19 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 7

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৭
**************************
সারাটা দিন আমরা রোজকার প্রয়োজনীয় ঘরের কাজ ছাড়া বই, খবরের কাগজ পড়া, সেলাই করা, ছবি আঁকা, লেখা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। যেখানে যখন সুযোগ পাওয়া যেত সাধারণ বন্দিনীদের সাথে গল্প করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যে গল্প করতাম। সবাই প্রায় সকলের জীবনের কথা, পরিবারের কথা জানতাম। সপ্তাহে সকলে একটা করে পোস্টকার্ড পেতাম। সবাই সবায়ের বাড়ীতে চিঠি লেখার পর, গোল হয়ে বসে সব চিঠিগুলি পড়া হত। সকলের বাড়ী থেকে উত্তর এলেও সবাই শুনতাম। যাদের যেদিন ইন্টারভিউ বা কোর্টের ডেট থাকত থাকত তারা ফিরে এসে, যাবার পথে ছেলে সাথীদের সাথে কি কথা হল, বাড়ীর লোকেদের কি কথা হল , কি কি ঘটনা ঘটল সব গল্প করত। বাকিরা বুভুক্ষুর মত সেগুলি গিলত। সেই সবদিন গুলি যেন উৎসবের মত মনে হত। -- নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য হলেও সবাই মিলে তার মীমাংসা করা হত, কেউ কোন ভুল করলে আত্মসমালোচনা না করা পর্যন্ত্য কোন ছাড় দেওয়া হত না। কিন্তু মীমাংসার পর কেউ তা মনে পুষে সাধারণত রাখতোনা।   কেউ অসুস্থ হলে সবাই পালা করে সারা দিন সারা রাত তার দেখভাল করত। এমনকি কোন কারনে কারোর যদি মন খারাপ হত, বা কেউ চুপচাপ থাকত সবাই তাকে ঘিরে বসে মনের কথা টেনে বার করে, নানাভাবে তাকে হাসানোর চেষ্টা চলত, যতক্ষণ না সে হাসতো কেউ হাল ছাড়তো না, প্রয়োজনে সারা রাতও জাগা হতো। কারোর বাড়ীতে বোন, ভাই বা কারোর বিয়ে ঠিক হলে সবাই মিলে হাতের কাজের  নানা রকম উপহার তৈরী করে দেওয়া হতো। সকলের বাড়ী থেকে যা আসতো তা ছিল এজমালি।
--
 আমরা পরস্পর কে নানা আদরের নাম দিয়েছিলাম। নিজেদের নিয়ে নানা মজা করতাম। একদিন খুকু বলল, " জানিস আমি না এক জায়গায় গোটা গোটা সেদ্ধ ডিমের পায়েস খেয়েছিলাম।"ব্যাস তারপর কিছু হলেই খুকুকে সেদ্ধ ডিমের পায়েস বলে খেপানো হত। একদিন শীতকালের বিকালে বিজু, শিখা, মিতা জয়া আর আমি ঠান্ডা কনকনে জল দিয়ে বেশ করে গায়ে মাথায় সাবান মেখে স্নান করলাম। কে যেন তাই দেখে ফেলে  ঘরে গিয়ে সবাইকে নালিশ করল। সবাই রেগেমেগে ঠিক করল আমাদের বয়কট করা হবে। আমরা তো ব্যাপার টা আগে থেকেই আঁচ করেছিলাম।  প্রথমে আমারা পাঁচ জন মিলে বাকীদের নামের একটা করে বিশেষত্ত্ব দিয়ে গান বাঁধলাম। জেলে বছরে দুটো করে বন্দীদের পাড় আলা সাদা শাড়ি দেওয়া হত। একটা করে শাড়ি পরে আর একটা করে গলায় জড়িয়ে চুল খুলে কীর্তনীয়া সেজে ঘরে ঢুকে গোল হয়ে বসলাম।
--
 কারোর সাথে কোন কথা না বলে লক আপ হয়ে গেলে থালা বাজিয়ে গান শুরু করলাম। বিচারকেরা এ হেন প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। গম্ভীর থাকার চেষ্টা করলে ও মুখগুলি হাসিতে ফাটো ফাটো। প্রথমেই বুলু হাত কামড়ে ফ্যাক করে হেসে ফেললো, "এই দ্যাখনা পাঁচটা কেমন রোবট এসেছে, আর গান গাইছে।" বাকীদের পক্ষে কষ্ট করে হাসি চেপে রাখা বড়ো মুশকিল।  মীনাক্ষীর কটমট চাউনি দেখে তারা হাসতে গিয়ে হাসিটা পারছে না। কিন্তু পেট ফুলে যাওয়া হাসি চাপা বড় দায়। এক মীনাক্ষী ছাড়া সবাই গানের তোড়ে হেসে  লুটোপুটি খাচ্ছে। মীনাক্ষী আমাদের ছেড়ে বিচারক দের বকতে শুরু করল, রেগে মেগে এক জায়গায় গুম মেরে বসে, মোটে কথা বলবেনা, খাবেনা। শেষে আমরা পাঁচ দোষী অনেক সাধ্য সাধনার পর মেয়ে ঠাণ্ডা হল।
--
