এই লেখাটি বিশেষ কারণে ভুল বশতঃ আসল লেখা থেকে না ছাপিয়ে খসড়া লেখা থেকে ছাপানো হয়। তাই অনেক তথ্যই এখানে বাদ যায়। তাই পরবর্তী কালে ছাপানোর সময় মূল লেখাটি জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত যেটা কয়েকটি পর্বে লেখা হয়েছে, সেটাই ছাপাতে হবে। আমার জীবদ্দশায় হলে সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা না হলে পরে কেউ ছাপাতে চাইলে তাঁর উদ্দেশ্যে এই সতর্কীকরণটা থাকল।
###########################################################################################
লালবাজারে পাকানো বাঁশের লাঠির বাড়ি মেরে হাত-পা ফুলিয়ে দিয়ে একরকমের
তেল লাগিয়ে দিতো, যাতে উপর থেকে ফোলা কমে যেতো, ভিতরে জখম খুব কিছু কমতো
না। সেটা নাকি বন্দুক পরিষ্কারের তেল। বুঝলাম মিনুর ভাগ্যে তাও জোটেনি। ও
কিন্তু একান্ত ভাবেই ঘরোয়া মেয়ে ছিলো, কোনোকালেই কোনো রাজনীতির সাথে যুক্ত
ছিল না। ওর ভাইবোনরা হয়তো ছিল। তাদের না পেয়ে ওকে আর ওর বাবাকে ধরে এনেছে।
দেখলাম ওকে উল্টো করে ঝুলিয়ে শুধু বেধড়ক মারই মারেনি, বুক-পিঠে জ্বলন্ত
সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে। দিন সাতেক মানিকতলা থানায় রেখেছিল। মাস কয়েক
আগেও একবার ওর বাড়িতে ভাইবোনদের তল্লাশ করে না পেয়ে ওকে ধরেছিলো। সেবার
শুধু জিজ্ঞাসাবাদের উপর দিয়ে গিয়েছিলো। এবার তাই বোধহয় তিন গুণ শোধ নিয়েছে।
ওকে দেখে একদিকে যেমন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, অন্যদিকে নিজে নতুন করে শক্তি
সঞ্চয় করছিলাম।
--
একটু পরেই একদল বন্দীকে আমাদের ওখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তার মধ্যে একজন
চশমা পরা মহিলা ছিলেন। আমাদের মতোই রাজনৈতিক বন্দী, মাস কয়েক আগে থেকেই
জেলে বন্দী আছেন। মিনু আগে একবার ধরা পড়ার সূত্রে তাকে চিনতো। নাম শীলা,
কোন এক কলেজের অধ্যাপিকা। আলাপ-পরিচয় হলো। শীলাদির বাবা বাড়ি থেকে খাবার
এনেছিলেন। তার থেকে আমাদের কিছুটা দিলেন, মিনু আর আমি বুভুক্ষুর মত গিললাম,
যেন কতোকাল পরে আপনজনের মাঝে এসে, পুলিশ থানায় হারানো খিদে তেষ্টা ফিরে
এসেছে আমাদের।
বিকেল পাঁচটার পর কোর্ট বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের কাউকেই বিচারকের সামনে
তোলা হলো না। পরে শুনেছিলাম আমাদের নামে রায়ট, খুনজখম ইত্যাদির জন্য
বিভিন্ন ধারায় কেস রুজু করা হয়েছে। আমাদের ভ্যানে তোলা হলো। মিনু হাঁটতে
পারছিলো না। আমি সাহায্য করতে গেলে শীলাদি বললেন—‘‘তুই পারবি না, আমি
দেখছি।” বলে তাকে কোলে তুলে ভ্যান পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, সাধারণ বন্দিনীদের
সাহায্যে উপরে তুললেন। আমাদের সবাইকেই গার্ড দিয়ে ভ্যানে তোলা হলো।
ভ্যান চলতে শুরু করল। খুপরির ভিতর থেকে বাইরেটা দেখছিলাম। রাস্তায় আলো
জ্বলছে। লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। মনে
হচ্ছিলো, ওদের সবাই স্বাধীন, খোলা আকাশের নীচে মুক্ত হাওয়াতে নিঃশ্বাস
নিচ্ছে। কি মজা, নিজেদের খুশিমতো যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবে। আর আমাদের জন্য
নির্ধারিত এক বন্দী জীবন।
চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। সেদিনটা পূর্ণিমা ছিলো কিনা জানা নেই,
কিন্তু চাঁদটাকে অনেক বড় আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো। তখনই এক সাথীর গলায় শোনা
গানের একটা কলি কানের কাছে বাজতে থাকলো, ‘‘যে স্বপনে কমরেডস নয়ন ভরেছো, সে
স্বপন মুক্তি স্বপন।” মনে মনে সেটাই আওড়াতে লাগলাম। ভ্যান আলিপুর
প্রেসিডেন্সী জেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
--
নাম ধরে ধরে সবাইকে গুনে গুনে জেলগেট দিয়ে ঢোকানো হলো। মিনুকে আগের মতো
করে সকলের সাহায্যে নামিয়ে শীলাদি কোলে করে নিয়ে এলেন। জেল অফিসে এক ঘণ্টা
অপেক্ষা করতে হলো। খাতাকলমে সবার নামধাম, কেস ইত্যাদি লেখাজোখা হলো। তারপর
প্রত্যেককে তন্ন তন্ন করে সার্চ করে, দুজন মহিলা ওয়ার্ডার আর বড় বাঁশের
পাকানো লাঠিধারী একজন জমাদার (মানে ছেলে ওয়ার্ডার) গরুর পালের মতো সব
বন্দীকে তাড়িয়ে নিয়ে চললো। মিনুকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো।
--
বিরাট পাঁচিল তোলা জেলের মধ্যে চলতে চলতে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট
পাঁচিলঘেরা জায়গায় পোঁছে জমাদার সকলের পিলে চমকে বাজখাই গলায় হাঁক দিলো,
‘‘জেনানা ফাটক আ গয়া।” বলেই দেওয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা দড়ি ধরে টান মারলো
আর ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠলো। ভিতর থেকে গেট খুলে এক জবরদস্ত জমাদারনি
বেরিয়ে, গুনতি মিলিয়ে সবাইকে ওয়ার্ডের ভিতর ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে বিশাল তালা
লাগিয়ে দিলো।
--
মিনুকে হাসপাতালে রাখা হলো। বাকিদের আবার তল্লাশি করা হলো। শীলাদিকে
অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে গেলো। আমাকে সাধারণ বন্দীদের সাথে হাজতী নম্বর ওয়ার্ডে
দেওয়া হলো। দেখলাম বড়জোর জনা পঞ্চাশেক মানুষ থাকার একটা ঘরে কম করে শ’দেড়েক
বন্দিনীকে কেস-নির্বিশেষে পুরে দেওয়া হয়েছে। একধারে আধা পাঁচিল তোলা, চট
ঘেরা জায়গা প্রাকৃতিক কাজের জন্য নির্ধারিত। তার কটু গন্ধে গা গুলিয়ে বমি
আসে।
--
সেই রাতে জেনানা ফাটকের সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা হয়ে গেল। নিভা
নামে এক নন-এলসি (নন ক্রিমিনাল লুনাটিক) বন্দিনী আর একজন রাজনৈতিক বন্দিনীর
সাহচর্যে। নিভা বললো, ‘‘জানো তো? এখানে মোট পাঁচটা ওয়ার্ড। হাসপাতাল,
মেয়াদি নম্বর, হাজতি নম্বর, পাগল বাড়ি, ডিভিশন বাড়ি। তাছাড়া গোটা ছয়েক সেল।
সকালে একপিস পাউরুটি, বা একমুঠো চিঁড়ে, বা মুড়ি, বা ছোলা সেদ্ধ দেওয়া হয়,
দুপুরে এক ডাব্বু ভাত, হলুদ জলের মত ডাল, বুড়িয়ে যাওয়া শুঁটকো তরকারির ঝোল।
রাতে তিনটি রুটির সাথে দুপুরের মতই ডাল-তরকারি। খাবারের পরিমাণ এতই কম, যে
জোয়ান মানুষ কেন বাচ্চাদেরও খিদে মেটে না।” রাত জেগে জেল আর জেলের বিভাগ
বিষয়ে জ্ঞান সঞ্চয়ের চেষ্টা করলাম।
--
ঘরের অর্ধেক জায়গা এক শ্রেণীর বিশেষ সুবিধাভোগী বন্দিনী, যারা
কর্তৃপক্ষের দালাল, তাদের দখলে। বাকিরা কোনোমতে ঘাড় গুঁজে, এক কাতে বসে
ঘুমোতে চেষ্টা করছে। হাজতি নম্বরের পারিপার্শ্বিক অবস্থা জেল ব্যবস্থার
নগ্ন চেহারাটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। বুঝিয়ে দিলো জেনানা ফাটকে রীতিমত
শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেই সাধারণ বন্দিনীরা কোনোমতে টিকে আছে।
-----------------------------
পর্ব ২
----------
বোধহয় ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো। হঠাৎ বিকট এক বাজখাঁই গলায় চিৎকার,
‘‘ফাইল, ফাইল। গুনতি, গুনতি। ওঠ, ওঠ এই শালীরা।” তাকিয়ে দেখি মোটাসোটা
লাঠিধারী হেড জমাদারনি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ, মানে কিছু দালাল বন্দিনী, লকআপ
খুলে ভেতরে ঢুকলো। ঘরের বন্দিনীরা সবাই তাড়াহুড়ো করে লাইন করে মাটিতে উবু
হয়ে বসে গেলো। নিভা আমার হাত ধরে টেনে একটা জায়গায় বসে পড়লো। দালালরা ক’জন
বন্দিনী আছে তার হিসেব নিলো। নতুনদের আলাদা করে নাম লিখে বললো, ‘‘এই তোরা
সকালের খাবার পাবি না। ন’টার সময় কেস টেবিল হবে, তারপর দুপুর থেকে থেকে
খাবার পাবি।” বলে সদলবলে বেড়িয়ে গেলো।
--
বন্দিনীরা প্রাতঃকর্ম সারা, স্নান করা আর খাবার জল ধরার জন্য হুড়োহুড়ি
লাগিয়ে দিলো, কারণ দেরি হয়ে গেলে হয়ত সকালের খাবারটাই মিলবে না। নিভা তার
খাবার নিয়ে এসে বলল, ‘‘আমার থেকেই আজকে খা।” আমি অবাক হয়ে দেখলাম দেড় মুঠি
ছোলা সেদ্ধ। ওতে নিভারই পেট ভরবে না। আমি কি করে ভাগ বসাই! নির্বিকার
চিত্তে নিভা বলল, ‘‘চিন্তা করিস না, তুই না নিলেও আমার পেটের এক কোণাও ভরবে
না। বলেছিনা, এখানে পেটের আগুন কখনো নেভেনা। জ্বলতে জ্বলতে শেষে আর বোধ
থাকে না।” জোর করে দেওয়া ছোলা মুখে তুলতে গিয়ে দেখি পোকাশুদ্ধ ছোলা। সেটা
ফেলতে গেলে নিভা আমার হাত চেপে ধরলো, ‘‘আরে করিস কি! পোকা ছোলা ফেলতে গেলে
সব ফেলে দিতে হবে। চোখ বুঝে খেয়ে নে। দুদিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে।”
--
খাওয়া শেষ না হতেই নিভা আমাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললো। ‘‘চল, পাগল
বাড়ির দরজা খোলা। আমি ওখানে
আগে থাকতাম। এই ফাঁকে দেখে নে, হয়তো আর কোনোদিন
দেখার সুযোগ পাবি না।” জেলখানায় পাগলরা থাকে আগে জানা ছিল না। পরে
শুনেছিলাম অনেকেই, বিশেষত যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, তারামাথার গণ্ডগোল হলে
নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের জেলখানায় সেরে ওঠার জন্য দিয়ে যায়। যেমন মদিনা, নিভাকে
দিয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া রাস্তা থেকেও পাগলদের ধরে এনে এখানে রাখা হয়। এরা
সবাই নন ক্রিমিনাল লুনাটিক কেসে বন্দী।
--
পাগল বাড়ি ঢুকে আমি পাথরের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোটা তিনেক
খাঁচার মত ঘর। সেখানে অনেক, অনেক একেবারে উলঙ্গ কঙ্কাল, মাথায় চুল, জট
পাকিয়ে গেছে, গা-হাত-পা নোংরায় কালো, এখানে সেখানে দগদগে ঘা। অনেককেই
হ্যান্ডকাফ দিয়ে, বা শেকল দিয়ে গরাদের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। যে যেখানে
পেরেছে প্রকৃতির ডাকে কাজ সেরেছে। তারই পাশ থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। অনেকে
আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি, চুল টানাটানি, কামড়াকামড়ি করে পরস্পরকে
ক্ষতবিক্ষত করছে, রক্ত ঝরছে। কেউ গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, কেউ গালিগালাজ করছে,
কাউকে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছেনা। সাধারণ মানুষ ওখানে ক’দিন থাকলে পাগল হয়ে
যাবে।
--
আমি জেলে ঢোকাকাকালীন সময়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে আর দোতলার
সেলে শুধু রাজনৈতিক বন্দীদের আলাদা করে রাখা হয়, যাতে তারা সাধারণ
বন্দীদের সাথে মিশতে না পারে। শীলাদি ছাড়াও মুক্তি, বিজু, আর আরও পাঁচজনের
সাথে পরিচয় হলো। উপরের সেলে কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া (মিত্র) থাকতো। বিজু ছিল
সবার ছোট, মুক্তি, ডালিয়া আমার সমবয়সী, কল্পনা আর জয়া ছিল শীলাদির বয়সী।
একটার সময় হেড ওয়ার্ডার তথা জমাদারনি এসে আবার লকআপ করে দিলো।
ভাত খাবার পর বিজু পড়লো আমাকে নিয়ে। শুনলাম প্রতি সপ্তাহে এক মুটকি
কেরোসিন তেলের গন্ধ ভরা মাথার তেল, এক মুটকি সরষের তেল আর একটুকরা কাপড়
কাচার সাবান বন্দিনীদের প্রাপ্য। সেই কেরোসিন তেল ওরফে মাথার তেল বিজু আমার
