21 May 2015

শঠতা বনাম সততা

শঠতা বনাম সততা
**************


জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলেছে কত শত গাড়ী, বাস লরি। সড়কের দুপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের  ক্ষেত। নাম না জানা ছোট বড় গ্রাম।  শ্যাওলা ধরা আদিম বট, অশথ গাছের সারি। মাঝে মধ্যে কাচুপানা ভরা পুকুর বা স্বচ্ছ টলটলে দীঘি। উপরে খোলা  নীল আকাশ , দল বেঁধে উড়ে চলেছে সার বাঁধা পাখীর দল। মাঝে মধ্যে চড়া পড়ে  যাওয়া বিশাল নদী। বিকেল গড়িয়ে চলেছে সন্ধ্যার দিকে। পশ্চিম দিগন্ত অস্ত রাগে রঙিন।
---

চার মাথার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল।  লাল বাতি জ্বলে উঠল। দাঁড়িয়ে গেল সার সার গাড়ী বাস লরি। গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়ের দল হাতে চুবড়ি নিয়ে গাড়ী গুলির জানালায় হানা দিল,তাদের পশরা নিয়ে। কেউ বেচতে চায় ঘরে তৈরী মুড়ির মোয়া বা নারকেল নাড়ু। কারো চুবড়ি তে তুলোর পাকানো  সলতে। কেউ বা বেচতে চায় গাছপাকা তেঁতুল ইত্যাদি। যাদের এসব জোটেনি, তারা বেচতে এসেছে পুকুর থেকে সদ্য তোলা শাপলা, শালুক ফুল।
--

সিগন্যাল টা বেশ দীর্ঘ স্থায়ী এই মোড়ে। তাই কেনা বেচা চলে জোর কদমে। গ্রামের ক্ষুদে বিক্রেতার দল হাঁক পাড়ে , "নিয়ে  যান বাবু ,নিয়ে যান আমার মা/ ঠাকুমার হাতে তৈরী মোয়া / নাড়ু , এমন স্বাদ যে একবার খেলে আবার খেতে ইচ্ছা করবে। " কিছু কিছু কচি কাচার রিনরিনে গলায় ,"গাছ পাকা তেঁতুল , এমন মিষ্টি স্বাদ ,জীবনে ভোলা যাবেনি। " কোন কোন বাচ্ছা হাঁকে , "এই যে বাবু আমার পিসীমার হাতে পাঁকানো সলতে,  দেখবেননি কেমন আলো দিবে পূজার সময়।"
--

ক্রেতার দের গলাও কম যায় না। শহুরে মানুষ রা দরাদরি তে বড়ই দর ।  সে ব্যাপারে মধ্যবিত্ত ,উচ্চবিত্ত সকলেরই  এক  রা।  "কতরে তোর মোয়া /নাড়ু। হাঃ দশ টাকায় মাত্র পাঁচটা ! দশটা দে , তবে নেব। " " এই তোর তেঁতুল মিষ্টি হবেতো ? এত দাম এই তেঁতুলের।  দাম না কমালে নেব না " "কিরে তোর সলতে ভাল জ্বলবে তো ? ভিজিয়ে ওজন বাড়াস নিতো ! দাম কমা, দাম কমা।  নাহলে নেওয়া যাবে না। "
--

সার বাঁধা গাড়ীর সারিতে কালো একটা মার্সীদিসএ  এক ব্যবসায়ী পরিবার  ছিল - স্বামী, স্ত্রী, তাদের ছোট্ট একটি মেয়ে, তার আয়া আর ড্রাইভার।  মেয়েটি বায়না ধরে শাপলা আর শালুক ফুল কেনার। তারই মতো ছোট্ট একটি মেয়ে কিছু ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের গাড়ীর কাছে। মুখে ছিল না কোন ভাষা। শুধু দুটি সজল চোখে এক অসহায় আকূতি। গাড়ীর ভিতর থেকে আবদার শোনা গেল ,"মা আমি ওই সব ফুলগুলি নেব। " বাবা হাঁক পাড়েন," এই কত রে তোর ফুলের দাম?" "সব ফুল নিলে পাঁচ টাকা মাত্র। " "আরে এ দিনে ডাকাতি , কার পুকুর থেকে কতগুলি বুনো ফুল চুরি করে এনে পাঁচ টাকায় বিক্রী করছিস ! দু টাকায় দিবি তো দে। " " না দিবোনি , আর এ ফুল মোদের গাঁয়ের পুকুরের ফুল। সকলের তরে সে পুকুর। চুরি করা ফুল নয়। " দৃঢ় গলায় ঘোষনা করে ছোট্ট ফুলওয়ালী ! এদিকে সিগন্যাল খুলে গেছে , মেয়ে ও কান্না জুড়েছে ফুলের জন্য। গাড়ীর মালিক একটা পাঁচ টাকার কয়েন ছুড়ে দিয়ে , ফুলগুলি প্রায় ছিনিয়ে নেন। "যত অসৎ লোকে দেশ ভরে গেছে " স্বগতোক্তি করে ড্রাইভার কে গাড়ী চালাতে হুকুম দেন। হুস করে গাড়ী বেরিয়ে গেল বিহ্বল ফুলওয়ালীর সামনে দিয়ে।
--

চলন্ত গাড়ীতে স্ত্রী প্রশ্ন করেন ,"তোমার কাছে পাঁচ টাকার কয়েন ছিল নাতো। কি দিলে বাচ্ছাটাকে ?" "আরে তুমি কি পাগল হলে, এই জংলা ফুল কি কেউ পাঁচ টাকায় কেনে ! কে যেন একটা অচল কয়েন দিয়েছিল আমাকে, সেটাই গছিয়ে দিলাম। যেমন কুকুর তেমন মুগুর নাহলে চলে। " স্ত্রী কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন। তারপর কঠিন গলায় বললেন ," এরপর থেকে সৎ/ অসৎ নিয়ে কথা বলার অধিকার আর তোমার থাকলো না। " অন্ধকারে ড্রাইভারের ঘৃণাভরা মুখ আর আয়ার জলভরা চোখ দেখতে না পেলেও,  লোকটি অনুভব করে তাঁর অবোধ অসহায় শিশুটির মুখের  হাসি শুকিয়ে গেছে। অজানা আশঙ্কায় মায়ের কাছে ঘন হয়ে সিঁটিয়ে বসে। কানে বাজতে থাকে স্ত্রীর হিম শীতল বিরূপ উক্তি। টাইযের ফাঁস গলায় যেন এঁটে বসে। তাঁর গলা শুকিয়ে কাট । হাঁসফাস করতে করতে দামী পারফিউম ভরা রুমালে ঘন ঘন কপালের ঘাম মুছতে থাকলেন।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------






























No comments:

Post a Comment