টানাপোড়েন
**********
"মা, মা, ওমা , দেখবে এসো। শিগগির , রান্নাঘরে একটা পেঁচা ঢুকেছে ", --- খোকনের চিত্কার শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলেন মা।
"তাড়াতাড়ি এসোনা , এখনি বসার ঘরে ঢুকে পড়বে যে ", সে তখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ঘুমের জড়তা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মা। "পেঁচা ! পেঁচা কি রে ! কি করে ঢুকলো ?"
"আরে বারান্দার দরজাটা খোলা ছিলো যে। বাবলুদের বাড়ীতে ঢুকেছিল আগে। ওর কাকার তাড়া খেয়ে সোজা এখানে এসে ঢুকে পড়লো। "
"তুই কি করছিলি ?"
"আমিতো বারান্দায়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সামনে দিয়েই তো হূশ করে উড়ে এলো। আমি কি করবো। "
"ও, পড়াশুনা বাদ দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলে। দুদিন বাদে পরীক্ষা , সে খেয়াল আছে ",-- মায়ের গলার পারদ চড়লো।
"পরে বকবে , আগে দেখে যাওনা। "
ইতিমধ্যে মা রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলেন ধূসর রঙের কি একটা যেন ঘরের কোনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খোকন তাকে জরিপ করছে।
কি ওটা ? পেঁচা কি করে বুঝলি ?"
"আমি দেখলাম তো। বাবলুর কাকাও তো বললো ," ওরে পেঁচা টা মিনুদের বাড়ীতে তাড়া খেয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিলো। এখন তোদের ওখানে গেছে। তাড়িয়ে দে। "
মা হাত নেড়ে তাড়াবার চেষ্টা করলেন --" হুস, হুস, যাঃ ,যাঃ -- আরে এতো মহা যন্ত্রণা। হ্যাট ,হ্যাট। এই তোর্ জন্যই যতো গণ্ডগোল ", পেঁচাটাকে তাড়াতে না পেরে ছেলের ওপর মুখিয়ে উঠলেন মা।
"আমি কি করলাম। খালি খালি সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপাও, "-- ছেলেও তেড়ে ওঠে।
"সাধে কি চাপাই, তুই তো সব গোলমাল পাকাবার রাজা।"
" কেন আমি কি পেঁচাটাকে ডেকে এনেছি , আয়, আয় , আমাদের ঘরে আয় , -- যত্তোসব ,'' খোকন ক্ষেপে লাল।
"ডেকে আনোনি তো কি , সারা দুপুর ঘুম নেই , পড়াশুনো নেই। বিকেল না হতেই বারান্দার দরজা খুলে হাঁ করে দাঁড়িয়েছিলে কেন ",---- মা ও ছাড়ার পাত্রী নন।
"হাঁ করে দাঁড়াবো কেন , পড়তে পড়তে মাথাটা গুলিয়ে গেছিলো , তাই একটু বিশ্রাম নিছিলাম।"
" আহা হা বিশ্রাম নেবার কি ছিরি। এখন যাও দরজার পেছন থেকে ঝুলঝাড়ু টা নিয়ে এসো। দেখি ওটাকে তাড়ানো যায় কিনা ," -- বলেই তিনি আঁচলটা কোমড়ে জড়ালেন।
"থাক না মা পেঁচাটা , ওটাকে আমরা পুষবো। দেখনা, বেচারা খালি খালি তাড়া খাচ্ছে , এবাড়ী - ওবাড়ী - সেবাড়ী , বেচারী ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। দেখছনা কেমন মুখ গুঁজে পড়ে আছে" -- খোকনের , গলার স্বর কোমল হয়ে আসে।
"হ্যা পেঁচা পুষবে। এক তোমাকে মানুষ করতেই জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে "-- মা খেঁকিয়ে ওঠেন। "যাও যা বললাম তাড়াতাড়ি করো"।
মলিন মুখে ঝুলঝাড়ুটা এনে মা'র হাতে দিল ছেলে। মা সেটা দিয়ে একটা খোঁচা দেন।
" এই যাঃ , যাঃ ,পালা "
আস্তে আস্তে মুখ তোলে পাখিটা।
"ওমা দেখ , কি সুন্দর ! গোল গোল চোখ , কেমন দেখছে দেখো। ঠিক একটা ছোট্ট বাচ্চার মতো , না মা "!
