30 Oct 2016

দিশারী - পর্ব 4

দিশারী - পর্ব ৪
************
কখন ভোর হল দিশারী খেয়াল ই করল না। হটাৎ এক বিদঘুটে চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেল। তাকিয়ে দেখল গেটের সামনে একটি গোলাকার জমাদারনী বীভৎস মুখ বিকৃত করে গালি দিচ্ছে, " এই কুত্তীর বাচ্চা, চোখের মাথা খেয়েছিস নাকি ? দেখছিস না সকাল হয়ে গেছে,গেট খুলতে এসেছি। ফাইলে না বসে গেট জুড়ে বসে আছিস কেন।" দিশারী তাকিয়ে দেখে ঘরের মাঝখানে সবাই একটা লাইনে বসতে শুরু করেছে। দুটি সর্দারনী গোছের মেয়ে চেঁচাচ্ছে," ফাইল, ফাইল। এই শালী ওখানে কি করছিস। ফাইলে বস তাড়াতাড়ি। "বইসতেছি, তা শুধু মুধু সক্কাল বেলা সকলে মেইলে গাল পারতেছো কেনে ?"
 --
"তব্বেরে, হারামীর বাচ্চা, খুব সাহস দেখি ", বলে তেড়ে গিয়ে তার চুলের ঝুঁটি ধরে। খাপরদার আমার বাপেরে গাল পারবেনি বলতেছি।" এদিকে গেট খুলে জমাদারনী দুই চেলা (দালাল বন্দিনী ) নিয়ে ভেতরে ঢোকে, "কি হয়েছে রে আনোয়ারা, এত গোলমাল কিসের ?" একসাথে কয়েক জন বন্দিনী দিশারীর পক্ষ নিয়ে বলে," ও বেচারা  মাত্র কাল এসেছে, কিছু জানে না। আনোয়ারা খামোখা ওর পেছনে পড়েছে।"
--
জোটবদ্ধ প্রতিবাদের মুখে জমাদারনী বিজয়া আর শিখা সহ সব দালালরা ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। "ও, নতুন বটে। ছাড়ান দে আনোয়ারা। গুনতি কর।" একজন সমবয়সী মেয়ে দিশারীর হাত ধরে টেনে লাইনে বসিয়ে দেয়। গুনতি করে খাতায় লিখে নেয় আর একটি দালাল। নতুন রা সব গেটের কাছে লাইন দে, 'কেস টেবিলে' যাবার জন্য," বলে গোলগাল ওয়ার্ডারটি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে যায়।
--
দিশারী গেটের কাছে 'কেস টেবিলে' যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ায়। ইতিমধ্যে গেট দিয়ে একজন মোটাসোটা ধোপদুরস্থ মহিলা ঢোকেন। সব ওয়ার্ডার আর দালালরা হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে,"নমস্কার মেট্রন মা।" মহিলা তাদের দিকে কৃপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু হেসে তার অফিসে ঢুকে যায়। হাসপাতাল টাই ছিল মেট্রনের অফিস ঘর।
--
তারপর ছেলে জমাদার বাইরে থেকে ঘন্টি বাজালে গেট খোলা হয়। এক জমাদারনী নতুন বন্দিনীদের নিয়ে তার সাথে ছেলেদের ওয়ার্ডের যায়। সেখানে বড় একটা টেবিলে ডেপুটি জেলার, বড় জমাদার আর এক / দুজন অফিস কর্মী ছিল। উল্টো দিকে নতুন বন্দীরাও লাইন দিয়ে বসে। সবায়ের নাম ধরে ডেকে জাবদা একটা খাতা থেকে তথ্য মিলিয়ে, কি সব লিখছিল আর একটা জাবদা খাতায়। প্রত্যেকের একটা বড় কাগজে (যাকে জেলে টিকিট বলা হত ) প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করে নিচ্ছিল।
--
দিশারী একটু যেন আসার আলো দেখল। এইবারে সে সব কথা বলতে পারবে, তাহলে নিশ্চয় বাড়ী ফেরার একটা উপায় হবে। তাকে ডেকে নাম ধাম, বাবার নাম সব লেখা হল, কিন্তু সে তার গ্রামের নাম ছাড়া থানা, পোষ্ট অফিস, জেলা কিছুই বলতে পারেনা। ডেপুটি জেলার তাচ্ছিল্য ভরে জিজ্ঞাসা, "কি দুষ্কর্ম করে এসেছিস ?" " চাচা আমি সুন্দরবনের মেয়া। কলকাতায় খেটে খেইতে এইসেছিনু। নোকের বাড়ী কাজ কইরতেছিনু। গেরাম থেইকে এইসে পথ হেইরে গেইছে। মোরে শেলদা ইস্টিশনে যদি পৌঁছায়ে দেন, আমি আমার কাজের বাড়ী আর গেরামে দুয়োই খানে যেইতে পাইরব। দয়া করেন, অনেক তাহইলে আল্লা আপনের অনেক দোওয়া কইরবেন। "