মাথায় জবজবে করে মাখিয়ে, কষে বেঁধে বেশ কিছুক্ষণ রেখে দিল। তারপর একটা সরু
চিরুনি দিয়ে জোরে জোরে আঁচড়াতে লাগলো। আর কেরোসিনের গন্ধে ঝরঝর করে উকুন
পড়তে লাগলো, মুক্তি সেগুলোকে মারতে থাকলো। বিকেলে চারটেয় লকআপ খুললে বিজু
কাপড় কাচার সাবান মাথায় গায়ে ঘষে স্নান করিয়ে দিলো। প্রায় দু’তিন দিন এই
পর্ব চললো। থানার কম্বল থেকে আসা উকুন তাড়াবার জন্য। বিকাল পাঁচটা/ছটার সময়
আবার লক আপ হলে মুক্তি আর বিজু মিলে পুলিশ লকআপে মার খেয়ে আঘাতের জায়গায়
সরষের তেল মালিশ করতে থাকে। যারাই নতুন আসে, এইভাবে শুশ্রূষা করে সারিয়ে
তোলাটা এখানকার রেওয়াজ। সাথীদের সাহচর্য্যে আর সেবায় শরীর মন দু’ই শান্তি
আর স্থৈর্য পায়। সন্ধ্যেবেলায় খাবার খেয়ে গল্প করা বা বই পড়া হতো, প্রায়ই
গানও হতো। মুক্তির গলায় অসাধারণ কাজ ছিলো। বিজুরও খুব মিষ্টি গলা ছিলো।
সবার শেষে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গাওয়া হতো। এইভাবে শুরু হল আমার জেল জীবন।
---------------------------------
পর্ব ৩
--------
কল্পনা ধরা পড়েছিল যদুগোড়া জঙ্গল থেকে, শ্রদ্ধেয় অনন্ত সিংহের গ্রুপের
বেশ কয়েকজনের একটা দলের সাথে। ও আমাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন জেলে
কাটিয়েছিলো। অসম্ভব সাহসী আর দৃঢ়চেতা ছিলো। মুক্তি শান্তশিষ্ট অথচ
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বভাবের মেয়ে, ধরা পড়ে ’৭১ সালে। ডালিয়া ছিলো ডাকাবুকো। আর
বিজু ছিলো প্রাণশক্তিতে ভরপুর উচ্ছল একটা বাচ্চা মেয়ে, কিন্তু দারুণ মনের
জোর, দেখলে বিস্মিত হয়ে যেতে হয়। ও ধরা পড়ে ’৭২ সালের প্রায় শেষের দিকে।
জয়া ধরা পড়ে সম্ভবত পুরুলিয়া থেকে। শীলাদিদের ৭/ ৮ জনের মধ্যেও সাহসের অভাব
ছিলো না, তারাও ’৭২-’৭৩ সালে ধরা পড়ে।
--
কল্পনা-ডালিয়াদের মুখে গল্প শুনেছি, ’৭০-’৭১ সালের প্রথম দিকে কল্পনাকে
একতলায় ঠান্ডা স্যাঁৎস্যাঁতে একটা সেলে রেখেছিলো। তখন অনেক মেয়ে ছিলো।
তাদের রাখা হয়েছিলো মেয়াদি নম্বরে। সবাই মিলে ঠিক করে, ওকে যখন স্নান করাতে
বার করবে তখন জমাদারনিদের হাত থেকে কেড়ে ওয়ার্ডে নিয়ে আসবে। সাধারণ কিছু
বন্দিনীও এতে সামিল হয়। যথারীতি পরিকল্পনা মাফিক কাজ হয়। জমাদারনিরা আটকাতে
সাহস পায় না। ফলে জেলারের নেতৃত্বে জমাদারদের বিশাল ফোর্স আসে। অসম শক্তির
মধ্যে লড়াই শুরু হয়। সবাইকে অবাক করে শিখা বলে সবচেয়ে সক্রিয় বন্দিনীটি
প্রথমেই দল বদলে জমাদারদের হাত থেকে লাঠি নিয়ে মেয়েদের মারতে শুরু করল।
এরপরে অতি সহজেই জেল কর্তৃপক্ষের সুনজরে এসে শিখা দালালদের রাণী হয়ে বসে।
পরবর্তীকালে গোবেচারি জমাদারনিরাও তাকে তোয়াজ করে চলতো। যাই হোক, আমাদের
মেয়েরা লড়াই করলো, সকলেই প্রচন্ড আহত হলো। কল্পনা, জয়া, ডালিয়া আর সীমাকে
সেলে বন্দী করে দিলো। বাকীদের মেয়াদি নম্বরে আমি ’৭৩-এর প্রথমে ধরা পড়ি। তখন ওই দলের কল্পনা, সীমা, ডালিয়া আর জয়া
বাদে সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে। বাকি সকলকে শীলাদিদের সাথে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে
দেওয়া হয়েছে। সীমাকেও পরে সেল থেকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয়।
--
সাধারণ বন্দিনীদের মেয়াদি নম্বরে দেওয়া হলো। আমাদের ওয়ার্ডের বাইরে একটা
প্যাসেজ ছিলো। সেখান থেকে মেয়াদি নম্বরের জানলা দিয়ে সাধারণ বন্দিনীদের
সাথে কথা বলা যেতো। তার পাশেই ছিলো হাসপাতাল। সেখানে মেট্রন আর
ডাক্তারবাবুদের বসার কথা, তাছাড়া রুগীদের থাকার কথা। কিন্তু সেখানে শিখা
তার দালালদের নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলো। আমাদের প্যাসেজ থেকে আমরা ওদের কারসাজির
দিকে লক্ষ্য রাখতাম। একজন পাহারায় থাকতাম, অন্যরা মিলে সাধারণ বন্দিনীদের
সাথে গল্প করতাম।
--
মহিলা ওয়ার্ডের ভিতর দিকটার এক কোণে, সেলের সামনে, একটা ছোট্ট ভাটিঘরে
বড় দুটো চুলা ছিলো। সেখানে গরম জল, বন্দিনীদের জন্য সপ্তাহে একদিন কাপড়
সিদ্ধ ছাড়াও, মেট্রন আর দালালদের জন্য রুগীদের ভাগ থেকে চুরি করা জিনিসপত্র
দিয়ে মুখরোচক খাবার বানানো হতো। ভাটিঘরের দু’পাশে দু’টি আগেকার দিনের ভারি
দরজা। আমাদের দিকের দরজাটা সাধারণত বন্ধ থাকতো। সেলের দরজাও প্রয়োজন ছাড়া
খোলা হত না।
--
কতো মানুষের সাথে পরিচয় হতো। পয়সার অভাবে যারা তদবির করতে পারতো না,
বছরের পর বছর তারা জেলে পচে মরতো। মীরা ছিল এক সিধেসরল ধর্ষিতা মা। তার
ধর্ষক বাইরের দুনিয়ায় বহাল তবিয়তে ঘুরছিলো। আর সে একটা হাড়-জিরজিরে বাচ্চা
নিয়ে অন্ধকূপে পড়ে ছিলো। আরেক মীরা বাংলাদেশের মেয়ে, দাঙ্গার সময় পালাতে
গিয়ে পথ হারিয়ে জেলে আসে। হাসিনা সুন্দরবন থেকে কাজের জন্য কলকাতায় এসে
রাস্তা হারিয়ে ফেলে। শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিলেই সে বাড়ি চলে যেতে পারতো।
জাহানারা ন-দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে ও ধর্ষিতা। ধর্ষক পয়সার জোরে খোলা আকাশের
নীচে। শুধু অসহায় মেয়েগুলো ‘ভিক্টিম’ হিসেবে সরকারি সেফ-কাস্টডির অন্ধকূপে
বন্দী। কেউ কেউ বন্দী চুরি না করেও চুরির অপরাধে। সবচেয়ে হাস্যকর, চুরি না
করে কেউ যদি করেছে বলে স্বীকার করে নেয়, তবে পাঁচ-সাত দিনের সাজা দিয়ে তাকে
ছেড়ে দেওয়া হয়। আর কেউ যদি আত্মমর্যাদা বোধবশত মিথ্যে অপবাদ অস্বীকার করে,
তাকে জেলে পচে মরতে হয়। ভালবাসার অপরাধেও জেলে থাকতে হয়। জেলে না এলে
জীবনে এত অভিজ্ঞতা হতোই না।
--
এর মধ্যে মুক্তি মিসা থেকে মুক্তি পেয়ে চোখের জলে বিদায় নিলো। ওদিকে
মিনু এলো আমাদের ওয়ার্ডে। একদিন বৃষ্টির দিন, খুব চা খাবার ইচ্ছে হলো। আমরা
পুরনো কাপড়ে আমাদের সেই বিখ্যাত উকুন তাড়ানো তেল ঢেলে, যে সামান্য চা পাতা
ছিল, তা-ই জলে দিয়ে অনেক ফুটিয়ে চা তৈরি করলাম। অমনি এক কোণা থেকে একটা
নেংটি ইঁদুর লাফ মেরে ফুটন্ত চায়ে পড়ে নিজের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটালো আর
আমাদের চায়ের ঘটালো দফারফা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এক দশাসই জমাদারনি
লকআপের কাছে এসে জিজ্ঞাসা শুরু করলো ‘‘কে আগুন জ্বালিয়েছে?” কেউ পাত্তা না
দেওয়াতে সে চাবি আনতে গেলো ঘরে ঢুকে দেখবার জন্য। এই অবসরে বিজু গরম চায়ের
বাটি ধরে গরাদের ফাঁক দিয়ে নর্দমায় ফেলে দিলো, আর আমি পোড়া ন্যাকড়াগুলো আধা
পাঁচিল দেওয়া যে বাথরুম ছিলো, তার লোহার প্যানে ফেলে, জল ঢেলে চাপা দিয়ে
দিলাম। জমাদারনি দরজা খুলে কিছুই দেখতে পেলো না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে
বাথরুমের প্যানের দিকে তাকিয়ে বক বক করতে করতে ফিরে গেলো। এদিকে আমাদের
দু’জনের হাতের অবস্থা খারাপ। অনেকক্ষণ জলে হাত ডুবিয়ে বসে থাকলাম।
--
এর মধ্যে আমাকে কোর্ট থেকে আবার চোদ্দ দিনের জন্য লালবাজারে নিয়ে যাওয়া
হলো, আবার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আর জেলের গোপন খবরের জন্য। ‘‘আপনাদের
লৌহবেষ্টনীর মধ্যে আটকে রেখে আমাকে গোপন খবরের জন্য জেরা করছেন! আপনাদের
ফোর্স ছাড়াও তো দালাল বাহিনী রয়েছে খবর দেবার জন্য।” ব্যাস। এক প্রস্থ মার।
সেন্ট্রাল লকআপে গিয়ে দেখি বরানগরের বহুদিনের ওয়ান্টেড একটি মেয়ের পেছনে
এমন মেরেছে, এক-দু’মাস পুলিশ হাসপাতালে রেখেও ঘা পুরো সারেনি। অথচ মেয়েটি
বহুদিন আগেই পার্টি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে রীতিমত ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
আমাকে মিসা দিয়ে জেলে ফেরত পাঠালো। ওই মেয়েটিকে পরে ক’দিনের জন্য জেলে
পাঠিয়েছিলো। তারপর ছেড়ে দেয়।
--
রাজনৈতিক বন্দীদের জেল কর্তৃপক্ষ বা দালালরা সচরাচর ঘাঁটাতো না, প্রাপ্য
জিনিসপত্র কিছুটা হলেও দিতো। কিন্তু সাধারণ বন্দিনীদের দুর্দ্দশার সীমা
ছিলো না, এদিক-ওদিক হলেই মারধর। শুধু খাবার কেন, খাবার জলটাও ঠিকমতো জুটতো
না। অসুখবিসুখে ওষুধপত্রও মিলতো না। আমরা চেষ্টা করতাম যাতে ওরা একজোট হয়ে
নিজেদের দাবীগুলো আদায় করতে পারে। একজোট হয়ে দালালদের মারধোর ঠেকাতে পারে।
দালালরা সব সময় চোখে-চোখে রাখতো, যাতে আমাদের সাথে ওরা কথা বলতে না পারে। কিন্তু তাই বলে জেলে লড়াই কখন থেমে থাকেনি। অন্যান্য বন্দিনীদের লড়াইয়ের পাশে আমরা সব সময় থাকতে চেষ্টা করেছি ,তাঁরাও আমাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। কখন লড়াই শুরু করেছে মীরা,শান্তিবাই,বেলা,রেখারা, কখন বা মিতা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, মদিনা ,শোভা, শান্তি মাসীর। কখন বার্মিজ মাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে, কখন মেয়াদী নম্বরের পাকিস্তানের পাসপোর্ট কেসের মাসীরা, আবার কখন মাস্তান একাই জেলকতৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবারে জীবন বাজী রেখে লড়ে গেছে।
--
একদিন কথা বলতে বলতে একটু বেখেয়ালি হয়ে পড়াতে কয়েকটা দালাল আমার চুল আর
কাপড় টেনে ধরে। আমি নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে চিৎকার করে বিজুকে ডাকতে থাকি।
বিজু দৌড়ে আসে, দু’জনে মিলে টানাটানি করে নিজেকে ছাড়াই। এদিকে মেট্রনের
নির্দ্দেশে হেড জমাদারনি আমাদের দরজাটা খুলে শিখা আর তার দালাল বাহিনীকে
ঢুকিয়ে দেয়। প্রথমেই আমাদের চশমাদুটো ভেঙে দেয়। আমার চোখের পাওয়ার মাইনাস
চোদ্দ। চশমা খুললে আমি কিছুই দেখতে পেতাম না। আমাকে ক’জন চেপে ধরলো। তবে
মূল লক্ষ্য ছিলো বিজু। সবাই মিলে বিজুকে চুল ধরে ঘুষি, থাপ্পড় মারতে লাগলো।
ইতিমধ্যে শীলাদিরা সবাই বার হয়ে ওদের ওপর চড়াও হলো। এমনকি দরজা খোলা পেয়ে
মীরা, শান্তিবাইরা প্রায় জনা পনেরো সাধারণ বন্দিনীরা ঢুকে দালাল বাহিনীকে
আক্রমণ করলো। ওরা এতটা ভাবতে পারেনি। কাজেই তাড়াতাড়ি পগারপার হলো। জমাদারনি
দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো। প্রায় দিন দশ-পনেরো সাধারণ বন্দিনীরা আমাদের সাথে
থাকলো। তারপর ওদের হাজতি নম্বরে ফিরিয়ে দিলো।
--
এর ক’দিন বাদে ডালিয়াকে দশ বছরের সাজা দিয়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে নামিয়ে দিলো
আর জয়াকে পুরুলিয়া পাঠিয়ে দিল। শীলাদিরা সবাই এক-এক করে ছাড়া পেয়ে গেলো।
বিজু, মিনু, ডালিয়া আর আমি রইলাম ডিভিশন ওয়ার্ডে। কল্পনা একা সেলে। এর
ক’দিন পরে বিজুর মিসা উঠে গেলো, ওকে অনেকের সাথে এন্টালি কনস্পিরেসি কেসে
ঢুকিয়ে দিলো, আর লালবাজারে নিয়ে গিয়ে একপ্রস্থ অত্যাচারও করা হলো। ও আমাদের
মাঝে ফিরে এলো সেই অত্যাচারের চিহ্ন নিয়ে।
-------------------------
পর্ব ৪
--------
আমরা ফিমেল ওয়ার্ড বা জেনানা ফাটককে বলতাম ‘জেলের ভিতর জেল’। তার ভিতর
ছিল সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ড। দুনিয়া থেকে কেন, প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতরে যে
