11 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 3

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব  ৩
************************

কল্পনা ধরা পড়েছিল যদুগোড়া জঙ্গল থেকে, শ্রদ্ধেয় অনন্ত সিংহের গ্রূপের বেশ কিছু জনের একটা দলের সাথে। ও আমাদের সকলের মধ্যে  সবচেয়ে বেশী দিন জেলে কাটিয়েছিল । অসম্ভব সাহসী আর দৃঢ় চেতা ছিল। মুক্তি শান্ত শিষ্ট  অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ স্বভাবের মেয়ে, ধরা পড়ে  '৭১সালে। ডালিয়া ছিল ডাকাবুকো। আর বিজু ছিল প্রাণ শক্তিতে ভরপূর উচ্ছল একটা বাচ্চা মেয়ে, কিন্তু দারুন মনের জোর, দেখলে বিস্মিত হয়ে যেতে হয়।ও ধরা পড়ে  '৭২সালের প্রায় শেষের দিকে।জয়া ধরা পড়ে সম্ভবত পুরুলিয়া থেকে। শীলাদি দের পাঁচজনের মধ্যেও সাহসের অভাব ছিল না, তারাও '৭২/ ৭৩ সালে ধরা পড়ে।
--
কল্পনা/ ডালিয়াদের মুখে গল্প শুনেছি, '৭০/৭১ সালের প্রথম দিকে কল্পনা কে প্রথমে একতলায় ঠান্ডা স্যাৎসেতে একটা সেলে রেখেছিল। তখন অনেক মেয়ে ছিল। তাদের রাখা হয়েছিল মেয়াদী নম্বরে। সবাই মিলে ঠিক করে ওকে যখন স্নান করাতে বার করবে তখন জমাদারনিদের হাত থেকে কেড়ে ওয়ার্ডে নিয়ে আসবে। সাধারণ কিছু বন্দিনী তাতে সামিল হয়। যথারীতি পরিকল্পনা মাফিক কাজ হয়। মেয়ে জমাদারনীরা সাহস পায়না। ফলে জেলারের নেতৃত্বে জমাদারদের বিশাল ফোর্স আসে। অসম শক্তির মধ্যে লড়াই শুরু হয়। সবাই কে অবাক করে শিখা বলে সবচেয়ে সক্রিয় বন্দিনী প্রথমেই দল বদলে জমাদারদের হাত থেকে লাঠি নিয়ে মেয়েদের মারতে শুরু করল।
--
অতি সহজেই জেল কতৃপক্ষের সুনজরে এসে সে দালালদের রানী হয়ে বসল। পরবর্তী কালে গোবেচারী জমাদারনীরাও তাকে তোয়াজ করে চলত। যাইহোক আমাদের মেয়েরা লড়াই করল, সকলেই প্রচন্ড আহত হল। কল্পনা, জয়া, ডালিয়া আর সীমাকে সেলে বন্দী করে দিল। বাকীদের মেয়াদী নম্বরে। আমি '৭৩এর প্রথমে ধরা পরি। তখন সেই গ্রূপটার কল্পনা, সীমা, ডালিয়া, জয়া ছাড়া সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে। বাকী সকল কে শীলাদিদের সাথে ডিভিশন ওয়ার্ডে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সীমাকেও সেল থেকে ডিভিশন ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছিল।
 --
সাধারণ বন্দিনী দের মেয়াদী নম্বরে দেওয়া  হল। আমাদের ওয়ার্ডের বাইরে একটা প্যাসেজ ছিল। সেখান থেকে মেয়াদী নম্বরের জানালা দিয়ে সাধারণ বন্দিনীদের সাথে কথা বলা যেত। তার পাশেই ছিল হাসপাতাল। সেখানে মেট্রন আর  ডাক্তারবাবু দের বসার কথা, তাছাড়া রুগীদের থাকার কথা। কিন্তু সেখানে শিখা তার পেয়ারের দালালদের নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল। আমাদের প্যাসেজ থেকে ওদের কারসাজি আমরা লক্ষ রাখতাম। একজন পাহারায় থাকতাম অন্যরা সাধারণ বন্দিনী দের সাথে গল্প করতাম।
--
মহিলা ওয়ার্ডের ভেতর দিকটা এক কোনে সেল এর সামনে একটা ছোট্ট ভাটিঘরে  বড় দুটো চুলা ছিল। সেখানে গরম জল, বন্দিনীদের সপ্তাহে একদিন কাপড় সেদ্ধ ছাড়াও, মেট্রন আর দালাল দের জন্য রুগীদের ডায়েটের থেকে চুরি করা খাবার দিয়ে মুখরোচক খাবার বানানো হতো। ভাটি ঘরের দুপাশে দুটি আগেকার দিনের ভারী দরজা। আমাদের দিকের দরজা টা সাধারণত বন্ধ থাকত।সেলের দরজাও প্রয়োজন ছাড়া খোলা হত না। 
