13 Jul 2019

শান্তিবাই

শান্তিবাই
*******
শান্তিবাই ছিল খুনের কেসের বন্দিনী। শ্যামবাই তার ঘনিষ্ট বান্ধবীও একই কেসে জেলে ছিল। দুজনেই যৌনকর্মী, একই পল্লীতে পাশাপাশি ঘরে থাকত। শ্যামবাই ছিল অপূর্ব সুন্দরী, অনেকটা লম্বা,ফর্সা টুকটুকে গায়ের রঙ। ডাকের সাজের প্রতিমার মত ডাগর ডাগর চোখ, টিকাল নাক, লম্বা কোমর ছাড়িয়ে লম্বা  কালো কুচকুুুচে চুল। শ্যামবাই ছিল লখনৌয়ের আদি নাম করা বাঈজী ঘর থেকে আসা মেয়ে। তাঁর কাছে শুনেছিলাম, তাঁদের ঘরানার নিয়ম অনুসারে ঘরের ছেলের বউদের লাইনে নামতে দেওয়া হত না, যাতে সন্তান হলে সে যে নিজেদের পরিবারের কিনা বোঝা যায়। লাইনে নামানো হত বাড়ীর মেয়েদের। সেই রীতি অনুসারে শ্যামবাই লাইনে আসে। সে  তখন সন্তানসম্ভবা, অনাগত সন্তানের প্রতীক্ষা করছে। সাধারণভাবে কুমারী যৌন কর্মীদের দর বেশী হয়। এমনিতে সৌন্দর্যের জন্য শ্যামবাই এর প্রচুর কদর ও খরিদ্দার ছিল। বাঁধা বাবুদের সংখ্যা ও নেহাৎ কম ছিল না। সন্তান হলে তার বাজার খারাপ হতে পারে, সে সম্ভাবনা  থাকলেও গর্ভবতী হওয়াতে তার কোনরকম দুঃখ বা দুঃশিন্তা ছিল না। মা হবার আনন্দে সে ডগমগ, এমন কি রীতিমত গরবিনী ছিল বলা যায়। শান্তিবাই তার সব কাজ করে দিত. পান থেকে চুন খসলে পাছে তার সন্তানের কোন ক্ষতি হয় এই আশঙ্কায় বান্ধবী কে বকে ভূত ভাগিয়ে দিত। শান্তিবাইকে কখন কোন রাগ করতে দেখা যেত না। শ্যামবাইয়ের অনাগত সন্তানের জন্য তারও দুঃশ্চিন্তা আর আনন্দ দুই ছিল, সে ও মাসি হতে চলেছে।
---
শান্তিবাই বিহারের আদিবাসি মেয়ে, শ্যামলা রঙ, সাপের মত লম্বা একটা বিনুনি,শ্যামবাইয়ের মত না হলেও অনেক টাই লম্বা ছিল। বয়স ১৭/ ১৮, চাবুকের মত ছিপছিপে শরীর, একফোঁটাও মেদ ছিলনা আর বিদ্যুৎ গতিতে চলা ফেরা করত। গ্রামে ভূমিহীন ক্ষেত মজুরের ঘরে তার জন্ম। সারাদিন ক্ষেতে, ঘরে দুঃসহ পরিশ্রম করত, দিনে এক বেলা খাওয়া। খাটতে তার কোনরকম আপত্তি ছিল না, শুধু পেটের ভুখটাই সহ্য হত না। তাইতো গ্রামের বড়লোকের বাড়ীর বাজার ঘাট করার ছেলেটার খপ্পরে পড়ল।  সে জোতদারের কাজে বিভিন্ন শহরে যেত , অনেক খবর রাখে। কোলকাতায় গেলে অনেক ভাল কাজ পাওয়া যাবে, দুজনে খাটবে, বিয়ে করে ঘর পাতবে, পেট ভোরে খেতে পাবে, এই স্বপ্ন দেখে একদিন তার সাথে পালিয়ে চলে এল কলকাতায়।
---
ছেলেটা তাকে নিয়ে তুলল পতিতা পল্লীতে। অনেক রাতে প্রায় অন্ধকার বড় একটা বাড়ীতে ঢুকল তারা। বয়স্কা একজন মহিলার সাথে আলাপ করিয়ে দিল বাড়ীওয়ালি বলে। তাকে একটা ঘরে বসিয়ে বললো, "তু থোড়া ঠ্যার য়া,খানা ভেজতা হুঁ ,পহলে খালে, ফির শো যা। ম্যায় ঘর কি কিরায়া কা বাত করলু, শুভা মে তেরে আউর মেরে কাপড়া, ঔর কুছ সমান খরিদ কর দুপহর আউঙ্গা। নাহা ভি লেনা, ঔর সাজধাজকে মেরে ইন্তেজার করনা। একসাথ খানা খাকে, কলকাত্তা ঘুমনে যাউজ্ঞা ।"
