26 Nov 2016

কালো ধন

কালো ধন
******
'কালো ধন উচ্ছেদ ' সাবাস ভাই সাবাস  
রাতারাতি নোট বাতিল, সাবাস  
'স্বচ্ছ ভারত' সাবাস।
--
রাঘব বোয়ালেরা নিশ্চিন্তে, কালো ধন দূর বিদেশে  
যেটুকু বাকী, সময় মত সাদা হয়ে গেছে 
কি জানি কার অদৃশ্য ইঙ্গিতে !
--
সাধারণের ঘরে শুধু কঠোর শ্রমের ফসল 
হঠাৎ কি করে যেন হয়ে গেল অচল
বলির পাঠা তারাই কেবল !
--
সৎ রোজগারের ধন এখন কালো
বাঁকা পথই কি তবে ভালো !
সোজা মানুষ কি পেল !
--
বিদেশের কালো টাকা ঘরে কি ফিরেছে?
লাখ পনেরো কজন পেয়েছে ?
উত্তর কি মিলেছে ?
--
অন্যদিকে ভোট বাজারের ভাবনা
শুধু গরম গরম ঘোষণা
বোঝে নাকি জনতা !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

12 Nov 2016

বয়স আঠারো

বয়স আঠেরো
**********
আঠেরো বছর বয়স
টগবগে তরতাজা সময়
নুতন স্বপ্ন দেখা। 
বুকভরা সাহস, সততা 
উদার, নির্ভিক চেতা, 
দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলা।
যাপনে ত্যাগের ব্রত
দেশ ও দশের তরে
তাগিদ কিছু করা।
--
আঠারো বছর বয়স
বড় মধুর, বড় সুন্দর সময়
স্মৃতির  কণাগুলি জুড়ে
আগামী দিনের ক্যানভাস,
প্রতি পল অবিরত 
তাড়া করে ফেরে। 
সারা জীবন ভরে
আঠার বছরের সঞ্চয়
রয় মনের গহন গভীরে।   ++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++         


10 Nov 2016

দাদার কীর্তি


দাদার কীর্তি
*********
রপ্তানি করেছি দাঙ্গা
দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন
বিক্রি করেছি অস্ত্র
পাঠিয়েছি যুদ্ধ জাহাজ
বোমারু বিমান বিধ্বংসী 
আজ আমারই ঘর বিপন্ন।
হিরোশিমা নাগাসাকি
সে আমারই কারসাজি। 
কার্পেট বোমবিং এর বীজ
বুনেছি ভিয়েতনাম, লাওস
ক্যাম্বোডিয়া, সমগ্র আরব দুনিয়ায়,
তারই চারা গাছ জন্ম নিয়েছে
আমার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক অঙ্গনে।
আধিপত্য বিস্তারে তৈরী করেছি
ষড়যন্ত্রী জঙ্গি, জীবন্ত রোবট কত শত
ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে তারা আমারই দুয়ারে 
ছড়িয়েছি মারণ বিষ পৃথিবীর কোনে কোনে
ঘৃণিত দস্যু আমি আজ বিশ্বের দরবারে।
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++         
     



 

