9 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 1 & 2

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ১
***********************
প্রায় একমাস লালবাজারের লক আপে ভিন্ন ভিন্ন নামে রেখে অবশেষে আমাদের ১৫/২০ জনের দলটাকে রাইফেল ধারী গার্ড দিয়ে শেয়ালদা কোর্টে নিয়ে যাওয়া হল। প্রতি দিনের শারীরিক ও মানষিক অত্যাচারে সকলেই অল্প বিস্তর বিদ্ধস্ত। দলের মধ্যে আমি ছিলাম একমাত্র মেযে। সকলেই আমার দিকে স্নেহপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। এরপরে আমার সাথে দেখা হবার সুযোগ হয়ত হবেনা। সময় ১৯৭৩ সাল, বেলা ১০ টা।
--
কোর্টে আমাকে মহিলা লক আপে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, বাকিদের ছেলেদের লক আপে। বহুদিনের সুখদুঃখের সাথীদের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ছোট্ট নোংরা ঘরটায় একটা মাত্র জালের বিশাল একটা তালাবন্ধ দরজা। প্রায় আত্মবিস্মৃত অবস্থায় একটা কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হটাত কে যেন ডাকল,"এই রীতা, এদিকে আয়, এইযে এই দিকে।" সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখি অন্য কোণে মিনু বসে আছে। ওর কাছে গিয়ে বসলাম। ভাল করে খেয়াল করে দেখি ওর পাদুটো গোদের মত ফোলা।
 --
লালবাজারে পাকানো বাঁশের লাঠির বারি মেড়ে হাত পা ফুলিয়ে দিয়ে একরকম তেল লাগিয়ে দিত যাতে ওপর থেকে ফোলা কমে যেত, ভেতেরে জখম খুব কিছু কমতো না। সেটা নাকি বন্দুক পরিস্কারের তেল। বুঝলাম মিনুর ভাগ্যে তাও জোটেনি। ও কিন্তু একান্ত ভাবেই ঘরোয়া মেয়ে ছিল। কোন কালে কোন রাজনীতির সাথে কোনভাবেই যুক্ত ছিল না, ওর ভাই বোনরা হয়ত ছিল। তাদের না পেয়ে ওকে আর ওর বাবাকে ধরে এনেছে।
--
দেখলাম ওকে উল্টো করে ঝুলিয়ে শুধু বেধরক মারই মারেনি বুক পিঠে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে। দিন সাতেক মানিক তলা থানায় রেখেছিল। মাস কয়েক আগেও একবার ওর বাড়ীতে ভাইবোন দের তল্লাশ করে না পেয়ে ওকে ধরেছিল। সেবার শুধু জিজ্ঞাসা বাদের উপর দিয়ে গেছিল। এবার তাই বোদহয় তিন গুন শোধ নিয়েছে। ওকে দেখে একদিকে যেমন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, অন্যদিকে নিজে নূতন করে শক্তি সঞ্চয় করছিলাম।
--
একটুপরেই একদল বন্দীকে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তারমধ্যে একজন চশমা পরা মহিলা ছিলেন। সে আমাদের মতই রাজনৈতিক বন্দী, মাস কয়েক আগে থেকেই জেলে বন্দী আছে। মিনু আগে একবার ধরা পড়ার সূত্রে তাকে চিনত। নাম শীলা, কোন এক কলেজের অধ্যাপিকা। আলাপ পরিচয় হলো। শীলাদির বাবা বাড়ী থেকে খাবার এনেছিলেন। তার থেকে আমাদের কিছুটা দিল, মিনু আর আমি বুভুক্ষুর মত গিললাম, যেন কতকাল পরে আপনজনের মাঝে এসে পুলিশ থানায় হারানো ক্ষিদে তৃষ্ণা আমাদের ফিরে এসেছে।
--
