26 Apr 2020

তোরা খা, আমিও খাই



তোরাও খা , আমিও খাই
******************

ছোটবেলায় দিয়াদের পাড়ায় এক মহিলা ছিলেন , যার বাস ছিল  যত্রতত্র। আজ কারো বাড়ীর রোযাকে , কাল কোন পার্কের বেঞ্চে , পরশু কোন রাস্তার গাড়ী বারান্দার তলায় বা  কোন গাছের তলায়।  সম্বল বলতে একটা মাঝারি আকারের পুঁটলি । রোজ সেটা  খুলে গভীর মনোযোগ সহকারে সব একবার বার করত , আবার গুছিয়ে পুঁটলি  বাঁধত। কেউ যদি দেখার জন্য উঁকি দিত তাহলেই হল। তর্বড়িয়ে পুঁটলি বন্ধ করে তেড়ে যেত তার দিকে। বাচ্চারা ভারী  মজা পেতো। সুযোগ পেলেই ক্ষ্যাপাত " ও শৈলী পাগলী তোর পুঁটলিতে কি আছে , দ্যাখানা আমাদের। দেখবি, একদিন তুই ঘুমালে আমরা সব চুরি করে নেব। " স্বাভাবিক ভাবেই সে ক্ষ্যেপে যেত। চুরি যাবার ভয়ে সেটাকে সব  সময় আকঁড়ে ধরে থাকতো , এমনকি  ঘুমের সময়়েও। অন্যথায় সে কিন্তু ভারী শান্ত ,অযথা কাউকে কিছু বলতনা বা করতনা।
--

পুঁটলি টাই তার একমাত্র সম্বল। সেই পুঁটলিতে ছিল ছেঁড়াখোঁড়া একটা গায়ের চাঁদর , এখটা শাড়ি , কিছু ন্যাকড়া কানি,  কাঁচের দুই একটা হাতের চুড়ি , কিছু মরচে পড়া টিনের কৌটা , শিশি বোতল ,কাগজের টুকরা ইত্যাদি। কারো দান করা বা ফেলে দেওয়া। তাতেই সে সন্তুষ্ট। মাথায় একঢাল নোংরা জটা পড়া চুল , গায়ের গোরা রঙ নোংরা আর রোদে পুরে তামাটে। মাঝে মধ্যে রাস্তার কলে স্নান করলে আসল রঙ উঁকিঝুকি মারত সেই তামাটে রঙের ভিতর থেকে। বড় বড় চোখ আর টিকালো নাক। পরিস্কার পরিছন্ন অবস্থায় দেখলে , তাকে  যে কেমন সুন্দর দেখাবে তাই ছিল দিয়া আর তার  বন্ধুদের গবেষনার বিষয়।
--

শৈলী কিন্তু কিছু ব্যাপারে বেশ শৌখিন ছিল।  রঙিন দড়ি পেলে জটাপড়া চুলগুলিকে একসথে বেঁধে রাখত। প্রতিদিন গাছ থেকে কোন ফুল বা কিছু পাতা তার জটায়ে গোঁজা থাকবেই। সকালে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। কাক, পায়রা বা  চড়ুই যে কোন পাখী দেখলেই ভারী খুশী হতো। দোকান থেকে একমুঠো মুড়ি বা ছোলা চেয়ে এনে , ছুড়ে ছুড়ে তাদের খাওনো ছিল তার শখ। চেনা দোকানদারা তাকে একটু স্নেহমেশানো প্রশ্রয় ই দিত।  প্রকৃতি কে উপভোগ করার রোমান্টিকতা প্রবাহিত হতো তার ধমনীর শিরায় শিরায়। অপূর্ব সুক্ষ এক শিল্পীস্বত্তা ছিল হৃদয়ের অন্তস্থলে।
---

বর্ষাকাল ছিল তার খুব প্রিয় -- মেঘের ডাকে সে ময়ূর-ময়ূরীর মতো চঞ্চল হয়ে উঠতো। বৃষ্টিভেজার আনন্দ তার চোখ মুখে ফুটে উঠতো । আর রাস্তায় জল জমলে তো কথাই নেই , শিশুর মতো সরল খিলখিল হাসিতে উছলে উঠতো।  বাচ্চাদের  জলে কাগজের নৌকা ভাসাতে দেখলে, তাদের দলে ভিড়ে যেত।   দিয়ার কাছে বায়না করতো ," এই মেয়ে আমাকে কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে দে , আমিও সবার মতো জলে ভাসাবো। দিয়া শৈলীর ছোটখাটো আবদার গুলি পূরণ করার চেষ্টা করতো। কয়েকটা কাগজের নৌকা বানিয়ে দিলো। শৈলী তো মহাখুশী। মনের আনন্দে বাচ্চাদের সঙ্গে জলে নৌকা ভাসানোর খেলায় মেতে উঠলো।
---

