15 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 6

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৬
************************
এতেও জেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হতে পারল না। কল্পনা কে হাজারীবাগ জেলে বদলী করল। রাজশ্রীকে লালবাজারে এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু কাউকেই ভাঙতে পারেনি। মীনাক্ষীকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে একদিন মিতা এলো মেদিনীপুর থেকে, অনেক অত্যাচারের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তারপর দেবযানী আর কমলা এল। দেবযানী পার্টি ছেড়ে দিয়েছিল আর কমলা ছিল খুবই সাধারণ, ঘরেলু মেয়ে।  আমাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা ছিল। তাদের ও সরকার বাহাদুর ভয় পেল।
--
কদিন বাদে রাজশ্রী ফিরে এলো। ওকে একা সেলে রাখাতে আমরা আপত্তি জানাতে দেবযানী আর কমলাকে সেলে পাঠিয়ে দিল। কিছুদিনে বাদে কল্পনা সেলে ফিরে আসে আর দেবযানী, কমলা ছাড়া পেয়ে যায়। ১৯৭৪ এর মাঝে মলয়া ধরা পরে। ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার চলে, দীর্ঘ একমাস পুলিশ হাসপাতালে রাখার পর ওকে জেলে পাঠায়। টেবিলের ওপর ফেলে পেছনে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। আমাদের কাছে আসার পর ওর হিপে লাঠির বাড়ির দাগ আর অজস্র খোঁদল। মলয়া স্কুল টিচার ছিল। এরপর  কৃষ্ণা ওরফে জয়া, শিখা,পার্বতী, জয়শ্রী একে একে ধরা পড়ে। যথারীতি পুলিশের অত্যাচারের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। কৃষ্ণার টেক নাম ছিল জয়া। কিন্তু ওকে আমরা সারা জীবন জয়া বলেই ডাকতাম। আর জয়শ্রী কে বৌমা বলতাম। বৌমা ও স্কুল টিচার ছিল।
--
এরপর লতিকা ওরফে সাথী, অর্চনা দি আর গৌরী ধরা পড়ল। ওদের তিনজনের ওপর, বিশেষ করে অর্চনা দির ওপরে প্রচন্ড অত্যাচার হয়েছিল। সাথী গোখেল কলেজের অধ্যাপিকা, অর্চনা দি একজন স্কুল টিচার আর গৌরী সেলাইয়ের কাজ করত। অর্চনাদি আর গৌরী সাথীর ননদ ছিল। একমাত্র অর্চনাদি আর মাসিমা ছাড়া আমরা সবাইকে নাম ধরে ডাকতাম। রাজশ্রী, মীনাক্ষী আমি সবে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে পা রেখেছিলাম।গৌরী আর খুকু আমাদের বয়সী ছিল। জয়া সভবত বি.এ পাশ ছিল। খুব সম্ভব কল্পনা, বৌমা, মলয়া, সাথী সম বয়সী ছিল। বিজু, মিতা,শিখা আর পার্বতী স্কুলের গন্ডি তখন ও পার হয়নি।
--
বিভিন্ন বয়সের হওয়া স্বত্তেও আমাদের সকলের সবার সাথে খোলাখুলি মিশতে কোন বাঁধা কখন হয়নি। সকলে কত যে গুণের অধিকারী ছিল। বিজুর  এম্ব্রডায়েরী দেখার মত ছিল,উল বোনা, কুরুশের কাজেও পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী অসাধারণ ছবি আকঁতো, সেলাইও নিপুন ছিল। মীনাক্ষীও ছবি আঁকা, সেলায়ে, আব্বৃত্তি তে পারদর্শী ছিল। রাজশ্রী আসার পর কল্পনার আঁকা ভীষণ সুন্দর হয়ে গেল। রাজশ্রী ছবি আঁকতে বসলেই ও খুব খেয়াল করে দেখত,আর নিজের ভেতরের অসীম প্রতিভায় খুব তাড়াতাড়ি পারদর্শী হয়ে গেল। মিতা কোন ছবি দেখলে এমন  নিপুন ভাবে সেটা আঁকতো,যে কোনটা আসল বোঝা যেতোনা। মাসিমা আর মলয়া ২/৩ দিনে একটা সোয়েটার শেষ করে ফেলত। গৌরী,শিখা,বুলু ও সূচীকর্মে পারদর্শী ছিল।খুকুর হাতের রান্না ছিল অসাধারন।  জয়া, বৌমা, মিনু, মলয়া আর সাথীরা  অসাধারণ গান করত। সাথীর তো ক্লাসিকাল চর্চা করা গলা ছিল। বৌমা পুরানো দিনের আই .পি.টি.আই এর কত যে  গান জানত, তা সবাইকে শেখাতো। তাছাড়া লেখালিখি তে অল্পবিস্তর সবাই পারদর্শী ছিল।বৌমা সর্বপ্রথম জেলের ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করে।
