13 Jul 2019

শান্তিবাই

শান্তিবাই
*******
শান্তিবাই ছিল খুনের কেসের বন্দিনী। শ্যামবাই তার ঘনিষ্ট বান্ধবীও একই কেসে জেলে ছিল। দুজনেই যৌনকর্মী, একই পল্লীতে পাশাপাশি ঘরে থাকত। শ্যামবাই ছিল অপূর্ব সুন্দরী, অনেকটা লম্বা,ফর্সা টুকটুকে গায়ের রঙ। ডাকের সাজের প্রতিমার মত ডাগর ডাগর চোখ, টিকাল নাক, লম্বা কোমর ছাড়িয়ে লম্বা  কালো কুচকুুুচে চুল। শ্যামবাই ছিল লখনৌয়ের আদি নাম করা বাঈজী ঘর থেকে আসা মেয়ে। তাঁর কাছে শুনেছিলাম, তাঁদের ঘরানার নিয়ম অনুসারে ঘরের ছেলের বউদের লাইনে নামতে দেওয়া হত না, যাতে সন্তান হলে সে যে নিজেদের পরিবারের কিনা বোঝা যায়। লাইনে নামানো হত বাড়ীর মেয়েদের। সেই রীতি অনুসারে শ্যামবাই লাইনে আসে। সে  তখন সন্তানসম্ভবা, অনাগত সন্তানের প্রতীক্ষা করছে। সাধারণভাবে কুমারী যৌন কর্মীদের দর বেশী হয়। এমনিতে সৌন্দর্যের জন্য শ্যামবাই এর প্রচুর কদর ও খরিদ্দার ছিল। বাঁধা বাবুদের সংখ্যা ও নেহাৎ কম ছিল না। সন্তান হলে তার বাজার খারাপ হতে পারে, সে সম্ভাবনা  থাকলেও গর্ভবতী হওয়াতে তার কোনরকম দুঃখ বা দুঃশিন্তা ছিল না। মা হবার আনন্দে সে ডগমগ, এমন কি রীতিমত গরবিনী ছিল বলা যায়। শান্তিবাই তার সব কাজ করে দিত. পান থেকে চুন খসলে পাছে তার সন্তানের কোন ক্ষতি হয় এই আশঙ্কায় বান্ধবী কে বকে ভূত ভাগিয়ে দিত। শান্তিবাইকে কখন কোন রাগ করতে দেখা যেত না। শ্যামবাইয়ের অনাগত সন্তানের জন্য তারও দুঃশ্চিন্তা আর আনন্দ দুই ছিল, সে ও মাসি হতে চলেছে।
---
শান্তিবাই বিহারের আদিবাসি মেয়ে, শ্যামলা রঙ, সাপের মত লম্বা একটা বিনুনি,শ্যামবাইয়ের মত না হলেও অনেক টাই লম্বা ছিল। বয়স ১৭/ ১৮, চাবুকের মত ছিপছিপে শরীর, একফোঁটাও মেদ ছিলনা আর বিদ্যুৎ গতিতে চলা ফেরা করত। গ্রামে ভূমিহীন ক্ষেত মজুরের ঘরে তার জন্ম। সারাদিন ক্ষেতে, ঘরে দুঃসহ পরিশ্রম করত, দিনে এক বেলা খাওয়া। খাটতে তার কোনরকম আপত্তি ছিল না, শুধু পেটের ভুখটাই সহ্য হত না। তাইতো গ্রামের বড়লোকের বাড়ীর বাজার ঘাট করার ছেলেটার খপ্পরে পড়ল।  সে জোতদারের কাজে বিভিন্ন শহরে যেত , অনেক খবর রাখে। কোলকাতায় গেলে অনেক ভাল কাজ পাওয়া যাবে, দুজনে খাটবে, বিয়ে করে ঘর পাতবে, পেট ভোরে খেতে পাবে, এই স্বপ্ন দেখে একদিন তার সাথে পালিয়ে চলে এল কলকাতায়।
---
ছেলেটা তাকে নিয়ে তুলল পতিতা পল্লীতে। অনেক রাতে প্রায় অন্ধকার বড় একটা বাড়ীতে ঢুকল তারা। বয়স্কা একজন মহিলার সাথে আলাপ করিয়ে দিল বাড়ীওয়ালি বলে। তাকে একটা ঘরে বসিয়ে বললো, "তু থোড়া ঠ্যার য়া,খানা ভেজতা হুঁ ,পহলে খালে, ফির শো যা। ম্যায় ঘর কি কিরায়া কা বাত করলু, শুভা মে তেরে আউর মেরে কাপড়া, ঔর কুছ সমান খরিদ কর দুপহর আউঙ্গা। নাহা ভি লেনা, ঔর সাজধাজকে মেরে ইন্তেজার করনা। একসাথ খানা খাকে, কলকাত্তা ঘুমনে যাউজ্ঞা ।"
---
সরল বিশ্বাসে শান্তিবাই বাড়ীওয়ালি মাসীর দেওয়া খাবার খেয়ে খুব খুশি, জীবনে প্রথম পেট ভরা খাবার খেতে পেয়েছে। সেই ঘরেই পাতা মাদুরে শুয়ে ভবিষ্যতের সুখের সংসার পাতার স্বপ্ন দেখতে দেখতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন অনেক বেলায় মাসী ডেকে দিল। স্নান করে, খেয়েদেয়ে সেজেগুঁজে তৈরী  হয়ে নিতে বলল। পাশের ঘরেই শ্যামবাই থাকত। সেই কিছু ভাল জামাকাপড়, প্রসাধনী জিনিসপত্র আর কাঁচের চুড়িপুঁথির মালা, নাকে, কানে পেতলের গয়না ইত্যাদি দিল। এসব জিনিস পরা তো দুরস্থান, জীবনে কোনদিন চোখেই দেখেনি। শান্তিবাই মহাখুশী, চটপট তৈরী হয়ে তার গ্রামের লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, তার বিয়ে হবে, সুন্দর একটা সংসার হবে, পেট ভরে দুবেলা খেতে পাবে, আর কি চাই।
--
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর, হটাৎ করে বাড়ীওয়ালি মাসি তার ঘরে একজন দেহাতি লোক কে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো  " নে তোর মরদ এয়ে গেছে,", কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় একটা ওড়না চাপিয়ে দিয়ে মুখ পর্যন্ত্য ঢেকে দিল। লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, " নাও, বাপু এবার মাথায় সিঁদুর দে, বে সেরে লাও, তারপর ঘর কর, তবে হ্যাঁ মাসের ভাড়া আর আমার দিনের হক মেরোনি, আর পেইল্যে যাবার চেষ্টাটি কর নি, তাইল্যে গুন্ডা দিয়ে এমন হাপিস করে দেব, কেউ টেরটি পাবেনি, " বলেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে, বাইরে থেকে শিকল টেনে দিল। বাড়ীওয়ালীর কথা শুনে শান্তিভাই ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কিছু বোঝার বা ভাল করে দেখার আগেই এক খাবলা সিঁদুর তার মাথা, মুখ ভরিয়ে দিয়ে  শান্তিকে সবলে আকর্ষণ করে কামুক লোকটি প্রাণ ভরে নিজের খিদে মেটাল। তারপরে তার হাতে ৩০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলল," আমি রোজ রাতে আসবো, রাতটা আমার জন্য খালি রাখবি, দিনে যত ইচ্ছে খদ্দের নিতে পারিস। " বলে দরজা ঠক ঠক করলে দরজা খুলে গেল।  লোকটা বেরিয়ে গেল আর শান্তি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
--