মাঝে মাঝে  বিশ্ব জগত ভুলে রাতের  মেঘ মুক্ত খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো  তন্ময় হয়ে। দিয়া জিজ্ঞাসা করতো -"ও শৈলী , কি দেখছো এত মন দিয়ে।" একগাল হেসে বলতো "দেখছিস না  কত তারা আকাশে।  আচ্ছা  চাঁদ কি ওদের রানী - কত বড় আর কি সুন্দর। নিশ্চই চাঁদ রাতের আকাশের রানী। " "তাহলে , রানীর রাজা কে ,শৈলী। " 'ওমা ,জানোনা বুঝি, ভোরের লাল সূর্য্য টাই ওর রাজা। সোনার  রাজার রূপার রানী।  ঠিক বলেছিনা বলো। " " হ্যা, একদম ঠিক বলেছো। " ব্যাস মহাখুশী শৈলী।
--

আর একটা অদ্ভূত মজার ব্যাপার ছিলো শৈলীর। ক্ষিদে পেলে সে সোজা  বাগানের গেট খুলে বাড়ীর দরোজাতে এসে স্বাভাবিক অধিকারবোধে  হাঁক পাড়তো - "কইরে , আমার ক্ষিদে পেয়েছে ক্ষেতে দে। তোরাও খা , আমিও খাই। " কেউ যদি বলতো " তোমাকে কেন দেবো ?"  "কেন দিবি না ! তোরা খাবি  আর আমি খাবোনা কেন ! তোরাও খা , আমিও খাই। "
তবে শেলী বুঝে গেছিলো কোথায় খাবার পাবে আর কোথায় পাবেনা। যেখানে তাকে স্নেহভরে খেতে দেবে সেখানেই সে সাধারনত যেতো।  কিন্তু  মুশকিল হলো, কোথাও মাথায় দেবার ফুল /পাতা না পেলে সে লোকের বাড়ীর বাগান থেকে নেবে। বারণ করলে , বলবে, " এই  মাটিতে গাছ হলে সেটা সবাইয়ের। তোদের যেমন ,আমারও তেমন। তোরা জন্মের সময়ে মাটি কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিস ?"  সাধারণত সে কখনোই একই বাড়ীতে সাত/দশ দিনে একবারের বেশী   যেতো না । ঘুরে ফিরে বিভিন্ন পাড়ায় বিভিন্ন বাড়ীতে যেতো। সমতাবোধ ছিল তার মজ্জাগত।
---

একদিন দিয়া তাকে জিজ্ঞাস করলো ," কি হলো , এতদিন পরে এলেযে ? কোথায় ছিলে ?" " অন্য পাড়ায় গেছিলাম , অন্য অনেক বাড়ী বাড়ী ঘুরছিলাম। " কেন ! এ পাড়ায় তোমাকে কেউ কিছু বলেছে ?" " ধূর বোকা মেয়ে , যেখানে আমকে ভালবাসে না , সে সব বাড়ীতে আমি কখনো যাইনা , আমার কি কোন মান নেই ! তবে হ্যা রোজ রোজ এক বাড়ীতে গেলে তাদের ওপর চাপ হবে না , অন্যায্য হবে না ! তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেলে কারোর গায়ে লাগবেনা। আর রোজ তোকেই বা শুধু কেন জালাবো ! বাকীরা ও তো নিজেরা খাচ্ছে , তাহলে আমাকেই বা খেতে দেবেনা কেন ?" অকাট্য যুক্তি। "তবে হ্যা , তুই  আমার সবচেয়ে ভাল মা, শোন আমি মরলে এই পুঁটলি টা তোকে ই দিয়ে যাবো। এই দ্যাখ আমার এই লাল চুড়ি দুটো পরবি। পরবি তো  ?" কি ব্যাকুলতা যে ছিল সেই প্রশ্নে। অত গভীর ভালবাসা কে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
__

