীবনের একই কাহিনী শুনাল। তেরী গাঁও কে মরদ ভি আওর এক খুদগড়জ আদমি হ্যায়, শাদী কা ওয়াস্তা দে কর তুঝে মাসী কে পাস্ বেঁচে দে কর ভাগ গেয়ি। ও তো দালাল হ্যায়, লড়কি লানা উস্কা কাম হ্যায়, পহলে ভি বহুৎ সারি লায়া। ইয়ে আদমি হর রোজ তেরে পাস্ আয়েগা,আছ্ছি বাত। পহেলা দিন মে তুঝে  পসন্দ কর লিয়া, দেখনা তেরে লিয়ে কুত্তাকে মাফিক হর রাত আয়েগি, প্যায়ার করেগি, কুছদিনকে লিয়ে তুঝে নেহি ছোড়েগি। মগর উস্কে বাত মে কভি না  ফাঁস যানা, ইঁহা সাচ্চা পেয়ার নেই হোতা। দিল কভি দেনা কিসিকো, চোট খায়েগি। ইঁহা যব তক মরদ কো আচ্ছে লগতে, তব তক পেয়ার ঢঙ রচায়গী, বাদমে আচ্ছে ঘরসে লড়কিকো শাদী করেগা, বিচ বিচ মে তেরে পাস আ সকতা, আনে দেনা মগর কভি দিল নেহি দেনা। দিন ভর তু আউর কাস্টোমার লেনা, বহুৎ কামানা, কুছ কুছ আনেবালা দিন কে লিয়ে জমাকে রাখনা। আউর শুন ভাগনে কা কোশিশ কভি নেহি কর না, এ বহৎ খতরনাক জাগা হ্যায়, খুন হো জায়গী। অব তেরে পাস দুসরা কই রাস্তা হ্যায় কেয়া !"
---            
সত্যি আর কোন পথ তার চোখে পড়লোনা, এই অজানা অচেনা জায়গায় সে কি করবে, বাড়ীওয়ালি মাসির কথাগুলি মনে পড়তেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। তখন থেকে শুরু হল তার পতিতাবৃত্তি। রাতে লোকটি নানা রকম খাবার, গিল্টি গয়না বা কাপড় চোপড় নিয়েও মাঝে মধ্যে নিয়ে আসে,পশুর মত তাকে ছিড়ে খায়। রাত শেষ হবার আগেই চলে যায়। বছর পার হয়ে গেল, শান্তি আর দিন ক্ষণের হিসাব রাখে না। পেট ভরে খায়, সাজগোজ করে, বেশ কিছু টাকা ব্যাংকে ও জমাতে থাকে। লোকটি মাঝে মাঝে মাসীকে বলে সিনেমায় নিয়ে যায়, বেড়াতে নিয়ে যায়।সরল মেয়েটা শ্যামবাইয়ের সতর্কীকরণ ভুলে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলে। ব্যাস ভয়ংকর বিপদ এসে গ্রাস করে তাকে।
---
শান্তি বাই  লক্ষ্য করতে শুরু করল লোকটা আজকাল প্রায়ই আসেনা, এলেও তাড়াতাড়ি চলে যায়, বাইরে বেড়াতেও নিয়ে যায় না। একদিন তো এসব নিয়ে বেশ ঝগড়া হয়ে গেল দুজনের মাঝে। লোক ঝগড়ার মধ্যে বলে বসে," তু কি মেরে শাদী  কিয়া জরু, নেহি  ম্যায় তেরে  সচমুচ কা প্রেমী হুঁ। হর রোজ তেরে সাথ রাত বিতানা পড়েগা ?  শালী রেন্ডী, তেরে সাথ বাহার ঘুমনে যানেসে, অউর মেরা নয়া জরু দেখ লেনেসে, মেরা ঘর টুট যায়গা, তব কেয়া হোগা ?" শান্তিবাই পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়, ঠান্ডা গলায় বলে," কুত্তা আভি নিকাল যা।" কিন্তু দু দুবার ভালবাসার অপমান সে  সহ্য করতে পারেনা, সব আশা চুর চুর হয়ে যায়, প্রানঢালা ভালোবাসার বদলে এত কুৎসিত গাল দিল। তাদের এই গালি তো সবাই দেয়, কিন্তু  দু দুবার এত বিশ্বাস আর ভালবাসার এই পরিণাম।
--
পরদিন আর ঘর থেকে বার হয় না, শ্যামবাই ব্যাপার টা আঁচ করতে পারে। সবাই কে সরিয়ে দিয়ে একা শান্তিবাইকে আগলে রাখে। তার কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করে, খাওয়ায়, স্নান করতে নিয়ে যায়। শ্যামবাইয়ের খদ্দের এসে গেল শান্তিবাই দরজা বন্ধ করে একা একা শুয়ে চিন্তা করতে থাকে। অপমানে আর  বিশ্বাসঘাতকতা তার মাথায় ছোবল মারতে থাকে। মনে মনে ঠিক করে যে করেই হোক এর প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তার মনভাব কাউকে বুঝতে দেয়নি। আগের মত খদ্দের ধরতে শুরু করে। সেই লোকটি খবর পায় শান্তিবাই আবার আগের মত কাজ করছে।
--
কামুক লোক মোহ কাটাতে না পেরে শান্তিবাই কে খুশী করার জন্য খাবার দাবার কাপড়চোপড় নিয়ে হাজির হয়। শান্তিবাই খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করে, বৌকে নিয়ে পরিহাস করে. ধীরে ধীরে আবার রোজ রাতে তার ঘরে আসতে শুরু করে। শান্তিবাই তার বিশ্বস্ত লোক দিয়ে বিষ সংগ্রহ করে। একদিন খাবার আর প্রচুর মদ খাওয়ায়।  মদের মধ্যে মিশিয়ে সেই বিষটুকু সবটা খাইয়ে দেয়। সকাল বেলায় হইচই পরে যায়। পুলিশ তার সঙ্গে শ্যামবাইকেও ধরে আনে। বাড়ীওয়ালি তাদের জানা ভাল উকিল লাগায়, শান্তিবাই আর শ্যামবাই এর খদ্দেররা টাকা ঢালে। শান্তিবাই পুলিশের কাছে স্বীকার করে শ্যামবাইয়ের কোন দোষ নেই, সে কিছুই জানত না। একাই সে সবকিছু করেছে। শ্যামবাই ছাড়া পেয়ে যায়। শান্তিবাইয়ের কেস চলতে থাকে।
--
জেলের খাবারে শান্তির স্বাভাবিক পেট ভরতো না, বাড়তি খাবারের জন্য কিন্তু কোনরকম দালালি করত না। বাড়তি খাটুনি করলে কিছু বাড়তি খাবার পেত। তাকে সেলের জল ভরা আর সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ডের (যেহেতু তাদের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখা হত ) খাবার ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়ার কাজ , ভাঁটি ঘরেও কাজ ইত্যাদি করত। জেল কর্তৃপক্ষ সাধারণ বন্দিনীদের কাছে রটিয়ে ছিল সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দিনীরা মানুষের রক্ত খায়। যদিও বেশীর ভাগ মানুষ এ কথা বিশ্বাস করত না। বিশেষ করে সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে যে রাজনৈতিক বন্দিনীরা ছিল তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য যে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও, তা খেত না। সাধারণ বন্দিনীরা যে খাবার পেত, তাই নিত। তারা কোন বন্দিনীর ওপর কোন অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদ করত। এসব কারণে সাধারণ বন্দিনীরা তাদের মনে মনে ভালবাসত।
 ---
