30 Jul 2015

দায়ী কে!

দায়ী কে !
*******

"বিশু আর নেই রে "- সকাল বেলায় মা ঘুম থেকে ডেকেই  খবরটা দিলেন দিয়াকে। ধরমড়িয়ে উঠে বসলো সে," কি বলছো কি ! সাত সকালে যত  আবোল তাবোল কথা কোথা থেকে শুনলে তুমি !" "না গো বৌদি, মাসীমা ঠিক কথাই বলেছে। সত্যি আজ ভোর বেলায় বিশু মারা গেছে। একটু পরে ওরা ওর দেহ নিয়ে আসবে।" কাজের মাসি উত্তর দিল। "কি ! কি হয়েছিল ! কবেই বা এত টা অসুস্হ হলো। এইত তিন / চার দিন আগে আমার সাথে কথা হলো। শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা বলেছিলো বটে। কিন্তু আমি হাসপাতালে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখানোর কথা বলাতে, বলেছিলো সে রকম মারাত্মক কিছু নয়। এর মধ্যে কি হলো যে তরতাজা প্রাণবন্ত ছেলেটা চলে গেল ! কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো, জানো কিছু ?"
---

"হাসপাতালে তো নিয়ে যায়নি। দিদির বাড়ী নিয়ে গিয়েছিলো ঝাঁড় ফুঁক করতে।""সেকি,ওর দিদির বাড়ী তো অনেকে দূর, একেবারে অজ পাড়া গাঁ। সেখানে তো কিচ্ছু নেই ,ওষুধের দোকান , স্বাস্থ্য কেন্দ্র - একদম কিচ্ছু নেই। তার চেয়ে এখান থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তো অনেক বড় / ছোট, সরকারী / বেসরকারী হাসপাতাল ছিল। সেখানে নিলো না কেন !" " বৌদি তোমরা তো মাত্র বছর খানেক হলো এসেছো, এখানের রীতি নীতি গুলি জানতে পারোনি। এখানে লোকেদের হাসপাতাল/ডাক্তার এসবের থেকে ঝাঁড় ফুঁক আর জলপড়া র উপর বিশ্বাস বেশী।"  " কিন্তু বিশুর মেয়ের কদিন আগেই তো বিশাল করে জন্মদিন পালন করলো, কেক কাটা হলো, মাইক লাগিয়ে গান বাজলো, কত লোক খেলো। ওদের তো পয়সাকড়ির খুব অভাব নেই , তাহলে ?"
 "বৌদি, আসলে তোমাদের মত শহরের লোকেদের দেখে ওরা জন্মদিন, বিয়ের দিন এসব শিখেছে, কিন্তু তোমাদের মতো পড়াশুনা তো শেখেনি, তাই এখনো অসুখ করলে বেশীর ভাগ মানুষ পুরানো দিনের ঝাঁড় ফুঁক এসবে বেশী বিশ্বাস করে।"
 ---
দিয়া চুপ করে যায়। বিশুর হাসিখুশী মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে তখন তারা এই ফ্লাটে নতুন এসেছে। একদিন সে যখন বাড়ীতে একা, বিদ্যুতের লাইনে কোন কারণে নিজেদের ফ্ল্যাটের ইলেকট্রিসিটি অফ হয়ে যায়। প্রচন্ড গরমে টেঁকা দায়। দিয়া নীচে নাম ইলেকট্রিশিয়ানের খোঁজে। ঠিক উল্টো দিকে বিশু নিজের কাপড় ইস্ত্রির দোকানে কাজ করছিলো। দিয়ার উত্কন্ঠিত মুখ দেখে বেরিয়ে আসে, "কি হয়েছে কাকিমা, কোন সমস্যা?"  সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিজের খুড়তুত ইলেকট্রিশিয়ান ভাইকে ডেকে পাঠিয়ে লাইন সারিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে। সেই প্রথম আলাপ।
---

বিশুর ছোট বেলায় পোলিও হবার ফলে পায়ে জোর ছিল না। বিশুর বাবার বেশ কিছুটা জমি জায়গা ছিল। তার বেশ  কিছুটা জমি প্রমোটারি ব্যবসায়ে নিযুক্ত এক রাজনৌতিক দলের নেতা ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটের বিনিময়ে লিখিয়ে নিয়েছিলো। সেই ফ্লাট ভাড়া, বিশুর বাবার  মুদিখানা দোকানের আয়, বিশুর নিজের দোকানের ছাড়াও, আরও বেশ কিছুটা জমির আয় ছিল।
---

