22 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 8

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৮
************************

১৯৭৫ সালে এমার্জেন্সি জারী হল।বাইরে তদানীন্তন সরকারের অত্যাচারে সর্বত্র জনগণ আর বিভিন্ন রাজনৌতিক দলগুলির মিছিল মিটিঙ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের, বিভিন্ন কাগজের পত্রকারদের জেলে বন্দী করা হল। একদিন প্রায় শ খানেক বিভিন্ন রাজনৌতিক দলের মহিলা কর্মী ও তাঁদের কিছু নেত্রীরা জেনানা ফাটকে এলো। সম্ভবত তাঁরা ২/৩দিন ছিলেন। আমাদের সাথে তাঁদের, বিশেষ করে সাধারণ কর্মীদের, অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক  বিষয়ে আলোচনা হল। তাঁরা জোর গলায় ঘোষনা করে গেল," তোমাদের আমরা ঠিক বার করে নিয়ে যাব। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় দাবী হবে।"
--
তখন লক আপ হয়ে গেছে। আমাদের ঘরের উঁচুতে দুটি ছোট্ট ছোট্ট গরাদ আর লোহার জাল ঘেরা জানালা ছিল। বাথরুমের পাঁচিল ওপর আমাদের কজন দাঁড়াবার জায়গা হল, মুষ্ঠি বদ্ধ হাত তুলে সেখান থেকে স্লোগান দিতে থাকলাম  "জনতাই সকল শক্তির উৎস, একদিন তাঁরাই নতুন শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলবেন ইত্যাদি। " আর বাইরে থেকে প্রায় শ খানেক রাজনৈতিক কর্মীদের কণ্ঠে একটাই স্লোগান জেলের প্রাচীর ফাঁটিয়ে সারা আকাশ মন্দ্রিত হয়ে উঠলো," সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।''
--
এদিকে জেনানা ফাটকে কয়েক জন রাজনৈতিক বন্দিনীদের খালাসের অর্ডার এলো, কয়েক জন কে অন্য জেলে বদলী করা হল। আমরা বাকীরা যথারীতি আমাদের গান, নাটক, লেখা,পড়া, হাতের কাজ সব নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
ডিভিশন ওয়ার্ডে একটা শিউলি ফুল আর একটা দুধে আলতা রঙের ফুলের গাছ ছিল। মাটিতে পড়ে যাওয়া শিউলি ফুলগুলি  ঘরে এনে রাখতাম, সারা ঘর গন্ধে  ম ম করত। দুধে আলতা রঙের ছোট ছোট কয়েকটা  ফুল ও পাতা শুদ্ধু ডাল ছোট শিশিতে জল দিয়ে সাজিয়ে রাখতাম।   আমাদের মধ্যে বরাবর বাগানের করার চল ছিল। বুলু, খুকু, বৌমা, মলয়া আর মাসিমা এ ব্যাপারে বিশেষ পারদর্শী ছিল। গাছের পরিচর্যা করত আর লুকিয়ে  দোপাটি ফুলের বড়া, শিউলি পাতার শুক্ত এই রকম নানা রান্না করে খাওয়াত। কুমড়ো গাছের বিচি মাটিতে পুঁতে দারুন একটা গাছ করেছিল। নানা ডাল, বাকল আর দড়ি দিয়ে একটা মাচার মত তৈরী করে তার উপর লতিয়ে দিয়েছিল। কদিন পর কুমড়ো ফুলের বড়া, আর পাতার শাক ও খেলাম।ছোট ছোট কুমড়ো ধরল,আস্তে আস্তে বিশাল বড় হতে থাকে।
--
