7 Aug 2019

একটি স্মরণীও রাত

একটি স্মরণীও রাত
***************


১৯৭২ এর অক্টোবর মাস। পার্টির বেশীর ভাগ নেতৃ স্থানীয় ব্যক্তিত্বরা হয় শহীদ হয়ে গেছেন, নয় জেলে। বাকিদের থাকার জায়গাগুলির অবস্থা  শোচনীয়, কিছুটা সেই কারণে, কিছুটা মধ্যবিত্ত মানষিকতার জন্য অবশিষ্ট শেল্টার গুলিতে জটলা করে থাকা হচ্ছিল।  কালীঘাটের রেড লাইট অঞ্চল আর কালীঘাট মন্দিরের মাঝামাঝি  একটি পুরান বিদ্ধস্ত চারতলা বাড়ীতে অনেকগুলি ঘর ছিল। খেটে খাওয়া মজদুর আর নিম্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকেদের বাস। সেখান পার্টির এক সমর্থক কমরেড একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। আর একজন কমরেড সেটাকে বলত জব চার্ণকের আমলের বাড়ী। একদম ওপরে দুটি ঘরের একটিতে তারা থাকত, আর অন্যটাতে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার - স্বামী, স্ত্রী আর একটি বাচ্চা ছিল। ভদ্রলোকের একান্ত আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর  ছোট ভাইয়ের ঘর টা সমর্থক কমরেডটিকে ভাড়া দিয়েছিল। জল, কল নীচে ছিল। ছেলেরা বাইরে উঠোনে বিশাল চৌবাচ্চা থেকে স্নান করত। সিঁড়ির নীচে খুপচি একটা বাথরুম ছিল, সেখান মেয়েরা স্নান করত। 
--
সাধারণত মিলন আর কৃষ্টি থাকত। মাঝে মধ্যে অন্য দুই একজন কমরেড রা আসতেন। কালীপূজার রাত ,দুজন মেয়ে আর জনা পাঁচেক ছেলে কমরেড ছিল। আর ছিল প্রচুর বই কাগজ পত্র। সবাই তখন আত্মগোপনে। কিন্তু প্রায়শঃ সেটা তাঁদের মাথায় থাকত না, আলোচনা হোক, হাসি বা গল্পই হোক একটু গলা চড়ে যেত। ঘরের মাথায় ন্যাড়া ছাদে যাবার একটা লোহার সিঁড়ি ছিল। সন্ধ্যে বেলায় ন্যাড়া ছাদের মাথায় বসে মাঝে মাঝে কথা বার্ত্তা বলত।
--
সেদিন কৃষ্টি  ঘরে ছিল কিছু কাজের জন্য, বাকীরা ছাদে গেছিল। হটাৎ বিশাল হৈ চৈ, ভেজান দরজায় টকটক করে আওয়াজ, রাগত গলায় কারা বলছে, দরজা খুলুন, খুলুন দরজা। কৃষ্টি তাড়াতাড়ি কাপড় জামাগুলি কাগজ পত্রের ওপরে ফেলে দিয়ে, দরজা খুলতেই শোনে ওপর থেকে শওকতের ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে, " কৃষ্টি ,কৃষ্টি আমরা সব জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন না।" তার সাথে কয়েক টা গলার জড়ান আওয়াজ,"একদম  চুপ, কোন চালাকি  চলবে না। " কৃষ্টিকে  চার / পাঁচ ঘিরে ধরে প্রশ্ন করছে , "নাম কি?, কে, কে থাকেন এখানে ?" " কৃষ্টি  আমি আর আমার নিজের দাদা থাকি। কালীপূজা উপলক্ষে আমাদের জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন রা এখানে এসেছে, দুদিন বাদে চলে যাবে। " "নিজের দাদার নাম কি?" "মিলন ।"  ছাদের ওপরের মেয়েটির কি নাম ,কে হয়। "  " মিঠু, আমার খুড়তুতো বোন।"  শওকতদের  সবাই কে নিয়ে আরও পাঁচটি ছেলে নেমে এলো, "এদের নাম কি?"  যার যা টেক নাম ছিল গড়গড় করে বলে গেল। প্রথমে মিলন নিয়ে পড়ল," আপনি তো ঘর ভাড়া নিয়েছেন ? কি কাজ করেন ?"  "হ্যাঁ, প্রেসে কম্পোজারের কাজ।"  অন্যদের নামধাম , ঠিকুজিকুষ্টি, পেশা বয়স সব তথ্য নিতে লাগল। সবাই বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে গড়গড় করে বলে গেল।

 --
তখন জনা চারেক থাকল আর বাকীরা বাড়ীওয়ালা ছেলেটিকে খুঁজতে গেল। চার জন কে ওরা  বলল, "আসুন ঘরে বসুন, চা করি, ওরা আসা পর্যন্ত্য চা খান। আপনারা তো সব এ পাড়ার ছেলে, একটু চেনা পরিচয়, আড্ডা হয়ে যাবে।" লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল, না না চা করতে হবে না। দ্বীপ ছিল সবার ছোট, জয়ন্তের কথায় সে জোর করে চা বসিয়ে দিল।  একজনের বোধহয় হটাৎ দ্বীপ কে দেখে মনে পড়ল ওর পেশা টা জানা হয়নি," ও কি করে ?" জয়ন্ত নিজের মাথায় আঙ্গুল ঠেকিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে ইশারায় বোঝাল মাথাটা একটু গন্ডগোল আছে। তাই দেখে বাকিদের অবস্থা খারাপ,গম্ভীর মুখে হাসি চেপে অন্য দিকে থাকিয়ে থাকল। যাই হোক ওরা আর গন্ডগোল পাকাল না। গল্প চলতে থাকে।
--
বাকীদের পাত্তা নেই। "ওরা বোধহয় সন্তুকে খুঁজে পাচ্ছেনা। " একটু পরে চারজন মিলে ঘরের বাইরে গিয়ে পরামর্শ করে একটা রফায় এলো, কৃষ্টিকে দেখিয়ে বলল দেখুন, " আপনি আমাদের সঙ্গে গিয়ে মাকালীর পা ছুঁয়ে শপথ করতে পারবেন যা যা বলেছেন সব সত্যি ?"  "হ্যাঁ ,নিশ্চয়ই , চলুন কোথায় যেতে হবে।" বাকিরা চঞ্চল হয়ে উঠল, এ মার্কামরা পাড়ায় রাতের অন্ধকারে কোথায় নিয়ে ফেলবে, কে জানে ! শওকত যেই বলল, " আমরা কেউ গেলে হয় না ?" ও বেচারার ওপর ওরা প্রথমেই খেঁপেছিল, কটমট করে তাকিয়ে বলল, " আপনি একদম কোন কথা বলবেন না। " মিলন তাড়াতাড়ি বলে উঠল ," "এই তুই চুপ করত, রাগ করবেন না ভাই বুঝতেই পারছেন বোনেরা সবার বড় আদরের তো, তাই যদি আপনাদের আপত্তি না হলে আমি যেতে। ...." " না একদম নয়, ওনাকেই যেতে হবে।"  "ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, কি আছে ওনাদের সাথেই তো যাচ্ছি, ওনাদের ও বোন আমি, চিন্তার কিছু নেই। "
--
অতএব কৃষ্টি ওদের চার জনের সাথে রওনা হল। অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলতে থাকে গলি ঘুঁচি পেরিয়ে মন্দিরের একটু আগে ওদের একজন সবাইকে দাঁড় করাল। কৃষ্টির দিকে ভাল করে লক্ষ্য করতে থাকে, বাকিরাও তার দেখাদেখি ওর দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে উদ্বেগ থাকলেও কৃষ্টি বাইরে এতটুকু বিচলিত ভাব দেখাল না, সহজ গলায় প্রশ্ন করে." মন্দির কি এসে গেছে ?" " আপনি মা কালীর নামে শপথ করে এখনও বলতে পারেন, যে আপনারা সবাই ভাই বোন। " সে চোখ বুঁজে, হাত জোড় করে বলে, "আমি শুধু মা কালী, মা দূর্গা কেন সব ভগবানের নামে শপথ করে বলছি আমরা সবাই জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোন। আপনারা আমাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে পারেন। আর আমরা তো এখানে আছি, মাঝে মধ্যে গিয়ে গল্প করে আসবেন।,বাড়ীওয়ালার সাথেও কথা বলে নিন। "
--
তখন চার জন নিজেদের নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিয়ে বলল, না না , আপনার কথা আমরা বিশ্বাস করছি। মন্দির পর্যন্ত্ আর যাবার দরকার নেই , চলুন আপনাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। " কৃষ্টি বলল, "একাই চলে যাচ্ছি আপনারা আর কষ্ট করে যাবেন কেন !" "না, না এত রাতে আপনাকে একা যেতে হবে না। জানেন তো পাড়াটা বিশেষ ভাল না। আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি, ওরা ফিরে যাক।" এই বলে  তিন জন চলে গেল আর একজন  কৃষ্টিকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেল।        
--
কৃষ্টি ফিরলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তার কাছে সব শুনে সবাই তো হেসেই খুন। পরদিন বাড়িওয়ালা ছেলেটি এসে মিলনের  কাছে আসল ব্যাপার খুলে বলে, "আমাৰ  দাদাই  ঘরটা দখল করার জন্য পাড়ার ছেলেদের উস্কেছে, তাই একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, আপনারা কিছু মনে করবেন না। পূজোর সময় লোকজন তো ঠাকুর দেখতে আসতেই পারে, আমি এতদিন ধরে আপনাদের দেখছি না," এবং হাত জোড় করে ক্ষমা চায়। এরপর বাড়ী টা থেকে আস্তে আস্তে  সন্দেহ উদ্রেক না হয় এমনভাবে  সব কাগজ পত্র সরিয়ে ফেলা হয়, ভীড় ও কমিয়ে ফেলা হয়। একমাস বাদে ঘর টা ছেড়ে দেওয়া হল।
--
সেদিনটা আজও মনে পড়ে কৃষ্টির, নিজেদের অবিমিশ্রকারিতার জন্য, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যেতে পারত, সমস্ত কাগজ পত্র শুদ্ধ ৭ /৮ জন ধরা পড়ে যেতে পারত। সবচেয়ে বড় কথা ওই রকম একটা পাড়ায় থেকেও ছেলেগুলি কত ভাল ছিল, অন্য কোন বিপদ ঘটেনি। আজকের দিন হলে হয়তো বা সে আর মিঠু কোন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারত, আরও ৫টি তাজা প্রাণ চলে যেতে পারত।  
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




  

     















No comments:

Post a Comment