সেলে তখন কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া মিত্র ছিল। ডিভিশন ওয়ার্ডে বিজু, মিনু আর আমি চারু মজুমদারপন্থী। আমরা তিনজন ছাড়া আরও ৮/৯ জন রাজনৈতিক বন্দিনী ছিল যারা অন্য পন্থায় বিশ্বাস করত এবং রাজনৈতিক বন্দিনীদের সুযোগ সুবিধা গুলি নিত। সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে কাজ করার ফলে আমাদের রাজনৈতিক প্রভাব শান্তিবাইদের ওপর পড়েছিল, এই টুকু তারা বুঝতে পারত আমরা গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য কাজ করতাম। বড়োলোকদের  রাজত্ব কে ভেঙে গরীব মানুষদের রাজত্ব তৈরী করতে চাইতাম, তাই বড়লোকদের রক্ষাকর্তা পুলিশ মিলিটারির সাথে আমাদের লড়াই, তাই তারাই আমাদের আটকে রেখেছে। আমরা কোন অন্যায় কাজ করে জেলে আসিনি।
---
একবার আমরা ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে মীরা ও শান্তিবাইয়ের নেতৃত্ত্বে একসাথে রেখা ,বেলা, মিতা, শিবানী  ইত্যাদি প্রায় ২০জন  সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করছিল , তখন মেট্রন বা তার দালাল বাহিনী কিছু করতে সাহস পায়নি। প্রতিবাদে আমরাও তাদের  পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাই ।
--
মীরা তখন  সেলের এক ভাল ওয়েলফেয়ার অফিসারের অফিসে কাজ করত, চিঠিপত্র দেওয়া নেওয়া, তাঁর কাগজ ফাইল পত্র গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি।বাংলা দেশের গ্রামের মেয়ে মীরার  বয়স ১৭/১৮, কলমি লতার মত ঢলঢলে মিষ্টি চেহারা।  বাংলা দেশের  ৭১ এর যুদ্ধের সময় পালিয়ে আসে, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে হারানো কেসে জেলে ছিল। আমাদের ৬ জনের সাথে তার ও বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে আমাদের রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
--
সেই প্রতিবাদের শোধ তুলতে এক বিশাল দালাল বাহিনী বিজু, মিনু, আমি - মাত্র তিনজন বলে মারতে ঢোকে। দালালরা ভাবতে পারেনি মীরা শান্তিবাই ১৫ জন নিয়ে দালালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ডিভিশন বাড়ীর বাকী ৮/৯ জন ও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়। মারতে এসে উল্টে মার খেয়ে দালালরা পালায়। ওয়ার্ডার তাড়াতাড়ি গেট বন্ধ করে দেয়। শান্তিবাইরা ভেতরেই আমাদের সাথে থেকে যায় প্রায় দিন ১৫। বাকীরা আমাদের সাথে শুতো, ভাল খাবার জন্য খেতো ডিভিশনের মেয়েদের। কিন্তু  মীরা আর শান্তিবাই আমাদের তিনজনের সাথেই খেত আর সারা সময় আমাদের পার্টির গল্প শুনত।
---
মেট্রন বা তার চামচে ওয়ার্ডার আর  দালাল বাহিনী শান্তিবাই আর মীরাকে শিক্ষা দেবার তক্কে তক্কে থাকল। একদিন বাকী বন্দিনীদের লক আপ করার পর তারা মীরা আর শান্তিবাইকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারল যে তাদের চেনা যাচ্ছিল না। আমাদের আর সেলের  কমরেড দের ইচ্ছে করে লক আপ করেনি, কিন্তু মূল গেট গুলি বন্ধ করে রাখে যাতে আমরা হাসপাতাল থেকে আর ওরা বারান্দার ফোঁকর দিয়ে সব দেখতে পাই, কিন্তু গলার ফাটান ছাড়া আর কিছু করতে না পারি, ওদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে না পারি। মেট্রনের নির্দেশে পাগলী বাজল না। .
---
এরপর স্বাভাবিক ভাবেই ওরা দুজন ভয় পেয়ে যায় আর দালাল বাহিনীর পেছনে পেছনে থাকত, কিছু প্রভাব পড়লেও ওরা হিংস্র দালালদের মত হয়ে ওঠেনি। এদিকে শ্যামবাই ছাড়া পেয়েছে, শান্তি বাই এর যাবৎজীবন কারাদন্ড হবার প্রবল সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে জয়া মিত্র পুরুলিয়া জেলে বদলী হয়ে গেল। ডালিয়ার ১০ বছর সাজা হয়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে এল। সেলে রাজশ্রী, মীনাক্ষী দুজন নতুন রাজনৈতিক বন্দিনী এলো আর খুকু ডিভিশন ওয়ার্ডে এলো।  সাধারণ বন্দিনীদের ওপর অত্যাচার বাড়তে লাগল। তাই আমরা একদিন প্ল্যান করে শিখা, আনোয়ারা সরযূর মত হিংস্র দালালদের ও শয়তান বড় মেট্রনটাকে বেশ করে শিক্ষা দিলাম। পাগলী হল, কিন্ত আমাদের কাছে কি অস্ত্র আছে, জেল কর্তৃপক্ষ সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না, মাত্র কটা খাবার থালা নিয়ে আর ওদের লাঠি কেড়ে ওদের মারব এটা ওরা বিশ্বাস করতে পারল না। তাছাড়া আমাদের মনেমনে শ্রদ্ধা করতেন এমন একজন ডেপুটি জেলারের মধ্যস্থতায় ফোর্স ফিরে গেল।
---
ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলি করে দিল। মাসিমা (শান্তিরানী দেব ) আর বুলু ডিভিশন ওয়ার্ডে নতুন এল। জেল কর্তৃপক্ষ বদলা নিল, বুলুকে আর আমাকে প্রচন্ড মারল, জেলের ডাক্তার বাবুদের হটাৎ উপস্থিতির ফলে আমরা আহত হলেও বেঁচে যাই। কিছুদিন পর মহাদেবীয়া হাসপাতালের মেট হয়। মহাদেবীয়ার মনুষ্যত্ব বোধ ছিল। যাবৎজীবন সাজা প্রাপ্ত বলে মেট্রন দের হুকুম মানতে বাধ্য থাকত, কিন্তু বীভৎস অত্যাচার কারোর প্রতি করেনি। এই সময় একদিন শান্তিবাই আমাদের বন্ধ গরাদের কাছে এসে চুপিসারে বলে গেল," আভি মহাদেবীয়া হেড মেট, আর কুছু ডর নেহি হ্যায়।" আমাদের একদিন ইন্টারভিউ এর সময় বলল, " তুমাদের মারার সময় শিখা,আনোয়ারা হামাদের পর লজর রেখেছিল, তাই দিদি তুর  চুল টা হামি একটু ধরে ছিলাম, মাফি দিয়ে দে। " আমি ওর হাতে চাপ দিয়ে বললাম ,"বুঝিরে, তোদের না হলে মেরে শেষ করে ফেলত। "
---
এরপর শান্তিবাইয়ের যাবৎজীবন সাজা হয়ে যায়। আমরা ৭৭ সালের রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির সময় ছাড়া পেয়ে যাই। একদিন বাসে মীরার সাথে দেখা হয়েছিল, উগ্র সাজগোজ করা। আমার পাশে বসল, হাত টা ধরে বলল, "দিদিরে
প্রাণ ভয়ে যে অপরাধ করেছি মাপ করে দে। " ওর মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে বললাম, "সব বুঝি, আমরা কি জানি না কি কারণে, কি অবস্থায় তোদের কি করতে হয়েছে। ভাল থাকিস।" ইচ্ছে করেই আর কোন প্রশ্ন করে ওকে আর বিব্রত করতে চাইলাম না, ওর সাজ পোশাক অনেক কিছু বলে দিচ্ছিল। আমার গন্তব্য, এসে যাওয়ায় বাস থেকে নেমে যাই।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




