13 Sept 2016

জাননা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 4

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৪
***********************

আমরা ফিমেল ওয়ার্ড বা জেনানা ফাটক কে বলতাম জেলের ভেতর জেল। তার ভিতর ছিল সেল আর ডিভিশন ওয়ার্ড। দুনিয়া থেকে কেন প্রেসিডেন্সি জেলের ভেতরে যে ছোট্ট জেল তার থেকেও আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রচেষ্টা বহাল ছিল। সাধারণ বন্দিনীদের উপর অত্যাচার ক্রমাগত বেড়ে চলল, বিশেষ করে আমাদের সাথে যারা কথা বলার চেষ্টা করত। এমন কি ছোট হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের ও কোন মাফ ছিল না, বেধড়ক অত্যাচার চলত।
--
আমরা সকলেই সাধারণ বন্দিনীদের সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে নানা ভাবে যোগাযোগ রাখতাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর তার জন্য নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধার কথা বলতাম। আমাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য, নানা দেশের গরীব মানুষের লড়াইয়ের কথা বলতাম। কোন বন্দিনীর সাথে কোন কমরেডের হয়ত বেশী সখ্যতা গড়ে উঠত। সবাই সন্ধ্যে বেলায় লক আপ হলে সবার সাথে কথাগুলি বা কোন সমস্যা থাকলে তাই নিয়ে আলোচনা হত। তাই সকল বন্দিনীদের কথাই সবার গোচরে থাকত।
--
ইতিমধ্যে মেয়াদী নম্বরে বাংলাদেশ যুদ্ধে ধৃত কিছু মহিলাদের সাথে তাঁদের কিশোরী মেয়েদের আর বাচ্চা কাচ্চাদের রাখা হল। শুনলাম তাঁদের স্বামীদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে সম্ভবত আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়েছিল।যাইহোক জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একমাত্র শিখার মত গুটি কয়েক নৃশঃস বন্দিনী ছাড়া বাকী সবাই মোটামুটি একজোট ছিল। মেয়াদী নম্বরের মাসিদের সাথে আমাদের ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের কিশোরী মেয়েরা তো আমাদের সমর্থক হয়ে যায়। অনেক ব্যাপারে আমাদের গোপনে সাহায্য ও করত।
--
তার কিছুদিন পরে বেশ কিছু বার্মিজ মাসিদের একইরকম ভাবে কিশোরী মেয়ে আর ছোট ছোট বাচ্চাদের জেলে নিয়ে আসা হল।ধর্মের গোড়ামি মানুষ কে কতটা যে অমানুষ করে দেয় তাই নতুন করে দেখলাম। বর্মা মূলত বৌদ্ধধর্ম প্রধান দেশ। সেখানকার সংখ্যা-লঘু মুসলমান আদি অধিবাসীদের ওপর নানা অত্যাচার চলত। সেই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেই সুদূর বর্মা থেকে এইটুকু আশ্রয়ের জন্য তাঁরা তাড়া খেতে খেতে ভাৰতে আসে। এসব দেখে তখন খুব অবাক হতাম। আজ আর হই না আজ এই গ্রহের মানুষ হয়েও কত কোটি মানুষের নিজের দেশ, আস্তানা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতি দিন। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে, ছোট্ট ফুলের মত শিশুদেরও ছাড় নেই। বাঁচার তাগিদে, একটুকু আশ্রয়ের জন্য এই পৃথিবীর মানুষ এক প্রান্ত থেকে অন্য্ ছুটে বেড়াচ্ছে। যেন পৃথিবীর কোন একটা কোণেও তাঁদের থাকার অধিকার নেই। ভারতে এসে বর্মী মাসীদের আশ্রয় হল জেলে। সীমান্ত থেকে বন্ধ ভ্যানে বদ্ধ দম আটকানো ঘুঁটে বোঝাইএর মত করে নিয়ে আসা হল প্রেসিডেন্সী জেলে।  