--
জয়া টা (কৃষ্ণা) খুব রসিক ছিল। যে কোন গুরু গম্ভীর পরিবেশে গম্ভীরভাবে এমন একটা রসিকতা করত যে সবাই হেসেই আকুল। তারপর সহজ পরিবেশে সমস্যাটা সমাধান করা খুব সুন্দর ভাবে হয়ে যেত। বৌমা, আমাদের জয়া আর শিখা ধরা পরার কিছুদিন পর একসাথে পুলিশ কাস্টডি তে ছিল। কি করে কাগজ পেন্সিল যোগাড় করে একজন পুলিশ অফিসার কে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছিল," ...নবীশের ভুড়ি / করি হাড়িকিড়ি। ...."ইত্যাদি। সেটা আবার সেই পুলিশ অফিসারের হাতে পড়েছিল। ফলে তার জন্য আর একদফা ঝামেলা পোহাতে হয়।
--
সকলের এত গুণাবলীর কথা বললাম এই কারনে যে, এরা এত সব গুনের অধিকারী ছিল ইচ্ছা করলেই প্রচলিত জীবনে থেকে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারতো। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে একটা নতুন সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়। ইতিমধ্যে একদিন শিখা আর পার্বতী কোর্ট থেকে পালতে গিয়ে, ধরা পরে মারধর খেয়ে চোখ মুখ ফুলিয়ে ওয়ার্ডে ফিরল।
--
এইসময় ডিভিশন ওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩০ এ গিয়ে দাঁড়াল,এদের মধ্যে আন্নার নাম টা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। ওরা খুব গরীব ছিল, লোকের বাড়ী কাজ করে সংসার চালাত। আমরা থালা কম থাকায় দুজনে মিলে এক থালায় খেতাম। সবাই একই জমা কাপড় পড়তাম। কারোর নিজস্ব বলে কিছু থাকতনা। ইন্টারভিউয়ে যার বাড়ী থেকে যা আসতো সাধারণ কমিউনে জমা পড়ত। দুজন করে এক সপ্তাহের কমিউন ইনচার্জ হত। তাদের হাতে খাবার দেবার দায়িত্ব থাকত। সেই সপ্তাহে ঘরের টয়লেট পরিস্কার করা, ঘর মোছা, ভাটির দিন  কাপড় কাচা সেসব কাজ থেকে তাদের ছুটি দেওয়া হতো। একবার আমি আর আন্না একসাথে কমিউন ইনচার্জ ছিলাম। এক থালায় খেতে খেতে ও আমাকে বলল দেখ আমরা এই রাজনীতি করি বলেই না এক সাথে খাই , সব কাজ একসাথে করি। কেউ কাউকে ঘেন্না করি না। আমাদের নতুন সমাজ টা তো এ রকম ই হবে।"আমি থ হয়ে ভাবলাম কত বড় সত্যি টা ও সহজ আর সুন্দর ভাবে বলল। এর কিছুদিন পর আন্না, মিনু, দেবযানী কমলা আরো অনেকে চলে গেল। তবে কল্পনা সেলে ফিরে এল। মোটের উপর আমরা ১৫/১৬ জনে এসে দাঁড়ালম।
---
এ কদিন মিতা, হাওয়া বিবি ,শান্তি মাসী, হাসিনা,শোভা, মর্জিনা ইত্যাদি প্রায় জনা তিরিশ বন্দিনী খাবার কম, ওষুধের অভাব, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা খাবার ধরল না, লক আপ ঢুকল না। তাঁদের সমর্থনে আমরাও খাবার বয়কট আর লক আপ রেজিস্ট করলাম। যৌথ প্রতিবাদের সামনে মেট্রন, আর এক কুখ্যাত বিজয়া ওয়ার্ডার আর দালাল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে কোর্ট থেকে আমাদের কজন কমরেড ফিরল। বন্দিনীদের কাছে আমাদের যৌথ প্রতিবাদের কথা শুনে তাঁদের সাথে বাইরেই  দাঁড়িয়ে থাকল কারন ডিভিশন ওয়ার্ডের গেট খুললে আমরাও বার হয়ে গেলে আর সামাল দেওয়া যাবেনা। অনেক তর্কবিতকের পর দালালরা হাত জোড় করে মাপ চায়, মেট্রন ওয়ার্ডার রা কথা দেয় তারা অন্যায়ের প্রতিকার করবে , খাবার মাপ মত দেবে ইত্যাদি। তারপর সবাই খাবার ধরে আর লক আপ হয়।     
---
