13 Oct 2016

দিশারী -- মুখবন্ধ, দিশারী - পর্ব ১

দিশারী   --  মুখবন্ধ
**************
দিশারী গল্পের মূল চরিত্রের আসল নাম ছিল হাসিনা। আমার সাথে আলাপ হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে।  ১৯৭৪/৭৫ সালে।সেখানেই মীরা, জাহানারা, ছোট্ট শংকর, শ্যামলী ইত্যাদি অজস্র মানুষের, বিশেষত মেয়েদের সাথে আলাপ হয়েছিল। হাসিনা আমার মেয়ে ছিল। মেয়াদী নম্বরের গরাদের ওপারে ছিল হাসিনা, অন্যপারে আমি।  দুজনেই প্রায় সমবয়সী। সুন্দরবনের কোন এক গাঁয়ের মেয়ে হাসিনা, প্রথম সাক্ষাতে দাবী করল আমি ওর মা। আমিও মেনেনিলাম। মেয়ের মতই আবদার ছিল তার। তার থেকে বেশী অন্য কারোর সাথে কথা বললে মুখ ভারী। কারনে অকারণে তার তলব আসতো। আমাদের অন্য কোন বন্ধুকে দেখলে,বলতো," এই দিদি মাকে ডেইকে দে।" বন্ধুটি এসে জানাত,"এই যা তোর মেয়ে ডাকছে। "  
 --
এখানে হাসিনার নাম দিয়েছি দিশারী। তারই মত জেলের অন্ধ কুঠুরি তে বন্দী অসংখ্য মেয়েদের প্রতিচ্ছবি সে। প্রথম কয়েকটি পর্ব তারই মুখে শোনা তারই জীবন কথা। পরবর্তী পর্বে সে হয়ে ওঠে সেই সব মানুষের মুখ, যারা জেলে নিদারুন কষ্ট আর অত্যাচারের এবং অন্যায়ের বিরুধ্বে প্রতিবাদের শরিক।  
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++ ++++

দিশারী - পর্ব ১
***********
"আম্মা দোর টা ঠিক কইরে চেইপে দে। দেখতেছিস না সূর্য্যির আলো ঘরে ঢুকতেছে। রাইতের আঁধার থাইতে, ভোর হওয়ার আগেই খাবারডা খায়ে ফালি, রোজা রাইখবো যে, " ৩/৪ বছরের দিশারী ঘুম ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে বলল। "ভোর কোন কালে হৈছে, সকলে যখন পান্তা খেইতেছিলো অনেক ডাকাডাকি তে ও উঠিস নাই। এখন কিছু খালে আর রোজা রাখতে পারবি না মা " আমিনা উত্তর দিলো। "তুই দোর টা চেইপে দেলেই আলো এইসতে পাইরবে  না। আঁধারে পান্তাডা খালে ই রোজা রেইখতে পারবো," জেদি গলায় দিশারী ঘোষোনা করে। "অমন বলে না, ফির বচ্ছরে রাইত থাইতে মোদের সাথে পান্তা খেইয়ে নিবি, আর রোজা রাইখতে বাঁধা থাইকবে না।" "না, ফির বছর লয়, ই বছরে রোজা রাইখবো," রীতিমত রেগে গেল মেয়ে। মা জিজ্ঞাসা করে,"পিপাস লাইগলে কি করবি ?" "পুকুরে চান করতে যেয়ে ডুইবে ডুইবে জল খায়ে নিব, কেউ বুইজতে পারবে না। " রেগে মা বলে, "সেয়ান মেয়া।"
--
বাবা ফকির আলী হাসি চেপে এতক্ষন মা মেয়ের বাকবিতন্ডা শুনছিলেন। এবারে হস্তক্ষেপ করলেন," আহা ছেইড়ে দে ক্যানে, ছোট দের কসুর আল্লা মাফ করি দিবেন, উয়াকে রোজা রাইখতে দে।" "দেখছোনি আব্বা কি বলতেছে, তাইতো আব্বারে এত ভাইলোবাসি" আল্লাদী গলায় দিশারী বিজয়ীর হাসি হাসে। " "যা মনে ধরে কইরোগে যাও, বাপের আর পিসির আদরে মেয়ার বারোটা বাজতেছে, মেয়ামানসের এত আল্লাদ উচিত লয়। " মেয়ামানুষ আর বেটাছিলের মইধ্যে কন ফারাক লাই। দুই আল্লার দান, আদরের জিনিস, " ফকির দৃঢ় গলায় উত্তর দেয়। ফকিরের বোন হামেদা উত্তর দেয়, ঠিক কথা বটে, কিন্তুক মেয়ামানুষদের যত দায়। আমারেই দেখ, বনকে মধু আনবার গিয়া বাঘের প্যাটে গেইল মরদ। শ্বশুরঘর আমারে দায়ী কইরে ভিটা ছাড়া কইরলে। দুই ছেলা নিয়া তমাদের এটুক স্থানে এইশতে হইলো।" "ইখানে এইসবে নাত কোথা যাবে, ই তমার বাপের ঘর," আমিনা বলে। ফকির বোন ধমকে বলে, "ই ঘরে তর সমান হক, খপরদার বাজে বকবিনি। তর দুই ছেইলা, মোদের দুই ছেইলা আর,এক বিটি, সব্বে মোদের আসল ধন, আদরের ধন।"
---------

সাত বছর কেটে গেছে। দিশারী এখন সকলের মত সমস্ত নিয়ম মেনে যথাযথ ভাবে রোজা পালন করে। সে এখন বাবার মুখে ছোটবেলায় রোজা রাখা নিয়ে তার ছেলেমানুষীর কথা শুনে লজ্জিত ভাবে হাসে। পাঁচ বছর আগেই কাছাকাছি গ্রামের নাসিরের সাথে তার নিকা হয়ে গেছে। তখন নাসির এলে সে তার ঘাড়ে চেপে মিষ্টি খাওয়ানোর বায়না ধরত। শ্বশুর বাড়ীর লোকেদের সাথে ঠিক হয় সে ঋতুমতী হলে পনের বাকী অংশ নিয়ে শ্বশুরঘরে যাবে।
--
ফকির আলীর ভিটে টুকু ছাড়া আর কোন জমি ছিল না। চাষের সময় হামেদার ছেলেদের নিয়ে জোতদারের জমিতে চাষ করত। বাকী সময় মাছ ধরত, জঙ্গলে কাঠ আর মধু সংগ্রহে যেত। ফতেমা আর হামিদা ধান ভানা, জমিতে বীজ বপন ইত্যাদি কাজ ছাড়াও নদীর পাড়ে মাছ ধরা, শাক তোলা ইত্যাদি কাজে ব্যাস্ত থাকতো।দিশারী  ঘরের সব কাজ ছোট থেকেই করত। শুধু রান্না করার পুরো দায়িত্ব পিসি দিত না, কেবল জোগান দিত। বাকি সময় বান্ধবীদের সাথে গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, ছাড়া গল্প করে হেসে খেলে দিন কাটাত।
--
গ্রামের মেয়ে, প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছে সে। নীল আকাশে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠে বা নদীর জলে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত , গাছের পাতায় বৃষ্টির জল, ঝোড়ো হাওয়া শব্দ, রাতের আকাশে তারাদের ঝিকিমিকি সব কিছু তার একান্ত আপনার, সবই তাকে ভীষণ ভাবে টানতো। সুখ না থাকলেও শান্তি ছিল পরিবারে। সবার আদরে সহজ সরল জীবনে খুশি ছিল দিশারী।
--
এর মধ্যে একদিন খবর এল নাসির ভাল পণ নিয়ে ১৯/২০ বছরের এক যুবতীকে বিয়ে করেছে। গ্রামের লোকজন ফকির কে পরামর্শ দিল পনের বাকি টাকার কিছু অন্তত দিয়ে দিশারীকে শ্বশুর বাড়ী পাঠিয়ে দিতে। ফকির সোজা সাপটা বলে," আমার মেয়া কে সতীনের ঘর করতে দিব না। " "সময় মত মেয়া কে মোরা ফির বিয়া দিব," হামেদার মত। ফতেমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে," কোথা পাব  টাকা! আর কি হবে মোদের মেয়ার !" গ্রামের লোকেরা সবাই বোঝে, তাদের সকলেই একই পরিস্থিতি। দিশারীর মন কিন্তু খুশিতে উচ্ছল, তাকে নিজের ঘর ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে হবেনা। নাসিরের দ্বিতীয় বার বিয়েতে তার কোন হেল দোল নেই। 
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++









































No comments:

Post a Comment