এরপর বেশ কদিন কেটে গেলো শৈলী আসে না। দিয়ার মনে মনে একটা অশ্বাস্তি বোধ হতে লাগলো। স্কুল যাওয়া আসার পথে দিয়ার  দুচোখ তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পায়না। শেষে এক শনিবার বিকালে বন্ধুরা দল বেঁধে তাকে খুঁজতে বার হলো । অবশেষে তার দেখা মিললো। এক বড় বাড়ীর গাড়ী বারান্দার তলায় তাকে আবিস্কার করা গেল , প্রচন্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে , কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার যোগাড় । দিয়াদের  দেখে এক চিলতে হাসি ফুটলো তার মুখে, কিন্তু কথা বলার শক্তি নেই।   আশপাশের দোকানদার রাই খাবার দাবার দিচ্ছিলো। পাড়ার এক ডাক্তার বাবু ওষুধ দিয়েছেন।
--

তখন মাঘ মাসের ঠান্ডায় ঘরে লেপ মুড়ি দিয়েও  সবাই  যখন কাঁপছে, খোলা জায়গায় শৈলীর জ্বৰ বেড়েই চললো, আস্তে আস্তে সজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। ডাক্তার বাবুর কথায় পাড়ার লোকজন সরকারি  হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসলো। দিন তিনেক বাদে শোনা গেলো শৈলী মারা গেছে। দাহ করার দায়িত্ব নেবার কেউ ছিল না , তাই বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে তার শেষ আশ্রয় জুটলো লাশঘরে।
---

পাড়ার অনেকের ই  মন খারপ,  শৈলী যে সকলের অজান্তে তাদের জীবনের একটা অঙ্গ বা অভ্যাস হয়ে দাড়িয়ে ছিল।  একদিন এক দোকানদার দিয়ার  হাতে শৈলীর লাল চুড়ি দুটি দিয়ে বললো ," দিদি শৈলী বারবার করে এটা তোমাকে দিতে বলে গেছে। "  অনেকদিনের জমানো চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। খালি মনে পড়তে থাকে, " এই খেতে দে,  ক্ষিদে পেযেছে। তোরাও  খা , আমিও খাই। " একটা অতি  সাধারণ মানুষ, লোকে যাকে পাগল বলত , কত সহজ, সরল ভাষায়  জীবনের সবচেয়ে গভীর সত্যটাকে  বলে গেছে। 
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

































































 

16 Apr 2020

খিদে

আমার দেশের পেটে খিদে, ভীষণ খিদে
একটাতো পেট নয়, সঙ্গে এক একটা পরিবার,
আমার দেশ তাই ছড়িয়ে পড়ে
এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে,
বাঁচার তাগিদে সুদূর পানে যাওয়া
এতো তার জন্মগত অধিকার,
কিন্তু নেই অধিকার শুধু ভাতের ;
খাবারের সন্ধানে যেতে হয় দূর থেকে দুরান্তরে।
---
হটাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত,  মহামারী,
সারা দেশ লক ডাউন, নেই ফেরার পথ !
পেটের খিদে তো বাগ মানে না
পরিবারের মুখ ভাসে, সেখানে পেট পুড়ছে জ্বলন্ত অঙ্গারে, মন উতলা,
দিশেহারা আমার দেশ
স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে অগণিত মাথা,
সুরাহা নেই কোনো, জোটে শুধু লাঠির বাড়ী ।
----
বাড়ী যাবার বাহন নেই, হতাশায় ভেঙে পড়া
আমার দেশ উঠে  দাঁড়ায়, হাঁটতে শুরু করে।
কত ক্রোশ, কত যোজন জানা নেই, অপরিচিত সড়ক,
গলা শুকিয়ে কাঠ, ক্ষত বিক্ষত পা, মুখ থুবড়ে পড়ে, কেউ কেউ আর ওঠেনা,
কেউ কেউ আবার ওঠে, আবার চলে ।
---
ঘুঘুডাকা গ্রাম, শ্যাওলা পড়া বুড়োবট, কলমিলতা বেষ্টিত ঘর,
আর পরিবার পরিজনের ক্যানভাস চোখে ,
মনে আশা একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে,
আমার দেশ উৎকণ্ঠায়, দুরাশায় পথ হাতড়ে মরে; অচেনা দিন, অজানা ভবিষ্যৎ ,
জ্বলন্ত রোদ মাথার ওপর, জ্বলন্ত আগুন পেটে !
------------------------------------------------------------------