শ্যামবাই দৌড়ে এসে সান্তনা দিতে লাগল। শান্তির মুখে একটাই কথা, " থোড়া পেটভর খানেকে লিয়ে ম্যাঁয় এ কিস জাহান্নামে আ গেই। " ধীরে ধীরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শ্যামবাই নিজের জীবনের একই কাহিনী শুনাল। তেরী গাঁও কে মরদ ভি আওর এক খুদগড়জ আদমি হ্যায়, শাদী কা ওয়াস্তা দে কর তুঝে মাসী কে পাস্ বেঁচে দে কর ভাগ গেয়ি। ও তো দালাল হ্যায়, লড়কি লানা উস্কা কাম হ্যায়, পহলে ভি বহুৎ সারি লায়া। ইয়ে আদমি হর রোজ তেরে পাস্ আয়েগা,আছ্ছি বাত। পহেলা দিন মে তুঝে  পসন্দ কর লিয়া, দেখনা তেরে লিয়ে কুত্তাকে মাফিক হর রাত আয়েগি, প্যায়ার করেগি, কুছদিনকে লিয়ে তুঝে নেহি ছোড়েগি। মগর উস্কে বাত মে কভি না  ফাঁস যানা, ইঁহা সাচ্চা পেয়ার নেই হোতা। দিল কভি দেনা কিসিকো, চোট খায়েগি। ইঁহা যব তক মরদ কো আচ্ছে লগতে, তব তক পেয়ার ঢঙ রচায়গী, বাদমে আচ্ছে ঘরসে লড়কিকো শাদী করেগা, বিচ বিচ মে তেরে পাস আ সকতা, আনে দেনা মগর কভি দিল নেহি দেনা। দিন ভর তু আউর কাস্টোমার লেনা, বহুৎ কামানা, কুছ কুছ আনেবালা দিন কে লিয়ে জমাকে রাখনা। আউর শুন ভাগনে কা কোশিশ কভি নেহি কর না, এ বহৎ খতরনাক জাগা হ্যায়, খুন হো জায়গী। অব তেরে পাস দুসরা কই রাস্তা হ্যায় কেয়া !"
---            
সত্যি আর কোন পথ তার চোখে পড়লোনা, এই অজানা অচেনা জায়গায় সে কি করবে, বাড়ীওয়ালি মাসির কথাগুলি মনে পড়তেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। তখন থেকে শুরু হল তার পতিতাবৃত্তি। রাতে লোকটি নানা রকম খাবার, গিল্টি গয়না বা কাপড় চোপড় নিয়েও মাঝে মধ্যে নিয়ে আসে,পশুর মত তাকে ছিড়ে খায়। রাত শেষ হবার আগেই চলে যায়। বছর পার হয়ে গেল, শান্তি আর দিন ক্ষণের হিসাব রাখে না। পেট ভরে খায়, সাজগোজ করে, বেশ কিছু টাকা ব্যাংকে ও জমাতে থাকে। লোকটি মাঝে মাঝে মাসীকে বলে সিনেমায় নিয়ে যায়, বেড়াতে নিয়ে যায়।সরল মেয়েটা শ্যামবাইয়ের সতর্কীকরণ ভুলে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলে। ব্যাস ভয়ংকর বিপদ এসে গ্রাস করে তাকে।
---
শান্তি বাই  লক্ষ্য করতে শুরু করল লোকটা আজকাল প্রায়ই আসেনা, এলেও তাড়াতাড়ি চলে যায়, বাইরে বেড়াতেও নিয়ে যায় না। একদিন তো এসব নিয়ে বেশ ঝগড়া হয়ে গেল দুজনের মাঝে। লোক ঝগড়ার মধ্যে বলে বসে," তু কি মেরে শাদী  কিয়া জরু, নেহি  ম্যায় তেরে  সচমুচ কা প্রেমী হুঁ। হর রোজ তেরে সাথ রাত বিতানা পড়েগা ?  শালী রেন্ডী, তেরে সাথ বাহার ঘুমনে যানেসে, অউর মেরা নয়া জরু দেখ লেনেসে, মেরা ঘর টুট যায়গা, তব কেয়া হোগা ?" শান্তিবাই পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়, ঠান্ডা গলায় বলে," কুত্তা আভি নিকাল যা।" কিন্তু দু দুবার ভালবাসার অপমান সে  সহ্য করতে পারেনা, সব আশা চুর চুর হয়ে যায়, প্রানঢালা ভালোবাসার বদলে এত কুৎসিত গাল দিল। তাদের এই গালি তো সবাই দেয়, কিন্তু  দু দুবার এত বিশ্বাস আর ভালবাসার এই পরিণাম।
--
পরদিন আর ঘর থেকে বার হয় না, শ্যামবাই ব্যাপার টা আঁচ করতে পারে। সবাই কে সরিয়ে দিয়ে একা শান্তিবাইকে আগলে রাখে। তার কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করে, খাওয়ায়, স্নান করতে নিয়ে যায়। শ্যামবাইয়ের খদ্দের এসে গেল শান্তিবাই দরজা বন্ধ করে একা একা শুয়ে চিন্তা করতে থাকে। অপমানে আর  বিশ্বাসঘাতকতা তার মাথায় ছোবল মারতে থাকে। মনে মনে ঠিক করে যে করেই হোক এর প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তার মনভাব কাউকে বুঝতে দেয়নি। আগের মত খদ্দের ধরতে শুরু করে। সেই লোকটি খবর পায় শান্তিবাই আবার আগের মত কাজ করছে।
--
কামুক লোক মোহ কাটাতে না পেরে শান্তিবাই কে খুশী করার জন্য খাবার দাবার কাপড়চোপড় নিয়ে হাজির হয়। শান্তিবাই খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করে, বৌকে নিয়ে পরিহাস করে. ধীরে ধীরে আবার রোজ রাতে তার ঘরে আসতে শুরু করে। শান্তিবাই তার বিশ্বস্ত লোক দিয়ে বিষ সংগ্রহ করে। একদিন খাবার আর প্রচুর মদ খাওয়ায়।  মদের মধ্যে মিশিয়ে সেই বিষটুকু সবটা খাইয়ে দেয়। সকাল বেলায় হইচই পরে যায়। পুলিশ তার সঙ্গে শ্যামবাইকেও ধরে আনে। বাড়ীওয়ালি তাদের জানা ভাল উকিল লাগায়, শান্তিবাই আর শ্যামবাই এর খদ্দেররা টাকা ঢালে। শান্তিবাই পুলিশের কাছে স্বীকার করে শ্যামবাইয়ের কোন দোষ নেই, সে কিছুই জানত না। একাই সে সবকিছু করেছে। শ্যামবাই ছাড়া পেয়ে যায়। শান্তিবাইয়ের কেস চলতে থাকে।
--
জেলের খাবারে শান্তির স্বাভাবিক পেট ভরতো না, বাড়তি খাবারের জন্য কিন্তু কোনরকম দালালি করত না। বাড়তি খাটুনি করলে কিছু বাড়তি খাবার পেত। তাকে সেলের জল ভরা আর সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ডের (যেহেতু তাদের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখা হত ) খাবার ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়ার কাজ , ভাঁটি ঘরেও কাজ ইত্যাদি করত। জেল কর্তৃপক্ষ সাধারণ বন্দিনীদের কাছে রটিয়ে ছিল সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দিনীরা মানুষের রক্ত খায়। যদিও বেশীর ভাগ মানুষ এ কথা বিশ্বাস করত না। বিশেষ করে সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে যে রাজনৈতিক বন্দিনীরা ছিল তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য যে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও, তা খেত না। সাধারণ বন্দিনীরা যে খাবার পেত, তাই নিত। তারা কোন বন্দিনীর ওপর কোন অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদ করত। এসব কারণে সাধারণ বন্দিনীরা তাদের মনে মনে ভালবাসত।
 ---
সেলে তখন কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া মিত্র ছিল। ডিভিশন ওয়ার্ডে বিজু, মিনু আর আমি চারু মজুমদারপন্থী। আমরা তিনজন ছাড়া আরও ৮/৯ জন রাজনৈতিক বন্দিনী ছিল যারা অন্য পন্থায় বিশ্বাস করত এবং রাজনৈতিক বন্দিনীদের সুযোগ সুবিধা গুলি নিত। সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে কাজ করার ফলে আমাদের রাজনৈতিক প্রভাব শান্তিবাইদের ওপর পড়েছিল, এই টুকু তারা বুঝতে পারত আমরা গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য কাজ করতাম। বড়োলোকদের  রাজত্ব কে ভেঙে গরীব মানুষদের রাজত্ব তৈরী করতে চাইতাম, তাই বড়লোকদের রক্ষাকর্তা পুলিশ মিলিটারির সাথে আমাদের লড়াই, তাই তারাই আমাদের আটকে রেখেছে। আমরা কোন অন্যায় কাজ করে জেলে আসিনি।
