4 Nov 2016

দিশারী - পর্ব 5

দিশারী - পর্ব ৫
**********

ধীরে ধীরে দিশারীর বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মায়ের মত স্নেহ প্রবন আলো মাসি, রশ্মি,শ্যামবাই, সমেদা। তবে আলোমাসি আর শোভা তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। হাজতী নম্বর ছাড়াও আরও ওয়ার্ড ছিল - মেয়াদী নম্বর, জাল ঘর, পাগল বাড়ী, ডিভিশন ওয়ার্ড, সেল। শোভার কাছে শুনল ডিভিশন ওয়ার্ডে আর উপরের একটা সেলে রাজনৈতিক বন্দীরা থাকে। তাদের সাথে কাউকে কথা বলতে দেখলে মেট্রন, কিছু ওয়ার্ডার আর দালাল রা মারধর করে।
--
আগে নাকি শিখা বলে একটি ভয়ংকর হিংস্র একটা দালাল ছিল, তার নেতৃত্বে আর মেট্রনের নির্দ্দেশে দালাল বাহিনী কত মানুষ কে যে অমানুষিক মার মেরেছে, এমনকি মেরেও ফেলেছে তার হিসাব নেই। তাছাড়া বন্দিনীদের খাবার মারত আর বাড়ীর লোক দেখা করতে এসে কিছু দিয়ে গেলে কেড়ে নিত। জেল কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আর মেট্রনের প্রিয়পাত্রী ছিল, তাদের সব ঘৃণ্য কুকর্মের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল। সে থাকতে সাধারণ বন্দিনীরা তো বটেই কিছু ভালমানুষ ওয়ার্ডার ও তটস্থ থাকত।
--
 মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল কলকাতায় রুজি রোজগারের জন্য। ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা দালাল কাউকে ভয় করত না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রন কে ডিঙিয়ে সে জানতে চাইল কবে তার কোর্টের দিন পড়বে।পরে সেই অপরাধে  মেট্রনের অঙ্গুলি লেহনে শিখারা চুড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় তাকে পাগল বাড়ীতে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়। তাকে কেউ আর দেখতে পায়নি।
--
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগরি বাই এর স্বামীর নতুন করে বিয়ে হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়। শিখা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত। একদিন কোনমতে সেল থেকে বেরিয়ে সে রোদ পোহাতে গেছিল। সেই অপরাধে তাকে মেরে লোপাট করে দিল। "সে এক ভয় পাইত  ডিভিশন বাড়ী আর দোতলার স্যালের দিদিগরে", শোভা বলে। ওই দিদিদের সাথ আমারে একবার দেখা কইরে দিবি," "হ্ একই দিন ফাঁক বুইঝ্যা তরে লইয়া যামু।"
--
একদিন শোভার সাথে দিশারীকে পাগল বাড়ীতে খাবার পৌঁছে দিতে বলা হল। ভেতরে ঢুকে সে হতভম্ব আর নিঃশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। উলঙ্গ, মাথা কামান কিছু কঙ্কাল শেকলে বাঁধা। কেউ কাঁদছে। কেউ নোংরা মেঝে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছে। কেউ কেউ পাশেই তার সহবন্দিনীর সাথে খামচা খামচি করছে। যে যেখানে আছে সেখানেই মলমূত্র ত্যাগ করছে।
--
 শোভা কাজ সেরে দিশেহারা দিশারীকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এল। "দ্যাখ, গড়িব ঘরের মানষে তাদের পাগল স্বজনরে এই হানে চিকিৎসা কইরা সুস্থ করনের লাইগ্যা দিয়া যায়। তারা জানেই না ক্যামনে এয়াদের চিকিৎছে হইত্যাছে,"শোভা বলে। "কিন্তু, এথানে সুস্থ নোকে, অসুস্থ হয়ে পইরবেনি !" কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিশারীর প্রশ্ন।
--
ইতিমধ্যে দিশারীর ডিভিশন বাড়ীর দিদিদের সাথে আলাপ বন্ধুত্বে দাঁড়িয়ে গেল। জীবনের সব কথা তাদের কাছে গল্প করত। দিদিদের কাছে নানা গল্প, তাদের জেলে আসার কারণ সব শুনত। তাদের সব কথা না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছিল এরা গরীব মানুষের বন্ধু। সমস্ত গরীব মানুষ কে এক হতে হবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়তে হবে, নিজেদের প্রাপ্য নিজেদেরই আদায় করে নিতে হবে। জেলে এসে তার অভিজ্ঞতা আরও বাড়ল। একদিকে চরম স্বার্থপরতা, লোভ, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা আর অন্য দিকে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, আত্মসম্মান বোধ। একদিকে অত্যাচার অন্যদিকে জোটবদ্ধ প্রতিরোধ।
--
একদিন প্রায় ১৫/২০ জন বন্দিনী একজোটে দালালদের অত্যাচার, কম খাবার আর বিনা অসুধ আর চিকিৎসায় মরার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। স্বাভাবিক ভাবেই দিশারী, শোভা, আলো মাসী আর তাদের বাকী বন্ধুরাও সেই জোটে ছিল। রাজনৈতিক বন্দীরা তখন ইন্টারভিউ থেকে ফিরছিল। তারাও ওদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে গেল। মেট্রন বেগতিক বুঝে দালালদের লোকদেখান বকাঝকা করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঠিকঠাক খাবার বাটালেন। মিষ্টি গলায় প্রতিশ্রুতি দিলেন এরপর সবাই অসুখ হলেই যেন হাসপাতালে তার কাছে চলে আসে, সবাই ঠিকঠাক চিকিৎসা পাবে।
--
আর একদিন রাতে হাজতী নম্বরে অনেক বন্দিনী এল। ভীড়ে সবার চিড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবার অবস্থা। এরই মাঝে একটি দুর্বল অসুস্থ বাচ্চা খিদের তাড়নায় কাঁদতে শুরু করে। রুগ্ন মায়ের শুকনো বুকে দুধ ছিল না। বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর মত কিছুই ছিল না, ফলে একনাগাড়ে বাচ্চাটা কেঁদেই চলে। আনোয়ারা, জোত্স্না আর বাকি দালালরা হুংকার ছাড়ে, "এই  মাগী তোর ওই বেজন্মাটা কে থামা শিগগিরি, নইলে গলা টিপে জন্মের মত চুপ করিয়ে দেব।" দিশারীদের দল এক জোটে রুখে দাঁড়ায়," একবার চেষ্টা কইরে দেখ ক্যানে, বাচ্চার কোন ক্ষেতি কইরতে চায়লে, আসো দেহি। কেমন ধারা মানুষ তমরা, পশুর অধম।" জোরাল প্রতিবাদে দালালরা বোবা হয়ে গেল।
--
রাজনৈতিক বন্দীদের জেল কর্তৃপক্ষ বা দালালরা সচরাচর ঘাঁটাতো না, প্রাপ্য জিনিসপত্র কিছুটা হলেও দিতো। কিন্তু সাধারণ বন্দিনীদের দুর্দ্দশার সীমা ছিলো না, এদিক-ওদিক হলেই মারধর। শুধু খাবার কেন, খাবার জলটাও ঠিকমতো জুটতো না। অসুখবিসুখে ওষুধপত্রও মিলতো না। আমরা চেষ্টা করতাম যাতে ওরা একজোট হয়ে নিজেদের দাবীগুলো আদায় করতে পারে। একজোট হয়ে দালালদের মারধোর ঠেকাতে পারে। দালালরা সব সময় চোখে-চোখে রাখতো, যাতে আমাদের সাথে ওরা কথা বলতে না পারে। কিন্তু তাই বলে জেলে লড়াই কখন থেমে থাকেনি। অন্যান্য বন্দিনীদের লড়াইয়ের পাশে আমরা সব সময় থাকতে চেষ্টা করেছি ,তাঁরাও আমাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। কখন লড়াই শুরু করেছে মীরা,শান্তিবাই,বেলা,রেখারা, কখন বা মিতা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, মদিনা ,শোভা, শান্তি মাসীর। কখন বার্মিজ মাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে, কখন মেয়াদী নম্বরের পাকিস্তানের পাসপোর্ট কেসের মাসীরা, আবার কখন মাস্তান একাই জেলকতৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবারে জীবন বাজী রেখে লড়ে গেছে।     
----
কিছুদিন পর দিশারীদের কয়েক জনকে মেয়াদী নম্বরে বদলী করে দেওয়া হল। ডিভিশন বাড়ীর দিদিদের সাথে পরিচয় হবার কিছুদিন পর থেকে প্রতি সপ্তাহে যে পোস্টকার্ড দেওয়া হত, তাতে তার হারান এবং বর্তমান বাসস্থানের কথা দিয়ে   তার মাকে চিঠি লিখে দিতে হত। "নেখ, পথমে ফকির মোল্লা, গেরাম রাইদিহি, সোন্দর বন।"
--
"পোস্ট অফিস কি? থানা কি? জেলা কি?" "ওসব বইলতে পাইরবনি।ডাকঘর চন্ননদিহি হোতি পাইরে।" প্রতিবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠিকানা লেখা হত। সুন্দরবন হলে জেলা দক্ষিণ ২৪পরগনা হওয়া স্বাভাবিক। আর রায়দীঘি, চন্দনদীঘি উল্টে পাল্টে লেখা হত। কখন গ্রাম, কখন পোস্ট অফিস, বা কখন থানা, যদি কোনটা খেটে যায়। কিন্তু খাটে না দিশারীর বাড়ীর কোন খবর নেই।
--
ইতিমধ্যে শঙ্করী নামে হারান একটি বাচ্চা মেয়ের বাড়ীর লোক খবর পেয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, ভূতপূর্ব ওয়েলফেয়ার অফিসারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে। তবুও শঙ্করীর বাবা মাকে মাস কয়েক জেল, থানা, কোর্টে তদবীর করতে করতে পায়ের শুকতলা ক্ষয়ে যায়। যেদিন শঙ্করী ছাড়া পেল ততদিনে সেই অফিসার বদলী হয়ে গেছে। যাই হোক শঙ্করী ছাড়া পাওয়াতে সকলের মধ্যে একটা খুশী সেই সাথে একটা আসার সঞ্চার হয়।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
(চলবে )








  


















   













           

No comments:

Post a Comment