বিকাল পাঁচটার পর কোর্ট বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের কাউকেই বিচারকের সামনে তোলা হলনা। পরে শুনেছিলাম আমাদের নামে রায়ট, খুনজখম ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন ধারায় কেস রুজু করা হয়েছে।  আমাদের পুলিশ ভ্যান এ তোলা হলো। মিনু হাঁটতে পারছিলো না।  আমি সাহায্য করতে গেলে শীলা দি বললো," তুই পারবি না, আমি দেখছি," বলে তাকে কোলে তুলে ভ্যান পর্যন্ত নিয়ে গেল, সাধারণ বন্দিনীদের সাহায্যে উপরে তুললো। আমাদের সবাইকেই গার্ড দিয়ে ভ্যানে তোলা হলো।
--
ভ্যান চলতে শুরু করল। খুপরির ভিতর থেকে বাইরে টা দেখছিলাম। রাস্তায় আলো জ্বলছে। লোকজন ব্যস্ত সমস্ত হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। মনে হচ্ছিল ওদের সবাই স্বাধীন, খোলা আকাশের নীচে মুক্ত হওয়াতে নিশ্বাস নিচ্ছে। কি মজা, নিজেদের খুশী মত যেখনে ইচ্ছা সেখানে যাবে। আর আমদের জন্য নির্দ্ধারিত এক বন্দী জীবন।
--
চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। সেদিনটা পূর্ণিমা কিনা জানা নেই, কিন্তু চাঁদ টাকে অনেক বড় আর উজ্জল দেখাচ্ছিল। তখন ই এক সাথীর গলায় শোনা গানের একটা কলি কানের কাছে বাজতে থাকল,"যে স্বপনে কমরেডস নয়ন ভরেছো, সে স্বপন মুক্তি স্বপন।" মনে মনে সেটাই আওড়াতে লাগলাম। ভ্যান আলিপুর প্রেসিডেন্সী জেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
--
নাম ধরে ধরে সবাই কে গুনে গুনে জেল গেট দিয়ে ঢোকান হলো। মিনু কে আগের মত করে সকলে সাহায্যে নামিয়ে শীলা দি কোলে করে নিয়ে এলো। জেল অফিসে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো। খাতা কলমে সবাই য়ের নাম, ধাম, কেস ইত্যাদি লেখা জোখা হলো। তারপর প্রত্যেক কে তন্ন তন্ন করে সার্চ করে, দুজন মহিলা ওয়াডার আর বড় বাঁশের পাকান লাঠিধারী একজন জমাদার, মানে ছেলে ওয়াডার গরুর পালের মত সব বন্দী কে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। মিনু কে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো।
--
বিশাল পাঁচিল তোলা জেলের মধ্যে চলতে চলতে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট পাঁচিল ঘেরা জায়গায় পোঁছে জমাদার সকলের পিলে চমকে বাঁজখাই গলায় হাঁক দিল,"জেনানা ফাটক আ গয়া।" বলেই দেয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা দড়ি ধরে টান মারলো আর ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠলো। ভিতর থেকে গেট খুলে এক জবরদস্ত জমাদারনি বেরিয়ে, গুনতি মিলিয়ে সবাইকে ওয়ার্ডের ভিতর ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে বিশাল তালা লাগিয়ে দিল।
--
মিনু কে হাসপাতালে রাখা হলো। বাকীদের আবার তল্লাশী করা হলো। শীলাদি কে অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে গেল। আমাকে আর সাধারণ বন্দীদের সাথে হাজতী নম্বরে ওয়ার্ডে দেওয়া হলো। দেখলাম বড়জোর জনা পঞ্চাশেক মানুষ  থাকার একটা ঘরে কম করে শ দেড়েক বন্দিনীকে কেস নির্বিশেষে পুরে দেওয়া হয়েছে। একধারে আধা পাঁচিল তোলা, চট ঘেরা জায়গা প্রাকৃতিক কাজের জন্য নির্ধারিত। তার কটু গন্ধে গা গুলিয়ে বমি আসে।
