6 Jul 2019

হাওয়াবিবি .

হাওয়াবিবি
***********

লম্বা ছিপছিপে চেহারা, কাল মিশমিশে লম্বা লম্বা চুলে, একটা হাত ঘুরিয়ে হাওয়া বিবি কেমন করে একটা খোঁপা বেঁধে রাখত। চুলগুলি ছিল তার বড় আদরের, সুযোগ পেলেই একটা ফুল বা পাতা গুঁজে রাখত। ডাগর ডাগর দুটি শিশুর মত সরলতা মাখা চোখ। সামনের দাঁতের পাটি একটু উঁচু, তাতে যেন তার আদিবাসী গ্রাম্য চেহারায় আলাদা একটা মাধুর্য্য এনে দিয়েছিল। আমাদের সকলের সাথেই তার ভাব, কিন্তু মলয়ার প্রতি তার একটু বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল। মলয়া তাকে শুধু হাওয়া বলে ডাকত। 
--
মলয়া তার উলকাঁটা নিয়ে মেয়াদী ঘরের জালনায় বসে আর হাওয়া গরাদের ওপার থেকে মলয়ার কান ঘেঁষে নিজের বিচিত্র জীবনের সব গোপন কথা যেন বলত। আমাদের বাকীদের কাছে জীবনের অল্পবিস্তর গল্প বলত বটে, কিন্ত তখন তার বলার থেকে শোনার চাহিদা ছিল বেশী। আমাদের পার্টির উদ্দ্যেশ্য বন্দিনীদের কাছে  সহজ ভাবে বলা হত, বিশেষ করে গল্পের মধ্যে দিয়ে।আর এইসব গল্প শোনার খুব  আগ্রহ ছিল হাওয়া বিবির। 
--
হাওয়া তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, চোখের মনি। খুব একটা অবস্থাপন্ন না হলেও একটি মাত্র সন্তান কে বড় আদরে মানুষ করেছিলেন। সাধ্যের অতিরিক্ত করে অবস্থাপন্ন ঘরে তার বিয়ে দেন। কিন্তু কাজে কর্মে পোক্ত না হওয়ায় শ্বশুর শ্বাশুড়ির গঞ্জনা শুনতে হত রাত দিন। স্বামীটাও ছিল চরিত্রহীন ও অত্যাচারী। এসব হাওয়ার বাড়ীতে আগে কেউ জানত না। হাওয়ার থেকে বয়সেও অনেকটা বড়। শারীরিক ভাবে তাকে তৃপ্ত করতে পারত না। ভোগ করা ছাড়া বিন্দু মাত্র স্নেহ ভালবাসা স্ত্রীর প্রতি ছিল না। এদিকে হওয়ার বাপের কাছ থেকে নানা ছুতায় নিত্যি নতুন পণ আদায়ের চেষ্টা করত। অন্যদিকে হওয়ার ওপর মারধর আর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়েই চলতে থাকে। মেয়ের দুর্দশা দেখে আর নিত্যি পণ এর দাবীতে অতিষ্ট হয়ে বাপমা মেয়েকে বাড়ী নিয়ে আসতে বাধ্য হয়, পাছে মেয়েকে একেবারে মেরে না ফেলতে পারে।  
--
বাপের ঘরে ফিরে হাওয়া খুব খুশী। সাথীদের সাথে খেলে বেড়ায়। কাছেই ছিল খালার বাড়ী। দুই খালাত ভাইদের সাথে ভারী ভাব, তাদের কাছে হাজার বায়না। গাছের উঁচু উঁচু ডাল থেকে  ফল, ফুল পেড়ে দেওয়া, পালা পার্বণে মেলায় নিয়ে যাওয়া। সঙ্গিনীদের সাথে ফল ভাগ করে খাওয়া, ফুল দিয়ে চুল বাঁধা, হাতে কানে গলায় পরে। কিন্তু আদরের মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে বাবামা চিন্তিত। এদিকে কৈশোরের  শেষ সীমায় এসে দাঁড়ায় সে, অনেক কিছু বুঝতে শেখে। সংসারের দায়িত্ব খানিকটা  টা নিজের কাঁধে তুলে নেয়, বাজান আর খালতো ভাইদের সাথে প্রতিদিন মাঠে খাটতে যেতে শুরু করে।
 --
অবশেষে পরিণত শরীর আর মন নিয়ে বড় খালাত ভাইয়ের সাথে প্রেমে পড়ে। দুই বাড়ীর বয়স্করা মিলে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। হওয়ার চিন্তা দূর হওয়াতে বাজান, আম্মা আশ্বস্ত হয়ে নতুন উদ্যমে খাটতে শুরু করেন। মহানন্দে হাওয়া বিবি তার নতুন সংসার শুরু করে। স্বামী, দেওর মাঠে চাষ করে, খালার সাথে মিলে ঘর সংসারের বাকী কাজ করে। সবাই খুব খুশী। কিন্তু গরীবের সুখ বড় ক্ষণস্থায়ী।বছর না ঘুরেতেই হাওয়ার আগের চরিত্রহীন স্বামী সুযোগ পেলেই তার পিছনে লাগতে শুরু  করল, তাকে ভোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সব কথা বাড়ীতে খুলে বলে, সকলে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন হন। হাওয়াও সাবধান থাকার চেষ্টা করত। তার নতুন স্বামী বিবিকে জান দিয়ে ভালবাসত। হাওয়াকে সব সময় সাহস দিত, -"মরা দুটা জোয়ান মরদ থাকতে, তুকে কিছু কৈর্তে লারবে, তুর কুনো ডর লাই। " 
