23 Feb 2017

ডাম্পিং গ্রাউন্ড

ডাম্পিং গ্রাউন্ড
***********

তৃতীয় বিশ্ব শুধু আজ 
ডাম্পিংগ্রাউন্ডের করে কাজ  
পরমাণু বর্জ্য কোথায় যাবে!
জমা হোক তৃতীয় বিশ্বে
পরিবর্তে দিলে কিছু ডোল  
হরেক কাজে হরেক ছল।
--
প্রভূত অস্ত্রের সম্ভার,
সুযোগ মুনাফা কামাবার
সেখানেই রপ্তানি করে 
বোকাগুলি যাতে মরে,
নিজেরাই মারামারি করে
এক চিলতে জমির তরে।
--
নাহলে লাগিয়ে দাও
কোন এক জিগির ওঠাও   
ভাষা, জাতি বা ধর্মের নামে  
ভেসে যাক রক্তের প্লাবনে
সভ্য মানুষের সমস্ত
বিবেক আর মনুষ্যত্ব। 
 --
উন্নত ধনী দেশ যত
আর্থিক সংকট তত,
নিজেরা থাকে নিরাপদ
তৃতীয় বিশ্ব কলুর বলদ 
পাহাড় প্রমান বোমা বারুদ
বর্ষিত হয় শান্তির অজুহাতে 
তৃতীয় দুনিয়ার দেশে দেশে,
গুঁড়িয়ে যায় বাড়ী, স্কুল, হাসপাতাল
পুড়ে যায় মাঠ ভরা ফসল,
কলকারখানা, খনি আর তেলকূপ
ধ্বংস হয় মানব সভ্যতার সুপ্রাচীন স্তুপ। 
--

আজ তোদের বারমাস
খেলেছিস - ফাঁকা মাঠ!
যেদিন তৃতীয় দুনিয়া
তাদের বেঁকে যাওয়া
কোমড় সোজা করে 
দাঁড়াবে উঠে একযোগে
ঘটাবে তোদের সর্বনাশ,
সেই মানব লৌহবলয় ভাঙার হবে না সাহস।
উত্তর দিতে হবে, যত  লীলাখেলা ধ্বংসাত্বক,
এই ডাম্পিং গ্রাউন্ডের নতুন মানুষেরা হোক
তোদের শেষ বিচারের বিচারক। 
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


9 Feb 2017

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আশীর্বাদ

25 Mar 2015

সেন্ট  ভ্যালেন্টাইনের আশীর্বাদ
********************

শ্যামলী জেলে এসেছিলো ভালবাসার অপরাধে।  জেলের ভাষায় তাকে বলত লাভ কেস। উত্তর চব্বিশ পরগণার কোন এক গ্রামের বর্দ্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে। বাবার অঢেল জায়গা জমি, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, ক্ষেতভরা ডাল, শাকসব্জি, গোয়ালভরা গরুমোষ, ছাগল, ঘরভরা হাঁস মুরগী। এককথায় বিশাল জোতদার। গ্রামের হাটে আড়তদারীও ছিল। সেইমতো মেজাজ ও ছিল সাংঘাতিক প্রকৃতির। গৌরাঙ্গ মন্ডলের প্রবল প্রতাপে বাঘেগোরুতে একঘাটে জল খেত, অর্থাৎ গরীব চাষী, ক্ষেতমজুর, সমস্ত গ্রামবাসী তটস্থ হয়ে থাকতো। ঋণের দায়ে কারসাজি করে গরীব গ্রামবাসীর চাষের জমি, ভিটে মাটি আত্মসাৎ করা থেকে শুরু করে, মারধোর, গ্রামছাড়া করা, এমনকি দুচারটে খুন করা সব  কিছুতেই সে সিদ্ধহস্ত। থানার পুলিশ / দারোগা তাকে  দেখলেই সেলাম করতো।
---

শ্যামলীর বাবা তিনভাই এর মধ্যে বড়। একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা। শ্যামলী পরিবারের একমাত্র মেয়ে এবং সর্বকনিষ্ঠ। তার বাবা কাকারা তো বটেই ভায়েরাও একি ধাঁচে গড়া। বাড়ির আদরের মেয়ে হলেও অষ্টপ্রহর সকলের কড়া  নজর ছিল তার উপর। এহেন পরিবারে ও পরিবেশে সে ভালবেসে বসল তাদের জমির ক্ষেতমজুর ওয়াসেখ আলীকে। সবল, সুঠাম শরীর, দোহারা গড়ন, কোঁচকানো ঝাঁকড়া চুলগুলি বাগ মানততো না, কপালের উপর এসে পড়ত। সহজ, সরল মানুষ, দরদে ভরা মন, কিন্তু ভীষণ জেদী আর অসম্ভব সাহসী। বলা যায় অকুতভয়। গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষের অত্যন্ত প্রিয়। তাদের যে কোনরকম প্রয়োজন বা বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে। এমন কি শ্যামলীর বাড়ির মহিলাদেরও সে ছিল প্রিয় পাত্র। পুরুষেরা তাকে মনে মনে একটু ভয় ই পেতো।
 ---

