9 Nov 2016

দিশারী - পর্ব 6

দিশারী - পর্ব ৬
************
প্রায় তিনটে বছর পার হয়ে গেল। দিশারী বাড়ীর  জন্য প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখিয়ে যায়। আশায় থাকে একদিন বাড়ীর লোক ঠিক চিঠি পেয়ে তাকে নিতে আসবে। কিন্তু মনে সন্দেহ রয়ে যায় চিঠি ঠিক জায়গায়  পৌঁছাচ্ছে না, কারন বোঝে ঠিকানা টাই সে ঠিক মত বলতে পারছে না। ইতিমধ্যে হটাৎ করে রশ্মি ছাড়া পেয়ে যায়। হাওয়ায় কথা ভাসে, সে নাকি লাইনে নেমেছে। কারণ ইদানিং সুইপার লছমীরানীর আর কুখ্যাত এক জমাদারনীর সাথে তার খুব ঘনিষ্টতা বাড়তে দেখা গেছিল। আলো মাসী তাকে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে কথা শুনতো না, ওই দুজনের সাথে মেয়ে পাচারকারী চক্রের যোগাযোগ আছে বলে অনেকে সন্দেহ করত।
--
জেনানা ফটকে তিন জন মহিলা সুইপার আসতো - শ্যামবাই, ছোট লছমীবাই আর বড় লছমীবাই। বড় লছমীবাইকে মেট্রন গোষ্ঠী লছমী রানী বলে ডাকত। সে অন্য দুজনের তুলনায় বয়স্ক আর সবচেয়ে পুরান লোক ছিল। কর্তৃপক্ষের খুব কাছের মানুষ, তাদের অনেক কুকর্মের ভাগীদার। তাই সাধারণ বন্দীরা তার থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করত।
--
রশ্মি লাইনে নেমেছে, একথা মানতে দিশারীর মন চাইত না, "রশ্মি দেহ বেচে খায়। এ হতে পাইরে না।" বছর ঘুরতে না ঘুরতে একদিন রশ্মি আরও কয়েকটি মেয়ের সাথে জেলে এল। তার সাজগোজ, ধরণ ধারণ ই পালটে গেছে, এখন তার নাম লীনা। দিশারীর কাছে সে কিছু গোপন করল না, বলল,"আমাদের মাসী তো কালই আমাদের ছাড়িয়ে নেবার ব্যবস্থা করবে। তুই চাইলে তোকে বার করার ব্যবস্থা করতে পারি। নাহলে তোকে এই জেলেই পচে মরতে হবে। আসবি দুজনে একসাথে থাকব।" ঘৃনায় দিশারী মুখ ঘুরিয়ে নিল,"ছিঃ! দেহ বেচার চে জেলে পইচে মরাও ভাল।" রশ্মি মুখ বেজার করে সরে গেল। পরদিন তারা ছাড়া পেয়ে গেল। এরপর সে আরও এক দুবার জেলে আসে, ১/২ দিনে ছাড়াও পেয়ে যেত।
--
একদিন মা র মুখে শুনল তাদের সাত জন ছেলে শেয়ালদা কোর্ট থেকে কেমন করে পালিয়েছে। শুনে দিশারী দারুন খুশি, "বেশ হইছে।পেইলে যাবার ঠিক জায়গা বেইচেছে। ওহানে যা নোকজন এক্কারে থই থই কইরতেছে। একবার  ভীড়ে মিসে জাতি পাইরলে, কে ধইরবে। মারে,আমারে যদি একবার শেলদা কোটে নে যায় তো ওই ভীড়ে আমিও পেইলে যাব, তুই দেইখিস ক্ষণে। "
--
একদিন দিশারী গরাদের ওপার থেকে উত্তেজিত গলায় ডেকে বলে,"হই শুইনেছিস, মোর শ্বহুরবাড়ীর গেরামের এক বুবু এইসেছে, সে মোর স্বামীদের ঘর ভাল চেইনে, মোদের কথা হবি নাকি জাইনে, মোরে বইলেছে ছেইড়ে নে যাবে।"
"বাঃ, এতো ভাল কথা। তা কি কেসে জেলে এসেছে, নাম কি ?" "দাঁইড়ে থাক, ডেইকে আইনতেছি, অ তুলসী বুবু, এপাশে এইসতো, মোর মা ডাইকতেছে।" একজন আধা গ্রাম্য আধা শহুরে মহিলা এসে দাঁড়াল।" মাসী, তুমি দিশারীর শ্বশুর ঘর চেন ?" "হ চিনিত,ওদের গুষ্টিগোত্তর সব জানি।" "তুমি কি কেসে এসেছ ?" "পেটের দায়ে গাঁ থেইকে আনাজ পত্তর এইনে শহরে বেচি। মাস ফুইরে গেইছে খ্যাল ছিলনি, নূতন মাসিক টিকিট কাটা হইনে, তাই ধইরেছে।"
"কিন্তু ওকে কি  ওর স্বামী ঘরে নেবে।" "নারে মা, সোয়ামির ঘর আমি যাবনি, শেলডা ইস্টিশনে মাসি নে যাবে, আমি বাপ্ মায়ের ঘরে চইলে যেইতে পাইরব।"
--
তুলসী মাসি দিন সাতেক সাজা খেটে বেরিয়ে গেল। দিশারী কে বলে গেল সে তার গ্রামে গিয়ে ফকির মিঞার সাথে সব কথা বার্তা বলে ঠিক করে রাখবে। প্রথমে তার নিজের স্বামী কে ইন্টারভিউ করতে পাঠাবে, তারপর কোর্ট ফেলার ব্যবস্থা করে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে, শেয়ালদা থেকে সে তার নিজের বাড়ী যেতে পারবে। প্রায় একমাস বাদে দিশারীর ইন্টারভিউ এল। সবাই খুশী। দিশারী মুখে হাসি, চোখে আনন্দের ঝিলিক। ডগমগ হয়ে ইন্টারভিউ তে গেল। কিছক্ষন বাদে সে যখন ফিরে এল, সমস্ত আলো মুছে গেছে, কপালে চিন্তার ভাঁজ।
--
সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল,"কিরে, কি হইল, কে এইসেছ্যাল, কি বইল?" দুটো ভারিক্কি গোছের নোক এইছ্যাল। তার মধ্যি একজন কইল বুবুর সোয়ামি, অন্যজনে তার পাড়ার নোক।" "ত তুই মুখটা অমন কালোপানা  কইরেছিস ক্যানে ? তোর বাপেরে খপর দ্যাছে ? তোরে ছাড়ায়ে নে যাবেনি ?" " কি জানি মোর কপালে কি আছে," বলে দিশারী থম মেরে বসে রইল।
--
ডিভিশন বাড়ীর দিদিরাও দিশারীর অপেক্ষায় ছিল," আর কি হল বলবি তো, চুপ করে আছিস কেন ?"
"জানিসনে ত, বুবুর সোয়ামীরে শুইধেছি, বাপেরে বুবু কি খপর দেছে, শুধু ঘাড় নেইরে হ্যা বইলে, মোর বাপমা মোর কথা কি বইলেছে স্যা সব বইলেনি। সোয়ামীর কথা যেই শুইধেছি, অন্য নোক টা বইল, তুমি তো বে হইছে স্যাই কথা চেইপে গেইছ।" "আরে, অ তো নামে মাত্তর বে।" "বুবুর সোয়ামি আমারে বইল, তর কোর্ট পৈরবে, কেউ জানতি চাইলে বৈলবি আমি তর পিশা।"
--
শুনে  শুনে সবাই গম্ভীর হয়ে গেল, ব্যাপারটা সন্দেহজনক, তুলসীরা সম্ভবত কোন দালাল চক্রের সাথে যুক্ত। দিশারীর মুখে তার জীবনের কথা শুনে চাল চেলেছে আর বানানো গল্প করেছে। " তুই ঠিক সন্দেহ করেছিস। জজের কাছে তোকে তুললে তুই সোজা বলে দিবি চিনিনা।" আশ্চর্য্য বিষয় দিন তিনেক পরেই দিশারীর কোর্টের দিন পড়ল এতদিন জেলে পচার পর। দিশারী কোর্টে গেল, কিন্তু আর ফিরল না। ওর সাথে আর যারা সেদিন কোর্টে গেছিল, তারা খুব পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারল না। দু /একজন শুধু বলল দিশারীকে জজের কাছে তোলেনি, লক আপ থেকে খালাস বলে বার করে দিয়েছে। শঙ্করীকে ছাড়াতে তার আসল বাবা মা মাসের পর মাস উপযুক্ত প্রমান সমেত থানা, কোর্ট আর জেল এ চক্কর কাটতে কাটতে জেরবার হয়ে গেছিল। অথচ দিশারীকে অনায়াসে খালাস করে দিল ! কোন প্রভাবশালী চক্র এর পেছনে কি কাজ করল ! তার ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা অজানাই থেকে গেল ! রয়ে গেল বিরাট একটা প্রশ্নচিন্হ।       ++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

 দিশারী - পরিশিষ্ট
 *************
 হাসিনা আমার জেলের মেয়ে। কিন্তু দিশারী আমার মানসকন্যা। তাই তার সেই কথাটাই আমার কানে বাজে," মারে,  আমারে যদি একবার শেলদা কোটে নে যায় তো, ওই ভীড়ে আমিও ঠিক পেইলে যাব, তুই দেইখিস ক্ষণে।"    
 --
১৯৭৭ সালে সরকার পরিবর্তিত হল। ভোটের সময়ে ঘোষিত তাদের রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির কর্মসূচি কার্য্যকর হল। আমরা বার হলাম। তার বেশ কিছু সময় বাদে একটা খবরের কাগজে একটন খবর বার হয়, নারীপাচার চক্রের একটা দল ধরা পড়েছে। বড় লছমীবাই মা সেজে একজন কে ছাড়াতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে । সে নাকি তার স্বীকারক্তিতে জেল কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মচারী / কর্মচারিনী আর মেয়ে জমাদারনীর নাম বলে দেয় এবং রাজস্বাক্ষী হতে রাজী হয়। তাকে প্রেসিডেন্সি জেলেই রাজসাক্ষী হিসাবে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষী দেবার আগেই ভাটি ঘরে কাজ করতে গিয়ে তার গায়ে আগুন লেগে যায়, এমন বীভৎস ভাবে পুড়ে মারা যায় যে সে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দেবার সুযোগ টুকুও পায়নি। কিভাবে তার  আগুন লাগে, সেও এক বিরাট প্রশ্নচিন্হ !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++                                                                 


  
















      


























No comments:

Post a Comment