26 Aug 2019

গোপাল, তুই স্মৃতিতে আছিস আর থাকবি

গোপাল, তুই স্মৃতিতে আছিস আর থাকবি
********************************

কিছুদিন আগে পুরাতন এক বন্ধুর কাছে শুনলাম মাস কয়েক আগে গোপাল স্ট্রোকে মারা গেছে। প্রায় বছর ১৫/২০ আগে বোধহয় ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। কিন্তু ও যে আর নেই এখনও ভাবতে পারিনা, ৭২/৭৩ সালে আলাপের দিন থেকে  প্রতিটি স্মৃতি আজও ছবির মত মনের স্মৃতিকোঠায়  ভাস্বর হয়ে আছে। এখনও ওর সদা হাসিমাখা মুখটা চোখে ভাসে। একটা চূড়ান্ত দুঃখের সময় ও যেন দুহাত বাড়িয়ে আমাকে সব আঘাত থেকে আগলে রেখেছিল।
--
আমাদের সাথে অনেকগুলি গোপাল নামে সাথী ছিল। এই গোপাল কাঠের দোকানে খুব ভাল পালিশ মিস্ত্রির কাজ করত, তাই ওর নাম হয়ে গিয়েছিল কাঠগোপাল, অনেক সময় ওকে শুধু কাঠ বলেও ডাকা হত। আমার সাথে ওর দেখা ৭২এর শেষ ভাগে, যখন আমার চারপাশের ঘনিষ্টরা আর কাজের সূত্রে যুক্ত বেশীর ভাগ সাথীরা ধরা পড়ে গেছে। মনটা ভীষণ খারাপ, কাজের ক্ষেত্রে নতুনদের সাথে যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। মতাদর্শের ক্ষেত্রেও পার্টির ভিতর বিরোধ দেখা দিয়েছে।
--
মনের অবস্থা ঠিক এতটাই খারাপ ছিল যে মাঝে মাঝেই চোখে জল চলে আসত। গোপালের দোকানে যেদিন প্রথম গেলাম, শুনলাম আর একজন সাথীর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেই আমার চোখে জল এসে গেল দেখে ও খুব অপরাধীর মত মুখ করে বলল, " লক্ষীসোনা বোনটি কাঁদিস না, তাহলে আমিও কেঁদে ফেলব কিন্তু। " ওর কথা বলার ধরণে এমন একটা আন্তরিকতা আর সৌহার্দ্য ছিল, আমি অনেক কষ্টে নিজের কান্না গিলে ফেললাম।
--
তারপর থেকেই ওর সাথে যোগাযোগটা পাকাপাকি হয়ে গেল। মন খারাপ লাগলে ওর দোকানে গিয়ে অক্সিজেন সঞ্চয় করে আসতাম। গেলেই জিজ্ঞাসা করত খিদে পেয়েছে কিনা বা কখন খেয়েছি, কি খেয়েছি। নানা রকম গল্পে গল্পে  মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত। সব সময় জিজ্ঞেস করত রাতের থাকার জায়গা ঠিক আছে কিনা, নাহলে দোকানে চলে যেতে বলত। ওর  বাড়ীতে শুধু মা ছিলেন। ওর  গ্রামে বা পরিচিত অন্য কোন গ্রামে রাতের ট্রেনে ওর সাথে চলে যেতাম, কাকভোরে বেরিয়ে আসতাম। একবার কি যেন একটা উৎসবে ওর সাথে আমরা তিন জন সাথী মিলে গিয়েছিলাম। ওর বাড়ীতে একটা হাঁস ছিল, সেটাকে কাটল আর মাকে ভাল করে রান্না করতে বলল আমাদের খাওয়াবার জন্য। তারপর আমাদের নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বেরোলো।
--
কি যেন উৎসব ছিল, বাড়ীতে বাড়ীতে ঘুরে নতুন কোটা চিরে আর গুড় খেয়ে আমার পেট ঢাক হয়ে গেল। বাড়ী ফিরে আমি আর হাঁসের মাংস ভাত খেতে পারছিনা দেখে খুব রেগে গেল, মন খারাপ করতে লাগল। আমিতো কোন মতে এক টুকরো মাংস খেলাম,ওকে উল্টে বকতে শুরু করলাম, "তুই কেন সারা গ্রাম ঘুরে চিরে গুড় খাইয়ে আনলি, তাইতো আর খেতে পারছি না। ছেলেরা অবশ্য ওর আশা পূরণ করে দিল। তখন একটু ঠান্ডা হল।
--
গোপালের কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা জায়গায় ঘুরে, শ্রমিক দের কারখানায় গেটে অপেক্ষা করে নতুন করে শ্রমিকদের মধ্যে যোগাযোগ করা, পুরান বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ গুলিকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতাম। সে সময়
শহরে আমাদের থাকার জায়গা গুলি পুলিশের নজরে এসে যাওয়ায়, প্রায়ই গোপালের সাথে বিভিন্ন গ্রামে ওর পরিচিতদের বাড়ী আশ্রয় নিতাম। একবার ওর গ্রামের থেকে একটু দূরে আমরা পোস্টার লিখতে গেছিলাম। কাছেই একটি ক্লাবে যাত্রার রিহার্সাল হচ্ছিল, আমাদের হটাৎ দেখতে পেয়ে তারা বেরিয়ে আসে," কি ব্যাপার আপনার কে, এখানে কি করছেন ?" স্বভাবিকভাবেই আমাদের প্রশ্ন করতে শুরু করল, সঙ্গে  এত রাতে একটা মেয়ে থাকায় সন্দেহটা ঘনীভূত হয়।
--
আমরা তখন আমাদের পার্টির শিক্ষা মত অসুবিধায় পড়লে জগণের কাছে, বিশেষ করে শ্রমিক/ কৃষক কে আমরা সোজাসুজি আমাদের পার্টির নাম ও রাজনীতির কথা বলতাম। দেখেছি এসব ক্ষেত্রে খুব ভালভাবে মানুষ আমাদের গ্রহণ করেছে, অনেক সময়ে সেখানে পার্টি ইউনিট গড়েও তোলা গেছে। তাই আমরা সরাসরি আমাদের রাজনীতি ও উদ্দেশ্য খোলাখুলি বললাম। তাঁরা সব মন দিয়ে শুনলেন, সাবধান করে দিলেন।" খুব ই ভাল আপনাদের উদ্দেশ্য, ভাল কাজ করছেন, কিন্তু প্রতিরোধ বাহিনী গ্রামে গ্রামে টহল দেয়,আর রাত না করে বাড়ী চলে যান। " আমরা তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফিরে আসি।
--
বাড়ী থেকে যখনই মুড়ি / চিড়ের মোওয়া, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি আসত ও আমাদের জন্য সরিয়ে রেখে সহকর্মীদের সাথে ভাগ করে খেত। খুব বড় মন ছিল, শেষ কপর্দক ব্যয় করে সবাইকে খাওয়াতে ভালবাসত। একবার গোপাল আর আমি এক শীতের রাতে শেষ ট্রেনে ওর গ্রামে যাচ্ছি। ট্রেন প্রায় ফাঁকা। আমরা বলাবলি করছিলাম প্রায় রোজ রাতে ওর গ্রামে যাওয়া টা ঠিক হচ্ছে না , শহরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না, গ্রামে নতুন করে কৃষকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। কামরায় আমরা দুজন ছাড়া আর একজন মাত্র ছিলেন। সঙ্গে একটা বিরাট ফাঁকা সবজি বওয়ার ঝুড়ি, আমাদের মনে হল উনি সম্ভবত গ্রামের কৃষক, ক্ষেতের সবজি শহরে বিক্রি করে গ্রামে ফিরছেন। নতুন যোগাযোগ গড়ে তোলার একটা বিরাট সুযোগ।
--
আমরা  কাজে লেগে পড়লাম, ওনার সঙ্গে গল্প করতে শুরু করলাম, কি কাজ করেন, বাড়ী কোথায়, কে কে আছেন ইত্যাদি। দেখলাম আমাদের আন্দাজ ঠিক আছে। ইতিমধ্যে ওনার ষ্টেশন চলে আসতে, নেমে গেলেন। আমরাও তাড়াহুড়ো করে তাঁর সঙ্গে নেমে তাঁর পিছু পিছু চললাম অন্ধকার গ্রামের পথ ধরে। একটু এগিয়ে তাঁকে ডেকে বললাম, "আমরা ভাইবোনে গল্প করতে করতে ভুল করে আমাদের ষ্টেশন ছেড়ে এসেছি, এখন তো আর ট্রেন পাওয়া যাবে না, এই ঠান্ডায় রাতে কোথায় যাব আপনি যদি রাতে আশ্রয় দেন, তো খুব উপকার হয়। " সত্যি আমাদের এক কথায় রাতে তাঁর বাড়ীতে আশ্রয় দিতে কোন দ্বিধা করলেন না। বাড়ী নিয়ে গেলেন। সাধারণ মানুষ এই রকম মহান আর উদার ই হন, আমরা নতুন করে আবার তার প্রমান পেলাম।
--
বাড়ী পৌঁছে তিনি আমাদের পরিচয় আর দুর্গতির কথা বলে সবাইকে বলে দিলেন আমরা রাতে থাকব। একান্নবর্তী পরিবার, অল্প জমি আছে সবাই মিলে নিজেরাই জমিতে খাটেন, শহরে গিয়ে চাল নিজেরাই মহাজনকে গস্ত করেন, মরশুমি সবজি আনাজপাতি নিজেরা শহরে বাজারের ফুটপাতে বা গ্রামের হাটে বিক্রি করেন, দুঃখকষ্টে দিন কেটে যায়। মাটির বাড়ীর দাওয়ায়ে বসে কথা হচ্ছিল একধারে মেয়েদের সাথে আমি বসে কথা বলছি। আর এক ধারে ছেলেদের সাথে গোপাল বসে কথা বলছিল। আমরা ষ্টেশনে হটাৎ করে নামাতে নিজেদের মধ্যে আর কিছু কথা ঠিক করে না নেওয়াতে নিজেরা নিজেদের মত কথা বলছিলাম। হটাৎ একজন যুবক গোপালের কাছে চুপি চুপি বলে, " দাদা আপনার আর আপনার বোনের কথা কিন্তু মিলছেনা। " গোপাল বিড়ি খাবার নাম করে তাঁকে নিয়ে বাইরে গিয়ে সব সত্যিকথা বলে। ছেলেটি শুনে আমাদের পার্টি ও রাজনীতির কথা আরও জানতে খুব উৎসাহ প্রকাশ করে। গোপাল যতটুকু সম্ভব বলে আর কথা দেয় বই কাগজ পত্র নিয়ে পরে আবার আসবে।
--
পরদিন সকালে চা খেয়ে আমরা রওনা দিই। রাস্তায় এসে আমরা ঠিক করি এরপর গোপাল একাই এসে এখানে যোগাযোগ রাখবে আর সংগঠন গড়ে তুলবে। কারণ আমি সাথে থাকলে বাইরের লোকের চোখে পড়বে, তাছাড়া আমি একা গ্রামের পথ ঘাট ঠিক মত চিনে উঠতে নাই পারতে পারি। গোপাল সেখানে সত্যি একটা মজবুত সংগঠন গড়ে তুলেছিল। পরবর্তী কালে জেল থেকে পালিয়ে সেখানে গিয়েই ওঠে। তাঁরা ওকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল। কিছুদিন থাকার পর তাঁদের সাহায্যে অন্য জায়গায় চলে যায়।
--
আর এক রাতে আমরা তিন / চার জন গোপালের গ্রামে যাওয়ার সময় মাঝপথে আমাদের প্রতিরোধ বাহিনীর লোক জন ঘিরে ধরেছিল। "আমরা কে কোথায় থাকি, এতো রাতে কোথা থেকে ফিরছি, কোথায় যাব" ইত্যাদি নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে। গোপাল বলে যে আমরা তিন জন ওর মামাত ভাইবোন শহরে থাকি, পিসির বাড়ী বেড়াতে এসেছি ,পাশের গাঁয়ে যাত্রা ফিরতে রাত হয়ে গেছে। সঙ্গে মহিলা থাকায় ওরা আর বিশেষ কিছু বললনা। আমরা গোপালদের বাড়ী চলে গেলাম। পরদিন পায়ে না হেঁটে আমরা বাসে করে সোজা ষ্টেশনে নামি। কথা ছিল গোপাল ছাড়া বাকীরা কলকাতায় চলে আসব আর গোপাল বাড়ী ফিরে যাবে। গোপাল ট্রেনের টিকিট কেটে আমাদের দিল। আমাদেেেরর সাথে ও নিজেও ট্রেনে উঠে পড়ল। আমরা অবাক, কি ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। ও শুধু বলল পরের স্টেশনে নেমে একজনের সাথে দেখা করে বাড়ী ফিরবে। আমাদের কেমন যেন সন্দেহ হল, কিন্তু পরের ষ্টেশনে তাড়াহুড়া করে নেমে যাওয়াতে কিছু জানা হল না।
--
দুদিন পর ওর সাথে ওর দোকানে দেখা হতে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, আগের দিনের প্রতিরোধ বাহিনীর একজনের সাথে ওর পরিচিত একটি খোচর কে ষ্টেশনে দেখে ও ট্রেনে উঠে পড়ে। পরের ষ্টেশন থেকে ঘুর পথে বাড়ী গিয়ে পার্টির যে কাগজ পত্র ছিল সরিয়ে দিয়ে, মাকে সব বুঝিয়ে বলে।  ভোর বেলা ট্রেন ধরতে ষ্টেশনে আসার সময় নিজের গ্রাম পার হয়ে বেশ কিছুটা আসার পথে পেছন থেকে কেউ গুলি চালায়। প্রানপন দৌড়ে ঘুরে ঘুরে অন্য ষ্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কোলকাতায় এসেছে। আমরা সবাই খুব বকলাম আমাদের সাথে আগের দিন চলে না আসার জন্য। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে দাঁত বার করে হেসে জবাব দিল, "আরে ফিরব বলে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি, রাতে না ফিরলে বুড়ী মা আমার চিন্তায় মরে যেত যে, আর কাগজ পত্র বাড়ীতে সার্চ করে পেলে, পিটিয়েই মাটাকে আমার মেরে ফেলত। "
--
মানুষের প্রতি, সাথীদের প্রতি ওর প্রগাঢ় দরদবোধ ওকে সব সময় মনের জোর যুগিয়েছে। ধরা পড়ার পর প্রচন্ড পুলিশি নির্যাতনেও ওর মুখ থেকে একটা কথাও বার করতে পারেনি। মৃত্যু ওকে ছিনিয়ে নিলেও মনের গভীরে আমাদের কাঠ গোপালের স্মৃতি জ্বলজ্বল করবে।  

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

















  






    

No comments:

Post a Comment