9 Nov 2016

দিশারী - পর্ব 6

দিশারী - পর্ব ৬
************
প্রায় তিনটে বছর পার হয়ে গেল। দিশারী বাড়ীর  জন্য প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখিয়ে যায়। আশায় থাকে একদিন বাড়ীর লোক ঠিক চিঠি পেয়ে তাকে নিতে আসবে। কিন্তু মনে সন্দেহ রয়ে যায় চিঠি ঠিক জায়গায়  পৌঁছাচ্ছে না, কারন বোঝে ঠিকানা টাই সে ঠিক মত বলতে পারছে না। ইতিমধ্যে হটাৎ করে রশ্মি ছাড়া পেয়ে যায়। হাওয়ায় কথা ভাসে, সে নাকি লাইনে নেমেছে। কারণ ইদানিং সুইপার লছমীরানীর আর কুখ্যাত এক জমাদারনীর সাথে তার খুব ঘনিষ্টতা বাড়তে দেখা গেছিল। আলো মাসী তাকে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে কথা শুনতো না, ওই দুজনের সাথে মেয়ে পাচারকারী চক্রের যোগাযোগ আছে বলে অনেকে সন্দেহ করত।
--
জেনানা ফটকে তিন জন মহিলা সুইপার আসতো - শ্যামবাই, ছোট লছমীবাই আর বড় লছমীবাই। বড় লছমীবাইকে মেট্রন গোষ্ঠী লছমী রানী বলে ডাকত। সে অন্য দুজনের তুলনায় বয়স্ক আর সবচেয়ে পুরান লোক ছিল। কর্তৃপক্ষের খুব কাছের মানুষ, তাদের অনেক কুকর্মের ভাগীদার। তাই সাধারণ বন্দীরা তার থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করত।
--
রশ্মি লাইনে নেমেছে, একথা মানতে দিশারীর মন চাইত না, "রশ্মি দেহ বেচে খায়। এ হতে পাইরে না।" বছর ঘুরতে না ঘুরতে একদিন রশ্মি আরও কয়েকটি মেয়ের সাথে জেলে এল। তার সাজগোজ, ধরণ ধারণ ই পালটে গেছে, এখন তার নাম লীনা। দিশারীর কাছে সে কিছু গোপন করল না, বলল,"আমাদের মাসী তো কালই আমাদের ছাড়িয়ে নেবার ব্যবস্থা করবে। তুই চাইলে তোকে বার করার ব্যবস্থা করতে পারি। নাহলে তোকে এই জেলেই পচে মরতে হবে। আসবি দুজনে একসাথে থাকব।" ঘৃনায় দিশারী মুখ ঘুরিয়ে নিল,"ছিঃ! দেহ বেচার চে জেলে পইচে মরাও ভাল।" রশ্মি মুখ বেজার করে সরে গেল। পরদিন তারা ছাড়া পেয়ে গেল। এরপর সে আরও এক দুবার জেলে আসে, ১/২ দিনে ছাড়াও পেয়ে যেত।
--
একদিন মা র মুখে শুনল তাদের সাত জন ছেলে শেয়ালদা কোর্ট থেকে কেমন করে পালিয়েছে। শুনে দিশারী দারুন খুশি, "বেশ হইছে।পেইলে যাবার ঠিক জায়গা বেইচেছে। ওহানে যা নোকজন এক্কারে থই থই কইরতেছে। একবার  ভীড়ে মিসে জাতি পাইরলে, কে ধইরবে। মারে,আমারে যদি একবার শেলদা কোটে নে যায় তো ওই ভীড়ে আমিও পেইলে যাব, তুই দেইখিস ক্ষণে। "
--
একদিন দিশারী গরাদের ওপার থেকে উত্তেজিত গলায় ডেকে বলে,"হই শুইনেছিস, মোর শ্বহুরবাড়ীর গেরামের এক বুবু এইসেছে, সে মোর স্বামীদের ঘর ভাল চেইনে, মোদের কথা হবি নাকি জাইনে, মোরে বইলেছে ছেইড়ে নে যাবে।"
"বাঃ, এতো ভাল কথা। তা কি কেসে জেলে এসেছে, নাম কি ?" "দাঁইড়ে থাক, ডেইকে আইনতেছি, অ তুলসী বুবু, এপাশে এইসতো, মোর মা ডাইকতেছে।" একজন আধা গ্রাম্য আধা শহুরে মহিলা এসে দাঁড়াল।" মাসী, তুমি দিশারীর শ্বশুর ঘর চেন ?" "হ চিনিত,ওদের গুষ্টিগোত্তর সব জানি।" "তুমি কি কেসে এসেছ ?" "পেটের দায়ে গাঁ থেইকে আনাজ পত্তর এইনে শহরে বেচি। মাস ফুইরে গেইছে খ্যাল ছিলনি, নূতন মাসিক টিকিট কাটা হইনে, তাই ধইরেছে।"