        



















































           

6 Jul 2019

হাওয়াবিবি .

হাওয়াবিবি
***********

লম্বা ছিপছিপে চেহারা, কাল মিশমিশে লম্বা লম্বা চুলে, একটা হাত ঘুরিয়ে হাওয়া বিবি কেমন করে একটা খোঁপা বেঁধে রাখত। চুলগুলি ছিল তার বড় আদরের, সুযোগ পেলেই একটা ফুল বা পাতা গুঁজে রাখত। ডাগর ডাগর দুটি শিশুর মত সরলতা মাখা চোখ। সামনের দাঁতের পাটি একটু উঁচু, তাতে যেন তার আদিবাসী গ্রাম্য চেহারায় আলাদা একটা মাধুর্য্য এনে দিয়েছিল। আমাদের সকলের সাথেই তার ভাব, কিন্তু মলয়ার প্রতি তার একটু বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল। মলয়া তাকে শুধু হাওয়া বলে ডাকত। 
--
মলয়া তার উলকাঁটা নিয়ে মেয়াদী ঘরের জালনায় বসে আর হাওয়া গরাদের ওপার থেকে মলয়ার কান ঘেঁষে নিজের বিচিত্র জীবনের সব গোপন কথা যেন বলত। আমাদের বাকীদের কাছে জীবনের অল্পবিস্তর গল্প বলত বটে, কিন্ত তখন তার বলার থেকে শোনার চাহিদা ছিল বেশী। আমাদের পার্টির উদ্দ্যেশ্য বন্দিনীদের কাছে  সহজ ভাবে বলা হত, বিশেষ করে গল্পের মধ্যে দিয়ে।আর এইসব গল্প শোনার খুব  আগ্রহ ছিল হাওয়া বিবির। 
--
হাওয়া তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, চোখের মনি। খুব একটা অবস্থাপন্ন না হলেও একটি মাত্র সন্তান কে বড় আদরে মানুষ করেছিলেন। সাধ্যের অতিরিক্ত করে অবস্থাপন্ন ঘরে তার বিয়ে দেন। কিন্তু কাজে কর্মে পোক্ত না হওয়ায় শ্বশুর শ্বাশুড়ির গঞ্জনা শুনতে হত রাত দিন। স্বামীটাও ছিল চরিত্রহীন ও অত্যাচারী। এসব হাওয়ার বাড়ীতে আগে কেউ জানত না। হাওয়ার থেকে বয়সেও অনেকটা বড়। শারীরিক ভাবে তাকে তৃপ্ত করতে পারত না। ভোগ করা ছাড়া বিন্দু মাত্র স্নেহ ভালবাসা স্ত্রীর প্রতি ছিল না। এদিকে হওয়ার বাপের কাছ থেকে নানা ছুতায় নিত্যি নতুন পণ আদায়ের চেষ্টা করত। অন্যদিকে হওয়ার ওপর মারধর আর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়েই চলতে থাকে। মেয়ের দুর্দশা দেখে আর নিত্যি পণ এর দাবীতে অতিষ্ট হয়ে বাপমা মেয়েকে বাড়ী নিয়ে আসতে বাধ্য হয়, পাছে মেয়েকে একেবারে মেরে না ফেলতে পারে।  
--
বাপের ঘরে ফিরে হাওয়া খুব খুশী। সাথীদের সাথে খেলে বেড়ায়। কাছেই ছিল খালার বাড়ী। দুই খালাত ভাইদের সাথে ভারী ভাব, তাদের কাছে হাজার বায়না। গাছের উঁচু উঁচু ডাল থেকে  ফল, ফুল পেড়ে দেওয়া, পালা পার্বণে মেলায় নিয়ে যাওয়া। সঙ্গিনীদের সাথে ফল ভাগ করে খাওয়া, ফুল দিয়ে চুল বাঁধা, হাতে কানে গলায় পরে। কিন্তু আদরের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে বাবামা চিন্তিত। এদিকে কৈশোরের  শেষ সীমায় এসে দাঁড়ায় সে, অনেক কিছু বুঝতে শেখে। সংসারের দায়িত্ব খানিকটা  টা নিজের কাঁধে তুলে নেয়, বাজান আর খালতো ভাইদের সাথে প্রতিদিন মাঠে খাটতে যেতে শুরু করে।
 --
অবশেষে পরিণত শরীর আর মন নিয়ে বড় খালাত ভাইয়ের সাথে প্রেমে পড়ে। দুই বাড়ীর বয়স্করা মিলে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। হওয়ার চিন্তা দূর হওয়াতে বাজান, আম্মা আশ্বস্ত হয়ে নতুন উদ্যমে খাটতে শুরু করেন। মহানন্দে হাওয়া বিবি তার নতুন সংসার শুরু করে। স্বামী, দেওর মাঠে চাষ করে, খালার সাথে মিলে ঘর সংসারের বাকী কাজ করে। সবাই খুব খুশী। কিন্তু গরীবের সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী।বছর না ঘুরেতেই হাওয়ার আগের চরিত্রহীন স্বামী সুযোগ পেলেই তার পিছনে লাগতে শুরু  করল, তাকে ভোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সব কথা বাড়ীতে খুলে বলে, সকলে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন হন। হাওয়াও সাবধান থাকার চেষ্টা করত। তার নতুন স্বামী বিবিকে জান দিয়ে ভালবাসত। হাওয়াকে সব সময় সাহস দিত, -"মরা দুটা জোয়ান মরদ থাকতে, তুকে কিছু কৈর্তে লারবে, তুর কুনো ডর লাই। " 
--
কিন্তু দুর্ভাগ্য, একদিন হাওয়া মাঠে স্বামী ও দেওরের দুপুরের খাবার খাইয়ে যখন বাড়ী ফিরছে, শয়তান টা তাকে অমানুষের মত  ধর্ষণ করে। প্রায় টলতে টলতে ঘরে ফিরে অবসন্নের মত পড়ে থাকে সে। স্বামী আর দেওর কাজ থেকে ফিরে সব শুনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে টাঙ্গি হাতে বেরিয়ে যায়, অনেক রাতে নদীতে স্নান সেরে ফিরে আসে। "তুকে আর জ্বালাতন করবেক নাই, মরা শয়তানটোৱে বুঝায়ে দিছি।" রাতে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পরে। দিন কতক বাদে নদীর জলে ফুলে ঢোল বীভৎস একটা লাশ ভেসে ওঠে। পুলিশ এসে গ্রামের সবাই কে জিজ্ঞাসা বাদ করে, কেউ চিনতে পারেনা। দিন ১৫ বাদে পুলিশ এসে হাওয়া বিবি আর তার স্বামী দেওর কে ধরে নিয়ে যায়। তিনজনের বিরুদ্ধে ওই অপরিচিত লাশ টাকে খুন করার দায়ে কেস দায়ের করে। তিনজনকে প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে আসা হয়।
--
 কোর্ট পড়লে হাওয়া কোর্টে যায়, স্বামী দেওরের সাথে দেখা হয়, জেলের মধ্যেও ছেলেদের ওয়ার্ড আর মেয়েদের ওয়ার্ড থেকে তাদের মধ্যে অফিস ঘরে ইন্টারভিউ হয়। হওয়ার খালা আর আব্বুজান শক্ত ভাবে উঠে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যেটুকু সম্বল ছিল আর আত্মীয় স্বজনের থেকে ধার করে উকিল লাগিয়েছে।   ধীরে ধীরে জেলের মধ্যে তার কিছু  বান্ধবী হয়, আমাদের সাথেও রীতিমত গল্প হত। বিশেষত  মলয়ার প্রতি তো তার নির্ভরতার শেষ ছিল না। আমাদের নাটক গারদের ওপার থেকে মেয়াদি নম্বরে বসে দেখতে ভালবাসত।