 --
সেই রাতে জেনানা ফটকের সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা হয়ে গেল নিভা নাম এক ন.সি.এল ( নন ক্রিমিনাল লুনাটিক ) বন্দিনী আর একজন রাজনৌতিক বন্দিনীর সাহচর্যে। নিভা বলল," জানতো এখানে মোট পাঁচ টা ওয়ার্ড। হাসপাতাল, মেয়াদী নম্বর, হাজতী নম্বর, পাগল বাড়ী, ডিভিশন বাড়ী। তাছাড়া গোটা ছয়েক সেল।আর সারা দিনের খাবারের ফিরিস্তি টাও শুনে রাখো। সকাল একপিস পাউরুটি, বা একমুঠ চিড়ে, বা মুড়ি, বা ছোলা সেদ্ধ দেওয়া হয়, দুপুরে এক ডাব্বু ভাত, হলুদ জলের মত ডাল, বুড়িয়ে যাওয়া বা শুটকো তরকারির ঝোল।  রাতে তিনটি রুটির সাথে দুপুরের মত ই  ডাল, তরকারি। খাবারের পরিমান এতই কম জোয়ান মানুষ কেন বাচ্চাদেরও খিদে মেটে না।" রাত জেগে জেল আর জেলের বিভাগের জ্ঞান সঞ্চয়ের চেষ্টা করলাম।
--
ঘরের অধ্বেক জায়গা জুড়ে এক শ্রেনীর বিশেষ সুবিধা ভোগী বন্দিনী, যারা কতৃপক্ষের দালাল, তাদের দখলে। বাকীরা কোনমতে ঘাড় গুঁজে এক কাতে বসে ঘুমাতে চেষ্টা করছে। হাজতী নম্বরের পারিপার্শিক অবস্থা জেল ব্যবস্থার নগ্ন চেহারা টা চোখের সামনে মেলে ধরল। বুঝিয়ে দিল জেনানা ফটকে রীতি মত শোষন অত্যাচারের বিরুধ্বে লড়াই করেই সাধারণ মানুষরা কোনমতে টিকে আছে ।
*********************
(চলবে)

28 Feb 2022


জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ২

***********************
বোধহয় ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো। হটাৎ বিকট এক বাজখাই গলায় চীৎকার," ফাইল, ফাইল।গুনতি, গুনতি।  ওঠ, ওঠ এই শালীরা।" তাকিয়ে দেখি মোঠা সোঠা লাঠি ধারী হেড জমাদারনি তার সাঙ্গপাঙ্গ,মানে  কিছু দালাল বন্দিনীদের সঙ্গে নিয়ে লক আপ খুলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের বন্দিনীরা সবাই তাড়াহুড়া করে লাইন করে মাটিতে উবু হয়ে বসে গেল, নিভা আমার হাত ধরে টেনে একটা জাগায় বসে পড়ল। দালালরা কজন বন্দিনী আছে ,তাদের হিসাব নিল। নতুদের আলাদা করে নাম লিখে বলল," এই তোরা সকালের খাবার পাবিনা। ৯টার সময় কেস টেবিল হবে, তারপর দুপুর থেকে থেকে খাবার পাবি", বলে সদলবলে বেড়িয়ে গেল।
--
বন্দিনীরা প্রাতঃকর্ম সারা, স্নান করা আর খাবার জল ধরার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। কারণ দেরি হয়ে গেলে হয়ত সকালের খাবারটাই মিলবে না। নিভা তার খাবার নিয়ে এসে বলল," আমার থেকেই আজকে খা।" আমি অবাক হয়ে দেখলাম এক/ দেড় মুঠি ছোলা স্বেদ্ধ। ওতে নিভার ই পেঠ ভরবে না, আমি কি করে ভাগ বসাই। নির্বিকার চিত্তে নিভা বলল, "চিন্তা করিস না, তুই না নিলেও আমার পেটের এক কোনা ও ভরবে না। বলেছিনা এখানে পেটের আগুন কখন নেভেনা। জ্বলতে, জ্বলতে শেষে আর বোধ থাকে না।" জোর করে দেওয়া ছোলা মুখে তুলতে গিয়ে দেখি পোকা শুদ্ধ ছোলা। সেটা ফেলতে গেলে নিভা আমার হাত চেপে ধরল, "আরে করিস কি, পোকা ছোলা ফেলতে গেলে সব ফেলে দিতে হবে। চোখ বুঝে খেয়ে নে। দুদিনেই অভ্যেস হয়ে যাবে।"