"কিন্তু ওকে কি  ওর স্বামী ঘরে নেবে।" "নারে মা, সোয়ামির ঘর আমি যাবনি, শেলডা ইস্টিশনে মাসি নে যাবে, আমি বাপ্ মায়ের ঘরে চইলে যেইতে পাইরব।"
--
তুলসী মাসি দিন সাতেক সাজা খেটে বেরিয়ে গেল। দিশারী কে বলে গেল সে তার গ্রামে গিয়ে ফকির মিঞার সাথে সব কথা বার্তা বলে ঠিক করে রাখবে। প্রথমে তার নিজের স্বামী কে ইন্টারভিউ করতে পাঠাবে, তারপর কোর্ট ফেলার ব্যবস্থা করে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে, শেয়ালদা থেকে সে তার নিজের বাড়ী যেতে পারবে। প্রায় একমাস বাদে দিশারীর ইন্টারভিউ এল। সবাই খুশী। দিশারী মুখে হাসি, চোখে আনন্দের ঝিলিক। ডগমগ হয়ে ইন্টারভিউ তে গেল। কিছক্ষন বাদে সে যখন ফিরে এল, সমস্ত আলো মুছে গেছে, কপালে চিন্তার ভাঁজ।
--
সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল,"কিরে, কি হইল, কে এইসেছ্যাল, কি বইল?" দুটো ভারিক্কি গোছের নোক এইছ্যাল। তার মধ্যি একজন কইল বুবুর সোয়ামি, অন্যজনে তার পাড়ার নোক।" "ত তুই মুখটা অমন কালোপানা  কইরেছিস ক্যানে ? তোর বাপেরে খপর দ্যাছে ? তোরে ছাড়ায়ে নে যাবেনি ?" " কি জানি মোর কপালে কি আছে," বলে দিশারী থম মেরে বসে রইল।
--
ডিভিশন বাড়ীর দিদিরাও দিশারীর অপেক্ষায় ছিল," আর কি হল বলবি তো, চুপ করে আছিস কেন ?"
"জানিসনে ত, বুবুর সোয়ামীরে শুইধেছি, বাপেরে বুবু কি খপর দেছে, শুধু ঘাড় নেইরে হ্যা বইলে, মোর বাপমা মোর কথা কি বইলেছে স্যা সব বইলেনি। সোয়ামীর কথা যেই শুইধেছি, অন্য নোক টা বইল, তুমি তো বে হইছে স্যাই কথা চেইপে গেইছ।" "আরে, অ তো নামে মাত্তর বে।" "বুবুর সোয়ামি আমারে বইল, তর কোর্ট পৈরবে, কেউ জানতি চাইলে বৈলবি আমি তর পিশা।"
--
শুনে  শুনে সবাই গম্ভীর হয়ে গেল, ব্যাপারটা সন্দেহজনক, তুলসীরা সম্ভবত কোন দালাল চক্রের সাথে যুক্ত। দিশারীর মুখে তার জীবনের কথা শুনে চাল চেলেছে আর বানানো গল্প করেছে। " তুই ঠিক সন্দেহ করেছিস। জজের কাছে তোকে তুললে তুই সোজা বলে দিবি চিনিনা।" আশ্চর্য্য বিষয় দিন তিনেক পরেই দিশারীর কোর্টের দিন পড়ল এতদিন জেলে পচার পর। দিশারী কোর্টে গেল, কিন্তু আর ফিরল না। ওর সাথে আর যারা সেদিন কোর্টে গেছিল, তারা খুব পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারল না। দু /একজন শুধু বলল দিশারীকে জজের কাছে তোলেনি, লক আপ থেকে খালাস বলে বার করে দিয়েছে। শঙ্করীকে ছাড়াতে তার আসল বাবা মা মাসের পর মাস উপযুক্ত প্রমান সমেত থানা, কোর্ট আর জেল এ চক্কর কাটতে কাটতে জেরবার হয়ে গেছিল। অথচ দিশারীকে অনায়াসে খালাস করে দিল ! কোন প্রভাবশালী চক্র এর পেছনে কি কাজ করল ! তার ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা অজানাই থেকে গেল ! রয়ে গেল বিরাট একটা প্রশ্নচিন্হ।       ++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