--
মোটামুটি ভাবে জেল জীবনে সে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। তবে স্বাভাবিক ভাবে ই  মাঝে মাঝে ই বাড়ীর জন্য কাঁদত, আর কেসের কথা ভেবে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ত। আমরা তার জেলের সাথীরা সবাই সান্তনা দিতাম, "কাঁদিস না, কেসে তোদের কিছু হবে না, কে একটা অপরিচিত লোক মরছে আর গাঁয়ের কেউ তো তোদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী ও দেয়নি, যাকে তোরা চিনিসনা, জানিস না তার জন্য তোদের কেন সাজা হবে। " "তবে জেলের ওই মাতব্বর মেয়াগুলান  (জেলের দালাল বাহিনী) যে সব্বদাই মকে বলে মদের সক্কলের ফাঁসী  হবে !" ওদের কথা ছাড়, ওরা তো কারো ভাল চায় না, আর তুই তো ওদের দলে যোগ দিসনি,তাই তোকে ভয় দেখায়। " শুনে সে আস্বস্ত হয়।
--
অবশেষে একদিন কোর্টে তাদের কেস ওঠে। সকলে খুব খুশী। হাওয়া হাওয়ায় উড়তে উড়তে কোর্টে যায়। সন্ধ্যে বেলায় কোর্টের সবাই ফেরৎ আসে। বন্ধ গরাদের ভেতর আমরা উদগ্রীব হাওয়ার খবর পাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই সারা ফিমেল ওয়ার্ড হাওয়ার করুণ অসহায় কান্নার প্রবল ধাক্কায় খান খান হয়ে গেল। বহু রাত ধরে তা প্রতিদ্ধনি চলতে থাকে।  নিরুপায় আমরা সকালের অপেক্ষায় থাকি। সেদিন ডিভিশন ওয়ার্ডের ডিউটি তে একজন ভাল ওয়ার্ডার ছিল। তার কাছে শুধু শুনতে পেলাম হওয়াদের কারোর জামিন হয়নি।
--
পরদিন সকালে ছুটে মেয়াদী নম্বরের জালনায় গেলাম, সেখানে হাওয়ার প্রিয় সঙ্গিনীরা খবর দিল হাওয়া কিছু খাচ্ছে না, সারা রাত ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছে, এখন গোঙাচ্ছে। কেউ তাকে সামলাতে পারছেনা,পাগলের মত করছে।খালি বলছে ওর স্বামী, দেওর সবার ফাঁসী হয়ে যাবে, কোর্টে থেকে সেই কুখ্যাত নীহারিকা নামে ওয়ার্ডার নাকি শুনে এসেছে। আমাদের কাছেও আসতে চাইছেনা। এইভাবে কেটে গেল। হাওয়ার সাথীরা আর আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
--
জেলখানার ইতিহাসে একই ঘটনা বার বার ঘটে সবাই দেখেছি।  সাজার খবর বা বাড়ীর কোন দুঃসংবাদ এলে অথবা নরকের অপ্রকৃতিস্থ পরিবেশে কেউ সামান্য মানষিক ভারসাম্য হারালেই হয় নীচে অন্ধকার স্যাৎস্যাঁতে সেলে অথবা পাগল বাড়ীতে ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো পাগল করে দেওয়াই রেওয়াজ। হাওয়াকে বাঁচানোর জন্য হাওয়ার প্রিয় শান্তি মাসীর দায়িত্বে আরও ভরসাযোগ্য দু জন কে অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের মাসীমার ক্যাম্পোস বড়ি একটা করে  দুবেলা জলের সাথে  ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দিতে বলা  হল। এইভাবে ৩ দিন চলল। অবশেষে হাওয়া একটু স্বাভাবিক হল, অল্পসল্প খেতে শুরু করল। আমাদের কথা মত ক্যাম্পোসের পরিমান আস্তে কমিয়ে দেওয়া হল।
--
অবশেষে দিন পাঁচ পরে শান্তি মাসী ওকে আমাদের কাছে নিয়ে এল। কিছুক্ষণ মলয়ার হাত দুটো ধরে চুপ করে বসে রইল। আমাদের বাকী কজনকে চলে যাবো কিনা ইতঃস্তত করতে দেখে, ভাঙা গলায় হাওয়া বারণ করল, " তরাও শুন, মুই তদের কাছে যে কথাগুলান বুলি নাই, সেগুলান বুইলতে চাই।  তরা মকে ভুল বুইজলেও, কুঁচু হবেক নাই। " "কেন ভুল বুঝবো। তোর মনের কথা খুলে বল, তাতে তুই শান্তি পেলেই আমরা খুশী। " "জেডা মইরে, ফুইলে, ভাইসে উইঠেছিল, উটা ছিল মর পুব্বের শয়তান সোয়ামিডা। মর ইখনকার সোয়ামি মর আসল সোয়ামি তো বটেক, উ মরে কাউরে  বৈলতে মানা কৈরেছিল, ইমনকি শয়তানডার সাথ মর দেখা হব্বার কথাডা ও কাউরে কইতে মানা কৈরেছিল, তাই কাউরেই কই নাই। তা তুরা মুকে খারাপ ভাইবতে পারিস বটে। "
--
আমরা সবাই তাকে আশ্বস্ত করলাম ," তোর বর খুব বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছে। আর তুই ও একদম ঠিক করেছিস। তোরা কোন ভুল করিসনি। এখনও আর কাউকে খবরদার কোন কথা বলবি না। তোদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী, প্রমান কিছুই নেই। শয়তানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে থাকলেও কোন দোষ করিসনি। একদম মুখ বুজে থাকবি। সাক্ষী, প্রমান না পেলে ফাঁসী তো দূরের কথা, শুধু সন্দেহের বশে কোন সাজা আইনত দেওয়া যায় না।" শুনে হাওয়া অনেকটা আশ্বস্ত হল।
--
আমাদের যদিও জানা ছিল পয়সা দিয়ে এই ব্যবস্থায় বিচার কেনা যায়। তবে হওয়ার বাজান, খালা, আর আত্মীয় স্বজন অনেক চেষ্টা করে ভাল উকিল দিয়েছে। কোন জোরাল প্রমান আর সাক্ষ্য ও পাওয়া যায়নি। আশেপাশের গ্রামের মেয়েদের জীবন অতিষ্ট করে তোলার জন্য মৃতের প্রতি পাড়া পড়শীর কোন সহানুভূতি ছিল না, এগুলি ভরসার কথা। আরও বছর খানেক বিচার চলার পর, হাওয়া, তার বর আর দেওর বেনিফিট অফ ডাউট এ খালাস পেল। সকলেই খুব খুশী। যাওয়ার সময় জনে জনে সম্ভাষণ জানিয়ে গেল।এক চোখে একদিকে বিচ্ছেদ বেদনা অন্য দিকে আনন্দের অশ্রু  নিয়ে আমাদের হাওয়াবিবি জেলের কাল কুঠুরী ছেড়ে আপনজনদের কাছে ফিরে গেল। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