ছোট্ট জেল, তার থেকেও আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা বহাল ছিল। সাধারণ
বন্দিনীদের উপর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়ে চললো, বিশেষ করে আমাদের সাথে যারা
কথা বলার চেষ্টা করতো। এমন কি ছোট, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদেরও কোন মাফ ছিলো
না, বেধড়ক অত্যাচার চলতো।
ইতিমধ্যে মেয়াদি নম্বরে বাংলাদেশ যুদ্ধে ধৃত কিছু মহিলাদের সাথে তাঁদের
কিশোরী মেয়েদের আর বাচ্চা কাচ্চাদের রাখা হল। তাঁদের স্বামীদের যুদ্ধবন্দী
হিসেবে, সম্ভবত আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়েছিলো। যাইহোক, জেল
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একমাত্র শিখার মতো গুটিকয়েক নৃশংস বন্দিনী ছাড়া বাকী
সবাই মোটামুটি একজোট ছিলো। মেয়াদি নম্বরের মাসিদের সাথে আমাদের ভালো
সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের কিশোরী মেয়েরা আমাদের সমর্থক হয়ে যায়। অনেক
ব্যাপারে আমাদের গোপনে সাহায্যও করতো।
--
তার কিছুদিন পরে বেশ কিছু বার্মিজ মাসিদের একইরকম ভাবে তাঁদের কিশোরী
মেয়ে আর ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে জেলে নিয়ে আসা হল। জালঘরে তাঁদের রাখা হল,
যার চারপাশে মোটা রড-জাল দিয়ে ঘেরা, মাথায় একটা চাল দেওয়া। গরমের দুপুরে
ঝলসানো বাতাসে ছোট বাচ্চাগুলো পেটের অসুখে ভুগতে ভুগতে জলাভাবে মৃত্যুর
কোলে ঢলে পড়তে লাগলো। ওষুধপথ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। শীতকালে হু-হু
করা হিমশীতল বাতাসে ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া ইত্যাদিতে কতোজন যে মারা গেলো,
কেউ জানেনা। ওয়েলফেয়ার অফিসারকে ঠুঁটো জগন্নাথের মত করে রাখা হয়েছিলো।
--
রোজকার বন্দিনীদের খাবার চুরি করা ছাড়াও, কচিৎ কারোর বাড়ি থেকে
‘ইন্টারভিউ’তে বাড়ির লোক যা নিয়ে আসতো, সব কিছু হাসপাতালে বসে মেট্রন,
ওয়ার্ডারদের সামনেই আত্মসাৎ আর ভাগাভাগি হয়ে যেতো। খিদের জ্বালায় বন্দীরা
একদিন প্রতিবাদ করতে শুরু করলো। আমাদের সাথীদের মধ্যে কেউ কেউ তখন কোর্ট
থেকে ফিরছিলো, তারাও ওদের সাথে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। মেট্রন বেগতিক দেখে
যারা খাবার চুরি করে, তাদের ছদ্ম শাসন করতে লাগলো। ফলে সেদিন বন্দীদের ভাগে
খাবারের পরিমাণ কিছুটা বেশি হলো।
--
আর একদিন আমরা ক’জন বাড়ির লোকেদের সাথে ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে দেখি
একজনকে মারার প্রতিবাদে বাংলাদেশের মীরা, শান্তিবাঈ, বাসন্তী মাসি, বেলা, রেখা, ইত্যাদি এরকম প্রায় কুড়ি জন প্রচণ্ড চেঁচামেচি-কান্নাকাটি করছে। শুনলাম
রেখা আর বেলাকে শিখার বাহিনী বিনা কারণে মেরেছে। আমরাও তাদের লড়াইয়ে সামিল
হলাম। মেট্রন যথারীতি সেই দালালদের দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করালো। কিন্তু
এইভাবে ক্রমাগত প্রতিবাদের দানা বেঁধে ওঠাটাকে মেট্রনরা আর তাদের দালালরা
স্বাভাবিক ভাবেই ভাল চোখে দেখলো না। আমরা ওদের বোঝাতে লাগলাম সব সময়
দল বেঁধে থাকতে, আর চলাফেরা করতে। কারণ আমাদের কাঠের দরজা তো বেশিরভাগ বন্ধ
করে রাখা হতো। সত্যি শেষে একদিন দালালরা আগের শান্তিবাঈ আর বাংলা দেশের মীরাকে অমানুষিক ভাবে মারলো, যেহেতু এরা আমাদের ভালবাসতো আর ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে কাজ করতো। প্যাসেজ থেকে হাসপাতালের ভিতরটা কিছুটা দেখা যেতো। আমরা অসহায় ভাবে ওদের বীভৎস ভাবে ফুলে ওঠা কান্নাভরা বিকৃত মুখগুলো আর ক্ষতবিক্ষত হাত-পা গুলো দেখে নিষ্ফল রাগে ফুঁসতে লাগলাম।
--
দালাল শিখা ছিল এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌ, দুটি সন্তানের মা। রোজ
বরের অফিসে টিফিন নিয়ে যাবার ছুতোয় মালিকের ছেলের সাথে প্রেম করে সব ফেলে
পালিয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাড়ি ভাড়া নিতো, পড়শিদের সাথে ভাব জমাতো।
তারপর তাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানা দামী জিনিসপত্র, টাকাপয়সা,
গয়নাগাঁটি নিয়ে চম্পট দিতো। এহেন মানুষের চরিত্র শঠতা, নিষ্ঠুরতা আর লোভে
ভরা থাকাটাই স্বাভাবিক। ফিমেল ওয়ার্ডে পাগলরাও ওর অত্যাচারের হাত থেকে বাদ
যেতো না। শুধু জেল কর্তৃপক্ষকে তুষ্ট করতেই নয়, অত্যাচার করতে আসলে ও আনন্দ
পেতো। কত অভাগা মেয়ের গোপনাঙ্গে হিংস্র ওয়ার্ডারদের সাথে মিলে লাঠি ঢুকিয়ে
দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। অবশ্য এধরণের অসংখ্য শিখাদের জেল কর্তৃপক্ষ
খুঁজে নিতো নিজেদের অত্যাচার কায়েম রাখতে। রাতের অন্ধকারে কতো মানুষকে
পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরেছে তার হিসেব নেই। দিনের আলোতে মানুষগুলিকে খুঁজে
পাওয়া যেতো না।
--
মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল
থেকে এসেছিল। শান্তির সময় লুকিয়ে বা পাহারাদারদের টাকা সীমানার এপার ওপার করত,কারণ দুই দেশেই আত্মীয় স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এইভাবে একবার সীমানা পার হতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। পথের সন্ধানে ঘুড়তে ঘুড়তে অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে পেটের দায়ে রুজিরোজগারের জন্য কলকাতায় এসে পৌছাঁয় । ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন
পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা
দালাল কাউকে ভয় করতো না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রনকে ডিঙিয়ে
জানতে চায় কবে তার কোর্টের দিন পড়বে। পরে সেই অপরাধে মেট্রনের
অঙ্গুলিহেলনে শিখারা চূড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় পাগলবাড়ীতে শেকল
বেঁধে রেখে দেয়। তাকে আমরা আর দেখতে পাইনি।
---
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগড়ি বাই যখন স্বামীর নতুন করে বিয়ে
হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়, শিখা আর তার
সাঙ্গোপাঙ্গোরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি
সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই
শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত।
একদিন কোনোমতে সেল থেকে বেরিয়ে রোদ পোহাতে গিয়েছিল, আর শেষ। তাকে মেরে
লোপাট করে দিল। কাজ ফুরোলে ছেঁড়া চটির মত মানুষকে ফেলে দিতে তাদের বাধত না।
--
ইতিমধ্যে সম্ভবত ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভেঙে পালানোর
একটা চেষ্টা হয়। অনেক ছেলেদের সাথে রাজশ্রী আর মীনাক্ষী ধরা পড়ে। তারপর
খুকুও ধরা পড়ে। রাজশ্রীকে সেন্ট্রাল জেল গেটেই ছেলেদের সাথে প্রচণ্ড মারধর
করা হয়। লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যায়, পায়ে গুলির স্প্লিন্টার লাগে। ওর স্বামী সঞ্জয় গুলিতে শহীদ হন। মীনাক্ষী,
খুকু লালবাজারের অত্যাচারের শিকার হয়। বেশ কিছুদিন জেরার পর ওদের জেলে
পাঠানো হয়।খুকুকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয়, আর মীনাক্ষী, রাজশ্রী কে সেলে
কল্পনার সাথে রাখা হয়। সাথীদের সেবাশুশ্রূষায় ওরা ভাল হয়ে ওঠে। এই সময় স্বামীকে হারাবার যন্ত্রণার বিরুদ্ধে রাজশ্রীকে প্রচন্ড মানষিক সংগ্রাম করতে হয়। এর সময়ে তিন-চার দিনের জন্য জয়াকে পুরুলিয়া থেকে আনা হয়, আর সেখান থেকেই ওকে মুক্তি
দেওয়া হয়।
--
উপরে সেলের একটা ঘরে ওয়েলফেয়ার অফিসার বসতেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ ভাল ছিলেন।
যতোটা পারতেন বন্দীদের ভালো করার চেষ্টা করতেন, আমাদের প্রতি একটা স্নেহ
ছিলো। বিশেষ কোনো সুবিধা নিতেন না। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। ফলে
মেট্রন আর তার দলবল ওনাকে সহ্য করতে পারতো না, নানা ভাবে তাঁর কাজে বাধা
দিত। তিনি ওদের কোন পরোয়া না করে, একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তাঁর কাজে
সাহায্য করার জন্য যে বন্দিনীদের দেওয়া হয়েছিলো তাদের ওপর মেট্রন বাহিনীর
রাগ ছিলো।
--
বন্দিনীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করল।মাস্তান, মীরা ও শান্তিবাই এর ওপর অত্যাচারের কোন বিচার হয়নি। মেট্রন চালাকি করে পাগলী বাজাতে দেয়নি। তাই আমরা ঠিক করলাম, এর একটা শিক্ষা দিতে হবে, নয়তো ওরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে
থাকবে। কিছু ন্যাকড়া আমাদের উকুন মারা কেরোসিন তেলে ভিজিয়ে হাতপাখার
হাতলগুলো ভেঙে মশাল বানালাম, আগুন দেখলে ভয় তো পাবে। আর আমাদের খাবার জন্য
জেল থেকে যে অ্যালুমিনিয়ামের থালা দিয়েছিলো, তা-ই হল অস্ত্র। ঠিক হলো,
চায়ের জন্য যখন সেলের আর ভাটিঘরের দরজা খুলবে, আমরা সবাই ঠেলে দু’পাশ থেকে
বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে যাবো। সবাই চুলগুলোকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে
খোঁপা করে নিলাম।
--
পরিকল্পনা মতো তাই হলো। ওয়ার্ডার চিৎকার করে উঠলো, ‘‘আরে কোথায় যাচ্ছো
সবাই মিলে!” ভাটির আগুন থেকে মশাল জ্বালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হলো না।
আনাড়ি হাতের মশাল কি জ্বলে! তাই মশালের আশা ত্যাগ করে থালা হাতেই দৌড়োলাম।
হাসপাতালের গেটে মেট্রন, ‘‘কি হলো! কি হলো!” করে বেরিয়ে আসতেই ডালিয়া থালার
এক বাড়ি বসিয়ে দিলো। মেট্রনের কপালের কাছে কেটে যেতেই ভয়ের চোটে সে
হাসপাতালে ঢুকে গেলো। সবচেয়ে দজ্জাল হেড জমাদারনি একটা মোটা বাঁশের লাঠি
নিয়ে এগিয়ে আসতেই ডালিয়া ওর হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিলো। ওদিকে শিখা যেই
বীরদর্পে এগিয়ে এলো একটা পাকানো বাঁশের লাঠি নিয়ে, খুকু খপ করে সেটা ছিনিয়ে
নিলো।
--
সে এক দেখার মতো অবস্থা। ওয়ার্ডার আর বাকী দালালরা অর্ধেক হাওয়া, আর
অর্ধেক হাঁ করে দেখছে, যে শিখা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। খুকু আর ডালিয়া
দু’পাশ থেকে ছন্দ বজায় রেখে কাপড় কাচার মত ওকে পেটাচ্ছিলো। আমি আর বিজু
চশমা খুলে রেখে গিয়েছিলাম। আমার হাই পাওয়ার বলে কিছু ভালো বুঝতে পারছিলাম
না। কে আমাদের মেয়ে, কে সাধারণ বন্দিনী, আর কে দালাল—কিছুই না। সেই সুযোগে
শিখার মত নৃশংস এক দালাল আনোয়ারা আমায় পিছন থেকে জোর ধাক্কা মারলো। আমি ছিটকে পড়ে
গেলাম। তখন মিনু এসে থালা দিয়ে তাকে এক বাড়ি মেরে আমাকে ধরে তুলল।
---
এদিকে পাগলি বেজে গেছে, অর্থাৎ জেলের গণ্ডগোলের সতর্কবার্তা পৌঁছে গেছে।
ওয়ার্ডারের বাঁশির আওয়াজ, ফোর্সের বুটের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমরা সবাই
পরিকল্পনা মাফিক সেলের দিকে দৌড়ে উঠে গেলাম। সেলের বারান্দার জাফরি দিয়ে
আমরা ওদের কাণ্ডকলাপ দেখতে থাকি। জেলারের নেতৃত্বে বিশাল ফোর্স আস্তে আস্তে
যেই সেলের দিকে এগোতে যায়, আমরা চেঁচাতে থাকি ‘‘মার মার বোম মার। গুলি