ওয়াসেখের বাবার ভিটে বাড়ী বন্ধক  ছিল গৌরাঙ্গ মন্ডলের কাছে, তারই  ঋণ চুকিয়ে যাচ্ছিল সে আর তার মা। মালিকের জমিতে খাটতো ছেলে , আর মাকে করতে হতো ঘরের যাবতীয় কাজ। এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবরকম কাজ করতে হতো মা ও  ছেলে কে। বন্ধকী  ভিটের ঋণ শুধে চলছিলো বছরেরে পর বছর। ছেলেবেলা থেকে শ্যামলীর যাবতীয় আবদার মেটাতো সে, গাছ থেকে কাঁচা আম, ডাসা পেয়ারা, টোপাকুল বা পাকা তেঁতুল পেড়ে এনে দেওয়া থেকে, পুকুর থেকে শালুক / পদ্ম ফুল জোগাড়  করে আনা সবই অম্লান বদনে করতো। ভালই লাগতো শ্যামলীর আবদার মেটাতে। ক্ষুদে মেয়েটিও লুকিয়ে চুরিয়ে নিজের ভাগের থেকে ভালো মন্দ খাবার দাবার এনে তাকে খাওয়াতো। মায়ের কাছে বায়না করতো দাদাদের পুরানো জামাকাপড় ওয়াসেখ কে দেবার জন্য।  মা নিজেও ছিলেন গরীবঘরের মেয়ে, রূপের দৌলতে বড়বাড়ীতে বিয়ে হয়েছে। তাঁর নিজের ও ছেলেটির প্রতি একটা মমত্ববোধ ছিল।
---

এইভাবে বেড়ে উঠছিলো শিশুদুটি। শৈশব থেকে কৈশোরে উপনীত হলো দুজনেই। তাদের অবোধ ভালবাসা ক্রমাগত নূতন মোড় নিতে শুরু করেছে দুজনের আগোচরে। বাড়ীর সকলের নজর এড়িয়ে গেলেও প্রমাদ গুনলো দুই মা, সন্তানদের মানসিক পরিবর্তন তাঁদের অভিজ্ঞ চোখ এড়ালো না, আর ভয়ংকর ভবিষ্যত পরিণতির কথা ভেবে শিউরে  উঠলেন। শেষে একদিন শ্যামলী কে তার মা বললেন, "শোন তুমি এখন বড় হয়েছ, এখন থেকে আর ওয়াসেখের সাথে কথা বলবেনা, গ্রামের মেয়েদের সাথে মিশবে, গল্প করবে। " "কেন, শুধু মেয়েদের সাথে কথা বলবো, আর ওয়াসেখ কি দোষ করলো ?" "যা বলছি মন দিয়ে শোন, এখন থেকে সাবধান হও, তোমার বিয়ের বয়স হচ্ছে, কিছুদিন বাদেই হয়তো বিয়ের জন্য দেখাদেখি শুরু হবে, যাতে কেউ  কোন বদনাম দিতে না পারে খেয়াল রাখতে হবে।" "কিন্তু ও আমার জন্যে যা নিয়ে আসতে পারে, করতে পারে তা আর কি মেয়েরা পারবে। "মা বলেন "সে সব আমাকে বলবে, আমি আনিয়ে দেবো।" "ধূর তাতে কোন মজা নেই, আমার পছন্দ ও ছাড়া কেউ বুঝতে পারবেনা। ওর  মতো আমাকে কেউ বোঝেনা।"
---

মেয়ের কথাতে মায়ের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে, সন্ত্রস্ত হয়ে বলেন ," আস্তে ,আস্তে কথা বল, কেউ শুনলে কি ভাববে।"
" ভাবলে, ভারী বয়েই গেলো, তুমি ছাড়া ওর মতো কেউ আমাকে বোঝেনা,  ভালোবাসে না। " "চুপ, চুপ এসব বলতে নেই , এ বাড়ীর একমাত্র মেয়ে তুমি, কত আদরের। সবাই তোমার কথা কতো চিন্তা করে।" "হ্যা, ভালবাসে, আর চিন্তা করে! তাই আমি এতো ভালো পড়াশুনায়, আর আমার স্কুল বন্ধ করার জন্য প্রতিদিন শলা পরামর্শ চলছে। আর দাদারা ফি বছর ফেল করছে তাদের স্কুল যাওয়া নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তোলে না।"  "কিন্তু তোমার বিয়ের জন্যে সবাই কতো চিন্তা করে, কতো জল্পনা কল্পনা, তা দেখছোনা কেন। "
---
"এখনই বিয়ের কথা আসছে কেন, আর কিছুটা পড়লে দোষ কি। বিয়ে হলেই কি সুখ ! তুমি আর কাকিমারা কি সুখে আছো ! সারাদিন মুখ বুজে খাটছ, বাবা, কাকাদের সেবা করছো আর, হুকুম তালিম করছো , কি স্বর্গ লাভ করছো,  তারা বাইরে পোষা মেয়েমানুষের সাথে রাত কাটিয়ে ভোররাতে ঘরে ফেরে। " "ছিঃ বাবা, কাকাদের সম্পর্কে এসব কথা বলতে নেই , তারা তোমার গুরুজন না। " "দেখো মা গুরুজনরা গুরুজনদের মতো কাজ করলেই তাদের মান্য করে কথা বলতাম। কাকিমাদের বা তোমাকে তো আমি গুরুজন বলেই মান্য করি। বাকীদের সাথে কথা বলতেই আমার প্রবৃত্তি হয়না। এমন কি আমাদের জমিতে যে চাচারা কাজ করে তাদের ও আমি মান্য করি। " মা চুপ করে যান , মনে  মনে তিনি জানেন মেয়ে খাঁটি কথা বলেছে। তারা নিজেরা তো খাঁচায় বন্দী পাখী ছাড়া আর কিছু নন। কি অপমান আর মানসিক  যন্ত্রনাময় জীবন তাদের, মরে বেঁচে থাকা, যার কোন মানে নেই।
 ---