                  


  




  







  








    







   

4 Jul 2019

শোনিচারীর কথা

শোনিচারীর  কথা
*************

শোনিচারী কে আমরা চিনেছিলাম মাসিমার (শান্তিরানী দেব ) মাধ্যমে। ৭০ দশকে বর্দ্ধমান জেলে মাসিমা আর  বুলু সাধারণ বন্দিনীদের সাথে থাকত। শোনিচারী এক আদিবাসী সাঁওতাল মেয়ে, খুনের অপরাধে জেলে এসেছিল, চিরাচরিত সেই শোষক আর শোষিতের দ্বন্দ্বের  ইতিহাসে।
--
দরিদ্র অভাবী একটি পরিবার - বাবা, মা, শোনিচারী আর তার বড় আদরের বছর খানেকের ছোট ভাই। একটা ঝক ঝকে মাটির নিকোনো ঘর আর তার লাগোয়া সামান্য কয়েক কাঠা চাষের জমি। ঘরের উঠোনে আর মাটির ঘরের চালে ছিল নিজেদের হাতে ফলান তরিতরকারির বাগান। চারজনের অক্লান্ত পরিশ্রমে চাষের জমিতে ফলত ধান। এই নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল তাঁরা। পরিবারের মধ্যে ছিল অগাধ ভালবাসা। সহজ সরল মানুষ তাঁরা, গ্রামের জমিদারের কুটিল ষড়যন্ত্রের কথা তাঁদের জানা ছিল না।
---
শোনিচারী তখন যৌবনে পা রেখেছে, কচি সবুজ তার মন। সবল শরীরে খাটতেও পারত, পাড়াপড়শীর সাথে প্রাণ খুলে মিশতে বাঁধা কোন ছিল না, সঙ্গী সাথীদের সাথে পালা পার্বনে মন উজাড় করে আনন্দ করতে জানত, আর সদাই ঝর্ণার মত খিলখিলিয়ে হাসত। এইভাবে বেশ দিন কাটছিল, কিন্তু  ঈশান কোনে কাল মেঘের আভাস তাঁরা পায়নি। গ্রামের জোতদার মুখিয়ে ছিল যে কোন শর্তে ফন্দিফিকিরে তাঁদের জমিখানি দখল করার।
--
একদিন পার্বণে সঙ্গিনীদের সাথে মেলায় গেছিল শোনিচারী। ভাইও তাঁর কাজে কর্মে গ্রামের বাইরে ছিল। মেলায় অনেক আনন্দ করে ভোর রাতে গ্রামে ফিরে শোনিচারী দেখে তাঁদের সোনার কুটির জ্বলে পুড়ে খাঁক, তারই সাথে বাবা ও মা পুড়ে কালো কাঠ, সবজি বাগান ও তথৈবচ। পরবে, মেলায়  মেতে ছিল গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ। অবশিষ্ট গ্রাম রাতের ঘুমে ডুবে। হটাৎ পোড়া ধোঁওয়ার  গন্ধে জেগে ওঠে. চারিদিকে জোতদারের লেঠেলদের দেখে ভয়ে পাথর হয়ে যায়। শোনিচারী বাড়ী ফিরে সব দেখে শুনে দিশেহারা। ভাই তখনও ফেরেনি। ধীরে ধীরে ভিতরে আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে। মাথা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে, কোন মতে একটা টাঙ্গি জোগাড় করে সব বাধা ভেঙে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে। শয়তান জোতদারের  বাড়ীর দিকে দৌড়াতে থাকে।
--
তখন সবে ভোর, জোতদারের বাড়ীর লোকজন ভিতরে ব্যস্ত, শুধু উঠোনে তাদের  দুটি বাচ্চা ঘুম চোখে বসে। দিকবিদিক শূন্য শোনিচারীর মাথা তখন ইটের ভাঁটার মত জ্বলছে। প্রতিশোধের আগুনে সে আধা ঘুমন্ত শিশুদুটিকে টাঙ্গি দিয়ে ক্রমাগত কোপাতে থাকে, তাদের কান্নার আওয়াজে চারিদিকে লোক জমে গেলেও শোনিচারী বধির। তার রণমূর্তি দেখে কেউ এগোতে সাহস পায়না, অবশেষে শ্রান্ত হয়ে রক্তাক্ত উন্মাদিনীর মত টাঙ্গি হাতে থানায় গিয়ে হাজির হয় অকপটে সব বৃত্তান্ত খুলে বলে।
--
জোতদার তার পেটোয়া লোকজন নিয়ে থানায় গিয়ে নালিশ জানায় শোনিচারী ও তার ভাই দুজনে মিলে বিনা কারণে তার নাতি ও নাতনি কে খুন করেছে। শোনিচারী বারবার প্রতিবাদ জানায় তাঁর ভাই গ্রামেই নেই, সে একাই শিশুদুটিকে হত্যা করেছে, জমিদার বাবু  বিনা কারণে তাঁর ঘুমন্ত বাপ্ মা কে রাতে পুড়িয়ে মেরেছে। কিন্তু থানার দারগাও আর এক খয়ের খাঁ। সে জমিদারের নালিশের ভিত্তিতে কেস সাজায়। গ্রামে ফিরে সব শুনে ভাই শোনিচারীর সাথে দেখা করতে এলে তাকেও হাজতে পুরে দেয়।  
--
বিচারে শোনিচারী আর তার ভাইয়ের যাবজ্জীবন সাজা হল দুটি শিশুকে মারার অপরাধে। গ্রামের সব সরল গরীব মানুষরা পুরো ঘটনার কথা আদালতে বলতে চেষ্টা করে। শোনিচারীর ভাই ঘটনার দিন গ্রামেই ছিল না, সে একদম নির্দোষ। আর জমিদার বাবুর আদেশে তার  দালালরা  সাজিস করে  নিরীহ ঘুমন্ত বাপমা কে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার জন্য শোনিচারীর মাথার ঠিক ছিলনা বলেই সে ওই অপরাধ করেছে, এ সব কথাই আদালতে তাঁরা বলেন। কিন্তু ঘাগু জোত্দারের দালালদের আধা মিথ্যা সাক্ষ্য ও থানার দারোগাদের পক্ষপাতিত্বমূলক কেস সাজানো, আর বাদীপক্ষের তুখড় ওকালতির চালে রায়  শোনিচারীদের বিরুদ্ধে যায়। তাঁদের বাবামায়ের পুড়িয়ে মারার ঘটনা কে নিছক দুর্ঘটনা  বলে গণ্য করা হয়। এরপর চতুর  জোতদারের শোনিচরীদের জায়গা আত্মসাৎ আর কোন বাধা থাকল না।
--