চালা।” অমনি ফোর্স পিছিয়ে যায়। আবার এগোতে গেলে আবার চেঁচাই, ওরা আবার
পিছিয়ে যায়। শুধু থালা হাতে আমরা এইভাবে লড়াই করতে গেছি, সেটা মেট্রনরা
ভাবতে পারেনি। আসলে ওরা আমাদের ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না, আর আন্দাজও করতে
পারছে না আমাদের কাছে সত্যি কি কি অস্ত্র আছে।
--
এইভাবে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর ওরা নিজেদের মধ্যে পরার্মশ করতে থাকে।
শেষে একজন আমাদের মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন এমন একজন মধ্যস্ততা করতে এলেন। তিনি সাদা রুমাল নাড়িয়ে উপরে এসে বলে,
‘‘তোমাদের যে কোনো একজন চলো। জেলারবাবু জানতে চান কি সমস্যা তোমাদের। উনি
সব ব্যবস্থা করে দেবেন।” ‘‘আমরা একজনও যাবো না। জেলারবাবুকে গিয়ে বলুন,
আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। ফিমেল ওয়ার্ডে দিনের পর দিন সাধারণ
বন্দিনীদের উপর যে অত্যাচার চলছে, সেটা বন্ধ করতে বলুন। ঠিকমতো চিকিৎসা আর
ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতে বলুন। রোজকার মাপ মতো খাবার দিতে বলুন সবাইকে।
এতগুলো সমস্যা রয়েছে! এগুলোর সমাধান হওয়া প্রয়োজন।”
---
ডেপুটি জেলার ফিরে গেলো। হাসপাতালে আলাপ আলোচনা করে ফোর্স নিয়ে জেলারও
ফিরে গেলো। তখন আমরা জল খেয়ে, যাদের আঘাত লেগেছে তাদের দেখভাল করতে লাগলাম।
কল্পনা আর বিজুর হাতে বেশ লেগেছিলো, জলপট্টি করা হল। বিকেলে সেই ডেপুটি
জেলার হেড জমাদারকে সঙ্গে এনে, গার্ড দিয়ে, আমরা যারা ডিভিশন ওয়ার্ডে থাকি
সেখানে পৌঁছে দিয়ে লকআপ করে দিল। সেলেও লকআপ করা হলো।
-----------------------
পর্ব ৫
--
জেল কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে যে ছেড়ে দেবে না, আমরা জানতাম। প্রথমে
ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলি করে দিলো। ওয়েলফেয়ার অফিসারকেও ট্রান্সফার করে
দিলো। ১৯৭৪-এর একেবারে প্রথম ভাগে ঘটনাটা ঘটে। সেইসময় আমাদের
সাতষট্টি-আটষট্টি বছর বয়সী মাসিমা আর বুলু বর্ধমান বা মেদিনীপুর জেল থেকে
বদলি হয়ে এসেছিলেন। আমাদের মহাভাগ্য জেলে আমরা মাসিমাকে মা হিসেবে
পেয়েছিলাম। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় আমাদের ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বয়সে আমাদের
সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতেন। তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের
সময়ে তিনি খুবই ছোট ছিলেন, কিন্তু লুকিয়ে বিপ্লবীদের নানাভাবে সাহায্য
করতেন। বস্তুত স্বাধীনতা আর ন্যায়ের প্রতি তাঁর চিরকালই অশেষ শ্রদ্ধা
ছিল। তাঁর নাম ছিল শান্তিরানী দেব।
---
দেশ ভাগাভাগির সময় সব ফেলে খালি হাতে চলে আসেন। অশেষ কষ্টের মধ্যে আস্তে
আস্তে উঠে দাঁড়ান। মেসোমশাই অসুস্থ থাকার ফলে তাঁকেই সংসারের হাল ধরতে হয়।
ছেলেরা একটু বড় হতেই বিভিন্ন কারখানায় কাজ জুটিয়ে নেয়। তাঁর চার ছেলের
মধ্যে দু-তিন জন আমাদের পার্টির সাথে যুক্ত ছিলো। মাসিমার বিবাহিত মেয়ে যেন
মাসিমারই প্রতিমূর্তি। জামাইও খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। রাজনীতির সাথে যুক্ত
ছিলেন না, কিন্তু মমতা আর সহৃদয়তার প্রতিচ্ছবি।
বুলু শান্তশিষ্ট, হাসিখুশী, দৃঢ়চেতা মেয়ে ছিল।
---
একদিন আমি আর বুলু
হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলাম। দালালরা মেট্রনের নির্দেশে তৈরি ছিল।
মেয়াদি ও হাজতি নম্বর, জালঘরের বন্দিনীদের লকআপ করে দিল। ভাটিঘর আর সেলের
নীচের কাঠের দরজাটা তো বন্ধ করাই থাকতো। এর মধ্যেই মেয়াদি নম্বরের মাসিরা
বিজুদের খবর দিয়ে দিয়েছে, শিখার নেতৃত্বে বিশাল এক দালাল বাহিনী বাঁশের
লাঠি, লোহার রড নিয়ে আমাদের মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিজুরা হাসপাতালের
জানলা দিয়ে আমাদের সাবধান করে দিলো। তবে ওরাও জানতো আর আমরাও বুঝলাম, খালি
হাতে দু’জন এতগুলো লাঠি, রডধারী দালালদের সাথে যুঝে উঠতে পারবো না। তাছাড়া
চশমা খোলা অবস্থায় আমি তো অসহায়। চশমাটা বিজুর হাতে দিয়ে বুলুর হাত শক্ত
করে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ওয়ার্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমরা দু’জন ঠিক
করে নিয়েছিলাম, মার তো খাবোই। কিন্তু ওরা যেন মনে না করে যে ভয় পেয়েছি।
---
কয়েকজন দালাল আমাদের প্রায় ঘিরে নিয়ে চললো। ওদের পুরো বাহিনী ভাটিঘরের
কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখানে যেতেই আনোয়ারা আমার মাথায় লোহার রড দিয়ে বাড়ি
লাগলো। এই আনোয়ারা আন্ডার-এজ সংশোধনাগারে তিনটি বাচ্চার মাথায় পাথর জাতীয়
কিছু মেরে খুন করার কেসে ছিল। তাই শিখা ওকে ওই দায়িত্ব দিয়েছিলো। আমার
মাথার ব্রহ্মতালুর একধারে দুটো, আর কপালের কাছে একটা বাড়ি লাগে। প্রায় অর্ধ
অচেতন অবস্থায় চুল ধরে হিড়হিড় করে মাঠের মাঝে নিয়ে গেল, যাতে একমাত্র
ডিভিশন ওয়ার্ড ছাড়া সেল, জালঘর, মেয়াদি আর হাজতি নম্বর থেকে সবাই দেখতে
পায়, আর অসহায় রাগে ছটফট করে। যতোক্ষণ আমার জ্ঞান ছিলো, বুঝতে পারছিলাম
হাতে, পায়ে, সর্ব শরীরে লাঠি আর রডের বাড়ি পড়ছে, মাথা দিয়ে রক্ত বার হয়ে
চলেছে। আমি ক্ষীণ স্বরে ওয়ার্ডার কে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি, ‘‘মাসি বুলু
কোথায় দেখো।”
---
তারপর আর জ্ঞান ছিলো না। যখন জ্ঞান আসে, দেখি হাসপাতালের একটা বেডে
শুয়ে। আর চার জন ডাক্তার ঘিরে আছেন, একজন মাথায় সেলাই করছেন। একজন প্রেশার
দেখছেন, আর বলছেন ‘‘ভীষণ হাই, ফ্লাকচুয়েট করছে।” চিফ মেডিকাল অফিসার আর
তাঁর পরের পদে যিনি, তাঁরা কথা বলছেন। পাশের বেডে বুলুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে,
ওরও শুশ্রূষা চলছে। ইতিমধ্যে মেট্রন মুখ বাড়িয়ে যতোবার মিষ্টি কথা বলতে
আসছে, আমি আর বুলু ওঠার চেষ্টা করছি, আর বকে যাচ্ছি, ‘‘চালাকি হচ্ছে! সব
জেনে প্ল্যান করে এসব কান্ড ঘটিয়ে এখন ভালোমানুষি হচ্ছে!” ইত্যাদি। আর হাত
বাড়াচ্ছি ওকে ধরার জন্য, বুলু তো প্রায় ধরেই ফেলেছিলো। একজন ডাক্তারবাবু
কড়া গলায় মেট্রনকে বললেন, ‘‘আপনি এখান থেকে সরুন তো, শুধু শুধু এদের
উত্তেজিত করবেন না।”
---
অনেকক্ষণ বাদে অবস্থার উন্নতি হলে আমাকে স্ট্রেচারে আর বুলু কে ধরে
ডিভিশন ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে গেলো। বুলু একবারে নতুন এসেছিলো বলে, ওকে অল্পের
উপর দিয়ে ছাড় দিয়েছিলো। ওর হাতে সেলাই পড়েছিলো। আমাদের সাথীরা না খেয়ে
অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমরা ঘরে ঢোকার পর থেকে আমাদের
দু’জনের সব দায়িত্ব তারা নিজেদের হাতে তুলে নিলো। ওষুধ খাওয়ানো আর সেলাইয়ের
জায়গা পরিষ্কার করে নতুন ব্যান্ডেজ করতে হতো সেলাই না কাটা পর্যন্ত। আমার
সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগলো। এই সময়টা আমি হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারতাম
না। মাসিমা, খুকু, বিজু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে সুস্থ করে তুললো। ওদের
ছাড়া আমার পক্ষে কোনো কিছু করাই সম্ভব ছিলো না। কোনো বিরক্তি বা ঘেন্না না
দেখিয়ে হাসিমুখে ওরা সব করতো।
---
জেলের সহবন্দিনীরা যে আমাদের কত ভালবাসতো, তার প্রমাণ আমরা নতুন করে
পেলাম। ওই স্বল্প খাবার থেকে তারা ডায়েটের দুধ, বিস্কুট, ডিম, ফল—যে যা
পারতো লুকিয়ে পাঠাতো। কোনো বারণ শুনতো না। আমাদের মারার পর শিখাকে অন্য
জেলে বদলি করে দেওয়া হয়েছিলো। মহাদেবিয়া হাসপাতালের মেট হল। একদিন
শান্তিবাঈ ভাটির দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললো, ‘‘শিখা ভয়ের চোটে পালিয়েছে।
মহাদেবিয়া ভাল মানুষ। এখন আর আগের মত অবস্থা থাকবে না। চিন্তার কিছু থাকবে
না।” হাত নেড়ে ওকে শুভেচ্ছা জানালাম।
---
অবশেষে দিন সাত-আট বাদে একটু সুস্থ হলে মেয়াদি নম্বর ঘরের সামনে বিজু আর
খুকু আমাকে ধরে নিয়ে যাবার পর মাসিরা নিশ্চিন্ত হলো। খাবার পাঠানো বন্ধ
করা গেলো। মাসিদের মুখে শুনলাম, আমাকে মারার পর মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত
দিয়ে শিখারা পায়ে আলতা পরেছিলো। আর সেদিন যে ওয়ার্ডারের কাঁধে জেনানা
ফাটকের শিকলে ঝোলানো চাবির ঝোপা ছিল, তাই দিয়ে সে দালালদের তাড়াবার আপ্রাণ
চেষ্টা করেছিলো। তাছাড়া চারজন ডাক্তারবাবু সে সময় গেট দিয়ে ঢুকে ওই দৃশ্য
দেখে, অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে, সোজা আমাকে ঘিরে হাত ধরে দাঁড়িয়ে
ব্যারিকেড তৈরি করেছিলেন। নাহলে আমাদের হয়তো সেদিন মেরেই ফেলত। হাজতি নম্বর
থেকেও অনেকে এসে দেখা করে গেলো। এতোদিন পরে সবাইকে দেখে, তাদের
ভালোবাসা-শুভেচ্ছায় মন ভরে গেল। সাধারণ মানুষের এই ভালবাসা/শ্রদ্ধা কোন
ব্যক্তি বিশেষের প্রতি ছিল না, ছিল আমাদের মতাদর্শের প্রতি।
---
শান্তিবাঈ আর মীরা এসে হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে বললো, ‘‘দিদি মাপ করিস, আমরা
দুজন সেদিন ওদের পেছনে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম, নাহলে মেরে ফেলবে বলে ভয়
দেখিয়েছিলো। তোদের মারতে দেখেও আমরা কিছু করতে পারিনি, মনে মনে কেঁদেছি।”
‘‘আরে না না, তোদের যখন মেরেছিলো, আমরাও তো অসহায় ভাবে দেখেছি, কিছু করতে
পারিনি। সবার সাথে মিলেমিশে থাকিস। কিন্তু ওদের দলে ভিড়ে সাধারণ বন্দীদের
ওপর অত্যাচার করিস না।” ‘‘না রে দিদি, ওদের মতো কখনও হবো না।”
----
এরপর কল্পনা, বিজু, খুকু, ডালিয়া, রাজশ্রী, মীনাক্ষী, আমাকে আগের সেই
ওয়েলফেয়ার অফিসারের নামে ব্যাংকশাল কোর্টে মেট্রনকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রের
অপরাধে জেল কর্তৃপক্ষ কেস করেছিলো। আমাদের মজাই হলো। জেলের এই অন্ধকূপ থেকে
বাইরে যাবার একটা সুযোগ মিললো। ব্যাংকশাল কোর্টে গিয়ে ডালিয়ার সাথে অনেক
দিন বাদে দেখা হলো, অনেক গল্পও হলো। বিকেলে কোর্ট বন্ধ হলে আবার ছাড়াছাড়ি।
আবার সেই কালো রাতের মত উঁচু কালো পাঁচিলের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া।
---
কোর্টে যাবার সুযোগে ভ্যান থেকে হোলেও তার খুপরি জলনার ভিতর দিয়ে বাইরের পর পৃথিবী টাকে একটু দেখতে পেতাম। এরকম এক কোর্টের দিনে জেলে অফিসে আমাদের যখন তল্লাশির জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে, দেখলাম এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা আর দুই মেয়ে মিলে তাদের মাকে জেলে ভর্ত্তি করতে এসেছে, যাতে তাঁর গভীর ডিপ্রেশন থেকে সেরে ওঠে। আমরা সকলে মিলে তিন ভাগে ভাগ য়ে বাবা আর দুই মেয়েকে জেলের প্রকৃত অবস্থা কি, পাগলদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়, তার পরিণতি কি সব বুঝিয়ে বললাম। "১ /২ মাস মাকে নয় তাঁর কঙ্কাল টা দেখতে পাবে, আর কদিন বাদে তাঁকে আর খুঁজেই পাবে না। তাঁকে জীবিচাইলে শীগগিরই বাড়ী নিয়ে যাও।" মেয়েরা কাঁদতে শুরু করল আর বাবার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ২/১ সপ্তাহ বাদেই সব ব্যবস্থা করে মাকে তাঁরা বাড়ী নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের জালনা থেকে আমরা আনন্দের সাথে দেখলাম। যাবার সময় গরাদের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাদের অনেক ভালবাসা জানালেন। আমরাও তাঁদের এই কাজের অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম।
