9 Dec 2019

দুই সখীর গল্প

ভূমিকা
*******
 কালীঘাটে যে ভিখারিনী শিশুদুটি ধর্ষিতা হয়েছে, আর প্রতিদিন সমাজের প্রান্তিকশ্রেণীর যে সব শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধারা সকলের চোখের আড়ালে ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন,  বিচারের নামে যে প্রহসন সহ্য করেন, তাঁদের সকলের স্মরণে আমার আজকের লেখা।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

দুই সখীর গল্প
**********
মিতা আর শোভা দুই বান্ধবীকে জেলে সব সময় একসাথে সকলে দেখতে অভ্যস্থ ছিল। দুইজনেই রেপ কেসের ভিক্টিম হিসাবে জেল কাস্টডিতে ছিল। মিতার সাধারণ ঘরোয়া চেহারার মধ্যে দুটি উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত, চোখ আর শান্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা মুখের ভাব ওকে অসাধারণ করে তুলেছিল। স্বল্পবাক ও কিন্তু মিশুকে সহজে সবার আপন হয়ে উঠত। অন্যদিকে শোভা ছিল রীতিমত সুন্দরী, উচ্ছল স্বভাবের মেয়ে। বিপরীত স্বভাব হলেও  দুজনে ছিল হরিহর আত্মা।   
---
মিতারা ছিল পূর্ব বাংলার লোক। জমিজমা কিছু ছিল না, বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। এক ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে মোটামুটি চলে যেত। সব ছেলেমেয়েই স্কুলে যেত। মিতা ছিল মেজ এবং ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী, বাবা আর বড় বোনের মিতাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ও গর্ব। দিদি যখন সবে স্কুলের গণ্ডি পার হয়, তখন বাংলাদেশ যুদ্ধ চলছিল। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যদের ভয়ে মিতারা ভারতে চলে আসে। কিন্তু বাবা দেশ ছেড়ে আসার দুঃখ সহ্য করতে পারেননি। এদেশে কাজকর্মের বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। বড় মেয়ে পড়াশুনা ছেড়ে দুইবেলা বস্তিতে বস্তিতে বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ শুরু করে, বাবাও প্রথমে তাই করতেন। তাঁদের দুজনের প্রবল ইচ্ছা মিতার পড়াশুনা যাতে বন্ধ না হয়, যদিও মিতার মা এ ব্যাপারে ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। মিতা ঘরের কাজকর্ম, ছোট ভাইবোন দুটিকে দেখাশুনার সাথে তার পড়াশুনা বাবা ও দিদির সাহায্যে চালিয়ে যেতে থাকে। ইচ্ছে প্রাইভেটে বোর্ডের পরীক্ষা দেবে। 
--
কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বাবার মৃত্যু সব স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়ে যায়। দিদির একার পক্ষে পুরো সংসারের দায়িত্ব নেওয়া অসম্ভব হওয়াতে মিতা দিদির অমতেই একটা কারখানায় কাজ যোগাড় করে নিতে বাধ্য হয়। তবে বাড়ীতে মায়ের তীব্র বিরোধীতা সত্ত্বেও সব কাজের মধ্যেও রাত জেগে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকে। দিদি অবশ্য সবসময় তাকে উৎসাহ দিয়ে যায়। কিন্তু এই টুকু সুযোগ ও তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। 
---
