7 Dec 2015

বাঁশী কেন কাঁদে

বাঁশী কেন কাঁদে
**********

নতুন পাড়ায় আসার পর দ্যূতি রোজ রাতে লিখতে বসলে, অদূরে কোথা থেকে বাঁশীর অপূর্ব একটা মন উদাস করা মেঠো মিষ্টি সুর শুনতে পায়। শুনতে শুনতে লেখে। খুব সুন্দর লাগে। যেন একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। লেখা কেন শুধু,  রাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই কান খাঁড়া হয়ে থাকে বাঁশীর সুরের জন্য। কে বাজায় জানতে খুব মন চায়। শিল্পীকে একবারের জন্য দেখতে ইচ্ছা হয়।
--
আসেপাশের লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে। শেষে পাড়ায় বিশুকে জিজ্ঞাস করে,"বিশু, বলতে পারো রোজ রাতে এত সুন্দর বাঁশী কে বাজায় ?"  "কাকিমা ওত আপনাদের কলমিস্ত্রি নিশীথ।" দ্যুতির মনে পড়ে , প্রথম দিন তাদের বাড়ী এসেই, নিশীথ বলেছিল, "বৌদি, আপনাগো ঘরেতো বই ই বই। আমি এক আধটু পড়থে পারি। সময় কইরা লইয়া যামু কিন্তু, পড়নের লাইগ্যা।" "বাঃ এতো খুব ভাল কথা, নিও। তুমিতো খুব সুন্দর বাঁশী বাজাও!" "তা হুন্দর হয় কিনা কইতে পারিনা, বাজাইতে ভালবাসি। সবই তো দ্যাশে ছাইরা আসছি। হুধু বউ, বাঁশী আর বাজান ডা সাথে নিয়া আসছি। এখানে আইসা একডা মাইয়া হইসে। এই আমার রাজার ধন, এডুকু লইয়া য্যান থাইকতে পারি"-- বলে দিল খোলা এক হাসি হেসেছিল।
--
ওপার বাংলার নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান নিশীথ। বাংলা দেশ থেকে রোজগারের চেষ্টায় প্রায় এক কাপড়ে বউ কে নিয়ে  চলে এসেছিল কলকাতায়। অনেকের মতই কিছু কাল রেলস্টেশনে কাটিয়ে, খালপাড়ে একটা আস্তানা জুটেছে। যখন যে কাজ জুটেছে তাই করেছে। ক্রমে কলের কাজ শিখে নিয়ে কলমিস্ত্রির কাজ করছে।  
--
তাও বোধহয় কপালে সইল না। একদিন বাঁশী থেমে গেল। দিন যায়, বাঁশীর সুর আর রাতের হওয়াতে ভেসে আসেনা। দ্যূতি শেষে থাকতে না পেরে আবার বিশুকে জিজ্ঞাসা করে, "নিশিথের খবর জান ? কেমন আছে? ও আর বাজায় নাতো। "
--
"বৌদি, আপনি শোনেননি, নিশীথের মেয়েটা কোথায় চলে গেছে, মানে ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।" "সেকি, দ্যূতি আর কিছু বলতে পারে না, ভাবতে ভাবতে বাড়ী ফিরে আসে। রোজই বিশুর কাছে খবর নেয়। নিশীথরা পাগলের মত মেয়েকে খুঁজছে, সাত সকালে বার হয় আর রাতে ফেরে। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার কোন খবর নেই।
--

শেষে একদিন নিশীথের মেয়ে ফিরে এল, কিন্তু লাশ হয়ে, খালের জলে কচুরিপানার সাথে ভেসে। বিশুর কাছে ই প্রথম শুনল, তারপর অবশ্য খবরের কাগজেও দেখল,"ছয় /সাত বছরের শিশুকে গ্যাং রেপ, তারপর শ্বাস রোধ করে হত্যা করে খালের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 --
দেখতে দেখতে দু / তিন মাস কেটে গেল, নিশীথ কাজে মন দিতে পারে না, খায় না, ঘুমায় না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বউ স্বামীর অবস্থা দেখে নিজের দুঃখ চেপে, কান্না গিলে, তাকে সান্তনা দেয়,খাওয়ানোর চেষ্টা করে। দ্যূতি বিশুর কাছ থেকে সব খবরই পায়, কিন্তু  যেতে চাইলে বিশু মানা করে। রাতে বেশী করে নিশীথের  কথা মনে পড়ে। 
--
অবশেষে একদিন গভীর রাতে হটাত বাঁশীর করুন সুরে বেজে উঠলো। দ্যুতির মনে হল এ যেন সুর নয়, মনের তীব্র যন্ত্রণার প্রকাশ। বাঁশী যেন কাঁদছে।  মন ভারী হয়ে আসে। তারপর থেকে প্রতিদিন বাঁশীর কান্নার মূর্ছনা গভীর রাতের আকাশ ভরিয়ে তুলত। 
--
আস্তে আস্তে নিশীথ আবার কাজ করতে শুরু করলো। একদিন দ্যুতির বাড়ী কল সারাতে এল। কাজ শেষ করে কান্না চাপা গলায় বলল,"বৌদি, আমার সাত রাজার ধন চুরি হইয়া গেসে শুনছেন।" নির্বাক দ্যূতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
"আস্সা বৌদি, ওরা কি মনিষ্যি! কি কইরা একফোডা মাইয়ার সাথে হেই নোংরামি ডা করতে পারল! আর পুলিশ্গুলান, আমারে জিগায়,'মাইয়া আমার কাউর লগে পিরিত করত নাকি!' আমি কই, 'বাবুমসইরা মাইয়া আমার মায়ের গড়ন পাইসে, মায়ের কাপড় ডা জড়াইয়া মা সাইজ্যা খেলা কৈরতাসিল। দ্যাখতে নয় / দশ লাইগতে পারে, কিন্তু মাত্র সাত বত্সরের আছিল, পিরিত বোঝনের বয়স ই হয় নাই। তাও ছাড়ান দ্যান, মাইরা ফ্যালোনের বিহিত ডা তো করেন।'কত দিন হইয়া গ্যাল, কোনডারে ধইরতে পাইরে না! কারেই বা কোই। আমি বাপ হইয়া কিইবা কর্তে পারসি।" 
--
দ্যুতি কিছুক্ষণ বোঝাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সে তো অন্তঃসার শুন্য কিছু কথা। আসলে নিশীথের কথার কোন উত্তর তার জানা ছিলনা। তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে বাঁশী বাজানোর কথা তুললো। "বৌদি, আমি ত বাঁশী আর বাজাই না, কান্দি, কাইন্দা কাইন্দা মাইয়াডারে ডাকি। ডাইক্যা কই, কি দোষে আমারে ছাইরা গেল! অর কি এখন যাওনের সময়!"
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------     









  













No comments:

Post a Comment