--
তাঁদের স্থান হল জাল ঘরে, যার  চার পাশটা  মোটা রড আর  জাল দিয়ে ঘেরা, মাথায় একটা চাল দেওয়া। গরমের  দুপুরে ঝলসানো গরম বাতাসে ছোট বাচ্চা গুলি পেটের অসুখে ভুগতে ভুগতে ডিহাইড্রেশন এ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলো। ওষুধ পথ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই। শীত কালে হুহু করা হিম শীতল বাতাসে  ঠান্ডা লেগে নিমোনিয়া ইত্যাদি তে কত যে মারা গেল কেউ জানেনা। বার্মিজ মাসীরা বাকী ওয়ার্ড থেকেএকটু বিচ্ছিন্ন থাকতেন।
--
বাকী বন্দিনীদের সাথে আমাদের লুকিয়ে চুরিয়ে মোটামুটি একটা যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বার্মিজ মাসীরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন বলে আমাদের সাথেও সে রকম ঘনিষ্ঠ কোন যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারেনি। ইন্টারভিউ বা কোর্টে যাতায়াতের পথে তাঁদের দূর থেকে চোখের দেখাটুকুই একমাত্র যোগাযোগ ছিল , কথা আদানপ্রদানের সুযোগ হত না। অন্যান্য বন্দিনীদের মাধ্যমে কিছু কিছু খবরাখবর পেতাম মাত্র, তাঁদের বিপদে পাশে দাঁড়াবার ও সুযোগ হত না। এদিকে ওয়েলফেয়ার অফিসারকে ঠুঁটো জগন্নাথের মত করে রাখা হল। তাই চূড়ান্ত কষ্টে তাঁরা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন।
--
এখানে একটা কথা বলা দরকার। জেলের ডাক্তারবাবুরা একেবারে অমানবিক ছিলেননা। ডাক্তার দাস মূলতঃ মেয়েদের ওয়ার্ডের ডাক্তার ছিলেন। প্রতিদিন তিনি আসতেন। তাছাড়া ডাক্তার গুপ্ত, ডাক্তার চ্যাটার্জী আর সি.এম. ও (চীফ মেডিক্যাল অফিসার ) সপ্তাহে ২/৩ বার আসতেন ।  চাকরির স্বার্থে অনেক সময় তাঁরা আপোষের মনোভাব নিয়ে চলতেন একথা ঠিক। কিন্তু মেট্রন আর দালাদের এড়িয়ে  তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তাঁরা সাধ্য মত করার চেষ্টা করতেন।
--
আমারদের ওয়ার্ডে তাঁরা ভিসিটে এলে আমার তাঁদের ওয়ার্ডের বিভিন্ন বন্দিনীদের অবস্থার কথা তুলে ধরতাম। কখন কখন হাসপাতালের জালানা দিয়ে তাঁদের কাছে অভিযোগ গুলি জানতাম। মেট্রন কিছু বিরোধীতা করতে সাহস করত না। সেই সুযোগের সাধারণ বন্দিনীদের জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব হত। যদিও সব টুকু সুবিধা তাঁদের হাতে ঠিক মত পৌঁছাতে না। খবর পেলে আমরা আবার ডাক্তার বাবুদের কাছে নালিশ জানতাম। তখন আবার কিছুদিন ঠিকমত চলত। এইভাবে সাধারণ মরণাপন্ন কিছু বন্দিনীদের, বিশেষ করে বার্মিজ মাসিদের সামান্য কিছু সহায়তা হত।
--
রোজকার বন্দিনীদের খাবার চুরি করা ছাড়াও, কচিৎ কারোর বাড়ী থেকে ইন্টারভিউ তে বাড়ীর লোক যা নিয়ে আসতো সব কিছু হাসপাতালে বসে মেট্রন, ওয়ার্ডারদের সামনে আত্মোৎস্যাত আর ভাগাভাগি হয়ে যেত। খিদের জ্বালায় বন্দীরা একদিন প্রতিবাদ করতে শুরু করল। আমাদের কিছু সাথীরা কোর্ট থেকে তখন ফিরছিল, তারাও ওদের সাথে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। মেট্রন বেগতিক দেখে যারা খাবার বাটে তাদের ছদ্ম শাসন করল। ফলে সেদিনে খাবারের পরিমান কিছুটা বেশী হল।
--