--
কত মানুষের সাথে পরিচয় হত। পয়সার অভাবে যারা তদবির করতে পারতোনা,বছরের পর বছর তারা জেলে পচে মরতো। মীরা ছিল এক সিধা সরল ধর্ষিতা মা। তার ধর্ষক বাইরের দুনিয়ায় বহাল তবিয়তে ঘুরছে। আর সে একটা হাড় জিরজিরে বাচ্ছা নিয়ে অন্ধকূপে পড়ে আছে। আর এক মীরা বাংলা দেশের মেয়ে, দাঙ্গার সময় পালিয়ে এসে পথ হারিয়ে জেলে আসে। হাসিনা সুন্দরবন থেকে কাজের জন্য কলকাতায় এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলে।শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে দিলেই সে বাড়ী চলে যেতে পারত। জাহানারা ৯/১০ বছরের বাচ্চা মেয়ে ও ধর্ষিতা। ধর্ষক পয়সার জোরে খোলা আকাশের তলে।শুধু অসহায় মেয়ে গুলি ভিক্টিম হিসাবে সরকারী সেফ কাস্টডির অন্ধকূপে বন্দী। কেউ বন্দী চুরি না করেও চুরির অপরাধে। সবচেয়ে হাস্যকর, চুরি না করে কেউ যদি করেছে বলে স্বীকার করে নেয়,তবে ৫/৭ দিনের সাজা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর কেউ যদি আত্মমর্যাদাবোধে  মিথ্যা অপবাদ অস্বীকার করে ,তাকে জেলে পচে মরতে হয়। ভালবাসার অপরাধেও জেলে থাকতে হয়। জেলে না এলে জীবনে এত অভিজ্ঞতা হতোই না।
--
 এর মধ্যে মুক্তি মিসা থেকে মুক্তি পেয়ে চোখের জলে বিদায় নিল। মিনু আমাদের ওয়ার্ডে এল। একদিন বৃস্টির দিন খুব চা খাবার ইচ্ছা হল। আমরা পুরান কাপড়ে আমাদের সেই বিখ্যাত উকুন তাড়ান তেল ঢেলে যে সামান্য চা পাতা ছিল তাই জলে দিয়ে অনেক ফুটিয়ে চা তৈরী করলাম, অমনি কোন কোনা থেকে একটা নেংটি ইঁদুর লাফ মেরে ফুটন্ত চায়ে পড়ে  নিজের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটালো আর আমাদের চায়ের দফারফা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এক দশাসই জমাদারনি লক আপের কাছে এসে জিজ্ঞাসা শুরু করল "কে আগুন জ্বালিয়েছে ?" কেউ পাত্তা না দেওয়াতে, চাবি আনতে গেল, ঘরে ঢুকে দেখার জন্য। এই অবসরে বিজু গরম চায়ের বাটি ধরে গরাদের ফাঁক দিয়ে নর্দমায় ফেলে দিল, আমি পোড়া ন্যাকড়া গুলি আধা পাঁচিল দেওয়া যে বাথরুম ছিল তার লোহার প্যানে ফেলে জল ঢেলে চাপা দিয়ে দিলাম। জমাদারনী দরজা খুলে কিছুই দেখতে পেলনা। সন্দিগ্দ্ধ দৃষ্টিতে বাথরুমের প্যানের দিকে তাকিয়ে বক বক করতে করতে ফিরে গেল। এদিকে আমাদের দুজনের হাতের অবস্থা খারাপ।অনেকক্ষন জলে হাত ডুবিয়ে বসে থাকলাম।
--
এরমধ্যে আমাকে কোর্ট থেকে আবার ১৪দিনের জন্য লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হল আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আর  জেলের গোপন খবরের জন্য।" আপনাদের লৌহবেষ্টনীর মধ্যে আটকে রেখে আমাকে গোপন খবরের জন্য জেরা করছেন! আপনাদের ফোর্স ছাড়াও তো দালাল বাহিনী রয়েছে খবর দেবার জন্য।" ব্যাস এক প্রস্থ মার। সেন্ট্রাল লক আপে গিয়ে দেখি বরানগরের বহুদিনের ওয়ান্টেড একটি মেয়ের পেছনে এমন মেরেছে ,এক/দু  মাস পুলিশ হাসপাতালে রেখেও ঘা পুরো সারেনি। অথচ মেয়েটি বহুদিন আগেই পার্টি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে রীতিমত ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমাকে মিসা দিয়ে জেলে ফেরত পাঠাল। ওই মেয়েটিকে পরে কদিনের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল। তারপর ছেড়ে দেয়। 
