30 Jun 2015

জাহানারা

জাহানারা
*******

জেল হাসপাতালের এক কোনে পড়ে থাকতো জাহানারা। বয়েস দশ / এগারো।  ছোটখাটো শীর্ণ শরীরের সাথে বেডপ পেটটা একেবারে বেমানান। নির্বাক, ভাবলেশ হীন ভাবে বসে থাকে। কেউ কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে শুধু বিহ্বল, ভাবলেশহীন চোখদুটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কখনো কখনো সেখানে একটা তীব্র আতঙ্ক আর বিতৃষ্ণা ঝিলিক দিয়ে যায়  - কিন্তু মুখে কোন কথা নেই।

---

কী ভয়ঙ্কর অপরাধ করে ও জেলে এসেছে! কোন মারাত্মক অন্যায়ের ভারে এই ছোট্ট মেয়েটা এমন মূকবধির! ক্ষিদে, তৃষ্ণা, ঘুম কোন প্রয়োজন ই কি ওর আর  নেই ! বেশীর ভাগ সময় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। ঘুমায় কিনা বোঝা ভার। দয়া করে কোন সহবন্দিনী ওর প্রাপ্য খাবার টুকু এনে দিলে, হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে। কান্না নেই, হাসি নেই, কথা নেই  - ও যেন নিজেই নেই জগতের মানুষ। মাঝেমধ্যে শুধু অভিব্যক্তি হীন চোখ মেলে গরাদের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। পেটটা ওর বড় হতে থাকে দিনের পর দিন। মাস কয়েক পর বোঝা গেল জাহানারা গর্ভবতী।

---

একদিন মাঝ রাতে সে একটি শিশুর জন্ম দিল। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তিতে কোন সাড়া জাগলোনা। নবজাতক ক্ষিদেতে চিত্কার করে। সারা হাসপাতাল বিব্রত বোধ করে, শুধু জাহানারার কোন হেলদোল নেই। মেট্রন / ওয়ার্ডার রা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। মাঝেমধ্যে দু / চার ঘা বসিয়েও দেয় - "দে। তাড়াতাড়ি বাচ্চাকে দুধ দে, নইলে মেরেই ফেলবো তোকে। সারা জেলহাসপাতাল মাথায় করে রেখেছে, যত সব বেজন্মার দল।" দু / চার ঘা লাঠির বাড়ি বা অকথ্য গালাগালি , কিছুতেই বিকার নেই। জীবনের প্রতি কোন মায়া নেই, নেই আকর্ষণ - না বাচ্চার প্রতি কোন টান, না নিজের প্রতি কোন খেয়াল - কিছুই নেই, যেন প্রাণহীন একটা জড় পদার্থ।

---

কদিন পরে জাহানারার বাবা - মা এলেন অসুস্হ মেয়ের সাথে দেখা করতে। বাবা এক ছোটখাটো বিস্কুট কারখানার শ্রমিক, মা লোকের বাড়ীতে বাড়ীতে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা ইত্যাদি কাজ করে বেড়ান। তাদের স্বল্প আয়ের মধ্যেই সাধ্যমত জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। জাহানারা সেসবের দিকে চোখ তুলেও দেখলো না। মা স্নেহভরে গায়ে  হাত বুলাতে লাগলেন। বাবা মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে স্নেহভরে কত কথা বলার চেষ্টা করলেন। মেয়ে নিশ্চুপ, উপুড় হয়ে মুখ গোঁজ করে শুয়ে থাকলো।

---

শেষমেষ মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বিব্রত বাবা শোনালেন মেয়ের অপরাধের কাহিনী। অভাবের সংসারে মেয়েকে কোন এক উচবিত্ত পরিবারে কাজে লাগিয়ে ছিলেন, অন্তত পক্ষে পেট ভরে দুটো খেয়ে বেঁচে থাকবে এই আশায়।প্রথম কটা মাস ঠিকঠাক চলছিল। একদিন বাবুর বাড়ীর  নববিবাহিত ছেলে-বউ  সন্ধ্যাবেলায় সিনেমা দেখতে গেল। বাড়ীতে রইলেন তাদের বাবা, বাড়ীর মালিক। বয়স ষাট / বাষট্টি হবে, শক্তপোক্ত চেহারা , রাশভারী মানুষ। ফাই ফরমাস খাটার জন্য রইল জাহানারা। ঠিকে রাঁধুনি রান্নাবান্না সেরে বাড়ী চলে গেল। বড়বাবু রাতের খাবার খেয়ে শুতে  যাবার সময়ে জাহানারা কে এক জগ খাবার জল শোবার ঘরে পৌঁছে দিতে আদেশ করে গেলেন।

---

জাহানারা জল নিয়ে ঘরে গেল। "শোন, জলটা টেবিলে রেখে আমার মাথাটা ভাল করে ম্যাসাজ করে দে। মাথাটা খুব ব্যাথা করছে।  তাছাড়া তোর তো এখন কোন কাজ নেই। আয় এইখানে আমার বিছানার পাশে বস " - আদেশ দিয়ে বিছানায় শুলেন তিনি।  ছোট্ট মেয়েটা ছোট ছোট হাত দিয়ে বড় বাবুর মাথা টিপতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই  প্রবীন মানুষটির মধ্যে পশুবৃত্তি জেগে ওঠে, জাহানারা কে দুহাতে বিছানায় টেনে নেয়। মেয়েটি তখন সবে মাত্র শৈশব থেকে কৈশরে পা রাখতে চলেছে। একেবারে সরল সহজ মেয়ে, জীবনের অনেক কিছু তার অজানা। তবু তার মনের মধ্যে একটা দারুন ভীতির সঞ্চার হল। বার বার তাকে ছেড়ে দেবার জন্যে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। বাবু তখন ভয়ংকর আর বেপরোয়া - ভাল করে কোন কিছু বোঝার আগেই সর্বনাশ হয়ে গেল জাহানারার।

----

প্রচন্ড হিংস্রতার সাথে ধর্ষিত মেয়েটি  জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে। এদিকে সিনেমা থেকে ফিরে ছেলে - বউ সব বুঝতে  পেরে তড়িঘড়ি গাড়ী করে জাহানারাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে যায়, বলে হটাত অসুস্হ হয়ে পড়েছে। পাড়ার ডাক্তার আসার পর সব খোলসা হয়ে যায়। বস্তিবাসীরা দল বেঁধে থানায় নালিশ জানায় পুলিশ এসে জাহানারাকে ভিক্টিম হিসাবে থানায় নিয়ে যায়। বাড়ীর লোকজন কে কদিন পরে শেয়ালদা কোর্টে হাজিরা দিতে বলে যায়। থানায় অসুস্থ মেয়েটির উপর চলে নানা পরীক্ষা - নিরীক্ষা, জিজ্ঞাসাবাদ, সেই  সঙ্গে নানা কদর্য্ রসিকতা।

---

সুবিচারের আশায় জাহানারার বাবা - মা কয়েক জন বস্তিবাসীকে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে  সকল দশটা থেকে শেয়ালদা  কোর্টে অপেক্ষা করতে থাকে। সারা দিন তারা পুলিশ, কোর্টবাবু, উকিল ইত্যাদি সবার কাছে চরকির মত পাক খান , কিন্তু কি হচ্ছে, কি হবে কিছুই তাঁদের বোধগম্য হয়না। শুধু বুঝলেন সরকার বাহাদুর জাহানার জন্য সরকারি উকিলের ব্যবস্থা করবেন, যেহেতু পয়সা খরচ করে উকিল রাখার ক্ষমতা তাদের নিজেদের নেই।

---

সারা দিন খাওয়া দাওয়া নেই,  শেয়ালদা কোর্টে  বসে রইলেন তাঁরা। বিকালের দিকে তাঁরা দেখলেন তাঁদের নাবালক ধর্ষিতা কন্যা কে পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে। আর ধর্ষক বড়বাবু বুক ফুলিয়ে ছেলের সাথে কোর্টের গেট দিয়ে বেরিয়ে নিজেদের গাড়ীতে উঠছে। জাহানারার বাবারা দৌড়ে গিয়ে থানার ওসিকে জিজ্ঞাস করলেন, "একি রকম বিচার হলো পুলিসবাবু। আমাদের নির্দোষ নিস্পাপ মেয়েকে তোমরা ধরে নিয়ে কোথায় চলেছো ! আর ওই দিকে অপরাধী যে দিব্ব্যি ছাড়া পেয়ে গাড়ী চড়ে নিজের বাড়ী চলে গেল ?"
---

ওসি উত্তরে বললেন, - "আরে ব্যাটা মুর্খের দল, যতোক্ষণ না প্রমান হচ্ছে উনি দোষী, ততক্ষণ জামিনে ছাড়া থাকবেন । আর তোদের মেয়ের যাতে কেউ কোন ক্ষতি না করতে পারে, তাই ওকে জেলে সরকারি হেপাজতে, মানে হলো গিয়ে রেপ কেসের ভিক্টিম হিসাবে প্রেসিডেন্সি জেলে সেফ কাস্টডিতে  রাখা হবে " জাহানারার বাবা-মা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন, "বাবু আর  কি ক্ষতি ওর হবে, বরং বাড়ী নিয়ে গেলে আমাদের কাছে আদরে থাকবে। তোমরা তো সব জানো। ওই লোকটাকে ধরে রাখো না কেন !" "যা যা, আমাদের উপদেশ দিস না, আইনের বুঝিস কিছু ? বিরক্ত করিসনা। " "একজন বস্তি বাসী উত্তর দেয় ," না বাবু, যে আইন দোষী কে ছেড়ে দিয়ে, নির্দোষী কে জেলে রাখে, সে আইন বুঝা মোদের কম্ম নয়। "

---

এতক্ষন সবাই জাহানারা বৃত্তান্ত শুনছিলো। হটাত করে ডুকরে কেঁদে ওঠে মীরা, কোলে তার হার জিরজিরে একটা বাচ্চা লেপ্টে আছে। জাহানার বাবা অবাক হয়ে তাকান। শান্তিবাই বলে ," ওর একই কেস , গত দুবছর ধরে এখানেই আছে। আর ও কত যে এরকম কেস আছে, তোমরা ধারণা করতে পারবে না। এই দেখোনা, আমাকে গাঁয়ের মোড়লের ছেলে ভালবাসার ভান করে সর্বনাশ করেছে। দিন গুনছি চাচা, যেদিন ছাড়া পাবো, শয়তান টার মজা দেখাবো।"

---

জাহানারার বাবা বুঝতে পারেন সুবিচারের প্রত্যাশায় অনেক  ভিক্টিম জেলের সেফ কাস্টডি পচছে। তবু আশা মরেও মরে না। যাবার সময় মেয়ের হাতদুটি ধরে অনেক বোঝালেন, "বাচ্চা টাকে দুধ খাওয়া মা। উকিল বলেছে এই বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে, ওর রক্তের সাথে শয়তান টার রক্ত মিললে , দোষী প্রমান করা যাবে ,আর শাস্তি হবে। " মেয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলো, আর তার জন্য আনা জিনিস পত্র পড়ে রইলো অবহেলায়।

---

জাহানারার বাবা মা যাবার সাথে সাথে লোভী ওয়ার্ডার আর তাদের দালাল কয়েদীদের মধ্যে তার বাড়ী থেকে আনা জিনিসপত্র ভাগাভাগি হয়ে গেল। কিন্তু সে একই ভঙ্গীতে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। তারপর আরো দুদিন কাটলো। সে বাচ্চাটাকে ছুঁয়েও দেখলো না। ভাল সহ বন্দিনীদের কেউ কেউ নিজের বুকের দুধ দিয়ে, বা হাসপাতালের থেকে একটু  আধটু দুধ জোগাড় করে খাওয়ালো , কিন্তু বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না।
---

আবার এলেন জাহানারার মা - বাবা। তাঁরা আসতেই মেট্রন ঝাঁঝিয়ে উঠলো, " তোমাদের  মেয়ে দুধ না খাইয়ে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে।" বাবা কপাল চাপড়ালেন." হায়, হায়, তুই কি করলি মা!ওটা বেঁচে থাকলে যে শয়তানটার শাস্তি হত।"    এত দিন বাদে চোখ তুলে তাকাল জাহানারা , কোন বিহ্ভলতা নেই সেই চোখে। আছে শুধু একটা পরিণত মানুষের আত্মবিশ্বাস, যা সঞ্চিত হয়েছে দীর্ঘ দশ মাসের  জেল জীবনের অস্বাভিক নরক যন্ত্রনা , কদিনের পুলিশ চৌকিতে পশুখামারের অপরিসীম ক্রুরতা আর দাদুর বয়সী একটা মানুষের আমানবিক পাশবিক হিংস্রতার অভিজ্ঞতার  আলোকে।
---
এক টুকরো বিদ্রূপ মাখা হাসিতে তার ঠোঁটের কোন দুটো একটু বেঁকে গেল। যেন বলতে চাইল, " আইন কি গরীব মানুষদের জন্যে ! আর দোষীকে শাস্তি দেওয়া কি এতই  সোজা সরল ব্যাপার ! তাহলে আমার মত এতগুলি মেয়ে এখানে পড়ে আছে কেন ! অনেক হয়েছে , এবারে আমাকে বাড়ী নিয়ে চলো। এই নরক থেকে আমি মুক্তি চাই। "
_________________________________________________________________________________________
সত্যঘটনা অবলম্বনে। ' সিনি - আশা' র ' ভাবনা ' সংকলনে, ১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশিত।    


____________________________________________________________________________________________




































































No comments:

Post a Comment