14 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 5

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৫
************************

জেল কর্তৃপক্ষ ব্যাপার টাকে  যে ছেড়ে দেবেনা আমরা জানতাম।প্রথমে ডালিয়াকে হাওড়া জেলে বদলী করে দিল। ওয়েলফেয়ার অফিসারকেও ট্রান্সফার করে দিল। ১৯৭৪ এর একেবারে প্রথম ভাগে ঘটনাটা ঘটে। সেই সময় আমাদের ৬৭/৬৮ বছর বয়সী মাসিমা আর বুলু বর্ধমান বা মেদিনীপুর  জেল থেকে বদলি হয়ে এসেছিলেন। আমাদের মহাভাগ্য জেলে আমরা মাসিমাকে মা হিসাবে পেয়েছিলাম। স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় আমাদের ভরিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বয়সে আমাদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতেন। তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তিনি খুবই ছোট ছিলেন, কিন্তু লুকিয়ে বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন । বস্তুত স্বাধীনতা আর ন্যাযের প্রতি তাঁর চিরকালই অশেষ শ্রদ্ধা ছিল।তাঁর নাম ছিল শান্তিরানী দেব।
--
দেশ ভাগাভাগির সময় সব ফেলে খালি হাতে চলে আসেন। অশেষ কষ্টের মধ্যে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান। মেসোমশাই অসুস্থ থাকার ফলে তাঁকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। ছেলেরা একটু বড় হতেই বিভিন্ন কারখায় কাজ জুটিয়ে নেয়। তাঁর চার ছেলের মধ্যে ২/৩ জন আমাদের পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। মাসিমার বিবাহিত মেয়ে যেন মাসিমার ই প্রতিমূর্তি। জামাই ও খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু মমতা আর সহৃদয়তার প্রতিচ্ছবি।
--
বুলু শান্তশিষ্ট, হাসিখুশী, দৃঢ়চেতা মেয়ে ছিল। একদিন আমি আর বুলু হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গেলাম। দালাল রা মেট্রনের নির্দ্দেশে তৈরী ছিল। মেয়াদীও হাজতী নম্বর, জাল ঘরের বন্দিনীদের লক আপ করে দিল। ভাটি ঘর আর সেলের নীচের  কাঠের দরজা টা তো বন্ধ করাই থাকতো। এর মধ্যেই মেয়াদী নম্বরের মাসিরা বিজুদের খবর দিয়ে দিয়েছে শিখার নেতৃত্বে বিশাল এক দালাল বাহিনী বাঁশের লাঠি, লোহার রড নিয়ে আমাদের মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিজুরা হাসপাতালের জানালা দিয়ে আমাদের সাবধান করে দিল। তবে ওরাও জানতো আর আমরাও বুঝলাম খালি হাতে দুজন এতগুলি লাঠি ,রড ধারী দালালদের সাথে যুঝে উঠতে পারবো না। তাছাড়া চশমা খোলা অবস্থায় আমি তো অসহায়।  চশমাটা  বিজুর হাতে দিয়ে  বুলুর হাত শক্ত করে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ওয়ার্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম।আমার দুজন ঠিক করে নিয়েছিলাম মার তো খাবোই। কিন্তু ওরা যেন ভয় পেয়েছি মনে না করে।
--
কয়েক জন দালাল আমাদের প্রায় ঘিরে নিয়ে চলল, আর পুরো বাহিনী ভাটিঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখানে যেতেই আনোয়ারা আমার মাথায় লোহার রড দিয়ে বাড়ি লাগলো। এই আনোয়ারা আন্ডার এইজ সংশোধনাগারে তিনটি বাচ্চার মাথায় পাথর জাতীয় কিছু মেরে খুন করার কেসে ছিল। তাই শিখা ওকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিল। আমার মাথার ব্রম্ভতালুর  একটু ধারে দুটো, আর কপালের কাছে একটা বাড়ি লাগে। প্রায় অর্ধ অচেতন অবস্থায় চুল ধরে হিড়হিড় করে মাঠের মাঝে নিয়ে গেল, যাতে একমাত্র ডিভিশন ওয়ার্ড ছাড়া সেল, জাল ঘর, মেয়াদী আর হাজতী নম্বর থেকে সবাই দেখতে পায়, আর অসহায় রাগে ছটফট করে। যতক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল, বুঝতে পারছিলাম হাতে,পায়ে সর্ব শরীরে লাঠি আর রডের বাড়ি পড়ছে, মাথা দিয়ে রক্ত বার হয়ে চলেছে। আমি ক্ষীন স্বরে ওয়ার্ডার কে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি,"মাসি বুলু কোথায় দেখ।"