---
সরল বিশ্বাসে শান্তিবাই বাড়ীওয়ালি মাসীর দেওয়া খাবার খেয়ে খুব খুশি, জীবনে প্রথম পেট ভরা খাবার খেতে পেয়েছে। সেই ঘরেই পাতা মাদুরে শুয়ে ভবিষ্যতের সুখের সংসার পাতার স্বপ্ন দেখতে দেখতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন অনেক বেলায় মাসী ডেকে দিল। স্নান করে, খেয়েদেয়ে সেজেগুঁজে তৈরী  হয়ে নিতে বলল। পাশের ঘরেই শ্যামবাই থাকত। সেই কিছু ভাল জামাকাপড়, প্রসাধনী জিনিসপত্র আর কাঁচের চুড়িপুঁথির মালা, নাকে, কানে পেতলের গয়না ইত্যাদি দিল। এসব জিনিস পরা তো দুরস্থান, জীবনে কোনদিন চোখেই দেখেনি। শান্তিবাই মহাখুশী, চটপট তৈরী হয়ে তার গ্রামের লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, তার বিয়ে হবে, সুন্দর একটা সংসার হবে, পেট ভরে দুবেলা খেতে পাবে, আর কি চাই।
--
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর, হটাৎ করে বাড়ীওয়ালি মাসি তার ঘরে একজন দেহাতি লোক কে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো  " নে তোর মরদ এয়ে গেছে,", কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় একটা ওড়না চাপিয়ে দিয়ে মুখ পর্যন্ত্য ঢেকে দিল। লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, " নাও, বাপু এবার মাথায় সিঁদুর দে, বে সেরে লাও, তারপর ঘর কর, তবে হ্যাঁ মাসের ভাড়া আর আমার দিনের হক মেরোনি, আর পেইল্যে যাবার চেষ্টাটি কর নি, তাইল্যে গুন্ডা দিয়ে এমন হাপিস করে দেব, কেউ টেরটি পাবেনি, " বলেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে, বাইরে থেকে শিকল টেনে দিল। বাড়ীওয়ালীর কথা শুনে শান্তিভাই ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কিছু বোঝার বা ভাল করে দেখার আগেই এক খাবলা সিঁদুর তার মাথা, মুখ ভরিয়ে দিয়ে  শান্তিকে সবলে আকর্ষণ করে কামুক লোকটি প্রাণ ভরে নিজের খিদে মেটাল। তারপরে তার হাতে ৩০ টাকা গুঁজে দিয়ে বলল," আমি রোজ রাতে আসবো, রাতটা আমার জন্য খালি রাখবি, দিনে যত ইচ্ছে খদ্দের নিতে পারিস। " বলে দরজা ঠক ঠক করলে দরজা খুলে গেল।  লোকটা বেরিয়ে গেল আর শান্তি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
--
শ্যামবাই দৌড়ে এসে সান্তনা দিতে লাগল। শান্তির মুখে একটাই কথা, " থোড়া পেটভর খানেকে লিয়ে ম্যাঁয় এ কিস জাহান্নামে আ গেই। " ধীরে ধীরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শ্যামবাই নিজের জীবনের একই কাহিনী শুনাল। তেরী গাঁও কে মরদ ভি আওর এক খুদগড়জ আদমি হ্যায়, শাদী কা ওয়াস্তা দে কর তুঝে মাসী কে পাস্ বেঁচে দে কর ভাগ গেয়ি। ও তো দালাল হ্যায়, লড়কি লানা উস্কা কাম হ্যায়, পহলে ভি বহুৎ সারি লায়া। ইয়ে আদমি