---
একবার আমরা ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে মীরা ও শান্তিবাইয়ের নেতৃত্ত্বে একসাথে রেখা ,বেলা, মিতা, শিবানী  ইত্যাদি প্রায় ২০জন  সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করছিল , তখন মেট্রন বা তার দালাল বাহিনী কিছু করতে সাহস পায়নি। প্রতিবাদে আমরাও তাদের  পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাই ।
--
মীরা তখন  সেলের এক ভাল ওয়েলফেয়ার অফিসারের অফিসে কাজ করত, চিঠিপত্র দেওয়া নেওয়া, তাঁর কাগজ ফাইল পত্র গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি।বাংলা দেশের গ্রামের মেয়ে মীরার  বয়স ১৭/১৮, কলমি লতার মত ঢলঢলে মিষ্টি চেহারা।  বাংলা দেশের  ৭১ এর যুদ্ধের সময় পালিয়ে আসে, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে হারানো কেসে জেলে ছিল। আমাদের ৬ জনের সাথে তার ও বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে আমাদের রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
--
সেই প্রতিবাদের শোধ তুলতে এক বিশাল দালাল বাহিনী বিজু, মিনু, আমি - মাত্র তিনজন বলে মারতে ঢোকে। দালালরা ভাবতে পারেনি মীরা শান্তিবাই ১৫ জন নিয়ে দালালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ডিভিশন বাড়ীর বাকী ৮/৯ জন ও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়। মারতে এসে উল্টে মার খেয়ে দালালরা পালায়। ওয়ার্ডার তাড়াতাড়ি গেট বন্ধ করে দেয়। শান্তিবাইরা ভেতরেই আমাদের সাথে থেকে যায় প্রায় দিন ১৫। বাকীরা আমাদের সাথে শুতো, ভাল খাবার জন্য খেতো ডিভিশনের মেয়েদের। কিন্তু  মীরা আর শান্তিবাই আমাদের তিনজনের সাথেই খেত আর সারা সময় আমাদের পার্টির গল্প শুনত।
---
মেট্রন বা তার চামচে ওয়ার্ডার আর  দালাল বাহিনী শান্তিবাই আর মীরাকে শিক্ষা দেবার তক্কে তক্কে থাকল। একদিন বাকী বন্দিনীদের লক আপ করার পর তারা মীরা আর শান্তিবাইকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারল যে তাদের চেনা যাচ্ছিল না। আমাদের আর সেলের  কমরেড দের ইচ্ছে করে লক আপ করেনি, কিন্তু মূল গেট গুলি বন্ধ করে রাখে যাতে আমরা হাসপাতাল থেকে আর ওরা বারান্দার ফোঁকর দিয়ে সব দেখতে পাই, কিন্তু গলার ফাটান ছাড়া আর কিছু করতে না পারি, ওদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে না পারি। মেট্রনের নির্দেশে পাগলী বাজল না। .
---
এরপর স্বাভাবিক ভাবেই ওরা দুজন ভয় পেয়ে যায় আর দালাল বাহিনীর পেছনে পেছনে থাকত, কিছু প্রভাব পড়লেও ওরা হিংস্র দালালদের মত হয়ে ওঠেনি। এদিকে শ্যামবাই ছাড়া পেয়েছে, শান্তি বাই এর যাবৎজীবন কারাদন্ড হবার প্রবল সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে জয়া মিত্র পুরুলিয়া জেলে বদলী হয়ে গেল। ডালিয়ার ১০ বছর সাজা হয়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে এল। সেলে রাজশ্রী, মীনাক্ষী দুজন নতুন রাজনৈতিক বন্দিনী এলো আর খুকু ডিভিশন ওয়ার্ডে এলো।  সাধারণ বন্দিনীদের ওপর অত্যাচার বাড়তে লাগল। তাই আমরা একদিন প্ল্যান করে শিখা, আনোয়ারা সরযূর মত হিংস্র দালালদের ও শয়তান বড় মেট্রনটাকে বেশ করে শিক্ষা দিলাম। পাগলী হল, কিন্ত আমাদের কাছে কি অস্ত্র আছে, জেল কর্তৃপক্ষ সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না, মাত্র কটা খাবার থালা নিয়ে আর ওদের লাঠি কেড়ে ওদের মারব এটা ওরা বিশ্বাস করতে পারল না। তাছাড়া আমাদের মনেমনে শ্রদ্ধা করতেন এমন একজন ডেপুটি জেলারের মধ্যস্থতায় ফোর্স ফিরে গেল।
---
ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলি করে দিল। মাসিমা (শান্তিরানী দেব ) আর বুলু ডিভিশন ওয়ার্ডে নতুন এল। জেল কর্তৃপক্ষ বদলা নিল, বুলুকে আর আমাকে প্রচন্ড মারল, জেলের ডাক্তার বাবুদের হটাৎ উপস্থিতির ফলে আমরা আহত হলেও বেঁচে যাই। কিছুদিন পর মহাদেবীয়া হাসপাতালের মেট হয়। মহাদেবীয়ার মনুষ্যত্ব বোধ ছিল। যাবৎজীবন সাজা প্রাপ্ত বলে মেট্রন দের হুকুম মানতে বাধ্য থাকত, কিন্তু বীভৎস অত্যাচার কারোর প্রতি করেনি। এই সময় একদিন শান্তিবাই আমাদের বন্ধ গরাদের কাছে এসে চুপিসারে বলে গেল," আভি মহাদেবীয়া হেড মেট, আর কুছু ডর নেহি হ্যায়।" আমাদের একদিন ইন্টারভিউ এর সময় বলল, " তুমাদের মারার সময় শিখা,আনোয়ারা হামাদের পর লজর রেখেছিল, তাই দিদি তুর  চুল টা হামি একটু ধরে ছিলাম, মাফি দিয়ে দে। " আমি ওর হাতে চাপ দিয়ে বললাম ,"বুঝিরে, তোদের না হলে মেরে শেষ করে ফেলত। "
---
এরপর শান্তিবাইয়ের যাবৎজীবন সাজা হয়ে যায়। আমরা ৭৭ সালের রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির সময় ছাড়া পেয়ে যাই। একদিন বাসে মীরার সাথে দেখা হয়েছিল, উগ্র সাজগোজ করা। আমার পাশে বসল, হাত টা ধরে বলল, "দিদিরে
প্রাণ ভয়ে যে অপরাধ করেছি মাপ করে দে। " ওর মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে বললাম, "সব বুঝি, আমরা কি জানি না কি কারণে, কি অবস্থায় তোদের কি করতে হয়েছে। ভাল থাকিস।" ইচ্ছে করেই আর কোন প্রশ্ন করে ওকে আর বিব্রত করতে চাইলাম না, ওর সাজ পোশাক অনেক কিছু বলে দিচ্ছিল। আমার গন্তব্য, এসে যাওয়ায় বাস থেকে নেমে যাই।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




