28 Feb 2022

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 2

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত  -  পর্ব ২ 
***********************
বোধহয় ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো। হটাৎ বিকট এক বাজখাই গলায় চীৎকার," ফাইল, ফাইল।গুনতি, গুনতি।  ওঠ, ওঠ এই শালীরা।" তাকিয়ে দেখি মোঠা সোঠা লাঠি ধারী হেড জমাদারনি তার সাঙ্গপাঙ্গ,মানে  কিছু দালাল বন্দিনীদের সঙ্গে নিয়ে লক আপ খুলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের বন্দিনীরা সবাই তাড়াহুড়া করে লাইন করে মাটিতে উবু হয়ে বসে গেল, নিভা আমার হাত ধরে টেনে একটা জাগায় বসে পড়ল। দালালরা কজন বন্দিনী আছে ,তাদের হিসাব নিল। নতুদের আলাদা করে নাম লিখে বলল," এই তোরা সকালের খাবার পাবিনা। ৯টার সময় কেস টেবিল হবে, তারপর দুপুর থেকে থেকে খাবার পাবি", বলে সদলবলে বেড়িয়ে গেল।
--
বন্দিনীরা প্রাতঃকর্ম সারা, স্নান করা আর খাবার জল ধরার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। কারণ দেরি হয়ে গেলে হয়ত সকালের খাবারটাই মিলবে না। নিভা তার খাবার নিয়ে এসে বলল," আমার থেকেই আজকে খা।" আমি অবাক হয়ে দেখলাম এক/ দেড় মুঠি ছোলা স্বেদ্ধ। ওতে নিভার ই পেঠ ভরবে না, আমি কি করে ভাগ বসাই। নির্বিকার চিত্তে নিভা বলল, "চিন্তা করিস না, তুই না নিলেও আমার পেটের এক কোনা ও ভরবে না। বলেছিনা এখানে পেটের আগুন কখন নেভেনা। জ্বলতে, জ্বলতে শেষে আর বোধ থাকে না।" জোর করে দেওয়া ছোলা মুখে তুলতে গিয়ে দেখি পোকা শুদ্ধ ছোলা। সেটা ফেলতে গেলে নিভা আমার হাত চেপে ধরল, "আরে করিস কি, পোকা ছোলা ফেলতে গেলে সব ফেলে দিতে হবে। চোখ বুঝে খেয়ে নে। দুদিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে।"
--
খাওয়া শেষ না হতেই নিভা আমাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। "চল পাগল বাড়ীর দরজা খোলা, আমি ওখানে আগে থাকতাম। এইফাঁকে দেখেনে, হয়তো আর কোনোদিন দেখার সুযোগ পাবিনা।" জেলখানায় পাগলরা থাকে আগে জানা ছিল না। পরে শুনেছিলাম অনেকেই, বিশেষত যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, তারা জেলখানায় মাথার গন্ডগোল হলে নিজেদের আত্মীয় স্বজন দের জেলে সেরে ওঠার জন্য দিয়ে যায়। যেমন নিভাকে দিয়ে গেছিল। তাছাড়া রাস্তা থেকেও পাগল দের ধরে এনে এখানে রাখা হয়। এরা সবাই নন ক্রিমিনাল লুনাটিক কেসে বন্দী।
 --
পাগল বাড়ী ঢুকে আমি পাথরের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোটা তিনেক খাঁচার মত ঘর। সেখানে অনেক অনেক, একেবারে উলঙ্গ কঙ্কাল, মাথায় চুল জট পাকিয়ে গেছে। গা হাত পা নোংরায় কালো। এখানে সেখানে দগদগে ঘা।  অনেককেই হ্যান্ড কাফ দিয়ে, বা শেকল দিয়ে গরাদের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। যে যেখানে পেরেছে প্রকৃতির ডাকে কাজ সেরেছে। তারই পাশ থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। অনেকে আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি, চুল টানাটানি, এমন কামড়া কামড়ি করে পরস্পরকে ক্ষত বিক্ষত করছে, রক্ত ঝরছে। কেউ গলা ফাটিয়ে কাঁদছে কেউ গালি গালাজ করছে।কাউকে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছেনা। সাধারণ মানুষ ওখানে কদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবে।
--