হর রোজ তেরে পাস্ আয়েগা,আছ্ছি বাত। পহেলা দিন মে তুঝে  পসন্দ কর লিয়া, দেখনা তেরে লিয়ে কুত্তাকে মাফিক হর রাত আয়েগি, প্যায়ার করেগি, কুছদিনকে লিয়ে তুঝে নেহি ছোড়েগি। মগর উস্কে বাত মে কভি না  ফাঁস যানা, ইঁহা সাচ্চা পেয়ার নেই হোতা। দিল কভি দেনা কিসিকো, চোট খায়েগি। ইঁহা যব তক মরদ কো আচ্ছে লগতে, তব তক পেয়ার ঢঙ রচায়গী, বাদমে আচ্ছে ঘরসে লড়কিকো শাদী করেগা, বিচ বিচ মে তেরে পাস আ সকতা, আনে দেনা মগর কভি দিল নেহি দেনা। দিন ভর তু আউর কাস্টোমার লেনা, বহুৎ কামানা, কুছ কুছ আনেবালা দিন কে লিয়ে জমাকে রাখনা। আউর শুন ভাগনে কা কোশিশ কভি নেহি কর না, এ বহৎ খতরনাক জাগা হ্যায়, খুন হো জায়গী। অব তেরে পাস দুসরা কই রাস্তা হ্যায় কেয়া !"
---            
সত্যি আর কোন পথ তার চোখে পড়লোনা, এই অজানা অচেনা জায়গায় সে কি করবে, বাড়ীওয়ালি মাসির কথাগুলি মনে পড়তেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। তখন থেকে শুরু হল তার পতিতাবৃত্তি। রাতে লোকটি নানা রকম খাবার, গিল্টি গয়না বা কাপড় চোপড় নিয়েও মাঝে মধ্যে নিয়ে আসে,পশুর মত তাকে ছিড়ে খায়। রাত শেষ হবার আগেই চলে যায়। বছর পার হয়ে গেল, শান্তি আর দিন ক্ষণের হিসাব রাখে না। পেট ভরে খায়, সাজগোজ করে, বেশ কিছু টাকা ব্যাংকে ও জমাতে থাকে। লোকটি মাঝে মাঝে মাসীকে বলে সিনেমায় নিয়ে যায়, বেড়াতে নিয়ে যায়।সরল মেয়েটা শ্যামবাইয়ের সতর্কীকরণ ভুলে লোকটাকে ভালোবেসে ফেলে। ব্যাস ভয়ংকর বিপদ এসে গ্রাস করে তাকে।
---
শান্তি বাই  লক্ষ্য করতে শুরু করল লোকটা আজকাল প্রায়ই আসেনা, এলেও তাড়াতাড়ি চলে যায়, বাইরে বেড়াতেও নিয়ে যায় না। একদিন তো এসব নিয়ে বেশ ঝগড়া হয়ে গেল দুজনের মাঝে। লোক ঝগড়ার মধ্যে বলে বসে," তু কি মেরে শাদী  কিয়া জরু, নেহি  ম্যায় তেরে  সচমুচ কা প্রেমী হুঁ। হর রোজ তেরে সাথ রাত বিতানা পড়েগা ?  শালী রেন্ডী, তেরে সাথ বাহার ঘুমনে যানেসে, অউর মেরা নয়া জরু দেখ লেনেসে, মেরা ঘর টুট যায়গা, তব কেয়া হোগা ?" শান্তিবাই পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়, ঠান্ডা গলায় বলে," কুত্তা আভি নিকাল যা।" কিন্তু দু দুবার ভালবাসার অপমান সে  সহ্য করতে পারেনা, সব আশা চুর চুর হয়ে যায়, প্রানঢালা ভালোবাসার বদলে এত কুৎসিত গাল দিল। তাদের এই গালি তো সবাই দেয়, কিন্তু  দু দুবার এত বিশ্বাস আর ভালবাসার এই পরিণাম।
--
পরদিন আর ঘর থেকে বার হয় না, শ্যামবাই ব্যাপার টা আঁচ করতে পারে। সবাই কে সরিয়ে দিয়ে একা শান্তিবাইকে আগলে রাখে। তার কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করে, খাওয়ায়, স্নান করতে নিয়ে যায়। শ্যামবাইয়ের খদ্দের এসে গেল শান্তিবাই দরজা বন্ধ করে একা একা শুয়ে চিন্তা করতে থাকে। অপমানে আর  বিশ্বাসঘাতকতা তার মাথায় ছোবল মারতে থাকে। মনে মনে ঠিক করে যে করেই হোক এর প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু তার মনভাব কাউকে বুঝতে দেয়নি। আগের মত খদ্দের ধরতে শুরু করে। সেই লোকটি খবর পায় শান্তিবাই আবার আগের মত কাজ করছে।