--
খাওয়া শেষ না হতেই নিভা আমাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলল। "চল পাগল বাড়ীর দরজা খোলা, আমি ওখানে আগে থাকতাম। এইফাঁকে দেখেনে, হয়তো আর কোনোদিন দেখার সুযোগ পাবিনা।" জেলখানায় পাগলরা থাকে আগে জানা ছিল না। পরে শুনেছিলাম অনেকেই, বিশেষত যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, তারা জেলখানায় মাথার গন্ডগোল হলে নিজেদের আত্মীয় স্বজন দের জেলে সেরে ওঠার জন্য দিয়ে যায়। যেমন নিভাকে দিয়ে গেছিল। তাছাড়া রাস্তা থেকেও পাগল দের ধরে এনে এখানে রাখা হয়। এরা সবাই নন ক্রিমিনাল লুনাটিক কেসে বন্দী।
 --
পাগল বাড়ী ঢুকে আমি পাথরের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোটা তিনেক খাঁচার মত ঘর। সেখানে অনেক অনেক, একেবারে উলঙ্গ কঙ্কাল, মাথায় চুল জট পাকিয়ে গেছে। গা হাত পা নোংরায় কালো। এখানে সেখানে দগদগে ঘা।  অনেককেই হ্যান্ড কাফ দিয়ে, বা শেকল দিয়ে গরাদের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। যে যেখানে পেরেছে প্রকৃতির ডাকে কাজ সেরেছে। তারই পাশ থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। অনেকে আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি, চুল টানাটানি, এমন কামড়া কামড়ি করে পরস্পরকে ক্ষত বিক্ষত করছে, রক্ত ঝরছে। কেউ গলা ফাটিয়ে কাঁদছে কেউ গালি গালাজ করছে।কাউকে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছেনা। সাধারণ মানুষ ওখানে কদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবে।
--
নিভা আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসার পর সম্বিত ফিরে পেলাম। একটা জায়গায় আমাকে বসিয়ে জল খাওয়াল। একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা এ রকম কঙ্কালের মত কেন !" "কেন আবার ঠিক মত খাবার দেয় না। জানিস ডাক্তার বাবুরা ওদের জন্য কত বেশী বেশী ডায়েট লিখে দেয়, দুধ ,ফল বিস্কুট,পাউরুটি, মাছ সব। কিন্তু কিছুই ওরা পায় না। দালাল গুলি সব মারে। আমাদের সকলের খাবার থেকেও ওরা মারে। তাইতো এতো কম খাবার পাই আমরা।" "কিন্তু মেট্রন,ওয়ার্ডার রা কিছু বলে না !" "পাগল ওদের নির্দেশেই তো এসব চলে। ওরাই তো মোটা ভাগ পায়। দালাল রাও পেটমোটা হচ্ছে খেয়ে খেয়ে। আবার নিজেদের পছন্দের জিনিস আনাছে ওয়ার্ডারদের দিয়ে। সপ্তাহে একদিন মাছ আর একদিন মাংস দেবার দিন। সেদিন দেখবি মগ ডুবিয়ে মাংস খেয়ে ঢকঢক করে হজমের ওষুধ খাচ্ছে।"
--