লোভী ওয়ার্ডার আর মেট্রনের নজরে পড়ে । অবশ্য ভয়ে হাত দেবার সাহস হয়নি। মজা হত জেলার, সুপার রা রাউন্ডে এলে। এত বিশাল বস্তু গুলি কুমড়ো না বোমা, নাকি ওর ভেতরে আমরা কিছু লুকিয়ে রেখেছি, ভেবে শুকনো সন্দিগদ্ধ মুখে তাকাতো। অবশেষে একদিন মহাদেবীয়ার সাথে কথা বলে প্রায় গোটা তিরিশ বিশাল কুমড়ো শুদ্ধ গাছ টাকে তুলে দিলাম, একসাথে রান্না করে সারা জেনানা ওয়ার্ড গুলিতে প্রত্যেক বন্দীর মধ্যে বিলি করার জন্য। লোভী মানুষ গুলি অনেকটা আত্তসাৎ করে নিলেও ছিটেফোঁটা সাধারণ বন্দীদের মিলল, এই টুকুই আমাদের সান্তনা।
 --
আমাদের মধ্যে বুলু খুব মিষ্টি ,ভাবুক অথচ রসিক মেয়ে ছিল। কোনদিন কারো সাথে ওর মনোমালিন্য হয়নি। একদিন জয়ার খুব শরীর খারাপ ছিল বুলু সারা রাত জেগে ওকে হাওয়া করল। সকালে জয়া হেসে হেসে আমাদের গল্প করছে, "জানিস কাল সারা রাত আমি রবিকে স্বপ্ন দেখেছি।" "ও মেয়ে, সারা রাত আমি হাওয়া করলাম আর তুই রবির স্বপ্ন দেখলি।" এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটত। মাসীমার মাথা ব্যাথা হলে তেলজল মিলিয়ে মালিশ করতাম। খুকুর গলার ইনফেকশন বুকে ধরে গেল। ২ মাস লড়াই করে সবাই মিলে তাকে সারিয়ে তুললাম। আর আমার গ্যাস্ট্রিক হওয়ার পর  সকলে জীবন পাত করে সারিয়ে তুলেছিল। একবার কানে ফোঁড়া হয়ে কদিন প্রচন্ড ব্যথা।সাথী অতি সাবধানে ঠান্ডা জল দিয়ে মাথা ধুয়ে দিল কতক্ষন ধরে। শিখা সারাদিন বসে হাওয়া করল। আমার থেকে অন্তত বছর চারেকের ছোট হওয়া সত্ত্বেও প্রথম থেকেই আমাকে মেয়ে বানিয়ে নিল। আর মায়ের মত মমতায় নজর রাখত। খুকু সারা রাত কাপড় লন্ঠনের গায়ে গরম করে সেঁক দিল। ভোরের দিকে ফোঁড়া ফেটে গেলে মলয়া ধীরে ধীরে কাঠির মাথায় তুলো লাগিয়ে কান পরিষ্কার করে দিল। বাকীরা হাসপাতালের সামনে গিয়ে চেঁচামিচি করে ডাক্তার বাবু কে ডেকে নিয়ে এলো ওষুধ দেবার জন্য। আমরা সবাই তখন সবায়ের জন্য প্রাণ দিতে পারতাম। হায় ! কোথায় হারিয়ে গেল সে সব দিন।
--
এর মধ্যে একদিন  হটাৎ খুব জোরে জোরে পাগলী বাজতে শুরু হল। গুলি গোলার আওয়াজ শোনা গেল। আমরা বুঝতে পারলাম ছেলেদের ওয়ার্ডে নিশ্চয় খুব বড় গন্ডগোল হয়েছে।সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।কল্পনার কোর্ট ছিল, অনেক দেরীতে ফিরে বলল, "জানিস, ভেতরের গেট, মেইন গেটের  সব চাবি বন্ধুক ধারী জমাদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের প্রায় ৫০ জন ছেলে জেল ভেঙে পালিয়েছে। স্বদেশ আর কালু দুজন বাকিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার দায়িত্বে ছিল। নিজেরা জীবন দিয়ে দায়িত্ব পালন করে গেছে। আর এক জমাদার ও মারা গেছে। " বিকাল ৬টা নাগাদ বড় জমাদার বন্দুক কাঁধে নিয়ে, আরও জমাদার, জমাদারনী সাথে এসে আমাদের লক আপ করে গেল।  
--