নিভা আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসার পর সম্বিত ফিরে পেলাম। একটা জায়গায় আমাকে বসিয়ে জল খাওয়াল। একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা এ রকম কঙ্কালের মত কেন !" "কেন আবার ঠিক মত খাবার দেয় না। জানিস ডাক্তার বাবুরা ওদের জন্য কত বেশী বেশী ডায়েট লিখে দেয়, দুধ ,ফল বিস্কুট,পাউরুটি, মাছ সব। কিন্তু কিছুই ওরা পায় না। দালাল গুলি সব মারে। আমাদের সকলের খাবার থেকেও ওরা মারে। তাইতো এতো কম খাবার পাই আমরা।" "কিন্তু মেট্রন,ওয়ার্ডার রা কিছু বলে না !" "পাগল ওদের নির্দেশেই তো এসব চলে। ওরাই তো মোটা ভাগ পায়। দালাল রাও পেটমোটা হচ্ছে খেয়ে খেয়ে। আবার নিজেদের পছন্দের জিনিস আনাছে ওয়ার্ডারদের দিয়ে। সপ্তাহে একদিন মাছ আর একদিন মাংস দেবার দিন। সেদিন দেখবি মগ ডুবিয়ে মাংস খেয়ে ঢকঢক করে হজমের ওষুধ খাচ্ছে।"
--
ইতিমিধ্যে 'কেস টেবিল, কেস টেবিল' করে বিকট চিৎকার শোনা গেল। নিভা আমাকে নিয়ে গিয়ে কেস টেবিলের যাবার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমাদের নতুন বন্দিনীদের দুইজন মেয়ে ওয়ার্ডডার আর একজন লাঠিধারী ছেলে ওয়ার্ডারের সাথে জেনানা ফাটক থেকে বেরিয়ে ছেলেদের ওয়ার্ডের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো।সেখানে একটা টেবিলে একজন ডেপুটি জেলার, হেডজমাদার বসে একটা বিরাট জাবদা খাতায় নাম,ধাম ঠিকানা,  কেস ইত্যাদি লিখে নিচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ওয়ার্ডে ফিরলাম। আমাকে ডিভিশন ওয়ার্ডে রাখা হল। প্ররথমেই এই এই ওয়ার্ডডের  নামকরণের বিষয়ে একটা কথা পরিিিষ্কার করা দরকার। ইংরাজ রাজত্বে এখানে রাজবন্দিনীদের রাখা হত। তাঁরা ছিলেন মধ্য উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ এবং বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত। কালক্রমে এখানে শুধু রাজনৈতিক বন্দিনীদের রাখা হত। আমাদের সময় শুধু নকশাল বন্দিনীদের রাখা হত, বিশেষ সুযোগসুবিধা বর্জন করলেও। প্রথম ছিল ক্লাস ডিভিশন , পরবর্তি কালে রাজনৈতিক মতাদর্শের ডিভিশন, যাতে আমজনতার মধ্যে সেই মতাদর্শ ছড়িয়ে না পরে।     
---
আমি  যেদিন ডিভিশন ওয়ার্ডে যাই তখন সেখানে  আর দোতলার সেলে শুধু নকশাল বন্দিনীদের আলাদা করে রাখা হয় যাতে তারা সাধারণ বন্দীনি দের সাথে মিশতে না পারে। শীলাদি ছাড়াও মুক্তি, বিজু আরও পাঁচজনের সাথে পরিচয় হল। ওপরে সেলে কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া থাকতো। বিজু ছিল সবার ছোট, মুক্তি, ডালিয়া আমার সমবয়সী, কল্পনা আর জয়া (মিত্র) ছিল শীলাদির বয়সী। ১টা র সময় হেড ওয়ার্ডার তথা জমাদারনী এসে লক আপ করে দিল। 
--
ভাত খাবার পর বিজু পড়ল আমাকে নিয়ে। শুনলাম প্রতি সপ্তাহে এক মুটকি কেরোসিন তেলের গন্ধ ভরা মাথার তেল, এক মুটকি সরষের তেল আর একটুকরা কাপড় কাচার সাবান বন্দিনীদের প্রাপ্য। সেই কেরোসিন তেল ওরফে মাথার তেল বিজু আমার মাথায় জবজবে করে মাখিয়ে, কোষে বেঁধে বেশ কিছুক্ষণ ৱেখে দিল। তারপর একটা সরু চিরুনি দিয়ে জোরে জোরে আঁচড়াতে লাগলো। আর কেরোসিনের গন্ধে ঝরঝর করে উকুন পড়তে লাগল, মুক্তি সেগুলিকে মারতে থাকল। বিকালে ৪টের লকআপ খুললে বিজু কাপড় কাচার সাবান মাথায় গায়ে ঘষে স্নান করিয়ে দিল।প্রায় দিন ২/৩ দিন এই পর্ব চলল, পুলিশ থানার কম্বলে সঞ্চিত উকুন তাড়াবার জন্য। বিকাল ৫/৬ টার সময় আবার লক আপ হলে মুক্তি আর বিজু মিলে পুলিশ লক আপে মার খেয়ে আঘাতের জায়গায় সরষের তেল মালিশ করতে থাকে।যারাই নতুন আসে এইভাবে শুশ্রুষা করে সারিয়ে তোলাটা এখানকার রেওয়াজ। সাথীদের সাহচর্য্যে আর সেবায় শরীর মন দু ই শান্তি আর স্থিরতা লাভ করে। সন্ধ্যে বেলায় খাবার খেয়ে গল্প করা বা বই পড়া হত, প্রায়ই গানও  হত। মুক্তির গলায় অসাধারণ কাজ ছিল। বিজুর মিস্টি গলা ছিল। সবার শেষে  ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া হত। এইভাবে শুরু হল আমার জেল জীবন।
**********************
(চলবে )



