        



















































           

6 Jul 2019

হাওয়াবিবি .

হাওয়াবিবি
***********

লম্বা ছিপছিপে চেহারা, কাল মিশমিশে লম্বা লম্বা চুলে, একটা হাত ঘুরিয়ে হাওয়া বিবি কেমন করে একটা খোঁপা বেঁধে রাখত। চুলগুলি ছিল তার বড় আদরের, সুযোগ পেলেই একটা ফুল বা পাতা গুঁজে রাখত। ডাগর ডাগর দুটি শিশুর মত সরলতা মাখা চোখ। সামনের দাঁতের পাটি একটু উঁচু, তাতে যেন তার আদিবাসী গ্রাম্য চেহারায় আলাদা একটা মাধুর্য্য এনে দিয়েছিল। আমাদের সকলের সাথেই তার ভাব, কিন্তু মলয়ার প্রতি তার একটু বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল। মলয়া তাকে শুধু হাওয়া বলে ডাকত। 
--
মলয়া তার উলকাঁটা নিয়ে মেয়াদী ঘরের জালনায় বসে আর হাওয়া গরাদের ওপার থেকে মলয়ার কান ঘেঁষে নিজের বিচিত্র জীবনের সব গোপন কথা যেন বলত। আমাদের বাকীদের কাছে জীবনের অল্পবিস্তর গল্প বলত বটে, কিন্ত তখন তার বলার থেকে শোনার চাহিদা ছিল বেশী। আমাদের পার্টির উদ্দ্যেশ্য বন্দিনীদের কাছে  সহজ ভাবে বলা হত, বিশেষ করে গল্পের মধ্যে দিয়ে।আর এইসব গল্প শোনার খুব  আগ্রহ ছিল হাওয়া বিবির। 
--
হাওয়া তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, চোখের মনি। খুব একটা অবস্থাপন্ন না হলেও একটি মাত্র সন্তান কে বড় আদরে মানুষ করেছিলেন। সাধ্যের অতিরিক্ত করে অবস্থাপন্ন ঘরে তার বিয়ে দেন। কিন্তু কাজে কর্মে পোক্ত না হওয়ায় শ্বশুর শ্বাশুড়ির গঞ্জনা শুনতে হত রাত দিন। স্বামীটাও ছিল চরিত্রহীন ও অত্যাচারী। এসব হাওয়ার বাড়ীতে আগে কেউ জানত না। হাওয়ার থেকে বয়সেও অনেকটা বড়। শারীরিক ভাবে তাকে তৃপ্ত করতে পারত না। ভোগ করা ছাড়া বিন্দু মাত্র স্নেহ ভালবাসা স্ত্রীর প্রতি ছিল না। এদিকে হওয়ার বাপের কাছ থেকে নানা ছুতায় নিত্যি নতুন পণ আদায়ের চেষ্টা করত। অন্যদিকে হওয়ার ওপর মারধর আর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়েই চলতে থাকে। মেয়ের দুর্দশা দেখে আর নিত্যি পণ এর দাবীতে অতিষ্ট হয়ে বাপমা মেয়েকে বাড়ী নিয়ে আসতে বাধ্য হয়, পাছে মেয়েকে একেবারে মেরে না ফেলতে পারে।  
--
বাপের ঘরে ফিরে হাওয়া খুব খুশী। সাথীদের সাথে খেলে বেড়ায়। কাছেই ছিল খালার বাড়ী। দুই খালাত ভাইদের সাথে ভারী ভাব, তাদের কাছে হাজার বায়না। গাছের উঁচু উঁচু ডাল থেকে  ফল, ফুল পেড়ে দেওয়া, পালা পার্বণে মেলায় নিয়ে যাওয়া। সঙ্গিনীদের সাথে ফল ভাগ করে খাওয়া, ফুল দিয়ে চুল বাঁধা, হাতে কানে গলায় পরে। কিন্তু আদরের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে বাবামা চিন্তিত। এদিকে কৈশোরের  শেষ সীমায় এসে দাঁড়ায় সে, অনেক কিছু বুঝতে শেখে। সংসারের দায়িত্ব খানিকটা  টা নিজের কাঁধে তুলে নেয়, বাজান আর খালতো ভাইদের সাথে প্রতিদিন মাঠে খাটতে যেতে শুরু করে।
 --
অবশেষে পরিণত শরীর আর মন নিয়ে বড় খালাত ভাইয়ের সাথে প্রেমে পড়ে। দুই বাড়ীর বয়স্করা মিলে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। হওয়ার চিন্তা দূর হওয়াতে বাজান, আম্মা আশ্বস্ত হয়ে নতুন উদ্যমে খাটতে শুরু করেন। মহানন্দে হাওয়া বিবি তার নতুন সংসার শুরু করে। স্বামী, দেওর মাঠে চাষ করে, খালার সাথে মিলে ঘর সংসারের বাকী কাজ করে। সবাই খুব খুশী। কিন্তু গরীবের সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী।বছর না ঘুরেতেই হাওয়ার আগের চরিত্রহীন স্বামী সুযোগ পেলেই তার পিছনে লাগতে শুরু  করল, তাকে ভোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সব কথা বাড়ীতে খুলে বলে, সকলে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন হন। হাওয়াও সাবধান থাকার চেষ্টা করত। তার নতুন স্বামী বিবিকে জান দিয়ে ভালবাসত। হাওয়াকে সব সময় সাহস দিত, -"মরা দুটা জোয়ান মরদ থাকতে, তুকে কিছু কৈর্তে লারবে, তুর কুনো ডর লাই। " 
--
কিন্তু দুর্ভাগ্য, একদিন হাওয়া মাঠে স্বামী ও দেওরের দুপুরের খাবার খাইয়ে যখন বাড়ী ফিরছে, শয়তান টা তাকে অমানুষের মত  ধর্ষণ করে। প্রায় টলতে টলতে ঘরে ফিরে অবসন্নের মত পড়ে থাকে সে। স্বামী আর দেওর কাজ থেকে ফিরে সব শুনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে টাঙ্গি হাতে বেরিয়ে যায়, অনেক রাতে নদীতে স্নান সেরে ফিরে আসে। "তুকে আর জ্বালাতন করবেক নাই, মরা শয়তানটোৱে বুঝায়ে দিছি।" রাতে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পরে। দিন কতক বাদে নদীর জলে ফুলে ঢোল বীভৎস একটা লাশ ভেসে ওঠে। পুলিশ এসে গ্রামের সবাই কে জিজ্ঞাসা বাদ করে, কেউ চিনতে পারেনা। দিন ১৫ বাদে পুলিশ এসে হাওয়া বিবি আর তার স্বামী দেওর কে ধরে নিয়ে যায়। তিনজনের বিরুদ্ধে ওই অপরিচিত লাশ টাকে খুন করার দায়ে কেস দায়ের করে। তিনজনকে প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে আসা হয়।
--
 কোর্ট পড়লে হাওয়া কোর্টে যায়, স্বামী দেওরের সাথে দেখা হয়, জেলের মধ্যেও ছেলেদের ওয়ার্ড আর মেয়েদের ওয়ার্ড থেকে তাদের মধ্যে অফিস ঘরে ইন্টারভিউ হয়। হওয়ার খালা আর আব্বুজান শক্ত ভাবে উঠে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যেটুকু সম্বল ছিল আর আত্মীয় স্বজনের থেকে ধার করে উকিল লাগিয়েছে।   ধীরে ধীরে জেলের মধ্যে তার কিছু  বান্ধবী হয়, আমাদের সাথেও রীতিমত গল্প হত। বিশেষত  মলয়ার প্রতি তো তার নির্ভরতার শেষ ছিল না। আমাদের নাটক গারদের ওপার থেকে মেয়াদি নম্বরে বসে দেখতে ভালবাসত।