আর একদিন  আমরা কজন বাড়ীর লোকেদের সাথে ইন্টারভিউ থেকে ফেরার পথে দেখি একজনকে  মারার প্রতিবাদে  বাংলাদেশের মীরা, শান্তিবাই,  বাসন্তী মাসি, সমেদা এরকম প্রায় ২০ জন প্রচন্ড চেঁচামিচি আর কান্না কাটি করছে। শুনলাম রেখা আর বেলাকে শিখার বাহিনী বিনা কারণে মেরেছে। আমরাও তাদের  লড়াইয়ে সাথে সামিল হলাম। মেট্রন যথারীতি সেই দালালদের দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করাল। কিন্তু এইভাবে ক্রমাগত প্রতিবাদের দানা বেঁধে ওঠাটা কে মেট্রনরা আর তাদের দালাল রা স্বাভাবিক ভাবেই ভাল চোখে দেখল  না। আমরা শান্তিবাইদের  বোঝাতে লাগলাম সব সময় দল বেঁধে থাকতে আর চলাফেরা করতে। কারণ আমাদের কাঠের দরজা তো বেশীর ভাগ বন্ধ করে রাখা হয়।  
--
দালাল শিখা ছিল এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌ, দুটি সন্তানের মা। রোজ বরের অফিসে টিফিন নিয়ে যাবার ছুতায় মালিকের ছেলের সাথে প্রেম করে সব ফেলে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাড়ী ভাড়া নিত, পড়শীদের সাথে ভাব জমাত। তারপর তাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানা দামী জিনিসপত্র, টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি নিয়ে চম্পট দিত। এ হেন মানুষের চরিত্র শঠতা, নিষ্ঠুরতা আর লোভে ভরা থাকাটাই স্বাভাবিক।
--
ফিমেল ওযার্ডে পাগলরাও  ওর অত্যাচারের হাত থেকে বাদ যেত না। শুধু জেল কতৃপক্ষকে তুষ্ট করতেই নয়, অত্যাচার করাতে ও আনন্দ পেতো। কত অভাগা মেয়ের গোপনাঙ্গে হিংস্র ওয়ার্ডারদের সাথে মিলে লাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। অবশ্য এধরনের অসংখ্য শিখাদের জেল কর্তৃপক্ষ খুঁজে নিত নিজেদের অত্যাচার কায়েম রাখতে। রাতের অন্ধকারে কত মানুষ কে পিটিয়ে বা, পুড়িয়ে মেরেছে তার হিসাব নেই। দিনের আলোতে মানুষগুলি কে খুঁজে পাওয়া যেতনা।
--
মস্তান বলে একজন বন্দিনী খুব সম্ভব পাঞ্জাবের কোন সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চল থেকে এসেছিল কলকাতায় রুজি রোজগারের জন্য। ফুটপাতে আস্তানা গেড়েছিল। একদিন পুলিশ তুলে নিয়ে কি একটা পেটি কেসে জেলে ভরে দেয়। মেট্রন, ওয়ার্ডার বা দালাল কাউকে ভয় করত না।একদিন জেলার, সুপার পরিদর্শনের সময় মেট্রন কে ডিঙিয়ে জানতে চায় কবে তার কোর্টের দিন পড়বে।পরে সেই অপরাধে  মেট্রনের অঙ্গুলি লেহনে শিখারা চুড়ান্ত অত্যাচার করে উলঙ্গ অবস্থায় পাগল বাড়ীতে শেকল বেঁধে রেখে দেয়। তাকে আমরা আর দেখতে পাইনি।
--
এমনকি তাদের এক দালাল সঙ্গিনী আসগড়ি বাই এর স্বামীর নতুন করে বিয়ে হওয়ার আর তার সাজা হওয়ার খবর আসার পর পাগলের মত হয়ে যায়। শিখা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তাকে মারধর করে নীচের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘুপচি সেলে পুরে দেয়। মনের দুঃখে আর ঠান্ডায় সে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেই শিখা তার বাহিনী নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করত, গোপনাঙ্গে লাঠি ঢুকিয়ে দিত। একদিন কোনমতে সেল থেকে বেড়িয়ে রোদ পোহাতে গেছিল শেষ তাকে মেরে লোপাট করে দিল। কাজ ফুরালে ছেঁড়া চটির মত তাকে ফেলে দিতে তাদের বাঁধত না।
--