সংসারের অভাব মেটাতে মিতা দিদির ঘোরতর অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায়ই ওভারটাইম করত। ফিরতে রাত হয়ে যেত, তার বিপদের আশংকায় দিদি অস্থির হয়ে পড়ত। বড় রাস্তা থেকে একটা কালভার্ট পেরিয়ে তাদের বস্তির পথ। সেখানে শাসক দলের কিছু বাজে ছেলে মদ খেয়ে মাতলামি করত, মেয়েদের পিছনে লাগত। দিদির ভয় কে সত্যি করে একদিন মিতার ফিরতে একটু বেশী রাত হয়ে যায়, সারা রাস্তা নির্জন, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসার পথে মিতা তাদের খপ্পরে পড়ে।  অনেক অনুনয়, চেঁচামিচি, ধস্তাধস্তি করেও তাদের হাত থেকে মুক্তি পায়না। জনা ৫/৬ জন তাকে একটা নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে, রক্তার্ত আর মুর্ছিত অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়। 
---
সারা রাত উৎকণ্ঠায় থেকে কাক ভোরে দিদি দুই একজন বস্তিবাসীকে নিয়ে মিতাকে খুঁজে বার করে এবং থানায় খবর দেয়। পুলিশ মিতাকে ভিক্টিম হিসাবে তাদের সেফ কাস্টডিতে নেয়। এরপর সেই একই বস্তাপঁচা ইতিহাস। মিতা ঘটনার যথা সম্ভব বর্ণনা দেয়। বস্তিবাসী রা কালভার্টের ওপর সন্ধ্যারাতের বখাটে ছেলেদের মাতলামি, মেয়েদের পিছনে লাগা এবং অসভ্যতার কথা বিবৃত করে। মিতাকে পুলিশ কাস্টডি থেকে জেল কাস্টডিতে চালান করা হয়। কেস ফাইল হলেও কোন লাভ হয় না। টি আই প্যারেডে মিতা ঠিক মত কাউকে চিনতে পারেনি ,"একে অন্ধকার রাত, চেহারা গুলি ভাল করে বোঝা যায় না। ভুল করে যদি নির্দোষ কোন লোককে সনাক্ত করে ফেলি, মনের মধ্যে সেই ভয়রে দিদি,তাইতো সব গুলিয়ে গেল।"  মিতার দিদি মোটামুটি বোনের জন্য যথাসাধ্য করার চেষ্টা করলেও, মায়ের ঘোরতর আপত্তি এবং বখাটে গুন্ডাদের ভয়ে  মিতাকে ছাড়িয়ে বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারেনা। আলিপুর প্রেসিডেন্সী জেল তার ঘরবাড়ী হয়ে দাঁড়ায়। 
---
শোভার ক্ষেত্রে ঘটনাটা ছিল অন্যরকম। শোভা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, স্কুলে পড়ত। তাদের পাড়ায় একটি বড়লোক বাড়ীর ছেলে শোভার রূপে আকৃষ্ট হয়ে প্রেম নিবেদন করে। কিশোরী শোভাও তার প্রেমে পড়ে। সে প্রেমে কোন খাদ ছিল না, মনপ্রাণ দিয়ে ছেলেটিকে ভালবাসে, বিশ্বাস করে। তাই ছেলেটি বিয়ের প্রস্তাব দিলে নিজের বাবামা এর অমতে শোভা সাড়া দেয়। দুজনে পালিয়ে গিয়ে কালীঘাটে বিয়ে করে এবং ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। মাস ২/৩ বাদে ছেলেটির হাতের পয়সা যথারীতি ফুরিয়ে যায়, ফলে বাধ্য হয় বাড়ী যায় টাকা যোগাড় করতে। ছেলেটির পরিবার সেই সুযোগে দুজকেই যার যার বাড়ী ফিরতে পরার্মশ দেয়, সামাজিক ভাবে তাদের বিয়ে দেবার প্রস্তাবে। দুজনে মহানন্দে বাড়ী ফেরে। 
---
কিন্তু ছেলেটা বাবামায়ের কথায় আত্মসমর্পণ করে, সম্ভবত শোভাকে যথেচ্ছ ভোগ করে তার নেশা কেটে যায়। এদিকে শোভা তখন সন্তানসম্ভবা। ছেলের বাড়ী থেকে তাঁদের এড়িয়ে চললেও, শোভা বিশ্বাস হারায় না। কিন্তু তার বাবামা ছেলের বাড়ীর মতলব বুঝে থানায় নালিশ করে। পুলিশ দুজন কে ধরে নিয়ে যায়, ছেলেটির বাবার প্রভাবে দুজনের জবানবন্দী আলাদা করে নেয়। কোর্টে কেসের শুনানির সময় শোভা সরল বিশ্বাসে সব কথা বলে এবং স্বীকার করে দুজনের স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। ছেলেটি সব অস্বীকার করে। ফলে পয়সার জোরে ছেলেটি জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। আর শোভা ভিক্টিম হিসাবে যথারীতি জেলকাস্টডি পায় এবং প্রেসিডেন্সী জেল তার আশ্রয় হয়।