ওয়াসেখ কে তিনি মনে মনে স্নেহ করেন। পরিশ্রমী, সৎ, পরোপকারী ছেলে। কিন্তু ওরা তো মুসলমান, দিনমজুর। তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে কি করে হবে। মেয়ে যে তার প্রেমে পড়েছে একথা বাড়ীর বেটাছেলেদের কানে গেলে তো কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। ওয়াসেখ কে বাঁচতে দেবে না, মেয়ের ভাগ্যে যে কি বিপদ আসবে কে জানে ! " যাই হোক তোমার ওর সাথে মেলামেশার দরকার নেই। বাবা, কাকারা দেখলে তোমার বাড়ী থেকে বার হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ওর ও  জীবন সংশয় হবে, কাজেই সাবধান।" এতক্ষন শ্যামলী মায়ের সাথে তর্ক করছিলো, কিন্তু  এইবার সে চুপ করে যায়। সত্যি তার বাপকাকরাই নয় ভাইয়েরাও কম নয়। মানুষ কে মানুষ বলে মনে করে না। নিজেদের স্বার্থে  ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে মানুষ খুন করতেও তাদের হাত কাঁপে না। তার নিজের জন্যে ওয়াসেখের এত বড় ক্ষতি সে করতে পারবেনা।
 ---

 এদিকে ওয়াসেখের আম্মা ছেলেকে  নিয়ে পড়লেন, " এই তুই এক্ষণ আর বাচ্চা নেই, বাবুর বাড়ীর মেয়ের সাথে মেশা আর কথা বলা বন্ধ কর। " "কেন আম্মা ওর সাথে আমি ছোট থেকেই মিশি, ওকে আমার খুব ভাল লাগে। তুই বারণ করছিস কেন। " "শোন বাজান ও এখন বড় হয়েছে, বেয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে। দুদিন বাদে বে হয়ে যাবে, তুই ওর সাথে মিশলে লোকজন কলঙ্ক রটাবে। ওর বাপভাইরাও এটাকে ভাল চোখে দেখবেনা। ওর তো বিপদ হবেই, মোদের মা বেটাকে ঘরে আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে মারবে। " ওয়াসেখ চুপ করে যায়, তার নিজের জন্য সে ভাবেনা। কিন্তু আম্মার কিছু হলে সে অনাথ হয়ে যাবে। তাছাড়া শ্যামলীর বিপদ হলেও সে সহ্য  করতে পারবেনা।
---
দিন কতক তারা দুজন দুজনকে এড়িয়ে চললো। কিন্তু এই বিচ্ছেদ এতদিনকার বন্ধ দরজার দ্বার খুলে দিলো। দুজনেই দুজনের প্রতি প্রবল আকর্ষন অনুভব করতে শুরু করল। বুঝতে পারলো তাদের শৈশবের বন্ধুত্বে আজ নূতন রঙ লেগেছে। তারা দুজন দুজনকে ভালবাসে, কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা। শ্যামলী বুধ্ধিমতি। সে তার মাকেও কিছু বুঝতে দিলো না, বান্ধবীদের বাড়ী যাবার নাম করে লুকিয়ে চুড়িয়ে ওয়াসেখের সাথে দেখা করতে শুরু করলো।
ওয়াসেখ সবাই কে গোপন করলেও আম্মার নজর এড়াতে পারলনা। তিনি ভয়ে কাঠ হযে থাকলেন।
---

এদিকে শ্যামলীর বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে, পাত্র দেখাশোনা  চলছে। দুজনেই বুঝতে পারছে এবার কিছু ব্যবস্থা করতে না পারলে চলবে না।  নিজেদের মধ্যে দেখাশোনা স্তিমিত হয়ে আসছে, প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবার ভয়। শ্যামলী শেষে পরামর্শ দেয়, " শোন ওয়াসেখ, কলকাতায় তোর নানীর বাড়ী আছে না ? ওখানে তোর মামার ছেলেকে বল তোর জন্য একটা কাজ ঠিক করতে। আম্মাকে নানীর অসুখের নাম করে মায়ের কাছ থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে পাঠিয়ে দে। তারপর আমরা ওখানে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। " ওয়াসেখ বলে, "সে আম্মা আর তোর জন্য আমি সব করতে পারি। কিন্তু তুই এতো আরামে মানুষ, তুই কি আমাদের গরীব মানুষের মতো দুঃখকষ্ট  সহ্য করতে পারবি, ভালো করে ভেবে দ্যাখ। "
---

" আমার পরে তোর বিশ্বাস নেই ! আমিও তোর জন্য সব  সহ্য করতে পারব। তোর মামার তো বড় গ্যারাজ আছে। সেখানে নিশ্চয় তোর একটা কাজ জুটে যাবে। আমিও ধীরে সুস্থ্যে একটা কিছু হাতের কাজ জোগাড় করে নেবো।  মামাদের বস্তিতেই একটা ঘর নিয়ে  আম্মা, তুই আর আমি থাকবো। মামাদের কাছাকাছি থাকলে আম্মাও ভালোই থাকবে। " ওয়াসেখ বলে, " তোর উপর বিশ্বাস আছে, কিন্তু  তোর বাড়ীর লোকজন যা, তাতেই চিন্তা হয়। মামাদের অবস্থা আমাদের থেকে ভালো। মামা আর নানী আমাদের খুব ভালবাসে। মামার গ্যারাজে কাজ তো হবেই, আমাদের বিপদে পাশেও থাকবে। ঠিক আছে আমি তোর কথা মতো ব্যবস্থা করছি। "
---

একদিন ক্ষেত থেকে ফিরে ওয়াসেখ আম্মাকে বলে রাতের ট্রেনে কলকাতা চলে যায়। মামার সাথে সব ঠিক করে কাক  ভোরে ফিরে আসে। আম্মা ভয়ে কুঁকড়ে যান। কিন্তু ছেলের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধে বারণও করতে পারেন না। পরদিন মামাতো ভাই বুয়াকে নিতে আসে। ওয়াসেখ শ্যামলীর বাড়ী গিয়ে তার মাকে বলে "গিন্নিমা নানীর বাড়াবাড়ি অসুখ, আম্মাকে দেখতে চেয়েছে, দয়া করে আপনি একটু কর্ত্তাবাবুকে বলে দুদিনের ছুটি দিলে একটু নানীকে দেখে আসতে পারে, মামার ছেলে  নিতে এসেছে। " কর্তাবাবু ওয়াসেখকে  হাজার গন্ডা জেরা করে, অবশেষে  দুদিনের কড়ারে মত দেন। আম্মার সাথে কিছু অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে মামাতো ভায়ের সাথে কলকাতা পাঠিয়ে দেয়। আম্মা বেচারী ছেলেকে  বিপদের মুখে ফেলে যাওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে যান। সবাই  মনে  করে নানীর অসুখের খবরে তিনি ভেঙে পড়েছেন। ফলে কেউ কোন সন্দেহ করতে পারেনি।
---

