26 Oct 2016

দিশারী - পর্ব 3

দিশারী - পর্ব ৩
************
রুবিনা দিশারীকে বেলেঘাটায় এক মধ্যবিত্ত বৃদ্ধ দম্পতির কাছে কাজে দিল। তাঁদের মেয়ের বাড়ীতে সে আয়ার কাজ করে। দিশারীকে ঘরের সব কাজ করতে হত, রান্না থেকে শুরু করে কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা, ঘর পরিস্কার সবকিছু।
হাড় ভাঙা খাটুনিতে অভ্যস্ত গ্রামের মেয়ে সে। তাদের তিনটি লোকের জন্য সে এই কাজ তার কাছে কোন সমস্যা ছিল না। বৃদ্ধ দম্পতি ভাল মানুষ ছিল।
--
মেয়ের বাড়ী যাবার সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। সেই বাড়ীর বারান্দা থেকে গঙ্গার ঘাট দেখতে পাওয়া যেত। রুবিনা বুয়ার সাথে দেখা হওয়া ছাড়া ঘাটের দিকে চেয়ে সূর্যাস্ত দেখতে তার খুব ভাল লাগত। তাছাড়া শেয়ালদায় বাজার করতে যাওয়া হত। চিড়িয়াখানা ইত্যাদি  নানা জায়গায় মেয়ের সাথে বেড়াতে যাবার সময় ও তাকে সাথে নিত। দম্পতির গাছের শখ ছিল। বাড়ীতে ছাদের উপর টবে গাছ ছিল। মাটির সাথে নাড়ির টান, তাই ধীরে ধীরে গাছের পরিচর্যার কাজ দিশারী আস্তে আস্তে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তিনজনে মিলে সেখানে অনেক সময় কাটাত, তাদের তার জীবনের সব গল্প করে  দিশারী মন হাল্কা করত। 
--
ঈদের সময় নিজের জমানো মাইনের টাকা নিয়ে রুবিনার সাথে গ্রামে গেল। বাড়ীর সবাই খুশীতে আত্মহারা। বিশেষত  ফকিরের আনন্দ যেন আর ধরে না, মেয়েকে এক মিনিট ও কাছ ছাড়া করতে চাইত না। কিন্তু কোথা দিয়ে উৎসবের দশটা দিন কেটে গেল। তারপর সেই কান্না আর দীর্ঘশ্বাসের সাথে আবার ছাড়াছাড়ি। উন্মুক্ত খোলা আকাশ আর নদীর পাড় ছেড়ে বদ্ধ শহর জীবন।
--
ছয় মাস বাদে আবার গ্রামে ফেরার সময় রুবিনা তার সাথে যেতে পারল না। তার কাজের বাড়ীর লোকেদের সাথে সে কোথায়  যেন বেড়াতে গেল। রুবিনা তাকে শেয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দিল। ঠিক হল দিন সাতেক বাদে সে নিজেই ফিরে আসবে। সবাই বার বার করে জিজ্ঞাসা করল "কিরে রাস্তা চিনে ঠিক মত ফিরতে পারবি তো।" "হ্যাগো, তোমাদের সাথ শেলডা বাজারে কত্তবার গেইছিনি, ঠিক চিনে নিব," - দিশারী আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
--
সে ঠিক মতই গ্রামে পৌঁছাল, কদিন মহা স্ফূর্তিতে কাটাল। মাইনের জমা টাকা আব্বার হাতে তুলে দিতে সে খুব তৃপ্ত বোধ করে। এবারে দিশারী ফেরার সময় ফকির জীবনে এই প্রথম বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল, "মা রে, কেমন যেন মনে হইছে তরে আর দেইখতে পাইরবনি। " "ইমন কথা বলনি আব্বা, তোমারে আমি কলকাতায় ভাল হাসপাতালে দ্যাখায়ে ভাল কইরে তুইলব," চোখের জলে বাপকে জড়িয়ে ধরে দিশারী বলে। ফকির চুপ করে যায়, মনে মনে কি এক অজানা আশঙ্কায় মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
--
ভাইরা ক্যানিং স্টেশন থেকে বোনকে আবার কলকাতা গামি ট্রেনে চাপিয়ে দেয়। সারাটা সময় দিশারীর অসুস্থ বাবার অসহায় মুখটা মনে পড়তে থাকে। কোনদিকে আর হুশ থাকেনা। কখন যে কোলকাতা পৌঁছে গেল খেয়াল ই রইল না। অন্যমনস্ক ভাবে ট্রেন থেকে নামল। ভীড়ের ঠ্যালায় যেদিকে নিয়ে যায় সেই দিকে চলতে শুরু করল। বেলেঘাটা যাবার বাসের রাস্তা কখন পার হয়ে কেমন যেন সম্মোহিত মানুষের মত হেঁটেই চলেছে। হটাৎ কানের কাছে একটা তীব্র আওয়াজ আর সেই সাথে এক প্রবল ধাক্কায় তার হুঁশ ফিরল।
--
তাকিয়ে দেখে তার চার পাশে ভীড় জমে গেছে।তাকে ধাক্কা দিয়েছিল যে মানুষ টি তাকে বকে ওঠে,"গিয়েছিলে তো এখনই বাসের তলায়, অন্ধের মত রাস্তা চলচ্ছ, লাগেনিত।" লজ্জিত মুখে দিশারী মাথা নেড়ে না করে, কৃতজ্ঞ চোখে তার দিকে তাকায়। "ভাল করে দেখে রাস্তা চল,"বলে লোকটি তার পথে চলে যায়, ভীড় ও কেটে যায়, পথিকরা যে যার পথে চলতে থাকে। এইবারে দিশারী ভাল করে চার পাশ তাকিয়ে দেখে, সব ই কেমন অচেনা, অজানা লাগে। বুঝতে পারে সে পথ হারিয়েছে। এক দিক ধরে সে চলতে শুরু করে, শেয়ালদা স্টেশনের দিকে যাবার জন্য।
--
অনেক্ষন হাঁটার পর ও রাস্তা খুঁজে পায়না। চিন্তা, খিদে আর তেষ্টায় অসুস্থ বোধ করে। রাস্তার ধারে একটা দোকান থেকে একটা গোল পাউরুটি আর এক ভাঁড় চা নিল। একগ্লাস জল চেয়ে খায়। এবার কি করবে চিন্তা করতে করতে মাথা ঝিম ঝিম  করতে থাকে। কোনমতে খাবার টা গলাদ্ধকরণ করে, হতবুদ্ধির মত কিছুক্ষণ বসে থাকল।
--
দোকানের প্রবীণ মালিক তার অবস্থা দেখে বুঝতে পারল সে কোন বিপদে পড়েছে। দিশারী তার সমব্যাথী দৃষ্টি দেখে শেয়ালদা স্টেশন কিভাবে যাবে জিজ্ঞাসা করল। "মা তুমি একদম উল্টো রাস্তায় অনেক দূর চলে এসেছ। তুমি একা যেতে পারবে না। রাস্তার মোড়ে যে পুলিশটা কে দেখছ, ওকে বল ও তোমায় শেয়ালদার বাসে তুলে দেবে। শেয়ালদা এলে কন্ডাক্টার যখন চেঁচাবে, তুমি নেবে যাবে। তোমার কাছে পয়সা আছেতো। দিশারী মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
--
সেই মত দিশারী পুলিশটা কে তার বিপদের কথা জানায় এবং শেয়ালদার বাসে তুলে দিতে অনুরোধ করে। ট্রাফিক পুলিশটি সেখানে কর্তব্যরত সার্জেন্ট কে রিপোর্ট করে। সার্জেন্ট দিশারীকে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বড় একটা পুলিশ ভ্যানে উঠতে বলে। দিশারী ভাবে পুলিশ নিশ্চয়ই এই গাড়ীতে তাকে শেয়ালদায় নামিয়ে দেবে। ভ্যানে আরও কিছু মহিলা ও পুরুষ মানুষ বসে ছিল।
--
প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ ভ্যানটি সবাইকে নিয়ে একটি পুলিশ থানায় উপস্থিত হয়, লাইন করে ভেতরে ঢোকায়। দিশারী ভাবে কিছু ভুল হয়েছে বোধহয়। সে একজন পুলিশ কে বলে,"কাকা আমরে  শেয়ালদা স্টেশনে ছেইড়ে দেন, ট্রেনে আমি আমার গ্রামে চইলে যাতি পাইরব।" পুলিশ টি সজোরে ধকম লাগে। পাশ থেকে একটি মেয়ে তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়। "চুপ করে আমাদের সাথে বসে থাক, না হলে পুলিশ ডান্ডার বাড়ী লাগাবে। তারপর মেয়েদের এক করে নাম জিজ্ঞাস করে তার সথে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, "এটা চুরি কেস, এটা রেপ কেস, এটা দেহবেচা কেস, দিশারীর বেলা বলে এটা হারান কেস ইত্যাদি। "
--
তারপর সবাইকে একটা বড় ঘরে ঢুকিয়ে লোহার গেট বন্ধ করে দেয়। কেউ কেউ হাসাহাসি করতে থাকে, কেউ  কাঁদে কেউ নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগায়।পুর্বতন মেয়েটি তাকে বলে,"ও তুমি হারিয়ে গেছো, তাই শেয়ালদা স্টেশন যেতে চাইছিলে। কিন্তু পুলিশের সাহায্য নিয়েই ভুল করেছ। ওরা তোমাকে সোজা জেলে নিয়ে যাবে, কারণ ওটাই ওদের কাছে সহজ পথ।" দিশারী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে।
--
পরের দিন সকালে এক টুকরো পাউরুটি আর চা খাইয়ে তাদের ভ্যানে করে শেয়ালদা কোর্টে নিয়ে গেল। সেই রাস্তায় যাবার পথ দিশারীর একান্ত পরিচিত। সে বার বার চেঁচিয়ে বলতে," ওগ আমারে ছেইড়ে দাও, ইখান থেইক্যে আমি আমার কাজের বাড়ী আর আমার গ্রামে দুইখানেই যেইতে পেইরব।" কাকস্য পরিবেদনা। কেউ তার কথায় কর্নপাত ই করল না। কোর্টে জজের কাছে কাউকে তোলা হল না। সন্ধ্যার সময় সবাইকে বাক্সবন্দি করে সোজা প্রেসিডেন্সি জেলে যাওয়া হল।
--
জেল অফিসে সবায়ের নাম, ধাম ইত্যাদি লিখে আপাদমস্তক সার্চ করে মেয়েদের নিয়ে দুই মেয়ে জমাদারনী (ওয়ার্ডার) এক লাঠিধারী জমাদার জেলের মধ্যে দিয়ে আর একটি দেয়াল ঘেরা ছোট জেলের মত জায়গায় গেল। জমাদার বিশাল জোরে হাঁক পারল, "জেনানা ওয়ার্ড " আর একটা ঝোলান দড়ি ধরে টান মারল। সাথে সাথে ঢংঢং করে ঘন্টা বাজতে  লাগল। ভেতর থেকে লোহার গেট খুলে আর এক জমাদারনী গুনে গুনে তাদের ঢুকিয়ে নিল। ভেতরে ঢুকে আর এক পর্ব সার্চ। তারপর বিভিন্ন ওয়ার্ডার বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দিনীদের ঢুকিয়ে দিল। দিশারীদের হাজতী নম্বরে ঢুকিয়ে বিশাল তালা ঝুলিয়ে দিল। বন্ধ লোহার গেটের সামনে বসে সারা রাত ধরে দিশারী অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, 'এ কেমন জগৎ যে শুধু মাত্র রাস্তা হারিয়ে যাবার অপরাধে সে আজ জেলে বন্দি। আর যে পুলিশদের কাছে সাহায্য চাইতে গেল তারা সাহায্য তো করলেই না, উল্টে বিনা দোষে তাকে এক অন্ধকূপে বন্ধ করার ব্যবস্থা করল। আর কেউ তার একটা কথাও শুনল না।'
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
( চলবে )











 



















   

















    





 

No comments:

Post a Comment