--
কিন্তু দুর্ভাগ্য, একদিন হাওয়া মাঠে স্বামী ও দেওরের দুপুরের খাবার খাইয়ে যখন বাড়ী ফিরছে, শয়তান টা তাকে অমানুষের মত  ধর্ষণ করে। প্রায় টলতে টলতে ঘরে ফিরে অবসন্নের মত পড়ে থাকে সে। স্বামী আর দেওর কাজ থেকে ফিরে সব শুনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে টাঙ্গি হাতে বেরিয়ে যায়, অনেক রাতে নদীতে স্নান সেরে ফিরে আসে। "তুকে আর জ্বালাতন করবেক নাই, মরা শয়তানটোৱে বুঝায়ে দিছি।" রাতে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পরে। দিন কতক বাদে নদীর জলে ফুলে ঢোল বীভৎস একটা লাশ ভেসে ওঠে। পুলিশ এসে গ্রামের সবাই কে জিজ্ঞাসা বাদ করে, কেউ চিনতে পারেনা। দিন ১৫ বাদে পুলিশ এসে হাওয়া বিবি আর তার স্বামী দেওর কে ধরে নিয়ে যায়। তিনজনের বিরুদ্ধে ওই অপরিচিত লাশ টাকে খুন করার দায়ে কেস দায়ের করে। তিনজনকে প্রেসিডেন্সী জেলে নিয়ে আসা হয়।
--
 কোর্ট পড়লে হাওয়া কোর্টে যায়, স্বামী দেওরের সাথে দেখা হয়, জেলের মধ্যেও ছেলেদের ওয়ার্ড আর মেয়েদের ওয়ার্ড থেকে তাদের মধ্যে অফিস ঘরে ইন্টারভিউ হয়। হওয়ার খালা আর আব্বুজান শক্ত ভাবে উঠে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, যেটুকু সম্বল ছিল আর আত্মীয় স্বজনের থেকে ধার করে উকিল লাগিয়েছে।   ধীরে ধীরে জেলের মধ্যে তার কিছু  বান্ধবী হয়, আমাদের সাথেও রীতিমত গল্প হত। বিশেষত  মলয়ার প্রতি তো তার নির্ভরতার শেষ ছিল না। আমাদের নাটক গারদের ওপার থেকে মেয়াদি নম্বরে বসে দেখতে ভালবাসত।
--
মোটামুটি ভাবে জেল জীবনে সে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। তবে স্বাভাবিক ভাবে ই  মাঝে মাঝে ই বাড়ীর জন্য কাঁদত, আর কেসের কথা ভেবে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ত। আমরা তার জেলের সাথীরা সবাই সান্তনা দিতাম, "কাঁদিস না, কেসে তোদের কিছু হবে না, কে একটা অপরিচিত লোক মরছে আর গাঁয়ের কেউ তো তোদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী ও দেয়নি, যাকে তোরা চিনিসনা, জানিস না তার জন্য তোদের কেন সাজা হবে। " "তবে জেলের ওই মাতব্বর মেয়াগুলান  (জেলের দালাল বাহিনী) যে সব্বদাই মকে বলে মদের সক্কলের ফাঁসী  হবে !" ওদের কথা ছাড়, ওরা তো কারো ভাল চায় না, আর তুই তো ওদের দলে যোগ দিসনি,তাই তোকে ভয় দেখায়। " শুনে সে আস্বস্ত হয়।
--
অবশেষে একদিন কোর্টে তাদের কেস ওঠে। সকলে খুব খুশী। হাওয়া হাওয়ায় উড়তে উড়তে কোর্টে যায়। সন্ধ্যে বেলায় কোর্টের সবাই ফেরৎ আসে। বন্ধ গরাদের ভেতর আমরা উদগ্রীব হাওয়ার খবর পাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই সারা ফিমেল ওয়ার্ড হাওয়ার করুণ অসহায় কান্নার প্রবল ধাক্কায় খান খান হয়ে গেল। বহু রাত ধরে তা প্রতিদ্ধনি চলতে থাকে।  নিরুপায় আমরা সকালের অপেক্ষায় থাকি। সেদিন ডিভিশন ওয়ার্ডের ডিউটি তে একজন ভাল ওয়ার্ডার ছিল। তার কাছে শুধু শুনতে পেলাম হওয়াদের কারোর জামিন হয়নি।
--
পরদিন সকালে ছুটে মেয়াদী নম্বরের জালনায় গেলাম, সেখানে হাওয়ার প্রিয় সঙ্গিনীরা খবর দিল হাওয়া কিছু খাচ্ছে না, সারা রাত ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছে, এখন গোঙাচ্ছে। কেউ তাকে সামলাতে পারছেনা,পাগলের মত করছে।খালি বলছে ওর স্বামী, দেওর সবার ফাঁসী হয়ে যাবে, কোর্টে থেকে সেই কুখ্যাত নীহারিকা নামে ওয়ার্ডার নাকি শুনে এসেছে। আমাদের কাছেও আসতে চাইছেনা। এইভাবে কেটে গেল। হাওয়ার সাথীরা আর আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
--
জেলখানার ইতিহাসে একই ঘটনা বার বার ঘটে সবাই দেখেছি।  সাজার খবর বা বাড়ীর কোন দুঃসংবাদ এলে অথবা নরকের অপ্রকৃতিস্থ পরিবেশে কেউ সামান্য মানষিক ভারসাম্য হারালেই হয় নীচে অন্ধকার স্যাৎস্যাঁতে সেলে অথবা পাগল বাড়ীতে ঢুকিয়ে দিয়ে পুরো পাগল করে দেওয়াই রেওয়াজ। হাওয়াকে বাঁচানোর জন্য হাওয়ার প্রিয় শান্তি মাসীর দায়িত্বে আরও ভরসাযোগ্য দু জন কে অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের মাসীমার ক্যাম্পোস বড়ি একটা করে  দুবেলা জলের সাথে  ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দিতে বলা  হল। এইভাবে ৩ দিন চলল। অবশেষে হাওয়া একটু স্বাভাবিক হল, অল্পসল্প খেতে শুরু করল। আমাদের কথা মত ক্যাম্পোসের পরিমান আস্তে কমিয়ে দেওয়া হল।
--
অবশেষে দিন পাঁচ পরে শান্তি মাসী ওকে আমাদের কাছে নিয়ে এল। কিছুক্ষণ মলয়ার হাত দুটো ধরে চুপ করে বসে রইল। আমাদের বাকী কজনকে চলে যাবো কিনা ইতঃস্তত করতে দেখে, ভাঙা গলায় হাওয়া বারণ করল, " তরাও শুন, মুই তদের কাছে যে কথাগুলান বুলি নাই, সেগুলান বুইলতে চাই।  তরা মকে ভুল বুইজলেও, কুঁচু হবেক নাই। " "কেন ভুল বুঝবো। তোর মনের কথা খুলে বল, তাতে তুই শান্তি পেলেই আমরা খুশী। " "জেডা মইরে, ফুইলে, ভাইসে উইঠেছিল, উটা ছিল মর পুব্বের শয়তান সোয়ামিডা। মর ইখনকার সোয়ামি মর আসল সোয়ামি তো বটেক, উ মরে কাউরে  বৈলতে মানা কৈরেছিল, ইমনকি শয়তানডার সাথ মর দেখা হব্বার কথাডা ও কাউরে কইতে মানা কৈরেছিল, তাই কাউরেই কই নাই। তা তুরা মুকে খারাপ ভাইবতে পারিস বটে। "
--
আমরা সবাই তাকে আশ্বস্ত করলাম ," তোর বর খুব বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছে। আর তুই ও একদম ঠিক করেছিস। তোরা কোন ভুল করিসনি। এখনও আর কাউকে খবরদার কোন কথা বলবি না। তোদের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী, প্রমান কিছুই নেই। শয়তানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে থাকলেও কোন দোষ করিসনি। একদম মুখ বুজে থাকবি। সাক্ষী, প্রমান না পেলে ফাঁসী তো দূরের কথা, শুধু সন্দেহের বশে কোন সাজা আইনত দেওয়া যায় না।" শুনে হাওয়া অনেকটা আশ্বস্ত হল।
--
আমাদের যদিও জানা ছিল পয়সা দিয়ে এই ব্যবস্থায় বিচার কেনা যায়। তবে হওয়ার বাজান, খালা, আর আত্মীয় স্বজন অনেক চেষ্টা করে ভাল উকিল দিয়েছে। কোন জোরাল প্রমান আর সাক্ষ্য ও পাওয়া যায়নি। আশেপাশের গ্রামের মেয়েদের জীবন অতিষ্ট করে তোলার জন্য মৃতের প্রতি পাড়া পড়শীর কোন সহানুভূতি ছিল না, এগুলি ভরসার কথা। আরও বছর খানেক বিচার চলার পর, হাওয়া, তার বর আর দেওর বেনিফিট অফ ডাউট এ খালাস পেল। সকলেই খুব খুশী। যাওয়ার সময় জনে জনে সম্ভাষণ জানিয়ে গেল।এক চোখে একদিকে বিচ্ছেদ বেদনা অন্য দিকে আনন্দের অশ্রু  নিয়ে আমাদের হাওয়াবিবি জেলের কাল কুঠুরী ছেড়ে আপনজনদের কাছে ফিরে গেল। 
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


                  


  




  







  








    







   

No comments:

Post a Comment