পাথরের মূর্তির মত সে  বড় বড় চোখ মেলে অসহায় ভাবে  চুপ করে শুনে যায়। রায়ের শেষে চীৎকার করে কেঁদে ওঠে," হুজুর, মুই খুনটো কৈরলাম, মকে ফাঁসী দাও কেনে , মর ভাই টো কুন্ দুষ করেক লাই, ওয়ারে সাজা দিলেক কেনে ? তমাদের পায়ে গড় করি, উকে ছেইড়ে দাও গ। " কিন্তু ইটঁকাঠের আদালত কি তার অসহায় কান্না শোনে! এইভাবেই  দিনের পর দিন  অন্যায়ের বদলা নিতে গেলে এভাবেই গরীবের শাস্তি ঠিক হয়, বড়লোকে টাকার জোরে ঠান্ডা মাথায় খুন করেও  ঠিক মুক্তি পায়, গরীবের ভিটে মাটি আত্মসাৎ করে।
--
শোনিচারী জেলে ফিরে আসে কাঁদতে কাঁদতে,পাগলের মত দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে। সবাই কে একই প্রার্থনা জানায়, বাচ্চা দুটিকে সে মেরেছে, মহা অন্যায় করেছে, তার  ফাঁসী হোক, কিন্তু তার ভাইতো কোন কিছুই জানতনা, কিছু অন্যায় সে করেনি, তাঁর কেন শুধু শুধু সাজা দিল।প্রচন্ড জ্বরে গা তার পুড়ে যেতে থাকে। সকলে শান্ত করার চেষ্টা করে, আমাদের মাসীমা কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে সারা রাত তার মাথায় জল পট্টি দিতে থাকেন, সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। সে রাতের মত শোনিচারী ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু কদিন বাদে বাদেই এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। একদিকে দুটি নিষ্পাপ শিশুকে খুনের দংশন, অন্যদিকে নির্দোষ ঘুমন্ত বাপমা কে পুড়িয়ে মারা, সবচেয়ে বেশী পরম আদরের ভাইটির বিনা দোষে সাজা তাঁর মনের মধ্যে কুরে কুরে খেত। আমাদের মাসীমা তাকে সেবা করে সরিয়ে তুলতেন, আমাদের রাজনীতির মূল বিষয়গুলি তাঁর মত সহজ সরল ভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। সে সময় মাসিমাই ছিলেন শোনিচারীর সবচেয়ে বড় ভরসা, একান্ত আপনার জন। ধীরে,ধীরে তার অবস্থার একটু উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু এই টুকু সাহচর্য আর ভরসা তার ভাগ্যে সইলো না, মাসীমাকে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে বদলী করা হল।
--
 বর্দ্ধমান থেকে মাসিমা আর বুলু আমাদের মধ্যে এসে পড়লেন। এদিকে মীনাক্ষিকে ডিভিশন ওয়ার্ড এ দিয়েছে, সেলে কল্যানী, রাজশ্রী আর কল্পনা। রাজশ্রী তখন একটা বিশাল মানষিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল জেল ভাঙার যে পরিকল্পনায় ওরা যুক্ত ছিল, তাতে ওর পরমপ্রিয় কমরেড ও স্বামী সঞ্জয়ের গুলিতে মৃত্যু হয়। ওয়ার্ড অনেক নতুন মেয়েরা এসেছে। আমরা সবাই মহা ব্যস্ত। এর মধ্যে একদিন মাসিমাকে হাসপাতালের বড় জালনায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে আমরা কয়েকজন একটু তফাৎ রেখে কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। জালনার ওপারে ছিল শোনিচারী, এইখানে চিকিৎসার জন্য বদলী হয়ে এসেছে। সমস্ত অপরিচিতের মাঝে মাসীমাকে দেখে যেন হারান মানিক খুঁজে পেয়েছে। তাঁর দুহাত জড়িয়ে ধরে একবার কাঁদে, আবার কান্নার মধ্যেই আনন্দে মুখে হাসির ঝিলিক দিতে থাকে। এতদিন আমরা যে শোনিচারীর গল্প অনেকবার শুনেছি তাকে এবার আমরা চাক্ষুস দেখলাম।
--
এই ভাবে চলতে থাকে। হাসপাতালের মেট তখন মহাদেবিয়া। মেট্রনদের সামনে সে তাঁদের আজ্ঞাবহ থাকত, কিন্তু আড়ালে আমাদের সাথে যথেষ্ট ভাল ব্যবহার করত। তাই মাসিমা প্রতিদিন শোনিচারীর সাথে কথা বলার সুযোগ পেতেন। সে সানন্দে মাসিমাকে তার সব দুঃখ,অভিযোগ আর জেলের মহিলা  ওয়ার্ডের বিভিন্ন ঘটনার গল্প করত। স্বাভাবিক ভাবেই  যে বিপর্যয় তাঁর জীবনে ঘটে গেছে তা কি সে ভুলতে পারে, প্রায়ই ভীষণ কান্নাকাটি করত, মাসিমা গরাদের এপার থেকে তাকে মাথায় হাত বুলাতেন, সান্তনা দিতেন।একমাত্র বুলু ছাড়া আমরা কেউ গিয়ে দাঁড়ালে শোনিচারী কচ্ছপের মত খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে ফেলত, কারণ আমরা বাকিরা সবাই তার কাছে অপরিচিত।  তাই আমরাও দূরে দূরেই থাকতাম, মাসিমার কাছ থেকেই সব কথা শুনতাম। মহাদেবিয়াও শোনিচারীর ভার মাসিমার হাতে দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হওয়াতে তাঁদের আলাপচারিতাতে বাধা দিত না।
--
তখন জেলের জালঘরে বার্মা থেকে পালিয়ে আসা অনেক জন মহিলা ও তাঁদের বাচ্চাদের রাখা হয়েছিল। প্রচন্ড কষ্টে তাঁরা ছিলেন। শীতের রাতে ঠান্ডা কনকনে বাতাস আর গরমের দুপুরের তীব্র দহন খোলা জালের ভিতর দিয়ে আসত , ছোট বাচ্চাগুলি জ্বর, পেটগরম ইত্যাদিতে ভুগতে। উপরন্তু জেলে বন্দিনীদের স্বভাবিকভাবেই চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য কোন কিছু ঠিক মত মিলত না। ডাক্তার বাবুরা ডায়েট লিখলেও সে সবই মেট্রন, অসৎ জমাদারনী আর তাদের পেটোয়া দালাল রা আত্মসাৎ করত। রোজই প্রায় জলঘরে  শিশুমৃত্যু ঘটত। একদিন বর্মী মাসিরা অনশন করে তার প্রতিবাদে। আমরাও সমর্থনে অনশনে ভাগ নিই। হাসপাতালের জানলা দিয়ে ডাক্তার বাবুদের ওষুধ,ডায়েট ইত্যাদি ব্যাপারে বাস্তব অবস্থা টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতে থাকি। আমাদের সামনে মেট্রন মেটদের ওপর খুব হম্বি তম্বি করে যাতে ঠিক মত ডায়েট ওষুধ দেওয়া হয়। অনশন প্রত্যাহার হয়। ডাক্তারদের সামনে এই অপমান শোধ যে পরে কোন ছুতায় মেট্রন নেবে তা আমরা বুঝে গেলাম। কিন্তু আপাতত আর কিছু করার ছিল না।