বাড়ীটা নিজেদের। তাই আর্থিক ভাবে অসচ্ছলতা ছিল না। বাবা মা নির্বিবাদী ভালমানুষ। তার বৌটির ব্যবহারও  খুব মিষ্টি। আর বিশুর ব্যবহারের তো তুলনা ছিল না। আসে পাশের মানুষ জনদের ছোটখাটো সমস্যাগুলি সে নিজে থেকেই সমাধান করতে চেষ্টা করতো। কোন বাড়ীতে জলের লাইনে সমস্যা, তা মেটানো। কোন ফ্ল্যাটের লোকেরা কদিনের জন্য বাইরে গেছে, যাতে চুরি নাহয় রাস্তার ধারে দোকানে বসে সব খেয়াল রাখতো। আর  নিজের ফোনে লোক ডেকে সবাই এর সমস্যার সমাধান করতো। 
---

দিয়ার মনে পড়ে আর একদিন সে ভুল করে চাবি না নিয়েই গডরেজ লকের দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়েছিল, এমনকি মোবাইলটাও ঘরে রয়ে গেছিল। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। বিশু তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে,সব শুনে নিজের দোকানে বসায়, বলে, " কাকিমা, কাকুর অফিস তো কাছেই। তাঁর কাছে বাড়তি চাবি নেই ? তাহলে আমার ফোন থেকে একটা ফোন করে দিন।" বিশুর সাহায্যে ই সেদিন ও দিয়া বিরাট ঝামেলার হাত থেকে মুক্তি পায়।
---

বিশুদের বাড়ী সল্টলেক সিটি থেকে পাঁচ মিনিট আর নিউটাউন থেকে দুই মিনিট দূরত্বে। পাড়ায় মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য বেশ কয়েকটি মল্টিস্টরিড বিল্ডিং ও হয়েছে। জায়গাটা যদিও এখনো পঞ্চাযেতের অধীন। সরকারী প্রাথমিক স্কুল আছে। ছেলেদের  জন্য সেলুন, মেয়েদের জন্য বিয়ুটিপর্লার আছে।আধুনিক নাচ শেখার কেন্দ্র ও হয়েছে। অঞ্চলের   অধিবাসীরাও এসবে উত্সাহ ভরে যোগ দেয়। 
--- 

ওষুধের দোকান আছে। কিন্তু এলোপ্যাথিক কোন ডাক্তার নেই। একজন হোমিয়প্যাথিক ডাক্তার দাঁত থেকে শুরু করে সব কিছুর  চিকিত্সা করেন, আর একজন অল্টারনেটিভ মেডিসিনের ডাক্তার আছেন  যিনি মূলত এলপ্যাথিক চিকিত্সা করেন, একটু কিছু হলেই স্যালায়িন গুঁজে দেন।
---

অনেক বাচ্চারা প্রাথমিক স্কুলে যায়। কিন্তু প্রথম থেকে প্রাইভেট কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়েও বিশেষ কিছু শেখেনা। শহরের হাওয়ার সান্নিধ্যে এসে আঞ্চলিক অধিবাসীদের মধ্যে কেক কেটে, বেলুন লাগিয়ে,ব্যান্ড বাজিয়ে জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ চালু হয়েছে।
ফেসিয়াল করা, উত্সবে ব্যান্ড বাজিয়ে চূড়ান্ত আধুনিক নাচ করা, চুলের বাহার, পোশাকের বাহার সবই আয়ত্ব করেছেন। কিন্তু অসুখ / বিশুখে মূলত ঝাঁড়ফুঁক/তুকতাক এর আশ্রয় নেন, খুব জোর অঞ্চলের হাতুড়ে ডাক্তার দের কাছে যান। কিন্তু সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে খুব কম লোক যান, তাও লোকাল হাতুড়ে ডাক্তাদের  পরামর্শ, একেবারে শেষ পর্যাযে।
----

শহর ভিত্তিক সংস্কৃতির জীবনের অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ বা অন্যান্য কুপ্রভাব গ্রামের সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবন যাত্রার উপর অনেকটাই  প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু তার বিজ্ঞান সম্মত বিষয়গুলি সম্পর্কে অজ্ঞতা আর শিক্ষাগত নীচু মানদন্ডের সমস্যা আগের মতই থেকে গেছে। উপরের শহুরে চাকচিক্য এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অনীহা থেকে গেছে। তারই ফলে বিশুর মত টগবগে মানুষদের অকালে বিনা চিকিত্সাতে মরতে হয়। কে এর দায় নেবে ! কে জ্বালবে প্রকৃত জ্ঞানের আলো !

__________________________________________________________________________________________















































No comments:

Post a Comment