10 Dec 2015

ভার

ভার
***

বৃষ্টির বাবা মারা যান ১৯৭১ সালে। সেই রাতের ছবিটা এখনও তার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন। সেদিন শরীর টা সকাল থেকেই খারাপ ছিল। ডাক্তারবাবু মোটামুটি ওকে বলেই গেছিলেন, "আর টানাহ্যাচড়া করে লাভ নেই, শেষ সময়টা শান্তিতে পরিবারের সাথে থাকাই কাম্য।" একমাস আগেই হাসপাতাল থেকে এই কথা বলেই ছুটি দিয়েছিল। তবু একটা মাস বাবার যত্ন করেতে তো পেরেছে বৃষ্টি।
--
মা তো তার কবেই চলে গেছেন। বাবা দুজনের স্নেহ দিয়ে তাকে বড় করেছেন। দাদা দিদিদের থেকে বয়সে সে অনেকটা ছোট। তাদের স্নেহও যথেষ্ট পেয়েছে। বাবা সবাই কেই খুবই স্নেহ/ভালবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন। প্রচুর পরিশ্রম করতেন। নামী এডভোকেট ছিলেন। আয় যথেষ্ট ছিল। কার কোন অভাব হতে দেননি সাধ্যমত। দাদা দিদিরা সবাই কৃতি ছাত্র/ছাত্রী ছিলেন। এখন সবাই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত, ভাল আয়।
--
একমাত্র বৃষ্টি এখন ইউনিভার্সিটির ছাত্রী,পড়াশুনায় ভাল। বাবা তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে না যেতে পারার দুশ্চিন্তায় ভুগতেন, তাঁর হাতে যে বেশী সময় নেই বুঝতে পেরেছিলেন। বৃষ্টির ঠাকুরদাদাও নামী এডভোকেট ছিলেন, বাবা তাঁর একমাত্র সন্তান। লেকের কাছে এক বিশাল বাড়ী করেছিলেন, নাতি/নাতিনীদের কথা ভেবে। বলা যায় বৃষ্টিরা যথেষ্ট স্বচ্ছল পারিবার।
--
বাবা বাড়ী আসার পর থেকে বৃষ্টি একাই আয়া মাসীদের সাহায্যে তাঁকে দেখাশুনা করত। নিজেই বাবাকে খাবার বা ওষুধ খাওয়াত, স্নান থেকে শুরু করে সব কিছু তার তত্বাবধানে হত। ইউনিভার্সিটি যাওয়া হত না। বাবা রাগ করতেন,"তুই আজও বাড়ী বসে আমার সেবা করবি,পড়াশুনা কি ছেড়ে দিলি? তোকেও কিন্তু ভাল রেজাল্ট করতে হবে।" " কদিন বাবার সেবা করলেই যদি রেজাল্ট ভাল না হয়, তবে সে পড়াশুনার দরকার কি?"
--
কিন্তু এই সময় টা ছেলেমেয়েদের একটু সান্নিধ্য মনে মনে আশা করতেন, যদিও মুখে কখনও প্রকাশ করেননি। তাঁর চার ছেলে /বৌ, বাকি দুই মেয়ে/জামাই, নাতি/নাতনি একই বাড়ীতে উপর তলায় থাকে। ইচ্ছে করলে পালা করে একটু সময় তাঁর সাথে অনায়াসে কাটাতে পারত। বৃষ্টি ই তাঁর অগতির গতি, দেখভাল ছাড়াও বাবাকে কাগজ/বই পড়ে শোনাত, গল্প করত। তিনি ঘুমালে তাঁর ঘরে বসেই নিজের পড়াশুনা করত।
--
সেদিন বিকাল গড়িয়ে গেলে বাবা মারা গেলেন। ডাক্তারবাবু ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে দিলেন। দিদি দাদারা একেবারে তাদের পরিবার সমেত এক তলায় বাবার ঘরে হাজির। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এদিকে সারা অঞ্চল পুলিশ/মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে। সমস্ত পাড়ায় চিরুনী তল্লাশী শুরু হল, ধরপাকড় চলল প্রায় রাত ১২/১ পর্য্যন্ত। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল।
--     
বৃষ্টি দের বাড়ীতে তখন অদ্ভূত এক পরিবেশ। বাবার মৃত দেহের সামনে ঘন্টাখানেক একটু কাঁদার পরই দাদা, দিদি, বৌদি, জামাইবাবুরা সবামিলে তন্ন তন্ন করে বাবার আলমারির চাবি খুঁজতে শুরু করল। উইল, কাগজ পত্র, মায়ের গয়না আর টাকাকড়ি  সব সেখানেই থাকত কিনা। এদিকে মৃতদেহের সামনে বৃষ্টি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। একটু ইতস্তত করে বড়দা তাকে বলল,"কাঁদিস না বোন, বাবার সময় হয়েছে চলে গেছেন। আমরাই তোর দেখভাল করব। বাবার চাবিটা কোথায় বলত।"
--
বৃষ্টি অবাক চোখে তাকায়,"বাবার চাবি ! এখন কি করবে চাবি দিয়ে!" "না মানে বাবার উইল, মায়ের গয়না, কাগজপত্র সব বার করতে হবেত", দাদার উত্তর। "কিন্তু এখন সেগুলি বার করতে হবে কেন!"- বৃষ্টির বিস্ময় কাটে না। মেজদি বলে,"বাঃ! বাবা কি রেখে গেছেন, কাকে কি দিয়ে গেছেন, দেখতে হবেনা " বৃষ্টি বলে,"এখনি দেখতে হবেই বা কেন!" বড়দি আমতা আমতা করে বলে,"আসলে সে সব ঠিক মত সবার মধ্যে ভাগ করতে হবেত।" " কিন্তু বড়দি,সেটা ত পালিয়ে যাবেনা। বাবার মৃতদেহ এখনও বাড়ীতে। দাহ হয়নি, আর এখনই  ভাগ বাটোয়ারা করতে হবে। দু /এক দিন পরে করা যাবেনা! আশ্চর্য্য! লোকে শুনলে কি বলবে!"
--
এবার হাল ধরলেন মেজদা,"বেশী পাকামী করো না! কোন লোক আছে এখানে, আমাদেরের একান্ত নিজেদের জন ছাড়া। আর এই গণ্ডগোলের মধ্যে মৃতদেহ নিয়ে তো বেরনো যাবে না, তাহলে আসল কাজ সেরে ফেলতে বাধা কোথায়।" এরপর কথা বাড়াতে বৃষ্টির প্রবৃত্তি হল না,"দ্যাখো, বাবার বিছানার গদির নীচে আছে!" "না না, বাকী বিছানা তো আমরা দেখেছি। বাকি শুধু....,বৌদির অসমাপ্ত কথা টা বৃষ্টি বুঝল, নীরবে বাবার বালিশের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে গোটা দশেক হাত ঝাঁপিয়ে পড়ল।
--
ভোর রাতে, বাবাকে দাহ করে ফিরে এসে বৃষ্টি অবসন্নের মত তাঁর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বেলা আটটায় ঘুম ভাঙলে, চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন দক্ষ যজ্ঞ হয়ে গেছে সে ঘরে। উঠে চোখ মুখে জল দিয়ে ভাল করে ঘরটা গুছাল, পরিষ্কার করল।বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, টেবিলের ঢাকনা সব বদলালো। বাবার আরাম কেদারার কাছে তাঁর হাতে পোতা একটা ফুলের টব রাখল। অনেক ফুল দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে, দেয়ালে টাঙানো বাবা আর মার বড় ছবি দুটিতে  মালা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে দিল।
--
স্নান সেরে, জামা কাপড় বদলে, বাবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। 'এঘরে এখন আর কারো দরকার পড়বে না। সবার প্রয়োজন তো কাল রাতেই মিটে গেছে' - একথা ভাবতে ভাবতে প্রিয় বান্ধবীর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেটা তাদের বাড়ী থেকে বেশ কিছু টা দূরে। যেতে যেতে মনে হল সারা পাড়ায় যেন শ্মশানের স্তব্ধতা। দোকান পাট বন্ধ, লোকজন খুব কম। যারা বাইরে বেরিয়েছে তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন অদৃশ্য দুঃখের ঝড়ে ভেঙে পড়ছে, মুখ গভীর শোকে বিহ্বল। বাচ্চারাও যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। বৃষ্টির মনে হল কোন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে আছন্ন সমস্ত এলাকা। 
--
বান্ধবীর বাড়ীর গিয়ে দেখে তারাও শোকে মুহ্যমান। "বৃষ্টি, শুনেছি তোর বাবা কাল মারা গেছেন, কালই যাব ভাবেছিলাম। কিন্তু পাড়ায় যে অবস্থা যেতে পারিনি, কিছু মনে করিস নিত। আজ যেতাম, তা তুই এত সকালে বাড়ী  থেকে বেরিয়েছিস?" "সে অনেক কথা পরে বলব, এখন মন ভাল লাগছেনা।" "আমাদেরও আজ খুব মন খারাপ। শুধু আমাদের কেন সারা পাড়ায়, না সারা বেলেঘাটাতেই আজ শোকের দিন।" "হ্যা, এতটা রাস্তা আসলাম, মনে হচ্ছিল কি একটা মারত্মক কিছু ঘটেছে। তোদের বাড়ীরও সবাই শোকগ্রস্ত বোঝাই যাচ্ছে। কি হয়েছে রে?"বৃষ্টি জানতে চায়।    
--
"জানিস  কাল পাড়ার চারটে অল্প বয়সী ছেলেকে গুলি করে মেরে লেকের ধারে ফেলে দিয়ে গেছে।" বৃষ্টি জিজ্ঞাসা করে, "সেকি, কেন !" "ওরা যে এই সমাজ ব্যবস্থা কে পাল্টাতে চেয়েছিল।" "মানে?" "মানে,ওরা নতুন মানুষ হতে চেয়েছিল। নতুন একটা সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল।" তারপর দুই বন্ধু চুপচাপ। মুখে কারও কোন কথা নেই, কিন্তু মনের মধ্যে যেন উথল পাতাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
--
বৃষ্টি বিরাট এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে," আচ্ছা আমাদের বাবা যে ছেলেমেয়েদের কে প্রাণপাত করে মানুষ করেছেন , তাঁর মৃত্যু তাদের মধ্যে কোন দাগ ই রেখ গেল না। অথচ এই ছেলেগুলির জন্যে সমস্ত এলাকা শোকস্তব্ধ। তাদের মৃত্যু অনাত্মীয় মানুষের বুকে কি বিশাল ভার চাপিয়ে দিয়েছে, কেন !" উত্তর এল," ওরা যে সূর্য্য ধরতে চেয়েছিল।"
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



















      






















































  

No comments:

Post a Comment