---
শোভার মনের বিশ্বাস তাতেও ভাঙেনা। তার ধারণা হয় সন্তানের জন্ম হলে  তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ীর লোক সব ভুলে তাকে ঘরে নিয়ে তুলবে। এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে তার দিন কাটে জেল হাসপাতালের তোষোকচাদর শূন্য খালি মরচে ধরা লোহার খাটে। যেদিন শোভা সন্তান প্রসব করল, তার আগের দিন তার স্বামী এক বড়লোকের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলল। হাসপাতালে বাবামা এর মুখে এই খবর পেয়ে জীবনের প্রতি সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে খান খান হয়ে গেল। গভীর রাতে বাচ্চাটা মরচে ধরা খাটে টিটেনাসে মারা গেল। কদিন পরে নির্বাক, হতবাক শোভা হাজতি নম্বরে বদলি হল। এই দুর্দিনে মিতা প্রথম শোভাকে কাছে টেনে নিল। সেই শুরু তাদের বন্ধুত্বের।
--
ধীরে ধীরে শান্তি মাসি, হাসিনা, হাওয়া বিবি, শ্যামলী ইত্যাদি সকলে মিলে পরম যত্নে তাকে ঘিরে ধরল, আর বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনল। কিন্তু বাবামা অনেক করে বাড়ীতে ফিরিয়ে নিতে চাইলেও শোভা ফিরতে চাইল না, "প্রতিদিন আমার চোখের সামনে নতুন বৌ নিয়ে সে ঘুরে বেড়াবে, আমাকে দেখিয়ে আনন্দ করবে, আমাকে বিদ্রূপ করবে, সে আমার আত্মায় সহ্য হবে না, সম্মানে লাগবে। আমার মত বোকার পক্ষে এই জেল ই ভাল। " কিন্তু জেল যে কেমন নরক, পদে পদে মৃত্যু  এখানে ফাঁদ পেতে বসে, ধীরে ধীরে শোভা সেটা বুঝেছিল।              
---
মিতা হাসিনাদের মত আমাদের সাথে মেয়াদী নম্বর দিয়ে কথা বলত, আমাদের রাজনীতির কথা শুনত। আমাদের সঙ্গে, বিশেষ করে মীনাক্ষীর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়। শোভা কিন্তু আমাদের একটু এড়িয়েই চলত,কল্পনার সাথে একটু সহজ ছিল। প্রতিবাদ দেখলে সরে যেত। অবশেষে এল সেই দিন যেদিন হাসিনা, মিতা, হাওয়াবিবি, মদিনা, শান্তিমাসি, শ্যামলী ইত্যাদি প্রায় জনা ২০/২৫ মেয়ে কম খাবার দেওয়া,  হয় কথায় নয় কথায় মারধর করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল, লক আপ হল না।  আমরা ওদের সমর্থনে লক আপ হলাম না। মিতা সহ সব বান্ধবী প্রতিবাদে নেমেছে সেখানে শোভা দূরে সরে থাকে কি করে, সে ও যোগ দিল। সেদিন ওই লড়াইয়ের মুখে কতৃপক্ষ নত হয়, দালালরা ক্ষমা চায়, মেট্রন ঠিক মত খাবার দেবার আশ্বাস দেয়। অবশ্য সাধারণ বন্দিনীদের মধ্যে প্রতিবাদী মুখগুলি কে চিনে রেখে দিল।
---
জেলে অনেক অসৎ কর্মচারী ও ওয়ার্ডার রা বাইরে রেড লাইট এরিয়ার মাসি ও দালালদের সাথে যোগাযোগ রাখত। সুযোগ বুঝে অনেক মেয়েকে নানা প্রোলভন দেখাত, যেমন বাড়ী পৌঁছে দেওয়া, বাইরে কাজ পাইয়ে দেওয়া, কখন সুলভে বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে, তাঁদের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মেয়ে চালান দিত। এই রকম একটি খারাপ ওয়ার্ডারের নজর পড়ল শোভার ওপর।  ওর সৌন্দর্য্য দেখে তার জিভ লালায় ভরে গেল। সে সুযোগ পেলেই ওকে ডেকে কথা বার্তা বলত। শান্তিমাসী প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আমাদের ওদের দলের সবাইকে জানিয়ে দিল।