--
খ্যাক খ্যাক করে বিদ্রূপের হাসি হাসে টেবিলের সকলে মিলে। একজন বলে," লেখ হারান কেস। আর একজন বলে, "যত দিন না তোর বাবা মা কোর্টে জজের কাছে উপযুক্ত প্রমান দিতে পারবে ততদিন তোকে এখানেই থাকতে হবে। "সরকার এখন তোর অভিভাবক। তোকে খেতে পরতেও দেবে চিন্তা নেই। তোদের মত কত অসহায় মেয়েদের এভাবেই সরকার সব বিপদের থেকে রক্ষা করে।" "কিন্তুক মোর আব্বা আম্মা জানবেক কি কইরে, যে আমি ইখনে রইছি।"
উত্তর আসে, "যা যা কাজের সময় গোল করিস না। এটাই হল আইন " জেনানা ওয়ার্ডে ফেরার পথে দিশারী ভাবে, 'এ কেমন আইন! কেমন ই বা সরকার! তারা নির্দোষ মানুষ কে রক্ষা করার নামে অন্ধ কূপে বন্দী করে রাখে!
--
ধীরে ধীরে দিশারী তার নতুন পরিস্থিতিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে লাগল। তাকে একটা এলুমুনিয়ামের থালা, একটা কম্বল আর একটা বস্তার মত মোটা লাল পাড় সাদা শাড়ী দেওয়া হল। সকালে একমুঠ পোকা ধরা ছোলাসেদ্ধ, কাঁচা চিড়ে বা এক টুকরো পাউরুটি, বা এক ডাব্বু বিভিন্ন ফসলের মেশানো খিচুড়ি দেওয়া হত। দুপুরে এক ডাব্বু ভাত, ৫০গ্রাম মত, জলের মত ডাল আর, মুখে দেওয়া অযোগ্য সবজির ঘ্যাট, আর রাতে বাজরা/ জোয়ারের আধা কাঁচা তিনটে রুটি ছিল বরাদ্দ। গরীবের মেয়ে সে, বাড়ীতে অতি সাধারণ মানুষরা যা খায় তাই খেত, কিন্তু তাতে যত্ন আর স্নেহের ছোঁয়া থাকত। এখানে খাবার পশুর ও খাওয়ার অযোগ্য ছিল, তার পরিমাণ এতই অকিঞ্চিৎকর, যে সহ বন্দিনীদের মত পেটের আগুন কখন নিভতো না।
--
সকালে ঘন্টা ২/৩ মত তারা ছাড়া থাকত। সেই সময়ের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ করে স্নান থেকে শুরু করে সকাল ও দুপুরের খাবার খেয়ে এক থালা খাওয়ার জল নিতে নিতেই লক আপ এর সময় হয়ে যেত। আবার বিকালে ঘন্টা খানেকের জন্য ছাড়া পেত রাতের খাবার খেয়ে আর খাওয়ার জল নিতে নিতেই লক আপের সময় হয়ে যেত। সন্ধ্যে বেলায় সহ বন্দিনীদের সাথে পরস্পরের সাথে নীচু গলায় সুখ দুঃখ বাটা, আর রাতে এক চিলতে জায়গায় আধ শোওয়া হয়ে ঘুমান। এর ওপর ছিল জেলের দালাল বাহিনী আর মেট্রনের নির্দেশ মত ওয়ার্ডারদের অত্যাচার। আর এখানে খিদের জ্বালায় একটা  বাড়তি রুটি বা এক মুঠো ভাতের জন্য, একটু বাড়তি সুবিধার বিনিময়ে দালাল তৈরী করা খুবই সহজ ব্যাপার ছিল।
--
গরাদের ধারের ভাল জায়গা গুলি থাকত দালালদের জন্য। যদি ৭৫ জন লোকের থাকার ঘরে ২০০ লোক কে থাকতে হয় আর তার আধা জায়গা গোটা ৭/৮ লোক দখল করে নেয়, তবে বাকীদের বস্তাবন্দীর মত রাত কাটান ছাড়ান পথ থাকেনা। মাটির মেয়ে দিশারী নির্বাক চিত্তে সব সহ্য করত। কিন্তু প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্নতা টা অসহ্য লাগত, কিছুতেই  মেনে নিতে পারত না। গেটের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ত, তাতে রাতের শোবার এক টুকরো জায়গা দখল হয়ে গেলেও আপত্তি ছিল না। দালালদের জন্য সেটাও অনেক সময় সম্ভব হত না।আর ঘরের এক কোনে পাঁচিল ঘেরা একটা জায়গা ছিল যেটা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার হত তার দুর্গন্ধে দিশারীর পেটের নাড়ি উল্টে আসতো। মনে পড়ত গ্রামে তাদের নিকান, পরিচ্ছন্ন ছোট্ট কুটিরের কথা।