 দিশারী - পরিশিষ্ট
 *************
 হাসিনা আমার জেলের মেয়ে। কিন্তু দিশারী আমার মানসকন্যা। তাই তার সেই কথাটাই আমার কানে বাজে," মারে,  আমারে যদি একবার শেলদা কোটে নে যায় তো, ওই ভীড়ে আমিও ঠিক পেইলে যাব, তুই দেইখিস ক্ষণে।"    
 --
১৯৭৭ সালে সরকার পরিবর্তিত হল। ভোটের সময়ে ঘোষিত তাদের রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির কর্মসূচি কার্য্যকর হল। আমরা বার হলাম। তার বেশ কিছু সময় বাদে একটা খবরের কাগজে একটন খবর বার হয়, নারীপাচার চক্রের একটা দল ধরা পড়েছে। বড় লছমীবাই মা সেজে একজন কে ছাড়াতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে । সে নাকি তার স্বীকারক্তিতে জেল কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মচারী / কর্মচারিনী আর মেয়ে জমাদারনীর নাম বলে দেয় এবং রাজস্বাক্ষী হতে রাজী হয়। তাকে প্রেসিডেন্সি জেলেই রাজসাক্ষী হিসাবে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষী দেবার আগেই ভাটি ঘরে কাজ করতে গিয়ে তার গায়ে আগুন লেগে যায়, এমন বীভৎস ভাবে পুড়ে মারা যায় যে সে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দেবার সুযোগ টুকুও পায়নি। কিভাবে তার  আগুন লাগে, সেও এক বিরাট প্রশ্নচিন্হ !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++                                                                 