--
কামুক লোক মোহ কাটাতে না পেরে শান্তিবাই কে খুশী করার জন্য খাবার দাবার কাপড়চোপড় নিয়ে হাজির হয়। শান্তিবাই খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করে, বৌকে নিয়ে পরিহাস করে. ধীরে ধীরে আবার রোজ রাতে তার ঘরে আসতে শুরু করে। শান্তিবাই তার বিশ্বস্ত লোক দিয়ে বিষ সংগ্রহ করে। একদিন খাবার আর প্রচুর মদ খাওয়ায়।  মদের মধ্যে মিশিয়ে সেই বিষটুকু সবটা খাইয়ে দেয়। সকাল বেলায় হইচই পরে যায়। পুলিশ তার সঙ্গে শ্যামবাইকেও ধরে আনে। বাড়ীওয়ালি তাদের জানা ভাল উকিল লাগায়, শান্তিবাই আর শ্যামবাই এর খদ্দেররা টাকা ঢালে। শান্তিবাই পুলিশের কাছে স্বীকার করে শ্যামবাইয়ের কোন দোষ নেই, সে কিছুই জানত না। একাই সে সবকিছু করেছে। শ্যামবাই ছাড়া পেয়ে যায়। শান্তিবাইয়ের কেস চলতে থাকে।
--
জেলের খাবারে শান্তির স্বাভাবিক পেট ভরতো না, বাড়তি খাবারের জন্য কিন্তু কোনরকম দালালি করত না। বাড়তি খাটুনি করলে কিছু বাড়তি খাবার পেত। তাকে সেলের জল ভরা আর সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ডের (যেহেতু তাদের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখা হত ) খাবার ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়ার কাজ , ভাঁটি ঘরেও কাজ ইত্যাদি করত। জেল কর্তৃপক্ষ সাধারণ বন্দিনীদের কাছে রটিয়ে ছিল সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দিনীরা মানুষের রক্ত খায়। যদিও বেশীর ভাগ মানুষ এ কথা বিশ্বাস করত না। বিশেষ করে সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে যে রাজনৈতিক বন্দিনীরা ছিল তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য যে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও, তা খেত না। সাধারণ বন্দিনীরা যে খাবার পেত, তাই নিত। তারা কোন বন্দিনীর ওপর কোন অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদ করত। এসব কারণে সাধারণ বন্দিনীরা তাদের মনে মনে ভালবাসত।
 ---
সেলে তখন কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া মিত্র ছিল। ডিভিশন ওয়ার্ডে বিজু, মিনু আর আমি চারু মজুমদারপন্থী। আমরা তিনজন ছাড়া আরও ৮/৯ জন রাজনৈতিক বন্দিনী ছিল যারা অন্য পন্থায় বিশ্বাস করত এবং রাজনৈতিক বন্দিনীদের সুযোগ সুবিধা গুলি নিত। সেলে আর ডিভিশন ওয়ার্ডে কাজ করার ফলে আমাদের রাজনৈতিক প্রভাব শান্তিবাইদের ওপর পড়েছিল, এই টুকু তারা বুঝতে পারত আমরা গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য কাজ করতাম। বড়োলোকদের  রাজত্ব কে ভেঙে গরীব মানুষদের রাজত্ব তৈরী করতে চাইতাম, তাই বড়লোকদের রক্ষাকর্তা পুলিশ মিলিটারির সাথে আমাদের লড়াই, তাই তারাই আমাদের আটকে রেখেছে। আমরা কোন অন্যায় কাজ করে জেলে আসিনি।
