23 Sept 2016

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব 9

জেনানা ফাটকের ইতিবৃত্ত - পর্ব ৯
************************
আমাদের ইন্টারভিউ ও কোর্ট গুলিতে আমাদের বাবা, মা, ভাই, বোন বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন রা আসতেন।  রোজ দেখা হতে হতে তাঁরা সবাই যেন একই পরিবারের লোক হয়ে গিয়েছিলেন, সকলেই পরস্পরের সমব্যাথী। আমাদের কারো কোন বিশেষ জিনিসের প্রয়োজন থাকলে, আমরা তাঁদের যে কোন কাউকে অক্লেশে বলতে পারতাম। যেমন আমার কোন বিশেষ কিছুর প্রয়োজন থাকলে, বৌমা তার ভাইকে বলত। আমাদের মধ্যে যারা বিবাহিত ছিল মীনাক্ষীর মা তাদের জন্য পূজোর সময় লাল চুড়ি কিনে আনতেন। বিজুর কিছুর প্রয়োজন হলে আমার মাকে বলতাম। শিয়ালদা কোর্টের লোকজন আমার মাকে বিজুর মা বলে জানত। তাছাড়া সবাই নানা ধরনের খাবার,জামা কাপড়, বইপত্র ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। কোর্টে তাঁরা যা খাবার নিয়ে আসতেন, আমাদের সাথীরা সারাদিন প্রায় উপবাস থেকে সব কিছু জেলে নিয়ে আসতো, সবাই মিলে খাবার জন্য। সকাল ১০টা নাগাদ জেল থেকে সামান্য কিছু খেয়ে তারা বার হত আর ওয়ার্ডে  ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে  ৭/৮ টা হয়ে যেত।
--
জেল অফিসে সে সময় নানা বন্দী /বন্দিনী, জমাদার/ জমাদারনী, অন্যান্য কর্মচারি ইত্যাদি তে পরিপূর্ন থাকত। স্বাভাবিক ভাবে কিছুটা গোলমাল হত। একজন ডেপুটি জেলায় গন্ডগোল থামাতে বকে উঠত,"আইকি, অটো সেসামিসি, সেসামিসি; অইটা কি সারিয়াখানা ?(একি, এত চ্যাঁচামিচি, চ্যাঁচামিচি; এটা কি চিড়িয়াখানা?)" গোলমাল রূপান্তরিত হতো হাসিতে। তাড়া তাড়ি ভদ্রলোক সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতো।
--
আমাকে মারার পরে জেলার, সুপার রাউন্ডে এলে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে আমার কোন উত্তর দিতাম না। সুপার হিংস্র গলায় বলতো," কি কথার উত্তর দেবেন না, না! বলে কটমটিয়ে মেট্রনের দিকে তাকাতো। সে বেচারা গদগদ গলায় নানা কথা বলে তোয়াজে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। জেলার চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতো। বন্দিনীরা ওকে আড়ালে রাবড়ি খচ্চর বলে ডাকত। আমাদের ওয়ার্ডে কোথা থেকে একটা ছোট্ট সাদা বেড়াল বাচ্চা এসে জুটেছিল। সেটাও ওদের দেখলে আমাদের কোলে এসে উঠত।
--
ইদানিং তাঁদের সকলের গলা দিয়েই যেন মধু ঝরতে শুরু করল, কি অসুবিধা,কি প্রয়োজন ইত্যাদি। যথারীতি আমরা কোন উত্তর দিতাম না। চুপচাপ মাথা নীচু করে চলে যেত। এই সময় ইন্টারভিউ তে কোন রকম বই দিতে নিষেদ্ধাজ্ঞা ছিল না, এমনকি মাও সে তুঙ থেকে চারু মজুমদারের বই পর্যন্ত। প্রথম থেকেই আমাদের সব ইন্টারভিউ তে  আই.বি / এস বি রা উপস্থিত থাকত, তারাই স্থির করে দিত কি দেওয়া যাবে আর কি দেওয়া যাবে না। এখন তারা অতি সজ্জ্বন, সর্ব দাতা।
--