--
মোটামুটি ভাবে জেল জীবনে সে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। তবে স্বাভাবিক ভাবে ই  মাঝে মাঝে ই বাড়ীর জন্য কাঁদত, আর কেসের কথা ভেবে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ত। আমরা তার জেলের সাথীরা সবাই সান্তনা দিতাম, "কাঁদিস না, কেসে তোদের কিছু হবে না, কে একটা অপরিচিত লোক মরছে আর গাঁয়ের কেউ তো তোদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী ও দেয়নি, যাকে তোরা চিনিসনা, জানিস না তার জন্য তোদের কেন সাজা হবে। " "তবে জেলের ওই মাতব্বর মেয়াগুলান  (জেলের দালাল বাহিনী) যে সব্বদাই মকে বলে মদের সক্কলের ফাঁসী  হবে !" ওদের কথা ছাড়, ওরা তো কারো ভাল চায় না, আর তুই তো ওদের দলে যোগ দিসনি,তাই তোকে ভয় দেখায়। " শুনে সে আস্বস্ত হয়।
--
অবশেষে একদিন কোর্টে তাদের কেস ওঠে। সকলে খুব খুশী। হাওয়া হাওয়ায় উড়তে উড়তে কোর্টে যায়। সন্ধ্যে বেলায় কোর্টের সবাই ফেরৎ আসে। বন্ধ গরাদের ভেতর আমরা উদগ্রীব হাওয়ার খবর পাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই সারা ফিমেল ওয়ার্ড হাওয়ার করুণ অসহায় কান্নার প্রবল ধাক্কায় খান খান হয়ে গেল। বহু রাত ধরে তা প্রতিদ্ধনি চলতে থাকে।  নিরুপায় আমরা সকালের অপেক্ষায় থাকি। সেদিন ডিভিশন ওয়ার্ডের ডিউটি তে একজন ভাল ওয়ার্ডার ছিল। তার কাছে শুধু শুনতে পেলাম হওয়াদের কারোর জামিন হয়নি।
--
পরদিন সকালে ছুটে মেয়াদী নম্বরের জালনায় গেলাম, সেখানে হাওয়ার প্রিয় সঙ্গিনীরা খবর দিল হাওয়া কিছু খাচ্ছে না, সারা রাত ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছে, এখন গোঙাচ্ছে। কেউ তাকে সামলাতে পারছেনা,পাগলের মত করছে।খালি বলছে ওর স্বামী, দেওর সবার ফাঁসী হয়ে যাবে, কোর্টে থেকে সেই কুখ্যাত নীহারিকা নামে ওয়ার্ডার নাকি শুনে এসেছে। আমাদের কাছেও আসতে চাইছেনা। এইভাবে কেটে গেল। হাওয়ার সাথীরা আর আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
--
জেলখানার ইতিহাসে একই ঘটনা বার বার ঘটে সবাই দেখেছি।  সাজার খবর বা বাড়ীর কোন দুঃসংবাদ এলে অথবা নরকের অপ্রকৃতিস্থ পরিবেশে কেউ সামান্য মানষিক ভারসাম্য হারালেই হয় নীচে অন্ধকার স্যাৎস্যাঁতে সেলে অথবা পাগল বাড়ীতে ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো পাগল করে দেওয়াই রেওয়াজ। হাওয়াকে বাঁচানোর জন্য হাওয়ার প্রিয় শান্তি মাসীর দায়িত্বে আরও ভরসাযোগ্য দু জন কে অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের মাসীমার ক্যাম্পোস বড়ি একটা করে  দুবেলা জলের সাথে  ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দিতে বলা  হল। এইভাবে ৩ দিন চলল। অবশেষে হাওয়া একটু স্বাভাবিক হল, অল্পসল্প খেতে শুরু করল। আমাদের কথা মত ক্যাম্পোসের পরিমান আস্তে কমিয়ে দেওয়া হল।
--
অবশেষে দিন পাঁচ পরে শান্তি মাসী ওকে আমাদের কাছে নিয়ে এল। কিছুক্ষণ মলয়ার হাত দুটো ধরে চুপ করে বসে রইল। আমাদের বাকী কজনকে চলে যাবো কিনা ইতঃস্তত করতে দেখে, ভাঙা গলায় হাওয়া বারণ করল, " তরাও শুন, মুই তদের কাছে যে কথাগুলান বুলি নাই, সেগুলান বুইলতে চাই।  তরা মকে ভুল বুইজলেও, কুঁচু হবেক নাই। " "কেন ভুল বুঝবো। তোর মনের কথা খুলে বল, তাতে তুই শান্তি পেলেই আমরা খুশী। " "জেডা মইরে, ফুইলে, ভাইসে উইঠেছিল, উটা ছিল মর পুব্বের শয়তান সোয়ামিডা। মর ইখনকার সোয়ামি মর আসল সোয়ামি তো বটেক, উ মরে কাউরে  বৈলতে মানা কৈরেছিল, ইমনকি শয়তানডার সাথ মর দেখা হব্বার কথাডা ও কাউরে কইতে মানা কৈরেছিল, তাই কাউরেই কই নাই। তা তুরা মুকে খারাপ ভাইবতে পারিস বটে। "
--
আমরা সবাই তাকে আশ্বস্ত করলাম ," তোর বর খুব বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছে। আর তুই ও একদম ঠিক করেছিস। তোরা কোন ভুল করিসনি। এখনও আর কাউকে খবরদার কোন কথা বলবি না। তোদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী, প্রমান কিছুই নেই। শয়তানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে থাকলেও কোন দোষ করিসনি। একদম মুখ বুজে থাকবি। সাক্ষী, প্রমান না পেলে ফাঁসী তো দূরের কথা, শুধু সন্দেহের বশে কোন সাজা আইনত দেওয়া যায় না।" শুনে হাওয়া অনেকটা আশ্বস্ত হল।
--
আমাদের যদিও জানা ছিল পয়সা দিয়ে এই ব্যবস্থায় বিচার কেনা যায়। তবে হওয়ার বাজান, খালা, আর আত্মীয় স্বজন অনেক চেষ্টা করে ভাল উকিল দিয়েছে। কোন জোরাল প্রমান আর সাক্ষ্য ও পাওয়া যায়নি। আশেপাশের গ্রামের মেয়েদের জীবন অতিষ্ট করে তোলার জন্য মৃতের প্রতি পাড়া পড়শীর কোন সহানুভূতি ছিল না, এগুলি ভরসার কথা। আরও বছর খানেক বিচার চলার পর, হাওয়া, তার বর আর দেওর বেনিফিট অফ ডাউট এ খালাস পেল। সকলেই খুব খুশী। যাওয়ার সময় জনে জনে সম্ভাষণ জানিয়ে গেল।এক চোখে একদিকে বিচ্ছেদ বেদনা অন্য দিকে আনন্দের অশ্রু  নিয়ে আমাদের হাওয়াবিবি জেলের কাল কুঠুরী ছেড়ে আপনজনদের কাছে ফিরে গেল। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