গ্রামে সন্ধ্যে হলেই লোকজন ঘরে ডুকে যায়, সারাদিন খাটা খাটনির পর তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ে । বিশেষ করে শীতের রাতে পথে ঘাটে লোকজন কমে যায়। ওয়াসেখ চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে, পরিকল্পনা মাফিক রাত নটার ট্রেনের দুটি টিকিট কেটে স্টেশনে একটা গাছের আড়ালে অপেক্ষা করতে থাকে। এদিকে শ্যামলী ঘোমটায় মুখ ঢেকে চাদর জড়িয়ে কিছু কাপড়জামা পুটলীতে বেঁধে লুকিয়ে পালিয়ে আসে। ট্রেন এলে দুজনে একই কামরায় উঠে দুই প্রান্তে বসে পড়ে। ট্রেন যতোক্ষণ না শেয়ালদা স্টেশন পৌছায় চুপচাপ নিজেদের হৃতপিন্ডের আওয়াজ শুনতে থাকে। ট্রেন শেয়াল্দায় পৌঁছালে নেমে পড়ে, একসঙ্গে গেট দিয়ে বার হয়। বাসে উঠে রাজাবাজারে নামে। এতক্ষন কেউ কারোর সাথে কোন কথা বলেনি। এইবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
---

মামার বাড়ীতে সবাই জেগেই ছিল। আম্মা দুজন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। তাঁর হারানিধিকে ফিরে পেয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে। কি নিদারুণ আশঙ্কা তে যে কয়েক ঘন্টা কেটেছ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না। কথায় কথায় ভোর হয়ে আসে। মামা পরের দিন মৌলভী ডেকে দুজনের নিকা করিয়ে দেন। তারপর সবাই মিলে কালিঘাটে যান। শ্যামলীর মনের ইচ্ছা পূরণ করতে মন্দিরে মালা বদল করে দুজনের বিয়ে হয়। ওয়াশেখের মামার  গ্যারাজে গাড়ী সার্ভিসিং করাতেন এক নামী  উকিল বাবু । মামা তাঁর কাছে সব ব্যাপারে পরামর্শ করতেন। তিনি সব শুনে দুজনের আইনগত ভাবে বিয়ে করিয়ে দেবার পরামর্শ দিলেন। তাঁর সাহায্যে একমাস পরে তাদের রেজিষ্ট্রি করে বিয়েও হয়।
---

 ওয়াসেখ প্রবল উত্সাহে গ্যারাজে কাজ শিখতে শুরু করে এবং খুব দ্রুত তা আয়ত্ব করতে থাকে। মাস দুই পর একটা ঘর ভাড়া করে একই বস্তিতে। আম্মা আর বউ কে নিয়ে স্বাধীন সংসার শুরু করে। ইতিমধ্যে শ্যামলী আর আম্মাও বস্তির মেয়ে বউ দের সাথে মিলে বিড়ি বাঁধার  কাজ শুরু করে। খুব সছ্বলতা না থাকলেও মহা আনন্দে চলছিলো তাদের নূতন জীবন। শুধু মাঝেমাঝে একটা অজানা আশঙ্কায় শ্যামলী আর আম্মার বুক কেঁপে উঠতো। বস্তিবাসী অনেকেই তাদের জীবনের ইতিহাস জানতো, সবাই তাদের সাহস জোগাত "তোমরা ভয় করোনা চাচী, আমরা এত লোক আছি, কেউ তোমাদের চুলের ডগাও ছুঁতে পারবেনা। "

***********************

এদিকে শ্যামলীদের গ্রামে ভোর বেলা ঘুম ভেঙে দেখা গেল শ্যামলী নেই। চারিধারে খোঁজাখুঁজি  শুরু হলো। ক্রমে জানা গেল ওয়াসেখের ও খোঁজ নেই। শ্যামলীর মা বুঝলেন পাখীরা খাঁচা ভেঙে পালিয়েছে, কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। বাড়ীর বাকীরা  মনে করলো শ্যামলী বিয়ের ভয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ী চলে গেছে। ওয়াসেখের ব্যাপারটা মনে করলো, বোধহয় নানী কে দেখতে গেছে। পাছে যেতে বাধা দেওয়া হয় সেইজন্য না বলে চলে  গেছে। "আসুক ব্যাটা বজ্জাত, না বলে যাবার মজা দেখাবো। আগে সব আত্মীয়ের বাড়ীতে চুপেচাপে শ্যামলীর খোঁজ করো সকলে। "বেশী লোক জানাজানি হয় যেন " - বাড়ীর কর্তা নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলোনা।
---

এদিকে ওয়াসেখের ও কোন পাত্তা নেই। বাড়ীর বাকীদের টনক নড়লো। দুয়ে দুয়ে চার করে ফেললো। কিন্তু দোষীরা নাগালের বাইরে। "হাতের কাছে পেলে কুঁপিয়ে রেখে দেবো সব কটাকে, বুড়ি টাকেও ছাড়বনা "-- নিঃস্ফল আক্রোশে বাড়ীর কর্তারা হাত কামড়াতে থাকলো। বউদের বাপ বাপান্ত করতে লাগলো, "একটা মাত্র মেয়ে কে সামলে রাখতে পারলি না তোরা।" বিস্তর লাথি ঝাঁটা জুটলো তাঁদের কপালে।শ্যামলীর মা বেধড়ক মার খেযে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।শুধু  মনে প্রাণে চোখের জলে প্রার্থনা করতে লাগলেন যেন পলাতকরা ধরা না পড়ে। তন্ন তন্ন করে খোঁজ খবর চলতে লাগলো। প্রায়  সারা জেলা তোলপাড় করে চষে ফেলা হলো। মাস ছয়েক পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের  ভিত্তিতে পলাতকদের হদিশ পাওয়া গেলো।
---

সদলবলে গিয়ে হানা দিলো রাজাবাজার বস্তিতে। তখন ওয়াসেখ ছিল কাজে। শ্যামলী গেছিলো বিড়ি বাঁধতে। আম্মা বাড়ীতে রান্নায় ব্যস্ত। অসহায় প্রবীণ মহিলার উপর হম্বিতম্বী শুরু হয়ে গেলো। তিনি ভয়ে নির্বাক মুখে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।  কিন্তু চেঁচামিচি শুনে আশেপাশের ঘরের মহিলারা ভীড় করলেন। খবর পেয়ে শ্যামলী ওয়াশেখদের খবর পাঠিয়ে দৌড়ে বাড়ী এলো। এদিকে ওয়াসেখ মামাতো ভাই, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাজির। মারমুখো জনতার সামনে চুপসে গেলো শ্যামলীর পরিবারের লোকজন। "এটা আপনাদিগের গাঁও নয় , যে যা মনে হয় তাই করবেন  " - বস্তির একজন  বৃদ্ধ মানুষ বললেন। ছেলে ছোকরা তো এই মারে কি সেই মারে, বয়স্করা তাদের আটকে রাখলেন।
---

"আমরাও দেখাচ্ছি মজা, জেলের ঘানি যদি না টানিয়েছি  সবকটাকে তাহলে নিজেদের নাম বদলে দেবো," - বলতে বলতে তারা পালিয়ে বাঁচে। "হ্যা হ্যা নিজেদের নূতন নাম ভাবতে থাকুন, আর কি করতে পারেন আমরাও দেখছি " - তরুনরা ফুঁসে ওঠে। ওয়াসেখের মামা শ্যামলী আর ভাগ্নেকে নিয়ে তাঁর  সেই উকিল খরিদ্দারের কাছে গেলেন। সব শুনে তিনি বললেন," ওরা ছেড়ে দেবেনা, থানা পুলিশ করবে, কেস ও করতে পারে। তোমরা তৈরী থাকো।" শ্যামলীকে বিশেষ ভাবে বলে দেন,  "তোমার বাপের বাড়ীর কেউ কিছুতে সই করতে বা টিপ  ছাপ দিতে বললে, একদম করবেনা। থানায় কেউ বললেও করবেনা। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলবে তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেছ, আর সামাজিক মতে এবং আইনগত ভাবে তোমাদের বিয়ে হয়েছে। কোর্টে কেস করলেও জজের সামনেও একই কথা বলবে। কিছুতেই বাপের বাড়ীতে ফিরে যাবেনা। মিষ্টি কথায় বোঝালেও কখনো রাজী হবেনা। অন্যথায়ে ওয়াসেখ আর তার আম্মার সাত বছরের জন্য জেল হয়ে যাবে। "
 ---

 সেই রাতেই রাজাবাজার থানার পুলিশ এসে শ্যামলী, ওয়াসেখ ও তার মাকে ধরে নিয়ে যায়। সারা রাত ধরে ওয়াসেখ কের উপর অকথ্য নির্যাতন চলে। শ্যামলী ও আম্মা ওপর  মানষিক নির্যাতন হয়। পরদিন সকালে সারা বস্তি ঝেঁটিয়ে লোকজন গিয়ে থানা ঘেরাও করে। পুলিশ বাধ্য হয় শেয়ালদা কোর্টে তাদের নিয়ে যেতে। ওয়াসেখ ও তার আম্মাকে জোর করে নাবালিকা কে হরণ করার চার্জ দেওয়া হয়। ওয়াসেখের মামা সেই উকিলের সাহায্যে কেস লড়ার জন্য প্রস্তুত ই  ছিলেন। তার উকিলবাবু  বিবাদী পক্ষের তরফে বাস্তব ঘটনা কে তুলে ধরেন । উভয় তরফের মতামত শুনে জজ এক মাস পরে শুনানির দিন ধার্য্য করেন ও তিনজনের  জেল কাস্টডি মঞ্জুর করেন।
---

জেলে প্রথম দিন এসে শ্যামলীরা  হকচকিয়ে যায়। এক একটা ঘরে গাদিয়ে ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্কা মানুষে ঠাসা। সোজা ভাবে শোবার জায়গা নেই। ঘরের কোনে আধা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায়  মলমূত্র ত্যাগ করতে হয় সকল কে। দুর্গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি উল্টে আসে। লম্বা লম্বা লোহার দরজা, বাইরে থেকে তালাবন্ধ। সকালে ঘন্টা ৫/৬, বিকালে ১/২ ঘন্টা খোলা হয়, স্নান করা, খাবার খাওয়ার জন্যে। সকালে এক টুকরো পাউরুটি, বা একমঠো মুড়ি বা পোকা ছোলা সেদ্ধ। দুপুরে এক ডাব্বু ভাত, ডালের জল, বুড়ো হয়ে যাওয়া, পোকা পরা তরকারির ঘ্যাট। বিকালে তিনটি কাঁচা কাঁচা জোয়ার/বাজরার রুটি আর সেই ডালের জল ও  ঘ্যাট। কোনমতে গলার্ধ্বকরণ করে নিয়ে খাবারের থালায় রাতের খাওয়ার জল নিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকে যেতে হত। খাওয়ার জন্য একটা আলুমুনিয়ামের থালা আর শোবার জন্য একটা কম্বল বন্দীদের প্রাপ্র্য ছিল।
---

সরকারী হিসাবে বরাদ্দ জিনিস আর খাওয়ার  পরিমাপ যাই থাকুক অসৎ কর্মচারী, ওয়াডার, আর মেট্রন তার থেকে অনেকটাই খাবলা মারত। তার পরে ছিল একদল দালাল বন্দী, যারা অসৎ মেট্রন, ওয়াডারদের অঙ্গুলিহেলনে সাধারন বন্দীদের খাবার মারা থেকে মারধোর সব রকম অত্যাচার চালাত। কেউ কোন প্রতিবাদ করলে তো কথাই নেই, পান থেকে চূন খসলেই ওয়াডার আর দালালরা মিলে বন্দীদের নির্মমভাবে মারধোর করতো। শ্যামলী ও আম্মা নীরবে তাদের পরস্থিতি কে মেনে নিতে বাধ্য হলো। আম্মার তবুও ভূখা থাকা, কষ্ট  সহ্য করার অভ্যাস ছিলো। কিন্তু শ্যামলী আরামে মানুষ, তার উঠতি বয়স। তার পক্ষে এসব, বিশেষ করে ক্ষিদে সহ্য করা ছিল এক নিদারুন পরীক্ষা।  
---

থানা, কোর্ট, জেল সবখানেই শ্যামলী ওয়াসেখ কে স্বামী আর তার আম্মা ও মামাকে অভিভাবক হিসাবে ঘোষণা করেছিল। মামার বাড়ী থেকে কেউ না কেউ তাদের সাথে প্রতি সপ্তাহে দেখা করতে আসত, প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র, খাবার দাবার সাধ্য মতো নিয়ে আসত। কিন্তু তার অনেকটাই দালাল বন্দী আর ওয়াডারা হাতিয়ে নিতো। তার বাবা, কাকা বা ভাইদের সাথে কিছুতেই সে দেখা করতো না। একদিন বাবা মাকে নিয়ে এলো আর দেখা করার স্লিপে মায়ের নাম দিল। শ্যামলী মায়ের খাতিরে দেখা করতে এলো। বাবা অনেক তর্জন গর্জন করলো, " শোন এবার কোর্টের দিনে জজের সামনে বলবে, তোমার অনিচ্ছায়  সে  তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছে, তুমি বাবামার কাছে ফিরে যেতে চাও।"
---

"না তা আমি কখনই বলবো না, মেরে ফেললেও না, তাছাড়া ওয়াসেখের তো কোনো দোষ নেই, আমিই ওকে জোর করেছি, আর  আমার বুদ্ধিতে ই সব হয়েছে। ওকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালবাসি,ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তোমাদের কাছে আমি কখনই ফিরে যাব না। মেয়েদের সাথে তোমরা পশুর চেয়ে অধম ব্যবহার করো। মা কাকিমা দের তো তোমরা মানুষ বলেই মনে করো না। ওয়াসেখ রা তোমাদের থেকে অনেক গুন ভালো, একদম অন্যরকম। " "বড় বাড় বেড়েছে তোমার। সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, খুব বড় বড় কথা শিখেছো না। দাঁড়াও  তোমাদের আমি কি করি শুধু দেখো, একেবারে খুন করে ফেলবো। "
 ---

"খালি খুন, অন্যের ঘরে আগুন দেওয়া, লোক ঠকানো এসব কাজই সারা জীবন ধরে করে আসছো। যা পারো কর, আমি কোনমতেই তোমাদের বাড়ী কেন গ্রামেই ফিরবনা। ভবিষ্যতে আমার সাথে খবরদার দেখা করার চেষ্টা করবেনা,"- বলে সদর্পে ওয়ার্ডে ফিরে আসে শ্যামলী।
---

আম্মা আর বাকী বন্দিনীদের সব গল্প করে। আম্মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন, আশীর্বাদ করতে থাকেন বার বার। বাকিরা তাকে সাহস যোগায়। আর একজন তার মত লাভ কেসে বন্দিনী বলে, " সাবধান, এরপর তোমার বাবা মিটমাট করে নিতে চাইবে, বলবে তোমাদের তিনজনকে ছাড়িয়ে গ্রামে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেবে। খবরদার সে কথায় ভুলো না যেন। আমার এক বান্ধবী কে তার বাবারা এরকম বলে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। পরে ছেলেটা কে মেরে ফেলে, মেয়ে কে আবার জোর করে বিয়ে দিয়ে দ্যায়। স্বশুরবাড়ীর অত্যাচারে শেষে সে গলায় দড়ি দ্যায়। " শুনে শ্যামলী শিউরে ওঠে।
---

একমাস পরে কেসের দিন কোর্টে জজের সামনে তোলা হলো বিবাদী পক্ষ কে। দুই পক্ষের উকিল উভয় তরফ থেকে বক্তব্য রাখলো। জজের প্রশ্নের উত্তরে শ্যামলী পরিস্কার সতেজ কণ্ঠে বলল, " হুজুর, আমি নিজের ইচ্ছায় বাপের ঘর থেকে চলে এসেছি। আমাকে কেউ জোর করে নিয়ে আসেনি, বরং আমার পরামর্শেই  সব ঘটনা ঘটেছে। আমি ওয়াসেখ আলীকে ভীষণ ভালবাসি। ও আর ওর আম্মা খুব ভাল লোক। কলকাতায়ে এসে আমাদের তিন বার বিয়ে হয়েছে, একবার মৌলভী সাহেব নিকা করিয়েছে, তারপর কালিঘাটে হিন্দু মতে বিয়ে হয়, শেষে রেজিস্ট্রী করে বিয়ে হয়েছ। এখন আমরা স্বামী স্ত্রী। ওয়াসেখকে  ছাড়া আমি বাঁচবো না। ওকে আমাদের গ্রামের সবাই ভালবাসে। ও কখন কোন খারাপ কাজ করেনি, সবাইয়ের কত উপকার করেছে। রাজাবাজার বস্তির সবাই এই ছয় মাসেই ওকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমি সারা জীবন ওর সাথেই থাকতে চাই। বাপের ঘরে কখনোই ফিরবনা, আমার বাপ,কাকা ভাইরা খুব খারাপ লোক। গ্রামের সব মানুষের উপরে অন্যায় অত্যাচার করে। "
---

বাদী পক্ষের উকিল বলে : ধর্মাবতার, শ্যামলী এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি, ওয়াসেখ প্রাপ্তবয়স্ক। কাজেই সেই ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে ভাগিয়ে এনেছে। " "হুজুর আমি ওয়াসেখের থেকে এক বছরের বড়, গ্রামের সকলে একথা জানে। আমার মা থাকলে শপথ নিয়ে কখনো মিথ্যা কথা বলবেনা। তাই কোন শাস্তি হলে আমারই  হওয়া উচিত। হুজুর, আমার স্বামী দিন আনে দিন খায়। সে যদি আটক থাকে, তাহলে আমাদের কেস চালানোর টাকা জোগার করা মুস্কিল, আপনি আমাকে আটক রেখে ওকে আর আম্মাকে ছেড়ে দিন। " অনেক টানা হ্যাচড়ার পর জজ হাজার টাকা জামিনের ভিত্তিতে ওয়াসেখ ও তার মাকে মুক্তির রায় দেন। আর শ্যামলীকে সেফ কাস্টোডি হিসাবে পরবর্তি শুনানির পর্যন্ত জেলে রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তি শুনানিতে শ্যামলীর মাকে হাজির করানোরও  নির্দেশ দেন।
---

কিন্তু ওয়াসেখের মামার পক্ষে দুজনের জন্য দুহাজার টাকা জোগাড়  করা মুস্কিল। নেহাৎ ঘনিষ্ট পরিচিতির সুবাদে তাদের উকীল বিনা পারিশ্রমিকে  কেস লড়ছেন। এদিকে আম্মা শ্যামলীকে জেলে একা ফেলে রেখে বার হতে রাজী নন। তাই শুধু ওয়াসেখের জামিন করানো হয়, যাতে সে বাইরে এসে গ্যারাজের কাজে লাগতে পারে, সেই সঙ্গে কেসের পেছনে দৌড়ঝাঁপ  করতে পারে। শ্যামলী আর আম্মা জেলে ফিরে যায়।
---

এদিকে শ্যামলীর বাবা পয়সা খাইয়ে ক্রমাগত নানা অজুহাতে কেসের দিন পিছাতে থাকেন। চরম কষ্টের মধ্যে জেলে আম্মা আর শ্যামলীর দিন কাটতে থাকে। ওয়াসেখ কোর্ট আর জেল দুইখানেই যাতায়াত করতে থাকে, যতক্ষণ গ্যারাজে কাজ করতে পারা সম্ভব কাজ করে। নিজের নাম মাত্র পয়সায় দিন গুজরান করে, জেল আর কোর্টের খরচ যোগানোর জন্য, আর  হাতে করে কিছু শ্যামলী আর আম্মার জন্য নিয়ে যাবে বলে। কোর্টে গিয়ে নিয়মিত কোর্টবাবুকে তাগাদা দিতে হত, চাবিস্কুট খায়ানো তার অঙ্গীভূত ছিল। বস্তি বাসী তাকে খাবার দাবার দিয়ে সাহায্য করতো। মামারা তো নানা ভাবে সাহায্য করতেনই । ওয়াসেখ সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল, কিন্তু তার আত্মসন্মানে লাগতো। কোর্টে চক্কোর লাগাতে লাগাতে সে বুঝতে পারছিলো সেখানে টাকা পয়সার খেলা চলে। ঘুষ দিয়ে কেসের দিন আগুপিছু করা যায়। সে আস্তে আস্তে সেখানে পরিচিতি বাড়াতে লাগলো। তার মিষ্টি ব্যবহারে অনেকেই তাকে সাহায্য করতে শুরু করল।
---

বছর প্রায় ঘুরতে চললো। শ্যামলীর বাবা আর একবার তার মাকে নিয়ে দেখা করতে এলো, এক নূতন চাল খেলার জন্য। শ্যামলীর মা সরল বিশ্বাসে স্বামীর শেখানো কথা বললেন, "দ্যাখ মা তোর বাবারা তোদের বিয়ে মেনে নেবে, কেস তুলে নেবে। জেল থেকে বেরিয়ে আমাদের সাথে তোরা গ্রামে ফিরে যাবি, সেখানে গ্রামের লোকের সামনে তোদের বিয়ে দেবে। ওয়াসেখের ঘরটা নূতন করে তুলে দেবে, তোদের নামে কিছু জমিজিরেত লিখে দেবে, তোরা তোদের মতো থাকবি, আমরাও তোদের কাছে ফিরে পাবো। " মুহূর্তের জন্য শ্যামলীর মনটা দুলে উঠলো। পরক্ষণে উকীল বাবুর সতর্ক বাণী আর সহবন্দিনীর বন্ধুর পরিণতির কথা মনে পড়ল। কঠিন গলায় বললো, "না আমরা কোন মতেই গ্রামে ফিরে যাবনা। মা তুমিতো বাবাদের চেনো, বুঝতে পারছোনা এটা একটা নূতন চালাকি। আমাদের তিনজন কে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে গ্রামে নিয়ে গিয়ে খুন করার মতলব। " মা মনে মনে বুঝলেন মেয়ে ঠিক ই বুঝতে পেরেছে। তিনি চুপ করে গেলেন।
---