--
সেই প্রথম শোভা হাসিনা মিতাদের সাথে ছুটে এল আমাদের কাছে। শোভাকে ভাল করে সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা হল। ও প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গেল। ওকে সকলে মিলে সাহস দিয়ে বলল," ভয় পেলে আরও পেয়ে বসবে, সাহস রাখ। সব সময় আমাদের সকলের মাঝে থাকবি। তোকে একা ডাকলেই কাউকে সাথে নিয়ে যাবি, পারত পক্ষে ওর ধারে কাছে যাবি না। " একদিন যখন সেই ওয়ার্ডার শোভাকে ডেকেছে দেখেই, শান্তিমাসি সঙ্গে গিয়ে হাজির, "কি গো মা,আমাদের ডাহেন ক্যান, কি কইবেন কন, আমাগো আবার ম্যাট্রন মা অনেক কাম কর্থে কৈছেন। শ্যাষ না হইলে জিগাইলে আপনার কথা কইতে লাগব। " জোঁকের মুখে নুন পড়ল। শোভাকে উনি দালালির ক্ষেত্রে মেট্রনের সাথে ভাগ করতে রাজী নন, তাতে লাভের গুন পিঁপড়ে খেয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি বললেন," না না, মেট্রনমার  তোমাদের কাজের কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম।" কিন্তু এভাবে কদিন ঠেকান যাবে, আমরা মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম।
---
এবার বিপদ এল অন্য দিক দিয়ে। জেলে ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে  সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা মেয়েদের ওয়ার্ডে নানা কাজে আসত, সেই সময় মেট্রনের দালাল হয়ে যাওয়া মেয়েরা দালাল ওয়ার্ডারদের তদারকিতে তাদের সাথে প্রেম ও মাখামাখি করত। চিঠিপত্র চলাচালি চলত। অনেক সময় ত্রিকোণ, চতুস্কোন ইত্যাদি নানা প্রেমের ফলে মেয়েদের মধ্যে ঝগড়া মারামারি হত। শোভা ফেঁসে গেল এই গোলমালের মধ্যে। তার হাতের লেখা সুন্দর, সে পড়াশুনা জানা মেয়ে। প্রেমে পড়া দালাল মেয়েরা সবাই তার কাছে চিঠি লেখাতে আসত। সুন্দর হস্তাক্ষরে মন মাতাল করা ভাষায় প্রেমপত্র লিখে দিত সবাইকে। ওর বন্ধুরা আর  আমরা সকলে বারণ করা সত্ত্বেও শোভা  প্রেমপত্র লেখা ছাড়তে পারল না," আমার মনে হয় যখন আমি প্রথম ওই ছেলেটাকে ভালবেসেছিলাম, তখন যেন ওকে চিঠি লিখছি, বিয়ের প্রথম দিনগুলিতে যেন বরকে চিঠি লিখছি ,এইটুকু ভাল লাগা ছাড়া আর কি আছে আমার,বল তোরা। " "কিন্তু ধরা পড়লে তোরই বিপদ হবে, কেউ কিন্তু স্বীকার করবে না। "
ভবি ভোলবার নয়।
---
অবশেষে মীরাকে লিখে দেওয়া চিঠি পড়ল হামিদার হাতে। হাতের লেখা যে শোভার বুঝতে দেরী হল না, হামিদাও যে অনেক চিঠি লিখিয়েছে। সে শোভাকে শাসাতে লাগল," আজ লক আপ হোক না, কি করি দেখবি।" ভয়ে শোভা আর তার বদ্ধুরা ছুটে এলো আমাদের কাছে। " আমাদের দরজা তো সারাক্ষণ বন্ধ থাকে। আমরা তো তোদের কাছে যেতেই পারব না। আর লক আপের পর ওরা কিছু করলে তো তোদের সবাইকে দল বেঁধে প্রতিবাদ করা ছাড়া কোন পথ নেই। ভয় পেলে চলবে না। সবাই মিলে ওকে ঘিরে থাকিস। "  
---