--
পর্ব ৬
এতেও জেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কল্পনাকে হাজারীবাগ জেলে
বদলি করল। রাজশ্রীকে লালবাজারে এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে গেলো। কিন্তু কাউকেই
ভাঙতে পারেনি।মীনাক্ষীকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে দিল। মাস কতক মীনাক্ষী সেলে ছিল, তারপর ডিভিশন বাড়ী। ইতিমধ্যে একদিন মিতা
এলো মেদিনীপুর থেকে, অনেক অত্যাচারের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তারপর দেবযানী আর কমলা
এলো। দেবযানী পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলো আর কমলা ছিল খুবই সাধারণ, ঘরোয়া মেয়ে;
আমাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ছিলো। তাদেরও সরকার বাহাদুর ভয় পেলো।
---
কদিন বাদে রাজশ্রী ফিরে এলো। ওকে একা সেলে রাখাতে আমরা আপত্তি জানাতে
দেবযানী আর কমলাকে সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছুদিনে বাদে কল্পনা সেলে ফিরে
আসে, আর দেবযানী, কমলা ছাড়া পেয়ে যায়। ১৯৭৪-এর মাঝে মলয়া ধরা পড়ে। ওর উপর
অকথ্য অত্যাচার চলে, দীর্ঘ একমাস পুলিশ হাসপাতালে রাখার পর ওকে জেলে পাঠায়।
টেবিলের ওপর ফেলে পেছনে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। আমাদের কাছে আসার পর দেখি
ওর ‘হিপে’ লাঠির বাড়ির দাগ আর অজস্র খোঁদল। মলয়া স্কুল টিচার ছিলো। এরপর
কৃষ্ণা ওরফে জয়া, শিখা,পার্বতী, জয়শ্রী একে একে ধরা পড়ে। যথারীতি পুলিশের
অত্যাচারের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। কৃষ্ণার টেক নাম ছিল জয়া। কিন্তু ওকে
আমরা সারা জীবন জয়া বলেই ডাকতাম। আর জয়শ্রীকে বৌমা বলতাম। বৌমাও স্কুল
টিচার ছিলো।
---
এরপর লতিকা ওরফে সাথী, অর্চনা দি আর গৌরী ধরা পড়লো। ওদের তিনজনের ওপর,
বিশেষ করে অর্চনাদির উপর প্রচণ্ড অত্যাচার হয়েছিলো। সাথী গোখেল কলেজের
অধ্যাপিকা, অর্চনাদি একজন স্কুল টিচার আর গৌরী সেলাইয়ের কাজ করতো। অর্চনাদি
আর গৌরী সাথীর ননদ ছিল। একমাত্র অর্চনাদি আর মাসিমা ছাড়া আমরা সবাইকে নাম
ধরে ডাকতাম। রাজশ্রী, মীনাক্ষী আমি সবে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে পা
রেখেছিলাম। গৌরী আর খুকু আমাদের বয়সী ছিলো। জয়া সম্ভবত বিএ পাশ ছিলো। খুব
সম্ভব কল্পনা, বৌমা, মলয়া আর সাথী সমবয়সী ছিলো। বিজু, মিতা, শিখা আর
পার্বতী স্কুলের গণ্ডি তখনও পার হয়নি।
---
বিভিন্ন বয়সের হওয়া স্বত্তেও আমাদের সকলের সবার সাথে খোলাখুলি মিশতে কোন
বাধা কখন হয়নি। সকলে কত যে গুণের অধিকারী ছিলো! বিজুর এম্ব্রডায়েরী দেখার
মত ছিলো, উল বোনা, কুরুশের কাজেও সে পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী অসাধারণ ছবি
আকঁতো, সেলাইতেও নিপুণ ছিল। মীনাক্ষীও ছবি আঁকা, সেলাই, আব্বৃত্তিতে
পারদর্শী ছিলো। রাজশ্রী আসার পর কল্পনার আঁকা ভীষণ সুন্দর হয়ে গেলো।
রাজশ্রী ছবি আঁকতে বসলেই ও খুব খেয়াল করে দেখতো, আর নিজের ভেতরের অসীম
প্রতিভায় খুব তাড়াতাড়ি পারদর্শীও হয়ে গেলো। মিতা কোন ছবি দেখলে এমন নিপুণ
ভাবে সেটা আঁকতো,যে কোনটা আসল বোঝা যেতো না। মাসিমা আর মলয়া দু-তিন দিনে
একটা সোয়েটার শেষ করে ফেলতো। গৌরী,শিখা,বুলু ও সূচীকর্মে পারদর্শী
ছিল।খুকুর হাতের রান্না ছিল অসাধারণ। জয়া, বৌমা, মিনু, মলয়া আর সাথীরা
অসাধারণ গান করতো। সাথীর তো ক্লাসিকাল চর্চা করা গলা ছিলো। বৌমা পুরানো
দিনের আইপিটিএ-র কতো যে গান জানতো! তা সবাইকে শেখাতোও। তাছাড়া লেখালিখিতে
অল্পবিস্তর সবাই পারদর্শী ছিলো।বৌমা সর্বপ্রথম জেলের ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে
শুরু করে।
---
জয়াটা (কৃষ্ণা) খুব রসিক ছিলো। যেকোনো গুরুগম্ভীর পরিবেশে গম্ভীরভাবে
এমন একটা রসিকতা করতো যে সবাই হেসেই আকুল। তারপর সহজ পরিবেশে সমস্যাটা খুব
সুন্দর ভাবে সমাধান করা হয়ে যেতো। বৌমা, আমাদের জয়া আর শিখা ধরা পড়ার
কিছুদিন পর একসাথে পুলিশ কাস্টডিতে ছিল। কি করে কাগজ পেন্সিল যোগাড় করে
একজন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছিল, ‘‘…নবীশের ভুড়ি / করি
হাড়িকিড়ি। ….” ইত্যাদি। সেটা আবার সেই পুলিশ অফিসারের হাতে পড়েছিল। ফলে তার
জন্য আর একদফা ঝামেলা পোহাতে হয়।
---
সকলের এত গুণাবলীর কথা বললাম এই কারনে যে, এরা এত সব গুণের অধিকারী ছিল
যে ইচ্ছা করলেই প্রচলিত জীবনে থেকে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারতো।
কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে একটা নতুন সুন্দর সমাজ
গড়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়।
ইতিমধ্যে একদিন শিখা আর পার্বতী কোর্ট থেকে পালতে গিয়ে, ধরা পড়ে মারধর খেয়ে
চোখ মুখ ফুলিয়ে ওয়ার্ডে ফিরলো।
---
তখন ডিভিশন ওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তিরিশে গিয়ে
দাঁড়াল,এদের মধ্যে আন্নার নামটা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। ওরা খুব গরীব
ছিল, লোকের বাড়ী কাজ করে সংসার চালাত। আমরা থালা কম থাকায় দুজনে মিলে এক
থালায় খেতাম। সবাই একই জামাকাপড় পরতাম। কারোর নিজস্ব বলে কিছু থাকতো না।
ইন্টারভিউয়ে যার বাড়ী থেকে যা আসতো সাধারণ কমিউনে জমা পড়তো। দু’জন করে এক
সপ্তাহের কমিউন ইনচার্জ হত। তাদের হাতে খাবার দেবার দায়িত্ব থাকতো। সেই
সপ্তাহে ঘরের টয়লেট পরিস্কার করা, ঘর মোছা, ভাটির দিন কাপড় কাচা সেসব কাজ
থেকে তাদের ছুটি দেওয়া হতো। একবার আমি আর আন্না একসাথে কমিউন ইনচার্জ
ছিলাম। এক থালায় খেতে খেতে ও আমাকে বললো, ‘‘দেখ আমরা এই রাজনীতি করি বলেই
না এক সাথে খাই , সব কাজ একসাথে করি। কেউ কাউকে ঘেন্না করি না। আমাদের নতুন
সমাজটা তো এরকম ই হবে।” আমি থ হয়ে ভাবলাম কত বড় সত্যিটা ও কতো সহজ আর
সুন্দর ভাবে বললো! এর কিছুদিন পর আন্না, মিনু, দেবযানী কমলা আরো অনেকে চলে
গেল। তবে কল্পনা সেলে ফিরে এল। মোটের উপর আমরা পনেরো-ষোলো জনে এসে
দাঁড়ালাম।
--
একদিন মিতা, হাওয়া বিবি ,শান্তি মাসী, হাসিনা,শোভা, মর্জিনা ইত্যাদি প্রায় জনা তিরিশ বন্দিনী খাবার কম, ওষুধের অভাব, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা খাবার ধরল না, লক আপ ঢুকল না। তাঁদের সমর্থনে আমরাও খাবার বয়কট আর লক আপ রেজিস্ট করলাম। যৌথ প্রতিবাদের সামনে মেট্রন, আর এক কুখ্যাত বিজয়া ওয়ার্ডার আর দালাল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে কোর্ট থেকে আমাদের কজন কমরেড ফিরল। বন্দিনীদের কাছে আমাদের যৌথ প্রতিবাদের কথা শুনে তাঁদের সাথে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল কারন ডিভিশন ওয়ার্ডের গেট খুললে আমরাও বার হয়ে গেলে আর সামাল দেওয়া যাবেনা। অনেক তর্কবিতকের পর দালালরা হাত জোড় করে মাপ চায়, মেট্রন ওয়ার্ডার রা কথা দেয় তারা অন্যায়ের প্রতিকার করবে , খাবার মাপ মত দেবে ইত্যাদি। তারপর সবাই খাবার ধরে আর লক আপ হয়
---
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরের বন্দিনীরা খালাশ পেয়ে গেল, সরকারী পর্যায়ে
বন্দী বিনিময় সূত্রে। মুন্নি,হামেদা,জড়িনা মাসী নানী সকলে যাবার সময়ে আমাদের জন্য অনেক দোয়া করলেন, শুভেচ্ছা
জানিয়ে বিদায় নিলেন। এবারে মেয়াদী ঘরে নানা কেসের বন্দিনীরা এলো। আরো নতুন
নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হল। এক আশ্চর্য্য ঘটনা দেখলাম। রেড লাইট এলাকার দেহ
ব্যবসায়ীনী দের সাথে সেখানকার মালকিন বা মাসিদের তুলে আনা হত মাঝে মাঝে,
আবার এক-দু দিন বাদে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হত জানতাম। এবার দেখলাম সেই মাসিরা
অনেক বন্দিনী মেয়েদের নানা রকম প্রলোভন দেখাচ্ছে। কাউকে বোঝাত তার বাড়ী
পৌঁছে দেবে, কাউকে চাকরি পাইয়ে দেবে ইত্যাদি। বন্দী জীবন থেকে মুক্তি
পাবার জন্য তারা সহজেই সে প্রলোভনে পা দিত। কিছু পাজী ওয়ার্ডার আর জেলের
অসৎ কর্মচারীদের সাথে তাদের ভাল যোগাযোগ থাকতো। মেয়েগুলিকে বলে যেতো, ‘‘আমি
তোদের একে একে কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করব, তোদের মা-বাবা-পিসি-কাকা
ইত্যাদি বলে যাকেই পাঠাবো, জজসাহেব জিজ্ঞাসা করলে মেনে নিবি। সেই লোক তোদের
ছাড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি তখন তোদের ঠিকঠাক ব্যবস্থা করে দেবো।
এখানে কাউকে কিছু বলবি না।” এইভাবে একটার পর একটা মেয়ে উধাও হয়ে যেতো।
হাসিনা বলে আমাদের খুব প্রিয় একটি মেয়ে ছিলো। আমাকে মা বলে ডাকতো।
সুন্দরবনের এক চাষী পরিবারের আদরের মেয়ে ছিলো, অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বর বাড়ি
এলে কোলে উঠে পুতুল কিনে দেবার বায়না ধরতো। অবশেষে বর আর একটি বিয়ে করে।
হাসিনাকে গ্রামের মোড়লের লালসার গ্রাস থেকে বাঁচাবার জন্য, ওর বাবা কলকাতায়
কাজে পাঠায়। একবার বাড়িতে দেখা করতে যাবার সময় পথ হারায়। ট্রাফিক পুলিশের
কাছে শেয়ালদা স্টেশনের খোঁজ নিতে গিয়ে থানায় জমা হয়, সেখান থেকে
প্রেসিডেন্সি জেলে। একদিন এসে খুশিতে ঝলমল করা মুখে বললো, ‘‘জানিস মা, আমার
শ্বশুরঘরের গ্রামের এক মাসি এখানে এসেছিল। প্রথমে ইন্টারভিউ করবে, তারপর
মেসোকে পাঠিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।” দুদিন পর ইন্টারভিউ এলে হাসিনা খুশি মুখে
গেলো। কিন্তু ফিরে চিন্তিত মুখে বললো, ‘‘জানিস মা, মাসি, মেসোর সাথে আর
একটা লোক এসেছিলো। আমি মাসিকে আমার বরের কথা জিজ্ঞেস করতেই, রেগে গিয়ে
মাসিকে বললো—এ যে বিবাহিত তা তো বলোনি! মাসি তাকে বলল—বেরিয়ে সব কথা শুনলে
বুঝবে।” আমরা ব্যাপারটা বুঝলাম, হাসিনাও বুঝলো। আমরা বলে দিলাম, ‘‘জজের
কাছে তুললে, তুই চিনিস না বলে দিবি।” পরদিন হাসিনার কোর্ট পড়লো, ও কিন্তু
আর জেলে ফিরলো না। ওর সাথে যারা গিয়েছিলো, তাদের মুখে শুনলাম যে ওকে জজের
কাছে তোলেইনি, লকআপ থেকে ছেড়ে দিয়েছে। কি সাংঘাতিক চক্র যে এর পেছনে কাজ
করছে ভেবে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অথচ সত্যিকার বাবা-মা’রা যখন অতি কষ্টে
খোঁজ পেয়ে বাচ্চাদের ছাড়াতে আসেন, তাঁদের নাস্তানাবুদ হয়ে যেতে হয়। মাসের
পর মাস চক্কর কাটার পর ভাগ্যে থাকলে হারানো বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফেরেন।
----------------------------------------------------
পর্ব ৭
