পড়শী
*****
দেশ বিভাগের সমসাময়িক সময়ের কথা। তখন পর্যন্ত্য ভারত ও পাকিস্থান দুই মানুষের মনেই একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। কিছু সুবিধাভোগী আর সমাজবিরোধীরা তাতে হাওয়া দিয়ে চলছে কিছু বাড়তি সুযোগ আদায়ের ইচ্ছায়। সেই সময়ে কলকাতার এন্টালি এলাকার একটি পাড়ায় খিস্টান, হিন্দু, মুসলমান বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সহবস্থান ছিল।
--
সেখানে একই বাড়ির দুটি অংশে থাকতো একটি হিন্দু আর একটি মুসলমান পরিবার। তাঁদের মধ্যে সদ্ভাবের অভাব ছিল না। বরং বলা যায় অতি ঘনিষ্ট আত্মীয়ের মত। দুটি পরিবারেরই জড় ছিল তদানিন্তন পূর্ব বাংলার টাঙ্গাইলের পাশাপাশি দুটি বাড়িতে । দুটি পরিবারের আধখানা সেখানেই রয়ে গেছিলো, আর আধখানা বৃত্তির তাগিদে কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিল। একের উত্সবে অপরের উপস্তিতি আর উপহার দেওয়া শুধু স্বাভাবিক নয় আবশ্যিক ছিল। বিপদ আপদেও তাই। রায়টের সময় ও দুই পরিবার পরস্পরকে আগলে ধরে পরম মিত্রতার মধ্যে দিয়ে কঠিন সময় পার করে চলেছে।
--
দুটি পরিবারেই বছর দেড় / দুই য়ের দুটি শিশু ছিল, যারা দুই পরিবারের চোখের মনি। শিশুদুটিকে কেন্দ্র করে ঘনিষ্টতা আরও যেন গভীর হয়ে ওঠে। তারা কখন এবাড়ি কখন বা ওবাড়ি থাকতো, খেলা করা, স্নান করা, এমনকি খাওয়া, ঘুমানো চলতো। একটি বাড়িতে ব্যস্ততার সময়ে অন্য বাড়ির রক্ষণাবেক্ষনে থাকতো তারা। মোটের উপর আপদে বিপদে পরস্পরের সহযোগিতায় দিন কাটছিলো। তাঁদের পাশের বাড়িতে এক বৃদ্ধ খ্রিষ্টান দম্পতি ছিলেন। তাঁদের ও এই পরিবার দুটির সাথে যথেষ্ট যাতায়াত ছিল। পাড়ায় এদের পাস্পরিক ভালবাসার কথা পাড়ার সবাই জানতেন। অতি দুর্যোগের মধ্যেও মোটামুটি শান্তিতে ছিলেন এখানকার মানুষ জন।
--
আচমকাই বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো একদিন। শিশুদুটি কোন একটি বাড়িতে সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ তাদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলনা। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে অথচ কোন চেঁচামিচি নেই।
দুই পরিবারই ধরে নিয়েছে অন্যদের কাছে আছে। তবু একটা সময়ের পর দুই মায়ের মনে হয় এবার অপর কে বিশ্রাম দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল তাদের গতিবিধি সম্পর্কে কেউই অবহিত নন। দুই পরিবারের বাকি লোকজন ও এসে জড়ো হলো যে ঘরে বাচ্চা দুটি ঘরে ঘুমাচ্ছিল সেখানে। দেখা গেল মাটিতে বিছানাযে তারা শুয়ে ছিল সেগুলি ভেজা অবস্থায়ে পরে আছে। কিন্তু বাচ্চা দুটি নেই। দুই বাড়ির আনাচে কানাচে খোঁজ শুরু হল। কোথাও পাওয়া যায়না তখন বাড়ির কর্তাদের অফিসে খবর গেল। হন্তদন্ত হয়ে তাঁরাও হাজির।
--
অবশেষে কার দায়িত্বে তারা ঘুমিয়েছিল তার হিসেব নিকেশ শুরু হল। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাকে প্রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করনোর অবস্থায় এসে পড়ে। ফলে তিনি ও বেগতিক দেখে নিজের দোষ কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে একে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্ঠা শুরু হল। তার থেকে এক পরিবার অন্য পরিবারের ঘাড়ে দোষ দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে পাড়ার লোকজন জড়ো হয়েছে। ধান্দাবাজ অত্যুতশাহিরা ধর্মের জিগীর তুলে দুই পক্ষকে উত্তেজিত করার চেষ্টায় রত। এত দিনের ভালবাসা, বিশ্বাস সব যেন গুঁড়িয়ে যাবার যোগাড়। শেষে অহিংস তর্কাতর্কি প্রায় সহিংস সংঘর্ষের রূপ নিতে চলে। দুই পরিবারের কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি।
--
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে দেখে এক পরিবারের ঠাকুমা নিজের ঘরে সন্ধ্যা আরতি দিতে ঢোকেন। খাটের তোলা থেকে পিলসুজ বার করতে গিয়ে তিনি চমকে ওঠেন। এক দৌড়ে ঘর থেকে বার উঠোনে যেখানে সব মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে গিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকেন, "এই তোরা সব তাড়াতাড়ি আমার ঘরে আয়, দেখে যা কি কান্ড হয়েছে।" সবাই দৌড়ে যায়।