  













23 Feb 2022

মিছিল

মিছিল 
************

মিছিল, মিছিল, মিছিল
মোমবাতি জ্বালিয়ে চলমান জনতা
পোষ্টার হাতে কিশোর, কিশোরী
স্লোগানে স্লোগানে দলবদ্ধ ছাত্রছাত্রী।
--
রাজপথ, জনপথ আজ আবার
মিছিলে মিছিলে ছয়লাপ,
এখনও প্রতিবাদ, প্রতিরোধে
মানুষ সামিল হতে জানে।
--
একদিন এই রকম কত 
অন্যায়, অবিচার বিরুদ্ধে 
কলরবের পুরোধা ছিলে তুমি, 
দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছিলে।
--
সে মিছিল একদিন গিয়েছিল
সেই আবীর রাঙা পলাশ গাছের
পাশ দিয়ে, যেখানে বসিয়েছিলে
স্কুলছুট বাচ্চাদের পাঠের আসর।
--
আর একটা মিছিল গিয়েছিল
সেই প্রাথমিক স্কুলের পাশ দিয়ে
যেখানে চলেছিল রক্তদান শিবির
রক্তের আকালে মানুষ ছিল অসহায়।
--
গ্রামের লোকেরা আজ দলবেঁধে চলেছে,
একদিন বন্যার প্রকোপে বিপর্যস্ত মানুষের
আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছ তোমরা সদলবলে
অন্নবস্ত্র তুলে দিয়েছো তাদের হাতে।
--
আজ সেই মানুষের ঢল নেমেছে 
প্রবল প্রতিবাদে তোমাকে হত্যার 
বিরুদ্ধে, ন্যায় বিচারের দাবীতে।
শাসকের সিংহাসন কাঁপছে 
জনতার মুষ্টিবদ্ধ হাতের উত্তলনে,
দলমত নির্বিচারে দৃপ্ত স্লোগানে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

22 Feb 2022

আনিস তুমি কি জাত

আনিস তুমি কি জাত
*********************

আনিস তুমি কি জাত !
আনিস তুমি মানুষের জাত
তুমি প্রতিবাদীর জাত
আনিস তুমি মানবদরদীর জাত
তুমি উজ্জ্বল নক্ষত্রদের জাত। 
--
আনিস তুমি সহমর্মিতার প্রতীক
সমাজসংস্কারের নাম
আনিস আত্মত্যাগের প্রতীক
প্রতিরোধের আর এক নাম,
তুমি আন্দোলনের প্রতীক।
--
আনিস তোমার মেরুদন্ড টা ছিল ঋজু 
মন ছিল সৎ, সরল, সতেজ, 
পথ  ছিল সোজা, সুকঠিন
তুমি মানুষের আশা, ভরসা, সাহস
ছিলে সমাজের প্রাণ ও পথের কান্ডারী
--
আনিস তুমি বরুনবিশ্বাসের বন্ধু,
তাপসী মালিকের ভাই
তুমি ভকত সিং এর উত্তরসূরী,
আজাদের জ্বালা আলোকবর্তিকা,
লালনের জাত, তিতুমীরনন্দন। 
---
আনিস ঊষর জমিনে মরুদ্যান,
পরিবেশের নির্মল বাতাস,
শাসক ও শোষকের বুকের ত্রাস
আনিস ভবিষ্যৎ শান্তির পারাবত,
উদীয়মান সূর্য্যের রক্তিম ঝলক। 
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------