একটু একটু করে কাছে এগিয়ে যায়। মনোযোগ দিয়ে ভালো করে দেখতে থাকে।
"বেশী কাছে যাসনা , আঁচড়ে দেবে। হ্যাট , হ্যাট "--- মা আবার ঝুলঝারাটা বাড়িয়ে দেন।
" আহা , মেরোনা মা ,--ওর লাগবে যে , --লক্ষিটি মাগো ,-- দাওনা আমায় ওকে পুষতে। আমার সত্যি এরকম একা একা ভালো লাগেনা। ওকে ছোলা খাওয়াব ,জল খাওয়াব , চান করাবো। ও আমার সাথে খেলবে। "-- ছলছল করে ওঠে তার চোখ।
" আরে , পেঁচা কি কেউ পোষে নাকি ", ছেলের মলিন মুখ , কান্না জড়ানো কন্ঠ মা কে বিব্রত করে। তবু ওটাকে না তারালেও নয়। আর একটা খোঁচা মারতে পাখিটা ডানা দুটি মেলল।
" আরে , ও দুটো কি ! ডানা না আর কিছু !" নিজের চোখ দুটি ভালো করে রগড়ে তাকালেন মা। ঠিক ডানা নয় ,বাঁকা বাঁকা অপুষ্ট মানুষের বাচ্চার দুটি হাতের মতো। গুটি ,গুটি পায়ে একটু এগিয়ে গেলেন। গোল গোল চোখ দুটি খোলা নাকি বোজা ! পেঁচা রাতো তো দিনের বেলায় দেখতে পায়না তবে ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে কি দেখছে ! মন্ত্র মুগ্ধের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন খোকনের মা।
ওটা মুখটা একটু ফাঁক করলো -- ঠিক যেন একটা বাচ্চা হাই তুলল ! সমস্ত জগৎ সংসার যেন হারিয়ে গেলো তাঁর কাছ থেকে। ওটা সত্যি কি মানুষের বাচ্চা নাকি ! কাছে , আরো কাছে এগিয়ে গেলেন। অতি আদোরের খোকনের অস্তিত্ব ভুলে গেছেন। আরো কাছে এগিয়ে গেলেন।
আরে এ যে অসহায় একটা ছোট্ট শিশুর মুখ --- ছোট্ট দুটি কাঠি কাঠি হাত , দুর্বল কঙ্কাল সার শরীর। একেবারে সেদিনকার ফুটপাতের সেই ভিখারিণীর বাচ্চাটার মত। কিন্তু সেটা এখানে এলো কিভাবে! কে আনলো! ওর মায়ের
অবস্থা তো খুব খারাপ ছিল। মা'টা কি তবে মরে গেছে ! তাই কি মা হারা বাচ্চাটাকে কেউ এখানে দিয়ে গেল!
কে দিয়ে গেলো! ওকে নিয়ে কি করবেন। আকাশ পাতাল ভাবতে থাকেন খোকনের মা। কি করা যায় ওকে নিয়ে। রাস্তায়ে রেখে আসবেন। উহু সেটা ঠিক হবে না। ওর মা মরে গিয়ে থাকলে কে দেখবে ওকে !কুকুর , বেড়াল ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু ঘরেও তো রাখা যায় না। তাহোলে কি হবে! কি উপায়!
আচ্ছা খোকনের সাথে ওকেও মানুষ করলে হয়না ! কোনো ভাই , বোন নেই বলে কত দুঃখ তার। সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। কিন্তু একটা অসুস্থ্য ,পঙ্গু শিশু কে নিয়ে কি করবেন। আজকের দিনে একটা সুস্থ্য সবল বাচ্চাকে মানুষ করতে মা বাবা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। তবে তার নিজেরই যদি এই রকম একটা রুগ্ন , পঙ্গু বাচ্চা থাকতো ,তাহলে কি হত! তিনি কি তাকে ফেলে দিতেন ! তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা তো তিনি নিশ্চয় করতেন। আজ যখন একটা অসহায়, বিকলাঙ্গ শিশু তার আশ্রয়ে এসেই পড়েছে , সেই দায়িত্ব অস্বীকার করা কি উচিত হবে ! কেনই বা হবেনা !ওটা তো সত্যি তার নিজের সন্তান নয়। নিজেদের যা রোজগার ,তাতে একটার বেশি বাচ্চাকে মানুষ করা যাবে না বলেই তো, খোকনের পরে আর কেউ আসেনি তার কোলে। তাহলে উটকো একটা বাচ্চা কেন তার খোকনের ভাগীদার হবে !
কিন্তু উটকো হলেও তো ওটা আর একটা মানুষের সন্তান , আর একজন মায়ের আদরের ধন। একটা নেহাৎই অনাথ, অসহায় মানব শিশু! তার দায় কি মানুষ হিসাবে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। একদিকে তার সংকীর্ন স্বার্থ বোধ, যেখানে তিনি শুধুই খোকনের মা , অন্যদিকে মনুষ্যত্তের দাবী, সামাজিক মাতৃত্ব বোধ - দুয়ের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ।
আচ্ছা কোন অনাথ এ আশ্রমে রেখে এলে কেমন হয় ! না না তার ঝক্কি কি কম, -- 'কার বাচ্চা , কোথায় পেলেন ', হাজার কৈফিয়ত ! তাছাড়া অনাথ আশ্রম গুলির যা অবস্থা , সুস্থ্য বাচ্চাগুলিই বাঁচে না , এইটা তো মরেই যাবে। কিন্তু একটা বিকলাঙ্গ অসুস্থ্য বাচ্চা মানুষ করা তো সহজ কথা নয়। শারীরিক , মানষিক, আর্থিক, সামাজিক সবকিছু জড়িয়ে আছে। মায়ের মনে চলতে থাকে একটা তীব্র টানাপোড়েন।
" ওমা অমন করছো কেন ? আমি পেঁচা পুষতে চাই না , আর পোষার জন্য বায়নাও করবো না। তুমি সরে এসে এখানে পাখার নীচে বসো। কাকুরা পেঁচাটাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তুমি শান্ত হও, " --- খোকনের বিচলিত কন্ঠস্বরে মায়ের সম্বিত ফিরে আসে। কখন যে তাঁর বিহ্বল অবস্থা দেখে ছেলে বাবলুর দুই কাকাকে ডেকে নিয়ে এসেছে , তিনি জানতেই পারেননি।
"সরুন তো দেখি বৌদি ,আমরা তাড়িয়ে দিচ্ছি পেঁচাটাকে , খুব ঘাবড়ে গেছেন বুঝি। না না ভয়ের কিচ্ছু নেই ",--- বাবলুর কাকারা খোকন কে আর তার মাকে সাহস যোগাতে চেষ্টা করে।
যাক , ওটা তাহলে পেঁচা ই তো --- স্বস্তির নিঃশাস ফেললেন মা। পর মুহূর্তে চমকে ওঠেন , তবে ওটাকে মানুষের বাচ্চার মতো দেখতে লাগছিলো কেন ! মনের কোণে কোথাও একটা কাঁটা বিঁধে থাকে , নিজের কাছে নিজেই যেন ধরা পড়ে গেছেন।
তাড়া খাওয়া পাখিটা পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মিলিয়ে যায়।
"
***************************************
'কালপ্রতিমা ', মার্চ ১৯৯৭, দশম সংখায় প্রকাশিত।
*********************************************************************************************