সারাটা দিন আমরা রোজকার প্রয়োজনীয় ঘরের কাজ ছাড়া বই, খবরের কাগজ পড়া,
সেলাই করা, ছবি আঁকা, লেখা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। যেখানে যখন সুযোগ পাওয়া
যেতো, সাধারণ বন্দিনীদের সাথে গল্প করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যে গল্প করতাম।
সবাই প্রায় সকলের জীবনের কথা, পরিবারের কথা জানতাম। সপ্তাহে সকলে একটা করে
পোস্টকার্ড পেতাম। সবাই সবাইয়ের বাড়িতে চিঠি লেখার পর, গোল হয়ে বসে সবকটা
চিঠি পড়া হতো। সকলের বাড়ি থেকে উত্তর এলেও সবাই শুনতাম। যাদের যেদিন
ইন্টারভিউ বা কোর্টের তারিখ থাকতো, তারা ফিরে এসে, যাবার পথে ছেলে সাথীদের
সাথে কি কথা হলো, বাড়ির লোকেদের সাথে কি কথা হলো, কি কি ঘটনা ঘটলো—সব গল্প
করত। বাকিরা বুভুক্ষুর মতো সেগুলো গিলতো। সেইসব দিনগুলো যেন উৎসবের মতো
ছিলো। নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হলেও সবাই মিলে তার মীমাংসা করা হতো, কেউ
কোনো ভুল করলে আত্মসমালোচনা না করা পর্যন্ত কোনো ছাড় দেওয়া হতো না। কিন্তু
মীমাংসার পর সাধারণত কেউ সেসব মনে পুষে রাখতো না। কেউ অসুস্থ হলে সবাই পালা
করে সারা দিনরাত তার দেখভাল করতো। এমনকি কোনো কারণে কারুর যদি মন খারাপ
হতো, বা কেউ চুপচাপ থাকতো, সবাই তাকে ঘিরে বসে মনের কথা টেনে বার করে,
নানাভাবে তাকে হাসানোর চেষ্টা চলতো। যতোক্ষণ না সে হাসতো, কেউ হাল ছাড়তো
না, প্রয়োজনে সারা রাতও জাগা হতো। কারুর বাড়িতে বোন, ভাই বা আর কারুর বিয়ে
ঠিক হলে সবাই মিলে হাতের কাজের নানারকম উপহার তৈরি করে দেওয়া হতো। সকলের
বাড়ি থেকে যা আসতো তা ছিলো এজমালি।
---
আমরা পরস্পরকে নানা আদরের নাম দিয়েছিলাম। নিজেদের নিয়ে মজাও করতাম।
একদিন খুকু বললো, ‘‘জানিস, আমি না এক জায়গায় গোটা গোটা সিদ্ধ ডিমের পায়েস
খেয়েছিলাম।” তারপর কিছু হলেই খুকুকে সিদ্ধ ডিমের পায়েস বলে খেপানো হতো।
একদিন শীতকালের বিকেলে বিজু, শিখা, মিতা, জয়া আর আমি ঠান্ডা কনকনে জল দিয়ে
বেশ করে গায়ে মাথায় সাবান মেখে স্নান করলাম। কে যেন তাই দেখে ফেলে ঘরে গিয়ে
সবাইকে নালিশ করলো। সবাই রেগেমেগে ঠিক করল আমাদের বয়কট করা হবে। আমরা
কিন্তু ব্যাপারটা আগে থেকেই আঁচ করেছিলাম। প্রথমে আমরা পাঁচ জন মিলে
বাকিদের নামের একটা করে বিশেষত্ব নিয়ে গান বাঁধলাম। জেলে বন্দীদের বছরে
দুটো করে পাড়ওয়ালা সাদা শাড়ি দেওয়া হত। একটা করে শাড়ি পরে আর একটা করে গলায়
জড়িয়ে চুল খুলে কীর্তনিয়া সেজে ঘরে ঢুকে গোল হয়ে বসলাম।
----
কারুর সাথে কোনো কথা না বলে লকআপ হয়ে গেলে থালা বাজিয়ে গান শুরু করলাম।
বিচারকেরা এ হেন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলেও মুখগুলো
হাসিতে ফাটো ফাটো। প্রথমেই বুলু হাত কামড়ে ফ্যাক করে হেসে ফেললো, ‘‘এই
দ্যাখ না পাঁচটা কেমন রোবট এসেছে, আর গান গাইছে।” বাকীদের পক্ষে কষ্ট করে
হাসি চেপে রাখা বড়ো মুশকিল। মীনাক্ষীর কটমট চাউনি দেখে তারা হাসতে গিয়ে
পারছে না। কিন্তু পেট ফুলে যাওয়া হাসি চাপা বড় দায়। এক মীনাক্ষী ছাড়া সবাই
গানের তোড়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। মীনাক্ষী আমাদের ছেড়ে বিচারকদের বকতে
শুরু করলো। শেষে রেগেমেগে এক জায়গায় গুম মেরে বসে, মোটে কথা বলবে না, খাবে
না। তখন আমরা পাঁচ দোষী মিলে অনেক সাধ্যসাধনা করার পর মেয়ে ঠাণ্ডা হলো।
----
আর এক রাতের কথা, নীহারকণা (রোগা ) বলে অতি পাজি এক ওয়ার্ডারের রাতের ডিউটি পড়ল
আমাদের ওয়ার্ডে। তাকে আমরা মাসি মাসি করে চেঁচিয়ে ডাকলাম। সে আমাদের
ওয়ার্ডে ডিউটি পড়লেই ভয়ে কাঁপতো। ভাটিঘরের কাছে দাঁড়িয়ে বললো, ‘‘কি হয়েছে?”
‘‘আরে এত দূরে কেন? কাছে এসো, ভয় পাচ্ছ, কেন? আজ আবার কি অপকীর্তি করেছো?
বলো শুনি?’’ ‘‘আরে রাম রাম! আমি কি করবো, গোবেচারি মানুষ।” ‘‘তাই বুঝি!আজ
কারো হাজতি বা মেয়াদি নম্বরের ইন্টারভিউয়ের জিনিসে ভাগ বসাওনি? মেট্রনের
কাছে চুকলি করে কাউকে মার খাওয়াওনি?” ‘‘না না, এই নাকে খত, কানে খত।” ‘‘ঠিক
আছে যাও, মাসিমার মাথা ব্যথা করছে, হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে এসো।’’ হঠাৎ
সাথী (লতিকা) বলে উঠলো, ‘‘যাচ্ছো তো, ওষুধের নামটা শুনলে? বলো গিয়ে ডি লা
গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস!” সাথীর বলার সাথে সাথে আমরা কয়েকজন চিৎকার করে
উঠলাম, ‘‘ইয়াক! ইয়াক!” নীহারকণা দৌড়। একটু পরে একটা ওষুধ নিয়ে এলো। সাথী
বললো, ‘‘এতা ভুল ওষুধ এনেছো! গিয়ে বলো ওষুধের নাম ডি লা গ্র্যান্ডি
মেফিস্টোফিলিস।” ‘‘ইয়াক! ইয়াক!” আমরা সমস্বরে চিৎকার করলাম। এইভাবে পাঁচবার
ওকে ঘোরানোর পর তবে ছাড়ান। হাসিনার মতো অজস্র সরল মেয়েগুলির কথা যে আমরা
ভুলতে পারতাম না।
----
বৌমা ছোট্ট বয়স থেকে আইপিটিএতে নাটক করতো। পরিণত বয়সে নাটক লেখা,
পরিচালনা, অভিনয় সব কিছুতেই সে দক্ষ হয়ে উঠেছিলো। ওর নেতৃত্বে আমাদের
নাটকচর্চা প্রবল বেগে এগিয়ে চললো। কখনো লকআপ হবার পর আমরা ক’জন নাটক করতাম।
বাকিরা দেখতো। বৃত্তাকারে চলতো ব্যাপারটা। পরবর্তীকালে কল্পনাও অনেক নাটক
লিখেছে। বাকিরা অল্পবিস্তর হাত পাকিয়েছে। আমরা নিজেরা স্টেজ বানাতাম, কম্বল
দিয়ে ট্রেনের বগি, চাসনালা খনি, স্পার্টাকাসের থাকার জায়গা ইত্যাদি
বানাতাম। নানারকম ড্রেসও বানাতাম। আর চিরসাথী জেলের থালা আমাদের নাটকে কতো
কাজ দিয়েছে! কিছুটা যাত্রার দলের মতো। গুলির শব্দ দরকার হলে একটা থালা দিয়ে
আর একটা থালায় ‘ধাম’ করে মারতাম। কখনো কখনো অবশ্য লোকটা আগে পড়ে যেতো, আর
গুলির শব্দটা হতো পরে। আনন্দের সীনে থালা বাজিয়ে গানও হতো। ঘরের মধ্যে লক
আপের পর দু-তিন জন মিলে হঠাৎ করে ছোট ছোট পথ নাটিকা আরম্ভ করে একে অপর
সকলকে চমকে দিতাম, পাল্টা চমকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতাম।
---
জিয়র্দানো ব্রুনো থেকে মার্ক্স, স্পার্টাকাস থেকে লেনিন, স্তালিন, মাও,
চে—সবাই যাঁরা পৃথিবীতে সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে জীবন দান করে গেছেন,
তিতুমীর, টিপু সুলতান, ভগত সিং—যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, শ্রমিক,
কৃষক আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—যাঁরা জীবনের চালিকা শক্তি, আমাদের নাটক,
গল্প গান সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁদের কথাই বলার চেষ্টা করতাম সহজ সরল
ভাষায়। মাঝে মাঝে আমরা মেয়াদি নম্বরের সামনের প্যাসেজে নাটক করতাম। হাজতি
নম্বর থেকেও অনেকে দেখতে আসতো। মহাদেবিয়া এসব নিয়ে ঝামেলা করতো না, এমনকি
হাসপাতাল থেকেও সবাই উঁকিঝুঁকি মারতো। মোটের উপর জেনানা ফাটকে আমাদের নাটক
খুব জনপ্রিয় ছিলো।
জেলের খাবার খেয়ে কেউই সুস্থ ছিলো না। সকলের অল্পবিস্তর পেটের সমস্যা
হতো। আমার হজমশক্তি খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। একদিন বাইরে থেকে এক নাম করা
ডাক্তারবাবু আমাকে দেখতে এলেন। আমার পাশে মীনাক্ষী বসে ছিলো। ওর কালো
কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিলো। তখন ও খুব রোগা ছিলো। বিরাট
লম্বা কাঠির মত হাত-পা। ডাক্তারবাবু কিছু না জিজ্ঞেস করেই প্যাঁক প্যাঁক
করে ওর পেট টিপতে শুরু করলেন। ভুল ভাঙানোর পর ডাক্তারবাবু আমাকে দেখে চলে
যেতেই আমাদের কি হাসি! আর একবার রাজশ্রীর পায়ে কাঁটা ফুটে পেকে গেলো। একজন
ছেলে বন্দী কম্পাউন্ডারের কাজ করতো। সেবার ও রাজশ্রীর বদলে মীনাক্ষীর পা
পরিষ্কার করতে শুরু করলো। এবার মীনাক্ষী সবার কাছে খুব বকা খেলো অপরিচ্ছন্ন
থাকার জন্য।
---
প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার জন্য অর্চনাদিকে সরকার ছেড়ে দেয়। মলয়ার
ব্রেস্টে টিউমার হবার ফলে পিজি-তে ভর্তি করা হয়েছিল। ম্যালিগন্যান্ট ছিলোনা
এই রক্ষে। রাজশ্রী, গৌরী আর আমাকেও পিজি-তে মাঝে মাঝে দেখাতে নিয়ে যাওয়া
হতো। তখন রোগ নিয়ে আমরা একেবারেই ভাবতাম না, বরং কিছুটা বন্ধনমুক্তির স্বাদ
প্রাণ ভরে উপভোগ করতাম। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু, ম্যাডাম, সিস্টাররা সকলে
আমাদের এতো স্নেহ করতেন, যে আমরা খুব কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।
তবে অচিরেই দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এলো—আমাদের প্রিয় মাসিমার ইউটেরাসে
ক্যান্সার ধরা পড়লো। কিছুদিন পর পর পিজি-তে রেখে চিকিৎসা হতো। কিন্তু তাঁর
মুক্তির জন্য কেউ কোনো প্রচার বা চেষ্টা করেনি। জেলের অস্বাস্থ্যকর
পরিবেশেই তিনি থাকতে বাধ্য হলেন। হয়তো তাঁর জন্য চেষ্টা করার মতো বিশেষ কেউ
ছিলো না, তাই তিনি কোনোদিনই প্রচারের আলোতে আসতে পারলেন না। এমনকি তাঁর
মৃত্যুও হয়েছে সকলের অজান্তে। সম্ভবত একটা শহীদ স্মরণ অব্দি তাঁর উদ্দেশ্যে
হয়নি। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় আমরাও খবরটা বহুদিন বাদে কানাঘুষোয়
শুনেছিলাম। এটা যে আমাদের জীবনের কত বড়ো লজ্জা, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে
না।
---
১৯৭২ সালে সিপিআই (এমএল)-এর জন্মদাতা শ্রদ্ধেয় চারু মজুমদার লালবাজারে
শহীদ হলেন। অনেক আলোচনা সমালোচনার পর পার্টি দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলো।
একভাগের নেতৃত্বে ছিলো শহীদ জহর। অন্যভাগের নেতৃত্বে ছিলো মহাদেব
মুখার্জ্জি। ১৯৭৫ সালে মহাদেব মুখার্জ্জি ধরা পড়ে পুলিশের কাছে নিজেকে
বিকিয়ে দেয়। সেইসময় পার্টি আবার খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়লো।
---
এসবের ফলে প্রথমে আমরা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ি। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই
নিজেদের হতাশা কাটিয়ে নানান দেশের বিভিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে জোরদার
পড়াশুনো শুরু করলাম। তাছাড়া নাটক, লেখা, গান, হাতের কাজ, মাসিদের সাথে গল্প
করা আরও দুরন্ত গতিতে চলতে থাকে। এই পর্যায়ে কল্পনা, রাজশ্রী আমাদের কাছে
ডিভিশন ওয়ার্ডে চলে আসে। এসময় আস্তে আস্তে অনেকে ছাড়াও পেয়ে যায়। যাই হোক,
প্রথমে কিছুটা মুষড়ে পড়লেও আমরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুটা যেন বদ্ধ
জলা থেকে বেরিয়ে আমাদের জীবন যেন আরো পরিণত আর সৃজনশীল হয়ে ওঠে।
---------------------------
পর্ব ৮
----
১৯৭৫ সালে এমার্জেন্সি জারি হল। বাইরে তদানীন্তন সরকারের অত্যাচারে
সর্বত্র জনগণ আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল-মিটিঙ শুরু হয়েছে,
রাজনৈতিক দলের কর্মীদের, বিভিন্ন কাগজের পত্রকারদের জেলে বন্দী করা হচ্ছে।
একদিন রাজনৈতিক দলের প্রায় শ’খানেক মহিলা কর্মী ও তাঁদের কয়েকজন নেত্রীরা
জেনানা ফাটকে এলেন। সম্ভবত দু’-তিন দিন ছিলেন। আমাদের সাথে তাঁদের—বিশেষ
করে সাধারণ কর্মীদের—অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয়ে আলোচনা হলো। তাঁরা জোর