--
আমাদের আশংকা একদিন সত্য হল। এক সকালে ভাটির দিন হটাৎ প্রচন্ড কান্নাকাটির রোল সারা মহিলা ওয়ার্ডে প্রতিদ্ধনিত হতে লাগল। আমরা  সকলে ডিভিশন বাড়ীর খাঁচায় বন্দী, একবার মেয়াদী নম্বরের জালনায়, একবার   হাসপাতালের জালনায়  কি তুলকালাম ঘটছে তাই জানার ব্যাকুল হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি। শেষে মেয়াদী নম্বর থেকে আমাদের ভালবাসত এমন কয়েক জন জানাল বর্মি মাসিদের বেধড়ক মারছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে কুখ্যাত বিজয়া জমাদারণী। "কেন মারছে " ? "ওদের কাছে নাকি দা চাকু বঠি সব লুকান ছিল, অনেক গয়না গাটি লুকানো  ছিল !" কি করে এসব থাকবে , জেলে ঢোকার সময় জেল অফিসে একবার, মহিলা ওয়ার্ডে একবার তন্নতন্ন করে সব বন্দিনীদের সারা শরীর ও জিনিসপত্র তল্লাশি হয়, পয়সাকড়ি, গয়নাগাটি  জেলের অফিসে জমা রাখা হয় , একটা সুঁচ গলার জো থাকেনা। সেখানে এতো গয়নাগাঁটি, চাকু, হাত দাও, বটি  নিয়ে তাঁরা দিব্যি চলে এল ! আর এত দিন বাদে সেগুলি ধরা পড়ল !"
--
"আমাদের রাজনীতির প্রভাবে যে বন্দিনীরা ছিলেন, তাঁরা বললেন সব ছল গো দিদি। ডায়েট নিয়ে মেট্রনের মুখ পুড়েছে না, এটা তার প্রতিশোধ। আমাদের মতই কুঁড়িয়ে পাওয়া টুকরো টাকরা টিনের পাত ছিল শুধু তাই পেয়েছে আর কারো কারো পায়ের আঙুলের আংটি আর অল্প কিছু বাসনকসন ছিল কুখ্যাত দালাল শিখা অন্য জেলে যাবার সময় কেড়ে নিয়েছিল, বাকী  লোভী শয়তানগুলি সেগুলির ভাগ তখন ই নিয়ে নিয়েছে। বাকী আর কিছুই পাবার নেই। সব  মিথ্যা রটনা।" ইতিমধ্যে হাপাতালের জালনায় দেখি শোনিচারী উত্তেজিত ভাবে সেই সব রটনাগুলি বিশ্বাস করে মাসিমাকে শোনাচ্ছে। মাসীমা বোঝাবার চেষ্টা করছেন। এতদিন হাসপাতালে থাকার ফলে তাঁর সরল মনে মেট্রনের আপাত মিঠে কথা আর সুবিধাভোগী দালালদের সঙ্গ তাদের প্রতি তার মনে একটা আস্থার  ছাপ ফেলেছে। তাই  সরল বিশ্বাসে তাদের সপক্ষে বলে যাচ্ছে। হটাৎ আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে বসে, "তুমিও শেষে ওই দালাদের দলে ভিড়লে।"  অপমানে, অভিমানে মুখ তাঁর কাল হয়ে ওঠে। মাসিমা বারবার ডাকলেও কোন উত্তর না দিয়ে সে পিছন ফিরে হাঁটা দেয়।
--
ইতিমধ্যে আমরা হাসপাতালের গরাদের এপার থেকে মেট্রন আর দালালদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকি। ডাক্তারবাবুরা এসে যান, তাঁদের আমরা আসল ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে থাকি। তাঁরা সব বুঝলেও, একমাত্র স্বল্প আয়োজনে যে টুকু সম্ভব আহতদের চিকিৎসা করেন। সময় হয়ে যাওয়ায় কজন জমাদার আর জমাদারনী এসে সব বন্দীদের খাঁচায় ভরে দেয়।
--
এর ফলে একটা খুব খারাপ ঘটনা ঘটল। শোনিচারী আর আমাদের থেকে দূরে সরে গেল। একমাত্র মাসিমাই ছিল তাঁর আপনার, কিন্তু তাঁর ডাকেও সে আর সাড়া দিলনা। মেট্রন তাকে প্রথমে হাজতি নম্বরে পাঠিয়ে দিল। অন্যদের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছিলাম তার নিঃসঙ্গতা দূর করতে। কিন্তু সে যেন চিরদিনের জন্য বোবা হয়ে গেল। তার অপরাধ বোধ তাকে ধীরে ধীরে অপ্রকিতস্থতার দিকে ঠেলে দিতে লাগল। হয়ত যখন তার বাবামায়ের পুড়ে কাঠ চেহারার কথা মনে পড়ত, দুটি শিশুর তীব্র আর্তনাদ কানে আসতো, তার ছোট ভাইটির বিনা দোষে সাজার কথা মনে পড়ত সে আর ঠিক থাকতে পারতনা গোঙাতে থাকত, উন্মত্ত হয়ে পড়ত। অবশেষে একদিন পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে পাগল বাড়ীর বাসিন্দা হল। এই খবর টুকু মহাদেবীয়া সবার অলক্ষে মাসীমাকে দিয়ে যায়। আমাদের একটা ভুলে সহজ সরল একটা নবীন প্রাণ অন্ধকার জীবনে ডুবে গেল।  কদিন এই নরক যন্ত্রনা তাকে ভোগ করতে হবে, জীবনের আলোতে আর কোনদিন  সে ফিরতে পারবে কিনা, সেটা অনিশ্চিতই রয়ে যাবে। তার পরিণীতি আর কেউ জানতে পারবেনা, আর মাসীমার মনে তার গভীর ক্ষত  হয়ে থাকল। আজও কত শোনিচারী এই ভাবে শোষণ আর অত্যাচারের শিকার হয়ে অন্ধকার কোন কুঠুরীতে পচে মরছে তার হিসাব নেই।      
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------