--
বৃদ্ধা বলেন,"দ্যাখ সবাই খাটের তলায়!" সকলে পস্পরকে ঠ্যালাঠ্যেলি করে ঝুঁকে পড়েন খাটের তলে। অবাক হয়ে দেখেন শিশু দুটি পাশাপাশি বসে আছে। সামনে তাদের দুটি বড় গামলা একটাতে চাল ভর্তি, আর অন্যটায় ডাল। দুজন মিলে তাদের ছোট্ট মুঠি ভরে চাল তুলে ডালের আর ডাল তুলে চালের গামলায় মেশাচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিজেদের মুখে দেবার চেষ্টাও চলছে। ঘুম ভেঙে গেলে সম্ভবত হামগুড়ি দিয়ে পাশের ঘরের খাটের তলায় মজার খেলায় মেতেছে। বড়দের মধ্যেকার অশান্তির আবহাওয়া তাদের দুজনের খেলায় কোন বিঘ্ন ঘটায়নি।
--
সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মায়েরা চট জলদি বসে পড়ে শিশু দুটিকে টেনে বার করেন। বুকের মানিকদের নিজেদের কলে তুলে জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কাঁদতে কাঁদতে আদর করতে থাকেন। দুই পরিবারের বাকিরা কিছক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। লজ্জায় একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। হটাত দুই বাড়ির লোকজনের সম্বিত ফেরে। চোখের জলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। ধান্দাবাজের দল গুটি গুটি সরে পরে। শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা দুই পরিবারের মিলনে নিজেদের মিলিয়ে দেন।
--
শেষ চমক দিলেন পাশের বাড়ির খ্রিষ্টান পরিবারের বৃদ্ধ কর্তা, "এই যে মায়েরা নিজেদের বাচ্ছাদের ফিরে পেয়েছ তো। একবার তাকিয়ে দ্যাখতো নিজের বাচ্চাকেই কোলে নিয়েছ তো!" সবাই অবাক হয়ে যায় তাঁর কথায়। দুই মা ভাল করে তাকিয়ে দেখেন, একে অন্যের বাচ্চাকে বুকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। গুমঠ গরম কেটে স্নিগ্ধ হাওয়া খেলতে থাকে সারা উঠোন জুড়ে।
_________________________________________________________________________________________
*****
দেশ বিভাগের সমসাময়িক সময়ের কথা। তখন পর্যন্ত্য ভারত ও পাকিস্থান দুই মানুষের মনেই একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। কিছু সুবিধাভোগী আর সমাজবিরোধীরা তাতে হাওয়া দিয়ে চলছে কিছু বাড়তি সুযোগ আদায়ের ইচ্ছায়। সেই সময়ে কলকাতার এন্টালি এলাকার একটি পাড়ায় খিস্টান, হিন্দু, মুসলমান বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সহবস্থান ছিল।
--
সেখানে একই বাড়ির দুটি অংশে থাকতো একটি হিন্দু আর একটি মুসলমান পরিবার। তাঁদের মধ্যে সদ্ভাবের অভাব ছিল না। বরং বলা যায় অতি ঘনিষ্ট আত্মীয়ের মত। দুটি পরিবারেরই জড় ছিল তদানিন্তন পূর্ব বাংলার টাঙ্গাইলের পাশাপাশি দুটি বাড়িতে । দুটি পরিবারের আধখানা সেখানেই রয়ে গেছিলো, আর আধখানা বৃত্তির তাগিদে কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিল। একের উত্সবে অপরের উপস্তিতি আর উপহার দেওয়া শুধু স্বাভাবিক নয় আবশ্যিক ছিল। বিপদ আপদেও তাই। রায়টের সময় ও দুই পরিবার পরস্পরকে আগলে ধরে পরম মিত্রতার মধ্যে দিয়ে কঠিন সময় পার করে চলেছে।
--
দুটি পরিবারেই বছর দেড় / দুই য়ের দুটি শিশু ছিল, যারা দুই পরিবারের চোখের মনি। শিশুদুটিকে কেন্দ্র করে ঘনিষ্টতা আরও যেন গভীর হয়ে ওঠে। তারা কখন এবাড়ি কখন বা ওবাড়ি থাকতো, খেলা করা, স্নান করা, এমনকি খাওয়া, ঘুমানো চলতো। একটি বাড়িতে ব্যস্ততার সময়ে অন্য বাড়ির রক্ষণাবেক্ষনে থাকতো তারা। মোটের উপর আপদে বিপদে পরস্পরের সহযোগিতায় দিন কাটছিলো। তাঁদের পাশের বাড়িতে এক বৃদ্ধ খ্রিষ্টান দম্পতি ছিলেন। তাঁদের ও এই পরিবার দুটির সাথে যথেষ্ট যাতায়াত ছিল। পাড়ায় এদের পাস্পরিক ভালবাসার কথা পাড়ার সবাই জানতেন। অতি দুর্যোগের মধ্যেও মোটামুটি শান্তিতে ছিলেন এখানকার মানুষ জন।
--
আচমকাই বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো একদিন। শিশুদুটি কোন একটি বাড়িতে সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ তাদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলনা। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে অথচ কোন চেঁচামিচি নেই।