                  


  




  







  








    







   

4 Jul 2019

শোনিচারীর কথা

শোনিচারীর  কথা
*************

শোনিচারী কে আমরা চিনেছিলাম মাসিমার (শান্তিরানী দেব ) মাধ্যমে। ৭০ দশকে বর্দ্ধমান জেলে মাসিমা আর  বুলু সাধারণ বন্দিনীদের সাথে থাকত। শোনিচারী এক আদিবাসী সাঁওতাল মেয়ে, খুনের অপরাধে জেলে এসেছিল, চিরাচরিত সেই শোষক আর শোষিতের দ্বন্দ্বের  ইতিহাসে।
--
দরিদ্র অভাবী একটি পরিবার - বাবা, মা, শোনিচারী আর তার বড় আদরের বছর খানেকের ছোট ভাই। একটা ঝক ঝকে মাটির নিকোনো ঘর আর তার লাগোয়া সামান্য কয়েক কাঠা চাষের জমি। ঘরের উঠোনে আর মাটির ঘরের চালে ছিল নিজেদের হাতে ফলান তরিতরকারির বাগান। চারজনের অক্লান্ত পরিশ্রমে চাষের জমিতে ফলত ধান। এই নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল তাঁরা। পরিবারের মধ্যে ছিল অগাধ ভালবাসা। সহজ সরল মানুষ তাঁরা, গ্রামের জমিদারের কুটিল ষড়যন্ত্রের কথা তাঁদের জানা ছিল না।
---
শোনিচারী তখন যৌবনে পা রেখেছে, কচি সবুজ তার মন। সবল শরীরে খাটতেও পারত, পাড়াপড়শীর সাথে প্রাণ খুলে মিশতে বাঁধা কোন ছিল না, সঙ্গী সাথীদের সাথে পালা পার্বনে মন উজাড় করে আনন্দ করতে জানত, আর সদাই ঝর্ণার মত খিলখিলিয়ে হাসত। এইভাবে বেশ দিন কাটছিল, কিন্তু  ঈশান কোনে কাল মেঘের আভাস তাঁরা পায়নি। গ্রামের জোতদার মুখিয়ে ছিল যে কোন শর্তে ফন্দিফিকিরে তাঁদের জমিখানি দখল করার।
--
একদিন পার্বণে সঙ্গিনীদের সাথে মেলায় গেছিল শোনিচারী। ভাইও তাঁর কাজে কর্মে গ্রামের বাইরে ছিল। মেলায় অনেক আনন্দ করে ভোর রাতে গ্রামে ফিরে শোনিচারী দেখে তাঁদের সোনার কুটির জ্বলে পুড়ে খাঁক, তারই সাথে বাবা ও মা পুড়ে কালো কাঠ, সবজি বাগান ও তথৈবচ। পরবে, মেলায়  মেতে ছিল গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ। অবশিষ্ট গ্রাম রাতের ঘুমে ডুবে। হটাৎ পোড়া ধোঁওয়ার  গন্ধে জেগে ওঠে. চারিদিকে জোতদারের লেঠেলদের দেখে ভয়ে পাথর হয়ে যায়। শোনিচারী বাড়ী ফিরে সব দেখে শুনে দিশেহারা। ভাই তখনও ফেরেনি। ধীরে ধীরে ভিতরে আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে। মাথা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে, কোন মতে একটা টাঙ্গি জোগাড় করে সব বাধা ভেঙে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে। শয়তান জোতদারের  বাড়ীর দিকে দৌড়াতে থাকে।
--
তখন সবে ভোর, জোতদারের বাড়ীর লোকজন ভিতরে ব্যস্ত, শুধু উঠোনে তাদের  দুটি বাচ্চা ঘুম চোখে বসে। দিকবিদিক শূন্য শোনিচারীর মাথা তখন ইটের ভাঁটার মত জ্বলছে। প্রতিশোধের আগুনে সে আধা ঘুমন্ত শিশুদুটিকে টাঙ্গি দিয়ে ক্রমাগত কোপাতে থাকে, তাদের কান্নার আওয়াজে চারিদিকে লোক জমে গেলেও শোনিচারী বধির। তার রণমূর্তি দেখে কেউ এগোতে সাহস পায়না, অবশেষে শ্রান্ত হয়ে রক্তাক্ত উন্মাদিনীর মত টাঙ্গি হাতে থানায় গিয়ে হাজির হয় অকপটে সব বৃত্তান্ত খুলে বলে।
--
জোতদার তার পেটোয়া লোকজন নিয়ে থানায় গিয়ে নালিশ জানায় শোনিচারী ও তার ভাই দুজনে মিলে বিনা কারণে তার নাতি ও নাতনি কে খুন করেছে। শোনিচারী বারবার প্রতিবাদ জানায় তাঁর ভাই গ্রামেই নেই, সে একাই শিশুদুটিকে হত্যা করেছে, জমিদার বাবু  বিনা কারণে তাঁর ঘুমন্ত বাপ্ মা কে রাতে পুড়িয়ে মেরেছে। কিন্তু থানার দারগাও আর এক খয়ের খাঁ। সে জমিদারের নালিশের ভিত্তিতে কেস সাজায়। গ্রামে ফিরে সব শুনে ভাই শোনিচারীর সাথে দেখা করতে এলে তাকেও হাজতে পুরে দেয়।  
--
বিচারে শোনিচারী আর তার ভাইয়ের যাবজ্জীবন সাজা হল দুটি শিশুকে মারার অপরাধে। গ্রামের সব সরল গরীব মানুষরা পুরো ঘটনার কথা আদালতে বলতে চেষ্টা করে। শোনিচারীর ভাই ঘটনার দিন গ্রামেই ছিল না, সে একদম নির্দোষ। আর জমিদার বাবুর আদেশে তার  দালালরা  সাজিস করে  নিরীহ ঘুমন্ত বাপমা কে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার জন্য শোনিচারীর মাথার ঠিক ছিলনা বলেই সে ওই অপরাধ করেছে, এ সব কথাই আদালতে তাঁরা বলেন। কিন্তু ঘাগু জোত্দারের দালালদের আধা মিথ্যা সাক্ষ্য ও থানার দারোগাদের পক্ষপাতিত্বমূলক কেস সাজানো, আর বাদীপক্ষের তুখড় ওকালতির চালে রায়  শোনিচারীদের বিরুদ্ধে যায়। তাঁদের বাবামায়ের পুড়িয়ে মারার ঘটনা কে নিছক দুর্ঘটনা  বলে গণ্য করা হয়। এরপর চতুর  জোতদারের শোনিচরীদের জায়গা আত্মসাৎ আর কোন বাধা থাকল না।
--