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরের বন্দিনীরা খালাশ পেয়ে গেল, সরকারী পর্যায়ে বন্দী বিনিময় সূত্রে। মুন্নি,হামেদা, আসমা। জড়িনা মাসী, নানী ইত্যাদি যাবার সময়ে আমাদের জন্য অনেক দোয়া করলেন, শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। এবারে মেয়াদী ঘরে নানা কেসের বন্দিনীরা এলো। আরো নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হল। এক আশ্চর্য্য ঘটনা দেখলাম। রেড লাইট এলাকার দেহ ব্যবসায়ীনী দের সাথে সেখানকার  মালকিন বা মাসিদের তুলে আনা হত মাঝে মাঝে, আবার ১/২ দিন বাদে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হত জানতাম। এবার দেখলাম সেই মাসিরা অনেক বন্দিনী মেয়েদের নানা রকম প্রলোভন দেখাচ্ছে। কাউকে বোঝাত তার বাড়ী পৌঁছে দেবে, কাউকে চাকরি পাইয়ে দেবে  ইত্যাদি। বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারা সহজেই সে প্রলোভনে পা দিত। কিছু পাজী ওয়ার্ডার আর জেলের অসৎ কর্মচারীদের সাথে তাদের ভাল যোগাযোগ থাকত। মেয়েগুলিকে বলে যেত,"আমি তোদের একে একে কোর্টে তোলার ব্যবস্থা করব,  তোদের  মা / বাবা / পিসি /কাকা ইত্যাদি বলে যাকেই পাঠাবো, জজসাহেব জিজ্ঞাসা করলে মেনে নিবি। সেই লোক তোদের ছাড়িয়ে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আমি তখন তোদের ঠিক ঠাক ব্যবস্থা করে দেব। এখানে কাউকে কিছু বলবি না।" এইভাবে একটার পর একটা মেয়ে উধাও হয়ে যেত।
--
হাসিনা বলে আমাদের খুব প্রিয় একটি মেয়ে ছিল। আমাকে মা বলে ডাকত। সুন্দরবনের এক চাষী পরিবারের আদরের মেয়ে ছিল, অল্প বয়সে বিয়ে হয়। বর বাড়ী এলে কোলে উঠে পুতুল কিনে দেবার বায়না ধরত। অবশেষে বর আর একটি বিয়ে করে। হাসিনাকে গ্রামের মোড়লের লালসার গ্রাস থেকে বাঁচাবার জন্য, ওর বাবা কলকাতায় কাজে পাঠায়। একবার বাড়ী তে দেখা করতে যাবার সময় পথ হারায়। ট্রাফিক পুলিশের কাছে শেয়ালদা স্টেশনের খোঁজ নিতে গিয়ে থানায় জমা হয়, সেখান থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে। একদিন এসে খুশীতে ঝলমল করা মুখে বলল," জানিস মা, আমার শ্বশুর ঘরের গ্রামের এক মাসি এখান এসেছিল। প্রথমে ইন্টারভিউ করবে, তারপর মেসো কে পাঠিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।" দুদিন পর ইন্টারভিউ এলে হাসিনা খুশী মুখে গেল। কিন্তু ফিরে চিন্তিত মুখে বলল," জানিস মা, মাসি,মেসোর সাথে আর একটা লোক এসেছিল। আমি মাসিকে আমার বরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই, রেগে গিয়ে মাসিকে বলল,'এ যে বিবাহিত তাতো বলনি।' মাসি তাকে বলল,' বেরিয়ে সব কথা শুনলে বুঝবে।" আমরা ব্যাপারটা বুঝলাম, হাসিনাও বুঝল। আমরা বলে দিলাম, "জজের কাছে তুললে, তুই চিনিস না বলে দিবি।" পরদিন হাসিনার কোর্ট পড়ল, কিন্তু আর জেলে ফিরল না। ওর সাথে যারা গেছিল, তাদের মুখে শুনলাম যে ওকে জজের কাছে তোলেইনি, লক আপ থেকে ছেড়ে দিয়েছে। কি সাংঘাতিক চক্র যে এর পেছনে কাজ করছে ভেবে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অথচ সত্যিকার বাবা মা রা যখন অতি কষ্টে খোঁজ পেয়ে বাচ্চাদের ছাড়াতে আসেন তাঁদের নাস্তানাবুধ হয়ে যেতে হয়। মাসের পর মাস চক্কর কাটার পর হারানো বাচ্চা নিয়ে ঘরে ফেরে।      
************************************************************************************
(চলবে)










              








No comments:

Post a Comment