 














 
















 






































25 Jun 2019

ঝরাপাতা

ঝরাপাতা
********
ঝরাপাতার দিন এখনও দুরায়ত,
আকাশের মুখ বিবর্ন, বিষন্ন
নিত্য নতুন নরক দর্শন,
লোভাতুর জিহবা কিসে তোর তুষ্টি!
মরনাপন্ন জীর্ণ ভূমি ধুঁকছে ,
জুঁই ফুলের সর্বাঙ্গেও জরুলের চাষ;
পাহাড়ী ছোট্ট নদীটির হাহাকার,
রাতের ভাঙাচোরা স্বপ্ন কাকডাকা ভোরে 
ডানা মেলে সুদূর সাগরের পানে -
সোনালী রোদ ঝরে যায়;
সুখের পাখী মুক্ত বাতাসে দেয় উড়ান
কুঁড়ে ঘরের চালে যাপিত জীবনে বসত করে দুঃখের পাখীটি।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

5 Jun 2019

বিবেক

বিবেক
*****

বিবেক তুমি কোথায়, আজ কি হারিয়ে গেছ জীবন থেকে ! মানুষের মনের গহনে ছিল তোমার বাস। ঝর্ণার মত কুলকুল করে বইতে, জোৎস্না মেদুর ভালবাসা ছড়িয়ে দিতে কত শত মনকেমনের নদীর স্রোতে। ঋজু পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় শ্বেতশুভ্র বরফে ছিল তোমার অস্তিত্ব । দিগন্ত জোড়া বনানীর মাঝে তুমি সবুজ হাসি হাসতে। এই মহাকাশ জোড়া স্বাধীনতা ছিল তোমারই  অবদান। কত নতুন নতুন ইচ্ছে ভরা ঝোড়ো বাতাসে ভরিয়ে দিতে বাতাবরণ। ভোরের নরম আলো নবীন উদ্যমে ভরে দিত। উর্বরা ভূমিতে দিয়েছিলে নিশ্চিন্ত মমতামাখা আশ্রয়। বৃষ্টিঝরা উচ্ছলতা তেও ছিল নিরাপত্তার সুখ।   রং বেরঙের প্রজাপতি আর পাখিদের করেছিলে মুক্তির দূত। ঋতুর বৈচিত্রে, ফুলের সৌরভে ঢেলে দিয়েছিলে অবাধ নির্মল ভালোবাসা। মহাসমুদ্রের গর্ভে গভীরতা আর তার উত্তাল তরঙ্গমালায়  সাহস ছড়িয়েছিল তুমি বিবেক, তুমি। আজ কোথায় অস্তিত্ব, কেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে তোমার উপস্থিতি!
--
অসংখ্য কাঁটাতারে ঘিরে ফেলেছে তোমার পৃথিবীকে, তোমার মানবজাতিকে অসংখ্য ভাগে বিভক্ত  করে ফেলছে। বেড়েই চলেছে গোলা বারুদ আর অস্ত্রের সম্ভার। বাতাবরণ হয়ে উঠেছে বিষাক্ত  ঘৃণা আর হিংসা ভরেছে মানুষের সেই মনে, যে সিংহাসনে ছিল বিবেক তোমার বসত। তোষামোদ স্থান নিয়েছে যোগ্যতার। সততা আর নিষ্ঠার বদলে লোভ চষে ফেলছে মানব জমিন। হিংস্রতার প্রতিযোগিতায় জীবন আজ দুর্বিষহ। ভালবাসা হারিয়ে যাচ্ছে, মানষিক শারীরিক স্থবিরতা জগৎ জুড়ে। আজ প্রতিটি দিন যেন ডুবে যায় গুমরান অন্ধকার এক সমুদ্রে।
--
কয়লার খনি থেকে পাওয়া যায় হীরে। ঝিনুকের মধ্যে জন্ম হয় মুক্ত। ঠিক তেমনি মানব হৃদয়ের অন্তরে, মস্তিকের অভ্যন্তরে বিবেকের বাস। বিবেক হল সততা, আর জীবন ও যাপনের  ধ্রুব তারা। এই বিবেক কে বাদ দিয়ে সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি, শক্তিসামর্থ, স্বপ্নইচ্ছা, প্রচেষ্টাপ্রতিজ্ঞা সব ই মূল্যহীন। বিবেক অন্ধকারের  আলো, প্রলয়ের কান্ডারী। তাই সমাজ থেকে বিবেকবোধ হারিয়ে যাওয়ার অর্থ পতনের পিচ্ছিল নরকের দ্বারে পা বাড়ান।        
--
বিবেক তুমি জেগে ওঠ পৃথিবীর প্রতিটি কোনে, প্রতিটি মানুষের মনে। ভেঙে ফেল এই গারদখানা, স্তব্ধ কর এই পৈশাচিকতার উল্লাসকে,  রুদ্ধ করে দাও এই ঘৃণিত গরল স্রোতধারা। প্রতিটি মানুষ শুধু কেন প্রতিটি প্রাণ এই ধরিত্রীর সন্তান। এখানে সকলের অধিকার সমান, আর সমান সকলের দায়িত্ববোধ। একমাত্র তুমিই পার এই পৃথিবীততে এক আকাশ জুড়ে অনন্য রামধনুর স্বপ্ন কে সফল করে তুলতে। সমাজে এই নিদারুণ একাকিত্বের হাহাকার মুছে যাক, মানবিক মেলবন্ধের কল্লোলে ভেসে যাক আমাদের এই পৃথিবী 
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------







26 Feb 2019

রক্ত

রক্ত
******

তুমি যখন আঘাত কর
মানুষের বুকের রক্তে
ভিজে যায় মানবমনের জমিন,
খালি হয়ে যায় কত মাতৃক্রোড়,
আমি যখন আঘাত হানি
সেই মানুষেরই বুকের রক্তে
লাল হয় একই মানবজমিন
শূন্য হয় কত মায়ের কোল।
--
বারুদ কোন ব্যবধান
বোঝেনা, সব কিছুকে
ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে করে ছারখার,
দেশ বিদেশের গণ্ডি মানে না
প্রতিবেশীর ঘরের চালে
আগুন লাগালে, সে অচিরে
ছড়িয়ে পড়ে আমারই চালে।
--

অনেক যুদ্ধ দেখছে পৃথিবী
জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে,
বর্ণে বর্ণে, দেশে দেশে।
দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে 
এই মানব সমাজ
হিরোশিমা নাগাসাকি আজও
তার ক্ষত বয়ে চলেছে,
আর যুদ্ধ চাই না।
--
যুদ্ধ মানে সত্যের অপমৃত্যু,
মানবাধিকারের লঙ্ঘন
আর মনুষ্যত্বের অবমাননা ;
মানবিকতা কিন্ত লাশের
প্রভেদ জানে না,
তাইতো প্রতিটি মৃত্যুই
চোখের জল ঝরায়,
ঝরায় তাজা রক্ত
রক্ত ঝরলে ভাল লাগে না,
ভীষণ খারাপ লাগে আমার।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------






   

31 Jan 2019

মুক্ত নুড়ির মালা

মুক্ত নুড়ির মালা
*************
জীবনে চলার পথে কুড়ানো কত নুড়ি
মহাকালের ঝুলিতে ভরা সযতনে,
নুড়ি পাথরের মুক্তমালা গাঁথার চেষ্টা অবিরাম
আছে কত আতর গন্ধ স্মৃতি
কত জ্যোৎস্না মাখা ভালবাসা
টুকরো টুকরো ঝিনুক ঢাকা কথা,
সুবিশাল ক্যানভাস
জলছাপ ছবি ভাসা ভাসা। 
--
জ্বলজ্বলে মুখগুলি যেন এক আকাশ তারা,
হাঁটাচলায় মাদলের দ্রিমি দ্রিমি
কণ্ঠ কখন বাঁশির সুর, 
কখন বা মেঘমন্দ্র আওয়াজ
উঁচু পাহাড়ের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া দিন।
মাথার ওপর জ্বলন্ত অঙ্গার, 
বা নিকষ নিবীড় অন্ধকার
বয়েছে অগণিত রক্তনদী।
--
কাঁটার মুকুট কপালে
ঝোড়ো সময়ের দৌড়, 
থামলেই থেমে যাওয়া,
তাইতো দ্রুতবেগে সবল পায়ে এগিয়ে যাওয়া 
আকাশের দিকে বাড়ান বজ্রমুষ্টি 
লাল সূর্য্যটাকে যে ধরতেই হবে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

17 Jan 2019

কবিতা

কবিতা 
********
জীবন সংগ্রামের আর এক নাম কবিতা
আদি থেকে অন্তের পরতে পরতে কাব্য,
বিবর্তনের অন্তঃস্থলে রয়েছে এক অপরূপ ছন্দ
বিন্দু থেকে বিশ্বব্রম্ভান্ডে রূপান্তরও সুগভীর এক লয়
ছত্রাক থেকে প্রানের সূচনায়ও লুকিয়ে আদিম কাব্য,
সৃষ্টি আর ধ্বংস চলে তালে তাল মিলিয়ে
সময়ের দু হাতে বাজতে থাকে দুন্দুভী
মহাকালের বাঁশীতে বয়ে চলে পরিবর্তনের ধারা
যুগে যুগে রচিত হয় এক একটি  মহাকাব্য,
ভরকেন্দ্রের হৃৎপিন্ড খুঁড়ে এগিয়ে যায় সে কাব্য, 
যুগিয়ে যায় বেঁচে থাকার অক্সিজেন
মৃত্যু কে বরণ করে নিতে দেয় প্রেরণা
কবিতা তার শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ, বর্ন নিয়ে 
গতির সাথে তাল, লয়, ছন্দ মিলিয়ে 
যখন হয়ে ওঠে অর্থবহ, দেখায় নতুন স্বপ্ন,
তখনই সে হয় মহান, কালোর্ত্তীর্ন,
অনুভবের অনুরণনে বিলীন,  
অগ্রগতির পাথেয়, এক অনন্য কৃষ্টি।