1 May 2020

প্রবাসী শ্রমিক -1

প্রবাসী শ্রমিক - ১
**************
৭০/৭১ এ সল্টলেক তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। একদিন বিকাল ৩টা নাগাদ উল্টোডাঙ্গার বাজারের সামনে দিয়ে ভূমি  যাচ্ছিল, সামনে একজন মজদুর মাথায় ঝাঁকায় পড়ন্ত বেলার সস্তায় কেনা কিছু তরিতরকারী আর কয়েকটা কাগজের ঠোঙায় কিছু জিনিস পত্র নিয়ে চলেছেন। সে তাঁর পিছু নিল, পার্টির প্রচলিত রীতি মাফিক নতুন নতুন শ্রমিকদের মধ্যে যোগাযোগ আর পার্টির রাজনীতির প্রচার বাড়াতে হবে, সেই উদ্দেশ্যে।
--
তিনি উল্টোডাঙ্গার মোড় পার করে ডানহাতি সল্টলেকে যে নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠছে সেদিকে বাঁক নিলেন। সেও রাস্তায় চিন্হ দেখে রাখতে রাখতে তাঁর পেছন পেছন চলতে শুরু করল। চারিদিকে তখন ধূ ধূ বালির মাঠ, মাঝে মাঝে কিছু কিছু বাড়ীঘর, রাস্তা তৈরী চলছে। শীতের বেলাশেষ, বেশ অনেকটা চলার পর তিনি একটা সবে তৈরী হচ্ছে এমন একটা বাড়ির পাশে একটা খাটানো তাঁবুতে ঢুকলেন। একটু অপেক্ষা করার পর ভূমিও গিয়ে তাঁবুর দরজা দিয়ে উঁকি মারলো, কাঁচুমাচু মুখ করে বলল," একটু খাবার জল দেবেন, খুব তেষ্টা পেয়েছে। "
---
"আসুন, আসুন দিদি, এখানে বসুন, জল খাবেন সেটা আর বেশী কথা কি," বলে  দুসারি ইটের ওপর একটা কাঠের তক্তা পেতে বেঞ্চির মত করা আছে, হাতের গামছা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে বসতে বললেন একজন বয়স্ক শ্রমিক। " এ আসলাম বেটা, দিদিকে গেলাস ভাল করে ধুয়ে একটু খাবার জল দে বটে। " আসলাম ছেলেটি একটা কলাই করা গ্লাস নিয়ে তাঁবুর পিছন দিকে চলে গেল। সে গ্যাঁট হয়ে বসে কথা শুরু করে দিল, "আপনারা এখানে কতজন আছেন, কোথায় বাড়ী , ইত্যাদি ?"
 ---
বয়স্ক মজদুরটি বললেন, "তা দিদি আমরা জনা কুড়ি আছি, এসেছি ভেন্ন ভেন্ন থান হতে, মর ঘর মেদিনীপুর। মর গাঁয়ের জনা পাঁচেক আছি , এছাড়া বর্ধমান, পুরুলিয়া থেকে জনা চারেক, বিহারের কজনা,উড়িষ্যার কজনা আছি। পেটের দায়ে ঘর ছেড়ে এসেছি কাজ করতি" বলতে বলতে হাঁক পারলেন, "আরে, কুঁয়া খুদে কি জল আনছিস, দ্যাখেন দেখি কি কান্ড, জলের জন্যি পরান টা যায় আপনের !" "আরে না না ব্যস্ত হতে হবে না, আপনার এখানে বেশ হাওয়া দিচ্ছে, গল্প করতে বেশ  লাগছে," মনে ভাবে আরও দেরী করুক না আসলাম, তার তাতে অসুবিধার থেকে সুবিধা বেশী। " তা আপনার  ঘরে কে কে আছে, গাঁয়ে জমিজমা আছে নাকি অন্যের জমিতে জন খাটতে হয়, কদিন বাদে বাদে বাড়ী যান" ইত্যাদি, ইত্যাদি।
---
তিনি হেসে বললেন, "আমার  গ্রামে বউ, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন সব আছে। জমিজমা নাই, বসত ভিটাখান আছে, আমরা দু ভাই এখানে আসছি, আর দুটা গেরামে জন খাটে। "  আসলাম সদ্য মাজা গ্লাসে জল নিয়ে এল, ইতিমধ্যে প্রায় ১৫জন শ্রমিক ভূমিদের ঘিরে বসে কথা শুনছে। কজন ভিতর দিকে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত, কিন্তু কান খাড়া করে কথা শুনছে। জলটা হাতে নিয়ে অল্প অল্প করে চুমুক দিচ্ছে আর কথা চালিয়ে যাচ্ছে। খেয়াল করে দেখলো ওই তাঁবুর মধ্যে নানা জাতি, নানা ধর্মের মিলন। আসলাম, রফিক, ফৈজল, ইমরান এসেছে বিহার থেকে। বৈজু, লক্ষ্মণ, হরিরাম রা এসেছে উড়িষ্যা থেকে। মোহন, সুবল,  মহেশরা এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকে, মুরারি, গণপতি হেমব্রম, শশধর মাহাতো  ইত্যাদিরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে। বেশির ভাগ ই ভূমিহীন বা দরিদ্র কৃষকের ঘর থেকে এসেছেন। কেউ মাস একবার, কেউ তিন মাসে একবার, কেউ বা ছমাসে একবার বাাড়ি যান, দুরত্ব, মজুরী বা খরচপাতির ওপর নির্ভর করে। বেশীর ভাগই ফুরণে মানে রোজ খাটা মজদুর।
