27 May 2015

কান্না

কান্না
****

শংকর কাঁদছে ! সেকি, শংকর কাঁদছে ? সে তো কখনো কাঁদে না। অন্তত তার ছয় মাসের জেল জীবনে কোনদিন কাঁদেনি। আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলের মহিলা ওয়ার্ডের ছোট্ট পরিসরের ময়ূরের মতো নেচে নেচে বেড়ায় সারাদিন। নয়তো পায়রার মতো বক বকম করে। কেউ তাকে কখন কাঁদতে দেখেনি। এমনকি জেলে আসার প্রথম সাতদিনের মাথায় ওয়াডারের হাতের পাকানো বাঁশের লাঠির আট / দশ টা বাড়ি খেয়েও তার কান্না পায়নি।
---

সেদিন সকালে জলখাবার হিসাবে এক মুঠো করে মুড়ি পেয়েছিল সবাই। তারপর এক ডাব্বু ভাত, ডাল নামক এক  হাতা পাতলা হলুদ জল আর বড় বড় পোকা ঢেঁড়শের তরকারি নামক একটু ঘ্যাট খেয়ে খিদেটা কোন মতেই বাগ মানাতে না পেরে আর একটু ভাতের আবেদন ছুটে গেছিলো মেট্রনমার ঘরে। তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা বেয়াদপ সন্তানটিকে শুধু সমান্য একটু সহবৎ শেখাতে ওয়াডার কে আদেশ দিয়েছিলেন মাত্র।
---

রাত বাড়ার সাথে সাথে লাঠির বাড়ির দাগ গুলি লাল হয়ে টাটিয়ে উঠল তার ছোট্ট শরীরটাতে।  অসহ্য ব্যথায় ঠোঁট দুটির কোনা বেঁকে গেলেও জল পড়েনি চোখ থেকে এক ফোঁটাও।
---

সেই শংকর আজ ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। কই প্রথম যেদিন পথ হারিয়ে তাদের মানা ক্যাম্পের ঝুপড়িটা খুঁজে বের করতে পারলো না সে তো কাঁদেনি। ঐ ঝুপড়ি তে আছে তার বড় আদরের ছোট্ট একটা ভাই আর বিধবা মা। পূর্ব বাংলা থেকে উচ্ছেদ হয়ে অ আসা কয়েক শ উদ্বাস্তু পরিবারের সাথে ওরাও এসে জুটে ছিল মানা ক্যাম্পে।
 ---

সর্বস্ব খুইয়ে যারা জুটেছিল এই রেফুইজি ক্যাম্পে, তাদের বাচ্ছাদের জন্য সরকার প্রাইমারী স্কুল খুলে দিয়েছিল। দেড়শ গ্রাম চাল আর দুটো আলু ডোল হিসাবে পেতো পড়ুয়ারা। আর পাঁচটা পরিবারের মতো অসুস্থ মা আর ভাইটা কে নিয়ে তাই দিয়ে দিন গুজরান হতো শংকরদের। এত দুঃখেও কোনদিন কাঁদেনি সে , বরং বেঁচে থাকার তাগিদে স্কুলের পরে অন্যান্য উদ্বাস্তু বাচ্চাদের সাথে মিলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, বাসে , ট্রেনে ভিক্ষা করে বেড়াত। শংকরের ছোট্ট কাঁধে অসুস্থ মা আর ভাই এর দায়িত্ব ছিল। তার বয়স ছিল তখন মেরে কেটে আট / নয় বছর।
---

একদিন ভিক্ষার সময়ে দল ছুট হয়ে পথ হারাল শংকর। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের কাছে মানা ক্যাম্পের রাস্তার হদিস চাইল। তিনি বেচারাকে চালান করলেন স্থানীয় থানায়। তারপর ক্রমাগত থানা বদল হতে হতে আদালতের  আদেশে ও এসে পড়ল প্রেসিডেন্সী জেলে। বাচ্চা বলে জায়গা হল মহিলা ওয়ার্ডে, হারিয়ে যাওয়া কেসে (Victim of Missing person case).
---

জেলের প্রথম রাত টা তার কাছে বিভত্স লাগে, অনেক মানুষকে  খাঁচা বন্দী পশুদের মতো নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে দেখে। কিন্তু এই অস্বাভাবিক  নারকীয় পরিস্থিতি তে, বৃন্তচ্যূত হয়ে এসে পড়েও কখনো কাঁদেনি শংকর। বরং পাহাড়ী ঝর্ণার মতো কলকল করে চলে সারাদিন। প্রয়োজনে বন্দিনী মাসি, দিদি দের সাহায্যের হাত বাড়িয়েই থাকতো। কারোর জন্য সামন্য কিছ করতে পারলে তার সরল, কচি মুখে আলোর ঝিলিক দিতো। বাচ্চাদের সাথে মিলেমিশে হেসে খেলে ভুলিয়ে রাখতো।
---

 বিকালে লকআপ হয়ে গেলে সহ বন্দিনীদের তার উদ্বাস্ত জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শোনাত। পূর্বাংলার ভাটিয়ালি গান গাইতো। নানা মজার গল্প বলে হাসিতে মাতিয়ে রাখত। মানা ক্যাম্পের শোনা ছড়া আওড়াতো ," গদির উপর বইছে কে / শিশির শুয়ার আবার কে। " "শিশির কেরে শংকর "? "আরে উদ্বাস্তু কমিটির চিয়ারম্যান গো, আমাগো বরাদ্দ মাইরা প্যাট মোটা করছে। ঠিক এহানে যেমন মেট্রন আর ওয়ার্ডার রা করতাছে। " শংকরের ডাগর চোখ দুটিতে সবসময় কৌতুক ঝিকমিক করত, কখন জল টলমল করতো না।
---

কান্না তো তার  শুকিয়ে গেছে কবেই।হয়তো সেদিন, যেদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় চোখের সামনে তার বাবাকে আর রহিম চাচা কে খুন হতে দেখে। পাশাপাশি বাড়ীতে তারা বাস করতো। দাঙ্গার সমযে রহিম চাচাদের বাড়ীতে তারা লুকিয়ে থাকতো। সেদিন বাবা আর রহিম চাচা বাড়ীর বাইরে থেকে বার হয়েছিলেন কিছু খাবার যোগার করতে। বাড়ীর বাগানের কাছে ঝোপের মধ্যে  লুকিয়ে ছিলো কিছু লোক। তারা হটাত বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর ধারাল অস্ত্র দিযে কুঁপিয়ে মারতে থাকে। রহিম চাচা একাই রুখে দাঁড়ায় ভাই সম বন্ধুকে বাঁচাতে। তিনিও রক্ষা পেলেন না। মারাত্মক আহত হলেন।
---

লোকগুলি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে শংকর বেরিয়ে  আসে। " চাচা আমি হেকিম চাচারে ড়াইক্যা আনি, তোমাদের মলম পট্টি করুক ক্যানে ?" " চুপ যা, এই বেলা যা কই মন দিয়া শোন, উহারা আবার আইবো। তর বাপ বাইচ্যা নাই, আমিও বাঁচুম না। তর মা আর বনেরে লইয়া হই জঙ্গলের পথ দিয়া আগাইয়া যা, বহু  লোক যাইত্যাছে , অগ সাথ ধইরা চইল্যা যা। তর চাচিরে তার বাজানের ঘর যাইতে ক। কসম খা, যা বৈলছি তাই কৈরবি। " বলতে বলতে রহিম চাচার শেষ নিঃশ্বাস ফেলে। ছোট থেকে যার কোলেপিঠে মানুষ হয়েছে সেই চাচা নেই। বাবা নেই। কিন্তু চোখের জল ফেলার অবকাশ নেই। মাথার উপর পাহাড় প্রমান দায়িত্ব। চাচী কে রওনা করিয়ে, মা ভাই কে সঙ্গে নিয়ে রহিম চাচার শেষ উপদেশ পালন করে যন্ত্রের মতো। সেদিন ও কাঁদেনি সে।
---

কান্না শব্দ টা তার জীবন থেকে সেদিন ই হারিয়ে গেছে হয়তো  যেদিন শৈশবের শান্তির নীড় ছেড়ে মা ভাই কে নিয়ে পথে নেমেছিলো। নয়তো দিনের পর দিন দুঃখ কষ্ট সহ্য  করতে করতে ,অসুস্থ ,অসহায় মায়ের চোখের জল দেখতে দেখতে,  দিন রাত রুগ্ন ভাইটার কান্না শুনতে শুনতে ,তার কচি মনটা পাথর হয়ে গেছে। 
 ---

কাঁদতে তো সে কবেই ভুলে গেছে , তবে আজ সে কাঁদে কেন ! চারপাশ থেকে বন্দিনী মাসীরা সস্নেহে জিজ্ঞাসা করেন ,- "কি হয়েছে বল না বাপ , এমন হাপুস নয়নে কাঁদিস কেন ?" মোটা মোটা গরাদ গুলি ছোট্ট ছোট্ট হাতের মুঠিতে আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে শংকর ," আজ কতদিন হইয়্যা গেল ইস্কুল যাইতে পারত্যাছিনা, ডোল পাইত্যাছি না, আমার মা আর ভাইডা খাইত্যাছে কি। "

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------  
 প্রথম  প্রকাশিত  :  কালপ্রতিমা , আশ্বিন ,১৪০৩.
 +++++++++++++++++++++++++++++++
































































No comments:

Post a Comment