17 Jul 2015

আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র

আকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র 
*********************
সত্তর দশকের একটি ব্ল্যাক আউট এর রাত। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। কলকাতা শহরের চিত্পুর আর হ্যারিসন রোডের ক্রসিং এ বাসস্টপে একটি কিশোরী তার এক সাথীর জন্য অপেক্ষারত। এদিকে ওদিকে আরও কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। মন হচ্ছে সবাই বাসের অপেক্ষায়ে। কিশোরীর ঠিক পেছনে একজন অতি সাধারণ জামা কাপড় পরা মানুষ দাঁড়িয়ে। তাঁর দোহারা চেহারা, পেশীবহুল দুটি হাত। দেখে মনে হয় সম্ভবত কোন কঠিন শ্রমজীবি কাজের সাথে যুক্ত। মানুষটি সতর্ক দৃষ্টিতে মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন।
---

একের পর এক বাস আসে, চলে যায়, কিন্তু কিশোরীটির বাসে ওঠার জন্য কোন তত্পরতা দেখা যায় না। অন্ধকার রাত, কারফিউ জারি হয়েছে। বেশীর ভাগ লোকজন বাস ধরে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরার জন্য উদগ্রীব। কিশোরিটি একটা লাইট পোস্টে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। শ্রমজীবি মানুষটি অনেকক্ষন ধরে উদগ্রীব চিত্তে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে, কিশোরীকে প্রশ্ন করেন, " দিদি কোন বাসে উঠছো না কেন ?" "আমার বাস এখনো আসেনি", সংক্ষিপ্ত উত্তর আসে। "কেন অনেকক্ষণ ধরে তুমি দাঁড়িয়ে। কত বাস তো এলো, গেলো। কত নম্বর বাসে যাবে তুমি ?"
"আমি... দেখি..দেখা যাক। " ছাড়া ছাড়া জবাব দিয়ে চুপ করে যায় মেয়েটি।
---

"কত নম্বর বাসে যাবে জানোনা ! সবাই একে একে বাসে উঠছে এই অশান্ত সময়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী যেতে ব্যস্ত। তুমি দাঁড়িয়ে আছ তো আছই !রাত বাড়ছে, কত নম্বর বাসে যাবে ঠিক করে বল ?"
"দেখি , কত নম্বর বাস পাই,"আবারসেই কাঠ কাঠ উত্তর। কিছুক্ষন নীরবতা। "ঠিক করে বলতো তুমি কোথায় যাবে? কত নম্বর বাসে যাবে ? একগাদা বাস চলে গেল !" অধৈর্য ভাবে বলেন তিনি। "আপনার কি দরকার ?আমি কোথায় যাব আর কত নম্বর বাসে যাব ?" - রুক্ষভাবে বলে মেয়েটি।
---

লোকটি হাঁটা দেয়। কিন্তু একটু গিয়েই আমার ফিরে আসে। কিশোরীটি পাশে দাঁড়ায়। আবার ও কিছু বাস চলে যায়। তখন তিনি প্রশ্ন করেন," কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন ? কত বাস তো গেল। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে তুমি দাঁড়িয়ে আছ।" এবার কিশোরী টি আর কোন উত্তর দেয় না। দু /একটা  বাসের দিকে এগিয়ে যায়। বাস ধরার ছল করে, কিন্তু কোন বাসে ওঠেনা। "কি হলো বাসে তো উঠলে না , কেন ?" "ভীষণ ভীড়, তাই উঠলাম না। " "মোটেও বেশি ভীড় ছিল না, তুমি ইচ্ছে করলেই উঠতে পারতে !" "ভীড় কি ভীড় না, আমাকে ঠিক করতে দিন।" রাগত স্বরে উত্তর করে মেয়েটি।
---

এতক্ষণ চাপা গলায় কথাবার্তা চলছিল। আস্তে আস্তে মেয়েটির গলা একটু চড়ে যায়। লোকটি এবার কঠিন গলায় প্রায় আদেশের সুরে বলে," এবার যে বাস আসবে তাতেই উঠে যাবে।আর কোন কথা নয়। আর দাঁড়াবেনা।"
"মেয়েটি ক্ষেপে যায়,"আপনার কি, আমি কি করবো, আমি ঠিক করবো, আপনি বলার কে!" আসে পাশে একটা অদৃশ্য অস্থিরতা অনুভূত হলো - দুজনেই বুঝলো। মেয়েটির এতক্ষনে ভাবলো, লোকটি সাদা পোশাকে পুলিশ নাকি! মানুষটিও একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও তার পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেলো। ইতিমধ্যে মেয়েটির সাথী এসে গেলো, "অনেক দেরী হয়ে গেলোরে। অনেকক্ষণ তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। "
---

তার আগমনে শ্রমজীবি মানুষটি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তিনি নবাগত ছেলেটির হাত ধরে নীচু গলায় বললেন "দাদা আপনি ভাগ্যিস এসে পড়েছেন। পেছন দিয়ে খেয়াল করে দেখুন একটা মাস্তান গ্যাং রয়েছে। দিদি তো কিছু খেয়াল করছেনা। একলা হলেই দিদিকে তুলে নিয়ে যাবার প্ল্যান করছে। অনেকক্ষণ তো ভীড় ছিল। কিন্তু ক্রমাগত হালকা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিদিকে ছেড়ে যেতে পারছিনা। তাই এতক্ষণ ধরে দিদিকে তাড়াতাড়ি  বাসে উঠে চলে যেতে বলছিলাম। এত কথা তো বলতে পারছিলাম না। দিদি জানে না বলে রেগে যাচ্ছিলো।"
---

মেয়েটির বন্ধু উপকারী, সাহসী মানুষটিকে হাত ধরে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন। ইতিমধ্যে তিনজনে শিয়ালদহ স্টেশন এর দিকে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন। স্টেশনের কাছে পৌঁছে মানুষটি বিদায় নিলেন। বন্ধুটির কাছে সব কথা শুনে মেয়েটি স্তম্ভিত হয়ে গেলো। নিজের ব্যবহারে ভীষণ লজ্জা পেল।
কত বড় মাপের একজন মানুষের সান্নিধ্যে এতক্ষণ সে ছিল - অতি সাধারণ এক মানুষের  অসাধারণ মানবিকতা, সাহসিকতা আর পরার্থপতার কথা ভেবে অভিভূত হয়ে গেল। সারা জীবনেরর অভিজ্ঞতার  ঝুলি তে এক অমূল্য রত্ন যোগ হলো।
----

আজ চল্লিশ বছর পরেও সেদিন হটাত আকাশের  উজ্জ্বল যে নক্ষত্র টা ছিটকে এসে পৃথিবীর মাটিতে পড়েছিল তার আলো আজও এতটুকুও ম্লান হয়নি। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় এই অজস্র ঝিকমিক করা বাকি নক্ষত্রগুলি আজ কোথায় গেলো, - তারা কি হারিয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে মনে হয় - তারা হারিয়ে যায়নি, মহাবিশ্ব প্রসারিত হবার সাথে সাথে তাদের সংখ্যা চোখে দেখা না গেলেও বেড়ে চলেছে। সেই উজ্জল নক্ষত্ররা বেঁচে আছে আর বেঁচে থাকবে শহীদ বরুন বিশ্বাস, অরূপ ভান্ডারী, তপন দত্ত, রাজীব দাস, সৌরভ চৌধুরীদের মধ্যে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------























No comments:

Post a Comment