--
রাজনৈতিক বন্দীদের জেল কতৃপক্ষ বা দালাল রা সচরাচর ঘাটাতো না, প্রাপ্য জিনিসপত্র কিছুটা হলেও দিত। কিন্তু সাধারণ বন্দিনীদের দুর্দ্দশার সীমা ছিল না, এদিক ওদিক হলেই মারধর। শুধু খাবার কেন, খাবার জল টাও ঠিকমত জুটতনা। অসুখ বিসুখে ওষুধ পত্র ও মিলত না। আমরা চেষ্টা করতাম যাতে ওরা একজোট হয়ে নিজেদের দাবী গুলি আদায় করতে পারে। একজোট হয়ে দালালদের মারধোর ঠেকাতে পারে। দালাল রা সব সময় চোখে চোখে রাখত যাতে আমাদের সাথে ওরা কথা বলতে না পারে।কিন্তু তাই বলে জেলে লড়াই কখন থেমে থাকেনি। অন্যান্য বন্দিনীদের লড়াইয়ের পাশে আমরা সব সময় থাকতে চেষ্টা করেছি ,তাঁরাও আমাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছে। কখন লড়াই শুরু করেছে মীরা,শান্তিবাই,বেলা,রেখারা , কখন মিতা, হাসিনা, হাওয়া বিবি, শোভা, শান্তি মাসীর। কখন বার্মিজ মাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে, কখন মেয়াদী নম্বরের পাকিস্তানের পাসপোর্ট কেসের মাসীরা, আবার কখন মাস্তান একাই জেলকতৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবারে জীবন বাজী রেখে লড়ে গেছে।       
--
একদিন কথা বলতে বলতে একটু বেখেয়ালী হয়ে পড়াতে কয়েকটা দালাল আমার চুল আর কাপড় টা টেনে ধরে। আমি নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে চীৎকার করে বিজু কে ডাকতে থাকি।  বিজু দৌড়ে আসে, দুজনে মিলে টানাটানি করে নিজেকে ছাড়াই। এদিকে মেট্রনের নির্দ্দেশে হেডজমাদারনি আমাদের দরজা টা খুলে শিখা আর তার দালাল বাহিনী কে ঢুকিয়ে দেয়। প্রথমেই আমাদের চশমা দুটো ভেঙে দেয়। আমার চোখের পাওয়ার মাইনাস ১৪। চশমা খুললে আমি কিছুই দেখতে পেতাম না। আমাকে কজন চেপে ধরল।
--
তারা মূল টার্গেট করল বিজুকে। সবাই মিলে ওর চুল ধরে ঘুষি,থাপ্পড় মারতে লাগল। ইতিমধ্যে শীলাদিরা সবাই বার হয়ে ওদের ওপর চড়াও হল। এমনকি দরজা খোলা পেয়ে মীরা, শান্তিবাই রা প্রায় জনা ১৫ সাধারণ বন্দিনীরা ঢুকে দালাল বাহিনী কে আক্রমণ করল। ওরা এতটা ভাবতে পারেনি। কাজেই তাড়া তাড়ি পগারপার। জমাদারনী দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। প্রায় দিন ১০/১৫ সাধারণ বন্দিনীরা আমাদের সাথে থাকল। তারপর ওদের হাজতি নম্বরে ফিরিয়ে দিল।
--
এর কদিন বাদে ডালিয়াকে ১০ বছরের সাজা দিয়ে ডিভিশন ওয়ার্ডে নামিয়ে দিল আর জয়া কে পুরুলিয়া পাঠিয়ে দিল। শীলাদিরা  সবাই এক এক করে ছাড়া পেয়ে গেল। বিজু, মিনু ,ডালিয়া আর আমি রইলাম ডিভিশন ওয়ার্ডে। কল্পনা একা সেলে। এর কদিন পরে বিজুর মিসা উঠে গেল , ওকে অনেকের সাথে এন্টালি কনস্পিরেসি কেসে ঢুকিয়ে দিল, আর লালবাজারে নিয়ে গিয়ে একপ্রস্থ অত্যাচার ও হল।  আমাদের মাঝে  ফিরে এলো সেই অত্যাচারের চিন্হ নিয়ে।
*********************************************************************************
(চলবে)
 
















No comments:

Post a Comment