22 Nov 2019

কর্ষিত জমিন

কর্ষিত জমিন
************
সত্তর সালের ডিসেম্বর মাস, অফিস টাইম, স্টেশনের লোক্যাল ট্রেনগুলিতে উপচে পড়া ভীড়। দুটি কিশোর আর একটি কিশোরী ধস্তাধস্তি করছে হাওড়াগামী ট্রেনে ওঠার জন্য, কিন্তু কিছুতেই একসাথে ট্রেনে উঠতে পারছে না। একজন ওঠে তো বাকী দুজন নীচে থেকে যায়, ফলত প্রথম জনকেও নেমে আসতে হয়। এমনিতেই এখান থেকে হাওড়ার ট্রেনের সংখ্যা কম। শেষে তারা ঠিক করে স্টেশনের বেঞ্চে বসে নিজেদের কাজের কথা বার্তা সেরে নিয়ে অফিস টাইমের ভীড় কমলে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করবে। একটু পরে ভীড় কেটে গেল বটে পরের ট্রেন প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে। ট্রেনের অপেক্ষায় থেকে, নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলতে থাকে।
--
কপাল মন্দ ! জাঁদরেল এক টিকিট চেকার এসে তাদের ধরে বলে তারা নিশ্চই বিনা টিকিটে ট্রেনে এসেছে। স্বভাবতই তারা প্রতিবাদ জানায় ,"আমরা হাওড়া স্টেশনের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, এইতো আমাদের কাছে হাওড়া যাওয়ার টিকিট আছে।" "তাহলে তোমরা কর্ড লাইনের ট্রেনে বিনা টিকিটে এখানে এসেছ, হাওড়ার টিকিট কেটে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছ। অনেকক্ষন ধরে তোমাদের আমি লক্ষ করছি, এখানে বসে গল্প করছ।" " হ্যাঁ ,তা করছি কারণ অফিস টাইমের ট্রেনে এত ভীড় যে আমরা উঠতে পারছিলাম না।" "তোমরা সব বিশ্ব বখাটে ছেলেমেয়ে, টিকিট ফাঁকি দিয়ে এখন গল্প বানাচ্ছো। চলো অফিসে, স্টেশন মাস্টারের ঘরে।" "ঠিক আছে চলুন ", বলে তিনজন চেকারের পেছন পেছন স্টেশন মাস্টারের অফিসে যায়।
--
সেখানে বেশ জনা কতক ট্রেনের কর্মচারী বসেছিলেন। দু /চার জন উৎসাহী লোকজনও জুটে গেল। নানা রকম টিকা টিপ্পুনি শুরু হয়ে যায়। "কিহে বিনা টিকিটে ট্রেনে সফর করছ "  "ওহে, এই বয়সেই প্রেম করছো ", " কি বেহায়া মেয়ে দেখেছেন, একজন দুটোকে নাচাচ্ছে ", ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা তিন জন প্রতিবাদ করে উঠলো, " আমরা মোটেও বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়িনি, আমাদের সাথে টিকিট আছে ", "কেন আজেবাজে কথা বলছেন, আমরা বন্ধু, এক পাড়ায় থাকি।"
এই ভাবে তর্ক বিতর্ক চলে, ঝামেলা বেশ পাকিয়ে উঠল। কেউ বলে আচ্ছা 'ধড়িবাজ', কেউ বলে 'বেয়ারা, বখাটে ', কেউ বলে 'কান ধরে ওঠ বস করান।'  শেষ পর্যন্ত স্টেশন মাস্টার বলেন, "কই দেখিতো হাওড়ার টিকিট কই?"
