8 Sept 2016

সততা





সততা 
 *****
দুই সন্তানের মা, নমিতা থাকত দত্তাবাদ বস্তির এক চিলতে ঘরে। স্বামী একটা ছোটখাটো কারখানায় কাজ করত। নমিতা বাড়ী বাড়ী বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাঁচা ইত্যাদি কাজ করত। এক চিলতে দরমার ঘর, চার ধারে বাঁশের খুঁটি, মাথায় বাঁশের উপর চাটাই, প্লাস্টিক। তার ভাড়া ২০০ টাকা। রাস্তার আলো থেকে হুক করে বিজলীর দুটি পয়েন্টের জন্য ৫০টাকা। ঘর ও সরকারি জমির উপর জবর দখল করে বানানো বিশাল বস্তির মধ্যে। বস্তির মালিকানা গুটি কতক লোকের হাতে। তারা যে পার্টি সরকারে থাকে তাদের দলের লোক। সরকার বদল মানে দল বদল।
--
তাই ইচ্ছা মত ভাড়াটে দের ওপর অত্যাচার চালাতে বাধা নেই। বৃষ্টির সময় ছাদ থেকে ঘরে জল পরে, তলা দিয়ে জল ঢোকে। ঝড়ে চাল উড়ে গেলে নিজেদের সারাতে হয়। দুটি বড় বড় পুকুর সরকারি জমির ওপর। তাতেই বস্তিবাসীদের  সব কাজ চালাতে নির্দ্দেশ দেওয়া আছে। বাকি কাজের জন্য খালি মাঠে যেতে হয়। ফলে সর্দিকাশি, পেটখারাপ তাঁদের নিত্য সঙ্গী। বাড়ীর মালিকদের ঠিক সময় মত ভাড়া আদায় করা ছাড়া কোন দায় নেই।
--
মালিক দের ক্রমাগত বাড়ীর পরিসীমা বাড়তে থাকে, পাকাপোক্ত ইট সিমেন্ট টাইলস লাগান ঝাঁ চক চক বাড়ী তৈরী হয়। সরকারি খরচে বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা আদ্ধেকের বেশী মালিক দের সেবায় যায়। বাকী টুকু তে ২০০ঘর ভাড়াটের জন্য দুটি মাত্র জলের কল আর দুটি টয়লেট তৈরী হয়। বস্তিবাসীদের সকল কেই সকালে কাজে বার হতে হয়, অতএব জল, কল আর টয়লেট নিয়ে নিত্য ই ঝগড়া বিবাদ লাগা থাকে।
--
অথচ প্রতি দুবছর অন্তর ঘর সারানোর নামে মালিক রা ভাড়াটেদের কাছ থেকে টাকা তোলে। ঘর সারানো পর দেখা যায় প্রত্যেকের ঘর আগের থেকে ছোট হয়ে গেছে, তা হয় মালিকের এলাকায় ঢুকে গেছে নয় নতুন দু / চারটি ঘর তৈরী হয়েছে নতুন ভাড়াটে বসানোর জন্য।  আর একটা সময় বস্তি মালিকরা খুব সক্রিয়। ভোটের সময় নিজেদের ভাড়াটেদের জোগাড় করে তাদের পছন্দসই প্রার্থীদের জন্য মিছিল করানো, ভোট দেওয়ান ইত্যাদি।
--
বাড়ী ওয়ালাদের আর একটি রোজগারের ব্যবস্থা হল মদের ঠেক চালান। পয়সার আমদানি দেদার , তার থেকে নিত্য নতুন ব্যবসা খোলা। শুধু রাজনৈতিক পার্টিদের চাঁদার জোগান ঠিক রাখা আর গদি নিয়ে কামড়া কামড়ির সময় মদত দেওয়া। মাঝে মধ্যে পার্টির মস্তানদের মধ্যে লড়াই চলে, বোমাবাজী হয়। তখন নমিতরা ছেলে পুলে নিয়ে দুরু দুরু বুকে সারা রাত উৎকণ্ঠায় কাঁটায়। তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে।
--
এক শীতের সকালে নমিতা যখন প্রথম মঞ্জরীর বাড়ী কাজে আসে, পাতলা ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল গায়ে দিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে। মঞ্জরী কি কি করতে হবে বলে দিয়ে সরোদ বাজাতে বসে যায়। রান্না আগেই হয়ে গেছিল। দুই ঘন্টা বাদে যখন হুঁশ আসে, "আরে মেয়েটা এতক্ষন কি করছে, অন্যেরা তো এক ঘন্টার আগেই কাজ সেরে চলে যেত। উঠে গিয়ে দেখে সারা বাড়ী ঘর ঝক ঝক করছে, ওয়াশিং মেশিনে কাঁচা কাপড় মেলা হয়ে গেছে। রান্নাঘরের সব তাক টাক পরিষ্কার করে বাসন মাঝতে বসেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ থেকে, বলে " কাজ হয়ে গেলে টেবিলের ওপর তোমার খাবার ঢাকা আছে খেয়ে নিয়ো।"