পাথরের মূর্তির মত সে  বড় বড় চোখ মেলে অসহায় ভাবে  চুপ করে শুনে যায়। রায়ের শেষে চীৎকার করে কেঁদে ওঠে," হুজুর, মুই খুনটো কৈরলাম, মকে ফাঁসী দাও কেনে , মর ভাই টো কুন্ দুষ করেক লাই, ওয়ারে সাজা দিলেক কেনে ? তমাদের পায়ে গড় করি, উকে ছেইড়ে দাও গ। " কিন্তু ইটঁকাঠের আদালত কি তার অসহায় কান্না শোনে! এইভাবেই  দিনের পর দিন  অন্যায়ের বদলা নিতে গেলে এভাবেই গরীবের শাস্তি ঠিক হয়, বড়লোকে টাকার জোরে ঠান্ডা মাথায় খুন করেও  ঠিক মুক্তি পায়, গরীবের ভিটে মাটি আত্মসাৎ করে।
--
শোনিচারী জেলে ফিরে আসে কাঁদতে কাঁদতে,পাগলের মত দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে। সবাই কে একই প্রার্থনা জানায়, বাচ্চা দুটিকে সে মেরেছে, মহা অন্যায় করেছে, তার  ফাঁসী হোক, কিন্তু তার ভাইতো কোন কিছুই জানতনা, কিছু অন্যায় সে করেনি, তাঁর কেন শুধু শুধু সাজা দিল।প্রচন্ড জ্বরে গা তার পুড়ে যেতে থাকে। সকলে শান্ত করার চেষ্টা করে, আমাদের মাসীমা কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে সারা রাত তার মাথায় জল পট্টি দিতে থাকেন, সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। সে রাতের মত শোনিচারী ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু কদিন বাদে বাদেই এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। একদিকে দুটি নিষ্পাপ শিশুকে খুনের দংশন, অন্যদিকে নির্দোষ ঘুমন্ত বাপমা কে পুড়িয়ে মারা, সবচেয়ে বেশী পরম আদরের ভাইটির বিনা দোষে সাজা তাঁর মনের মধ্যে কুরে কুরে খেত। আমাদের মাসীমা তাকে সেবা করে সরিয়ে তুলতেন, আমাদের রাজনীতির মূল বিষয়গুলি তাঁর মত সহজ সরল ভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। সে সময় মাসিমাই ছিলেন শোনিচারীর সবচেয়ে বড় ভরসা, একান্ত আপনার জন। ধীরে,ধীরে তার অবস্থার একটু উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু এই টুকু সাহচর্য আর ভরসা তার ভাগ্যে সইলো না, মাসীমাকে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে বদলী করা হল।
--
 বর্দ্ধমান থেকে মাসিমা আর বুলু আমাদের মধ্যে এসে পড়লেন। এদিকে মীনাক্ষিকে ডিভিশন ওয়ার্ড এ দিয়েছে, সেলে কল্যানী, রাজশ্রী আর কল্পনা। রাজশ্রী তখন একটা বিশাল মানষিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল জেল ভাঙার যে পরিকল্পনায় ওরা যুক্ত ছিল, তাতে ওর পরমপ্রিয় কমরেড ও স্বামী সঞ্জয়ের গুলিতে মৃত্যু হয়। ওয়ার্ড অনেক নতুন মেয়েরা এসেছে। আমরা সবাই মহা ব্যস্ত। এর মধ্যে একদিন মাসিমাকে হাসপাতালের বড় জালনায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে আমরা কয়েকজন একটু তফাৎ রেখে কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। জালনার ওপারে ছিল শোনিচারী, এইখানে চিকিৎসার জন্য বদলী হয়ে এসেছে। সমস্ত অপরিচিতের মাঝে মাসীমাকে দেখে যেন হারান মানিক খুঁজে পেয়েছে। তাঁর দুহাত জড়িয়ে ধরে একবার কাঁদে, আবার কান্নার মধ্যেই আনন্দে মুখে হাসির ঝিলিক দিতে থাকে। এতদিন আমরা যে শোনিচারীর গল্প অনেকবার শুনেছি তাকে এবার আমরা চাক্ষুস দেখলাম।
--
এই ভাবে চলতে থাকে। হাসপাতালের মেট তখন মহাদেবিয়া। মেট্রনদের সামনে সে তাঁদের আজ্ঞাবহ থাকত, কিন্তু আড়ালে আমাদের সাথে যথেষ্ট ভাল ব্যবহার করত। তাই মাসিমা প্রতিদিন শোনিচারীর সাথে কথা বলার সুযোগ পেতেন। সে সানন্দে মাসিমাকে তার সব দুঃখ,অভিযোগ আর জেলের মহিলা  ওয়ার্ডের বিভিন্ন ঘটনার গল্প করত। স্বাভাবিক ভাবেই  যে বিপর্যয় তাঁর জীবনে ঘটে গেছে তা কি সে ভুলতে পারে, প্রায়ই ভীষণ কান্নাকাটি করত, মাসিমা গরাদের এপার থেকে তাকে মাথায় হাত বুলাতেন, সান্তনা দিতেন।একমাত্র বুলু ছাড়া আমরা কেউ গিয়ে দাঁড়ালে শোনিচারী কচ্ছপের মত খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে ফেলত, কারণ আমরা বাকিরা সবাই তার কাছে অপরিচিত।  তাই আমরাও দূরে দূরেই থাকতাম, মাসিমার কাছ থেকেই সব কথা শুনতাম। মহাদেবিয়াও শোনিচারীর ভার মাসিমার হাতে দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হওয়াতে তাঁদের আলাপচারিতাতে বাধা দিত না।
--
তখন জেলের জালঘরে বার্মা থেকে পালিয়ে আসা অনেক জন মহিলা ও তাঁদের বাচ্চাদের রাখা হয়েছিল। প্রচন্ড কষ্টে তাঁরা ছিলেন। শীতের রাতে ঠান্ডা কনকনে বাতাস আর গরমের দুপুরের তীব্র দহন খোলা জালের ভিতর দিয়ে আসত , ছোট বাচ্চাগুলি জ্বর, পেটগরম ইত্যাদিতে ভুগতে। উপরন্তু জেলে বন্দিনীদের স্বভাবিকভাবেই চিকিৎসা, ওষুধ, পথ্য কোন কিছু ঠিক মত মিলত না। ডাক্তার বাবুরা ডায়েট লিখলেও সে সবই মেট্রন, অসৎ জমাদারনী আর তাদের পেটোয়া দালাল রা আত্মসাৎ করত। রোজই প্রায় জলঘরে  শিশুমৃত্যু ঘটত। একদিন বর্মী মাসিরা অনশন করে তার প্রতিবাদে। আমরাও সমর্থনে অনশনে ভাগ নিই। হাসপাতালের জানলা দিয়ে ডাক্তার বাবুদের ওষুধ,ডায়েট ইত্যাদি ব্যাপারে বাস্তব অবস্থা টা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতে থাকি। আমাদের সামনে মেট্রন মেটদের ওপর খুব হম্বি তম্বি করে যাতে ঠিক মত ডায়েট ওষুধ দেওয়া হয়। অনশন প্রত্যাহার হয়। ডাক্তারদের সামনে এই অপমান শোধ যে পরে কোন ছুতায় মেট্রন নেবে তা আমরা বুঝে গেলাম। কিন্তু আপাতত আর কিছু করার ছিল না।