  
















      


























4 Nov 2016

দিশারী - পর্ব 5

দিশারী - পর্ব ৫
**********

ধীরে ধীরে দিশারীর বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মায়ের মত স্নেহ প্রবন আলো মাসি, রশ্মি,শ্যামবাই, সমেদা। তবে আলোমাসি আর শোভা তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। হাজতী নম্বর ছাড়াও আরও ওয়ার্ড ছিল - মেয়াদী নম্বর, জাল ঘর, পাগল বাড়ী, ডিভিশন ওয়ার্ড, সেল। শোভার কাছে শুনল ডিভিশন ওয়ার্ডে আর উপরের একটা সেলে রাজনৈতিক বন্দীরা থাকে। তাদের সাথে কাউকে কথা বলতে দেখলে মেট্রন, কিছু ওয়ার্ডার আর দালাল রা মারধর করে।
--
আগে নাকি শিখা বলে একটি ভয়ংকর হিংস্র একটা দালাল ছিল, তার নেতৃত্বে আর মেট্রনের নির্দ্দেশে দালাল বাহিনী কত মানুষ কে যে অমানুষিক মার মেরেছে, এমনকি মেরেও ফেলেছে তার হিসাব নেই। তাছাড়া বন্দিনীদের খাবার মারত আর বাড়ীর লোক দেখা করতে এসে কিছু দিয়ে গেলে কেড়ে নিত। জেল কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আর মেট্রনের প্রিয়পাত্রী ছিল, তাদের সব ঘৃণ্য কুকর্মের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল। সে থাকতে সাধারণ বন্দিনীরা তো বটেই কিছু ভালমানুষ ওয়ার্ডার ও তটস্থ থাকত।
--
 মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল কলকাতায় রুজি রোজগারের জন্য। ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা দালাল কাউকে ভয় করত না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রন কে ডিঙিয়ে সে জানতে চাইল কবে তার কোর্টের দিন পড়বে।পরে সেই অপরাধে  মেট্রনের অঙ্গুলি লেহনে শিখারা চুড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় তাকে পাগল বাড়ীতে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়। তাকে কেউ আর দেখতে পায়নি।
--
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগরি বাই এর স্বামীর নতুন করে বিয়ে হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়। শিখা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত। একদিন কোনমতে সেল থেকে বেরিয়ে সে রোদ পোহাতে গেছিল। সেই অপরাধে তাকে মেরে লোপাট করে দিল। "সে এক ভয় পাইত  ডিভিশন বাড়ী আর দোতলার স্যালের দিদিগরে", শোভা বলে। ওই দিদিদের সাথ আমারে একবার দেখা কইরে দিবি," "হ্ একই দিন ফাঁক বুইঝ্যা তরে লইয়া যামু।"
--
একদিন শোভার সাথে দিশারীকে পাগল বাড়ীতে খাবার পৌঁছে দিতে বলা হল। ভেতরে ঢুকে সে হতভম্ব আর নিঃশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। উলঙ্গ, মাথা কামান কিছু কঙ্কাল শেকলে বাঁধা। কেউ কাঁদছে। কেউ নোংরা মেঝে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছে। কেউ কেউ পাশেই তার সহবন্দিনীর সাথে খামচা খামচি করছে। যে যেখানে আছে সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ করছে।
--
 শোভা কাজ সেরে দিশেহারা দিশারীকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এল। "দ্যাখ, গড়িব ঘরের মানষে তাদের পাগল স্বজনরে এই হানে চিকিৎসা কইরা সুস্থ করনের লাইগ্যা দিয়া যায়। তারা জানেই না ক্যামনে এয়াদের চিকিৎছে হইত্যাছে,"শোভা বলে। "কিন্তু, এথানে সুস্থ নোকে, অসুস্থ হয়ে পইরবেনি !" কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিশারীর প্রশ্ন।
--
ইতিমধ্যে দিশারীর ডিভিশন বাড়ীর দিদিদের সাথে আলাপ বন্ধুত্বে দাঁড়িয়ে গেল। জীবনের সব কথা তাদের কাছে গল্প করত। দিদিদের কাছে নানা গল্প, তাদের জেলে আসার কারণ সব শুনত। তাদের সব কথা না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছিল এরা গরীব মানুষের বন্ধু। সমস্ত গরীব মানুষ কে এক হতে হবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়তে হবে, নিজেদের প্রাপ্য নিজেদেরই আদায় করে নিতে হবে। জেলে এসে তার অভিজ্ঞতা আরও বাড়ল। একদিকে চরম স্বার্থপরতা, লোভ, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা আর অন্য দিকে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, আত্মসম্মান বোধ। একদিকে অত্যাচার অন্যদিকে জোটবদ্ধ প্রতিরোধ।
