8 Dec 2015

সেবা


সেবা
****

শিল্পী হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। ঘরে ঢুকলেন এক ভদ্রমহিলা, "দিদি, আমি তোমার দিনের আয়া মাসী, আমার নাম বীণা ঠাকুর।" অবাক চোখে দেখে শিল্পী, কি অদ্ভুত মায়া জড়ানো একটা মুখ, পরিষ্কার পাটভাঙা সাদা  লালপাড়ে ছাপা শাড়ি। চেহারায় একটা নির্ভরতার আশ্বাস। আমতা আমতা করে বলে, "তা আপনি বসুন।" "এইতো, প্রথমেই পর করে দিলে, তুমি বল, নাহলে ক্যামন যেন বাইরের লোক মনে হয়," বলেন বীণামাসী।
--
সেটা ছিল আশির দশক। শিল্পী সন্তান সম্ভবা, জন্ডিজ হবার ফলে একমাস আগেই ডাক্তারবাবুরা ভর্তি করে নিয়েছেন, যদিও সেই হাসপাতালের প্যাথলজী ডিপার্টমেন্ট এর রিপোর্ট এ জন্ডিস ধরা পড়েনি। কিন্তু গাইনোকলজির ডাক্তাররা সিমটমগুলি শুনে  তাকে ভর্তি করে নিয়েছিল। তখন তাঁদের সিনিয়র অনুপস্থিত ছিলেন। জুনিয়ার ডাক্তারা নিজেরাই রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসে। তাতে জন্ডিস পাওয়া যায়, অবস্থা খুব সিরিয়াস ছিল, মরণ / বাচন সমস্যা এবং এমার্জেন্সি কেস।  
--
শিল্পী, স্বামী সরকারি অফিসার হবার সূত্রে কেবিন এ ছিল। বই পড়া, মাঝে মধ্যে বারান্দায় হাঁটা আর জানালা দিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। তাই বীনা মাসী তাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দিতেন, শুধু বাড়ীর লোকের আসার সময় টুকু বাদ দিয়ে। বীনামাসী সংসারে মূল উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন। তিনটি সন্তান আর রুগ্ন স্বামীকে নিয়ে তাঁর সংসার, বনগাঁয়ে বাড়ী।
--
রাত ভরে উঠে ঘর সংসারের কাজ আর রান্না করে সকাল আটার মধ্যে কেবিনে হাজির হয়ে যেতেন। কোনদিন ডিউটি তে কোন রকম অবহেলা, বিরক্তি বা ঘেন্না তাঁর ছিল না। মায়ের স্নেহ দিয়ে রুগীকে যেন আগলে রাখতেন। অন্য কোন আয়ামাসী রুগীদের প্রতি কোন বিরক্তি দেখলে ই সজোরে প্রতিবাদ করতেন,"রাগ করলেতো চলবে না, এ হল সেবার কাজ, রুগীকে সন্তানের মত দেখতে হবে, যত্ন নিতে হবে। তা না পারলে এ লাইনে আসা কেন বাপু।"
--
শিল্পী এবং সাধারন ওয়ার্ড এ ছিলেন এমন আর  একজন রুগীকে নিয়েও  হাউসস্টাফরা খুব চিন্তিত ছিলেন। তাঁর ও একই অবস্থা। অসীম যত্ন নিয়ে এই জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা সব রুগীদের দেখতেন, বিশেষত জন্ডিসে আক্রান্ত হবু মায়েদের প্রতি ছিল সতর্ক নজর, রোজ তাঁদের পথ্য থেকে শুরু করে সব খবর নিতেন।
 --
একদিন সিস্টাররা ওয়ার্ডের রুগীর ব্যাপারে নালিশ করেন। আগের দিন নাকি তাঁর স্বামী তাঁরই আবদার রাখতে লুকিয়ে কাটলেট এনে খাওয়াছিলেন, আধখাওয়া কাটলেট টি দেখালেন। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তারবাবুরা বকলেন,"আপনি আপনার নিজের ভাল বোঝেন না। কোথায় আমরা আপনাদের সুস্থ করে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, আপনি নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছেন। এমনি করলে আপনার বাড়ীর লোক আসা বন্ধ করে দেব।"
--
কদিন পর রাতের মাসীর কাছে শিল্পী জানতে পারল, ওই রোগিনী মারা গেছেন। পরদিন সকালে বীনামাসীকে খবরটা দিল। শুনেই মাসী রেগে টং, "কে বলল তোমাকে ? রাতের মাসী বুঝি ! সত্যি এদের কোন আক্কেল নেই ! গল্প করার বিষয় পায় না। দিদি, তুমি এসব আবোল তাবোল কথা একদম শুনবে না কিন্তু।" শিল্পী আর কথা বাড়ায় না।
--
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল, তার প্রসবের দিন এসে গেল। সকাল থেকে ব্যথা শুরু হল অল্প অল্প। যে সিনিয়ার ডাক্তারের অধীনে শিল্পী ভর্তি ছিল রাউন্ডে এসে, জুনিয়র ডাক্তারদের বলে গেলেন, বেরোবার মুখটা পরিষ্কার করে দিও।"
ক্রমে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যে একজন স্যারের  নির্দেশ মত কাজ করে, তাকে সাহস জুগিয়ে গেল,"একদম চিন্তা করবেন না, আমাদের আজ নাইট শিফট না থাকলেও অসুবিধা কিছু হবেনা। যাদের ডিউটি আছে, তারাই দেখাশুনা করবে।"  