পরদিন থেকে সারা জেলে তল্লাশী শুরু হয়। দুদিন পরে আমাদের ওয়ার্ডে তল্লাশী হবে জেনে আমরা আমাদের বই পত্র লুকিয়ে ফেললাম। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ছেলে পুলিশরা মেটালডিটেক্টার দিয়ে সর্বত্র খুঁজতে লাগল, সারা ঘর,প্যাসেজ, স্নান ঘর সার্চ করল।  ঘরের বাইরে বিশাল একটা গর্ত কে টানেলের মুখ ভেবে তারা খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল। লোহার মাটি খোঁড়ার যন্ত্র পাতি এনে বিশাল আড়ম্বরে খুঁড়তে শুরু করতে না করতে ই গুটি কতক বড় বড় ধেড়ে ইঁদুর তেড়ে এলো। বীর পুংগবেরা তাড়াতাড়ি পিছু হটে বাঁচল। গৌরী খিক খিক করে হাসে আর বলে,"খা,খা মাটি খা, ইদুরের কামড় খা।" আমরা হাসা হাসি করতে থাকলাম।
--
এদিকে মহিলা পুলিশরা আমাদের জামা কাপড়, কম্বল, বইপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। স্তালিনের একটা খন্ড  আমরা লুকাতে ভুলে গেছিলাম। শেষে মলয়ার উল সেলাইয়ের ব্যাগে সেটা ভোরে দেওয়া হল। একজন মহিলা পুলিশ খালি তাড়া দেয় আপনি কম্বল টা থেকে উঠুন তো। রাজশ্রী আর আমি বলি,"উঠে পড় , ওই ধার টা ওনার খোঁজা হয়ে গেছে তুই ওখানে বস।" আমরা দুজন ওকে গার্ড করলাম, ও বইটা ব্যাগ থেকে বার করে, তার উপর বসে সেলাই করতে লাগল। আর এক মহিলা পুলিশ এসে ওর ব্যাগ টা সার্চ করে চলে গেল। আমরা হেসে বললাম," দে, এবার ভাল করে তা দে। " রাজশ্রীর বাড়ী থেকে বিরাট একটা ছবির খাতা দিয়েছিল। সেটাতে আমাদের সকলের আঁকা ছবি ছিল। এক মহিলা পুলিশ 'দুনিয়া কাঁপান দশ দিন' বইটার মলাটে লাল রঙ দিয়ে আঁকা যে ছবিটা ছিল, রাজশ্রীর হাতের আঁকা সেই  ছবি দেখেই ষাঁড়ের মত খেপে গেল। ওটা যে নির্দোষ একটা ছবির খাতা মাত্র সেটা কিছুতেই বোঝানো গেল না। দম্ভভরে খাতা টা বগল দাবা করে ইঁদুরের তাড়ায় ভীত বীরের দল বেরিয়ে গেল। আমরা হেসে ফেললাম,' নাকের বদলে নরুন পেল।' মলয়ার স্তালিনের বই বাঁচাবার গল্প শুনে সবার কি হাসি। আর স্তালিনের নাম উঠলেই মলয়ার  মুখ খুশীতে লাল হয়ে যেত।
 --
কোথায় কুমড়োর ভয়ে জেল কর্তৃপক্ষ পাগল হয়ে যাচ্ছিল, আর কোথায় তাদের নাকের তলা দিয়ে ৫০ জন পালিয়ে গেল। জেলে আবার কড়াকড়ি বাড়লো। তবে চূড়ান্ত অত্যাচার আর তল্লাশি চালিয়ে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তো বটেই, প্রায় একবছর আগে শেলাদা কোর্ট থেকে পালন বেশীর ভাগ ছেলেদের ধরে ফেলে, প্রচন্ড অত্যাচার করেও ক্ষ্যান্ত হল না। ধরা পড়া সবাইকে নিয়ে আলিপুর স্পেশাল জেলে জমায়েত করে ডান্ডাবেড়ি পড়ালো, যাতে কেউ নড়তে চড়তে না পারে। ২/৩ দফায় প্রায় ৫০ এর ওপর পাকানো লম্বা বাঁশের লাঠি ধারী জমাদার তাঁদের বেধড়ক মার মারত। সারা পশ্চিম বাংলার জেলগুলি থেকে দাগী বদমাস দালাল এনে লাঠি, লোহার রড দিয়ে  কদর্য ভাবে নানা রকম অত্যাচার করত।
--
 দিনের পর দিন এই অত্যাচার সহ্য করে আমাদের ছেলেরা  ধীরে ধীরে দালাল বাহিনী ও কিছু কিছু জমাদার বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে,তাদের বশীভূত করে। এদিকে বিভিন্ন জেলের প্রবল অত্যাচার নিয়ে বাইরে বন্দীমুক্তি বাহিনী, নানা মানবিক সংগঠন,গানের দল তৈরী হয়। তারাও গণজাগরণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পত্র পত্রিকা তে লেখালেখি শুরু হয়। আমাদের সমর্থক বাহিনী বিদেশের পত্র পত্রিকা তে লেখা বার করার ব্যবস্থা করে। ফলে সরকার বাধ্য হয় অত্যাচার বন্ধ করতে।
--
এদিকে বাইরে তখন ভোটের দামামা বেজে গেছে। এমার্জেন্সি উঠে গেছে। ভোটে এবার যে একটা ওলোট পালট যবে আমরা আঁচ করতে পারছিলাম জেল কর্তৃপক্ষ আর পুলিশবাহিনীর নরম ব্যবহারে। কথায় আছে  না জাহাজ ডুবলে ইঁদুররা পালায় সবার আগে ।
১৯৭৭ সালে  সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী বিভিন্ন রাজনৌতিক দল  শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের  বিরুদ্ধে একজোট হল ভোটে লড়তে। 
************************************************************************************
 (চলবে)






  

No comments:

Post a Comment