ওপরে সেলের একটা ঘরে ওয়েলফেয়ার অফিসার বসতেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ ভাল ছিলেন। যতটা পারতেন বন্দীদের ভাল করার চেষ্টা করতেন, আমাদের প্রতি একটা স্নেহ ছিল। কোন বিশেষ সুবিধা নিতেন না। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। ফলে মেট্রন আর তার দল বল ওনাকে সহ্য করতে পারত না, নানা ভাবে তাঁর কাজে বাঁধা দিত। তিনি ওদের কোন পরোয়া না করে, একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তাঁর কাজে সাহায্য করার জন্য যে বন্দিনীদের দেওয়া হয়েছিল তাদের ওপর মেট্রন বাহিনীর রাগ ছিল।
--
একদিন দালালরা শান্তিবাই আর বাংলা দেশের মীরাকে অমানুষিক ভাবে মারল, যেহেতু এরা আমাদের ভালবাসত, আর ওয়েলফেয়ার অফিসারের কাছে কাজ করত। প্যাসেজের থেকে হাসপাতালের ভিতর কিছুটা দেখা যেত, আমরা অসহায় ভাবে ওদের ক্রন্দনরত বীভৎস ভাবে ফুলে ওঠা বিকৃত মুখগুলি আর ক্ষত বিক্ষত হাত পা গুলি দেখে নিষ্ফল রাগে ফুঁসতে লাগলাম। 
--
ইতিমধ্যে সম্ভবত ১৯৭৩ সালের শেষ ভাগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভেঙে পালানোর একটা প্রচেষ্টা হয়।  অনেক ছেলেদের সাথে রাজশ্রী আর মীনাক্ষী ধরা পড়ে। তার পরই খুকুও ধরা পড়ে। রাজশ্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটি কমরেড সঞ্জয় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। রাজশ্রীকে সেন্ট্রাল  জেল গেটেই  প্রচন্ড মারধর করা হয়। লাঠির ঘায়ে মাথা ফেটে যায়, পায়ে গুলির স্প্লিন্টার লাগে। মীনাক্ষ আর খুকু কে লালবাজারে অত্যাচারের স্বীকার হয়। বেশ কিছুদিন জেরার পর ওদের  জেলে পাঠান হয়। খুকুকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয় আর মীনাক্ষী, রাজশ্রী কে সেলে কল্পনার সাথে রাখা হয়। সাথীদের সেবা শুশ্রুষায়  ওরা ভাল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ৩/৪ দিনের জন্য জয়াকে পুরুলিয়া থেকে আনা হয়, সেখান থেকে ওকে মুক্তি দেওয়া হয়।
--
তখন ফিমেল ওয়ার্ডে মেট্রন, খারাপ ওয়ার্ডার আর শিখা তার দালাল বাহিনীর অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, একটা প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল খুব।  আমরা ঠিক করলাম এর একটা শিক্ষা না দিতে পারলে ওরা অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে থাকবে। কিছু ন্যাকড়া আমাদের উকুন মারা কেরোসিন কাম মাথার তেলে ভিজিয়ে হাতপাখার হাতল গুলি ভেঙে মশালের মত বানালাম, আগুন দেখলে ভয় তো পাবে। আর আমাদের খাবার জন্য জেল থেকে যে এলুমুনিয়ামের থালা দিয়েছে তাই হল অস্ত্র। ঠিক হল চায়ের জন্য যখন সেলের আর ভাটিঘরের দরজা খুলবে আমরা সবাই ঠেলে দুপাশ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে যাবো। সবাই চুল গুলি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে খোঁপা করে নিলাম।
---
