25 Sept 2016

জেনানা ফটকের ইতিবৃত্ত - পরিশিষ্ট

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত -  পরিশিষ্ট 
******************************
জেল থেকে বার হবার পর আমরা যেন অথৈ সাগরে পড়লাম। পার্টি তখন খন্ড বিখন্ড। অনেক প্রশ্ন আর সংশয়। একটা সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখতে পারছিনা। বেশ কিছুদিন হাবু ডুবু খেলাম। কিন্ত মূর্তিমান বাস্তব, নিজেদের রুজি রোজগারের সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াল। যারা স্কুল,কলেজের পাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম তারা তার  কিছুটা শেষ করলাম। যারা চাকরি ছেড়ে এসেছিল তারা চাকরিতে যোগ দিল।  কেউ কেউ নতুন করে চাকরি খুঁজে নিল। অজস্র মানুষ প্রবল দারিদ্রে দিন গুজরান করতে থাকলো। বেশীর ভাগ লোক শারীরিক ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ বা অকেজ হয়ে পড়ল। তবুও তারা  নিজেদের পেশার সাথে নানা ধরনের সমাজ কল্যাণ কর কাজে যোগ দিল। একদল অবশ্যই এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার সুবাদের নাম ভাঙিয়ে খেল। সেটা একেবারে নগন্য ঘটনা। 
--
তা সত্ত্বেও পথ খোঁজা চলতে থাকল। নকশালবাড়ির  আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শ্রমিক / কৃষক এবং মেহনতী মানুষকে কমিউনিস্ট পার্টীর নেতৃত্বে  শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নয় প্রধানত  সশস্ত্র পথে  ক্ষমতাদখলের লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিল। পার্টি সমস্ত যুবশক্তিকে শ্রমিক / কৃষকের সাথে একাত্ব হবার আহবান জানায়। এই সংগ্রামের সবচেয়ে সদর্থক দিক হল সমাজ বিবর্তনের আন্দোলনে এক নতুন ইতিহাস যুক্ত হল। আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক সশস্ত্র লড়াই হলেও সেগুলির মূল দিশা ছিল অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়। এখানেই পূর্বতন লড়াইগুলির সাথে নকশাল বাড়ীর আন্দোলনের মূলগত পার্থক্য। এই কথাটাই অনেকের মনে থাকেনা। 
যাইহোক  অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পূর্বতন শদীদ সিঁধু ,কানু চাঁদ ভৈরব, তিতুমীর, নুরুলদের সাথে ভূমাইয়া, কিসটা, ধ্যানেশ্বরী, সীমাস্বরী, নয়েয়েশ্বরী, সুরুবালা,সোনামতি, ফুলমতি, সামসারি, গৌড়রাও, খাড়শিং ইত্যাদি অসংখ্য শহীদ  কিষাণ ও কিষানীর নাম যুক্ত হল। স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য বীর যোদ্ধা সূর্য সেন, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা দের সাথে নির্মলা কৃষ্ণমূর্তি,দ্রোণাচার্য, আশু মজুমদার বিপ্লব ব্যানার্জী ইত্যাদি, তেভাগা  তেলেঙ্গানার, খাদ্য আন্দোলন  এর মত আন্দোলন গুলিকে কে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করল। জীবনে সর্ব ক্ষেত্রে উত্থান /পতন থাকে , ঠিক / ভুল হয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আত্ম সমীক্ষার মাধ্যমে ভুল শুধরে আবার নতুন করে পথ চলা শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতাই বিজ্ঞান। অনেক আত্মত্যাগ আর লড়াই এর মধ্যে দিয়েই  বিপ্লব সফল হয়।তাই মে দিবস আজও পালিত হয়। 
--            
আমরা বেশীর ভাগ এখন ও মনে করি আমাদের সবচেয়ে নিষ্পাপ, সরল আর সুন্দর সময় টা ব্যক্তিগত ক্যারিয়র তৈরী করার পেছনে না দৌড়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য একটা মহান , সুন্দর কাজে ব্যয় করেছিলাম। আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়ে এক নতুন সমাজ গড়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমাদের পরম ভাগ্য। জ্ঞানের মহা সমুদ্রের এক বিন্দু জল সেখানেই পান করেছিলাম। সেটাই আমাদের পরম সম্পদ।
--
আমরা অনেকেই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে  ধীরে ধীরে গতানুগতিক জীবনে ফিরে এসেছি। কেউ কেউ নাটক, গণতান্ত্রিক অধিকার, নারীমুক্তি, পথশিশু, শিশু শ্রমিকদের পড়াশোনা ইত্যাদি নানা কিছু মানবিক আর সামাজিক কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা করছি। কিছুটা হয়তো নিজেরা যাতে জড় পদার্থে পরিণত না হয়ে যাবার তাগিদে।
--
 আর এক দল মানুষ হাজার সংশয় আর প্রশ্ন থাকা নিয়েও  সক্রিয় ভাবে সহস্র বাঁধা সত্বেও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলেছে, কারণ তারা জানে প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন সমস্যার সমাধান করা যাবেনা।  আমি নতজানু হয়ে সেই সৈনিকদের কুর্নিশ জানাই, বিশ্বাস করি এক দিন না একদিন সেই শোষণহীন নতুন সমাজের লাল আলোয় পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
*************************************************************************************
 বিঃ দ্রঃ -
এখানে বলা প্রয়োজন, বিশেষ কারণে মিনু, সীমা , শীলা ও কমলা নাম চার টি পরিবর্তন করতে হয়েছে।
 তাছাড়া প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। কিছু স্মৃতি বিভ্রম ঘটে থাকতে পারে। সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনীয়। সেই সময়ের অনেক অভিজ্ঞতা ও জেলের অনেক বন্দিনীর জীবনী আগেই লিখেছি। সাধারণ মানুষের কথা লেখাই আমার ইচ্ছা ছিল। জেলে সাধারন বন্দিনীদের অবস্থা, তাঁদের উপর অত্যাচার এবং জেলকর্ত্রীপক্ষ ও দালাল দের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াইয়ের কথা ইংরেজিতে 'dishari' গল্পে যতটা মনে ছিল লিখেছিলাম। এর বাংলা করার ইচ্ছা ছিল। চোখের সমস্যার জন্য তা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার কন্যা সম কিছু বন্ধুদের অনুরোধে লিখলাম। আপনারা যাঁরা ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। জেলখানকে শোধনাগার নাম দিলেও, বদলায়নি কিছুই , "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। "







No comments:

Post a Comment