গলায় ঘোষণা করে গেলেন, ‘‘তোমাদের আমরা ঠিক বার করে নিয়ে যাবো। রাজনৈতিক
বন্দীদের মুক্তির দাবি আমাদের কাছে সব চেয়ে বড় দাবি হবে।”
---
তখন লকআপ হয়ে গেছে। আমাদের ঘরে উঁচুতে দুটি ছোট্ট ছোট্ট গরাদ আর লোহার
জাল ঘেরা জানলা ছিলো। বাথরুমের পাঁচিলের উপর আমাদের ক’জনের দাঁড়াবার জায়গা
হলো, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে সেখান থেকে স্লোগান দিতে থাকলাম ‘‘জনতাই সকল
শক্তির উৎস, একদিন তাঁরাই নতুন শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলবেন ”। আর বাইরে থেকে
প্রায় শ’খানেক রাজনৈতিক কর্মীদের কণ্ঠে একটাই স্লোগান জেলের প্রাচীর ফাটিয়ে
সারা আকাশ মন্দ্রিত করে উঠলো, ‘‘সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, মুক্তি
চাই।”
---
এদিকে জেনানা ফাটকে কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দিনীর খালাসের অর্ডার এলো,
কয়েকজনকে অন্য জেলে বদলিও করা হলো। আমরা বাকিরা যথারীতি আমাদের গান, নাটক,
লেখাপড়া, হাতের কাজ এইসব চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ডিভিশন ওয়ার্ডে একটা শিউলিফুল আর একটা দুধেআলতা রঙের কি যেন ফুলের গাছ
ছিল। মাটিতে পড়ে যাওয়া শিউলি ফুলগুলো ঘরে এনে রাখতাম, সারাঘর গন্ধে ম ম
করত। দুধে আলতা রঙের ছোটছোট কয়েকটা ফুলও পাতাশুদ্ধ ডাল ছোট শিশিতে জল দিয়ে
সাজিয়ে রাখতাম। আমাদের মধ্যে বরাবর বাগান করার চল ছিলো। বুলু, খুকু, বৌমা,
মলয়া আর মাসিমা এব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী ছিলো। গাছের পরিচর্যা করতো আর
লুকিয়ে দোপাটি ফুলের বড়া, শিউলিপাতার শুক্ত—এইরকম নানা রান্না করে খাওয়াতো।
---
খুকু একটা লঙ্কা কাছ পুঁতেছিল, ছোট্ট গাছ প্রচুর লঙ্কা হত। লক আপ হলেই খুকু গরাদের কাছে বসে পাহারা দিত যাতে ওয়ার্ডার বা দালাল রা কেউ লঙ্কা না নেয়। গাছের ধারে কাছে কেউ গেলেই চেঁচাতো, "কি গো মাসি লংকা গাছের কাছে কি কর। " কুমড়ো গাছের বিচি মাটিতে পুঁতে দারুণ একটা গাছ হয়েছিলো। নানা ডাল, বাকল আর
দড়ি দিয়ে একটা মাচার মত তৈরি করে তার উপর লতিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ক’দিন পর
কুমড়ো ফুলের বড়া আর পাতার শাকও খেলাম। ছোটছোট কুমড়ো ধরল, আস্তে আস্তে
সেগুলো বিশাল বড় আকারের হতে থাকে। লোভী ওয়ার্ডার আর মেট্রনের নজরেও পড়ে।
অবশ্য ভয়ে ওদের হাত দেবার সাহস হয়নি। মজা হতো জেলার বা সুপাররা রাউন্ডে
এলে। এত বিশাল বস্তুগুলি কুমড়ো নাকি বোমা, নাকি ওর ভেতরে আমরা কিছু লুকিয়ে
রেখেছি, ভেবে শুকনো সন্দিগ্ধ মুখে তাকাতো। অবশেষে একদিন মহাদেবিয়ার সাথে
কথা বলে প্রায় গোটা তিরিশ বিশাল কুমড়োশুদ্ধ গাছটাকে তুলে দিলাম, একসাথে
রান্না করে সমস্ত জেনানা ওয়ার্ডগুলোতে প্রত্যেক বন্দীর মধ্যে বিলি করার
জন্য। লোভী মানুষগুলো অনেকটা আত্মসাৎ করে নিলেও ছিটেফোঁটা সাধারণ বন্দীদের
মিললো, এইটুকুই আমাদের সান্ত্বনা।
---
আমাদের মধ্যে বুলু খুব মিষ্টি, ভাবুক অথচ রসিক মেয়ে ছিলো। কোনদিন কারুর
সাথে ওর মনোমালিন্য হয়নি। একদিন জয়ার খুব শরীর খারাপ ছিলো, বুলু সারা রাত
জেগে ওকে হাওয়া করলো। সকালে জয়া হেসে হেসে আমাদের গল্প করছে, ‘‘জানিস কাল
সারা রাত আমি রবিকে স্বপ্ন দেখেছি।” ‘‘ও মেয়ে, সারা রাত আমি হাওয়া করলাম আর
তুই রবির স্বপ্ন দেখলি!” এরকম ঘটনা অহরহ ঘটতো। মাসিমার মাথাব্যথা হলে
তেলজল মিলিয়ে মালিশ করতাম। খুকুর গলার ইনফেকশন বুকে ধরে গেলো। দু’মাস লড়াই
করে সবাই মিলে তাকে সারিয়ে তুললাম। আর আমার গ্যাস্ট্রিক হওয়ার সময় সকলে
জীবনপাত করে সারিয়ে তুলেছিলো। একবার কানে ফোঁড়া হয়ে ক’দিন প্রচন্ড ব্যথা।
সাথী অতি সাবধানে ঠান্ডা জল দিয়ে মাথা ধুয়ে দিলো কতোক্ষণ ধরে! শিখা সারাদিন
বসে হাওয়া করলো। আমার থেকে অন্তত বছর চারেকের ছোট হওয়া সত্ত্বেও প্রথম
থেকেই আমাকে মেয়ে বানিয়ে নিলো, মায়ের মত মমতায় নজর রাখতো। খুকু সারা রাত
লন্ঠনের গায়ে কাপড় গরম করে সেঁক দিলো। ভোরের দিকে ফোঁড়া ফেটে গেলে মলয়া
ধীরে ধীরে কাঠির মাথায় তুলো লাগিয়ে কান পরিষ্কার করে দিলো। বাকিরা
হাসপাতালের সামনে গিয়ে চেঁচামেচি করে ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে এলো ওষুধ
দেবার জন্য। আমরা সবাই তখন সবাইয়ের জন্য প্রাণ দিতে পারতাম। হায়! কোথায়
হারিয়ে গেলো সে সব দিন।
---
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ খুব জোরে জোরে পাগলি বাজতে শুরু করলো। গুলিগোলার
আওয়াজ শোনা গেলো। আমরা বুঝতে পারলাম ছেলেদের ওয়ার্ডে নিশ্চয় খুব বড় গণ্ডগোল
হয়েছে। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কল্পনার কোর্ট ছিল, অনেক দেরিতে ফিরে
বললো, ‘‘জানিস, ভেতরের গেট, মেইন গেটের সব চাবি বন্দুকধারী জমাদারদের হাত
থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের প্রায় পঞ্চাশজন ছেলে জেল ভেঙে পালিয়েছে। স্বদেশ আর
কালু—এই দু’জন বাকিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার দায়িত্বে ছিলো। নিজেরা
জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছে। আর এক জমাদারও মারা গেছে।” বিকেল ছ’টা
নাগাদ বড় জমাদার বন্দুক কাঁধে নিয়ে, আরও জমাদার-জমাদারনিদের সাথে এসে
আমাদের লকআপ করে গেলো।
---
পরদিন থেকে সারা জেলে তল্লাশি শুরু হয়। দু’দিন পরে আমাদের ওয়ার্ডেও
তল্লাশি হবে জেনে আমরা আমাদের বইপত্র লুকিয়ে ফেললাম। স্পেশাল ব্রাঞ্চের
ছেলে-পুলিশরা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে সর্বত্র খুঁজতে লাগলো, সারা ঘর, প্যাসেজ,
স্নানঘর সার্চ করলো। ঘরের বাইরের বিশাল একটা গর্তকে টানেলের মুখ ভেবে তারা
খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলো। মাটি খোঁড়ার লোহার যন্ত্রপাতি এনে বিরাট আড়ম্বরে
খুঁড়তে শুরু করতে না করতেই গুটিকতক বড় বড় ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে এলো।
বীরপুঙ্গবেরা তাড়াতাড়ি পিছু হটে বাঁচলো। গৌরী খিক খিক করে হাসে আর বলে,
‘‘খা, খা, মাটি খা, ইঁদুরের কামড় খা।” আমরা হাসাহাসি করতে থাকলাম।
---
এদিকে মহিলা পুলিশরা আমাদের জামাকাপড়, কম্বল, বইপত্র তন্ন তন্ন করে
খুঁজছে। স্তালিনের একটা খণ্ড আমরা লুকোতে ভুলে গিয়েছিলাম। শেষে মলয়ার উল
সেলাইয়ের ব্যাগে সেটা ভরে দেওয়া হলো। একজন মহিলা পুলিশ খালি তাড়া দেয় আপনি
কম্বলটা থেকে উঠুন তো। রাজশ্রী আর আমি বলি, ‘‘উঠে পড়, ওই ধারটা ওনার খোঁজা
হয়ে গেছে তুই ওখানে বস।” আমরা দু’জন ওকে গার্ড করলাম, ও বইটা ব্যাগ থেকে
বার করে, তার উপর বসে সেলাই করতে লাগলো। আরেক মহিলা পুলিশ এসে ওর ব্যাগটা
সার্চ করে চলে গেলো। আমরা হেসে বললাম, ‘‘দে, এবার ভাল করে তা দে।”
---
রাজশ্রীর বাড়ি থেকে মস্ত একটা ছবির খাতা দিয়েছিলো, সেটাতে আমাদের সকলের
আঁকা ছবি ছিলো। এক মহিলা পুলিশ ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ বইটার মলাটে লাল রঙ
দিয়ে আঁকা যে ছবিটা ছিলো, রাজশ্রীর হাতের আঁকা সেই ছবি দেখেই ষাঁড়ের মত
খেপে গেলো। ওটা যে নির্দোষ একটা ছবির খাতা মাত্র, তা কিছুতেই বোঝানো গেলো
না। দম্ভভরে খাতাটা বগলদাবা করে ইঁদুরের তাড়ায় ভীত বীরের দল বেরিয়ে গেলো।
আমরা হেসে ফেললাম, ‘‘নাকের বদলে নরুণ পেলো।” মলয়ার স্তালিনের বই বাঁচাবার
গল্প শুনে সবার কি হাসি! আর স্তালিনের নাম উঠলেই মলয়ার মুখ খুশিতে লাল হয়ে
যেতো।
----
কোথায় কুমড়োর ভয়ে জেল কর্তৃপক্ষ পাগল হয়ে যাচ্ছিলো, আর কোথায় তাদের
নাকের তলা দিয়ে পঞ্চাশজন পালিয়ে গেলো। জেলে আবার কড়াকড়ি বাড়লো। তারপর
চূড়ান্ত অত্যাচার আর তল্লাশি চালিয়ে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে পালানো ছেলেদের
তো বটেই, প্রায় একবছর আগে শেয়ালদা কোর্ট থেকে পালানো বেশিরভাগ ছেলেদেরও ওরা
ধরে ফেলে, প্রচন্ড অত্যাচার করে তাতেও ক্ষান্ত হয় না, ধরা পড়া সবাইকে নিয়ে
আলিপুর স্পেশাল জেলে জমায়েত করে ডান্ডাবেড়ি পরায়, যাতে কেউ নড়তে চড়তে না
পারে। দু’-তিন দফায় প্রায় পঞ্চাশের উপর জমাদার, পাকানো লম্বা বাঁশের লাঠি
দিয়ে তাদের বেধড়ক মার মারতো। পুলিশ সারা পশ্চিম বাংলার জেলগুলি থেকে দাগী
বদমাস দালালদের আনিয়ে লাঠি, লোহার রড দিয়ে কদর্য ভাবে তাদের উপর নানারকম
অত্যাচার করাতো।
----
দিনের পর দিন এই অত্যাচার সহ্য করে আমাদের ছেলেরা ধীরে ধীরে দালাল
বাহিনী ও কিছু কিছু জমাদার বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে তাদের
বশীভূত করে। এদিকে বিভিন্ন জেলের প্রবল অত্যাচার নিয়ে বাইরে বন্দীমুক্তি
বাহিনী, নানা মানবিক সংগঠন, গানের দল তৈরি হয়। তারাও গণজাগরণের কাজে
ঝাঁপিয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকাতে লেখালেখি শুরু হয়। আমাদের সমর্থক বাহিনীরা
বিদেশের পত্রপত্রিকাতে লেখা বার করার ব্যবস্থা করে। ফলে সরকার একসময় বাধ্য
হয় অত্যাচার বন্ধ করতে।
----
এদিকে বাইরে তখন ভোটের দামামা বেজে গেছে। এমার্জেন্সি উঠে গেছে। ভোটে
এবার যে একটা ওলোটপালোট হবে, আমরা আঁচ করতে পারছিলাম জেল কর্তৃপক্ষ আর
পুলিশবাহিনীর নরম ব্যবহারে। কথায় আছে না, জাহাজ ডুবলে ইঁদুররা পালায় সবার
আগে? ১৯৭৭ সালে সারা ভারতবর্ষব্যাপী বিভিন্ন রাজনৌতিক দল শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একজোট হল ভোটে লড়তে।
----
পর্ব ৯
----
আমাদের ইন্টারভিউ আর কোর্টগুলোতে আমাদের বাবা, মা, ভাই, বোন বা অন্যান্য
আত্মীয়স্বজনরা আসতেন। রোজ দেখা হতে হতে তাঁরা সবাই যেন একই পরিবারের লোক
হয়ে গিয়েছিলেন, সকলেই পরস্পরের সমব্যথী। আমাদের কারুর কোন বিশেষ জিনিসের
প্রয়োজন থাকলে, আমরা তাঁদের যে কোনো কাউকে অক্লেশে বলতে পারতাম। যেমন আমার
কোনো বিশেষ কিছুর প্রয়োজন থাকলে, বৌমা তার ভাইকে বলতো। আমাদের মধ্যে যারা
বিবাহিত ছিলো, মীনাক্ষীর মা তাদের জন্য পুজোর সময় লাল চুড়ি কিনে আনতেন।
বিজুর কিছুর প্রয়োজন হলে আমার মাকে বলতাম। শিয়ালদা কোর্টের লোকজন আমার মাকে
বিজুর মা বলে জানতো। তাছাড়া সবাই নানা ধরণের খাবার,জামাকাপড়, বইপত্র
ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। কোর্টে তাঁরা যা খাবার নিয়ে আসতেন, আমাদের সাথীরা
সারাদিন প্রায় উপবাসে থেকে সব কিছু জেলে নিয়ে আসতো, সবাই মিলে খাবার জন্য।
সকাল দশটা নাগাদ জেল থেকে সামান্য কিছু খেয়ে তারা বার হতো, ওয়ার্ডে ফিরতে
ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে সাতটা-আটটা হয়ে যেতো।
---
জেল অফিস সেসময় নানা বন্দী-বন্দিনী, জমাদার-জমাদারনি, অন্যান্য কর্মচারী
ইত্যাদিতে ভরে থাকতো। স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা গোলমালও হতো। একজন ডেপুটি
জেলার গণ্ডগোল থামাতে বকে উঠতো, ‘‘আইকি, অটো সেসামিসি, সেসামিসি! অইটা কি
সারিয়াখানা?” (একি, এত চ্যাঁচামেচি, চ্যাঁচামেচি! এটা কি চিড়িয়াখানা?)