আর এক দিন রাতে নিহারকণা বলে অতি পাজী এক ওয়ার্ডারের রাতের ডিউটি পড়ল আমাদের ওয়ার্ডে। তাকে আমরা মাসি মাসি করে চেঁচিয়ে ডাকলাম। সে আমাদের ওয়ার্ডে ডিউটি পড়লেই  ভয়ে কাঁপত। ভাটি ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,"কি হয়েছে "? " আরে, আরে এত দূরে কেন কাছে এস, ভয় পাচ্ছ, কেন আজ আবার কি অপকীর্তি করেছো ? বলো শুনি।" "আরে রাম, রাম আমি কি করব, গোবেচারী মানুষ।" "তাই বুঝি, আজ কারো হাজতী বা মেয়াদী নম্বরের ইন্টারভিউ এর খাবার বা জিনিসে ভাগ বসাও নি, মেট্রনের কাছে চুকলি করে কাউকে মার্ খায়াওনি ?" "না না, এই নাকে ক্ষত, কানে ক্ষত। " ঠিক আছে যাও, মাসীমার মাথা ব্যাথা করছে, হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে এস।" হটাৎ সাথী (লতিকা) বলে উঠলো, "যাচ্ছত, ওষুধের নামটা শুনলে না!" "কি নাম?" "বলো গিয়ে ড্রিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস," সাথীর বলার সাথে সাথে আমরা কয়েকজন চিৎকার করে উঠলাম," ইয়াক ইয়াক।" নীহারকণা দৌড়, একটু পরে একটা ওষুধ নিয়ে এল। সাথী বলল," এতো ভুল ওষুধ এনেছো, গিয়ে বল ওষুধের নাম 'ড্রিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস।" "ইয়াক ইয়াক," আমরা সমস্বরে চীত্কার করলাম। এইভাবে পাঁচবার ওকে ঘোরানোর পর ক্ষ্যামা দিলাম। হাসিনার মত অজস্র সরল মেয়েগুলির কথা যে আমরা ভুলতে পারতাম না।
--
বৌমা (জয়শ্রী) ছোট্ট বয়স থেকে আই.পি.টি.আই তে নাটক করত। পরিণত বয়সে  নাটক লেখা, পরিচালনা, অভিনয় সব কিছুতে সে দক্ষ হয়ে উঠেছিল। ওঁর নেতৃত্বে আমাদের নাটক চর্চা প্রবল বেগে এগিয়ে চলল। কখন লক আপ হবার পর আমরা কজন নাটক করতাম। বাকীরা দেখত। বৃত্তাকারে চলত। পরবর্তী কালে কল্পনাও  অনেক নাটক লিখেছে। বাকীরা অল্প বিস্তর হাত পাকিয়েছে। আমরা নিজেরা স্টেজ বানাতাম ,কম্বল দিয়ে ট্রেনের বগি, চাসনালা খনি, স্পার্টাকাসের যুদ্ধের জন্য অডিটোরিয়াম ইত্যাদি বানাতাম। নানা রকম ড্রেসও  বানাতাম। আর চির সাথী থালা আমাদের নাটকে কত কাজ দিয়েছে কিছুটা যাত্রার দলের মত। গুলির  শব্দ দরকার হলে একটা থালা দিয়ে আর একটা থালায় ধাম করে মারতাম। কখন কখন অবশ্য লোকটা আগে পড়ে  যেত, গুলির শব্দটা পরে হত। আনন্দের সিনে থালা বাজিয়ে গান হত। ঘরের মধ্যে লক আপের পর ২/৩ জন মিলে হটাৎ করে ছোট ছোট পথ নাটিকা আরম্ভ করে একে অপর সকল কে চমকে দিতাম, পাল্টা চমকে উচ্ছসিত হয়ে উঠতাম।
--
জিয়রদান ব্রুনো থেকে মার্ক্স্ , স্পার্টাকাস থেকে লেনিন , স্তালিন, মাও, চে  সবাই যাঁরা পৃথিবীতে সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্টা করতে জীবন দান করে গেছেন, তিতুমীর, টিপু সুলতান, ভকত সিং সবাই যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, শ্রমিক কৃষক আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ই যে জীবনের চালিকা শক্তি , আমাদের নাটক,গল্প গান সব কিছুর মধ্যে দিয়ে আমরা সেটাই বলার চেষ্টা করতে করতাম সহজ সরল ভাষায়। মাঝে মাঝে আমরা মেয়াদী নম্বরের সামনের প্যাসেজে নাটক করতাম। হাজতী নম্বর থেকেও অনেকে দেখতে আসতো। মহাদেবীয়া এসব নিয়ে ঝামেলা করত না, এমনকি  হাসপাতাল থেকেও সবাই উঁকি ঝুঁকি মারত। মোটের উপর জেনানা ফাটকে আমাদের নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল।      
--