সেদিন রাতে হাজতি নম্বর থেকে প্রচন্ড চিৎকার চ্যাঁচামিচি শোনা গেল। পরদিন সকাল হতে মেয়াদী নম্বরের জালনায় আমরা পালা করে হাজির থাকলাম, শোভারা কেউ এল না। মেয়াদী ঘরের মাসিদের সাথেও কথা বলা যাচ্ছে না। কারণ একজন না একজন দালাল সব সময় নজর রাখছে। সারাদিন ওই ভাবে গেল, সারা ফিমেল ওয়ার্ড যেন থম থম করছে। রাতে একজন ভাল ওয়ার্ডারের ডিউটি পড়ল আমাদের ডিভিশন ওয়ার্ডে। তাঁর মুখে শুনলাম রাতে হামিদা দলবল নিয়ে শোভাকে মারতে চেষ্টা করেছিল ,তবে তার বন্ধুরা পাল্টা রুখে দাঁড়িয়েছে। হাজতী নম্বরের অন্য অনেক  মাসীরাও শোভাদের পক্ষে ছিল। মেট্রনের কাছে হামিদা নালিশ করার পর মেট্রন হেড জমাদার আর মেয়ে ওয়ার্ডারদের নিয়ে শোভাকে পাগল বাড়ীতে দিয়েছে, মিতা আর মদিনাকে পাগলবাড়ীর মেটের ঘরে রেখে দিয়েছে।
---
পরদিন আমরা কয়েকজন ডাক্তারদের আর ওয়েলফেয়ার অফিসার কে ব্যাপার টা জানালাম। তাঁদের মধ্যস্থতায় দিন ২/১ বাদ দিয়ে মিতা হাজতী নম্বরে ফিরে আসে। মদিনা আর শোভা পাগলবাড়ীর মেটের ঘরে আছে। মদিনার নন ক্রিমিন্যাল লুনাটিক কেস ছিল বলে মেট্রন সেই সুযোগ টা নিয়েছে। আর শোভা মিতাকে বলেছে হাজতী নম্বরে ফিরলে হামিদারা ওকে মেরে ফেলবে। তাছাড়া ওখানে থাকলে খারাপ ওয়ার্ডারটার কুদৃষ্টির হাত থেকেও বাঁচবে। " কিন্তু জেলের কুচক্র যে কোন কাউকেই ইচ্ছে করলে  তার অমতে হাসিনার মত চালাকি করে বার করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিতে পারে না জানি কোন অন্ধকারে।
---
আমরা ভেবে দেখলাম আপাতত শোভার পক্ষে এটাই ভাল। অবশ্য জেলখানায় সব ভালই সাময়িক। এখানে চূড়ান্ত ভাল আর চূড়ান্ত মন্দের খেলা চলে অনবরত। এখানে একদিকে একটুরো রুটির জন্য মানুষ দালালি করে, অন্যদিকে এক মা তার বুকের দুধ অন্যের সন্তানকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে, নিজের ভাগ অন্যেকে নির্বিচারে দান করে। এখানে কত মানুষকে পিটিয়ে মেরে রাতারাতি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে ,অনাহারে মরেছে কত পাগল। জেলের প্রতিটি কোনে শোনা যায়, জানোয়ারের চেয়েও অধম অবস্থায় রাখা পাগলদের গোঙানি, দুঃখী মানুষের হাহাকার, মীরা,শোভাদের মত মেয়েদের  আর্তনাদ, আর অন্যদিকে শোনা যায় হয়তো বা একটা কুমড়ো চুরির অপরাধে ধৃত গ্রামের মানুষের মেঠোগলায় অথবা  শংকরের মত শিশুগলায় শোষণের আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গান, রাজনৈতিক দলের স্লোগান আর প্রতিবাদের ও লড়াইয়ের  গান।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

পরিশিষ্ট
******
কাগজে দেখেছিলাম কালীঘাটের ধর্ষিতা ভিখারিনী শিশুদুটিকেও ভিক্টিম হিসাবে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভবত মিতা, শোভা, হাসিনাদের মত সেফ কাস্টডি হিসাবে কারেকশন হোমে (যা নাকি জেলের বর্তমান নাম, আদতে একই জিনিষ, কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ ) নেওয়া হবে আর তাদের ভাগ্যেও একই পরিণতি লেখা আছে,একটু একটু করে তিলে তিলে নরকের আগুনে পুড়বে, শেষে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাবে। তাই মনে হয় পুরো ব্যবস্থাটিকে নতুন করে ঢেলে না গড়লে সমাজের বুকের এই ক্ষত থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------