পরিকল্পনা মতো তাই হল ওয়ার্ডার  চীৎকার করে উঠোল,"আরে কোথায় যাচ্ছ সবাই মিলে।" ভাটির আগুন থেকে মশাল জ্বালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ হল না। আনাড়ী হাতের মশাল কি জ্বলে। তাই মশালের আশা ত্যাগ করে থালা হাতেই দৌড়ালাম। হাসপাতালের গেটে মেট্রন, "কি হল কি হল" করে বেরিয়ে আসতেই ডালিয়া একথালার বাড়ী বসিয়ে দিল। মেট্রনের কপালের কাছে কেটে যেতেই ভয়ের চোটে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে গেল। সবচেয়ে দজ্জাল হেড জমাদারনী একটা মোঠা বাঁশের লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতেই ডালিয়া হাত থেকে লাঠি টা কেড়ে নিলো। ওদিকে শিখা বীর দর্পে এগিয়ে এলো আর একটা পাকান বাঁশের লাঠি নিয়ে। খুকু খপ করে সেটা ছিনিয়ে নিল।
--
তখন দেখার মতো অবস্থা। ওয়ার্ডার আর বাকী দালাল অর্ধেক হাওয়া ,আর অর্ধেক হা করে দেখছে শিখা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। খুকু আর ডালিয়া দুপাশ থেকে ছন্দ বজায় রেখে কাপড় কাঁচার মত পেটাচ্ছে। আমি আর বিজু চশমা খুলে গেছিলাম। আমার হাই পাওয়া বলে কিছু ভাল বুঝতে পারছিনা। কে আমাদের মেয়ে, কে সাধারণ বন্দিনী আর কে দালাল কিছুই বুঝতে পারছিনা। সেই সুযোগে শিখার মত নৃশংস একটা দালাল আমার পিছন থেকে বিশাল ধাক্কা মারল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। তখন মিনু এসে থালা দিয়ে তাকে একবাড়ি মেরে আমাকে ধরে তুলল।
--
এদিকে পাগলী বেজে গেছে, অর্থাৎ জেলের গন্ডগোলের সতর্ক বার্তা পৌঁছে গেছে।  ওয়ার্ডারের বাঁশির আওয়াজ,   ফোর্সের বুটের শব্ধ শোনা যাচ্ছে। আমরা সবাই পরিকল্পনা মাফিক সেলের দিকে দৌড়ে উঠে গেলাম। সেলের বারান্দার জাফরী দিয়ে আমরা ওদের কান্ড কলাপ দেখতে থাকি। জেলারের নেতৃত্বে বিশাল ফোর্স আস্তে আস্তে যেই সেলের দিকে এগোতে যায় ,আমরা চেঁচাতে, "থাকি মার মার বোম মার। গুলি চালা। " অমনি ফোর্স পিছিয়ে যায়। আবার এগোতে গেলে আবার আমরা সবাই মিলে চেঁচাই। ওরা আবার পিছিয়ে যায়। শুধু থালা হাতে আমরা এইভাবে লড়াই করতে গেছি, সেটা মেট্রন রা ভাবতে পারেনি। আসলে ওরা আমাদের ভাল করে দেখতে পারছে না, আর আন্দাজ ও করতে পারছে না আমাদের কাছে সত্যি কি অস্ত্র আছে।
--
এইভাবে প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর নিজেরা পরার্মশ করতে থাকে। শেষে একজন গোবেচারি ডেপুটি জেলার সাদা রুমাল নাড়িয়ে ওপরে এসে বলে ,"তোমাদের যে কোন একজন চল। জেলার বাবু জানতে চায়, কি সমস্যা তোমাদের। জেলারবাবু ব্যবস্থা করবেন।" " আমরা একজন ও যাব না। জেলার বাবুকে গিয়ে বলুন, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। ফিমেল ওয়ার্ডে দিনের পর দিন সাধারণ বন্দিনী দের ওপর যে অত্যাচার চলছে, সেটা বন্ধ করতে বলুন। ঠিকমত চিকিৎসা আর ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করতে বলুন। রোজকার মাপমত খাবার সবাইকে দিতে বলুন। এতগুলি ই সমস্যা। এগুলির সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। "
--
ডেপুটি জেলার ফিরে গেল। হাসপাতালে আলাপ আলোচনা করে ফোর্স নিয়ে জেলার ফিরে গেল। তখন জল টল  খেয়ে, যাদের লেগেছে তাদের দেখভাল করা হল। কল্পনা আর বিজুর হাতে বেশ লেগেছিল, জলপট্টি করা হল। বিকালে সেই ডেপুটি জেলার হেডজমাদারকে সঙ্গে এনে গার্ড দিয়ে আমরা যারা ডিভিশন ওয়ার্ডে থাকি সেখানে পৌঁছে দিয়ে লক আপ করে দিল। সেলেও লক আপ করে ফিরে গেল।
***********************************************************************************
(চলবে)

No comments:

Post a Comment