দেখতে দেখতে সারা ভারত জুড়ে ইলেকশনের বাদ্যি বেজে উঠল। তখন কেবল  বুলু ,মাসিমা কল্পনা, মলয়া, খুকু, শুভা, মিতা, মীনাক্ষী, সাথী, গৌরী, রাজশ্রী আর আমি জেলে ছিলাম। বাকিরা বাইরে বন্দিমুক্তি আন্দোলনে ব্যাস্ত।    ১৯৭৭এর  মার্চ এসে গেল।কল্পনা ছেলেদের ওয়ার্ড থেকে একটা ট্রান্সজিস্টর জোগাড় করে নিয়ে এলো ইলেকশন বুলেটিন শোনার জন্য। সম্ভবত বিশে মার্চ রেজাল্ট ডিক্লেয়ার শুরু হয়েছিল। কল্পনা সারা রাত জেগে খবর শুনতে থাকল।আমরা আধা জাগরণ, আধা ঘুমে। একটা করে মহীরুহের পতন হয়, কল্পনার ডাকে আমরা হই হই করে উঠি। সবচেয়ে বেশী আনন্দে আমরা আত্মহারা হয়ে হুল্লোড় করি সির্দ্ধার্থ শংকর রায়ের পরাজয়ে। যার নেতৃত্বে বরাহনগর/ কাশিপুরের শয়ে শয়ে লরি বোঝাই আমাদের সাথীদের আত্মীয় স্বজন শব গঙ্গায় ফেলা হয়। যার হাত আমাদের হাজার হাজার সাথীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। তাছাড়া  যে গান্ধী পরিবার সারা দেশেকে জেল বানিয়ে ছেড়েছিল, বিরুদ্ধ মতামত কে স্তব্ধ করে ভারতবাসী কে ক্রীতদাস বানাতে চেয়েছিল তাদের পরাজয় আমাদের মধ্যে আনন্দের বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল।
--
সারা রাত জেগে হৈচৈ চলল, চা খাওয়া চলল। পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হল। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারের অন্যত্তম মূল ঘোষনা ছিল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস বিরোধী সর্বদল মোর্চার  ইস্তেহারেও সেই ঘোষণা ছিল।  কেন্দ্রে মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে সেই কংগ্রেস বিরোধী জনতা দল ক্ষমতায় আসে।  
শুরু হয় রাজনৌতিক বন্দীদের মুক্তি।
-
জেনানা ফাটক থেকে প্রথমে শুভা, সাথী, গৌরী একে একে মুক্তি পেল। তারপর মাসিমা আর বুলুর  মুক্তির অর্ডার এল। ছল ছল চোখে বিদায় নিয়ে ভাটি ঘর পর্যন্ত্য গিয়েও মাসিমার পা আটকে গেল, কিছু যেন বাদ থেকে গেল। মীনাক্ষী আমাকে মাসিমার কাছে ঠেলে দিয়ে বলল, " যাও মাসিমার আল্লাদী তোমাকে কিছু না বললে তাঁর পা ওখানেই আটকে থাকবে।" আমি আর একটু কাছে গেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, মাসিমা বুলুর সাথে এগিয়ে গেল।
--
এরপর এল আমার আর মলয়ার মুক্তির পরোয়ানা। তখন আমরা সবাই এক জায়গায় বসে ছিলাম। আমি আর মীনাক্ষী পাশাপাশি বসেছিলাম। এদের সবাইকে ফেলে যেতে হবে। মীনাক্ষীর কোলে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। সবাই ঘিরে ধরে আমাকে শান্ত করার চেস্টা করছে। আর মলয়া বলে যাচ্ছে," ও রীতা কাঁদিস না, কাঁদিস না। আমাকে ও ছেড়ে দেবে শিগগিরই।" সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে, বলল, " তাকাচ্ছিস কেন, দেখছিসনা আমার ছাড়ার অর্ডার না আসার জন্য ও কাঁদছে।" খুকু বলে উঠল, "কি যে বলিস, তোর আর ওর অর্ডার তো একসাথে ই এসেছে।" সব কান্না এক বিশাল হাসিতে ভরে উঠল। কল্পনা বলল," বাইরে গিয়ে এক অন্য জগতে পড়বি , শুধু মনে রাখিস এডজাস্টমেন্ট শব্দটা।" সাবায়ের কাছ থেকে হাসি/ কান্নায় বিদায় নিয়ে অফিসে এলাম। আমি মলয়া কে বললাম, "আমি তো এদিকটা চিনতে পারবোনা।" ওর বাড়ী ছিল চেতলা। অভয় দিয়ে বলল, "আরে আমার বাড়ী তো  কাছেই, ভাইকে দিয়ে তোকে পৌঁছে দেবো।
--
অফিস থেকে বেরিয়ে জেলের কাঁটার তার নিয়ে ঘেরা শেষ চত্বরের গেটে দেখি সজল নয়নে দাঁড়িয়ে আছে মা, 'আমার মা।' শেষ হল আমার জেল জীবনের সারে ৪বছর। 
এরপর প্রথমে মীনাক্ষী, রাজশ্রী ,তারপর কল্পনা, শেষে খুকু মিতা সবাই  ছাড়া পেল ১৯৭৭ সালে ই।
*********************************************************************************   (চলবে )



























No comments:

Post a Comment