20 Sept 2019

বহতা সময়ের অঙ্গীকার

বহতা সময়ের অঙ্গীকার
*****************

নিতান্ত আটপৌরে যাপনেও কোথায় যেন
একটা বিষম রকম চিড় খেয়ে গেছে ,
সকালের চা আর খবরের কাগজ মধ্যবিত্ত জীবনে
এক চলমান চিরাচরিত ধারাতেও ঘুন ধরেছে,
কাগজের প্রতিটি পাতা যেন নিঃশব্দ চোখের জল
চায়ের কাপে মিশে মিশে স্বাদহীন করে তোলে।
--
অনাহার, অর্ধাহার, আত্মহত্যা, খুনোখুনি, ধর্ষণ
বেশ কিছু হল প্রতিদিনের ডাল ভাতের মত জোলো,
নোটবন্দী, দেশের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অনায়াসে
বিদেশে পালানো যেন নেহাৎ ই ছোট্ট একটু মশার কামড়।
বিদেশীদের কাছে প্রাকৃতিক সম্পদ, জনতার জন্মসূত্রে অর্জ্জিত
অধিকার গুলি কোন অদৃশ্য হাতের খেলায়  বিক্রী হয়ে যাচ্ছে।
স্কুল কলেজে গুন্ডাবাজী দেখে দেখে আমাদের চোখ ক্লান্ত
নোঙ্গর ফেলা জীবনে সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবে ঘটে চলছে।
--
কিন্তু আসামে দেশের মানুষ যখন বিদেশী তকমা পেয়ে ক্যাম্পে
বাস করতে বাধ্য হয়, কাশ্মীর যখন সংবিধান স্বীকৃত অধিকার খুইয়ে
কাঁটাতারের ঘেরাটোপে থাকে, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়
সেনাপরিবেষ্টিত বসতি, যখন নিত্যদিন বুলেটবৃষ্টি ঘটে চলে সেখানে,
তখন দাঁড়িপাল্লার মত দোদুল্যমান জীবনেও ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়।
--
যাঁরা চিরকাল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছে,তাঁদের ফেলে যাওয়া
পদচিহ্নের ওপর যে পলিমাটির স্তর সৃষ্টি হয় তাতে সোনাগলা ফসল
ফলে, দিগন্তের কোনে ঝুলে থাকে লাল সূর্য, রাতের সাগরে
ডুব দিয়ে ওঠে অজন্তার পূর্ণিমার চাঁদ, ফুলের মত অসংখ্য তারা,
হৃদয় মোচড়ানো কান্না পরিবর্তিত হয় বহতা সময়ের নুপুর ঝংকারে।
নির্মল শিশির সিক্ত পরিযায়ী বাতাসে মন্দ্রিত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়,
"এই পৃথিবীর মানুষ আর নতুন করে কোন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
বা ইহুদি ঘেটো তৈরী করতে দেবেনা, দেবেনা, দেবেনা। "
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------