 --
দুদিন পর মঞ্জরী ওকে দুটো কাপড় দেয়, নমিতার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে। " তোমার গায়ের চাদর নেই।" "একটা চাদর আছে, সেটা আমার বর গায়ে দিয়ে কারখানায় গেছে, ফিরতে রাত হয়ত, ঠান্ডা লাগবে তাই।" মঞ্জরী একটা গায়ের চাদর ও বার করে দেয় ," মনে মনে ভাবে, যা ঠান্ডা পড়েছে, শেষে অসুখে পরে গেলে আমার ই মরণ।"
 --
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে যায়। নমিতার কাজে কোন ফাঁকি নেই। সময় সময় মঞ্জরী বকে, "হ্যারে তোর বাড়ীঘর নেই, বাচ্চাদুটো স্কুল থেকে আসবে ! কখন বাড়ীর রান্না করবি আর ওদের খেতে দিবি?" "আরে মামী তুমি এত ভেবোনা। আমি ঠিক সময়ে বাড়ীর কাজ সেরে ফেলব। তুমি যে বড় ড্রাম টা দিয়েছ, তাতে সকাল বেলায় জল ভরে রেখে আসি, ফিরে গিয়ে কাজ করতে কোন অসুবিধা হয় না, আর রান্না মানে তো ডাল ভাত বা ভাতে ভাত দুটো ফুটিয়ে নেওয়া।"" "যাই হোক তাড়াতাড়ি বাড়ী যা। আর ঘরের চাবিটা নিয়ে যা, বিকালে আমি থাকব না।" মঞ্জরীর ফ্ল্যাটের একটা চাবির সেট নমিতার কাছেই থাকে, মাঝে মধ্যে ভুলে রেখে যায়।
--
ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক আস্থার জায়গা তৈরী হয়ে গেছে। নমির কখন কোন কাজে ফাঁকী নেই, মনে হয় যেন নিজের ঘরের কাজ করছে। হাজার অভাব স্বত্তেও মুখ ফুটে কখন কিছু চায়না। মঞ্জরীর বাড়ীতে সব কিছু খোলা মেলা পরে থাকে, আলমারিতে চাবি ঝুলতে থাকে। সর্বত্র নমির অবাধ গতি। টেবিলে টাকা পয়সা, মানিব্যাগ পড়ে  থাকে। নমি সুন্দর করে টেবিল পরিস্কার করে রাখে। পাঁচ বছরে একটা সুতোও এদিক ওদিক হয়নি।
--
মঞ্জরী একটু বেখেয়ালি। কোনদিন ব্যাগে ভরতে গিয়ে হাজার টাকার নোট মেঝেতে পড়ে গেছে খেয়াল করেনি, কোনোদিন আবার আলমারি হা করে খোলা রেখে বেড়িয়ে যায়। ফিরে এসে নমির কাছে বকা খায়,"মামী তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। এক একদিন এক একটা কীর্তি করে রেখে যাও।""যাক তুই আছিস তো, সব ঠিক করে রাখবি জানি তো, আর বকিস না।"
--
১৯/২০ বছরের মেয়ে। অবিরাম দারিদ্রের সাথে লড়াই করে চলেছে। কিন্তু প্রখর আত্মসম্মান বোধ। মাঝে মাঝে টাকা ধার করে, ঠিক শোধ ও করে দেয়। মুখ ফুটে কখন কিছু চায় না। বাড়তি কিছু দিলে শুধু একবার চোখ দুটি তুলে তাকায়। একবার ধূম জ্বর নিয়ে নমি কাজে এল। ওর চেহারা দেখে মঞ্জরী কপালে হাত দিয়ে দেখে বলে, "যা বাড়ী যা, গায়ে তো খুব জ্বর, এত ঠান্ডা লাগালি কি করে ?" "শুধু আমার নয় বাড়ী শুদ্ধ লোকের ঠান্ডায় জ্বর হয়েছে। আসলে মাটিতে মাদুর পেতে শুই তো, গায়ে দেবার দেবার মতো মোটা কিছু নেই।"
--