---
জল শেষ হয়ে গেল এবার আর কোন অজুহাতে বসে থাকা যায় না। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন বয়স্ক শ্রমিকটি যাঁকে সবাই কাকা বলে ডাকছিল, বললেন " দিদি আমাদের গ্লাসে জল যখন খেলেনই , তখন একটু চাও খেয়ে যান ক্যানে। " সে তো এক পায়ে খাড়া। এবার সোজাসুজি রাজনীতির আলোচনা শুরু করে দিল।  দিয়েই বুঝলো কাকা রীতিমত বামপন্থি রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছেন, শুধু তাই নয় ভূমিদের পার্টির কিছু নেতার নামও জানেন। চা আসতে আসতে  জোর কদমে রাজনীতি আলোচনা শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে সে তার রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে ব্যাগ থেকে পার্টির বই, কাগজ পত্র বার করে ফেলেছে। চা পর্ব শেষ হতে হতে সাতটা বেজে গেছে। চারিদিক অন্ধকার নেমে এসেছে। সবার মধ্যে এমন উদ্দীপনা দেখে মেয়েটি হতবাক। যা হয় হবে ভেবে কথা চালিয়ে গেল।
---
কাকা রাতের খাবার অনুরোধ করলেন। এক কথায় রাজী, গরম রুটির সাথে পাঁচমেশালি তরকারির ঝোল। খেতে খেতে তাঁদের নানা অভিজ্ঞতা শুনল। রাত প্রায় নয়টা বাজে, মনে মনে প্রমাদ গুনছে , যতই চিন্হ রেখে আসুক কেন, ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা রাস্তা চিনে ফেরা মুশকিল। মুশকিল আসান কাকাই প্রথম বললেন, "যা রসিক দিদিকে উল্টাডাঙার মোড়ে  ছেড়ে দিয়ে আয় বটে।" পরের দিন বিকালে আবার যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। মহা খুশীতে সে  রসিক ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে ফিরে চললো।
---
পরদিন ওই অঞ্চল কিছুটা চেনে একজন ছেলে সাথীকে নিয়ে গেল। তারপর মাঝে মাঝেই ওখানে যেতে শুরু করল বই, কাগজপত্র নিয়ে। যথারীতি জল খাওয়া দিয়ে শুরু করে, চা, রুটি তরকারি দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে ফিরত। সকলের মধ্যে বিপুল উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল। এমন কি মাঝে মধ্যে ওখানে রাত ও কাটায়। দুটি কাঠের পাটাতন দিয়ে নিজেদের চাদর পেতে তার জন্য দারুণ শোবার ব্যবস্থা করে দিতেন। মশার প্রচন্ড তান্ডবের মধ্যেই তাঁরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তেন, আর ভূমি সারা রাত মশা মারত আর ঘুমাতে চেষ্টা করত। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের সাথে একাত্ম হওয়ার পার্টির এই  নির্দেশ যে  শ্রেণী সংগ্রামের অংশ নেওয়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ন সেটা ভাল করে বুঝতে পেরেছিল। এর কিছুদিন পর ভূমিরা ধরা পড়ে যায়, কিন্তু উর্ব্বর সেই জমিতে পার্টির  মতাদর্শের বীজের থেকে কিছু চারা গাছ গজানোর সম্ভবনা সম্পর্কে গভীর বিশ্বাস নিয়ে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------












































  

No comments:

Post a Comment