দুই পরিবারই ধরে নিয়েছে অন্যদের কাছে আছে। তবু একটা সময়ের পর দুই মায়ের মনে হয় এবার অপর কে বিশ্রাম দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল তাদের গতিবিধি সম্পর্কে কেউই অবহিত নন। দুই পরিবারের বাকি লোকজন ও এসে জড়ো হলো যে ঘরে বাচ্চা দুটি ঘরে ঘুমাচ্ছিল সেখানে। দেখা গেল মাটিতে বিছানাযে তারা শুয়ে ছিল সেগুলি ভেজা অবস্থায়ে পরে আছে। কিন্তু বাচ্চা দুটি নেই। দুই বাড়ির আনাচে কানাচে খোঁজ শুরু হল। কোথাও পাওয়া যায়না তখন বাড়ির কর্তাদের অফিসে খবর গেল। হন্তদন্ত হয়ে তাঁরাও হাজির।
--
অবশেষে কার দায়িত্বে তারা ঘুমিয়েছিল তার হিসেব নিকেশ শুরু হল। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তাকে প্রায় কাঠগড়ায় দাঁড় করনোর অবস্থায় এসে পড়ে। ফলে তিনি ও বেগতিক দেখে নিজের দোষ কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে একে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্ঠা শুরু হল। তার থেকে এক পরিবার অন্য পরিবারের ঘাড়ে দোষ দেওয়া শুরু হয়। ইতিমধ্যে পাড়ার লোকজন জড়ো হয়েছে। ধান্দাবাজ অত্যুতশাহিরা ধর্মের জিগীর তুলে দুই পক্ষকে উত্তেজিত করার চেষ্টায় রত। এত দিনের ভালবাসা, বিশ্বাস সব যেন গুঁড়িয়ে যাবার যোগাড়। শেষে অহিংস তর্কাতর্কি প্রায় সহিংস সংঘর্ষের রূপ নিতে চলে। দুই পরিবারের কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি।
--
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে দেখে এক পরিবারের ঠাকুমা নিজের ঘরে সন্ধ্যা আরতি দিতে ঢোকেন। খাটের তোলা থেকে পিলসুজ বার করতে গিয়ে তিনি চমকে ওঠেন। এক দৌড়ে ঘর থেকে বার উঠোনে যেখানে সব মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে গিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকেন, "এই তোরা সব তাড়াতাড়ি আমার ঘরে আয়, দেখে যা কি কান্ড হয়েছে।" সবাই দৌড়ে যায়।
--
বৃদ্ধা বলেন,"দ্যাখ সবাই খাটের তলায়!" সকলে পস্পরকে ঠ্যালাঠ্যেলি করে ঝুঁকে পড়েন খাটের তলে। অবাক হয়ে দেখেন শিশু দুটি পাশাপাশি বসে আছে। সামনে তাদের দুটি বড় গামলা একটাতে চাল ভর্তি, আর অন্যটায় ডাল। দুজন মিলে তাদের ছোট্ট মুঠি ভরে চাল তুলে ডালের আর ডাল তুলে চালের গামলায় মেশাচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিজেদের মুখে দেবার চেষ্টাও চলছে। ঘুম ভেঙে গেলে সম্ভবত হামগুড়ি দিয়ে পাশের ঘরের খাটের তলায় মজার খেলায় মেতেছে। বড়দের মধ্যেকার অশান্তির আবহাওয়া তাদের দুজনের খেলায় কোন বিঘ্ন ঘটায়নি।
--
সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মায়েরা চট জলদি বসে পড়ে শিশু দুটিকে টেনে বার করেন। বুকের মানিকদের নিজেদের কলে তুলে জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর করে কাঁদতে কাঁদতে আদর করতে থাকেন। দুই পরিবারের বাকিরা কিছক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। লজ্জায় একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। হটাত দুই বাড়ির লোকজনের সম্বিত ফেরে। চোখের জলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। ধান্দাবাজের দল গুটি গুটি সরে পরে। শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা দুই পরিবারের মিলনে নিজেদের মিলিয়ে দেন।
--
শেষ চমক দিলেন পাশের বাড়ির খ্রিষ্টান পরিবারের বৃদ্ধ কর্তা, "এই যে মায়েরা নিজেদের বাচ্ছাদের ফিরে পেয়েছ তো। একবার তাকিয়ে দ্যাখতো নিজের বাচ্চাকেই কোলে নিয়েছ তো!" সবাই অবাক হয়ে যায় তাঁর কথায়। দুই মা ভাল করে তাকিয়ে দেখেন, একে অন্যের বাচ্চাকে বুকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। গুমঠ গরম কেটে স্নিগ্ধ হাওয়া খেলতে থাকে সারা উঠোন জুড়ে।
_________________________________________________________________________________________
No comments:
Post a Comment