--
তার পর আর জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান আসে দেখি হাসপাতালের একটা বেডে শুয়ে। আর চার জন ডাক্তার ঘিরে আছেন, একজন মাথায় সেলাই করছেন। একজন প্রেসার দেখছেন, আর বলছেন ভীষণ হাই আর ফ্লাকচুয়েট করছে।
চিফ মেডিকেল অফিসার আর তাঁর পরের পদে যিনি তাঁরা কথা বলছেন।পাশের বেডে বুলু কে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে, ওর ও শুশ্রুষা চলছে।" ইতিমধ্যে মেট্রন মুখ বাড়িয়ে যত বার মিস্ষ্টি  কথা বলতে আসছে, আমি আর বুলু ওঠার চেষ্টা করছি, আর বকে যাচ্ছি, "চালাকি হচ্ছে,সব জেনে প্ল্যান করে এ সব কান্ড ঘটিয়ে, এখন ভালোমানুষি হচ্ছে ,ইত্যাদি।" আর হাত বাড়াচ্ছি ওকে ধরার জন্য, বুলু তো প্রায় ধরেই ফেলেছিল। একজন ডাক্তারবাবু কড়া গলায় মেট্রনকে  বললেন, " আপনি এখন থেকে সরুন তো, শুধু শুধু এদের উত্তেজিত করবেন না।"  
--
অকেনক্ষণ বাদে অবস্থার উন্নতি হলে আমাকে স্ট্রেচারে আর বুলু কে ধরে ডিভিশন ওয়ার্ডে পৌঁছে দিয়ে গেল। বুলু একবারে নতূন এসেছিল বলে, ওকে অল্পের ওপর দিয়ে ছাড় দিয়েছিল।বুলুর হাতে সেলাই পড়েছিল।আমাদের সাথীরা না খেয়ে অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা ঘরে ঢোকার পর থেকে আমাদের দুজনের সব দায়িত্ব তারা নিজেদের হাতে তুলে নিল। রেগুলার ওষুধ খাওয়ান আর  সেলাইয়ের জায়গা পরিস্কার করে নতুন ব্যান্ডেজ করতে হত সেলাই না কাটা পর্যন্ত্য। আমার সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগল। এই সময় টা আমি হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারতাম না। মাসিমা,খুকু,বিজু অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাকে সুস্থ করে তুলল। ওদের ছাড়া আমার পক্ষে টয়লেট করাও সম্ভব ছিল না।কোন বিরক্তি বা ঘেন্না না দেখিয়ে হাসিমুখে ওরা সব করত।
--
আর জেলের সহবন্দিনীরা যে আমাদের কত ভালবাসত তার প্রমান আমরা নতুন করে পেলাম। ওই স্বল্প খাবার থেকে তাঁরা ডায়েটের দুধ, বিস্কুট, ডিম,ফল যে যা পারত লুকিয়ে পাঠাত। কোন বারণ শুনতো না।আমাদের মারার পর শিখাকে অন্য জেলে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। মহাদেবিয়া হাসপাতালের মেট হল। একদিন শান্তিবাই ভাটির দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, শিখা ভয়ের চোটে পালিয়েছে। মহাদেবিয়া ভাল মানুষ। এখন আর আগের মত অবস্থা থাকবে না। চিন্তার কিছু থাকবেনা। হাত নেড়ে ওকে শুভেচ্ছা জানালাম। 
--