তখন সত্তরের দশক, গ্রামে গ্রামে কৃষকরা জোতদার/মজুতদার দের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠছে, জমি জায়গা নিয়ে, নিজেদের অধিকার নিয়ে সজাগ হতে শুরু করেছে।  দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় ছুটে আসা মুশ্কিল। তাই গৌরাঙ্গ মণ্ডল নূতন আর একটা চাল খেললেন। উকীল কে কোর্টে কেসের দিন ফেলতে বললেন। আর শ্যামলীর মাকে শেখালেন ," মন দিয়ে শোন, কোর্টে জজের সামনে বলবি যে শ্যামলীর বয়স সতেরো আর ওয়াসেখের বয়স আঠারো। ওই আমাদের মেয়েকে ফুসলে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। আর ও খুব খারাপ ছেলে। মা ছেলে মিলে মেয়েদের এই ভাবে ফুসলে নিয়ে এসে দুদিন ভোগ করে কোথায় বিক্রী করে দেবে। এটাই ওদের ব্যবসা। আমদের মেয়েকে ও তাই করবে। একটা কথা যদি বেঁফাস বলেছিস তো বাড়ী গিয়ে তোকে খুন করে ফেলবো। " মা বেচারি নিরুপায়, চুপ করে থাকলেন।
---

কয়েক দিনের মধ্যেই কোর্টে কেসের দিন পড়লো। শ্যামলী আর আম্মা পুলিশের ভ্যানে কোর্টে এলো।  এদিকে ওয়াসেখ তার মামা আর উকিলের সাথে হাজির। কিছুক্ষণ পরে কোর্টের মধ্যে বাদী/বিবাদী পক্ষের ডাক পড়লো। শ্যামলীর মা কাঁপতে কাঁপতে কাঠগড়ায়  উঠলেন । নিস্তব্ধ কোর্ট ঘর। তিনি কাঁপা গলায় শপথ নিলেন। জজের প্রশ্নের উত্তরে একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। শ্যামলী, ওয়াসেখ আর আম্মার বুকে হাতুরি বাড়ি পড়তে লাগলো। তারপর হটাত তিনি  যেন সম্বিত ফিরে পেলেন।
---


পরিস্কার গলায় উত্তর দিলেন, "হুজুর আমার মেয়ের বয়স আঠারো হয়ে গেছে। ওয়াসেখের আম্মাই আমার দাই ছিলো। শ্যামলীর জন্মের এক বছর পরে ওয়াসেখের জন্ম হয়। ও আমার মেয়ের থেকে ছোটো। ও আর ওর আম্মা খুব ভালো লোক। ওরা কখনোই শ্যামলীর অমতে জোর  করে কিছু করতে পারেনা, এ আমার দৃড় বিশ্বাস। আমি খুব খুশী হয়েছি যে আমার মেয়ে ভালোঘরে, ভালো বরের হাতে পড়েছে। ওরা গরীব হলেও মানুষের মতো মানুষ। আমার শ্যামলী খুব আনন্দে থাকবে। আমি ও খুব খুশী ওদের বিয়েতে।  হয়তো জীবনে আর কোন দিন ওদের আমি দেখতে পাবোনা। এখান থেকেই ওদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করছি।" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে তিনি চোখে আঁচল চাপা দিলেন। সারা কোর্ট ঘর নিঃশ্চুপ, বাদী বিবাদী দুই পক্ষই  হতভম্ব।
---
 জজ তাঁর রায়ে , তিনজনকেই বেকসুর খালাস করে দিলেন। ওয়াসেখরা গিয়ে শ্যামলীর মায়ের পায়ে হাত প্রণাম করলো। শ্যামলী মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো, "মা, তোমার জন্যই আমার যত দূর্ভাবনা, বাবা যে তোমাকে কি করবে, সেটাই ভয়। " মা কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন, " ভয় পাস  না মা, আমিও আর কাউকে ভয় করি না। সারা জীবন মরে বেঁচে ছিলাম। এবার বাঁচতে হলে মাথা তুলেই  বাঁচবো। "

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

 

2 Feb 2017

মহান কবি নাজিম হিকমত কে

1st February 17


 মহান  কবি নাজিম হিকমত কে
*************************

 হে আমার প্রিয় কবি নাজিম হিকমত, কবে আসবে সেই সুসময়
 যেদিন দেয়ালে পিঠ ঠেকে  যাওয়া অগনিত মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াবে।
--
কবে আসবে সেই সুসময়
যেদিন সব পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবে মানুষের মন ,
জীবন্ত লাশ নয় মানুষ হয়ে উঠবে ঝকঝকে ইস্পাতের ফলক।
--
কবে আসবে সেই সুসময় 
যেদিন বন্ধ হবে রোজকার রক্তের হোলি খেলা,
অগনিত পাখীর সবথেকে মধুর কাকলীতে ভরে উঠবে বাতাস ,
--
কবে আসবে সেই সুসময়
যেদিন সমুদ্র হয়ে উঠবে সবথেকে উত্তাল ,
সবথেকে রঙিন প্রজাপতিরা ফুলে ফুলে মধু সঞ্চয় করবে।
--
কবে আসবে সেই সুসময়
যেদিন মাতৃগর্ভে জন্ম নেবে সবথেকে সুন্দর শিশুরা ,
সবথেকে উজ্জ্বল তারারা জয়্জযন্তির মূর্ছনায় মাতিয়ে দেবে মহাবিশ্বকে।
--
কবে আসবে সেই সুসময়
যেদিন সমুদ্রে স্নান করে সবথেকে রক্তিম সূর্য্য রাঙিয়ে দেবে পৃথিবীকে,
মানুষ হয়ে উঠবে প্রকৃত মানুষ, পরিপূর্নতা লাভ করবে মানব সমাজ।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এই কবিতা টি1. 2. 15 তারিখে লেখা কবিতার নতুন ভাবে লেখা, কোন এক কবি বন্ধুর মূল্যবান মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে।