16 Oct 2016

দিশারী - পর্ব 2

দিশারী  - পর্ব ২
************
ধীরে ধীরে দিশারী বড় হয়, ঋতুমতী হয়। ক্রমে সে তার চনমনে ১৬ বছরে পৌঁছায়, তার বিবাহিত বন্ধুদের মুখে নানা রোম্যান্টিক গল্প শোনে। এখন সে তার স্বামীর কথা ভাবতে শুরু করে। নাসির কে নিয়ে নিজের জীবনের নানা রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বড় মধুর লাগে নাসিরের টুকরো টাকরা স্মৃতি। সে নানা ভাবে তার খবর পেতে চেষ্টা করে। ঠিক কোথায় নাসিরের বাড়ী, কি পরিস্থিতি সব খবর সংগ্রহ করে। বাবা মাকে কিছু বলতে লজ্জা পায়। অবশেষে যৌবনের ডাক অগ্রাহ্য করতে না পেরে বাড়ীতে কাউকে না জানিয়ে একাই নাসিরের গ্রামে গিয়ে, তার বাড়ী খুঁজে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। শুধু এক বান্ধবী কে বাড়ীতে খবর দেবার কথা বলে যায়, যাতে বাবা মা চিন্তা না করে।
--
এদিকে নাসিরের বাড়ীতে তার উপস্থিতি এক বিরাট গন্ডগোল বাঁধায়। সারা গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। নাসিরের দ্বিতীয়া স্ত্রী উঁচু গলায় চিৎকার করতে থাকে। তার কোলের বাচ্চাটা ভয়ে কাঁদতে থাকে, আর একটি বাচ্চা মায়ের আঁচল চেপে ধরে খাবারের দাবী জানাতে থাকে।প্রতিবেশীরা বাড়ী ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা মতামত দিতে থাকে। সদর দরজার ভেতরের একপাশে দিশারী মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে, কিন্তু ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় বিনা যুদ্ধে সে মাটি ছাড়বে না। এদিকে নাসিরের মা চিৎকার করে একবার দিশারীর আর একবার প্রতিবেশীদের চোদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করছে। কারণ প্রতিবেশীদের বেশ বড় একটা অংশ দিশারীর স্বপক্ষে সওয়াল করতে থাকে। হতবুদ্ধি নাসির দাওয়ায় মাথায় দু হাত দিয়ে বসে থাকে।
--
নাসিরের বড় বোন কামিনী ও তার স্বামী জাকির আসে। তাদের দিশারীকে দেখে খুব মায়া হয়। তারাও তাকে ঘরে তোলার যুক্তি দেয়। অবশেষে গাঁয়ের মাতব্বরের দল সালিশির জন্য আলোচনায় বসে। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, সাথে সাথে বৃষ্টি শুরু হয়। মাতব্বরের দল বিধান দেয় দিশারীকে বাড়ীতে থাকতে আর খেতে পরতে দিতে হবে। কিন্তু নাসির দ্বিতীয়া স্ত্রীর সাথেই সহবাস করবে। দিশারীর বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে সব জানিয়ে দেওয়া হবে।
--
পরিবারের প্রধান হিসাবে নাসিরের মা সংসারের সব ভারী কাজের দায়িত্ব চাপিযে দেয় দিশারীর কাঁধে। আর ভারী পণ নিয়ে আসা দ্বিতীয়া স্ত্রীর ভাগে হাল্কা কাজের ভার দেয়। কামিনী ও জাকির দিশারীর জন্য একটা সন্মানজনক ব্যবস্থার পক্ষে বৃথাই সওয়াল করে। দিশারীর ভাগ্যে শুধু শ্বশুরঘরে স্থান টুকু জোটে কোনমতে।
--
এই ভাবে দুবছর কাটল। সারাদিন হাড় ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে শ্বাশুড়ি ও সতীনের অকথ্য গালিগালাজ আর প্রায় আধপেটা খেয়েও সে মুখ বুজে আর দাঁত কামড়ে পড়ে ছিল। সমস্ত দুঃখের মধ্যে তার একমাত্র সান্তনা ছিল স্বামী। কারণ ইতিমধ্যে নাসির লুকিয়ে চুরিয়ে দিশারীর সঙ্গে সহবাস করতে শুরু করেছিল। যৌবনের ধর্মে স্বামীর আদর সে উপভোগ করত, আনন্দে সাড়া দিত, আর প্রাণ ভরে তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল।
--
তবে ক্রমে নাসিরের ব্যবহার তার কাছে পরস্পর বিরোধী হয়ে উঠতে লাগল। অনেক সময় শ্বাশুড়ি ও সতীনের কথায় তাকে প্রচন্ড গালিগালাজ, এমন কি প্রচন্ড মারধর করতে শুরু করল। অন্যদিকে তার শারীরিক আকর্ষণ শুধু যে উপেক্ষা করতে পারত না তা নয়, লুকিয়ে চুরিয়ে মেঠাইও খাওয়াত। আর ছোট বেলায় তার ঘাড়ে চেপে মেঠাই এর জন্য বায়না করা নিয়ে ঠাট্টা করত। মাঝে মাঝে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বাপের বাড়ী ফিরে যাবার পরামর্শ দিত," তুই মোর থেইকে অনেক ছোট।এখন ডাগর ডুগর হহইয়েছিস, বাপের বাড়ী চইলে যা, আবার জোয়ান মরদ বিয়া কর।" উত্তরে দিশারী স্বামীকে আঁকড়ে ধরে, বুকে গুঁজে দিত, "দূর, আমি আর বিয়া কইরতে পাইরবনা।"
--
কামিনী দিদির কাছে সে সব গল্প করত। নিঃসন্তান কামিনী ও জাকির তাকে মেয়ের মত ভালোবাসত। কামিনী তার শুকনো মুখ দেখলেই কাছে বসিয়ে পেট ভরে খাওয়াত। কিন্তু অকস্মাৎ মাথায় বাজ পড়ল। দিশারী সন্তানসম্ভবা হল। আর তাদের গোপন রোমান্স ধরা পরে গেল। স্বাভাবিক কারণে ঈর্ষায় সতীনের তার প্রতি দুর্ব্যবহার মাত্রা চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, তাই তাকে তুষ্ট করতে নাসির আর তাঁর মা দিশারীর উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করল। কামিনী আর জাকির দিশারীর মা হওয়ার সম্ভাবনায় খুব খুশি ছিল আর যথা সম্ভব তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করত।
--
একদিন দুপুরে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত দিশারীকে বিশ্রাম নিতে দেখে নাসির বিদ্রুপ করে," অরে রাইজকন্যা ভর দোপোরে ঘুমের ব্যবস্থা দেখতেছে। যা ওঠ বড়মানষের মেয়া, জমিনে বেগুন চারা লেইগেছি। ওই পোকামারনের ওষুধ (পেস্টিসাইড) ওগুলার পাতার উপর ছড়ায়ে দিবি। আর সারের বোঝা নিয়া যা, গাছের গড়ায় দিবি। উল্টাপাল্টা কইরলে আস্ত রাখবনি, মনে থাকে যেন।"
--
সার আর কীটনাশকের ভারী বোঝা নিয়ে দিশারী কোনো মতে টলতে টলতে বেগুন ক্ষেতে যায়।  চোখে মুখে সে যেন সর্ষেফুল দেখছে। নাসিরের কথা ভুলে গিয়ে সার আর কীটনাশক দুই কোন মতে গাছের উপর ছুড়ে ছুড়ে দিতে থাকে। নাসির তার পেছনে এসে এই কান্ড দেখে সব বোধ হারিয়ে হাতের কাস্তে টা ছুঁড়ে মারে। সেটা গিয়ে দিশারীর ডান হাতর ওপরে পড়ে অনেকখানি কেটে যায়। যন্ত্রয়ায় চিৎকার করে কেঁদে সে মাটিতে বসে পড়ে। বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে তাকে সজোরে এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে নাসির বাড়ী ফিরে যায়। অবসন্ন দিশারীর ডান হাত থেকে প্রবল বেগে রক্ত ঝরতে থাকে, তারপর জ্ঞান হারিয়ে বেগুন ক্ষেতে শুয়ে পড়ে।
--
একটু পরে জ্ঞান ফেরে, কিন্তু তলপেটে বীভৎস যন্ত্রনায় সারা শরীর মোচড় খেতে থাকে, দু পায়ের মধ্যে দিয়ে রক্তস্রাবে কাপড় ভিজে যায়। বমি হতে শুরু করে। অনেক্ষন পর কোন মতে উঠে প্রায় হামাগুড়ি দেওয়ার মত করে কামিনীর বাড়ীর দরজায় কাছে পৌঁছে আবার জ্ঞান হারায়। প্রায় সপ্তাহ ভর বাদে তার পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে। দেখে কামিনীর খাটে সে শুয়ে, স্বামী স্ত্রী দুজন তার শুশ্রূষায় ব্যস্ত। কামিনীর মুখে নিজের গর্ভপাতের খবর জানতে পারে, নাসির বা তার মা এক বারের জন্যও তার কোন খবর নেয়নি।
--
আরও  কিছু দিন  বাদে তার শরীরে বল আসে, কিন্তু বিবাহিত জীবনের রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলি একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে। কামিনীর পরামর্শে সে জাকিরের সাথে বাপের বাড়ীর পথে পা বাড়ায়। গ্রামে পৌঁছে দিয়ে জাকির ফিরে যায়, দিশারী প্রচন্ড সংকোচে বাড়ী না গিয়ে পুকুর পাড়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। লোকমুখে খবর পেয়ে বাড়ীর সবাই ছুটে আসে। ফকির হারান মানিক ফিরে পেয়ে আত্মহারা হয়ে যায়,"মারে, তুই তোর নিজি স্থানে ফিরে এইসেছিস। তর কুন
দোষ নাই। লাজ কইরবি ক্যানে।"
--
মেয়ের অবস্থা দেখে ফাতেমা আর হামেদা নাসিরদের সকলকে অভসম্পাত করতে থাকে। ফকির বলে,"চুপ যা, ওদের নাম এ ঘরে কেউ বলবিনি। ওর মনে স্থিতি আসুক আর কিছু চাইবিক না কেউ।" শুধু দিশারীর ভায়েরা বলে, "তর চারটা ভাই রয় নাই। ইয়ার জবাব না দিয়া ছাড়বোনি।" "আল্লার কাছে সবার বিচার হবে, কনদিন কি কন ভাল মনিষ্যি  মোর সোনার পিতিমের দাম দিবে না, তাও কি হয় নাকি," বলে ফকির মেয়ের মাথায় হাত বুলায়।
--
দিশারী চুপ করে থাকে। বিয়ের কথা সে আর ভাববে না। তার রাস্তা সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে। কদিন সময় লাগবে এই দুঃস্বপ্ম থেকে থেকে পুরোপুরি মুক্তি। তারপর শরীর আর মনের জোর ফিরে পেলে, সে জাকির ভাই কথা মত হাতের কাজ শিখবে। এবার থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে।
 ---

সূর্য্যকে আর একবার প্রদক্ষিন করল পৃথিবী। কিন্তু দিশারীদের অবস্থা আরও খারাপ হল। ফকির জঙ্গলে গাছ থেকে পড়ে  শিরদাঁড়ায় এমন চোট পেল যে তার ভারী কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল। একটি ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেল।বাড়ীর বাকীদের ওপর চাপ বাড়ল। দিশারীকে ও ঘরের কাজের সাথে বাইরে কাজে বার হতে হল, শাকপাতা সংগ্রহ, জ্বালানী জোগাড়, নদীর পাড়ে মাছ ধরার জন্য।  
 --
কিন্তু বিধি বাম। তার পিছনে লাগল গ্রামের জোতদার আরশাদ মোল্লা। ফলে মা বা পিসির সঙ্গ ছাড়া একা বেরোন বন্ধ করতে হল। ইতিমধ্যে দিশারীর কিছু বিয়ের প্রস্তাব আসে। পরিবারের ইচ্ছা থাকলেও দিশারী অনড়। বাড়ীর লোক তাকে বিয়ের জন্য কোন চাপ দেয়নি। আরশাদ মোল্লা তার সুযোগ নিল। নিজের অপরিণত মস্তিস্কসম্পন্ন ছেলের সাথে দিশারীর বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। তার বদ মতলব আর কারসাজি গ্রামের লোকের বুঝতে বাকী রইল না।
 --
বাপ মেয়ের আসন্ন বিপদের গন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়ল। অসহায় ফকির  গ্রামের লোকেদের পরামর্শে তার খালাত বোন
রুবিনা খাতুনের তত্ত্বাবধানে তাকে ঘরের কাজের লোক হিসাবে কাজ করার জন্য কলকাতায় পাঠাতে রাজী হল।"মারে, তুই রুবীনারে তর মা আর খালার মত মান্য কইরবি। আল্লা তরে বিপদে রক্ষা কইরবে। তর ভাল মন্দের বোধের উপর মোদের পুরাপুরি বিশ্বাস রইছে।"
--
 ফাতেমা আর হামেদা চোখে আঁচল দিল। ভারী বুকে দাঁত চেপে ফকির মেয়ের জন্য সকলের কাছে দোয়া চাইলেন। ভাইরা রুবিনা আর দিশারীর সাথে ক্যানিং স্টেশন পর্যন্ত গেল, সেখান থেকে তারা কলকাতার ট্রেনে চড়ল। অবশেষে দিশারী তার ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল - তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নাকি আরও বড় দুর্গতি ভোগ করার জন্য !
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
 (চলবে )






  


































































No comments:

Post a Comment