--
দ্বিতীয় রাতে না জেনে দালাদের নির্দিষ্ট ফাঁকা জায়গায় সে তার জিনিস পত্র নিয়ে রওনা দিয়েছিল। পাশ থেকে শোভা  নামে একটি মেয়ে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়, "আরে,আরে ওদিক খবরদার যেও না। ওগুলি আনোয়ারা, কাঁদা  মন্ডল, পুঁটিরানী, আসগরি, আরতি, সমেদা দের জায়গা। ওখানে কারও যাওয়া নিষেধ, গেলে মেরে রেখে দেবে। ওরা মেট্রন আর ওয়ার্ডারদের খুব প্রিয়, তাদের সব হুকুম তালিম করে, একে মারা,তাকে সেল বা পাগল বাড়ীতে ঢোকান, কাকে কম খাবার দেবে, কাকে বেশী সব কিছু। আমাদের খাবার মেরে  মেট্রন /ওয়ার্ডারদের দেয়, তাদের গরু/মোষ খাবার জন্য আর অসুস্থদের ডাক্তারবাবু ডায়েট লিখে দিলে, সেখান থেকে ডিম, বিস্কুট, দুধ, মাছ তাদের না দিয়ে মেট্রন,ওয়ার্ডারদের দেয়। কারো বাড়ী থেকে খাবার বা জিনিস পত্র এলেও নিয়ে ওদের দেয়। ওরা হল জেলের দালাল। ওদের ধারে পাশে যাবি না, বিপদে পড়বি। হয় দালালের দলে নাম লেখাতে হবে নয় মারধর খেতে হবে। তাই ওদের সব সময় এড়িয়ে চলবি।"
--
দিশারী শোভার, সাথেই থাকত। আস্তে আস্তে তাদের সাথে আরও শ্যামলী, মীরা,শান্তিবাই, শ্যামবাই, বেলা, হাওয়া বিবি,শান্তি মাসি  আরও অনেকে জুটল। দুই মীরার একজন বাংলা দেশের মেয়ে, তার মতোই হারান কেস। আর এক  মীরা ছিল রেপ কেসের ভিক্টিম। যে তাকে রেপ করেছিল সে মুক্ত হয়ে আরও কতজনের সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছে কে জানে । আর মীরা তার দেওয়া হাড় জিরজিরে একটা বাচ্চাকে বুকের  মধ্যে অপরিসীম মমতায় আঁকড়ে ধরে অন্ধ কূপে তিল তিল করে মরণের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজ একজন ধর্ষক কে মেনে নিচ্ছে কিন্তু ধর্ষিতাকে, বিশেষ করে একজন কুমারী মা কে মেনে নেবে না বলে মীরার গরীব বাড়ীর লোক তাকে বাড়ীতে নিয়ে যেতে ভয় পেয়েছে। সরকারি তত্ত্বাবধানে জেলে ফেলে রেখে দিয়েছে।বেলা চুরি কেস এ আটক। শান্তিবাই / শ্যামবাই খুনের কেসে ইত্যাদি। লক্ষ্মী ডাকাতি কেসে।        
--
বেলা চুরি না করেও মিথ্যা আরোপে আটক। সবাই বলে ও যদি জজের সামনে চুরির অভিযোগ স্বীকার করে নিত, তাহলে ১০/১৫ দিনের সাজা খেটে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ও তা করেনি, তাই এখন জেলে পচছে। "তা, যে চুরি কইরেনি, সে কেনেই বা বইলবে কইরেছে। সম্মানে লাগবেনি। আর এ কেমন বিচার ধারা, অন্যায় না কইরে মানতি হবে,"  দিশারী বলে। "তা হইলে তুই /আমি কি অন্যায় করসি, ক দেহি। আর শ্যামলী অর বাপের অমতে বিয়া করসে। অর বাপ নাবালিকা কইয়া অরে, জ্যালে দিসে। শোভারে অদের গাঁয়ের জোতদারের ব্যাটা অরে বিয়া কইরবার কথা কইয়া নষ্ট করসে। পোয়াতি হইয়া পরলে বড়লোকের ব্যাটা উলটাপালটা কইয়া গাঁয়ের লোকজনরে কু বুঝাইয়া অরে জ্যালে পুরসে। এইজে হাওয়া বিবি, উয়ারে আর উয়ার বরেরে মিছামিছি খুনের ক্যাস দিসে। শোনিচারিরে বাপের বসতবাটি আর জমিটুক হরপের লাইগ্যা জমিন্দারে খুনের কেসে জড়াইসে। আসলে এ দুনিয়ায় বিসার নাই,"মীরা বলে। দিশারী যত দেখে, শোনে ততই অবাক হয়। ভাবে এ কেমন দুনিয়া!
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
(চলবে)








  

  






   

No comments:

Post a Comment