--
একদিন প্রায় ১৫/২০ জন বন্দিনী একজোটে দালালদের অত্যাচার, কম খাবার আর বিনা অসুধ আর চিকিৎসায় মরার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। স্বাভাবিক ভাবেই দিশারী, শোভা, আলো মাসী আর তাদের বাকী বন্ধুরাও সেই জোটে ছিল। রাজনৈতিক বন্দীরা তখন ইন্টারভিউ থেকে ফিরছিল। তারাও ওদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেল। মেট্রন বেগতিক বুঝে দালালদের লোকদেখান বকাঝকা করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঠিকঠাক খাবার বাটালেন। মিষ্টি গলায় প্রতিশ্রুতি দিলেন এরপর সবাই অসুখ হলেই যেন হাসপাতালে তার কাছে চলে আসে, সবাই ঠিকঠাক চিকিৎসা পাবে।
--
আর একদিন রাতে হাজতী নম্বরে অনেক বন্দিনী এল। ভীড়ে সবার চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবার অবস্থা। এরই মাঝে একটি দুর্বল অসুস্থ বাচ্চা খিদের তাড়নায় কাঁদতে শুরু করে। রুগ্ন মায়ের শুকনো বুকে দুধ ছিল না। বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর মত কিছুই ছিল না, ফলে একনাগাড়ে বাচ্চাটা কেঁদেই চলে। আনোয়ারা, জোত্স্না আর বাকি দালালরা হুংকার ছাড়ে, "এই  মাগী তোর ওই বেজন্মাটা কে থামা শিগগিরি, নইলে গলা টিপে জন্মের মত চুপ করিয়ে দেব।" দিশারীদের দল এক জোটে রুখে দাঁড়ায়," একবার চেষ্টা কইরে দেখ ক্যানে, বাচ্চার কোন ক্ষেতি কইরতে চায়লে, আসো দেহি। কেমন ধারা মানুষ তমরা, পশুর অধম।" জোরাল প্রতিবাদে দালালরা বোবা হয়ে গেল।
--
রাজনৈতিক বন্দীদের জেল কর্তৃপক্ষ বা দালালরা সচরাচর ঘাঁটাতো না, প্রাপ্য জিনিসপত্র কিছুটা হলেও দিতো। কিন্তু সাধারণ বন্দিনীদের দুর্দ্দশার সীমা ছিলো না, এদিক-ওদিক হলেই মারধর। শুধু খাবার কেন, খাবার জলটাও ঠিকমতো জুটতো না। অসুখবিসুখে ওষুধপত্রও মিলতো না। আমরা চেষ্টা করতাম যাতে ওরা একজোট হয়ে নিজেদের দাবীগুলো আদায় করতে পারে। একজোট হয়ে দালালদের মারধোর ঠেকাতে পারে। দালালরা সব সময় চোখে-চোখে রাখতো, যাতে আমাদের সাথে ওরা কথা বলতে না পারে। কিন্তু তাই বলে জেলে লড়াই কখন থেমে থাকেনি। অন্যান্য বন্দিনীদের লড়াইয়ের পাশে আমরা সব সময় থাকতে চেষ্টা করেছি ,তাঁরাও আমাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। কখন লড়াই শুরু করেছে মীরা,শান্তিবাই,বেলা,রেখারা, কখন বা মিতা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, মদিনা ,শোভা, শান্তি মাসীর। কখন বার্মিজ মাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে, কখন মেয়াদী নম্বরের পাকিস্তানের পাসপোর্ট কেসের মাসীরা, আবার কখন মাস্তান একাই জেলকতৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবারে জীবন বাজী রেখে লড়ে গেছে।     
----
কিছুদিন পর দিশারীদের কয়েক জনকে মেয়াদী নম্বরে বদলী করে দেওয়া হল। ডিভিশন বাড়ীর দিদিদের সাথে পরিচয় হবার কিছুদিন পর থেকে প্রতি সপ্তাহে যে পোস্টকার্ড দেওয়া হত, তাতে তার হারান এবং বর্তমান বাসস্থানের কথা দিয়ে   তার মাকে চিঠি লিখে দিতে হত। "নেখ, পথমে ফকির মোল্লা, গেরাম রাইদিহি, সোন্দর বন।"
--
"পোস্ট অফিস কি? থানা কি? জেলা কি?" "ওসব বইলতে পাইরবনি।ডাকঘর চন্ননদিহি হোতি পাইরে।" প্রতিবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিকানা লেখা হত। সুন্দরবন হলে জেলা দক্ষিণ ২৪পরগনা হওয়া স্বাভাবিক। আর রায়দীঘি, চন্দনদীঘি উল্টে পাল্টে লেখা হত। কখন গ্রাম, কখন পোস্ট অফিস, বা কখন থানা, যদি কোনটা খেটে যায়। কিন্তু খাটে না দিশারীর বাড়ীর কোন খবর নেই।
--
ইতিমধ্যে শঙ্করী নামে হারান একটি বাচ্চা মেয়ের বাড়ীর লোক খবর পেয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, ভূতপূর্ব ওয়েলফেয়ার অফিসারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে। তবুও শঙ্করীর বাবা মাকে মাস কয়েক জেল, থানা, কোর্টে তদবীর করতে করতে পায়ের শুকতলা ক্ষয়ে যায়। যেদিন শঙ্করী ছাড়া পেল ততদিনে সেই অফিসার বদলী হয়ে গেছে। যাই হোক শঙ্করী ছাড়া পাওয়াতে সকলের মধ্যে একটা খুশী সেই সাথে একটা আসার সঞ্চার হয়।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
(চলবে )