আমাদের বউমা
***********
"আমরা এগিয়ে চলি জীবনেরই প্রান্তে, আঁধারের বোঁটা থেকে আলো ছিঁড়ে আনতে। "
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
গতকাল ২৪ শে জানুয়ারি চলে গেল আমাদের জেল জীবনের আর এক সাথী, অতি ভালোবাসার বউমা। শান্তিপুর নিবাসী জয়শ্রী ভট্টাচার্য্য (ডাক নাম রুবি) কে আমরা সবাই বউমা বলে ডাকতাম। ডাক টা শুরু করেছিল জয়া (কৃষ্ণা ব্যানার্জ্জী)। বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিল, অবশেষে সেরিব্রাল স্ট্রোকে ১৩ দিন হাসপাতালে লড়াই করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
--
অসাধারণ সব গুনের অধিকারী ছিল বউমা। ছোটবেলা থেকেই আই.পি.টি.আই. এর সাংস্কৃতিক কাজের - গান, নাটক ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিল। বি.এ পাশের পর একটি সরকারি স্কুলে চাকরী পায়। মা, দুই বোন, এক ভাই কে নিয়ে সংসারের দায়িত্ব বহন করে। ভাই উপযুক্ত হয়ে চাকরি পাওয়া পর্য্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেছে।
--
আজীবন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজে নিমগ্ন শহীদ কমরেড শ্রী অজয় ভট্টাচার্য্য কে বিয়ে করেছিল। স্কুলে কাজ করার সাথে সাথে এই সমস্ত কাজে বউমাও খুবই সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিল। অজয়দাদের চার জন কে পুলিশ যখন গুলি করে মারে, সে তখন পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী হিসাবে অনেক দূরে কাজ করছিল। খবরের কাগজের মাধ্যমে প্রথম খবরটা জানতে পারে। এই দুঃসহ আঘাত তাকে ভাঙতে পারেনি বরং বিপ্লবের কাজে আরও দৃঢ় করে তোলে।
--
সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জয়শ্রী ভট্টাচার্যের চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। জেলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর লেখা অজস্র প্রবন্ধ,গল্প ও নাটকগুলিতে মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রাম ছিল মূল বিষয়। তাঁর লেখা অনেক নাটক তাঁরই পরিচালনায় জেলে আমরা কখনও সাধারণ বন্দিনীদের সামনে কখনও বা নিজেদের মধ্যে অভিনয় করতাম।
--
একবার বউমা একটা নাটকে শ্রী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা রাজা ও টুনটুনি পাখীর গল্পটার আধারে শ্রমিক কৃষক বিদ্রোহের একটা নাটক লিখেছিল, সেখানে এক বোষ্টমের গলায় গানের মধ্যে দিয়ে রাজার দুরাচারের কথা বলা হয়েছিল। পরে 'হীরকরাজার দেশে' সিনেমা টা দেখে বউমার সৃজনশীলতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।
--
খুব সুন্দর গানের গলা ছিল। নাটকের জন্য গান লেখা, তাতে সুর দেওয়া সবই ছিল তাঁর অনায়াসলভ্য। আমাদের আই.পি.টি.আই এর কত গান শিখিয়েছিল। অসুখে সেবা করা, নিজের হাতে রান্না আদর করে খাওয়ান সব কিছুতে একান্ত আপনজনের মত ছিল আমাদের বউমা।
--
জয়শ্রী জেলে আসে ৭৪ সাল নাগাদ। বেশীর ভাগ সময় প্রেসিডেন্সী জেলে, এবং কিছুদিন কৃষ্ণনগর জেলে ছিল। আমরা একমাত্র মাসিমা (শান্তি রানী দেব), আর অর্চনাদি ছাড়া সবাই কে সবাই তুই তোকারি করতাম, সে ১০/১৫ বছর বড় হলেও, জেলে এটাই স্বাভাবিক চল ছিল। এইজন্যে মাঝে মধ্যে বউমা, (কল্পনা, মলায়া, লতিকা ইত্যাদিরা) রাগের ভান করত, আমরা পাত্তা দিতাম না। কিন্তু কোন বিশেষ কারণে বউমা সাত্যি যখন কাউকে বকতো, তখন সে গাম্ভীর্য্য কে উপেক্ষা করার সাহস কারো হতো না।
--