গোলমাল রূপান্তরিত হতো হাসিতে। তাড়াতাড়ি লোকটি সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতো।
---
আমাদের মারার পর থেকে জেলার বা সুপার রাউন্ডে এলে কোনো কথা জিজ্ঞেস করলে
আমরা কোনো উত্তর দিতাম না। সুপার হিংস্র গলায় বলতো, ‘‘কি, কথার উত্তর দেবেন
না, না?” বলে কটমটিয়ে মেট্রনের দিকে তাকাতো। সে বেচারা গদগদ গলায় নানা কথা
বলে তোয়াজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। জেলার চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতো।
বন্দিনীরা ওকে আড়ালে ‘রাবড়ি খচ্চর’ বলে ডাকতো। আমাদের ওয়ার্ডে কোথা থেকে
একটা ছোট্ট সাদা বেড়াল বাচ্চা এসে জুটেছিলো। সেটাও ওদের দেখলে আমাদের কোলে
এসে উঠতো।
---
ইদানিং তাদের সকলের গলা দিয়েই যেন মধু ঝরতে শুরু করলো—কি অসুবিধা, কি
প্রয়োজন ইত্যাদি। যথারীতি আমরা কোনো উত্তর দিতাম না। তখন চুপচাপ মাথা নীচু
করে চলে যেতো। এই সময় ইন্টারভিউতে কোনোরকম বই দিতে নিষেদ্ধাজ্ঞা ছিলো না,
এমনকি মাও সে তুঙ থেকে চারু মজুমদারের বই পর্যন্ত। প্রথম থেকেই আমাদের সব
ইন্টারভিউতে আইবি-এসবিরা উপস্থিত থাকতো, তারাই স্থির করে দিতো কি দেওয়া
যাবে আর কি দেওয়া যাবে না। এখন তারা অতি সজ্জন, সর্বদাতা।
-----
দেখতে দেখতে সারা ভারত জুড়ে ইলেকশনের বাদ্যি বেজে উঠল। তখন কেবল বুলু,
মাসিমা, কল্পনা, মলয়া, খুকু, শুভা, মিতা, মীনাক্ষী, সাথী, গৌরী, রাজশ্রী আর
আমি জেলে ছিলাম। বাকিরা বাইরে বন্দীমুক্তি আন্দোলনে ব্যস্ত। ১৯৭৭-এর মার্চ
এসে গেলো। কল্পনা ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে একটা ট্রান্সজিস্টর জোগাড় করে নিয়ে
এলো ইলেকশন বুলেটিন শোনার জন্য। সম্ভবত বিশে মার্চ রেজাল্ট ডিক্লেয়ার শুরু
হয়েছিল। কল্পনা সারা রাত জেগে খবর শুনতে থাকলো। আমরা আধা জাগরণ, আধা ঘুমে।
একটা করে মহীরূহের পতন হয়, কল্পনার ডাকে আমরা হৈ হৈ করে উঠি। সবচেয়ে বেশি
আনন্দে আমরা আত্মহারা হয়ে হুল্লোড় করি সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পরাজয়ে, যার
নেতৃত্বে বরানগর-কাশিপুরের শয়ে শয়ে লরি বোঝাই করে আমাদের সাথীদের শব গঙ্গায়
ফেলা হয়, যার হাত আমাদের হাজার হাজার সাথীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো।
তাছাড়া যে গান্ধী পরিবার সারা দেশেকে জেল বানিয়ে ছেড়েছিলো, বিরুদ্ধ মতামতকে
স্তব্ধ করে ভারতবাসীকে ক্রীতদাস বানাতে চেয়েছিল তাদের পরাজয় আমাদের মধ্যে
আনন্দের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল।
---
সারা রাত জেগে হৈ চৈ আর চা খাওয়া চললো। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট
মন্ত্রীসভা গঠিত হলো। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারের অন্যতম মূল ঘোষণা ছিল
রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেসবিরোধী সর্বদল
মোর্চার ইস্তেহারেও সেই ঘোষণা ছিলো। কেন্দ্রে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে
সেই কংগ্রেস বিরোধী জনতা দল ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় রাজনৈতিক বন্দীদের
মুক্তি।
---
জেনানা ফাটক থেকে প্রথমে শুভা, সাথী, গৌরী একে-একে মুক্তি পেলো। তারপর
মাসিমা আর বুলুর মুক্তির অর্ডার এলো। ছল ছল চোখে বিদায় নিয়ে ভাটিঘর পর্যন্ত
গিয়েও মাসিমার পা আটকে গেলো, কিছু যেন বাদ থেকে গিয়েছিলো। মীনাক্ষী আমাকে
মাসিমার কাছে ঠেলে দিয়ে বললো, ‘‘যাও মাসিমার আহ্লাদী, তোমাকে কিছু না বললে
তাঁর পা ওখানেই আটকে থাকবে।” আমি আর একটু কাছে গেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে,
মাসিমা বুলুর সাথে এগিয়ে গেলেন।
এরপর এলো আমার আর মলয়ার মুক্তির পরোয়ানা। তখন আমরা সবাই এক জায়গায়
বসেছিলাম। আমি আর মীনাক্ষী পাশাপাশি বসেছিলাম। এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে।
মীনাক্ষীর কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। সবাই ঘিরে ধরে আমাকে
শান্ত করার চেষ্টা করছে। আর মলয়া বলে যাচ্ছে, ‘‘ও রীতা কাঁদিস না, কাঁদিস
না। আমাকেও ছেড়ে দেবে শিগগিরই।” সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে বললো,
‘‘তাকাচ্ছিস কেন! দেখছিস না আমার ছাড়ার অর্ডার না আসার জন্য ও কাঁদছে।”
খুকু বলে উঠলো, ‘‘কি যে বলিস? তোর আর ওর অর্ডার তো একসাথেই এসেছে।” সব
কান্না ঘরভরা হাসি হয়ে উঠলো। কল্পনা বললো, ‘‘বাইরে গিয়ে এক অন্য জগতে পড়বি,
শুধু মনে রাখিস অ্যাডজাস্টমেন্ট শব্দটা।” সবার কাছ থেকে হাসিকান্নায় বিদায়
নিয়ে অফিসে এলাম। আমি মলয়াকে বললাম, ‘‘আমি তো এদিকটা চিনতে পারবো না।” ওর
বাড়ি ছিল চেতলায়। অভয় দিয়ে বললো, ‘‘আরে আমার বাড়ি তো কাছেই, ভাইকে দিয়ে
তোকে পৌঁছে দেবো।”
----
অফিস থেকে বেরিয়ে জেলের কাঁটার তার দিয়ে ঘেরা শেষ চত্বরের গেটে দেখি সজল
নয়নে দাঁড়িয়ে আছে মা—আমার মা। শেষ হল আমার জেলজীবনের সাড়ে চার বছর।
এরপর প্রথমে মীনাক্ষী আর রাজশ্রী, তারপর কল্পনা, শেষে খুকু, মিতা সবাই ছাড়া পেলো ১৯৭৭ সালেই।
পরিশিষ্ট
---
জেল থেকে বার হবার পর আমরা যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। পার্টি তখন খণ্ডবিখণ্ড।
অনেক প্রশ্ন আর সংশয়। একটা সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখতে পাচ্ছি না। বেশ
কিছুদিন হাবুডুবু খেলাম। কিন্ত মূর্তিমান বাস্তব, নিজেদের রুজিরোজগারের
সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ালো। যারা স্কুল, কলেজের পাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম,
তারা তারই কিছুটা শেষ করলাম। যারা চাকরি ছেড়ে এসেছিলো তারা আবার চাকরিতে
যোগ দিলো। কেউ কেউ নতুন করে চাকরি খুঁজে নিলো। অজস্র মানুষ প্রবল দারিদ্রে
দিন গুজরান করতে থাকলো। বেশিরভাগ লোক শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো
হয়ে পড়লো। তবুও তারা নানা ধরনের সমাজকল্যাণকর কাজে যোগ দিলো। একদল মানুষ
অবশ্যই এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার সুবাদ ভাঙিয়ে খেলো। সেটা একেবারে নগণ্য
ঘটনা।
---
জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পরিশিষ্ট
******************************
জেল থেকে বার হবার পর আমরা যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। পার্টি তখন খন্ড বিখন্ড। অনেক প্রশ্ন আর সংশয়। একটা সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখতে পারছিনা। বেশ কিছুদিন হাবু ডুবু খেলাম। কিন্ত মূর্তিমান বাস্তব, নিজেদের রুজি রোজগারের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াল। যারা স্কুল,কলেজের পাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম তারা তার কিছুটা শেষ করলাম। যারা চাকরি ছেড়ে এসেছিল তারা চাকরিতে যোগ দিল। কেউ কেউ নতুন করে চাকরি খুঁজে নিল। অজস্র মানুষ প্রবল দারিদ্রে দিন গুজরান করতে থাকলো। বেশীর ভাগ লোক শারীরিক ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ বা অকেজ হয়ে পড়ল। তবুও তারা নিজেদের পেশার সাথে নানা ধরনের সমাজ কল্যাণ কর কাজে যোগ দিল। একদল অবশ্যই এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার সুবাদের নাম ভাঙিয়ে খেল। সেটা একেবারে নগন্য ঘটনা।
--
তা সত্ত্বেও পথ খোঁজা চলতে থাকল। নকশালবাড়ির আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শ্রমিক / কৃষক এবং মেহনতী মানুষকে কমিউনিস্ট পার্টীর নেতৃত্বে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নয় প্রধানত সশস্ত্র পথে ক্ষমতাদখলের লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল। পার্টি সমস্ত যুবশক্তিকে শ্রমিক / কৃষকের সাথে একাত্ব হবার আহবান জানায়। এই সংগ্রামের সবচেয়ে সদর্থক দিক হল সমাজ বিবর্তনের আন্দোলনে এক নতুন ইতিহাস যুক্ত হল। আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক সশস্ত্র লড়াই হলেও সেগুলির মূল দিশা ছিল অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়। এখানেই পূর্বতন লড়াইগুলির সাথে নকশাল বাড়ীর আন্দোলনের মূলগত পার্থক্য। এই কথাটাই অনেকের মনে থাকেনা।
যাইহোক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পূর্বতন শদীদ সিঁধু ,কানু চাঁদ ভৈরব, তিতুমীর, নুরুলদের সাথে ভূমাইয়া, কিসটা, ধ্যানেশ্বরী, সীমাস্বরী, নয়েয়েশ্বরী, সুরুবালা,সোনামতি, ফুলমতি, সামসারি, গৌড়রাও, খাড়শিং ইত্যাদি অসংখ্য শহীদ কিষাণ ও কিষানীর নাম যুক্ত হল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য বীর যোদ্ধা সূর্য সেন, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা দের সাথে নির্মলা কৃষ্ণমূর্তি,দ্রোণাচার্য, আশু মজুমদার বিপ্লব ব্যানার্জী ইত্যাদি, তেভাগা তেলেঙ্গানার, খাদ্য আন্দোলন এর মত আন্দোলন গুলিকে কে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করল। জীবনে সর্ব ক্ষেত্রে উত্থান /পতন থাকে , ঠিক / ভুল হয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আত্ম সমীক্ষার মাধ্যমে ভুল শুধরে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতাই বিজ্ঞান। অনেক আত্মত্যাগ আর লড়াই এর মধ্যে দিয়েই বিপ্লব সফল হয়।তাই মে দিবস আজও পালিত হয়।
--
আমরা বেশীর ভাগ এখন ও মনে করি আমাদের সবচেয়ে নিষ্পাপ, সরল আর সুন্দর সময় টা ব্যক্তিগত ক্যারিয়র তৈরী করার পেছনে না দৌড়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য একটা মহান , সুন্দর কাজে ব্যয় করেছিলাম। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়ে এক নতুন সমাজ গড়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমাদের পরম ভাগ্য। জ্ঞানের মহা সমুদ্রের এক বিন্দু জল সেখানেই পান করেছিলাম। সেটাই আমাদের পরম সম্পদ।
--
আমরা অনেকেই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ধীরে ধীরে গতানুগতিক জীবনে ফিরে এসেছি। কেউ কেউ নাটক, গণতান্ত্রিক অধিকার, নারীমুক্তি, পথশিশু, শিশু শ্রমিকদের পড়াশোনা ইত্যাদি নানা কিছু মানবিক আর সামাজিক কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা করছি। কিছুটা হয়তো নিজেরা যাতে জড় পদার্থে পরিণত না হয়ে যাবার তাগিদে।
--
আর এক দল মানুষ হাজার সংশয় আর প্রশ্ন থাকা নিয়েও সক্রিয় ভাবে সহস্র বাঁধা সত্বেও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে, কারণ তারা জানে প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন সমস্যার সমাধান করা যাবেনা। আমি নতজানু হয়ে সেই সৈনিকদের কুর্নিশ জানাই, বিশ্বাস করি এক দিন না একদিন সেই শোষণহীন নতুন সমাজের লাল আলোয় পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
*************************************************************************************
বিঃ দ্রঃ -
এখানে বলা প্রয়োজন, বিশেষ কারণে মিনু, সীমা , শীলা ও কমলা নাম চার টি পরিবর্তন করতে হয়েছে।
তাছাড়া প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। কিছু স্মৃতি বিভ্রম ঘটে থাকতে পারে। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনীয়। সেই সময়ের অনেক অভিজ্ঞতা ও জেলের অনেক বন্দিনীর জীবনী আগেই লিখেছি। সাধারণ মানুষের কথা লেখাই আমার ইচ্ছা ছিল। জেলে সাধারন বন্দিনীদের অবস্থা, তাঁদের উপর অত্যাচার এবং জেলকর্ত্রীপক্ষ ও দালাল দের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের কথা ইংরেজিতে 'dishari' গল্পে যতটা মনে ছিল লিখেছিলাম। এর বাংলা করার ইচ্ছা ছিল। চোখের সমস্যার জন্য তা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার কন্যা সম কিছু বন্ধুদের অনুরোধে লিখলাম। আপনারা যাঁরা ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। জেলখানকে শোধনাগার নাম দিলেও, বদলায়নি কিছুই , "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। "