জেলের খাবার খেয়ে কেউ সুস্থ ছিল না। সকলের অল্পবিস্তর পেটের সমস্যা ছিল। আমার হজম শক্তি খুব দুর্বল হয়ে গেছিল। একদিন বাইরে থেকে এক নাম করা ডাক্তার বাবু দেখতে এলেন। আমার পাশে মীনাক্ষী বসে ছিল। ওর কাল কোঁকড়ান ঝাঁকড়া চুল গুলি পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিল। তখন ও খুব রোগা ছিল।বিশাল লম্বা কাঠির মত লম্বা হাতপা। ডাক্তার বাবু কিছু না জিজ্ঞাসা করেই প্যাক প্যাক করে ওর পেট টিপতে শুরু করল। ভুল ভাঙানোর পর ডাক্তার বাবু আমাকে দেখে চলে যেতেই আমাদের কি হাসি। আর একবার রাজশ্রীর পায়ে কাঁটা ফুঁটে পেঁকে গেল। একজন ছেলে বন্দী কম্পাউন্ডারের কাজ করত। সেবার ও রাজশ্রী র বদলে মীনাক্ষীর পা পরিস্কার করতে শুরু করল। এবার মীনাক্ষী সবার কাছে খুব বকা খেলো, অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য।
--
প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার জন্য অর্চনা দি কে সরকার ছেড়ে দেয়। তারপর মলয়ার ব্রেস্ট এ টিউমার হওয়ার ফলে পি.জি তে ভর্তি করা হয়েছিল ম্যালিগন্যান্ট ছিল না এই রক্ষে। রাজশ্রী, গৌরী ও আমাকেও পি.জি তে মাঝে মাঝে দেখাতে নিয়ে যাওয়া হত। তখন রোগ নিয়ে আমরা একেবারেই ভাবতাম না, বরং কিছুটা বন্ধন মুক্তির স্বাদ প্রানভরে উপভোগ করতাম। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু, ম্যাডাম,সিস্টার রা সকলে আমাদের এতো স্নেহ করতেন আমরা খুব কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।
--
তবে  অচিরে ই সবচেয়ে দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এল,আমাদের প্রিয় মাসিমার ইউট্রাসে ক্যান্সার ধরা পড়ল। কিছুদিন পর পর পি.জি তে তাঁকে রেখে চিকিৎসা হতো। কিন্তু তাঁর মুক্তির জন্য কেউ কোন প্রচার বা প্রচেষ্টা করেনি। জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই তিনি থাকতে বাধ্য হলেন। হয়ত তাঁর জন্য চেষ্টা করার মত বিশেষ বিশেষ লোকজন দের অভাব ছিল, তাই তিনি কোনোদিনই প্রচারের আলোতে আসতে পারলেন না। এমনকি তাঁর মৃত্যু ও সকলের অজান্তে ,অগোচরে হয়েছে। সম্ভবত একটা শহীদ স্মরণে তাঁর উদ্দেশ্যে হয়নি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরাও খবরটা বহুদিন বাদে কানাঘুষো শুনেছিলাম। এটা যে আমাদের জীবনের কত বড়ো লজ্জার, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
--
১৯৭২ সালে  সি. পি. আই (এম.এল ) জন্মদাতা শ্রদ্ধেয় চারু মজুমদার লালবাজারে শহীদ হবার পর, অনেক আলোচনা সমালোচনার পর পার্টি দুভাগে ভাগ হয়ে গেছিল।  একভাগের নেতৃত্ব ছিল শহীদ জহর। অন্যভাগের নেতৃত্ব ছিল মহাদেব মুখার্জ্জী। ১৯৭৫ সালে মহাদেব মুখার্জ্জী ধরা পরে পুলিশের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। সেই প্রশ্নে পার্টি আবার খন্ড বিখন্ড হয়ে পড়ল।
--
প্রথমে আমরা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ি। খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের হতাশা কাটিয়ে আমরা নিজেদের দেশ, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংগ্রামএর ইতিহাস নিয়ে জোরদার পড়াশুনা শুরু করলাম। তাছাড়া নাটক, লেখা, গান, হাতের কাজ  মাসিদের সাথে গল্প করা আরও দুরন্ত  গতিতে চলতে থাকে। এই পর্যায়ে কল্পনা, রাজশ্রী আমাদের কাছে ডিভিশন ওয়ার্ডে চলে আসে। যদিও আগেই ওদের নিয়েই বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা আগেই করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি শুভা আর দুচারজন মেয়ে আমাদের মধ্যে এসেছিল। আস্তে আস্তে অনেকে ছাড়াও পেয়ে যায়। যাই হোক প্রথমে কিছুটা মুষড়ে পড়লেও আমরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। বরং কিছুটা যেন বদ্ধ জলা থেকে বেরিয়ে আমাদের জীবন যেন আরও  পরিণত আর ক্রিয়েটিভ হয়ে ওঠে। 
************************************************************************************
(চলবে )   
















  


















 







No comments:

Post a Comment