জেল থেকে বার হবার পর স্কুলের চাকরী টা ফিরে পাওয়া পর্যন্ত বউমাকে বেশ কিছুদিন প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়, কিন্তু তারজন্য কোন ব্যক্তি বা দলের দ্বারস্থ হয়নি। দিনের পর দিন ঠোঙা বেঁধে দিন গুজরান করেছে। চাকরী ফিরে পাবার পরও অতি সাধারণ জীবন যাপন করেত। গানের গ্রূপ তৈরী করেছে, নাটকের দল গড়েছে। মানুষ কে সচেতন করে তোলার জন্য দূরে দূরে গ্রামে গঞ্জে সেই সব দল নিয়ে প্রোগ্রাম করেছে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদে সভা সমিতিতে যোগ দিয়েছে, অনেক পত্রপত্রিকায় লিখেছে।
--
পরবর্তী কালে এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেরই এক সঙ্গী, একজন তাঁতশিল্পীকে বিয়ে করেছিল। অসুস্থ থাকা কালীন তিনি বউমাকে অনলস সেবা করে গেছেন। জয়শ্রী ভট্টাচার্য্য কোনদিন পয়সা রোজগার বা নাম কামাবার জন্য লেখেনি, বা কখন কোন বিশেষ সুবিধা নেবার চেষ্টা করেনি, এমন কি স্কুল থেকে অবসর নেবার পরেও নয়। যতদিন সুস্থ থেকেছে নীরবে কাজ করে গেছে। অসুস্থ হবার পর আস্তে আস্তে ঘরে আটকে পড়ে, তবু সাধারণ মানুষ আর বর্তমান সমাজের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা সে কখনও বন্ধ করেনি।
--
সময়ের আগেই বড় তাড়াতাড়ি একে একে চলে যাচ্ছে ১৯৭০ এর আমাদের ঝোড়ো হওয়ার দিনের সেই সাথীরা। প্রথমে মাসিমা চলে গেলেন আমাদের সবার অগোচরে। তারপর গেল মীনাক্ষী, ওর পাশে তবু আমরা উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। তারপর গেল মলয়া, তার কাছে যাবো ভেবেও যেতে পারিনি। বৌমাকে আমরা দেখতে যাবো যাবো করেও, গিয়ে উঠতে পারিনি, শেষ দেখাটা হল না। আরও কত জনের তো কোন খৱৰ ই জানিনা। এগুলি আমাদেরই অনেক ব্যর্থতার মধ্যে আর একটি ব্যর্থতা। এবার আমাদের বুক খালি করে দিয়ে চলে গেল আমাদের সকলের একান্ত আদরের বউমা। শুধু আশা করব এদের সকলের কাজগুলি যেন বেঁচে থাকে আগামী দিনের পাথেয় হিসাবে। ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
***********
"আমরা এগিয়ে চলি জীবনেরই প্রান্তে, আঁধারের বোঁটা থেকে আলো ছিঁড়ে আনতে। "
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
গতকাল ২৪ শে জানুয়ারি চলে গেল আমাদের জেল জীবনের আর এক সাথী, অতি ভালোবাসার বউমা। শান্তিপুর নিবাসী জয়শ্রী ভট্টাচার্য্য (ডাক নাম রুবি) কে আমরা সবাই বউমা বলে ডাকতাম। ডাক টা শুরু করেছিল জয়া (কৃষ্ণা ব্যানার্জ্জী)। বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিল, অবশেষে সেরিব্রাল স্ট্রোকে ১৩ দিন হাসপাতালে লড়াই করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
--
অসাধারণ সব গুনের অধিকারী ছিল বউমা। ছোটবেলা থেকেই আই.পি.টি.আই. এর সাংস্কৃতিক কাজের - গান, নাটক ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিল। বি.এ পাশের পর একটি সরকারি স্কুলে চাকরী পায়। মা, দুই বোন, এক ভাই কে নিয়ে সংসারের দায়িত্ব বহন করে। ভাই উপযুক্ত হয়ে চাকরি পাওয়া পর্য্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেছে।
--
আজীবন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাজে নিমগ্ন শহীদ কমরেড শ্রী অজয় ভট্টাচার্য্য কে বিয়ে করেছিল। স্কুলে কাজ করার সাথে সাথে এই সমস্ত কাজে বউমাও খুবই সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিল। অজয়দাদের চার জন কে পুলিশ যখন গুলি করে মারে, সে তখন পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী হিসাবে অনেক দূরে কাজ করছিল। খবরের কাগজের মাধ্যমে প্রথম খবরটা জানতে পারে। এই দুঃসহ আঘাত তাকে ভাঙতে পারেনি বরং বিপ্লবের কাজে আরও দৃঢ় করে তোলে।
--
সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জয়শ্রী ভট্টাচার্যের চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। জেলের ভেতরে ও বাইরে তাঁর লেখা অজস্র প্রবন্ধ,গল্প ও নাটকগুলিতে মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রাম ছিল মূল বিষয়। তাঁর লেখা অনেক নাটক তাঁরই পরিচালনায় জেলে আমরা কখনও সাধারণ বন্দিনীদের সামনে কখনও বা নিজেদের মধ্যে অভিনয় করতাম।
--
একবার বউমা একটা নাটকে শ্রী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা রাজা ও টুনটুনি পাখীর গল্পটার আধারে শ্রমিক কৃষক বিদ্রোহের একটা নাটক লিখেছিল, সেখানে এক বোষ্টমের গলায় গানের মধ্যে দিয়ে রাজার দুরাচারের কথা বলা হয়েছিল। পরে 'হীরকরাজার দেশে' সিনেমা টা দেখে বউমার সৃজনশীলতা সম্পর্কে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়।
--
খুব সুন্দর গানের গলা ছিল। নাটকের জন্য গান লেখা, তাতে সুর দেওয়া সবই ছিল তাঁর অনায়াসলভ্য। আমাদের আই.পি.টি.আই এর কত গান শিখিয়েছিল। অসুখে সেবা করা, নিজের হাতে রান্না আদর করে খাওয়ান সব কিছুতে একান্ত আপনজনের মত ছিল আমাদের বউমা।
--
জয়শ্রী জেলে আসে ৭৪ সাল নাগাদ। বেশীর ভাগ সময় প্রেসিডেন্সী জেলে, এবং কিছুদিন কৃষ্ণনগর জেলে ছিল। আমরা একমাত্র মাসিমা (শান্তি রানী দেব), আর অর্চনাদি ছাড়া সবাই কে সবাই তুই তোকারি করতাম, সে ১০/১৫ বছর বড় হলেও, জেলে এটাই স্বাভাবিক চল ছিল। এইজন্যে মাঝে মধ্যে বউমা, (কল্পনা, মলায়া, লতিকা ইত্যাদিরা) রাগের ভান করত, আমরা পাত্তা দিতাম না। কিন্তু কোন বিশেষ কারণে বউমা সাত্যি যখন কাউকে বকতো, তখন সে গাম্ভীর্য্য কে উপেক্ষা করার সাহস কারো হতো না।
--
জেল থেকে বার হবার পর স্কুলের চাকরী টা ফিরে পাওয়া পর্যন্ত বউমাকে বেশ কিছুদিন প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়, কিন্তু তারজন্য কোন ব্যক্তি বা দলের দ্বারস্থ হয়নি। দিনের পর দিন ঠোঙা বেঁধে দিন গুজরান করেছে। চাকরী ফিরে পাবার পরও অতি সাধারণ জীবন যাপন করেত। গানের গ্রূপ তৈরী করেছে, নাটকের দল গড়েছে। মানুষ কে সচেতন করে তোলার জন্য দূরে দূরে গ্রামে গঞ্জে সেই সব দল নিয়ে প্রোগ্রাম করেছে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদে সভা সমিতিতে যোগ দিয়েছে, অনেক পত্রপত্রিকায় লিখেছে।
--
পরবর্তী কালে এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেরই এক সঙ্গী, একজন তাঁতশিল্পীকে বিয়ে করেছিল। অসুস্থ থাকা কালীন তিনি বউমাকে অনলস সেবা করে গেছেন। জয়শ্রী ভট্টাচার্য্য কোনদিন পয়সা রোজগার বা নাম কামাবার জন্য লেখেনি, বা কখন কোন বিশেষ সুবিধা নেবার চেষ্টা করেনি, এমন কি স্কুল থেকে অবসর নেবার পরেও নয়। যতদিন সুস্থ থেকেছে নীরবে কাজ করে গেছে। অসুস্থ হবার পর আস্তে আস্তে ঘরে আটকে পড়ে, তবু সাধারণ মানুষ আর বর্তমান সমাজের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা সে কখনও বন্ধ করেনি।
--
সময়ের আগেই বড় তাড়াতাড়ি একে একে চলে যাচ্ছে ১৯৭০ এর আমাদের ঝোড়ো হওয়ার দিনের সেই সাথীরা। প্রথমে মাসিমা চলে গেলেন আমাদের সবার অগোচরে। তারপর গেল মীনাক্ষী, ওর পাশে তবু আমরা উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। তারপর গেল মলয়া, তার কাছে যাবো ভেবেও যেতে পারিনি। বৌমাকে আমরা দেখতে যাবো যাবো করেও, গিয়ে উঠতে পারিনি, শেষ দেখাটা হল না। আরও কত জনের তো কোন খৱৰ ই জানিনা। এগুলি আমাদেরই অনেক ব্যর্থতার মধ্যে আর একটি ব্যর্থতা। এবার আমাদের বুক খালি করে দিয়ে চলে গেল আমাদের সকলের একান্ত আদরের বউমা। শুধু আশা করব এদের সকলের কাজগুলি যেন বেঁচে থাকে আগামী দিনের পাথেয় হিসাবে। ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment