28 Aug 2015

হারানো কাকলী

হারানো কাকলী
**********
বাবুই, বউকথা কও, বক, ইস্টিকুটুম
চিরকালই গ্রামের বাসিন্দা।
শহরের বুকে আধিপত্য ছিল
কাক, কোকিল, চড়াই, পায়রাদের।
--

গৃহস্থের পরিছন্ন গৃহস্থালিতে   
চড়াই পাখিদের অযাচিত অনুপ্রবেশ।
ঘরে কোনা-কাঞ্চিতে
বাসা বাঁধা, ডিম পাড়া।
--

নৈমিত্তিক তাদের খুনসুটি, 
ঠোঁটে করে বাচ্চাদের খাবার আনা ,
অনবরত খড়কুটো ফেলা,
ছিল তাদের জন্মগত অধিকার।
--

পায়রাদের বসত ছিল   
পুরাতন বাড়ির ঘুলঘুলির মধ্যে।
উঠোনের আনাচে কানাচে 
খাবারের সন্ধানে তাদের ব্যস্ততা ।
--

বারমহলে তাদের অনয়াস গতি,
বেড়ালের প্রতি সতর্ক নজর,
দিনভর গলা ফুলিয়ে বকবকম
নির্জনতার প্রাচীর ভাঙত।
--

আজ যখন চড়াইয়ের খুনসুটি দেখে
পায়রার বকুমবকুম শুনে
একাকিত্ব থেকে মুক্তির পথ খুঁজি,
তারা হারিয়ে গেছে শহুরে মানুষের জীবন থেকে।
--

কেমন হবে সেদিন যেদিন থেকে
বাড়ীর কার্নিশে, ছাদের পাঁচিলে
কাকদের সভা আর বসবে না, কোকিল আর 
ডিম পাড়ার জন্য কাকের বাসা খুঁজে পাবেনা।
__

এমনি করেই মানুষকে আরো একা করে
কোন এক দিন হয়তো বা হারিয়ে যাবে
কাকের কর্কশ কা কা রব ,
সাথে কোকিলের মিঠে কুহু তান।  

__________________________________________________________________________________________

























27 Aug 2015

শ্রাবন শেষের আঙিনাতে

শ্রাবণ শেষের আঙিনাতে
****************

ঘন ধূসর মেঘের আস্তরণের
মধ্য দিয়ে বিদ্যূত চমকের মত
যৌবনের সহজাত প্রেরণাগুলি
মনের গভীর থেকে উঁকি মারছে।
--

অলস কালক্ষেপন না করে ,
উদ্দাম চলমান জগতের সাথে
দৃঢ় পদক্ষেপে, শান্ত সমাহিত মনে, 
অভিসারে সাড়া দিতে ডাকছে।
--

বৃষ্টি শেষে সদ্যস্নাত কচি চারাগুলি
দিনের উচ্ছল আলো মেখে
রাতের হিমেল বাতাসের পরশ পেয়ে
নরম আনন্দে ভরিয়ে দেবে মনের দৃষ্টিকে।
---

হাসি কান্নার জোয়ার ভাঁটায় 
অনন্ত অসীম বিশ্বের নৈসর্গিক
রূপ রস অনুভবে মগ্ন করবে
আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতা আর সৃষ্টিকে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------







19 Aug 2015

আপনজন


আপনজন
********

কসর আলীর সাথে সৃষ্টির পরিচয় হয়েছিলো ১৯৭১ সালের এক বৃষ্টি ভেজা শীতের রাতে, তাদের এক সাথীর মাধ্যমে।
"এই দ্যাখ সৃষ্টি ইনি হলেন আমাদের কসর দা, ওনার বাড়ীই আপাতত তোর আস্তানা। ওঁদের ঘর তিলজলা বস্তিতে, ওখানে তোকে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। বিশাল এলাকা মানে বিশাল কাজের জায়গা।
ওখানে বেশীর ভাগ উর্দুভাষী মুসলিম। তবে হিন্দী জানেন, ভাঙা বাংলাও জানেন। তুই তো আবার হিন্দীটাও ভাল জানিস না। ভাঙা হিন্দী আর বাংলা মিলিয়ে মিশিয়ে চালাবি।"
--

কসর দা প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, খাড়া নাক, মমতা মাখা সরল দুটি চোখ। বোঝা যায় গায়ের রঙ এক সময় গৌরবর্ণ ছিল, বর্তমানে পুড়ে তামাটে। চেহারায় কঠোর পরিশ্রমের আর পোশাকে দারিদ্রের ছাপ। তিনি জুতার কারখানায় ওস্তাদ কারিগর। বাড়ীতে আম্মা, স্ত্রী আর চারটি সন্তান। একটি ছয় ফুট / ছয় ফুট টিন আর ছাপড়া বেড়ার ঘর। তাতে উঁচু করে পাতা একটা বড় চৌকি যার উপরে নীচে শোবার ব্যবস্থা, মানে কোনমতে কাত হওয়া। আর এক কোনে উনান পাতা, রান্না, খাওয়ার সরঞ্জাম। সারা অঞ্চল জুড়েই এই ব্যবস্থা।
--

এরই মধ্যে কসর আলী সৃষ্টি কে নিয়ে হাজির হলেন। বাড়ীর লোকেদের বোধহয় আগাম নোটিস দেওয়া ছিল, তাই স্বাভাবিক ভাবে সবাই মেনে নিল। ভাবী মানে কসর দার স্ত্রী, সন্তানদের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন, "ইয়ে তুমহারা বুয়া হায়।" বাচ্ছারা খুব খুশির সাথে বুয়ার কাছ ঘেসে এলো। ছোট্ট টা দুহাত বাড়িয়ে দিল কোলে ওঠার জন্যে। "বাদমে, পহলে বুয়াকো বৈঠনে দো, মুহাত ধোনে দো।" সৃষ্টি ভাবী আর আম্মাকে নমস্তে করে বাচ্ছা টাকে কোলে তুলে নিল। যথারীতি ভাঙা হিন্দি আর বাংলা মিশিয়ে সবায়ের সাথে আলাপ করতে লাগলো। তবে তার উপস্থিতি যে আম্মা কে সন্তুষ্ট করেনি, সেটা বুঝতে পারলো। ভাবী চোখের ইঙ্গিতে ঘাবড়াতে বারণ করলো।
--

রাতে রুটি আর হালিম খাওয়া হলো। কসর দা রাজনীতি, চার পাশের মামুষের অবস্থা, দেশের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা আলোচনা করলেন। ভাবী ও হাতের কাজ সারতে সারতে কিছুক্ষন আলোচনা শুনলেন। সৃষ্টি সাহায্য করতে গেলে বাধা দিয়ে বললেন, " আব তুমলোগ বাতে করো, সুভে মেরে হাত বাটানা।" কিন্তু আম্মা সবাইকে চুপ করে শুতে বলে দিলেন। কসর দা আস্তে আস্তে বললেন," দো দিন যানে দো, তব সব কুছ ঠিক হো যায়গা।" কসর দা আর  ভাবী ছোট দুটো বাচ্ছাদের নিয়ে চৌকির নীচে মাদুর পেতে শুলেন, আর উপরে আম্মা, বড় বাচ্ছা দুটি আর সৃষ্টি। সারা দিন খাটাখাটনির পর শোবার সাথে সাথে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। শুধু ঘুম নেই সৃষ্টির চোখে। প্রবল মশার উপদ্রব। মশা মারতে মারতে রাত কাবার।
--

পরদিন সকালে কসর দা কাজে বেরিয়ে গেলেন। সৃষ্টি ভাবীর সাথে হাতে হাতে কাজ করতে করতে গল্প করতে লাগলো। বস্তির একটা গোসল ঘর, তাতে কল দেওয়া বিশাল একটা চৌবাচ্চা, জল ভর্তি করা হয় স্নানের জন্য। বাইরে আর একটা টাইম কল। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জল ধরা, আর সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে নিতে হয়। স্নান থেকে শুরু করে সব কিছু লাইন দিয়ে করতে হয়। দুপুরে ভাত পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে খাওয়া। বিকালে আবার টাইম কলে লাইন দিয়ে কাজ সারা।
--

কসর দার ওভার টাইম সেরে ফিরতে একটু রাত হত। খাওয়া দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ কথা বার্তা। রাতে শোওয়া। দ্বিতীয় দিন রাতে সৃষ্টি মশার কামড়ের মধ্যে ই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হটাত কোঁকানির আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেল। দেখে আম্মা উঠে বসে নিজের পা টিপছেন  আর কোঁকাচ্ছেন। সৃষ্টি কাছে গিয়ে জোর করে তাকে শুয়িয়ে দিয়ে সরষের তেল পায়ে মালিশ করে দিল। আস্তে আস্তে আম্মা ঘুমিয়ে পড়লে, সে শুয়ে পড়লো।
--

প্রায় দিন সাতেক পার হতে চলল। আম্মার ব্যবহারের  আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। ইতিমধ্যে বস্তির অনেক মহিলা ও মেয়েদের সাথে সৃষ্টির পরিচয় হয়ে গেছে। সে প্রায় ঘরের লোক হয়ে গেছে। প্রচারের কাজ ধীরে ধীরে ভালই এগোচ্ছে। একদিন কসর দা দের সাথে তাদের  এক আত্মীয়ের বাড়ীতে এক পরব উপলক্ষে গেল। সে বিশাল বড়লোক বনেদী মুসলিম পরিবার, গিজগিজ করছে মানুষ। এলাহি ব্যাবস্থা। সৃষ্টি তো অবাক। আম্মা তাই দেখে বললো,"বেটি অব হামলোগনে এয়েস্যা জী রহী হু, মগর কসরকা  বাপ অওর মেরে খানদান নবাব ঘর সে তালুক রাখতে থে।" সৃষ্টি বুঝতে পারলো এই জন্য আম্মা প্রথম দিন তাকে ভাল মনে কেন গ্রহন করতে পারেননি , আসলে তাঁর প্রাচীন আভিজাত্যে ঘা লেগেছিল। বর্তমান দারিদ্রে বাইরের লোকের সামনে প্রকাশ করতে চান না। তাছাড়া পর্দানশীন বনেদী পরিবারের একজন বৃদ্ধার কাছে বাইরের একটা উটকো মানুষ কে মেনে নেওয়া স্বভাবিকভাবেই সহজ নয়। কসর দা ও ভাবী যে কতটা প্রগতিশীল মানুষ, সেটা ভেবে অবাক হতে হয়। 
--

একদিন সৃষ্টিকে সকালে কসর দার সাথে পার্টির বিশেষ কাজে বার হতে হলো। কাজ সেরে রাতে বস্তিতে ফিরতে গিয়ে একটা বিশাল উত্তেজনার পরিবেশ নজরে এলো।
কসর দার বাড়ী যাবার পথে তাঁদের একজন প্রতিবেশী তাকে হাত ধরেটেনে ঘরে নিয়ে গেল। মহিলা বললেন,"তু আভ্ভি উনকো ঘর মত যানা, বহুত ঝামেলা চল রহা হ্যায়। মসজিদ সে  মৌলভি সাব আয়া। উনকো পাস্ খবর হ্যায় কী কসর জীকে ঘরমে এক হিন্দু লেড়কি আয়া। বস্তিকা সব লোগনে মিলকে উনকো সমঝাযা, কসর জী কে এক বাঙালী মুসলীম দোস্ত কা বেটি কুছ দিনকে লিয়ে আয়া। ম্যায়নে মেরি মরদ কো বুলাতা হু। তু মেরে এক বোর্খা পহেনকে আভ্ভি বাস পকড় কে ভাগ যা। "
--

ইতিমধ্যে একজন  মহিলা আম্মাকে ডেকে এনেছে। স্বাভাবিক ভাবেই কসর দা আর ভাবী আসতে পারেননি। কারণ তারা মৌলভী সাহেবের সাথে কথা বলছেন।
আম্মা এসেই কেঁদে সৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরেন। "বেটি ম্যায় পহলে তুঝে আচ্ছা দিলসে নেহী লেনে সেকা। মুঝে মাপ কর দে।"সৃষ্টি বারবার করে আম্মাকে বুঝাতে থাকে যে তাঁর কোন দোষ নেই। তার নিজের মা ও  হটাত একজন অপরিচিত মুসলীম মেয়েকে নিয়ে গেলে, সহজে মেনে নিতে পারবেন না। উপস্তিত সবাইয়ের চোখ দিয়ে জল বেরিযে আসে। মাত্র সাতদিনের পরিচয়ে বস্তির বেশীর ভাগ মানুষ একজন ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে মনের ভিতর থেকে গ্রহন করেছে।সে যেন তাদের একান্ত আপনজন।
--

ইতিমধ্যে কসর দার সেই ঘরের প্রতিবেশী দাদা চলে আসেন। সেই ভাবীর বোর্খা পরে সৃষ্টি তাঁর সতর্ক প্রহরায় বাস স্ট্যান্ডে আসে। বোর্খাটা খুলে সেই দাদাকে দিয়ে ফিরে যেতে বলে,পাছে কেউ তাঁকে দেখে ফেললে, তিনি আবার বিপদে না পড়েন।
কিন্তু তিনি শুধু একটু দুরে দাঁড়িয়ে চারদিকে কড়া নজরদারি করতে থাকলেন, যতক্ষণ না সৃষ্টি নিরাপদে বাসে উঠে চলে যায়। মাত্র সাতদিনের আশ্রয় সৃষ্টিকে একটা জিনিস শিখিয়েছে যে সাধারণ মানুষের কাছে মানবিকধর্ম বোধ ঐশ্বরিক ধর্মের থেকে অনেক উপরে। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




































































































 

9 Aug 2015

স্বপ্ন -- (১)

স্বপ্ন - (১)
***
যুগ যুগ ধরে, পলে পলে
মানবতা খুন হচ্ছে,
স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে 
সেই সুদিনটার যেদিনে 
মনুষত্বের  বিজয় পতাকা প্রতিরোধে
পৃথিবীর আকাশে উড়বে সদর্পে।
তার বার্তা বাতাস ছড়িয়ে দেবে
সাগরের ফেনায় ফেনায়, বন থেকে বনান্তরে,
পাহাড়ে পাহাড়ে, দিক থেকে দিগন্তরে। 
----
হ্যামিলিনের সেই পাইড পাইপারের বাঁশীতে  
উৎসারিত সুরের মোহে আকর্ষিত হয়ে,
শয়তানের দল, যারা মুখ ঢেকে আজ মানুষের মুখোশে,
ইঁদুরের মত একে একে গিয়ে পড়বে
আগ্নেয়গিরির জলন্ত লাভা স্রোতে।
যুগ থেকে যুগান্তরে নিহত,
সকল শহীদের কন্ঠে উচ্চারিত সুরে,
নতুন জীবনের আগমন প্রতিধ্বনিত হবে। 
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------








4 Aug 2015

দূর্ভোগ

দূর্ভোগ
******

শ্যাওলা ধরা আকাশে
ঝলমলে রোদ মারছে উঁকি,
পিচ্ছিল রাস্তাগুলি এখন শুকনো,
নেই সেই বিরক্তিকর বদ্ধ থৈ থৈ জল ,
বাতাসে কেটেছে মেঘের কঠিন কঠোর ভ্রুকুটি,
নরম আলো হাসছে গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় ,
শহুরে মানুষের মনে স্যাতস্যাতে ভাব মুছে তৃপ্তির হাসি।
---

এখনও বহু জায়গা বানভাসি ,
মানুষগুলি ঘর ছাড়া, নেই মাথার উপর ছাদ,
কিছু ভাগ্যবানের কপালে জুটেছে ছিঁটেফোঁটা ত্রান, 
পেটে ক্ষুধার জ্বালা, পরনে কাদামখা ভিজা কাপড়, খাবার জলের আকাল,
পুকুর, নদীর কূল ছাপিয়ে, নালার জল মিলেমিশে একাকার, এবার হবে মহামারী,
ত্রান নিয়ে চলছে রাজনীতি, নেতারা উদগ্রীব নজর কাড়তে, ভোটের বাজার গোছাতে।  
প্রকৃতির মারের চেয়ে বড় বিপদ মনুষ্যত্বের কেনা বেচা, মানুষ কবে শিখবে মানুষকে ভালোবাসতে !
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------