ইতিমিধ্যে 'কেস টেবিল, কেস টেবিল' করে বিকট চিৎকার শোনা গেল। নিভা আমাকে নিয়ে গিয়ে কেস টেবিলের যাবার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমাদের নতুন বন্দিনীদের দুইজন মেয়ে ওয়ার্ডডার আর একজন লাঠিধারী ছেলে ওয়ার্ডারের সাথে জেনানা ফাটক থেকে বেরিয়ে ছেলেদের ওয়ার্ডের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো।সেখানে একটা টেবিলে একজন ডেপুটি জেলার, হেডজমাদার বসে একটা বিরাট জাবদা খাতায় নাম,ধাম ঠিকানা,  কেস ইত্যাদি লিখে নিচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ওয়ার্ডে ফিরলাম। আমাকে ডিভিশন ওয়ার্ডে রাখা হল। প্ররথমেই এই এই ওয়ার্ডডের  নামকরণের বিষয়ে একটা কথা পরিিিষ্কার করা দরকার। ইংরাজ রাজত্বে এখানে রাজবন্দিনীদের রাখা হত। তাঁরা ছিলেন মধ্য উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ এবং বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত। কালক্রমে এখানে শুধু রাজনৈতিক বন্দিনীদের রাখা হত। আমাদের সময় শুধু নকশাল বন্দিনীদের রাখা হত, বিশেষ সুযোগসুবিধা বর্জন করলেও। প্রথম ছিল ক্লাস ডিভিশন , পরবর্তি কালে রাজনৈতিক মতাদর্শের ডিভিশন, যাতে আমজনতার মধ্যে সেই মতাদর্শ ছড়িয়ে না পরে।     
---
আমি  যেদিন ডিভিশন ওয়ার্ডে যাই তখন সেখানে  আর দোতলার সেলে শুধু নকশাল বন্দিনীদের বন্দীদের আলাদা করে রাখা হয় যাতে তারা সাধারণ বন্দীদের সাথে মিশতে না পারে। শীলাদি ছাড়াও মুক্তি, বিজু আরও পাঁচজনের সাথে পরিচয় হল। ওপরে সেলে কল্পনা, ডালিয়া আর জয়া থাকতো। বিজু ছিল সবার ছোট, মুক্তি, ডালিয়া আমার সমবয়সী, কল্পনা আর জয়া (মিত্র) ছিল শীলাদির বয়সী। ১টা র সময় হেড ওয়ার্ডার তথা জমাদারনী এসে লক আপ করে দিল। 
--
ভাত খাবার পর বিজু পড়ল আমাকে নিয়ে। শুনলাম প্রতি সপ্তাহে এক মুটকি কেরোসিন তেলের গন্ধ ভরা মাথার তেল, এক মুটকি সরষের তেল আর একটুকরা কাপড় কাচার সাবান বন্দিনীদের প্রাপ্য। সেই কেরোসিন তেল ওরফে মাথার তেল বিজু আমার মাথায় জবজবে করে মাখিয়ে, কোষে বেঁধে বেশ কিছুক্ষণ ৱেখে দিল। তারপর একটা সরু চিরুনি দিয়ে জোরে জোরে আঁচড়াতে লাগলো। আর কেরোসিনের গন্ধে ঝরঝর করে উকুন পড়তে লাগল, মুক্তি সেগুলিকে মারতে থাকল। বিকালে ৪টের লকআপ খুললে বিজু কাপড় কাচার সাবান মাথায় গায়ে ঘষে স্নান করিয়ে দিল।প্রায় দিন ২/৩ দিন এই পর্ব চলল, পুলিশ থানার কম্বলে সঞ্চিত উকুন তাড়াবার জন্য। বিকাল ৫/৬ টার সময় আবার লক আপ হলে মুক্তি আর বিজু মিলে পুলিশ লক আপে মার খেয়ে আঘাতের জায়গায় সরষের তেল মালিশ করতে থাকে।যারাই নতুন আসে এইভাবে শুশ্রুষা করে সারিয়ে তোলাটা এখানকার রেওয়াজ। সাথীদের সাহচর্য্যে আর সেবায় শরীর মন দু ই শান্তি আর স্থিরতা লাভ করে। সন্ধ্যে বেলায় খাবার খেয়ে গল্প করা বা বই পড়া হত, প্রায়ই গানও  হত। মুক্তির গলায় অসাধারণ কাজ ছিল। বিজুর মিস্টি গলা ছিল। সবার শেষে  ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া হত। এইভাবে শুরু হল আমার জেল জীবন।
**********************
(চলবে )
















No comments:

Post a Comment