অবশেষে দিন ৭/৮ বাদে একটু সুস্থ হলে মেয়াদী নম্বর ঘরের সামনে বিজু আর খুকু আমাকে ধরে নিয়ে যাবার পর মাসিরা নিশ্চিন্ত হল। খাবার পাঠান বন্ধ করা গেল। মাসিদের মুখে শুনলাম আমাকে মারার পর মাথা দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত দিয়ে শিখারা পায়ে আলতা পরেছিল। আর সেইদিন যে ওয়ার্ডারের কাঁধে জেনানা ফাটকের শিকলে ঝোলানো চাবির ঝোপা ছিল, তাই দিয়ে তিনি দালাদের তাড়াবার আপ্রাণ চেস্টা করেছিলেন। তাছাড়া চারজন ডাক্তারবাবু সে সময় গেট দিয়ে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখে অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা আমাকে ঘিরে হাত ধরে দাঁড়িয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলেন। "নাহলে তোদের হয়ত সেদিন মেরেই ফেলত।" হাজতী নম্বর থেকেও অনেকে এসে দেখা করে গেল। এতোদিন পরে সবাইকে দেখে আর তাঁদের ভালোবাসা, শুভেচ্ছায় মন ভরে গেল। সাধারণ মানুষের এই ভালবাসা/শ্রদ্ধা  কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি ছিল না, ছিল আমাদের মতাদর্শের প্রতি।
--
 শান্তিবাই আর মীরা এসে হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে বলল, "দিদি মাপ করিস, আমরা দুজনকে  সেদিন ওদের পেছনে থাকতে বাধ্য  হয়েছিলাম, নাহলে মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখিয়েছিল।  তোদের মারতে দেখেও আমরা কিছু করতে পারিনি , মনে মনে কেঁদেছি।" " আরে না,না, তোদের যখন মেরেছিল, আমরা তো অসহায় ভাবে দেখেছি। কিছু করতে পারিনি। নিজেরা সবার সাথে মিলে মিশে থাকবি। কিন্তু ওদের দলে ভীড়ে সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার করিসনা।" " নারে, দিদি ওদের মত কখন হবোনা।"  
 --
এরপর কল্পনা, বিজু, খুকু, ডালিয়া, রাজশ্রী,মিনাক্ষী, আমার ও পূর্ববর্তী ওয়েলফেয়ার অফিসারের নামে ব্যাংকশাল কোর্টে মেট্রন কে মেরে ফেলার যড়যন্ত্রের অপরাধে জেল কর্তৃপক্ষ কেস করল। আমাদের মজাই হল, জেলের এই অন্ধকূপ থেকে বাইরে যাবার একটা সুযোগ মিলল। ব্যাংকশাল কোর্টে গিয়ে ডালিয়ার সাথে অনেক দিন বাদে দেখা হল। অনেক গল্প হল। বিকালে কোর্ট বন্ধ হলে আবার ছাড়াছাড়ি। আবার সেই কালো রাতের মত কাল উঁচু পাঁচিলের মধ্যে আবার হারিয়ে যাওয়া।
 --
কোর্টে যাবার সুযোগে ভ্যান থেকে হোলেও তার খুপরি জলনার ভিতর দিয়ে বাইরের পর পৃথিবী টাকে একটু দেখতে পেতাম। এরকম এক কোর্টের দিনে জেলে অফিসে আমাদের যখন তল্লাশির জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে, দেখলাম এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা আর দুই মেয়ে মিলে তাদের মাকে জেলে ভর্ত্তি করতে এসেছে, যাতে তাঁর গভীর ডিপ্রেশন থেকে সেরে ওঠে। আমরা সকলে মিলে তিন ভাগে ভাগ য়ে বাবা আর দুই মেয়েকে জেলের প্রকৃত অবস্থা কি, পাগলদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়, তার পরিণতি কি সব বুঝিয়ে বললাম। "১ /২  মাস মাকে নয় তাঁর কঙ্কাল টা দেখতে পাবে, আর কদিন বাদে তাঁকে আর খুঁজেই পাবে না। তাঁকে জীবিচাইলে শীগগিরই বাড়ী নিয়ে যাও।" মেয়েরা কাঁদতে শুরু করল আর বাবার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ২/১ সপ্তাহ বাদেই সব ব্যবস্থা করে মাকে তাঁরা বাড়ী নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের জালনা থেকে আমরা আনন্দের সাথে দেখলাম। যাবার সময় গরাদের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাদের অনেক ভালবাসা জানালেন। আমরাও তাঁদের এই কাজের অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম। 
--


************************************************************************************
(চলবে )




  


























  







 









    









No comments:

Post a Comment