--
ওদের মধ্যে লিডার গোছের ছেলেটি তিনটি টিকিট বার করে দেয়। স্টেশন মাস্টার টিকিট তিনটি হাতে নিতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একজন  চেকার স্টেশনমাস্টাররে  হাত থেকে টিকিট তিনটে নিয়ে বলে ওঠেন," আরে একি, তোমাদের মধ্যে কে নাবালক ?" লিডার গোছের ছেলেটি বলে,"আজ্ঞে আমি, মানে হাফ টিকিটটা আমার। আর ফুল টিকিট দুটি ওদের দুজনের।" সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কিশোরটিও সবার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম একটা হাসি ছাড়ে। এদিকে কিশোরীটি আর অপর কিশোরটি তো অবাক তাদের সাথীর দিকে তাকায় আর ভাবে, "এটা কি উদ্ভট কাজ করেছে আকাশ, আর কেন করেছে ! ওর কি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে, তিনজন সাবালক তারা, তাহলে কেনই বা দুজনের ফুল টিকিট আর একজনের হাফ টিকিট!" মাথা মুন্ডু খুঁজে পায় না।
--
চেকারটি আকাশ কে ধমকে ওঠে," চুপ করহে বাচাল ছোকরা, এখনই পুলিশে তুলে দেব তিনজনকে। " আকাশ গম্ভীর ভাবে বলে, "না ,তা আপনি করতে পারেন না, আমাকে পুলিশে দিতে পারেন হাফ টিকিটের জন্য, কিন্তু ওদের দুজনকে পুলিশে দিতে পারেন না, ওদের তো ফুল টিকিট আছে। "  সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সেই জাঁদরেল চেকারটি লাফিয়ে পড়ে, "দাঁড়াও, তোমার হাফ টিকিট আর ফুল টিকিট বার করছি। প্রথমেই আমি বলেছিলাম বিনা টিকিটে ট্রেন ধরে কর্ড লাইন থেকে এখানে এসেছো, হাওড়ার ট্রেন ধরার জন্য। মেন্ লাইন বলে ভয়ে দুটো ফুল আর একটা হাফ টিকিট কেটেছ , আর মিথ্যা কথা বলেছ। " আকাশ বলে." আমরা মিথ্যা কথা মোটেও বলিনি। "
--
এবার কিশোরী আর অন্য কিশোরটি ময়দানে নামে," দেখুন,ও খেয়াল করেনি। নাহলে দুটো ফুল টিকিট কাটল যখন এক তখন একটা হাফ কাটবে কেন! আমরা হাফ টিকিটের বদলে আর একটা ফুল টিকিট কেটেঁ নিচ্ছি। আমাদের বিরাট ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দিন। " "কভি নেহি ,পুলিশে তোমাদের দেবই দেব। কদিন জেলে ঘানি টেনে এস তবে তোমাদের শিক্ষা হবে বাছাধন। " কিশোরী টি আস্তে আস্তে স্টেশন মাস্টারের কাছে ঘেসে বলতে শুরু করল," দেখুন মাস্টার  মশাই , আপনিই ভাবুন এই রকম ফাঁকি কেউ দেয়, হয় টিকিট কাটে না, নয়তো তিনটেই হাফ টিকিট কাটে। একসাথে তিনজন সাবালক যাচ্ছি, সেখানে এ রকম বোকামি ইচ্ছে করে কেউ করে !" " আমিও তো বুঝে উঠতে পারছি না, এ কি রকম বুদ্ধি ! আর তুমি মা একটা মেয়ে সঙ্গে আছো, কি যে করি !" জাঁদরেল চেকার টি চেঁচিয়ে ওঠে, "মাস্টারমশাই আপনি নরম হবেন না। ওদের পুলিশেই দিতে হবে। "
--
এবার উপস্থিত মানুষদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেল। কেউ বলে 'পুলিশে দেওয়া ঠিক,'  বিরোধী পক্ষ বলে 'ছেড়ে দিন, অল্প বয়েসের ছেলে মেয়ে, কিছু একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে, সঙ্গে একটা মেয়ে আছে'  ইত্যাদি, ইত্যাদি। দু /চার জন আবার বললে, 'কিন্তু সত্যি কি ঘটনা হয়েছে সেটা জানা দরকার।' হটাৎ আকাশ সবাই কে চমকে দিয়ে বলে উঠল, "আমার কাছে দুটো ফুল আর একটা হাফ টিকিটের বেশী পয়সা ছিল না, আমরা তিনজন গরীব মানুষের পার্টি করি, আজ আমাদের কলকাতায় ফিরতেই হবে তাই এ ছাড়া উপায় ছিল না ," আকাশ মুখ খোলার সাথে সাথে অপর কিশোর টি ও তাদের রাজনীতি প্রচার করতে শুরু করে দিল। কিশোরীটি ব্যাগ থেকে পার্টির কাগজ পত্র বার করে বিলোতে থাকল। তিনজন তিনটে গ্রূপ করে তাদের পার্টির মতাদর্শ প্রচার করতে শুরু করে দিল। নির্বাক হয়ে জনতা তাদের কথা শুনলো। কাগজ পত্র পকেটে পুরে ফেললো। অনেকেই বলে ফেলল," সত্যি এই সমাজ টাকে বদলানো দরকার, তোমরা হয়তো পারবে। আমাদের শুভেচ্ছা তোমাদের সাথে থাকল। "
--
ইতিমধ্যে হাওড়াগামী ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। স্টেশনমাস্টার তিনটে ফুল টিকিট ওদের হাতে দিয়ে বলল ,"এ রকম ভুল আর কোরনা, সাবধানে থেক। " জাঁদরেল চেকার টি ওদের সঙ্গে করে খালি কামরা দেখে  ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বলল ,"সাবধানে যেও ভাই। " আর ট্রেনে উঠেই অন্য কিশোর আর কিশোরী দুজনে মিলে দুদিক থেকে আকাশের দুই কান ধরে টেনে ধরল, "হতভাগা  আমাদের বাঁচিয়ে নিজে শহীদ হতে গিয়েছিলি। তবে জনতা যে সত্যিকারের কর্ষিত উর্ব্বর জমিন, প্রয়োজন শুধু উৎকৃষ্ট বীজের, এটা আবার প্রমান হল।  "
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------