--
রোজ বীনা মাসীকে শিল্পী আগেই ছেড়ে দিত, অনেক দুর তাঁকে যেতে হয় বলে। কিন্তু বার বার বলা সত্বেও সেদিন তিনি রাজী হলেন না। রাতের মাসী যথারীতি দেরী করে এলেন। বীণা মাসীর যেতে রাত হয়ে গেল। যাবার সময় রাতের মাসীকে বললেন,"আমি ট্রলি আনতে বলে যাচ্ছি। দিদিকে একদম ছাড়বেনা, সব সময় সঙ্গে থাকবে। অন্য কোথাও গল্পে জমে যেওনা।"
 --
বীণামাসী যাবার পরই খুব জোর প্রসব বেদনা শুরু হল। নীচে বীণা মাসী, আর অপেক্ষা রত শিল্পীর স্বামী আর বাবা দৌড়া দৌড়ি করে ট্রলির ব্যবস্থা করলেন। লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। সেখানে সারি সারি বেডে প্রায় জনা দশেক প্রসূতি অপেক্ষায় রয়েছে। শিল্পীর সারা রাত যন্ত্রণা হতে থাকল, ব্যথা ওঠে আবার পড়ে যায়। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে মনে হতে থাকে,পাশে দাঁড়ান মাসীর কাছে কয়েক বার জল চায়। মাসী মাঝে মধ্যেই ঘন্টা ভর ডুব দ্যায়। তখন একটু জল দেবার ও লোক মেলে না। এই চলে সারা রাত।
--
 ভোর হয়ে আসে, দ্বিতীয় লেবার রুমে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। দরজার কাছেই সে বেড পেল। জল ভাঙতে শুরু হয়ে যায়। শুরু হল নবাগত নার্স দের হাত পাকানোর পরীক্ষা। একটি ট্রেইনি নার্স সাহস করে এগোয় পরীক্ষার নামে হাত পাকাতে। শিল্পী চোখ পাকিয়ে এক ধমক লাগায়,"একদম হাত দেবে না।"মেয়েটি পালিয়ে বাঁচে। ইতিমধ্যে বীণা মাসী এসে গেছেন, সব দেখছিলেন। এবার কাছে এসে বললেন, "ঠিক করেছ দিদি, ওদের ওপর তো আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই।"        
--
সকাল বেলায় সেই সিনিয়র ডাক্তার, হাউস স্টাফদের নিয়ে উপস্থিত হলেন। সারা ঘর ঘুরপাক দিয়ে তিনি যেই দরজা দিয়ে বার হতে যাবেন, শিল্পী খপ তাঁর হাত টা চেপে ধরে,"আপনি আমাকে না দেখে যেতে পারবেন না।" "না, না, দেখছি, দেখছি।" জুনিয়ররা বার বারই তার দিকে দেখছিলেন, কিন্তু স্যার কে কিছু বলতে পারছিলনা। এবার তাঁরা নীরবে উত্সাহিত করার ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালেন। বড় ডাক্তার দেখেই বললেন,"তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটার নিয়ে যাও, অজ্ঞান করে ডিপ ফর্সেভ দিয়ে বাচ্চা বার কর। সাবধান গলায় কর্ড জড়িয়ে আছে।"
--
তাঁর ইমিডিয়েট সিনিয়র ডাক্তারের নেতৃত্বে জুনিয়র ডাক্তারদের টিম শিল্পীকে এটেন্ড করতে শুরু করলেন। জ্ঞান ফিরতে তার কানে এল, একজন জুনিয়র ডাক্তার বলছেন,"শুনুন, আপনার বাচ্চা হয়ে গেছে।" সারাদিন লেবার রুমের একটা বেডে অঘোরে ঘুমাল সে। বিকালে ঘুম ভাঙতে, যিনি অপারেশন করেছিলেন এসে পরীক্ষা করে, কেবিনে ফিরিয়ে দিতে নির্দ্দেশ দিলেন।
--
ট্রলি করে কেবিনে ফিরে শিল্পী, দেখল মা, বাবা আর স্বামী বসে আছে। মা উদ্বিঘ্ন গলায় প্রথমেই বীণামাসী কে জিজ্ঞাসা করলেন,"বীণা বাচ্চা কেমন আছে?" "এখন ভাল আছে মাসীমা, মস্ত ফাঁড়া কাটিয়ে মা - ব্যাটা বেঁচে ফিরেছে। দিদি ভাগ্যিস বড় ডাক্তার বাবুর হাত চেপে ধরেছিল। বাচ্চার গলায় নাড়ী জড়িয়ে বার হতে পারছিল না। তবে হ্যা মাসীমা,  হাউসস্টাফ রা আপ্রাণ করেছে। বাচ্চা অনেক্ষণ কাঁদেনি, ওদের চেষ্টার ফলে শেষ পর্যন্ত কেঁদে উঠেছে, প্রাণে বেঁচেছে।" আরও চার দিন বীণামাসীর যত্নে থেকে বাচ্চা নিয়ে বাড়ী ফেরে শিল্পী। 
--
এরপর কত বছর অতিক্রান্ত, আজও তার মনে বীণা মাসীর ছবি অম্লান। সেই জুনিয়র ডাক্তারদের নাম আজও তার মনে আছে, গঙ্গা, অমিতাভ, অভয়। তাঁরা সকলে ডাক্তার নরম্যান বেথুনের উত্তরসূরী।
 _________________________________________________________________________________________








    

No comments:

Post a Comment