--
আমাদের আশংকা একদিন সত্য হল। এক সকালে ভাটির দিন হটাৎ প্রচন্ড কান্নাকাটির রোল সারা মহিলা ওয়ার্ডে প্রতিদ্ধনিত হতে লাগল। আমরা  সকলে ডিভিশন বাড়ীর খাঁচায় বন্দী, একবার মেয়াদী নম্বরের জালনায়, একবার   হাসপাতালের জালনায়  কি তুলকালাম ঘটছে তাই জানার ব্যাকুল হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি। শেষে মেয়াদী নম্বর থেকে আমাদের ভালবাসত এমন কয়েক জন জানাল বর্মি মাসিদের বেধড়ক মারছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে কুখ্যাত বিজয়া জমাদারণী। "কেন মারছে " ? "ওদের কাছে নাকি দা চাকু বঠি সব লুকান ছিল, অনেক গয়না গাটি লুকানো  ছিল !" কি করে এসব থাকবে , জেলে ঢোকার সময় জেল অফিসে একবার, মহিলা ওয়ার্ডে একবার তন্নতন্ন করে সব বন্দিনীদের সারা শরীর ও জিনিসপত্র তল্লাশি হয়, পয়সাকড়ি, গয়নাগাটি  জেলের অফিসে জমা রাখা হয় , একটা সুঁচ গলার জো থাকেনা। সেখানে এতো গয়নাগাঁটি, চাকু, হাত দাও, বটি  নিয়ে তাঁরা দিব্যি চলে এল ! আর এত দিন বাদে সেগুলি ধরা পড়ল !"
--
"আমাদের রাজনীতির প্রভাবে যে বন্দিনীরা ছিলেন, তাঁরা বললেন সব ছল গো দিদি। ডায়েট নিয়ে মেট্রনের মুখ পুড়েছে না, এটা তার প্রতিশোধ। আমাদের মতই কুঁড়িয়ে পাওয়া টুকরো টাকরা টিনের পাত ছিল শুধু তাই পেয়েছে আর কারো কারো পায়ের আঙুলের আংটি আর অল্প কিছু বাসনকসন ছিল কুখ্যাত দালাল শিখা অন্য জেলে যাবার সময় কেড়ে নিয়েছিল, বাকী  লোভী শয়তানগুলি সেগুলির ভাগ তখন ই নিয়ে নিয়েছে। বাকী আর কিছুই পাবার নেই। সব  মিথ্যা রটনা।" ইতিমধ্যে হাপাতালের জালনায় দেখি শোনিচারী উত্তেজিত ভাবে সেই সব রটনাগুলি বিশ্বাস করে মাসিমাকে শোনাচ্ছে। মাসীমা বোঝাবার চেষ্টা করছেন। এতদিন হাসপাতালে থাকার ফলে তাঁর সরল মনে মেট্রনের আপাত মিঠে কথা আর সুবিধাভোগী দালালদের সঙ্গ তাদের প্রতি তার মনে একটা আস্থার  ছাপ ফেলেছে। তাই  সরল বিশ্বাসে তাদের সপক্ষে বলে যাচ্ছে। হটাৎ আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলে বসে, "তুমিও শেষে ওই দালাদের দলে ভিড়লে।"  অপমানে, অভিমানে মুখ তাঁর কাল হয়ে ওঠে। মাসিমা বারবার ডাকলেও কোন উত্তর না দিয়ে সে পিছন ফিরে হাঁটা দেয়।
--
ইতিমধ্যে আমরা হাসপাতালের গরাদের এপার থেকে মেট্রন আর দালালদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকি। ডাক্তারবাবুরা এসে যান, তাঁদের আমরা আসল ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে থাকি। তাঁরা সব বুঝলেও, একমাত্র স্বল্প আয়োজনে যে টুকু সম্ভব আহতদের চিকিৎসা করেন। সময় হয়ে যাওয়ায় কজন জমাদার আর জমাদারনী এসে সব বন্দীদের খাঁচায় ভরে দেয়।
--
এর ফলে একটা খুব খারাপ ঘটনা ঘটল। শোনিচারী আর আমাদের থেকে দূরে সরে গেল। একমাত্র মাসিমাই ছিল তাঁর আপনার, কিন্তু তাঁর ডাকেও সে আর সাড়া দিলনা। মেট্রন তাকে প্রথমে হাজতি নম্বরে পাঠিয়ে দিল। অন্যদের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছিলাম তার নিঃসঙ্গতা দূর করতে। কিন্তু সে যেন চিরদিনের জন্য বোবা হয়ে গেল। তার অপরাধ বোধ তাকে ধীরে ধীরে অপ্রকিতস্থতার দিকে ঠেলে দিতে লাগল। হয়ত যখন তার বাবামায়ের পুড়ে কাঠ চেহারার কথা মনে পড়ত, দুটি শিশুর তীব্র আর্তনাদ কানে আসতো, তার ছোট ভাইটির বিনা দোষে সাজার কথা মনে পড়ত সে আর ঠিক থাকতে পারতনা গোঙাতে থাকত, উন্মত্ত হয়ে পড়ত। অবশেষে একদিন পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে পাগল বাড়ীর বাসিন্দা হল। এই খবর টুকু মহাদেবীয়া সবার অলক্ষে মাসীমাকে দিয়ে যায়। আমাদের একটা ভুলে সহজ সরল একটা নবীন প্রাণ অন্ধকার জীবনে ডুবে গেল।  কদিন এই নরক যন্ত্রনা তাকে ভোগ করতে হবে, জীবনের আলোতে আর কোনদিন  সে ফিরতে পারবে কিনা, সেটা অনিশ্চিতই রয়ে যাবে। তার পরিণীতি আর কেউ জানতে পারবেনা, আর মাসীমার মনে তার গভীর ক্ষত  হয়ে থাকল। আজও কত শোনিচারী এই ভাবে শোষণ আর অত্যাচারের শিকার হয়ে অন্ধকার কোন কুঠুরীতে পচে মরছে তার হিসাব নেই।      
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------