3 Sept 2019

শান্তিমাসীর ঘরকন্না

শান্তিমাসীর ঘরকন্না
***************
শান্তিমাসী জেলে এসেছিলেন পাসপোর্ট কেসে। তখন তাঁর বয়স ৩০এর মধ্যে, বাংলা দেশের মানুষ। ছোটখাটো কিন্তু কর্মঠ চেহারা। সম্ভবত বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত, গলায় তুলসীর কন্ঠী, নাকে রসকলি আঁকা। মনটি ছিল দয়ামায়ায় ভরপুর।
মাসীর কাছে শুনেছিলাম খুব কৈশোরেই  দোজবরে বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর আগের পক্ষের দুটি ছেলেই শান্তিমাসীর থেকে বয়সে বড়, এবং বিবাহযোগ্য ছিল। তথাপি ছেলেদের বিয়ে না দিয়ে শ্যামলা চেহারায় মিষ্টি মুখশ্রী ও ফুটন্ত যৌবনের টানে স্বামী নিজেই বিয়ে করেন। সংসারে স্বাচ্ছন্দের অভাব ছিলনা। কিন্তু বিয়ের সাথে সাথেই স্বামী গোয়াল সামলান, ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ, ধানভানা, চিঁড়েকোটা, সবজি বাগান দেখভাল সমস্ত কাজ সদ্যকিশোরী মেয়েটির উপর চাপিয়ে দিয়েছিল, যাতে তাঁকে সারাদিন ব্যস্ত রাখা যায়।
--
মানুষটি ছিল প্রচন্ড সন্দেহপ্রবন ও কামুক প্রকৃতির। ঘরে দুটি জোয়ান ছেলে, তাই কঠোর নজরদারী। কাজের তোড়ে বউ এর যখন নিশ্বাস ফেলার সময় নেই তখন এসে নিজের শারীরিক খিদে মেটাত, দিনের মধ্যে কত বার যে এ ঘটনা ঘটাত তার ঠিক ঠিকানা থাকত না। শরীরে না পোশালেও কোন রেহাই ছিল না, আপত্তি করলে পৈশাচিক ভাবে তাকে ধর্ষণ করত। একটা  সময়ের পর মাসীর মনে মাতৃত্বের সাধ জাগে, কিন্তু সে গুড়েও বালি। এদিকে নিজের প্রৌঢ়ত্বের অক্ষমতা তার স্বামীকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলত। নাতনীসম কিশোরী মেয়েটির মন বা শরীরের খবর রাখা স্বামীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ত না, শারীরিক খিদে মেটান আর সংসারের সাশ্রয় করার কল ছিল সে। সব সময় সন্দেহ যে জোয়ান ছেলে দুটির প্রতি আকর্ষণ বশতঃ শান্তিমাসীর তার প্রতি অনীহা।  এত বিকৃত অত্যাচার দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে মাসীর জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে, পরিত্রানের পথ খুঁজতে থাকেন।
--
সুযোগ এসে যায় বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের কিছুকাল পরে কিছু পরিচিতজন ও স্বজন পালিয়ে চলে  আসছিল। মাসী তাঁদের সাথে চুপি চুপি ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসেন। পথে সীমান্তরক্ষীদের হাতে পড়েন, এ থানা ও থানা ঘুরে প্রেসিডেন্সি জেলের হাজতী নম্বরে ঠাঁই পান। ধীরে ধীরে এখনকার ব্যাপার স্যাপার বুঝে নেন। আস্তে আস্তে  আমাদের সাথে আলাপ হয়, আমাদের মধ্যে বুলুর সাথে মাসীর বেশী ভাব জমে ওঠে। তাছাড়া হাজতি নম্বরে মদিনা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, শোভা, মিতাদের স্নেহ দিয়ে কাছে টেনে নেন, ক্রমে তাঁদের গার্জিয়ান হয়ে ওঠেন। কোন সময়ে কোন কারণে তাঁরা অবাধ্যতা করলে দু কথা শোনাতে ছাড়তেন না, আবার কারোর শরীর বা মন খারাপ হলেও সেবাযত্ন আর হাসি মস্করা করে তাঁদের ভুলিয়ে রাখতেন। কিন্তু কোন কারণে যদি ওঁর কথা না শুনতো বা মাসীর মুখে মুখে কথা বলত, তিনি চোখের জল ফেলতে ফেলতে মেয়াদী নম্বরের গরাদের কাছে, আমাদের সাাথে ফাঁক দিয়ে কথা বলার জন্য ছুটে আসতেন, তাঁর কষ্টের কথা জানাতেন, "দ্যাখতো, আমার তো সত্যকার ঘরকন্না তো কোনদিন হইল না, মা হইতে পারি নাই।  অদের দিয়া ঘরকন্নার স্বাদ মিটাই, মা না হওনের দুখ ভুলি। হেয়ারা হেই কথাডা বঝতে চায় না। অদের যা কোই, অদের ভালার  জন্যি তো কোই।" আমরা তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করতাম, দোষী ব্যক্তি কে একটু বকতাম, মিটমাট হতে সময় লাগত না। অবশ্য শান্তি মাসীর চোখের জল ওরা সহ্য করতে পারত না,  তাই বেশীর ভাগ সময়েই ওরা নিজেরাই মিটমাট করে নিত।
--