" ঠিক আছে বাড়ী গিয়ে তোর ভাইকে রিকশা টা নিয়ে আসতে বল।" একটু পরে নমির ভাই রিকশা নিয়ে এল, ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে," দিদি বলেছে, যে কদিন আসতে পারবে না, বোন কদিন তোমার কাজ করে দেবে। তোমাকে তো কাজে যেতে হবে।" নমির বিবেচনা বোধে বিস্মিত মঞ্জরীর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। কথা না বাড়িয়ে বাড়তি তোশক, কম্বল, জ্বরের ওষুধ আর টাকা পাঠিয়ে দিল। তার সাথে নিজেদের আধ পুরান কিছু গরম জামা কাপড় ও দিয়ে দিল।
 --
কদিন বাদে নমি কাজে এসে প্রথমেই বলল, "মামী, তোমার পাঠান জিনিষ গুলো খুব কাজে লেগেছে। তবে আমাকে যে টাকা পাঠিয়ে ছিলে আর বোনকে যা দিয়েছো, আমার মাইনে থেকে কিছু কিছু করে কেটে নিও।" লজ্জ্বায় মঞ্জরীর মাথা হেঁট হয়ে যায়। তার বাড়ীতে  বাড়তি তোষক কম্বল থাকা স্বত্তেও নমির পরিবার এই প্রবল শীতে ঠান্ডা মাটিতে রাত কাটছিল, সে খোঁজ ই রাখেনি। অথচ ওই টুকু মেয়ের কি অপরিসীম বিবেচনা বোধ। "যা তোকে আর পাকামো করতে হবে না", বলে কোন মতে ইতি টেনে পালিয়ে বাঁচে।
 --
 একবার মঞ্জরীরা দার্জিলিং যাচ্ছে শুনে, লজ্জিত মুখে এসে বলল,"মামী আমার ছেলে, মেয়ে, আর বরের জন্য ওখান থেকে সোয়েটার এনে দেবে ? মাইনে থেকে আস্তে আস্তে টাকা শোধ করে দেব।" "তোর লাগবে না?" "হ্যা মানে, আমার ও একটা কালো সোয়েটারের খুব শখ, কিন্তু তোমার ওপর অনেক চাপ পড়ে যাবে যে।" " সে সব তোকে ভাবতে হবেনা। আমার সাধ্য মত আমি এনে দেব। পয়সার চিন্তা তোকে করতে হবেনা। তুই আমার জন্য যা করিস, নিজের লোকের থেকেও বেশী।"
--
ফিরে আসার পর সোয়েটার গুলি পেয়ে খুশিতে নমির শ্যামলা রঙ টা কচি কলাপাতার মত ঝল মল করতে থাকে। মঞ্জরী মনে মনে ভাবতে থাকে, " সত্যি মেহনতি মানুষ রা কত অল্পেতে খুশি হয়। আর আমাদের চাওয়ার পাওয়ার যেন কোন শেষ নেই।
--
কিন্তু এরপর মঞ্জরী আর নমির ছাড়া ছাড়ির দিন এগিয়ে এলো। মঞ্জরীর স্বামীর সরকারি চাকরি। অবসরের তিন মাসের মধ্যে সরকারি আবাসন ছেড়ে দিতে হয়। যাবার দিন এগিয়ে আসতে থাকে।  নমি মামীর  গলা জড়িয়ে শুধু কাঁদতে থাকে, মঞ্জরীও কান্না গিলতে থাকে, এমন পরিজন দুর্লভ। এদিকে গোছগাছ শুরু হয়ে যায়। মঞ্জরী কিছু কিছু ফার্নিচার, বাসনপত্র, ট্রাংক,ব্যাগ ইত্যাদি নমিকে দিয়ে দেয়। নমির ভাই আর বর এসে নিয়ে যেতে থাকে।
--
ওপরের লফ্ট এ টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদির প্রচুর পিসবোর্ডের কাটিম জমেছিল। সেগুলি নমিকে নিতে দেখে মঞ্জরী জিজ্ঞাস করে এগুলি দিয়ে জঞ্জাল বাড়িয়ে ঘর গুদাম করে ফেলিস না, উনানে আঁচ দিয়ে দিস।"
"নমি হেসে বলে," না মামী গুদাম হবেনা। তোমার দেওয়া জিনিস ছাড়া আমার ঘরে তো আর কিছু ছিল না। শুধু দুটো মাদুর আর দুচারটে জামা কাপড়। " মঞ্জরী স্তম্ভিত হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় মাথা নীচু করে ভাবে, "একেবারে নিঃস্ব এই মেয়েটা কত কষ্ট সহ্য করেছে। কিন্তু মুখ ফুটে কখন দয়া ভিক্ষা করেনি। হাতে তুলে না দিলে, সুযোগ থাকা স্বত্বেও একটা কুটি ও সরায় নি।    এ আত্মমর্যাদা বোধ আর সততা - এই বোধহয় মেহনতী মানুষের একমাত্র সম্বল আর অনন্য সম্পদ।"
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


















No comments:

Post a Comment