---
একবার আমরা ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে মীরা ও শান্তিবাইয়ের নেতৃত্ত্বে একসাথে রেখা ,বেলা, মিতা, শিবানী  ইত্যাদি প্রায় ২০জন  সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করছিল , তখন মেট্রন বা তার দালাল বাহিনী কিছু করতে সাহস পায়নি। প্রতিবাদে আমরাও তাদের  পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাই ।
--
মীরা তখন  সেলের এক ভাল ওয়েলফেয়ার অফিসারের অফিসে কাজ করত, চিঠিপত্র দেওয়া নেওয়া, তাঁর কাগজ ফাইল পত্র গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি।বাংলা দেশের গ্রামের মেয়ে মীরার  বয়স ১৭/১৮, কলমি লতার মত ঢলঢলে মিষ্টি চেহারা।  বাংলা দেশের  ৭১ এর যুদ্ধের সময় পালিয়ে আসে, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে হারানো কেসে জেলে ছিল। আমাদের ৬ জনের সাথে তার ও বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে আমাদের রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
--
সেই প্রতিবাদের শোধ তুলতে এক বিশাল দালাল বাহিনী বিজু, মিনু, আমি - মাত্র তিনজন বলে মারতে ঢোকে। দালালরা ভাবতে পারেনি মীরা শান্তিবাই ১৫ জন নিয়ে দালালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ডিভিশন বাড়ীর বাকী ৮/৯ জন ও আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়। মারতে এসে উল্টে মার খেয়ে দালালরা পালায়। ওয়ার্ডার তাড়াতাড়ি গেট বন্ধ করে দেয়। শান্তিবাইরা ভেতরেই আমাদের সাথে থেকে যায় প্রায় দিন ১৫। বাকীরা আমাদের সাথে শুতো, ভাল খাবার জন্য খেতো ডিভিশনের মেয়েদের। কিন্তু  মীরা আর শান্তিবাই আমাদের তিনজনের সাথেই খেত আর সারা সময় আমাদের পার্টির গল্প শুনত।
---
মেট্রন বা তার চামচে ওয়ার্ডার আর  দালাল বাহিনী শান্তিবাই আর মীরাকে শিক্ষা দেবার তক্কে তক্কে থাকল। একদিন বাকী বন্দিনীদের লক আপ করার পর তারা মীরা আর শান্তিবাইকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারল যে তাদের চেনা যাচ্ছিল না। আমাদের আর সেলের  কমরেড দের ইচ্ছে করে লক আপ করেনি, কিন্তু মূল গেট গুলি বন্ধ করে রাখে যাতে আমরা হাসপাতাল থেকে আর ওরা বারান্দার ফোঁকর দিয়ে সব দেখতে পাই, কিন্তু গলার ফাটান ছাড়া আর কিছু করতে না পারি, ওদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে না পারি। মেট্রনের নির্দেশে পাগলী বাজল না। .
---
এরপর স্বাভাবিক ভাবেই ওরা দুজন ভয় পেয়ে যায় আর দালাল বাহিনীর পেছনে পেছনে থাকত, কিছু প্রভাব পড়লেও ওরা হিংস্র দালালদের মত হয়ে ওঠেনি। এদিকে শ্যামবাই ছাড়া পেয়েছে, শান্তি বাই এর যাবৎজীবন কারাদন্ড হবার প্রবল সম্ভাবনা। ইতিমধ্যে জয়া মিত্র পুরুলিয়া জেলে বদলী হয়ে গেল। ডালিয়ার ১০ বছর সাজা হয়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে এল। সেলে রাজশ্রী, মীনাক্ষী দুজন নতুন রাজনৈতিক বন্দিনী এলো আর খুকু ডিভিশন ওয়ার্ডে এলো।  সাধারণ বন্দিনীদের ওপর অত্যাচার বাড়তে লাগল। তাই আমরা একদিন প্ল্যান করে শিখা, আনোয়ারা সরযূর মত হিংস্র দালালদের ও শয়তান বড় মেট্রনটাকে বেশ করে শিক্ষা দিলাম। পাগলী হল, কিন্ত আমাদের কাছে কি অস্ত্র আছে, জেল কর্তৃপক্ষ সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না, মাত্র কটা খাবার থালা নিয়ে আর ওদের লাঠি কেড়ে ওদের মারব এটা ওরা বিশ্বাস করতে পারল না। তাছাড়া আমাদের মনেমনে শ্রদ্ধা করতেন এমন একজন ডেপুটি জেলারের মধ্যস্থতায় ফোর্স ফিরে গেল।
---
ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলি করে দিল। মাসিমা (শান্তিরানী দেব ) আর বুলু ডিভিশন ওয়ার্ডে নতুন এল। জেল কর্তৃপক্ষ বদলা নিল, বুলুকে আর আমাকে প্রচন্ড মারল, জেলের ডাক্তার বাবুদের হটাৎ উপস্থিতির ফলে আমরা আহত হলেও বেঁচে যাই। কিছুদিন পর মহাদেবীয়া হাসপাতালের মেট হয়। মহাদেবীয়ার মনুষ্যত্ব বোধ ছিল। যাবৎজীবন সাজা প্রাপ্ত বলে মেট্রন দের হুকুম মানতে বাধ্য থাকত, কিন্তু বীভৎস অত্যাচার কারোর প্রতি করেনি। এই সময় একদিন শান্তিবাই আমাদের বন্ধ গরাদের কাছে এসে চুপিসারে বলে গেল," আভি মহাদেবীয়া হেড মেট, আর কুছু ডর নেহি হ্যায়।" আমাদের একদিন ইন্টারভিউ এর সময় বলল, " তুমাদের মারার সময় শিখা,আনোয়ারা হামাদের পর লজর রেখেছিল, তাই দিদি তুর  চুল টা হামি একটু ধরে ছিলাম, মাফি দিয়ে দে। " আমি ওর হাতে চাপ দিয়ে বললাম ,"বুঝিরে, তোদের না হলে মেরে শেষ করে ফেলত। "
---
এরপর শান্তিবাইয়ের যাবৎজীবন সাজা হয়ে যায়। আমরা ৭৭ সালের রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির সময় ছাড়া পেয়ে যাই। একদিন বাসে মীরার সাথে দেখা হয়েছিল, উগ্র সাজগোজ করা। আমার পাশে বসল, হাত টা ধরে বলল, "দিদিরে
প্রাণ ভয়ে যে অপরাধ করেছি মাপ করে দে। " ওর মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে বললাম, "সব বুঝি, আমরা কি জানি না কি কারণে, কি অবস্থায় তোদের কি করতে হয়েছে। ভাল থাকিস।" ইচ্ছে করেই আর কোন প্রশ্ন করে ওকে আর বিব্রত করতে চাইলাম না, ওর সাজ পোশাক অনেক কিছু বলে দিচ্ছিল। আমার গন্তব্য, এসে যাওয়ায় বাস থেকে নেমে যাই।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




        



















































           

No comments:

Post a Comment