শান্তি মাসীর পুষ্যিদের মধ্যে বেশ কজন হারানো বাচ্চা ছিল, যাদের কেউ দেখার ছিল না। জেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে ওরা নাম কে ওয়াস্তে ছিল, ওদের প্রকৃত আশ্রয় ছিল শান্তি মাসী। কে খাবাার ধরেনি, মাসী দালাল আর মেটদের সাথে নরমে গরমে কথা বলে তার খাবার ধরে নিয়ে আসতো, না পেলে নিজের খাবারের থেকে ভাগ দিত। কোন বন্দিনী অবাক হলে মাসী বলতেন,  " অরে আমাগো না খাইয়া থাকার অভ্যাস আসে, হেয়ারা পোলাপান মানুষ, ক্ষিদা সঝ্য করবো ক্যামনে !" জেলের ভিতর ক্ষিদে সহ্য করা যে কি কঠিন, সকালে এক মুঠো মুড়ি, দুপুরে এক ডাব্বু ভাত আর ডালের নামে একটু হলুদ জল, চিমটি খানেক তরকারি নামক এক বিশেষ ধরনের ঘ্যাট, বিকালে তিনটে আধা কাঁচা রুটি আর সেই ডালের জল আর ঘ্যাট। এতে একজন জোয়ান মানুষ কেন বাচ্চাদেরও পেট ভরে না, সেই মুষ্টিভর  অন্ন অনায়াসে বিলিয়ে দিতে যে পারে তাঁর আত্মত্যাগের কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন হয় না।
--
কোন বাচ্চা চান করেনি, গায়ে বাহ্যি পেচ্ছাপ লাগিয়ে ফেলেছে, জলের কলের কাছে প্রচন্ড ভীড়, কাছে যাবার উপায় নাই। মাসী ঠ্যালাঠেলি করে নিজের খাবার থালায় জল ভরে ভরে এনে উঠোনের ধারে দাঁড় করিয়ে সেই অভাগাটিকে চান করিয়ে, নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে দিতেন। মেট্রন, ওয়ার্ডাররা জায়গা নোংরা করার জন্য বকলে হেসে বলতেন, "চিন্তা কইরেন না, পরিষ্কার কইরা দিমু , জল না পাইলে নিজের কাপড়খানা দিয়া মুইছা দিমু হনে। হেয়ারা গুমুত মাইখ্যা রইলে কি জ্যালার, হুপারের (জেলার,সুপার ) কাসে আপনাগো বদনাম হইব না," জোঁকের মুখে নুন পড়ত। কোন বাচ্চার জ্বর হয়েছে, মাসি মেট্রন, ওয়ার্ডার মেটদের প্রায়  হাতে পায়ে ধরে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপথ্যি আদায় করে ছাড়তো। তা সম্ভব না হলে, ভাল ওয়ার্ডার বা ভাল মেট থাকলে অথবা ডায়েট আছে এমন বন্দিনীদের কাছ চেয়ে চিন্তে  দুধপাউরুটি জোগাড় করে খাওয়াত, ওষুধের বদলে নিজের রাতে খাবার থালার জলের মধ্যে কাপড়ের কোনা ভিজিয়ে জল পট্টি দিত। ওই এক থালা জলই মাসীর রাতের খাবার জন্য ধরা থাকত। মাতৃহীন ছেলে মেয়েরা শান্তিমাসীর কাছে মাতৃস্নেহ পেয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে, মায়ের মতই ভালোবাসত।
--
এসব  দেখে মেট্রন, খারাপ ওয়ার্ডার আর দালাল বন্দিনীরা খুশী হত না। হিংসায় মেট্রন একদিন হারানো বাচ্চাদের দেখার দায়িত্ব আনোয়ারা নামে এক দালালের হাতে তুলে দেয়। আনোয়ারা অল্প বয়সে ইঁট দিয়ে তিনজন বাচ্চার মাথায় মেরে খুন করে জুভেনাইল মার্ডার কেসে বন্দিনী হিসাবে জেলে এসেছিল। বাচ্চাদের দিয়ে সে তার স্নানের জল জোগাড় করা, চুলে, গায়, হাতে, পায়ে সাবান মাখানো, তেল মাখানো এসব কাজ করাত, কেউ কোন কাজ না পারলে প্রচন্ড মারধোর করত। অদ্ভুুুত একটা হিংস্রতা ছিল তার চরিত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই শান্তি মাসির মাতৃত্ব বোধে প্রচন্ড ঘা লাগে। তখন হাসিনারা সকলে মিলে ঘিরে রাখে। নানা আবদারে তাঁকে ব্যস্ত করে রাখত, গ্রামের প্রচলিত নানান ছড়া, গান, গল্প শুনতে চাইত।ওঁদের সেসব শোনাতে গিয়ে নিজের বেদনা ভুলে যেতেন। পরবর্তীকালে যতদিন জেলে ছিলেন সবুরজানের মত ছোট ছোট শিশুগুলির দেখভাল তিনিই করতেন। মেট্রন মনেপ্রাণে সেটা মেনে নিতে না পারলেও কিছু বাধা দেয়নি কারণ এতটুকু বাচ্চাদের দেখভাল যে তার দালালবাহিনীর দ্বারা সম্ভব নয় তা সে ভালই বুঝতো।
--
মাসী নিজের জন্য এক কণা জিনিষ কোনদিন কারও কাছে চাননি, বা নিজের জন্য কখন কোন দয়া ভিক্ষা করেননি। প্রখর আত্মসন্মানবোধ তাঁকে জেলের কুৎসিত প্রভাবগুলি কে ঘৃণা করতে শক্তি যোগাত। আবার যেদিন হাওয়াবিবি, মিতা, শোভা, হাসিনা, মদিনার মত জনা ১৫/২০ মেয়ে কম খাবার দেবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল শান্তি মাসি কিন্তু তাঁদের পাশে ছিলেন। একটাই কথা তাঁর, "আমার মাইয়াগুলান লড়াই করথে গিয়া শয়তানগুলানের হাতে মাইর খাইব আর আমি দূরে দাঁড়াইয়া দেখুম, তা আমার ধরমে সইব না। " তাঁর মাতৃত্ববোধ এমনই মহান ছিল।        
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------